পুঁইমাচা : বিভূতিভূষণের প্রকৃতিচেতনার ক্ষেত্র


পুঁইমাচা : বিভূতিভূষণের প্রকৃতিচেতনার ক্ষেত্র


বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সহজ সরল জীবনের রূপকার। কল্লোল-এর সময়ে আবির্ভূত হয়েও কল্লোলকেন্দ্রিক লেখক না হয়ে নিজস্ব ব্যানধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি লিখতে শুরু করেন। সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ, আশা-থাকাম্বার কথা শুনিয়েছেন তিনি। তাঁর গল্প উপন্যাসে। তারাশংকর ও মানিকের মতো মানুষের আদিম অনার্জিত চেহারা. মানুষের মনের গোপন জটিল অন্তাপুরের রহস্যকে তাঁর গল্পে ও উপন্যাসে তিনি দে নি। প্রকৃতি এবং মানুষই ছিল তাঁর গল্পের প্রধান বিষয়। বাংলাসাহিত্যে বিভূতিভূষণের আবির্ভাব এবং প্রকৃতিচেতনার ক্ষেত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরী। সাধারণ মানুষের সুখদুঃখের অনুভূতির সঙ্গে বিভূতিভূষণের প্রকৃতিচেতনা একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছেন — “ একমাত্র প্রকৃতিকে অবলম্বন করে তিনি কখনো কোনো এ লেখেননি – প্রকৃতি যখনই আবির্ভূত হয়েছে ছোটগল্পের বদনাকে তখনই তাঁর সঙ্গে এসে দেখা দিয়েছে মানুষ কিংবা মানুষের উপাস্য "দেবা।" (গল্প সংগ্রহের ভূমিকা জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) নাগরিক জীবনের চিত্রাঙ্গনে বিভূতিভূষণের অনীহা ছিল। তাই তিনি প্রানাপ্রকৃতির এবং সেখানকার মানুষের সুখদুখে আনন্দ বেদনার চিত্র অংকন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। জীবনের সংগে জীবনের সংযোগ ঘটিয়েই তিনি তাঁর গল্পগুলি লিখেছেন। প্রতিদিনের দেখা মানুষগুলির কথা সহজ সরলভাবে স্থান পেয়েছে তার বলে। শ্রদ্ধের সমালোচক প্রাণ নাথ বিশীর মস্তক। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে – “মানুষের প্রাতাহিক জীবনে ছোটখাটো সুখদাখের যে লালাচাঞ্চলা আছে, সুখের ভিতরে যে দুঃখের আভাস আছে, দুঃখের মধ্যেও যে মানদের ইংগিত আছে। বিভূতিভূষণ সাহিত্যরচনার জন্য সেগুলিকেই আশ্রয় করিয়াছেন, চাবনাড়ম্বর তার সাহিত্যের উপজীব্য নয়।” (শ্রেষ্ঠ গল্পের ভূমিকা, পৃঃ ৩)

'পুঁইমাচা' গল্পটি বিভুতিভূষণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি গল্পের মধ্যে পড়ে। গল্পটির বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করার মত। ড. সুকুমার সেন বলেছেন 'পুঁইমাচা গল্পটিতে বিভূতিভূষণের 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসের বীজ নিহিত ছিল।' 'পুঁইমাচা' গল্পটি ১৩৩১ সালের মাথ সংখার প্রবাসী পরিবার প্রকাশিত হয়। নেল্লোর' গল্পগ্রন্থের একটি গল্প পচা'। 'পথের পাঁচালী'র প্রথম লেখা শুরু পুঁইমাচা' বক্সটি প্রকাশের পরে ১৭ই বৈশাখ ১৩৩২- এ। এর থেকে জানতে পারা যায় যে পইমাচা' গল্পটি 'পথের পাঁচালী'র পূর্ববর্তী রচনা। এই গল্পের প্রধান চরিত্র কন্তি পথের পাঁচালী'র কিশোরী দুর্গা। পুঁইমাচা'র সময়হরি অন্নপূর্ণা 'পথের পাঁচালী'র হরিহর, সর্বজয়া ছাড়া আর কী হতে পারে! 'পথের পাঁচালী'র নারিদ্র্যপীড়িত পিতামাতার প্রথম সন্তান দর্ণার মৃত্যু হয়েছিল হরিহরের অনুপস্থিতিতে নিজের বাড়ীতে এক দুর্যোগের রাতে মার এইমাচা'র বিবাহিত করি মৃত্যু হয়েছিল অবহেলার অাদরে বসন্তরোগে তার শ্বশুর বাড়ীতে। মনে রাখতে হবে 'পুঁইমাচা' ছোটগল্প তার 'পথের পাঁচালী' উপন্যাস। তাই উপন্যাস ও ছোটগল্পের মৌলধর্ম আলাদা। তারই প্রেক্ষাপটে 'পুঁইমাচা' গল্পটি একটি আলাদা মর্যাদা পায়। প্রকৃতি এবং মানুষের স্থান এ গল্পে যুগপৎ লক্ষিত হয়।।

'পুঁইমাচা' গল্পের বিষয়বস্তু অতি সাধারণ। কাহিনীর মধ্যে কোনো চনক নেই। এক দরিদ্র পরিবারের কৃচ্ছ্রসাধনের আটপৌরে কাহিনী। দারিদ্রোর অসহনীয় পীড়ন আর প্রকৃতির স্নেহস্পর্শে লালিত পরিবারের সরলা কিশোরী ক্ষেত্তি এ গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। ক্ষেন্তি গল্পের গতিকে ত্বরান্বিত করেছে। ক্ষেত্তি ভোজন প্রিয় এবং লোভী স্বভাবের। বাড়ীতে তাদের ভালো খাবার জোটে না। চোদ্দ পনের বছর বয়স ক্ষেত্তির। তার বিয়ের বয়স উত্তীর্ণ। গানের লোকেরা তাই বলে। দরিদ্র সহায়হরি ক্ষেত্তির বিয়ের ব্যবস্থা করতে না পারায় গ্রামের চৌধুরীদের চণ্ডীমন্ডপে কালীনর চৌধুরীরা সহায়হরির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। কিন্তু ক্ষেন্তি তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যে ছোট দুটি বোনকে সঙ্গে নিয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। একদিন ক্ষেত্তি অন্যের ফেলে দেওয়া পাকা পুইড়াটা নিয়ে বাড়ীতে ঢোকে। পেছনে দুটি বোনের একটির হাতে পাতায় মোড়া কুচো চিংড়ি যা গরাপিসির কাছ থেকে ধারে কেনা। হলদে পুইগাছ দেখে না অন্নপূর্ণা ভীষণ রেগে যায়। সেগুলো বাইরে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। মায়ের অগ্নিমূর্তি দেখে তিন বোন ভয় পায়। পুঁইগাছগুলো টানতে টানতে বাইরে ফেলে দিয়ে আসে। কিন্তু অন্নপূর্ণা পরে ঘটনাটির কথা স্মরণ করে নির্বোধ শান্ত ক্ষেন্তির কথা ভেবে কষ্ট পান। তাই সবার অলক্ষ্যে আবর্জনা থেকে পুঁইডাটাগুলি কুড়িয়ে এনে তরকারি রান্না করে মেয়েদের পাতে তুলে দেয়। ক্ষেত্তি ওইডাটার তরকারি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে। অন্নপূর্ণা ক্ষেন্তিকে আরো তরকারি দেওয়ার ক্ষেন্তি আনন্দ চেপে রাখতে পারে না। অন্নপূর্ণার মাতৃহৃদয়ও আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে।

এর পরের ঘটনা মর্মান্তিক। প্রথমবার ক্ষেত্তির বিয়ের সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল কিন্তু পাত্রের চরিত্রগত দোষের জন্য সে বিয়ে ভেঙে যায়, ফলে সহায়হরি আর দেরি না করে অপবাদের ভয়ে চল্লিশ বছরের এক দোজবরে পাত্রের সঙ্গে ক্ষেন্তির বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই বসন্তরোগে ক্ষেতির মৃত্যু হয়। পণের টাকা বাকী ছিল তাই ক্ষেন্তিকে সহায়হরি আনতে গেলেও শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা তাকে পাঠায় নি। অবহেলা আর ভালোবাসার অভাবে ক্ষেন্তির মৃত্যু সহায়হার অন্নপূর্ণা মেনে নিতে পারে নি। কয়েকমাস পরে পৌষ সংক্রান্তি ফিরে আসে। গত পৌষসংক্রান্তির দিনে অন্নপূর্ণা পিঠে তৈরি করে পুঁটি রাধীর সঙ্গে ক্ষেন্তিকে খেতে দিয়েছে কিন্তু এ বছর তার আদরের ক্ষেন্তি নেই। পিঠে তৈরির আনুষঙ্গিক কাজ এবং পিঠে ভাজা শেষ হয়ে গেলে ক্ষেন্তির কথা মনে পড়ে অন্নপূর্ণার। পৌষপার্বনের জ্যোৎস্নারাত্রে মা অন্নপূর্ণা, পিতা সহায়হরি এবং ছোটবোন পুঁটি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ক্ষেন্তির নিজের হাতে পোঁতা নধর এবং পরিপুষ্ট পুইগাছটির দিকে। গল্পটি শেষ হয়েছে এক অপরূপ রীতিতে যেখানে বিভূতিভূষণের প্রকৃতিচেতনা স্পষ্ট প্রতীয়মান— তিনজনেরই দৃষ্টি কেমন করিয়া আপনা আপনি উঠোনের এক কোণে আবদ্ধ হইয়া পড়িল .... সেখানে বাড়ির সেই লোভী মেয়েটির লোভের স্মৃতি পাতায় পাতায় শিরায় শিরায় জড়াইয়া তাহার কত সাধের নিজের হাতে পোঁতা পুঁই গাছটি মাচা জুড়িয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে.... বর্ষার জল ও কার্তিক মাসের শিশির লইয়া কচি কচি সবুজ ডালগুলি নাচাতে সব ধরে নাই, মাচা হইতে বাহির হইয়া দুলিতেছে সুপষ্ট, নধর প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরপুর।' বিভূতিভূষণ তাঁর রচনার মধ্যে সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র জীবনের সুখ দুঃখ ও বিরহ মিলনপূর্ব ছবি এঁকেছেন। এদিক দিয়ে মানবদরদী সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর তুলনা চলে। কিন্তু শরৎচন্দ্রের সঙ্গে বিভূতিভূষণের রচনার পার্থক্য হল এই যে বিভূতিভূষণের রচনায় মানুষের ক্ষুদ্র জীবনের সীমা অতিক্রম করে যে বৃহত্তর জগতের সংকেতময় ব্যঞ্জনা ধ্বনিত হয় শরৎচন্দ্রের রচনায় তার পরিচয় মেলে না। বিভূতিভূষণের অপ দৈনন্দিন ঘটনাবহুল জগতের অন্তরালে সবসময় এক বৃহত্তর অনাবিষ্কৃত জগতের সন্ধান করে ফিরেছে। তার কাছে বাস্তব জীবন এই বৃহত্তর অনাবিষ্কৃতেরই প্রতীকস্বরূপ।

বিভূতিভূষণের ছোটগল্পে সাধারণ মানুষের সমাবেশ ঘটেছে। অজস্র তুচ্ছ গ্রামীণ মানুষের সুখদুঃখ আশা আকাঙ্খার অসংখ্য ছবি লেখকের চোখে পড়েছে তাঁর চলার পথের দুধারে। সেই সব বর্ণবিরল নিতান্ত অনভিজ্ঞাত ছবিগুলি হয়ে উঠেছে অপূর্ব। লেখকের সার্থক গল্পগুলি জীবনের যে গূঢ় পরিচয় বা রসসৌন্দর্যের সংকেত বহন করুক না কেন তাদের বাস্তবতা, ঘটনায়, চরিত্রে, সংলাপে, পরিবেশে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। 'পুঁইমাচা' গল্পে কতকগুলি চরিত্র আছে। চরিত্রগুলি নিতান্তই সাদামাটা সেরকম কোন জৌলুস নেই, চাকচিকাও নেই। ক্ষেন্তি, সহায়হরি, অন্নপূর্ণা এগুলি প্রধান চরিত্র। এদের পাশাপাশি এসেছে কালীময় চৌধুরী, বিষ্ণু সরকার এবং ক্ষেত্তির দুই বোন পুঁটি ও রাধী।


 

Post a Comment

0 Comments