কার্ল মার্কসের শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব।

 

কার্ল মার্কসের শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব।

                                      ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার ভিত্তিতে রচিত শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব মার্কসবাদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। Communist Manifestoতে মার্কস সুস্পষ্ট ভাষায় লেখেন—“মানুষের ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামরে ইতিহাস। এই সংগ্রাম শোষক শোষিত শ্রেণীর মধ্যে, সমাজ বিবর্তণের বিভিন্ন স্তরে শাসক শোষিত শ্রেণীর মধ্যে।যেখানেই শ্রেণীভেদ, সেখানেই শ্রেণী সংঘাত বা সংঘর্ষ। মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে জীবন ধারণের জন্য দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে হলে উৎপাদন করতে হয়। প্রত্যেক সমাজের দুটি পরস্পর বিরোধী শ্রেণী থাকে। অর্থনীতিতে অগ্রসর ধনী শ্রেণী সব সময়েই শোষিত শ্রেণীর উপর তাঁর প্রাধান্য স্থাপন করে। রাষ্ট্রযন্ত্র বা রাষ্ট্র কাঠামোর সব কিছুই থাকে তার হাতের মধ্যে। প্রাচীন কালে এই শোষণ সংগ্রাম ছিল দাস মালিক দাসদের মধ্যে। আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোয় পরস্পরবিরোধী এই দুই শ্রেণী হল বুর্জোয়া পুঁজিপতি শ্রেণী সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণী। উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে মার্কস দেখান কীভাবে মালিক শ্ৰেণী শ্রমিক শ্ৰেণীকে শোষণ করেন। এই সংঘাতের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন,–এই শ্রেণী সংগ্রাম শেষ শ্রেণী সংগ্রাম এবং এই সংগ্রামের অবসানে বুর্জোয়া ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অবসান হবে। অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর কাছে মালিক শ্রেনীর পরাজয় হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে সর্বহারা একনায়কতন্ত্র। শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব মার্কসবাদের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হলেও মার্কস এই তত্ত্ব তুলে ধরেণনি এবং তিনি তা স্বীকারও করেন। তিনি লিখেছেন—Long before me bourgeois historians had described the historical development of this class struggle, তাঁর হাতেই এই তত্ত্ব পূর্ণতা পায়। শ্রেণী সংগ্রামের অবসানে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র স্থাপিত হবে বা এক শোষনমুক্ত সমাজের আবির্ভাব হবে তা আগে বলা হয়নি। মার্কসের সমালোচনার সঙ্গে অনেকেই একমত নন। প্রথমত, মার্কস ইতিহাসকে পর্যবেক্ষণ করেন অবিরত এক সংগ্রামের নিরিখে। দয়া-মায়া-মমতা নয় তাঁর বর্ণিত সমাজ ব্যবস্থায় আছে হিংসা ঘৃনা। সহনশীলতা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃষ্টিগোচর হয়নি। তিনি শ্রেণী সংগ্রাম ব্যাখ্যা করেও মৌলিক বিচ্যুতির বিষয়ে সমালোচনা করেন। অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলেনসব ইতিহাসই শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাসমার্কসবাদীর এই বক্তব্য অতি সরল। দ্বিতীয়ত ইতিহাসে শ্রেনী সংযোগীতার কোন উদাহরন নেই।

সর্বোপরী বলা যায় শিল্পোন্নত সমাজে শ্রেণী বিন্যাস মার্কস যেমনটি ভাবেন তেমন হয়নি। শোষক শোষিত সম্পূর্ন পরস্পর বিরোদী বহির্ভুত এই দুটি শ্রেনীতে সকল সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেমার্কসের এই ভবিষ্যতবাণী সফল হয়নি। তিনি সমাজকে দুটি পরস্পরবিরোধী শিবিরে বিভক্ত করেও বাস্তব জ্ঞানের পরিচয় দেননি সমাজে মাত্র দুটি নয় আরও অনেক শ্রেনী থাকে এবং তার আরও উপবিভাগ থাকে। মার্কসের মৃত্যুর পর ১০০ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও আজও শ্রেনীহীন শোষনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি বা রাষ্ট্রের বিলোপ ঘটেনি। তবে শ্রমিকদের অবস্থা আগে থেকে খানিকটা উন্নত হয়েছে।

Post a Comment

0 Comments