টোপ গল্পে : নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়


টোপ গল্পে : নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

রাজাবাহাদুরের সাদর অভ্যর্থনায় লেখক অভিভূত। শ্রদ্ধায় আর বিনয়ে আমার মাথা নীচু হয়ে গেল। মুখে কথা জোগাল না, শুধু বেকুবের মতো কৃতার্থের হাসি হাসলাম একগাল।' আদর আপ্যায়নের কোন ত্রুটি ছিল না। লেখকের মনে হয়েছে এসব জিনিস তার কাছে একেবারেই নতুন। সব কিছু কেমন যেন বেমানান। তাই ধোপদুরস্ত ফরাস- ডাঙার ধুতি, সিল্কের লুঙ্গি, আদ্দির পাজামা না পরে দানের দিক থেকে সস্তার পাজামাটা পরে তিনি লাউঞ্জে এসে বসলেন রাজাবাহাদুরের কাছে। চায়ের আসরেই লেখক জানতে পারেন চারশো ফুট নীচের খাদটির কথা, আর জানতে পারেন রাজাবাহাদুরের মাছ ধরার কথা। তরাই জঙ্গলে হিংস্র পশুর বাস। চারশো ফুট উঁচু জায়গা থেকে নীচের কোন পশু শিকার সহজ ঝাপার নয়। তাই রাজাবাহাদুর টোপ ফেলে মাছ শিকার করেন। ভাল টোপ ছাড়া মাছ ধরায় রাজাবাহাদুরের অনীহা তাও প্রকাশ পায় তার কথাবার্তায়। রাজাবাহাদুরের শিকারী ক্যারিনা দেখানোর জন্যে তিনি বদ্ধপরিকর। মদ্যপায়ী শিকারবিলাসী রাজাবাহাদুর লেখকের চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জনের মানসে তাঁকে নিয়ে গিয়ে হাজির করান এক রোমাঞ্চকর পরিবেশে—একটা কাঠের সাঁকো, দুটো কপিকলের মতো জিনিস দিয়ে ঘেরা একটা জায়গায়। মাছ ধরতে গেলে কপিকলের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা লেখকের মাথায় আসে না। লেখক ভাবনার সাগরে ডুব দেন— 'অতি নরম জাজিমের বিছানায় শুয়েও ঘুম আসছে না। মাথার ভেতরে আবর্তিত হচ্ছে অসংলগ্ন চিত্তা। মাছ ধরা, কাঠের সাঁকো, কপিকল, অত্যন্ত গোপনীয়। তাতল রহস্য।'

রাজাবাহাদুরের হান্টিং বাংলোর সামনে ক্রীড়ারত কয়েকটি ছেলেমেয়ে। এরা মাতৃহারা। বাংলোর কী পারের ছেলেমেয়ে। রাজাবাহাদুরের অনুগ্রহ প্রকাশ পায় ছেলেমেয়েগুলোর দিকে কখনও বিস্কুট কখনও পয়সা আবার কখনও বা রুটি ছুঁড়ে দেওয়ায়। দোতলার জানলা থেকে পয়সা, কিংবা বিস্কুট ছুঁড়ে দেন, নিচে ওরা সেগুলো নিয়ে কুকুরের মতো লোফালুফি কেের। রাজাবাহাদুরের চোখের ভাষা অন্য। লেখক রাজাবাহাদুরের চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করেন। রাজাবাহাদুরের পয়সা ছড়ানো, রুটি বিস্কুট ছুঁড়ে দেওয়া নিছক কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে না মানবিকতার তাগিদে। লেখক একটা জালের মধ্যে জড়িয়ে পড়েন। শিকারের দিন রাজাবাহাদুর কীপারকে পাঠিয়ে দেন শহরে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আনার জন্যে। রাত্রিবেলায় কীপারের পক্ষে ফেরার সম্ভাবনা নেই। রাজাবাহাদুর রাতেই শিকার করার তোড়জোড় শুরু করে দেন। দুজন বেয়ারা একটা কপিকলের চাকা ঘুরিয়ে কী একটা জিনিস নামিয়ে দিচ্ছে নীচের দিকে। লেখকের অবিশ্বাস্য দৃষ্টি কপিকলের ঘূর্ণায়মান ঢাকার সঙ্গে ঘুরতে থাকে। লেখক স্পষ্ট দেখতে পান – “প্রায় আড়াইশো ফুট নিচে সাদা পুঁটলির মতো কী একটা জিনিস কপিকলের দড়ির সঙ্গে নেমে যাচ্ছে দ্রুতবেগে। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে জানতে চাইলে লেখক ধমক খান। তাঁর হুইস্কির গন্ধে জায়গাটা ভরে ওঠে। লেখকের সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যায়। লেখক চারশো ফুট নীচে খাদের দিকে তাকাতে গিয়ে স্পষ্ট দেখতে পান – আবছাভাবে যেন দেখতে পাচ্ছি- কপিকলের দড়ির সঙ্গে বাবা সাদা পুঁটলিটা অল্প অল্প নড়ছে বালির ওপরে। এক হাতে রাজাবাহাদুর রাইফেলটা বাগিয়ে ধরে আছেন, আর এক হাতে মাঝে মাঝে আলোটা ফেলছেন নিচের পুঁটলিটায়।' এ কী নাছের টোপ না অন্য কিছু। লেখকের চোখে অবাক বিস্ময়।

শিকার আসার প্রহর গোনা শুরু। মিনিট কাটছে, ঘণ্টা কাটছে, রেডিয়ান ডায়াল ঘড়ির কাটা চলছে ঘুরে। একসময়ে গর্জে ওঠে রাজাবাহাদুরের রাইফেল। সমগ্র বনভূমি কেঁপে ওঠে। রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। চেয়ারশুদ্ধ কেঁপে ওঠেন লেখক। লেখক টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পান-- ডোরাকাটা অতিকায় একটা বিশাল জানোয়ার সাদা পুঁটলিটার ওপরে এক থাবা চাপিয়ে দিয়ে পড়ে আছে, সাপের মতো লাভ আছড়াচ্ছে অভিন মাক্ষেপে। ওপর থেকে ইন্দ্রের বজ্রের মতো অব্যর্থ গুলি গিয়ে লেগেছে তার মাথায়। আর তখনই লেখক শোনেন একটা শিশুর গোঙানি। লেখকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় চারশো ফুট নীচ থেকে যার গোঙানি ভেসে আসছে সে আর কেউ নয় কীপারের একটি মাতৃহারা সন্তান। এখানেই গল্পের চমক। রাজাবাহাদুরের প্রতি লেখকের শ্রদ্ধা অশ্রদ্ধায় রূপান্তরিত হয়। লেখক চীৎকার করে ওঠেন পাগলের মতো- রাজাবাহাদুর কিসের টোপ আপনার। কী দিয়ে আপনি মাছ ধরলেন? রাজাবাহাদুর লেখকের উদ্ধতা মেনে নিতে পারলেন না। তার কন্দকের বল এসে ঠেকে লেখকের বুকে। লেখক বলেন – তার পরেই আমার চারদিকে পৃথিবীটা পাক খেতে খেতে হাওয়ায় গড়া একটা বদদের মতো শুনে। মিলিয়ে গেল। আটমাস পরে সেই বাঘের চামড়ায় তৈরী চটিজোড়া রাজাবাহাদুর লেখককে পাঠিয়েছেন উপহার হিসেবে। লেখক হলে যেতে চেয়েছেন সেই রোমহর্ষক ঘটনার কথা যা ঘটেছিল আটমাস আগে। কর্মবহুল ব্যস্ততার মধ্যে লেখক ভুলে যেতে চেয়েছেন সেই শিকার কাহিনীর কথা ---- আটমাস আগেকার সে রাত্রি এখন স্বপ্ন হয়ে যাওয়াই ভালো, কিন্তু এই চটিজোড়া অতি মনোরন বস্তু। পায়ে দিয়ে একবার হেঁটে দেখলাম যেমন নরম তেমনি আরাম। এখানেই গানের শেষ।

গল্পের কাহিনীতে দুটি চরিত্রের পরিচয় স্পষ্ট। এক রামগঙ্গা এস্টেটের রাজাবাহাদুর এবং দুই গল্পের লেখক। রাজাবাহাদুর চরিত্রটি আলোচনায় উঠে আসতে পারে। গল্পে রাজাবাদরের পরিচয় আছে- রাজাবাহাদুর এন. আর. চৌধুরী, রামগঙ্গা এস্টেট। পুরো নাম নেই। রাজাবাহাদরের পরিচয় রাজাবাহাদুর রূপেই। সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব তার মধ্যে স্পষ্ট। তাঁর আচার আচরণ, হাবভাব, কথাবার্তায় রাজাবাহাদুরের ছাপ স্পষ্ট। তবে লেখকের সঙ্গে কথাবার্তায় লেখকের শিক্ষাদীক্ষার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোরের পরিচয় মেলে।

লেখকের কাছে একটি পার্সেল এসেছে যার মধ্যে রয়েছে একজোড়া চটি আর সঙ্গে একটি কার্ডে আছে রাজবাহাদুরের নাম। তার তখনই লেখকের মনে পড়েছে আট মাস আগের একটি শিকার কাহিনীর ঘটনা। আর সে ঘটনার কথা মনে করতে গিয়ে সেই শিকার কাহিনীর নাসামনি হিসেবে চলে আসেন রাজাবাহাদর। বাহাবানরের কাব্যরসিকতার পরিচয় মেলে গল্পের প্রথমেই রাজাবালাদরের জন্য বাসবে লেখক সত্য প্রবৃত্ত হয়ে একটি কবিতা রচনা করেন । রাজানা পর পূর্ণা হয়ে লেখবারে একটি সেনার হাতাড়ি দেওয়ায় তাঁনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ মারা পড়ে রাজাবাহাদুরের চরিত্রে। আবার রাজাবাহারের মাতিনেতাদের স্পষ্ট হয় লেখানো ভাবাতি দেওয়ার মাসে। এই ঘটনায় লেখকের সঙ্গে রাজাবাহাদুরের একটা সপার মার। রাজাবাহাদুর শিকারবিলাসী— কাহিনীচিত্রনে তা স্পষ্ট। গল্পের মধ্যে শিকারের বর্ণনা প্রধান স্থান জুড়ে রয়েছে আর সেজন্যই রাজাবাহাদুর প্রধান ভূমিকায় চলে আসেন। কানু বিনা গীত নাই— সেরকম রাজাবাহাদুর ছাড়া কাহিনী নেই। রাজাবাহাদুর যখন গল্পে আছেন তখন তার পারিষদরাও নিশ্চয় আছেন আর আছেন মোসাহেবের দল। রাজাবাহাদুর সামত্ত তান্ত্রিক শ্রেণীর প্রতিনিধি সুতরাং তার চাল চলন আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক। রাজাবাহাদুরের অমানবিকতার ছাপ যেমন গল্পের শেষে মেলে সেরকম মানুষ মারতে যে তাঁর হাত কাঁপে না তা তাঁর কথাবার্তাতেই স্পষ্ট। রাইফেল বন্দুক পিস্তল যখন আছে, শিকারের কথা যখন আছে তখন মানুষ মারা যে তাঁর কাছে একটা সামান্য ব্যাপার তা তাঁর চালচলনে ধরা পড়ে। তিনি যখন প্রজাদের শাসন করেন তখন নিশ্চয়ই প্রজাদের শাস্তির বিধানও করেন। কারণ বারবছর বয়সেই রাজাবাহাদুরের রাইফেল হাতে নেওয়ায় তা তো আরও স্পষ্ট হয়। কীপারের ছোট ছেলেমেয়েদের বিস্কুট রুটি খাওয়ানোর সময়ে তাঁকে একভাবে দেখা যায় আবার বাঘের টোপ হিসেবে কীপারের ছেলেটিকে ব্যবহার করায় তাঁর প্রতি ঘৃণাবোধ প্রবল হয়ে ওঠে। এই অমানবিক কাজের জন্য তাঁকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। রাজাবাহাদুরের সৌজন্যবোধ গল্পে লক্ষণীয়। লেখককে দেখে রাজাবাহাদুরের অভ্যর্থনায় লেখক মুগ্ধ হন --- রাজাবাহাদুর 'একগাল হেসে বললেন আসুন আসুন আপনার জন্য আমি এখনো চা পর্যন্ত খাইনি।' শুধু তাই নয় রাজাবাহাদুর রাজাবাহাদুরের মত ইংরেজী-হিন্দী ভাষায় মিশ্রিত নির্দেশ বয়কে দিয়েছেন— আগে স্নান করে রিফ্লেশড হয়ে আসুন, টি ইজ গেটিং রেডি। বোয়, সাহাবকো গোসলখানামে লে যাও। বাংলায় না বলে হিন্দী-ইংরেজী মিশিয়ে কথা বলায় রাজাবাহাদুরের আত্মমর্যাদাবোধের প্রাবল্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ ভাষায় কতটা যে কৃত্রিমতা আছে তা 'বোয়' শব্দটি উচ্চারণের মধ্যে ধরা পড়ে।

রাজাবাহাদুরের রাজকীয় ভঙ্গীর প্রকাশ ঘটেছে চেয়ারে চিৎ হয়ে শুয়ে ম্যানিলা চুরুট খাওয়ার মধ্যে। চা, কফি, কোকো, রুটি, মাখন, মাংস এসব সাজিয়ে তো রাজাবাহাদুরের মত লোকেরাই বসবেন। এসব তাঁর আভিজাত্যের নিদর্শন তা স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন ঐ সব উপকরণে রাজাবাহাদুরের হাত না দেওয়ার মধ্যে। শুধুমাত্র তিন কাপ চা খাওয়া আর চুরুট টানার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ। রাজাবাহাদুর যে দক্ষশিকারী তার পরিচয় লেখক দিয়েছেন একটি বড় অনুচ্ছেদে। দেওয়ালের গায়ে হরিণের মাথা, ভালুকের মুখ, নানা রকমের চামড়া — বাঘের, সাপের হরিণের, গো-সাপের। একটা টেবিলে অতিকায় হাতীর মাথা - দুটো বড় বড় দাঁত এগিয়ে আছে সামনের দিকে।' রাজাবাহাদুরের কীর্তির নিদর্শন এভাবে না দিলে রাজাবাহাদুর চরিত্রের পূর্ণতা প্রকাশ পেতনা। শিকার করার সাজসরঞ্জামের বর্ণনাও লেখক দিয়েছেন — চারিদিকে সারি সারি নানা আকারের আগ্নেয়াস্ত্র। গোটা চারেক রাইফেল, ছোটবড় নানা রকম চেহারা। একটা হুকের সঙ্গে খাপ আঁটা একজোড়া রিভলবার ঝুলছে। তার পাশেই দুলছে খোলা একখানা লম্বা শেফিল্ডের তরোয়াল – সূর্যের আলোর মতো তার ফলার নিষ্কলঙ্ক রঙ। মোটা চামড়ার বেলটে ককঝকে পেতলের কার্তুজ রাইফেলের, রিভলভারের। জরিদার খাপে খানতিনেক নেপালী ভোজালী। এতসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই তাঁর শিকার পর্ব। সুতরাং হিল জন্তুদের শিকার করে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নিদর্শন রাজাবাহাদুরের কীর্তিবহুল জীবনের পরিচায়ক। রাজাবাহাদুর মদ্যপায়ী তার পরিচয় আছে গল্পের মধ্যে। চোদ্দবছর বয়সেই রাজাবাহাদুর ড্রিঙ্ক শুরু করেছেন তা তাঁর কথাতেই জানা যায়। লেখক মদ্যপান না করায় রাজাবাহাদুরের অসন্তুষ্টি প্রকাশ পায়। রাজাবাহাদুরের অসংলগ্ন কথাবার্তায় মদ্যপায়ী চরিত্রের স্বরূপ প্রকাশ পায়। রাজাবাহাদুরের প্রখর উজ্জ্বল চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে এল ক্রমশ, ফর্সা গালে গোলাপী রং ধরল। এবং তার পরিপূর্ণতা প্রকাশ পায়--- তাঁর লাউঞ্জের সেই চেয়ারটায় হাঁ করে ঘুমুচ্ছেন রাজাবাহাদুর, মুখের কাছে কতকগুলো মাছি উড়ছে ভনভন করে। মুখের কাছে কতকগুলো মাছি ভনভন করছে—এরকম দৃশ্য পথেঘাটে আহার দেখা যায়। রাজাবাহাদুরের মধ্যে পথঘাটে পড়ে থাকা মাতাল চরিত্রটির ছবি স্পষ্ট হয়। রাজাবাহাদুরের মানবিকবোধের পরিচয় মেলে কীপারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের রুটি, বিস্কুট পয়সা দেওয়ার মধ্যে। মাতৃহারা শিশুগুলি রাজাবাহাদুরের মমত্ববোধে মুগ্ধ হয়। দোতলার জানলা থেকে পয়সা রুটি কিংবা বিছুট ছুঁড়ে দেন, নিচে এরা সেগুলো নিয়ে কুকুরের মতো লোফালুফি করে। শুধু তাই নয় কখনো কখনো রাজাবাহাদুর পকেটে হাত দিয়ে কতকগুলো পরশ ছড়িয়ে দিলেন এদের ভিতর। হরির লুটের মতো কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। কিন্তু গল্পের শেষে এই রাজাবাহাদুর টোপ হিসাবে কীপারের একটি ছেলেকে ব্যবহার করায় তার মধ্যে ধরা পড়ে যায় ভন্ডামি। যা মুহুর্তের মধ্যে রাজাবাহাদুরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের স্বচ্ছতায় কালিনালিও হয়ে পড়ে। রাজাবাহাদুর তখন আর রাজাবাহাদুরের পর্যায়ে থাকে না একটা শয়তানরূপে আমাদের সামনে উঠে আসে। একটি শিশুকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা এক আদিম বিকৃত মনোভাবের প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। বাঘ শিকারে যেখানে টোপ হিসেবে ব্যবহৃত হয় কোন এক ইতর প্রাণী সেখানে এক মানবশিশুকে ব্যবহার করা রাজাবাহাদুরের নাচ মনোভাবের পরিচায়ক। সেই প্রীতি ভালবাসা দিয়ে যেখানে শিশুদের হৃদয় জয় করা যায় সেখানে রুটি, বিস্কুট, পয়সা দেওয়ার পেছনে যে জঘন্য মানসিকতা কাজ করছিল তা রাসবাহাদরের ক্রিয়াকর্ণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। গল্পের শেষে লেখক শিশুটির গোঙ্গানি শুনে রাজাবাহাদুরকে প্রশ্ন করার লোকের বুকে রাজ্যবাহাদুর বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তার আত্মমর্যাদার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। লেখক বলেছেন-- "তখনই আনার চারিদিকে পৃথিবীটা পাক খেতে খেতে হাওয়ায় গড়া একটা বদদের মতো শুনো মিলিয়ে গেল। রাজাবাহাদুর জাপটে না করলে চারশো ফুট নিচেই পড়ে যেতাম হয়তো। রাসবাহাদুর যে রাজাবাহাদুর সেই আসল সত্যটাই এখানে ধরা পড়েছে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'টোপ' গল্পটি বেশ জনপ্রিয়। তাঁর সাহিত্যিক জীবনের প্রথম দিকের গল্প টোপ। গল্পটির বিষয় ভাবনার অভিনবত্ব লক্ষণীয়। গল্পটি অরণ্য পটভূমিকায় লেখা । সেই কাহিনীতে আছে দুটি চরিত্র— গল্পের কথক এবং শিকার বিলাসী রায়বাহাদুর। তার পাশাপাশি এসেছে কতকগুলি পার্শ্বচরিত্র। গল্পে অরণা প্রকৃতির অবস্থান সম্পর্কে লেখকের নিজের স্বীকারোক্তি— 'মনে পড়ল আটমাস আগেকার এক আরণ্যক ইতিহাস, একটি বিচিত্র শিকার কাহিনী। গল্পে একদিকে আছে অরণ্যের ইতিহাস, অন্যদিকে আছে রাজাবাহাদুরের শিকার কাহিনীর বর্ণনা। অরণ্যের ভয়াল পরিবেশে রাজাবাহাদুরের বাঘ শিকারের যে বর্ণনা গল্পে আছে তার প্রত্যক্ষদর্শী তো লেখক নিজেই। একদিনের একটি ঘটনা যা আটমাস আগে ঘটেছিল তা এসেছে বর্তমানের পটভূমিতে। অতীতের ঘটনাকে লেখক তুলে ধরেছেন। বর্তমান 'ঘটনার প্রেক্ষাপটে অতীত ঘটনার চিত্রায়ণ। পশ্চাদ উদভাষণ রীতিতে (flash back) ঘটনাটি তুলে ধরতে গিয়ে বর্তমান আর বর্তমানে থাকে না। অতীতের ঘটনাই বর্তমান হয়ে দাঁড়ায়।

গল্পের শুরুতেই নাটকীয়তা। একদিন সকালে লেখকের কাছে একটি পার্সেল আসার ঘটনায় গল্পের শুরু। সকালে একটা পার্সেল এসে পৌঁছেছে। খুলে দেখি একজোড়া জুতো।' পার্সেলে জুতো পাঠানোর প্রেরককে খুঁজতে গিয়ে রাজাবাহাদুরের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় আটমাস আগের একদিনের ঘটনা। যে ঘটনা আজও লেখকের মনে হলে তা অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিন্তু ঘটনাটা সত্যি। পার্সেলের সঙ্গে ছিল সবুজ কার্ড আর সেই কার্ডে লেখা 'উইথ বেস্ট কমপ্লিমেন্টস অব রাজাবাহাদুর এন. আর. চৌধুরী, রামগঙ্গা এস্টেট, রাজাবাহাদুরের শিকার পর্ব, রয়াল বেঙ্গল টাইগার, কীপারের সেই ছোট্ট ছেলেটা।

গল্পের কাহিনী হল রামগঙ্গা এস্টেটের রাজাবাহাদুরের শিকার কাহিনী নিয়ে। শিকার করা রাজাবাহাদুরের নেশা। রাজরাজড়াদের অনেক রকমের নেশা থাকে তার মধ্যে শিকার করার নেশাটা একটা বাড়তি মাত্রা পায়। একটা এস্টেটের রাজাবাহাদুর মানে বিরাট তার প্রতিপত্তি। এরকম একজন লোকের সঙ্গে লেখকের আলাপ হয়। আর সেই আলাপের সূত্র ধরে রাজাবাহাদুরের জন্মবাসরে লেখকের কবিত্বশক্তির গুণে উপরি পাওনা হিসেবে জুটেছিল একটি হাতঘড়ি। এর ফলে লেখকের শ্রদ্ধা জন্মায় রাজাবাহাদুরের ওপর। এরপর লেখকের ডাক পড়ে রাজাবাহাদুরের শিকার যাত্রার সহযাত্রী হিসেবে। লেখক খুশী হন। কোনকিছু না ভেবে লেখক কলকাতা থেকে সোজা চলে আসেন রাজাবাহাদুরের কাছে। রাজাবাহাদুরের দুপাশে শালবনের জঙ্গল দেখতে এসে পৌঁছান রাজাবাহাদুর এন. যার চৌধুরীর হান্টিং বাংলোর সামনে। বাড়টি দেখে লেখকের মনে হয়েছে— 'এই নির্বিত জঙ্গলের ভেতর যেমন আকস্মিক, তেমনি অপ্রত্যাশিত।

গল্পের প্রধান চরিত্র রাজাবাহাদুর। লেখক তাঁর শিকার কাহিনী বর্ণনার মধ্য দিয়ে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলে পরেছেন। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরতে গিয়ে বর্ণনা সংক্ষিপ্ত হলে ভাল হত। গল্পে আর একটি চরিত্র প্রার্থনা তিনি হলেন লেখক নিয়ে। লেখক এখানে কথকের ভূমিকা নেওয়ায় তাকে কখন বলতে কোনো অসুবিধা হয় না। ঘরের মধ্যে তার পরিচয় দুটা হিসেবে। রাজাবাহাদুরের শিকার পর্বের সাক্ষী তিনি। রাজাবাহাদুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন---- রাজাবাহাদুরের সঙ্গে আলাপের ইতিহাসটা ঘোলাটে, সূত্রগুলো এলোমেলো। গল্পের কথক কবি। তাঁর কাব্যচর্চার পরিচয় মেলে গল্পের প্রথনে। রাজাবাহাদুরের জন্মদিনে তাঁকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লেখার তিনি রাজাবাহাদুরের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। সোনার হাতঘড়ি উপহার হিসেবে মেলে। রাজাবাহাদুরের প্রতি জমায় কৃতজ্ঞতা আর তার জন্য লেখক বলেন – 'রাজাবাহাদুরকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু লেখকের বন্ধুরা তাঁকে রাজাবাহাদুরের মোসাহেব' বলায় লেখক অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন -- আমি জানি এটা নিছক গায়ের জ্বালা আমার সৌভাগ্য এদের ঈর্ষা। তা আমি পরোয়া করি না। নৌকা বাঁধতে হলে বড় গাছ দেখে বাঁধাই ভালো, অন্তত ছোট-খাটো বড় ঝাপটার আঘাতে সম্পূর্ণ নিরাপদ। কথকের প্রকৃতিপ্রীতির পরিচয় আছে এ গল্পে। গল্পের বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে আছে প্রকৃতিচিত্র। রাজাবাহাদুরের রোলস রয়েস চড়ে বাংলোতে যাওয়ার পথের দৃশ্য দেখে কথকের অনুভূতি— 

(১) পথের দুপাশে তখন নতুন একটা জগতের ছবি 

(২) 'বনের রূপ দেখতে দেখতে চলেছি', 

(৩) প্রকৃতির এমন অপূর্ব রূপ জীবনে আর দেখিনি।

কথকের রোলস রয়েসে ওঠা এবং হান্টিং বাংলোর সামনে নানা পর্যন্ত একটা অধ্যায়। সেখানে কথক একা এবং তার চিন্তাভাবনার মধ্যে পড়েছে এর প্রকৃতি। কিন্তু হান্টিং বাংলোতে এসে রাজাবাহাদুরকে দেখা, তার চালচলন আচার ব্যবহার কখনও কখনও কথককে মুগ্ধ করেছে বটে আবার কথক রাজাবাহাদুরের ব্যবহারে ভয় পেয়েছে। রাজাবাহাদুরের আন্তরিকতা, সখ্যতা, অতিথি বাৎসল্য দেখে রাজাবাহাদর সম্পর্কে কথকের ধারণা তাঁকে মহিমান্বিত করে তোলে! কথক কখনও কখনও তাঁর মনের গোপন অনুভবটুক প্রকাশ করে ফেলেছেন। হান্টিং বাংলোর বাথরুমে দেখে কথক বলেছেন -- এমন একটা বাথরুন জীবনে আমি স্নান করিনি।' নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে কথকের সচেতনতার প্রকাশ ঘটে সা পাজামাটা পরার মধ্য দিয়ে। এবং দায়িত্ববোধের পরিচয় মেলে তার কথায়---- পরের পয়সায় রাজভোগ থেরে এবং রাজোচিত বিলাস ঘরে বেশিদিন কাটানো আর সম্ভব নয় আমার পক্ষে। রাজাবাহাদুরের অনুগ্রহ একটা দেশে জিনিস বটে, কিন্তু কলকাতায় আমার ঘর-সংসার আছে, একটা দায়িত্ব আছে আমার। কখকবে বাস্তব জগত থেকে একটা স্বপ্নের জগতে আছেন তা যার একবার প্রমাণিত হয় তাঁর কথায়- জীবনে এমন দামী বাবার কোনো দিন নখে তুলিনি', 'এমন চমৎকার বাথরুমে স্নান করিনি কখনো!", "এত পুরু অাজিনের বিছানার শুনে অসস্থিতে প্রথম দিন তো ঘুনতেই পারিনি আমি। এসব উক্তির মধ্য দিয়ে।

কথকের গভীর প্রীতির পরিচর মেলে গল্পের একেবারে শেষে। কীপারের এক শিশুকে বাঘের টোপ হিসেবে ব্যবহার করার কথা জানতে পেরে কথক পাগলের মত চাঁৎকার করে উঠে বলেছেন--- রাজাবাহাদুর কিসের টোপ আপনার। কী দিয়ে আপনি না করলেন। কীপারের শিশুটির গোঙানি আর কথকের চাকার করে যেন এক হয়ে যায়। শিশুটির গোঙ্গানি আর কথকের চাংকারকে কোনতেই আলাদা করা যায় না। রাবারের কাছে চাৎকার করে কথা বলাটা কথকের প্রতিবাদ করা ছাড়া আর কিছু নয়। দুর্বলের প্রতি কথকের এই সহানুভূতি কথককে একটা আলাদা মর্যাদা দেয়। রাজাবাহাদুরের আন্তরিক প্রীতি, সখ্যতা এসব কথকের কাছে ঘৃণার বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। কথকের হীনমনা মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে গল্পের প্রথম থেকে। নিজেকে নিজে বাঙ্গ করেছেন কথক। কথক আর রাজাবাহাদুর আসলে দুই মেরুর বাসিন্দা। কথক মধ্যবিত্ত মানসিকতার ঘেরাটোপ বন্দী আর রাজাবাহাদুর তাঁর সামন্ততান্ত্রিকতার বিস্তৃত প্রান্তরে উন্মুক্ত বিহঙ্গ তাই দুজনের আচার-আচরণে চালচলনে খাপ খায় না। কখকের হীনমন্য মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে-

(১) চনংকার ঝকঝকে বাঘের চামড়ার নতুন চটি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, পায়ে দিতে লজ্জাবোধ হয় দস্তরনতো। ইচ্ছে করে বিছানায় শুইয়ে রাখি।'

(২) 'সেই গন্ধমাদন থেকে যা পারি গোগ্রাসে গিলে চললাম আমি।'

(৩) 'এখানে ঢোকবার পরে এত বিচিত্র রকমের আসনে বসছি যে আমি প্রায় নার্ভাস হয়ে উঠেছি।

(৪) জীবনে এমন দামী খাবার কোনো দিন মুখে তুলি নি, এমন চমংকার বাথরুমে স্নান করিনি কখনো, এত পুরু জাজিমের বিছানায় শুয়ে অস্বস্তিতে প্রথম দিনতো ঘুমুতেই পারি নি আমি।'

গল্পের একবারে শেষে কথকের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে গেছে তা বোঝা যায় শেষ অনুচ্ছেদটিতে— 'তার ঘাটনাস পরে এই চমৎকার চটিজোড়া উপহার এসেছে। আট মাস আগেকার সে রাত্রি এখন স্বপ্ন হয়ে যাওয়াই ভালো, কিন্তু এই চটিজোড়া অতি মনোরম বাস্তব। পারে দিয়ে একবার হেঁটে দেখলাম, যেমন নরন, তেমনি আরান। যে চটিজোড়া বিছানায় শুইয়ে রাখার কথা গল্পের প্রথমে বলেন গল্পের শেষে সেই চটিজোড়া পরে হাঁটার পরে তাঁর মানসিকতার পরিবর্তন প্রকাশ পায়। গল্পের মূল ঘটনার সঙ্গে যেমন জড়িত রাজাবাহাদুর সেরকম জড়িত কথক নিজেও। রাজাবাহাদুর কথককে তার শিকার পর্ব দেখানোর জন্যই তো শিশুটিকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে। রাজাবাহাদুরের এই অমানবিক কাজকে কোনমতেই সমর্থন করা যায় না কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে কণকেরও একটা ভূমিকা ছিল রান্নাবাহাদুরকে নিরস্ত করার। রাজাবাহাদুরের সঙ্গে কথকের ঘনিষ্ঠতার সুবাদে কথক যদি শিকারের গোপন রহস। একটু খুঁটিয়ে জানার চেষ্টা করতেন তাহলে এই অমানবিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তাকে হতে হত না। কিন্তু কথক সে চেষ্টা করেননি। যতই মুখে কথক তাঁর শ্রেণী সচেতনতার পরিচয় তুলে ধরুন না কেন তার মধ্যে যে সুবিধাবাদী মানসিকতা বহুলাংশে কাজ করেছে তার প্রমাণ মেলে শিকার করা সেই বাঘের চামড়ায় তৈরী নরম চটি পায়ে দিয়ে হাঁটার মধ্য দিয়ে।

গল্পের মাধ্যে প্রকৃত বর্ণনা লক্ষ্য করা যায়। অরণ্য পটভূমিকায় গল্পটি লেখা। তরাই- এর জঙ্গল গল্পের পটভূমি। গল্পের প্রথমেই লেখক বলেছেন- মনে পড়ল আট মাস আগেকার এবং যারণাক ইতিহাস, একটি বিচিত্র শিকারকাহিনী। আরণ্যক' শব্দটি থাকায় অরণ্য পরিবেশের কথাই স্পষ্ট হয়। বিভূতিভূষণের আরণ্যক' উপন্যাস তারণাপ্রকৃতিরই প্রাধান্য লাভ করেছে। প্রকৃতির শান্ত কোমলরাপের পরিচয় কেমন মাছে সেরকম তার ক কঠোর রূপের পরিচয়ও আছে। আর সেই অরণ্য প্রকৃতিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। কতকগুলি মানুষ তারা বিভিন্ন শ্রেণীভুক্ত, বিভিন্ন ধরনের মানুষ। কিন্তু 'টোপ' গল্লে আছে 'তরাই'-এর জঙ্গলের কথা। কিন্তু নিচের এই যে দলটি দেখতে পাচ্ছেন, এটি বড় সুবিধার জায়গা নয়। টেরাইয়ের ওয়ান অব দি স্ফিয়ারেস্ট ফরেস্ট। একেবারে প্রাগৈতিহাসিক হিংস্রতার রাজত্ব। গল্পে প্রকৃতি বর্ণনা বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায়। সেগুলি হল-

১. পথের দু'পাশে এখন নতুন একটা জগতের ছবি। সবুজ শালবনের আড়ালে আড়ালে চা বাগানের বিস্তার চকচকে উজ্জ্বল পাতার শাক্ত, শামিল সমূদ্র। দূরে আকাশের গায়ে কালো পাহাড়ের রেখা।

২. বাতাসে গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির মতো শালের ফুল ঝরে পড়ছে পথের পাশে। উে আসছে গায়ে। কোথা থেকে চকিতের জন্যে নয়ূরের তীক্ষ্ণ চীৎকার ভেসে এল। দুপাশে নিবিড় শালের বন, কোথাও কোথাও ভেতর দিয়ে খানিকটা খানিকটা দৃষ্টি চলে, কখনো কখনো বুনো ঝোপে আচ্ছন্ন।

৩. চারশো ফুট নীচে ওই অতিকায় জঙ্গলটাকে একটা নিরবচ্ছিন্ন, বেঁটে গাছের ঝোপ বলে মনে হচ্ছে, নদীর রেখাটাকে দেখাচ্ছে উজ্জ্বল একখানা পাতের মতো। আশ্চর্য সবুজ, আশ্চর্য সুন্দর। অফুরন্ত রোদে ঝলমল করছে অফুরন্ত প্রকৃতি পাহাড়টা যেন গাঢ় নীল রং দিয়ে আঁকা।

যেহেতু গল্পটির বিষয় শিকার কাহিনী তাই অরণা পরিবেশে যে গল্পটি এগোবে তা বলাই বাহুল্য। হিংস্র বাঘ শিকার করার ঘটনাটি ঘটেছে একেবারে গল্পের শেষে। কিন্তু তার আগে ওয়ান অব দি ফিয়ারেস্ট ফরেস্টস' কথাগুলি বারবার রাজাবাহাদুরের কাছ থেকে শোনা গেছে। সুতরাং সেই জঙ্গলের বর্ণনাই গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে। গল্পের নামকরণটি ব্যঞ্জনাধর্মী। গল্পের সেই টোপটি যে একটি মানবশিশু তা গল্পের শেষে জানা যায়। শিশুটির গোঙানিই সেই সত্যকে প্রমাণিত করে। গল্পের ক্লাইম্যাক্স একেবারে শেষে চারশো ফুট নীচে গভীর খাদে টোপটি নামিয়ে দিয়ে বাঘ শিকারের আয়োজন, আবার টর্চের আলোর গল্পের সেই চরনক্ষণ উপস্থিত। পুঁটলিটা যেন জীবন্ত অথচ কী জিনিস কিছু বুঝতে পারছি না। ও নাকি নাছের টোপ। কিন্তু কী এ মাছ- এ কিসের টোপ তখনই লেখকের মনে একটা সন্দেহ দেখা দেয়।

'টোপ' গল্পের নামেই মূল গল্পের কেন্দ্রবিন্দু স্পষ্ট। লেখকের প্রধান বিষয় ছিল একটি বিচিত্র শিকার কাহিনীকে ভাষারূপ দেওয়া তাই তার পরিচয় গল্পে বেশ কিছুটা জায়গায় আছে তার প্রমাণ টোপ সম্পর্কিত ভাবনায় -

১. তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন, প্রায়ই চা খাওয়াতে লাগলেন, তারপর সামান্য একটা উপলক্ষ্য করে দামী একটা সোনার হাত ঘড়ি দিয়ে বসলেন এক সময়ে। 

২. ব্রাকেটে ধোপদুরস্ত ফরাসডাঙার বৃত্তি, সিলের লুঙ্গি..

৩. তবে ভালো টোপ ছাড়া আমার পছন্দ হয় না, আর তাতে অনেক সময়।

গল্পের শৈলী ও সমরেশ বসু ও অন্যান্য

ক) মনে পড়ল আটমাস আগেকার এক আরণ্যক ইতিহাস, একটি বিচিত্র শিকার কাহিনী'। বর্তমান থেকে অতীতে যাওয়া আবার অতীত থেকে বর্তমানে আসা। এভাবেই গল্পটি এগিয়েছে। তারাশংকরের 'না' গল্পটির প্রথমে আছে আট বৎসর পূর্বে ঘটিয়াছিল যে হত্যাকান্ড, তাহারই বিচার।' তারপরে ঘটনা শুরু হয়েছে। 'টোপ' গল্পের শুরু পার্সেলে একজোড়া জুতো আসার ঘটনায়। কীভাবে জুতো জোড়াটা এল সেকথা বলতে বলতে লেখক পুরোপুরি গল্পটি শেষ করেছেন এবং শেষ অনুচ্ছেদে ঐ জুতোজোড়াটি পায়ে দিয়ে লেখক গল্পটি শেষ করেছেন।

৪. গল্পে কবিতার ব্যবহার লেখক যে কবি তার প্রমাণ মেলে চার লাইনের কবিতা প্রয়োগে। রাজাবাহাদুরের জন্মদিনে তাঁর কীর্তিকে অবলম্বন করে কবিতা লিখে রাজাবাহাদুরের নজরে পড়েন এবং উপঢৌকাও লাভ করেন। চার লাইনের কবিতা-

ত্রিভুবন প্রভা কর ওহে প্রভাকর।

গুণবান নহীয়ান হে, রাজেন্দ্রবর। 

ভূতলে অতুল কীর্তি রামচন্দ্র সন- 

অরাতিদমন ওহে তুমি নিরুপম।

৫. বাক্যগঠন— বাক্যগঠনে লেখকের মুন্সীয়ানার পরিচয় মেলে।

ক) রাজাবাহাদুরের সঙ্গে আলাপের ইতিহাসটা ঘোলাটে, সূত্রগুলো এলোমেলো। খ) একেবারে প্রাগৈতিহাসিক হিংসার রাজত্ব।

'ক' উদাহরণে 'ঘোলাটে' এবং 'এলোমেলো' শব্দ দুটির বাহ্যিক অর্থ প্রায় একই। তবে এর অন্তর্নিহিত অর্থ হল 'ঘোলাটে' বিস্মৃত অবস্থা এবং 'এলোমেলো' খাপছাড়া সংবদ্ধ নয় এই অর্থ প্রকাশ করছে।

৩. বাক্য বিশ্লেষণ — একটি বাক্য – এখানে হাতীর পাল ঘুরছে দূরের কোন পাহাড়ের পাথর গুঁড়িয়ে শুঁড়িয়ে, ঝোপের ভেতরে অগের প্রতীক্ষা করে আছে অসতর্ক শিকারের আশায়, আসন্ন বিষাদের সম্ভাবনায় উৎকর্ণ হয়ে আছে হরিণের পাল আর কোনো একটা খাদের ভেতরে জলজল করছে ক্ষুধার্ত বাঘের চোখ।

বাক্যটিকে চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে

ক) এখানে হাতীর পাল ঘুরছে দূরের কোন পাহাড়ের পাথর গুঁড়িয়ে শুঁড়িয়ে। 

খ) ঝোপের ভেতরে অগর প্রতীক্ষা করে আছে অসতর্ক শিকারের আশায়। 

গ) আসন্ন বিষাদের সম্ভাবনার উৎকর্ণ হয়ে আছে হরিণের পাল।

ঘ) যার কোনো একটা খাদের ভেতর জলঙ্গন করছে ক্ষুধার্ত বাঘের চোখ । হাতী, অজগর, হরিণ এবং বাঘ চারটি পশুর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে একটি বাকে৷ যা ভাঙলে আলাদা আলাদা থাকো পরিণত হলেও অর্থের কোন বিচ্যুতি ঘটে না।


 

Post a Comment

0 Comments