রেকর্ড গল্প :নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

 


রেকর্ড গল্প :নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

গল্পের উত্তম পুরুষ কথক ও তাঁর স্ত্রী করুণার ভাবনা এ গল্পে একটি বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। কথক এবং তাঁর স্ত্রী করুণার মধ্যে রেকর্ডের আসল সত্যটা জানার যে আগ্রহ তার সঙ্গে পাঠকহৃদয়ও তৎপর হয়ে ওঠে। একটা অজানা সুর সবার মনকে তোলপাড় করে দেয়। জানার আগ্রহটা প্রবল হয়ে ওঠে। আর সেজন্যেই গল্পের কথক সবার কাছে জানতে চান গানের প্রকৃত অর্থ। গল্পের শেষে আসল সত্য জানতে পেরে কথক যেমন চিন্তান্বিত হয়ে পড়েন সেরকম সহানুভূতিশীল পাঠকচিত্তও করুণায় আর্দ্র হয়ে ওঠে। আর তখনই পাঠকের মনোলোকে রেকর্ডটি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে নিতে সক্ষম হয়। আগেই বলেছি গল্পে কাহিনী অংশটুকু নেই বললেই চলে। নিটোল কাহিনী না হলেও যেটুকু আছে তা হল গল্পের উত্তমপুরুষ নায়ক কলকাতার শিয়ালদা অঞ্চলের গলি খুঁজির মধ্যে 'সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেট'-এ (চোরাবাজার) গিয়েছিলেন একটি বুককেসের খোঁজে। কিন্তু বুককেস না পেয়ে ফিরে আসার সময়ে একটি দোকানের দিকে কথকের নজর পড়ে। সেটা ফার্নিচারের দোকান নয়। পুরোনো ফ্যাশানের নানা টুকিটাকি জিনিসের দোকান। সেখান থেকে কথক একটি রেকর্ড কেনেন। সে রেকর্ড চোঙাওলা গ্রামোফোনের ডিস্কে বসিয়ে বাজাতে হয়। সেই রেকর্ডের লেবেল কথকের চেনা নয়। রেকর্ডের ওপরে লেখাগুলোও রোমান ফরফে নয় অথচ রেকর্ডটি যে খুব বেশি পুরোনো নয় তা কথকের বুঝতে অসুবিধা হয় না। দোকানদার গানটা বাজিয়ে শোনানোর পরে কথক সে গানের ভাষা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না। লেখক বলেছেন-- চোঙাতলা গ্রামোফোন থেকে প্রথমে একরাশ অদ্ভুত বাজনা ছড়িয়ে পড়ল। এ ধরনের বাজনা এর আগে কখনো শুনিনি। একটা ড্রাম বাজছে- গীটারও আছে বোধ হয়- কিন্তু আরো কী কী যে আছে আমার বোধগম্য হল না।' নারী পুরুষের চার পাঁচটি কণ্ঠস্বরের সঙ্গে আছে অদ্ভুত বাজনা আর অদ্ভুত সুর। কথকের মনে হয়েছে --‘জানি এ সুর একেবারে অচেনা, তবু মনে হতে লাগল এ যেন আমি করে কোথায় শুনেছিলুম।' রেকর্ডটি ঘরে এনে মেশিনে চালিয়ে শুনতে বসেন কথক ও তাঁর অধ্যাপিকা স্ত্রী করুণা। করুণাও কথকের মত অভিভূত হয়ে পড়েন রেকর্ডের গান শুনে। কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। সবটাই কেমন যেন দুর্বোধ্য। অচেনা সুর, অচেনা ভাষা। একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়েন কথক ও তাঁর স্ত্রী। লেখক বলেছেন- ওই রেকর্ডখানা আমাদের দুজনের সন্ধ্যাকেই আচ্ছন্ন করে রাখল। এ একটা বিরক্তিকর মানসিক অবস্থা। এভাবে কয়েকটা দিন কাটে। একদিন করুণার এক সহপাঠিনী আইভি করুণার বাড়ী আসে। বিদুষী গুনবতী মহিলা আইভি। শুধু তাই নয় ওয়েস্টার্ন মিউজিকে ডক্টরেট। করুণা আইভিকে পেয়ে আশার আলো দেখতে পান। সমস্যাটার সমাধান করতে পারবে আইভি। কিন্তু আইভিও গানের সুর, ভাষা, বাজনার অর্থ কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। সুইংসারলান্ডের ম্যারেজ ফেস্টিভ্যালের গান বলে চালাবার চেষ্টা করলেও বোপে না টেকার পালিয়ে বাঁচে। রেকর্ডের বাজনা শুনে কথকের মনে কতগুলি অনুষঙ্গ এসে ভীড় জমায়। বর্ষার ব্রহ্মপুত্র, নাগাদের ঢাক, নাগরা-টিকারার আওয়াজ, ছৌ নাচের বাজনা। শেষে একজন ভূ-পর্যটক এসে সমস্যার সমাধান করে দেন। রেকর্ডের গান, ভাষা, সুর, বাজনা শুনে ভূ পর্যটক বলেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর বিরুদ্ধে এই রেকর্ডটি প্রচারিত হয়েছিল আত্মগোপনকারী স্বাধীনতাকামীদের তৎপরতায়। এই রেকর্ডে আছে মুক্তি যোদ্ধাদের গান। কিন্তু সেইসব মুক্তিযোদ্ধারা আজ আর নেই। হিটলারের গোয়েন্দারা সেই সব মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে শুধু তাই নয় রেকর্ডগুলিও বাজেয়াপ্ত করে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা নেই কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বর রয়ে গেছে এই রেকর্ডে। কিভাবে যে রেকর্ডটি বেরিয়ে এসেছে সেটাই ভাবার বিষয়। ভূ-পর্যটক অবাক হয়ে যান রেকর্ডটি দেখে। আর ঠিক এসময়েই কলকাতার পথ ঘাট জুড়ে ছাত্র যুবকদের প্রতিবাদী আন্দোলন চলছিল। ছাত্র শোভাযাত্রার দূর ধ্বনিটা হঠাৎ বন্যার মতো প্রবল বেগে ভেঙে পড়ল। আর সেই আন্দোলনের পরিণতি শোষকশ্রেণীর অত্যাচারের নিদর্শন লাঠি, টিয়ার গ্যাস, ধরপাকড়, বোমার আওয়াজ, বন্দুকের গুলির শব্দ । রেকর্ডের গান, ভাষা বর্তমান ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে যেন এক হয়ে যায়। লেখক সত্যি কথাটা বলেছেন এভাবে-- -জানতুন, আমরা এ সুরকে জানতুম। ঘুনন্ত রক্তের মধ্যে তলিয়ে ছিল বলেই এতদিন চিনতে পারিনি। এখানেই গল্পের ক্লাইমাক্স। মুক্তি যোদ্ধাদের গান, তাদের ভাষা, তাদের সুরের প্রতি করুণা সমর্থন জানান এভাবে—- এ রেকর্ডকে কেউ ভেঙে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। কেউ পারবে না! কথক ও তাঁর স্ত্রী করুণার আত্মপ্রত্যয়ের বলিষ্ঠ ঘোষণার মধ্য দিয়ে গল্পটি শেষ হয়েছে।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি বিশিষ্ট গল্প 'রেকর্ড'। অন্য গল্পগুলি থেকে এ গল্পটি একটু আলাদা। গল্পে কাহিনী থাকে এবং সে কাহিনী নিটোল কাহিনী কিন্তু নিটোল কাহিনী ছাড়া যে গল্প হতে পারে তা 'রেকর্ড' গল্পটি পড়লেই বোঝা যায়। গল্পটি আইডিয়া নির্ভর। আইডিয়াকে নির্ভর করেই গল্পটি এগিয়েছে। আইডিয়ার মধ্য দিয়েই প্রতিবাদী চেতনা স্পষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে শোষক শ্রেণীর অত্যাচারের কাহিনী অজানা নয়। শোষিত শ্রেণীর করুণ কাহিনী লেখকের মনে স্থান পায় এবং তার প্রতিফলন ঘটে সাহিত্যে। শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের জেহাদ ফুটে উঠেছে এ গল্পে একটি রেকর্ডের মাধ্যমে। সেই সব মানুষের প্রতিবাদী মনোভাবের পরিচয় আছে তাদের গানে, সুরে, ব্যথা-বেদনার প্রকাশে। গল্পের শেষে গল্পের মূল বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে ব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে।

এ গল্পে বিপ্লব সচেতনতা স্পষ্ট। বিপ্লবী মুক্তিযোদ্ধাদের বিপ্লবের বাণী স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হয়েছে তাদের গানে। গল্পের কেন্দ্রীয় লক্ষ্যে তাই এসে দাঁড়িয়ে পড়ে বিপ্লবচেতনা। চরিত্র প্রাধান্য পায়নি চরিত্রের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের কথাও নেই বরং গল্পের কথক চরিত্র এবং তাঁর স্ত্রীর সহানুভূতি বর্ষিত হয়েছে সেইসব মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যারা হিটলার বাহিনীর কাছে পর্যুদস্ত। গল্পের কেন্দ্রীয় বক্তব্যে উঠে এসেছে শোষিত মানুষের সর্বহারা মানুষের বিপ্লবী চিন্তাভাবনা। গল্পটি আইডিয়া নির্ভর গল্প - যার মধ্যে নিহিত আছে বিপ্লবচেতনা। শিয়ালদায় বুককেসের সন্ধানে গিয়ে লেখকের রেকর্ডটি পাওয়া এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। সত্য আনার জন্যে তাঁরা বাস্ত হয়ে পড়ে। প্রসঙ্গক্রনে এসেছে সাওতাল বিদ্রোহের কথা— ‘বালুরঘাটের অন্ধকার সাঁওতালি গানগুলো থেকে অমনিভাবেই নাগরা-টিাকারা রোল আমি শুনেছিল। আর এরই অনুষঙ্গে এসেছে বাঘেরডাক। কলকাতার মার্কাস স্কোয়ারে সার্কাস দলের বাঘটির ডাক প্রতীক ছাড়া আর কিছুই নয়। সার্কাস দলের বাঘ খাঁচার থাকে। অনেক কায়দা কসরৎ করে শিকের খোঁচা দিয়ে তাকে পোষ মানানো হয়, খেলা শেখানো হয়। সার্কাসের প্রতিটি শো-তে তাকে খেলা দেখাতে হয় চাবুকের দিকে চোখ রেখে। কিন্তু এবং এক সময় সে বিদ্রোহ করে। চোখেমুখে প্রকাশ পায় বিদ্রোহের ছাপ। তার বিদ্রোহীসত্তা প্রবল আকার ধারণ করতে থাকে তার বজ্রনির্বোধ ডাকেই তার প্রকাশ ঘটে। বলক রেকর্ডের ভাষার সঙ্গে বাঘের ডাকের একটা মিল খুঁজে পান কিন্তু কেন জানি না- আমার এই বিদেশী রেকর্ডটাকে মনে পড়ল। গল্পের শেষে কথকের স্বীকারোক্তি 'স্পষ্ট হয় ব্রহ্মপুত্রের বর্ষা মাদল, নাগা পাহাে ঢাক, ছৌ নাচের নাগরা, বালুরঘাটের রাত্রি কাঁপানো টিকারার আওয়াজ — নাকাস সোয়ার থেকে বাঘের ডাক, আর আজকের এই ঘা খাওয়া নিছিল, সব একসঙ্গে মিলে এই টাকে সৃষ্টি করেছে। দেশে দেশে, কালে কালে এ সুর এক। অনতুন, আনরাও এ সরকে লানতুন। ঘুমন্ত রক্তের মধ্যে তলিয়ে ছিল বলেই এতদিন চিনতে পারিনি।

গল্প চরিত্র সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। চরিত্রই প্রাধান্য পায়। চরিত্রের মনস্তত্ব প্রাধান্য পায়। কিন্তু রেকর্ড গল্পে চরিত্র সেভাবে প্রাধান্য পায় নি। টোপ গল্পে রায়বাহাদুরের চরিত্রটি প্রাধান্য পেয়েছে তার পাশে আছে গল্পের কথক চরিত্রটি। কিন্তু এ গল্পে 'টোপ' গল্পের চরিত্রের মত চরিত্র নেই। তবে এখানে আছে গল্পের কথক চরিত্র। দলে নায়ক-নায়িকা চরিত্রের প্রাধান্য দেখা যায় কিন্তু এ গল্পে কথক চরিত্রই নায়ক চরিত্র হয়ে কথা দিয়েছে গল্পের উত্তাপুরুষ কথকই নায়ক চরিত্র। কিন্তু কোন নামে তিনি চিহ্নিত নন। কথকের লেপথেটি রয়েছেন গল্পকার নিজে। গল্পটি এগিয়েছে তারই কেনা একটি রেকর্ডকে কেন্দ্র করে। বৈঠকখানা মার্কেটে কথক গিয়েছিলেন একটি বুককেসের সন্ধানে। অনেক বোরাঘুরির পরে তিনি একটি দোকান থেকে একটি পুরোনো রেকর্ড কিনে ফেলেন। পুরোনো। জনিসপত্র কেনা কথরের একটা অভাব ছিল। আর এই কোন কিছু না ভেবেই তিনি একটি রেকর্ড কিনে ফেলেন। কিন্তু রেকর্ডের বাংলা গান শুনে এখন নিছু কে উঠতে পারেন না। তবুও পুরোনা জিনিসের রেকর্ডটি কিনে ফেলার মধ্য দিয়ে কথকের রুচিবোধের পরিচয় মেলে। পরোনো রেকর্ড কেনার যে অভ্যেস ছিল তার প্রমান মেলে অপালা কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত, রাধিকা গোস্বামীর গান, দিলীপকুমারের শ্যামাসংগীতের মত কিছু পুরোনে গানের রেকর্ড বেনায়। এতে সঙ্গীতের প্রতিবে কথকের একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল তার পরিচয় মেলে।

রেকর্ডটি কেনার পরে কখন সমস্যায় পড়ে যান। কথকের কাছে রেব এটি একেবারে নতুন ঠেকে। রকর্ডের বাঘনাও একেবারে নटुন। কথক বলেন– द अনत्रि मনেন কিন্তু এ জিনিস কখনো কানে বাসেনি এর সাথে। কথক একটা বাদ পড়ে যান। জাতি  এ সুর একেবারে অচেনা তব মনে হতে লাগল যেন আমি করে কোথায় এনেছিলেন। অস্থিরচিত্ততার মধ্য দিয়ে রেকর্ডটি বাড়ী এনে স্ত্রী করুণাকেও সমস্যায় ফেলে দেন কথক। করুণাও রেকর্ডের ভাষা, সুর কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। সমস্যা আরো তীব্র হয়ে ওঠে। করুণা রেকর্ডের ভাষা, সূর বুঝে উঠতে না পেরে রাজ্যের চাইপাঁশ' বলতেও দিধা করেন না। কথকের মনে হয় তিনি যেন কোথায় শুনেছেন এর সুর, এর ভাষা অথচ ঠিক মনে করে উঠাতে পারছেন না। কোথায় শুনেছি-- করে শুনেছি। কিন্তু কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। কথক এবং করুণার কথোপকথনের মধ্য দিয়ে অস্বস্তি ফুটে ওঠে। 'ওই রেকর্ডখানা আনাদের দুজনের সন্ধাকেই আাচ্ছন্ন করে রাখল। এ একটা বিরক্তিকর মানসিক অবস্থা। রেকর্ডটিকে নিয়ে কথকের মানসিক অবস্থার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়—

এক।। জানিএ সুর একেবারে অচেনা— তব মনে হতে লাগল এ যেন আমি করে কোথায় শুনেছিলুন।

দুই ।। দু কান ভরে ওই বিচিত্র বাংলা আর গানের সুর বেজে চলেছে। কোথায় শুনেছি—করে শুনেছি। কিন্তু কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না।

তিন।। নিলছে না— অথচ কোথায় যেন মিলছে। কিছুতেই মনে আনতে পারছি না— অথচ ঠিক মনে আছে। কী যে খারাপ লাগতে লাগল।

চার।।

আমার এই বিদেশী রেকর্ডটাকে মনে পড়ল। মিল আছে—ওর সঙ্গেও মিল আছে। অথচ কিছুতেই ধরতে পারছি না— কিছুতেই না। পাঁচ।। জানতুম, আমরাও এ সুরকে অনতুন। ঘুমন্ত রক্তের মধ্যে তলিয়ে ছিল বলেই এতদিন চিনতে পারিনি।

কথকের স্ত্রী করুণার বান্ধবী, ওয়েস্টার্ন মিউজিকে বিশেষজ্ঞা আইডিও রেকর্ডের গানের সুর ও ভাষা সম্পর্কে কোন হদিশ দিতে না পারায় কথক দিশেহারা হয়ে পড়েন। শেষে এক ভূ-পর্যটক সমস্যার সমাধান করে দেন। ইউরোপের একটা দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষদের সম্মিলিত গান রেকর্ডটিতে রয়েছে। হিটলারের শাসনে শাসিত ঐ ছোট্ট দেশের স্বাধীনতার জন্যে মুক্তি যোদ্ধারা যে গান গেয়েছিল তাই-ই রয়েছে এতে। তবে ঐ সময়ে হিটলারের নাৎসী বাহিনী গোয়েন্দারা ঐ গানের শিল্পীদের হত্যা করে। শুধু তাই নয় ঐ গানের রেকর্ডগুলি এ বাজেয়াপ্ত করে ফেলে। সেই গানেরই একটি রেকর্ড হল এটি। আর সেই অনুষঙ্গেই গল্পকার এনেছেন কলকাতার রাস্তার প্রতিবাদী ছাত্রদের আন্দোলন। কথক মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়ান। তাঁর সহানুভূতিশীল মনের পরিচয় মেলে-- দেশে দেশে কালে কালে এ সুর এক। জানম, শামরাও এ সুরকে জানতন। ঘুমন্ত রাজের মধ্যে তলিয়ে ছিল বলেই এতদিন চিনতে পারিনি। গল্পটির শেষাংশে রেকর্ডটি ভাষা উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে কথক ও পাঠক হৃদয় একই অক্ষরেখায় অবস্থান করে। কথক চরিত্রের আর একটি বৈশিষ্ট্য। হল তিনি ছিলেন শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বৈঠকখানা রোডের মার্কেটে তিনি গিয়েছিলেন একটি বুককেসের সন্ধানে। সেখানেই তিনি রেকর্ডটি পেয়ে যান। তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তার প্রমাণ মেলে – আমি কতকগুলো খাতা টেনে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের সংখ্যা বাড়াতে বসে গেলন। কিন্তু

অংশটুকুতেও রেকর্ড প্রসঙ্গ তবে সেই গানের মর্মোদঘাটন করেছেন এক ভূ-পর্যটক। আসল অর্থ জানার পরে গল্পের কথক নায়ক এবং করুণার প্রতিক্রিয়ায় গল্পটি শেষ হয়েছে। এইগল্পটি প্রসঙ্গে প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপোতা আবিষ্কার' গল্পটির কথা এসে পড়ে। এ প্রসঙ্গে সমালোচকের মন্তব্য উদ্ধার করা যেতে পারে—– প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপোতা আবিষ্কার' যেমন অভিনব আবিষ্কারের গল্প, এ-ও তাই-ই। প্রেমেন্দ্র মিত্র Invention এবং discovery দুইকেই অদ্ভুত রহস্যময়তা, শিল্পের কৌতূহল ও ব্যঞ্জনায় রেখেছেন, 'রেকর্ড' নামে সে ব্যঞ্জনা নেই।' (বাংলা ছোটগল্প : প্রসঙ্গ ও প্রকরণ-বীরেন্দ্র দত্ত) তেলেনাপোতা একটি জায়গার নাম তাকে আবিষ্কার করার কথা গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে আর 'রেকর্ড' গল্পে রেকর্ডের ভাষা উদ্ধার করাই মূলত গল্পের প্রধান বিষয়। তেলেনাপোতা গ্রামটি কোথাও আছে তাকে আবিষ্কার করা আর রেকর্ডের গানের অর্থ উদ্ধার করা- দু-ই একই পর্যায়ে পড়ে। ভাষাসমস্যাটাই প্রধান রেকর্ড' গল্পে। তবুও রেকর্ড' নামের ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে গল্পের নামকরণে। কয়েকটি ব্যাখ্যার মধ্যে চলে আসে গল্পের নামকরণটি।


এক।। গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে রেকর্ডটি। তাকে ঘিরেই অন্য চরিত্রগুলি ঘুরপাক খেয়েছে। বৈঠকখানার বাজারে দোকান থেকে কেনার পরেই রের্ডটির অন্যরূপ। গল্পের কথক ও তাঁর স্ত্রী করুণা রেকর্ডটি নিয়ে সমস্যায় পড়েন। আইভিও এসেছেন রেকর্ডের ভাষা উদ্ধার করার জন্যেই। কিন্তু তাঁর পক্ষে সম্ভব না হওয়ায় এসেছে ভূ-পর্যটক। তিনি গানের মর্ম উদঘাটন করে দিয়েছেন। সমস্যার সমাধানও হয়েছে। তাই গল্পে রেকর্ডটি প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। সুতরাং গল্পের নামকরণ এদিক থেকে সঠিক হয়েছে।


দুই।। রেকর্ডটি বহুদিনের পুরনো তা ভূ-পর্যটকের কথাতেই জানা যায়। শুধু তাই নয় কথক চরিত্রটি অচেনা ভাষা অচেনা সুরটিকে ধরতে না পারার সমস্যাটি জটিল হয়ে পড়েছে। রেকর্ডের ভাষা, সুর, গান, বাজনা সবকিছু কেমন যেন একটু আলাদা। আর গল্পের শেষে সেই গানের ব্যাখ্যা প্রাপ্তিতেই গল্পটি শেষ। এদিক দিয়ে গল্পের নামকরণ সার্থক।


তিন।। গল্পে কোন চরিত্র প্রাধান্য পায় নি। কোন চরিত্রের মনস্তত্ত্বও সেভাবে প্রকাশ পায়নি। কথক রেকর্ডটি না বুঝেই কিনে ফেলেছিলেন। তার ভাষা উদ্ধারেই তাঁকে হিমসিম খেতে হয়েছে। কথকের স্ত্রী করুণাকেও একই অবস্থার মধ্যে দেখি। কিন্তু গল্পে এঁরা সেভাবে স্থান পায়নি। রেকর্ডটিকে ঘিরেই এঁদের কথাবার্তা। তাই গল্পটি কোন চরিত্রের নামানুযায়ী হওয়া সম্ভব ছিল না। কের্ডটি গল্পের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রয়েছে তাই 'রেকর্ড' ছাড়া অন্যকোন নামকরণ করা সম্ভব ছিল না।


চার।। রেকর্ড হল কোন ব্যক্তির কথা বা গান ইত্যাদি ধরে রাখার জিনিস। বহুদিনের পুরোনো কণ্ঠস্বর রেকর্ডের মাধ্যমেই নতুন করে শোনা যায়। তখন আর রেকর্ডটিকে নির্জীব বলে মনে হয় না সজীব হয়ে ওঠে। এখনও আমরা কোনকোন সময়ে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর রেকর্ড বাজিয়ে শুনি। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর রেকর্ডে শুনলে তা নতুন বলেই মনে হয়। তাই রেকর্ডের একটি মর্যাদা আছে একটি বিশেষ মূল্যও আছে। হিটলারের নাৎসী বাহিনীর অকথ্য অত্যাচার, শাসনশোষণের হাত থেকে বাঁচার জন্যে ইউরোপের কোন এক জায়গার বিপ্লবীরা যে বিদ্রোহের গান গেয়েছিল তা কোনমতেই ক্ষণকালের নয় তা চিরকালের হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপ্লবীদের বিপ্লবীসত্তার পরিচয় রয়েছে এই রেকর্ডটিতে। এই রেকর্ডটির গান শুনে সাধারণ মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। (তবে বর্তমানে রেকর্ডের বদলে ক্যাসেট ব্যবহৃত হচ্ছে।) সেদিক থেকে নামকরণটি সার্থক।


পাঁচ।। যেহেতু রেকর্ডটিতে আছে বিপ্লবীদের গান তাই সেটি আর বিশেষ কোন গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে না। সেটি হয়ে দাঁড়ায় সর্বকালের বিপ্লবের প্রতীক। আর এই সত্য ধরা পড়ে গল্পের একেবারে শেষে কথকের কথায়— 'জানতুম, আমরাও এ সুরকে জানতুম। ঘুমন্ত রক্তের মধ্যে তলিয়ে ছিল বলেই এতদিন চিনতে পারিনি।' শুধু তাই নয় গল্পের শেষ অনুচ্ছেদে করুণার কথায় সেই গভীর সত্যটি ধরা পড়ে-- 'এ রেকর্ডকে কেউ ভেঙে নিশ্চিহ্ন করতে পারে নি। কেউ পারবে না।' রেকর্ডের ভাষা বিপ্লবের ভাষা দুই মিলে গিয়ে গল্পে একটি বিশেষ তাৎপর্য এনে দিয়েছে। তাই নামকরণটি সার্থক হয়েছে। সাধারণত ছোটগল্প হয় গতিমুখী। কাহিনী, চরিত্র, তার ভাষাভঙ্গী গল্পে প্রাধান্য পায়। চরিত্র, চরিত্রের মনস্তত্ত্ব গল্পের পরিণতির দিকে এগোয়। গল্পে বাঞ্জনারও একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে। এই প্রসঙ্গে 'রেকর্ড' গল্পের শৈলীগত দিকটি নিয়ে আলোচনা করা যেতে

পারে।

১।। গল্পটিকে পঁচটি অংশে ভাগ করা যেতে পারে।

(১) লেখকের কথা ( লেখকই কথক) 

(২) রেকর্ড প্রাপ্তি 

(৩) কথক ও করুণা 

(8) কথক, করুণা ও করুণার বান্ধবী আইভি 

(৫) কথক, করুণা ও ভূ-পর্যটক।

১.ক. বর্ণনাধর্মী অংশ গল্পের প্রথম অংশেই লেখক শিয়ালদহ-বউবাজার অঞ্চলের চোরাবাজারের বর্ণনা দিয়েছেন কয়েকটি অনুচ্ছেদ ধরে। বৈঠকখানা মার্কেটের বিভিন্ন ধরনের দোকানের বর্ণনা আছে পৃথক পৃথক অনুচ্ছেদে। প্রথম অনুচ্ছেদের প্রথম বাকাটিতেই বাজারটি সম্পর্কে লেখক সবকিছু যেন বলে দিয়েছেন—‘বৌবাজার স্ট্রীট আর শেয়ালদার মোড়ের কয়েকটি ছোট ছোট গলি দিয়ে কিংবা স্কট লেনের পাশ কাটিয়ে একটি বিচিত্র বাজারে ঢোকা যায়।' 'বিচিত্র' শব্দটিই বাজারটি সম্পর্কে একটা ধারণা স্পষ্ট করে। তৃতীয় অনুচ্ছেদে উত্তম পুরুষ লেখক যে বর্ণনা দিয়েছেন তা তেলেনাপোতা আবিষ্কার’গল্পের বর্ণনায় একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। 'তেলেনাপোতা আবিষ্কার' গল্পে শনি ও মঙ্গলের—মঙ্গলই হবে বোধ হয়— যোগাযোগ হলে তেলেনাপোতা আপনারাও একদিন আবিষ্কার করতে পারেন।' 'রেকর্ড' গল্পে — এই অংশে দাঁড়ালেই নাকে আসবে স্পিরিট আর বার্ণিশের গন্ধ - তারপর আপনি একেবারে ফার্নিচারের জগতে গিয়ে পৌঁছাবেন।' ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার' গল্পের প্রথমাংশটি বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তারপরে মূল 'ঘটনায় প্রবেশ। 'রেকর্ড' গল্পেও লেখক একটি বুককেসের সন্ধানে গিয়ে বৈঠকখানা বাজারের বর্ণনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন এবং রেকর্ড প্রাপ্তিতে গল্প অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। গল্পের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদেই আসল সত্য ধরা পড়ে। এখানেই উত্তমপুরুষ কথক নায়ক হয়ে দেখা দেন— আমি গিয়েছিলুম ছোট একটা বুককেসের সন্ধানে।' তার আগের পাঁচটি অনুচ্ছেদে শুধুমাত্র লেখকের বর্ণনা ছাড়া আর কিছুই নেই। তবে চোরাবাজারে জিনিস কিনলে ঠকতে হয় তাও লেখক বলেছেন এবং পঞ্চম অনুচ্ছেদে তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন—তবু আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের এখানে লটারীর টিকিটই কিনতে হয়। বৌবাজার কিংবা রিপণ স্ট্রীটের দিকে পা বাড়াতে আমাদের সাহসে কুলোয় না।' একটি দোকানের বর্ণনা · একটি দোকানের বর্ণনায় লেখকের বাস্তববোধের পরিচয় মেলে—‘বাবু কলকাতার শেষ অভিজ্ঞান কতগুলি গৃহসজ্জা, চীনে মাটির বড় ‘পট’, গিল্ট করা ফ্রেমে বিলিতি ছবি, দু'একটা শ্বেতপাথর কিংবা ইমিটেশন স্টোনের ছোট বড় মূর্তি, ব্রোঞ্চের নায়িকা, পুরনো ফ্যাশানের আরো নানা টুকিটাকি।'


২।। অনুচ্ছেদ গুলি শুরু হয়েছে ছোট ছোট বাক্য দিয়ে। এটি লেখকের একটি বৈশিষ্ট্য। কতকগুলি উদাহরণ—

এক।। নতুন পুরোনো ফার্নিচারে দোকানগুলো ঠাসা।

দুই।। আমি গিয়েছিলুম একটা বুককেসের সন্ধানে।

তিন।। একজন বের করে দিলে।

চার।। হিন্দী রেকর্ডটা থেমে গিয়েছিল।

পাঁচ।। তারপর গান ।

ছয়।। জল খেতে উঠেছি— কানে এল বাঘের ডাক।

সাত।। দূরে শুনেছি প্রাণের বন্যা ক্রোধের ঝোড়ো গর্জন।

আট।। করুণা আমার দিকে তাকালো।

৩।। একটি বাক্যেই একটি সম্পূর্ণ অনুচ্ছেদ তৈরি এ গল্পের কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো।

এক।। আমি চোখ তুলে তাকালুম।

দুই।। বলতে বলতে হতাশভাবে চুপ করে গেল করুণা ? কী জানি ।

 তিন।। এর মধ্যে একদিন করুণার এক সহপাঠিনী এসে হাজির। 

চার।। সেদিন মাঝরাতে আমার ঘুম ভাঙল।

পাঁচ।। বাঘ ডাকছে ।

ছয়।। শেষ পর্যন্ত সমাধান করলেন এক ভূ-পর্যটক। সাত।। পর্যটক থামলেন।

আট।। আবার স্তব্ধতা নামল ঘরে। 

৪। ক্রিয়াপদহীন বাক্য প্রয়োগ

এক।। অচেনা লেবেল, অচেনা ভাষা।

দুই।। যেমন অদ্ভুত বাজনা— তেমনি অদ্ভুত সুর।

তিন।। পাশের একটা প্রকাণ্ড দীঘিতে পানডুবকীর কলধ্বনি, ঝিঁঝিঁর ডাক।

৫। 'লুম' প্রত্যয়ের প্রাধান্য এ গল্পে দেখা যায়। অথচ 'টোপ' গল্পে লেখক চরিত্র হয়েও 'লুম' প্রত্যয় ব্যবহার করেন নি।

এক।। আমি গিয়েছিলুম ছোট একটা বুককেসের সন্ধানে।

দুই।। বললুম, রেকর্ড দেখাও তো!

তিন।। দেখলুম, বেশি পুরোনোও নয়। 

চার।। বললুম, একটা বাজাও তো।

পাঁচ।। এ যেন আমি কবে কোথায় শুনেছিলুম। 

ছয়।। গান থামলে করুণার দিকে তাকালুম।

সাত।। আমিও কতগুলো খাতা টেনে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের সংখ্যা বাড়াতে বসে গেলুম।

আট।। আমি চোখ তুলে তাকালুম।

নয়।। ছেলেবেলায় তখন আসামে ছিলুন।

৬। গল্পে প্রকৃতি বর্ণনা সেভাবে নেই। প্রাসঙ্গিকভাবে একটি প্রকৃতি বর্ণনা এসেছে। আসামে নাগাদের ঢাকের বাজনা প্রসঙ্গে আসামের প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা এসেছে। এক।। দুধারে কুসুম গাছের সারি আর ঘন বাঁশের বন— তারই ভেতর দিয়ে নির্জন পথ বেয়ে চলেছি। অন্ধকার হয়ে এসেছে --- ঝালদার পাহাড় দূরে ভতুড়ে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে। পাশের একটা প্রকাণ্ড দীঘিতে পানডুবকীর কলধ্বনি, ঝিঁঝিঁর ডাক। 

৭। সূত্র এক : ঘটনা দুই রেকর্ডটির বাজনা এবং গানের প্রকৃত অর্থ উদ্ধার করতে গিয়ে নানান ভাবনার মধ্যে এই ঘটনা দুটি এসেছে।

এক।। সেই অস্পষ্ট অন্ধকার কালো হয়ে আসা কুসমগাছ আর বাঁশবন, ঝালদার পাহাড়ের ভুতুড়ে ছবি আর ওই নাগরার আওয়াজে হৃৎপিণ্ড আমার চমকে চমকে উঠেছিল। 

দুই।। মনে পড়েছিল, পুলিশের বুলেটের সঙ্গে লড়বার আগের দিন রাত্রে বিয়াল্লিশের আগস্টে, বালুরঘাটের অন্ধকার সাঁওতালি গ্রামগুলো থেকে অমনি ভাবেই নাগরা টিকারার রোল আমি শুনেছিলন। রেকর্ডের গান এবং সুর উদ্ধার করতে না পারায় কথক এবং করুণার মনে কতকগুলি ভাবনার সমাবেশ ঘটেছে। সেগুলি অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। রেকর্ডের গান ; অনুষঙ্গ

এক।। ব্রহ্মপুত্রের বর্ষা

দুই ৷৷ মাদল

তিন।। নাগা পাহাড়ের ডাক

চার।। ছৌ নাচ

পাঁচ।। নাগরা

ছয়।। বালুরঘাটের রাত্রি কাঁপানো টিকারার আওয়াজ

সাত।। মার্কাস স্কোয়ার থেকে সার্কাসের বাঘের ডাক


এই প্রসঙ্গে লেখকের আত্মোপলিব্ধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং সেখানেই ক্লাইম্যাক্‌স অংশ—- দেশে দেশে কালে কালে এ সুর এক। জানতুম, আমরাও এ সুরকে জানতুম। বিপ্লবের সুর বিপ্লবের গান সবসময়েই যে এরকমই হয় তা লেখকের স্বীকারোক্তিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আর এরই প্রেক্ষাপটে এসেছে শেষ অনুচ্ছেদটি। করুণার মধ্যেও বিপ্লবীসত্তা স্পষ্ট তার প্রমাণ মেলে তাঁর কথায়—'এ রেকর্ডকে কেউ ভেঙে নিশ্চিহ্ন করতে পারে নি। কেউ পারবে না। হিটলারের নাৎসী গোয়েন্দাদের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে রেকর্ডটি বেরিয়ে এসেছে, রেকর্ডটি হারিয়ে যখন যায় নি, একে কেউ ভেঙে নিশ্চিহ্ন করতে পারে নি। করুণার প্রত্যয় আরো দৃঢ় হয় 'কেউ পারবে না' এই বাক্যটিতে। বাক্যটির তিনটি শব্দ রঞ্জন রশ্মির মত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এক বর্ণাবয়ব সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয় দু চোখে ঘৃণা জ্বলছে ওর’- এই বাক্যটির মধ্য দিয়ে যে করুণা চরিত্রের সহানুভূতিশীল হৃদয়ের স্বরূপটি ফুটে ওঠে।

আট।। ছাত্রদের শোভাযাত্রা

নয়।। বোমাবাজির আওয়াজ দশ।। ঘা খাওয়া মিছিল

৯। বাক্য বিশ্লেষণ

একটি বাক্যকে ভেঙে টুকরো টুকরো করলে কোন বাক্যের কোন ক্ষতি হয় না। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে

এক।। আর্ত অথচ ভয়ঙ্কর, ক্লান্ত অথচ ক্রুদ্ধ।

১০। ইংরেজী ভাষা প্রয়োগ এ গল্পে ইংরেজী ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে করুণার বান্ধবী আইভির মুখে। আইভি ইউরোপ থেকে গানের ওপরে ডক্টরেট। তার আভিজাত্য বজায় রাখতে গিয়ে ইংরেজী ভাষা তার মুখে দেওয়া হয়েছে।

এক।। ন্যান্সি ইজ ফিলিং, ভেরি লোলি। এ পুওর লিটল থিং শী ইজ।'

১১। বিহারী মুসলমানের ভাষা • রেকর্ডটি কোন ভাষার জিজ্ঞেস করায় দোকানদার হেসে বলল- ক্যা মালুম?

১২। গল্পের শেষ অংশটি তাৎপর্যপূর্ণ। গল্পটি শেষ হয়েছে সংক্ষেপে এবং এর ক্লাইম্যাক্সও গল্পের শেষে। রাস্তা দিয়ে ছাত্রদের শোভাযাত্রায় উত্তাল কলকতার ছবি লেখক দু'একটি কথায় দিয়েছেন।

এক।। রাস্তা দিয়ে গর্জিত একটা ছাত্র- শোভাযাত্রা যাচ্ছিল।

দুই।। ছাত্র শোভাযাত্রার দূর-ধ্বনিটা হঠাৎ বন্যার মতো প্রবল বেগে ভেঙ্গে পড়ল। দুমদুম করে আওয়াজ উঠল কয়েকটা। তারপর পথ দিয়ে চিৎকার করতে করতে কে বলে গেল ; লাঠি চলছে—টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছে।


 

Post a Comment

0 Comments