তারিণী মাঝি : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়


তারিণী মাঝি  : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়


‘তারিণী মাঝি' গল্পে তারিণী ময়ূরাক্ষী নদীর গনুটিয়া ঘাটের খেয়া পারাপারের মাঝি কালাচাঁদ তার সঙ্গী। নদীর সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক। ময়ুরাক্ষী সারা বছর জনহীন ধু ধু বালি নিয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু বর্ষার জলে সে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। সেই বর্ষার দিনে উত্তাল নদীতে তারিণী নৌকা পারাপার করে। শুধু তাই নয় নিমজ্জমান ব্যক্তিকে খরস্রোতা ময়ুরাক্ষীর বুক থেকে সে নিমেষে উদ্ধার করে আনে। এ ভাবেই ঘোষমশায়ের পুত্রবধূকে সে ময়ুরাক্ষী থেকে উদ্ধার করে, আর তার বিনিময়ে সে টাকা পায়, ফাঁদি নথ আর একখানি শাড়ী। তারিণী তার নিঃসন্তান স্ত্রীকে উপহার দেয়। সুখীকে সে খুশী করে, সুখী খুশী হয়। এভাবেই তাদের দিন কাটছিল। সংসারে সুখীই তার একমাত্র আপনজন । রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্যে তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। বাংলা ছোটগল্পেও এঁদের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত। এঁদের মধ্যে তারাশঙ্কর বয়সের দিক থেকে বড়। তারাশঙ্কর কল্লোলগোষ্ঠীর গল্পকারদের সমসাময়িক হলেও কল্লোলপন্থী নন, কল্লোল আন্দোলনের নাগরিক জীবনবোধ কখনোই তাঁকে আকৃষ্ট করেনি। তিনি গ্রামজীবনের চেনা জগতে জাগিয়ে তুলেছেন চিরন্তনকে। যে মানুষের কথা তিনি বলেছেন তারা এক বিশেষ অঞ্চলের মানুষ একথা সত্য, তবে তাদের মানবিক আবেদন সর্বব্যাপী। বাংলা ছোটগল্পে তারাশঙ্কর সম্ভবত সর্বপ্রথম মাটি এবং আদিম প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত অমার্জিত মানুষের জীবন কাহিনী এঁকেছিলেন। তারাশঙ্কর আপন স্বাতন্ত্রে মানবজীবন নিয়ে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। ওই পরীক্ষায় তাঁর বিশ্বাস বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। অশিক্ষিত, অমার্জিত, আদিম জৈব-কামনা-বাসনায় পরিবৃত জীবনের পরিচয় মেলে তাঁর গল্পে। ‘তারিণী মাঝি' গল্পটি সেই জীবন ভাবনারই পরিচয় তুলে ধরে।

‘তারিণী মাঝি' গল্পটি তারাশঙ্করের এক অনবদ্য সৃষ্টি। এ গল্পের পটভূমিকা এবং প্রধান চরিত্র তারাশঙ্করের একেবারে চেনা ও জানা। আবাল্য পরিচিত তিনি এই পটভূমি ও চরিত্রগুলির সঙ্গে। তাই ময়ূরাক্ষীর খেয়াঘাটের মাঝি তারিণীর জীবন রহস্যের চিত্র লেখক সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। অমোঘ নিয়তির কাছে মানুষ যে কত অসহায় সেই অসহায়তার ছবি ফুটে উঠেছে তারিণী চরিত্রে। ময়ুরাক্ষী বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময় শুষ্ক থাকে। তখন তারিণীর কোন কাজ থাকে না। তারিণীর অভাবের সংসারে দুর্যোগ নেমে আসে। বর্ষার ভরা ময়ুরাক্ষীর রূপ দেখে তারিণীর বুকও ভরে ওঠে। কিন্তু দীর্ঘদিনের অনাবৃষ্টিতে দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। দলে দলে মানুষ ছোটে শহরের দিকে খাদ্যের সন্ধানে। সুখীর হাত ধরে তারিণীও শহরমুখী হতে চায়। কিন্তু আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞ তারিণী মাঝি গ্রামে ফেরে। ময়ুরাক্ষী নদীতে ভয়ঙ্কর বন্যা দেখা দেয়। ময়ুরাক্ষী বন্যায় খলখল করে হেসে ওঠে। বেরিয়ে পড়ে সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। তারিণীত সুর্গাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। রাতের অন্ধকারে পথ ভুল করে খরস্রোতা ময়ূরাক্ষীতে এসে পড়ে তারিণী। সুখীকে কারে নিয়ে কলে ভাসে। কিন্তু অকস্মাৎ নরুরাক্ষীর প্রবল স্রোতে সে পড়ে যায়। হলের প্রবল স্রোতের ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে দুজনেই অতল জলে যেন তলিয়ে যেতে থাকে। এই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে সুখীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে তারিণী। একসময় সুখার ভেসে থাকার ক্ষমতা কমে আসে। তারিণী এই বিপদ থেকে বাচার চেষ্টা করে। সুখী তারিণীর কোন জড়িয়ে ধরে থাকে দৃঢ়ভাবে। ধীরে ধীরে তার হাত তারিণীকে নাগপাশের মত আঁকড়ে ধরতে চায়। এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে সুখাকে ছেড়ে না দিলে তারিণীর বাঁচাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। সুখীকে বিসর্জন দিয়েই তাঁর বাঁচা সম্ভবপর। শেষ পর্যন্ত তারিণী তাই করে। যন্ত্রণায় তারিণী হল খানচাইয়া ধরিতে লাগিল। পরমুহূর্তে হাত পড়িল সুখীর গলায়। দুই হাত প্রবল আক্রোশে সে সুখীর গলা সেমন করিয়া ধরিল। সে কি তাহার উন্মত্ত ভীষণ আক্রোশ। হাতের মুঠিতেই তাহার সমস্ত শক্তি পুঞ্জিত হইয়া উঠিয়াছে। যে বিপুল ভারটা পাথরের নত টানে তাহাকে অতলে টানিয়া লইয়া চালিয়াছিল, সেটা থামিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে জলের উপরে ভাসিয়া উঠিল। এভাবেই তারিণী মাঝি নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। গল্পের শেষ এখানেই।

গল্পে প্রধান চরিত্র দুটি তারিণী : তার স্ত্রী সুখী। কিন্তু ওদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মরুরাক্ষী। কাহিনীতে নয়ুরাক্ষীর একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। ময়ুরাক্ষী নদীই তারিণী ——সুখীর জীবনচক্র রচনা করেছে, কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। গল্পটি পড়ে আমরা জানতে পারি। লেখক নরুরাক্ষী নদীর গুনুটিয়া ঘাটের মাঝি তারিণীর সঙ্গে ময়ূরাক্ষীর একটা অভেদ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন। একসময় মনে হয়েছে তারিণী ছাড়া ময়ুরাক্ষীর কোন অস্তিত্ব নেই সেরকম নয়ূরাক্ষী ছাড়া তারিণীরও যেন কোন অস্তিত্ব নেই। দুজনেই দুই ভিন্ন মেরুবাসী। তরও গল্পের কাহিনী গ্রন্থনে নয়ূরাক্ষীর ভূমিকাকে কোনমতেই অস্বীকার করার উপায় নেই।

ময়ূরাক্ষী নদী এ গল্পের পটভূমি। তারিণী গনুটিয়া ঘাটের মাঝি। সে নিঃসন্তান। ঘরে তার স্ত্রী সুখী। সুখীকে নিয়েই তার সুখ, তার শান্তি। তারিণীর জীবনে নয়ূরাক্ষী আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। ময়ূরাক্ষী আছে বলেই যেন তারিণী আছে আর তারিণী ছাড়া যেন নয়ূরাক্ষী স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ময়ুরাক্ষী তাকে খাওয়ায়, পরায়, বাঁচায়। ময়ূরাক্ষীই তারিণীকে স্বপ্ন দেখাতে শেখায়। তাই নয়ুরাক্ষীর নাড়ীনক্ষত্র তারিণীর জানা। যেমন জানে সমরেশ বসুর 'গঙ্গা' উপন্যাসের বিলাস। নয়ূরাক্ষী কখনও ভয়ঙ্করী, কখনও সে শান্ত, তার ভয়ঙ্কর রূপের বর্ণনা দিয়েছেন লেখক: বর্ষার প্রারম্ভে সে রাক্ষসীর মত ভয়ঙ্করী। দুই পার্শ্বে চার-পাঁচ মাইল গাঢ় পিঙ্গলবর্ণ জলস্রোতে পরিব্যাপ্ত করিয়া বিপুল স্রোতে সে তখন ছুটিয়া চলে। আবার কখনও হড়পা বাণ, ছয়-সাত হাত উচ্চ জলস্রোত সম্মুখের বাড়ি-ঘর ক্ষেত খামার গ্রামের পর গ্রাম নিঃশেষে ধুইয়া মুছিয়া দিয়া সমস্ত দেশটাকে প্লাবিত করিয়া দিয়া যায়।' আবার তার বিপরীত চিত্রও লেখক দিয়েছেন। 'বারো মাসের মধ্যে সাত-আট মাস ময়ূরাক্ষী এক মাইল প্রশস্ত বালুকা রাশি ধু ধু করে। জলহীন নয়ূরাক্ষীর বালুকাময় গর্ভ গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্ ঝিকমিক করিতেছিল।' নয়ূরাক্ষীর ভয়ঙ্করী মূর্তি দেখে পটিয়ার মানুষেরা ভয় পায়, তারিণী সুখীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ভয় কি তোর, আমি সঙ্গে রইছি।' তারিণীর অগাধ বিশ্বাস ময়ূরাক্ষীকে ---মায়ের বুকে কি ভয় থাকে।' কিন্তু সেই নয়ূরাক্ষীই একসময় ভয়ঙ্করী হয়ে ওঠে। হড়পা বাণ' আসে প্রকৃতির নিয়নে। রাক্ষসী মূর্তিতে ময়ূরাক্ষী ফুলে ফেঁপে ওঠে। একটু একটু করে বাণের জল বাড়তে থাকে। তারিণী বিপদ গনে। ময়ূরাক্ষীকে দেখে তারিণীর বুক কেঁপে ওঠে। তারিণী চাঁৎকার করে বলে ওঠে আমার কোমর ধর সুখী। গতিক ভাল লয়।' তারিণীর চোখে জল। ভুল বাড়ে ময়ূরাক্ষীর। সে বাঁচাতে চায় সুখীকে, সুখীও বাঁচতে চায়। তারিণী সুখীকে নিয়ে অনিবার্য মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকে। সেই মুহূর্তে যেন তারিণী শুনতে পায় সুখীর কণ্ঠস্বর: 'তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই গো। তারিণীর অন্তরাত্মা সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেয়, সুখী তুই ছাড়া আনারও কেউ নেই রে।' ময়ুরাক্ষীতে যেমন বাণ আসে সেরকম বাণের পরে যারা বেঁচে থাকে তারা সুখে থাকে শান্তিতে থাকে। ওই ময়ূরাক্ষী যেমন একদিকে মানুষের জীবনে ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনে সেরকম তাদের জীবনে সুখ সমৃদ্ধিও এনে দেয়। লেখক বলেছেন— নয়ুরাক্ষীর পলিতে সোনা ফলে'। অরিণীকে বলতে শুনি- 'বাণের লেগে পুজো দেয়। এই নায়ের কিপাতেই এ মলুকের লক্ষ্মী।' ময়ূরাক্ষীই তারিণী মাঝির জীবনে এনে দিয়েছে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য। নয়ুরাক্ষীকে ছাড়া তারিণীর যেমন চলে না সেরকম তারিণীর পেশাগত ভাবনার দিক দিয়ে তো নয়ুরাক্ষী স্পষ্টরূপে প্রকাশ পায়।

'অরিণী মাঝি' গল্পের প্রধান চরিত্র তারিণী। তারিণী দীর্ঘদেহী নিঃসন্তান। সুখীকে নিয়ে তার সংসার। দুঃখ-কষ্টের। খেয়া পারাপার করে সে দিনাতিপাত করে। গণটিয়া ঘাটের মাঝি সে। যখন ময়ূরাক্ষীতে জল থাকে না তখনই তার বিপদ। খেয়া পারাপার বন্ধ। ফলে দুঃখের সংসারে দুর্যোগ নেমে আসে। তারিণী ভাঙে কিন্তু মচকায় না। এটাই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তারিণীর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হল পরোপকার করা। মানুষের সুখে দুঃখে তারিণী মানবিক মূল্যবোধ থেকে এগিয়ে আসে। খরস্রোতা নদীতে ঝাঁপি দিয়ে ডুবন্ত ঘোলনশারেরর পুত্রবধূকে তুলে এনে সে শুধু তার কর্তব্যপালন করেছে। বিনিময়ে ঘোষনশায় অনেক কিছু দিতে চাইলেও তারিণী শুধু এক হাঁড়ি নদের দান আট আনাই চেয়ে বসে। কিন্তু পরক্ষণেই সুখীর কথা মনে হওয়ায় তার জন্য চেয়ে নিয়েছে একটি ফাঁদি নত। কাঁদি নত দিয়ে সে সখীকে চমক দেবে। তারিণী একসময় বলে, 'পেটের ভাত ঐ নয়ূরাক্ষীর দৌলতে। তখন নয়ুরাক্ষীর প্রতি তারিণীর অগাধ শ্রদ্ধা ভক্তি প্রচ্ছন্নভাবে বেরিয়ে আসে। দশহরার দিন নয়ূরাক্ষীর পূজাও তারিণী করে। তারিণী পূজো করে ময়ূরাক্ষীকে দুটি বিষয় মাথায় রেখে। প্রথমটি হল— নয়ুরাক্ষীর জলপ্রবাহের মত তার জীবনের প্রবাহও বয়ে চলবে স্বচ্ছন্দ গতিতে। দ্বিতীয়টি হল পূজো করলে ময়ুরাক্ষীতে বাণ আসবে। বাণ হলে পলি পড়বে আর সেই পলিতে সোনা কলাবে। ময়ূরাক্ষীর পলিতে দেশে সোনা ফলে। অরিণী চায় নয়ূরাক্ষী জলভাবে ফুলে ফেঁপে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। তারিণীত সুর্গাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। রাতের অন্ধকারে পথ ভুল করে খরস্রোতা ময়ূরাক্ষীতে এসে পড়ে তারিণী। সুখীকে কারে নিয়ে কলে ভাসে। কিন্তু অকস্মাৎ নরুরাক্ষীর প্রবল স্রোতে সে পড়ে যায়। হলের প্রবল স্রোতের ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে দুজনেই অতল জলে যেন তলিয়ে যেতে থাকে। এই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে সুখীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে তারিণী। একসময় সুখার ভেসে থাকার ক্ষমতা কমে আসে। তারিণী এই বিপদ থেকে বাচার চেষ্টা করে। সুখী তারিণীর কোন জড়িয়ে ধরে থাকে দৃঢ়ভাবে। ধীরে ধীরে তার হাত তারিণীকে নাগপাশের মত আঁকড়ে  ধরতে চায়। এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে সুখাকে ছেড়ে না দিলে তারিণীর বাঁচাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। সুখীকে বিসর্জন দিয়েই তাঁর বাঁচা সম্ভবপর। শেষ পর্যন্ত তারিণী তাই করে। যন্ত্রণায় তারিণী হল খানচাইয়া ধরিতে লাগিল। পরমুহূর্তে হাত পড়িল সুখীর গলায়। দুই হাত প্রবল আক্রোশে সে সুখীর গলা সেমন করিয়া ধরিল। সে কি তাহার উন্মত্ত ভীষণ আক্রোশ। হাতের মুঠিতেই তাহার সমস্ত শক্তি পুঞ্জিত হইয়া উঠিয়াছে। যে বিপুল ভারটা পাথরের নত টানে তাহাকে অতলে টানিয়া লইয়া চালিয়াছিল, সেটা থামিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে জলের উপরে ভাসিয়া উঠিল। এভাবেই তারিণী মাঝি নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। গল্পের শেষ এখানেই।

গল্পে প্রধান চরিত্র দুটি তারিণী : তার স্ত্রী সুখী। কিন্তু ওদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মরুরাক্ষী। কাহিনীতে নয়ুরাক্ষীর একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। ময়ুরাক্ষী নদীই তারিণী ——সুখীর জীবনচক্র রচনা করেছে, কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। গল্পটি পড়ে আমরা জানতে পারি। লেখক নরুরাক্ষী নদীর গুনুটিয়া ঘাটের মাঝি তারিণীর সঙ্গে ময়ূরাক্ষীর একটা অভেদ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন। একসময় মনে হয়েছে তারিণী ছাড়া ময়ুরাক্ষীর কোন অস্তিত্ব নেই সেরকম নয়ূরাক্ষী ছাড়া তারিণীরও যেন কোন অস্তিত্ব নেই। দুজনেই দুই ভিন্ন মেরুবাসী। তরও গল্পের কাহিনী গ্রন্থনে নয়ূরাক্ষীর ভূমিকাকে কোনমতেই অস্বীকার করার উপায় নেই। ময়ূরাক্ষী নদী এ গল্পের পটভূমি। তারিণী গনুটিয়া ঘাটের মাঝি। সে নিঃসন্তান। ঘরে তার স্ত্রী সুখী। সুখীকে নিয়েই তার সুখ, তার শান্তি। তারিণীর জীবনে নয়ূরাক্ষী আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। ময়ূরাক্ষী আছে বলেই যেন তারিণী আছে আর তারিণী ছাড়া যেন নয়ূরাক্ষী স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ময়ুরাক্ষী তাকে খাওয়ায়, পরায়, বাঁচায়। ময়ূরাক্ষীই তারিণীকে স্বপ্ন দেখাতে শেখায়। তাই নয়ুরাক্ষীর নাড়ীনক্ষত্র তারিণীর জানা। যেমন জানে সমরেশ বসুর 'গঙ্গা' উপন্যাসের বিলাস। নয়ূরাক্ষী কখনও ভয়ঙ্করী, কখনও সে শান্ত, তার ভয়ঙ্কর রূপের বর্ণনা দিয়েছেন লেখক: বর্ষার প্রারম্ভে সে রাক্ষসীর মত ভয়ঙ্করী। দুই পার্শ্বে চার-পাঁচ মাইল গাঢ় পিঙ্গলবর্ণ জলস্রোতে পরিব্যাপ্ত করিয়া বিপুল স্রোতে সে তখন ছুটিয়া চলে। আবার কখনও হড়পা বাণ, ছয়-সাত হাত উচ্চ জলস্রোত সম্মুখের বাড়ি-ঘর ক্ষেত খামার গ্রামের পর গ্রাম নিঃশেষে ধুইয়া মুছিয়া দিয়া সমস্ত দেশটাকে প্লাবিত করিয়া দিয়া যায়।' আবার তার বিপরীত চিত্রও লেখক দিয়েছেন। 'বারো মাসের মধ্যে সাত-আট মাস ময়ূরাক্ষী এক মাইল প্রশস্ত বালুকা রাশি ধু ধু করে। জলহীন নয়ূরাক্ষীর বালুকাময় গর্ভ গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্ ঝিকমিক করিতেছিল।' নয়ূরাক্ষীর ভয়ঙ্করী মূর্তি দেখে পটিয়ার মানুষেরা ভয় পায়, তারিণী সুখীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ভয় কি তোর, আমি সঙ্গে রইছি।' তারিণীর অগাধ বিশ্বাস ময়ূরাক্ষীকে ---মায়ের বুকে কি ভয় থাকে।'

কিন্তু সেই নয়ূরাক্ষীই একসময় ভয়ঙ্করী হয়ে ওঠে। হড়পা বাণ' আসে প্রকৃতির নিয়নে। রাক্ষসী মূর্তিতে ময়ূরাক্ষী ফুলে ফেঁপে ওঠে। একটু একটু করে বাণের জল বাড়তে থাকে। তারিণী বিপদ গনে। ময়ূরাক্ষীকে দেখে তারিণীর বুক কেঁপে ওঠে। তারিণী চাঁৎকার করে বলে ওঠে আমার কোমর ধর সুখী। গতিক ভাল লয়।' তারিণীর চোখে জল। ভুল বাড়ে ময়ূরাক্ষীর। সে বাঁচাতে চায় সুখীকে, সুখীও বাঁচতে চায়। তারিণী সুখীকে নিয়ে অনিবার্য মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকে। সেই মুহূর্তে যেন তারিণী শুনতে পায় সুখীর কণ্ঠস্বর: 'তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই গো। তারিণীর অন্তরাত্মা সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেয়, সুখী তুই ছাড়া আনারও কেউ নেই রে।' ময়ুরাক্ষীতে যেমন বাণ আসে সেরকম বাণের পরে যারা বেঁচে থাকে তারা সুখে থাকে শান্তিতে থাকে। ওই ময়ূরাক্ষী যেমন একদিকে মানুষের জীবনে ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনে সেরকম তাদের জীবনে সুখ সমৃদ্ধিও এনে দেয়। লেখক বলেছেন— নয়ুরাক্ষীর পলিতে সোনা ফলে'। অরিণীকে বলতে শুনি- 'বাণের লেগে পুজো দেয়। এই নায়ের কিপাতেই এ মলুকের লক্ষ্মী।' ময়ূরাক্ষীই তারিণী মাঝির জীবনে এনে দিয়েছে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য। নয়ুরাক্ষীকে ছাড়া তারিণীর যেমন চলে না সেরকম তারিণীর পেশাগত ভাবনার দিক দিয়ে তো নয়ুরাক্ষী স্পষ্টরূপে প্রকাশ পায়। 'অরিণী মাঝি' গল্পের প্রধান চরিত্র তারিণী। তারিণী দীর্ঘদেহী নিঃসন্তান। সুখীকে নিয়ে তার সংসার। দুঃখ-কষ্টের। খেয়া পারাপার করে সে দিনাতিপাত করে। গণটিয়া ঘাটের মাঝি সে। যখন ময়ূরাক্ষীতে জল থাকে না তখনই তার বিপদ। খেয়া পারাপার বন্ধ। ফলে দুঃখের সংসারে দুর্যোগ নেমে আসে। তারিণী ভাঙে কিন্তু মচকায় না। এটাই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।


তারিণীর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হল পরোপকার করা। মানুষের সুখে দুঃখে তারিণী মানবিক মূল্যবোধ থেকে এগিয়ে আসে। খরস্রোতা নদীতে ঝাঁপি দিয়ে ডুবন্ত ঘোলনশারেরর পুত্রবধূকে তুলে এনে সে শুধু তার কর্তব্যপালন করেছে। বিনিময়ে ঘোষনশায় অনেক কিছু দিতে চাইলেও তারিণী শুধু এক হাঁড়ি নদের দান আট আনাই চেয়ে বসে। কিন্তু পরক্ষণেই সুখীর কথা মনে হওয়ায় তার জন্য চেয়ে নিয়েছে একটি ফাঁদি নত। কাঁদি নত দিয়ে সে সখীকে চমক দেবে। তারিণী একসময় বলে, 'পেটের ভাত ঐ নয়ূরাক্ষীর দৌলতে। তখন নয়ুরাক্ষীর প্রতি তারিণীর অগাধ শ্রদ্ধা ভক্তি প্রচ্ছন্নভাবে বেরিয়ে আসে। দশহরার দিন নয়ূরাক্ষীর পূজাও তারিণী করে। তারিণী পূজো করে ময়ূরাক্ষীকে দুটি বিষয় মাথায় রেখে। প্রথমটি হল— নয়ুরাক্ষীর জলপ্রবাহের মত তার জীবনের প্রবাহও বয়ে চলবে স্বচ্ছন্দ গতিতে। দ্বিতীয়টি হল পূজো করলে ময়ুরাক্ষীতে বাণ আসবে। বাণ হলে পলি পড়বে আর সেই পলিতে সোনা কলাবে। ময়ূরাক্ষীর পলিতে দেশে সোনা ফলে। অরিণী চায় নয়ূরাক্ষী জলভাবে ফুলে ফেঁপে উঠুক, পলিমাটিতে সোনার ফসল ফলুক, সারা বছর নদীতে জল থাকুক। জল থাকলে তার মত ভূমিহীন মানুষের রুজি রোজগারের পথ সুগম হবে। তারিণীর চাওয়া-পাওয়া শুধু ওইটুকুই।

তারিণীর দাম্পত্যজীবন সুখের। দুঃখকে দুঃখ বলে সে মনে করেনি। ঘোষমশায়ের পুত্রবধূকে খরস্রোতা নদী থেকে উদ্ধারের কথা শুনে সুখী স্বামীর প্রতি রুষ্ট হয়। সে তা প্রকাশ করতে না পেরে গলায় দড়ি দেওয়ার কথা বলে। এ প্রসঙ্গেই তাদের পারিবারিক সুখ-দুঃখের কথা প্রকাশ পায়। তারপরেই সুখী ‘নত'টা পরে আসে। তারিণী হাঁ করিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল, ভাত খাওয়া তখন বন্ধ হইয়া গিয়াছে।' 'নত’ পরা মুখ দেখে তারিণী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সুখীর দিকে। সুখীর মুখে পুলকের আবেশ ফুটিয়া উঠিল।' শুধু তাই নয়, তাদের সুখের সংসারে যে ভাঙন ধরার কোন সম্ভাবনা নেই সেই প্রত্যয়ে লেখক বলেছেন- সুখীর জন্য তারিণীর সুখের সীমা নেই।

এরপর তারিণীর জীবনের দ্বিতীয় অঙ্ক শুরু। বৃষ্টি নাই, দেশে দুর্ভিক্ষ ঘনিয়ে এলো। তারিণীও অন্যদের মত গ্রাম ছাড়ার কথা ভাবে, একসময় স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। কিন্তু পিঁপড়েদের স্থান বদল এবং কাকদের কুটো মুখে করতে দেখে বৃষ্টির সম্ভাবনা সে অনুমান করে আর শহরমুখী হতে চায় না। 'কাকেরা কুটো তুলছে বাসা সারাবে বলে।' প্রকৃতির এই ইঙ্গিত একমাত্র তারিণীর পক্ষেই বোঝা সম্ভব আর কারো পক্ষে নয়। এখানেই গল্পের ক্লাইম্যাক্স। তারিণী সুখীকে নিয়ে ঘরে ফেরে, শহরে যাওয়ার কথা সে ভাবে না।

তারিণীর জীবনের তৃতীয় অঙ্ক। ময়ুরাক্ষীতে বাণ আসে। ময়ুরাক্ষীর গর্জন, বাতাসের অট্টহাস্য আর বর্ষণের শব্দ লুণ্ঠনকারী ডাকাতের অট্টহাস্য ও চিৎকার যেমন করিয়া ভয়ার্ত গৃহস্থের ক্রন্দন ঢাকিয়া দেয় ঠিক তেমনই ভাবে জল বাড়ে। সুখী ঘর ছাড়তে চায়নি।' তারিণী বলে, ‘বাণ যদি আরও বাড়ে সুখী।' সুখী ভগবানের প্রতি আস্থা হারায় না। ছিষ্টি কি আর লষ্ট করবে ভগবান।' কিন্তু জল আরো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারিণী বলে, 'আমার কোমর ধর সুখী। গতিক ভাল লয়। খরস্রোতা নদীর বুক থেকে ঘোষমশায়ের পুত্রবধূকে যে বাঁচাতে পারে সে নিজের স্ত্রীকে বাঁচাতে পারবে না। নিজের স্ত্রীকে বাঁচানোর দায়িত্ব তো তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সেই কর্তব্যবোধের তাগিদেই সে সুখীতে বাঁচাতে চায়। একটা বোধ তারিণীর মধ্যে কাজকরে। সেই বোধের তাড়নায় তারিণী আর তারিণীর মধ্যে থাকে না। তারিণী বলে, আমার পিঠে চাপ সুখী।' প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে সে সুখীকে বাঁচাতে চায়। এ প্রসঙ্গে সমরেশ বসুর 'পাড়ি' গল্পটির কথা মনে পড়ে। ছ'মাস আগে বিয়ে করা সেই মেয়েটির মত সুখী নয়। সেই মেয়েটি উত্তাল নদীর সঙ্গে লড়াই করে ঊনত্রিশটি জানোয়ারকে পার করিয়ে দেয় তার লোকটির সঙ্গে। কিন্তু সুখী পারে না। না পারার কারণ আছে – -‘পাড়ি' গল্পে জোয়ারের প্রাবল্য আর নয়ুরাক্ষীতে দেখা গেছে হড়পা বাণ' দুয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। ফলে সুখী বেশীক্ষণ বুঝতে পারে না। শরীরও ক্রমশ যেন আড়ষ্ট হইয়া আসিতেছিল। মাঝে মাঝে ময়ুরাক্ষীর তরঙ্গ শ্বাসরোধ করিয়া দেয়। কিন্তু সুখীর হাতের মুঠি কেমন যেন হইয়া আসে যে।'

তারিণীর জীবনের শেষ অঙ্ক। এ দৃশ বড় মর্মান্তিক। তারিণী সুখীকে পিঠে নিয়েই জলে ডুবে গেল। ভেসে উঠতেই পিঠ ছেড়ে তার কোমরের কাপড় ধরে ভেসে থাকার পরামর্শ দেয় তারিণী। কিন্তু তারিণী অনুভব করিল—অতল জলের তলে ঘুরিতে ঘুরিতে তাহারা ডুবিয়া চলিয়াছে। ঘূর্ণিতে পড়িয়াছে তাহারা।’ অনিবার্য মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারিণী ও সুখী। আত্মরক্ষার জন্য কী মর্মান্তিক প্রচেষ্টা। ঘূর্ণির মুখে পড়ে ডুবন্ত মানুষ দুটি বাঁচতে চায়। তারিণী অনুভব করল সুখী তাকে নাগপাশের মত জড়িয়ে ধরেছে। আর তখনই সেই মুহূর্তেই তারিণী নিজেকে বাঁচানোর জন্যে তৎপর হয়ে ওঠে। তারিণীর ব্যক্তিসত্তা তাকে আর এক তারিণীকে রূপান্তরিত করে তোলে। তাই সুখীকে সে ঠেলে দিয়েছে প্রবল ঘূর্ণিস্রোতের মধ্যে। 'যে বিপুল ভারটা পাথরের মতো টানে তাহাকে অতলে টানিয়া লইয়া চলিয়াছিল, সেটা খসিয়া গেল সঙ্গে সঙ্গে সে জলের উপরে ভাসিয়া উঠিল।' তারিনী বুক ভরে বাতাস নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

গল্পটির পরিণতি মর্মান্তিক। নিজের স্ত্রীকে গলা টিপে হত্যা করা নিঃসন্দেহে ঘৃণ্য ব্যাপার কিন্তু এখানে আত্মরক্ষার প্রবল তাগিদের মুখে পড়ে তারিণী তার প্রেম ও মনুষ্যত্বের অবমাননা করেছে। এছাড়া তার আর কীই বা করার ছিল? আত্মরক্ষার অন্ধ তাড়নায় প্রেমের চরম পরাজয় ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য এই গল্পটির মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন আত্মরক্ষার আদিম প্রবৃত্তির হাতে মানুষের প্রেম নির্ভরতার চরম পরাভবের ট্রাজেডিই এ গল্পের উপজীব্য। নিয়তির লীলারহস্য একেবারে অন্তিম মুহূর্তে ঘটনা পরম্পরায় অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে অকস্মাৎ বিদ্যুদ্ধিকাশের মত জীবনসত্যের উন্মেষই ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্য। এদিক দিয়ে ‘তারিণী মাঝি' ছোটগল্পের উৎকৃষ্টতম উদাহরণ।' (পৃ: ১০, শ্রেষ্ঠ গল্পের ভূমিকা) সমরেশ বসুর ‘পাড়ি' গল্পের সেই পুরুষটি এবং মেয়েটি নদীর উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে লড়াই করে ঊনত্রিশটি জানোয়ারকে পার করে দিয়ে নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছে। এ গল্পে মানুষের বেঁচে থাকার চিরন্তন আকাঙ্খাই জয়যুক্ত হয়েছে সেকথা স্পষ্ট করে বলেছেন সমালোচক অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরী——“জীবনসন্ধানী তারাশঙ্কর তাকে অস্বীকার করতে পারেননি, বরং তারিণী মাঝির অতিমানুষিক আত্মক্ষরণের মধ্যে জীবনের জয়ই ঘোষিত হয়েছে বই কি! নিরাবরণ নিরাভরণ সেই জীবনধর্মের জয়। যার জন্য প্রেম, প্রীতি, আত্মত্যাগ ইত্যাদি সকল মহং মূল্যবোধের লালন ও বর্ধন মানুষের ইতিহাসে অনিবার্য হয়ে পড়ে।' (পৃ: ৫৩৬, বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্প ও গল্পকার)।

উদাহরণে ‘প্রবল আক্রোশে এবং ‘গলা পেষণ করা' এগুলি বীভৎস দৃশ্যের ছবি তুলে ধরেছে।

প্রকৃতি বর্ণনা প্রকৃতি বর্ণনায় লেখকের মুন্সীয়ানার পরিচয় মেলে। গল্পটি ময়ুরাক্ষীকেন্দ্রিক। ‘হড়পা বাণ'-এর কথা থাকায় প্রকৃতির রুদ্ররূপের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। যেমন-

ক) ময়ুরাক্ষীর পরিপূর্ণ রূপ। বিস্তৃতি যেন পারাপারহীন। রাঙা জলের মাথায় রাশি রাশি পুঞ্জিত ফেনা ভাসা-ফুলের মত দ্রুত বেগে ছুটিয়া চলিয়াছে।' (পৃ: ৪৬৫, তারাশংকরের গল্পগুচ্ছ ১ম খণ্ড )

খ) ‘গাঢ় গম্ভীর অন্ধকার, কানের পাশ দিয়া বাতাস চলিয়াছে হু হু শব্দে, তাহারই সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে ময়ুরাক্ষীর বাণের হুড়হুড় দুড়দুড় শব্দ।' (পৃ: ৪৬৬ ঐ)

‘ক’ বর্ণনাটিতে ময়ুরাক্ষীর পরিপূর্ণরূপ কিন্তু ‘খ’ বর্ণনায় সেই পরিপূর্ণ রূপের ভযঙ্করতা স্পষ্ট হয় ‘বাণ’ এর 'হুড়হুড় দুড় দুড়' শব্দে। 'ইড়পা বাণ'-এর বর্ণনা আবার কখনও কখনও আসে হড়পা বাণ, ছয় সাত হাত উচ্চ জলস্রোত সম্মুখের বাড়ি-ঘর ক্ষেত-খামার গ্রামের পর গ্রাম নিঃশেষে ধুইয়া মুছিয়া দিয়া সমস্ত দেশটাকে প্লাবিত করিয়া দিয়া যায় ৷” ৫. সমপ্রকার বাক্য প্রয়োগ—-গল্পে তারাশঙ্কর কখনও কখনও সমপ্রকার বাক্যপ্রয়োগ করেছেন।

ক) ‘পেটের ভাত ওই ময়ুরাক্ষীর দৌলতে।' (পৃ: ৪৬০ )

খ) 'ওই ময়ুরাক্ষীর প্রসাদেই তারিণীর অন্নবস্ত্রের অভাব হয় না।' (পৃ: ৪৬১) গ) ‘ঘরের উঠানে এক-কোমর জল।' (পৃ: ৪৬৫)

ঘ) ‘দাওয়ার উপর এক হাঁটু জলে চালের বাঁশ ধরিয়া সুখী দাঁড়াইয়া আছে।' (পৃ: ৪৬৫) ৬. গল্পে সংমিশ্রণ (Composition) - এ গল্পে সংমিশ্রণের পরিচয়ও মেলে। জল- ঝড়-দুর্যোগ-বিদ্যুৎ পরপর এসেছে। একটির সঙ্গে আর একটির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন—

১। আকাশ তখন দুরন্ত দুর্যোগে আচ্ছন্ন ঝড়ের মত বাতাস সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝম করিয়া বৃষ্টি।' (পৃ: ৪৬৫ ঐ)

২। ‘সে কান পাতিয়া রহিল, কিন্তু বাতাস ও জলের শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যায় না, আর একটা গর্জনের মত গোঁ গোঁ শব্দ।'

প্রথম উদাহরণে আকাশ, বাতাস এবং বৃষ্টি পরপর এসেছে। আবার আকাশ-এর অবস্থা বোঝাতে ‘দুরন্ত দুর্যোগ’, বাতাস-এর অবস্থা ঝড় দিয়ে এবং বৃষ্টির প্রাবল্য বোঝাতে ‘ঝমঝম’ শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়েছে।

দ্বিতীয় উদাহরণে বাতাস, জলের শব্দ এবং গর্জন পরপর এসেছে। বাতাস এবং জলের শব্দ ‘গর্জন' শব্দটির দ্বারা স্পষ্ট হয়েছে।

৭. বাক্যে সমান্তরলতা—সমান্তরলতা হল সমগঠণের বা প্রায় সমগঠণের যে কোন আন্বয়িক উপাদানের বারবার ব্যবহার এবং তার ফলেই একটি সৌষম্যের সৃষ্টি। এ গল্পে এরকম একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

১। কিন্তু সে সমস্ত শব্দ আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছিল ময়ুরাক্ষীর গর্জন, বাতাসের অট্টহাস্য আর বর্ষণের শব্দ। ময়ুরাক্ষীর বাতাসের বর্ষণের গর্জন অট্টহাস্য শব্দ

৮. গুল্পে একটি শব্দের পর আর একটি শব্দ স্বাভাবিকভাবে এসেছে। এই শব্দগুলি বাক্যের কোন ক্ষতি করে না। এই শব্দগুলি যেন একটি আর একটি পিঠে চড়েই আসে। তারা পরস্পর পরস্পরের দ্বারা সম্পূর্ণ। যেমন— বাড়ি-ঘর, খেত-খামার, ধুইয়া-মুছিয়া, জল-টল, বাণ-টান, নড়িয়া-চড়িয়া, শৃগাল-কুকুর, ব্যামো-স্যামো, মাথা-মুণ্ডু, পথ-ঘাট, নরনারী, গরুছাগল, আদান-প্রদান ইত্যাদি। 

৯. চিত্রকল্প :— গল্পে চিত্রকল্প প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণ—

১। ‘জলহীন ময়ুরাক্ষীর বালুকাময় গর্ভ গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রে ঝিকমিক করিতেছিল'— ঝিকমিক' শব্দটি সোনার চিত্রকল্প তুলে ধরে।

২। ‘আকাশ তো ফটফটে, চকচক করছে’ -‘চকচক' শব্দটি সোনার চিত্রকল্প তুলে ধরে। ৩। ‘গাছে বাঁধা ডোঙাটা তরঙ্গাঘাতে মৃদু মৃদু দোল খাইতেছিল'—‘তরঙ্গ' শব্দটি নদীর চিত্রকল্প তুলে ধরে।

১০. গল্পে আলংকারিক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়-

১। নিম্নে খরস্রোতা ময়ুরাক্ষী নিম্নস্বরে ক্রুর হাস্য করিয়া বহিয়া চলিয়াছিল’--- সমাসোক্তি অলংকার। নদীর ওপর চেতন শক্তি আরোপ করা হয়েছে।

২। ‘কিন্তু বর্ষার প্রারম্ভে সে রাক্ষসীর মত ভয়ংকরী।' উপমেয়——ময়ুরাক্ষী, উপমেয়- রাক্ষসী।

৩। ‘সমস্ত দেশটার মধ্যে একটা মৃদু কাতর ক্রন্দন যেন সাড়া দিয়া উঠিল। প্রত্যাসন্ন বিপদের জন্য দেশ যেন মৃদু স্বরে কাঁদিতেছিল।' সমাসোক্তি অলংকার।

৪। ‘চোখে মুখে বৃষ্টির ছাট আসিয়া বিঁধিতেছিল তীরের মত'—উপমা অলংকার। উপমেয় বৃষ্টি, উপমান-তীর।

৫। কুটার মত তাহারা চলিয়াছে’-- উপমা অলংকার। উপমেয় - তাহারা (সুখী ও তারিণী) উপমান - কুটা।

তারাশংকরের নিজস্ব একটি ভাষাভঙ্গী রয়েছে। সেই ভাষাভঙ্গী প্রকাশ পেয়েছে তাঁর বিভিন্ন চরিত্রের মুখের ভাষায়। তিনি তাঁর চরিত্রের মুখে জোর করে বানানো কৃত্রিম ভাষা বসাতে রাজী নন। তাদের মুখের স্বতস্ফূর্ত ভাষাই চরিত্রগুলিকে অধিকতর স্বাভাবিক ও জীবন্ত করে তুলেছে। স্বতস্ফূর্ত ভাষা প্রয়োগ ভাষার কারুকার্য যে সেভাবে ফুটে ওঠে না। 'তারিণী মাঝি' গল্পে তার পরিচয় মেলে।

গল্পের শৈলী প্রসঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে :

১. গল্পটিতে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ ঘটেছে। ময়ূরাক্ষী নদীর তীরবর্তী গ্রাম গনুটিয়া। সেই অঞ্চল বিশেষের ভাষা চরিত্রগুলির মুখে স্পষ্ট। লেখকের নিজস্ব বর্ণনা সাধুভাষায় । কিন্তু চরিত্রগুলি যখন কথা বলে তখন চলিত ভাষার প্রয়োগ লক্ষণীয়। গল্পের শুরু সাধুভাষায়--- তারিণী মাঝির অভ্যাস মাথা হেঁট করিয়া চলা। অস্বাভাবিক দীর্ঘ তারিণী ঘরের দরজায়, গাছে-ডালে, সাধারণ চালাঘরে বহুবার মাথায় বহু ঘা খাইয়া ঠেকিয়া শিখিয়াছে।' আবার চরিত্রের কথোপকথনে কিন্তু চলিত রীতির ব্যবহার ঘটেছে। যেমন-- ‘তারিণী তামাক খাইতে খাইতে হাঁক মারিয়া উঠিল--আর লয় গো ঠাকরুণরা, আর লয়। গঙ্গাচান করে পুণ্যির বোঝায় ভারী হয়ে আইছ সব।’

২. গল্পটি নদীকেন্দ্রিক। ময়ুরাক্ষী নদীর গনুটিয়া ঘাটে তারিণী মাঝি খেয়া পারাপার করে। ময়ূরাক্ষীর ভয়ঙ্করী রূপ যেমন প্রকাশ পেয়েছে সেরকম শাক্ত রূপও লেখক তাঁর ভাষাচাতুর্যে তুলে ধরেছেন।

(১) ভয়ঙ্করীরূপের বর্ণনা— 'কিন্তু বর্ষার প্রারম্ভে সে রাক্ষসীর মত ভয়ঙ্করী। দুই পার্শ্বে চার-পাঁচ মাইল গাঢ় পিঙ্গলবর্ণ জলস্রোতে পরিব্যাপ্ত করিয়া বিপুল স্রোতে সে তখন ছুটিয়া চলে। আবার কখনও ‘হড়পা বাণ' ছয় সাত হাত উচ্চ জলস্রোত সম্মুখের বাড়িঘর ক্ষেত-খামার গ্রামের পর গ্রাম নিঃশেষে ধুইয়া মুছিয়া দিয়া সমস্ত দেশটাকে প্লাবিত করিয়া দিয়া যায়।'

(২) ‘গাঢ় গভীর অন্ধকার, কানের পাশ দিয়া বাতাস চলিয়াছে। হু হু শব্দে, তাহারই সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে ময়ুরাক্ষীর বাণের হুড়হুড় দুড়দুড় শব্দ। চোখেমুখে বৃষ্টির ছাট আসিয়া বিঁধিতেছিল তীরের মত।’

খ. শান্ত রূপের বর্ণনা

(১) ‘বারো মাসের মধ্যে সাত আট মাস ময়ুরাক্ষী, এক মাইল দেড় মাইল প্রশস্ত বালুকারাশি ধু ধু’

(২) ‘জলহীন ময়ুরাক্ষীর বালুকাময় গর্ভ গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রে ঝিকঝিক করিতেছিল।' 

৩. পরিবেশ চিত্রণে ভাষা প্রয়োগে বীভৎসতা তুলে ধরেছে।

ক) ‘তারিণীর অট্টহাসিতে বর্ষার রাত্রির সজল অন্ধকার ত্রস্ত হইয়া উঠিল।'

খ) ‘বলির পাঁঠাটা নদীগর্ভের উত্তপ্ত বালুকার উপর আর থাকিতে চাহিতেছিল না।’ 

গ) দুর্ভিক্ষ যেন দেশের মাটির তলেই আত্মগোপন করিয়াছিল, মাটির ফাটলের মধ্য দিয়া পথ পাইয়া সে ভয়াল মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করিয়া বসিল।' 

ঘ) ‘কতকটা তাহার শৃগাল-কুকুরে ছিঁড়িয়া খাইয়াছে।'

ঙ) ‘গরু ছাগল ভেড়া কুকুরের সে কি ভয়ার্ত চিৎকার।'

চ) দুই হাতে প্রবল আক্রোশে সে সুখীর গলা পেষণ করিয়া ধরিল।'

‘ক’ উদাহরণে অট্টহাসি' শব্দটিতে ছবি ফুটে উঠে। ‘

খ’ উদাহরণে বলির পাঁঠার মৃত্যুদৃশ্যই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উত্তপ্ত বালুকা উপলক্ষ্য মাত্র। নিজেকে বাঁচানোর জন্যে পাঠাটির না থাকাটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 

‘গ’ উদাহরণে দুর্ভিক্ষ' শব্দটি একটি চিত্রকল্প তুলে ধরে যা খুব সুখকর নয়। ভয়াল মূর্তি' শব্দ দুটি প্রয়োগ করায় তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 

‘ঘ' উদাহরণে মানুষকে ছিঁড়ে খাওয়ার প্রসঙ্গে শিয়াল, কুকুর প্রভৃতি ইতর প্রাণীর কথা এসেছে। 

'ঙ' উদাহরণে ভয়ার্ত' চিংকার শব্দ দুটি ভয়ঙ্কর দৃশ্যের ছবি তুলে ধরে।


 

Post a Comment

0 Comments