দেব সেনাপতি কার্তিকের জন্ম-উপাখ্যান

 দেব সেনাপতি কার্তিকের জন্ম-উপাখ্যান

কার্তিকেয় বা কার্তিক হিন্দুদের কাছে যুদ্ধ-দেবতা হিসাবে পরিচিত। কার্তিকের একাধিক নাম, যেমন— কৃত্তিকাসুত, বিশাখ, অম্বিকেয়, ষড়ানন, শক্তিপাণি, ক্রৌঞ্চারতি, তারকারি, বাহুলেহ, সৌরসেন, কুমার, নমুচি, অগ্নিজ প্রভৃতি ।

মহাকবি কালিদাস তাঁর কুমারসম্ভব কাব্যে ‘কুমার’ অর্থাৎ কার্তিকের জন্মকথা বর্ণনা করেছেন। এই কাব্যে সতেরোটি স্বর্গে (মতান্তরে আঠারোটি) এই দেবতার জীবনকথা কবির লেখনীতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। বায়ুপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, বরাহপুরাণ, কালিকাপুরাণ, মৎসপুরাণ ইত্যাদি গ্রন্থে কার্তিকের জন্ম নিয়ে নানারকম তথ্য পাওয়া যায়।

কৃত্তিকা নক্ষত্রে কার্তিকের জন্ম হয়েছিল। ছয় কৃত্তিকার (ধাত্রী) দ্বারা তিনি পুত্র রূপে গৃহীত এবং প্রতিপালিত হয়েছিলেন বলেই তাঁর নাম হয়েছিল কার্তিক। ব্রহ্মার করে তারকাসুর নিধন করার জন্যই এমন অমিতবিক্রম তেজোময় যোদ্ধা দেবতার জন্ম হয়েছিল বলে বিভিন্ন উৎসে বর্ণনা আছে। আবার শিবের রুদ্ররূপের (অগ্নি) সঙ্গে এক হওয়ার পর মহাদেব সপ্ত ঋষি পত্নীদের রূপে কামমোহিত হয়ে পড়েন। তাঁকে তুষ্ট করতে স্বাহা (অগ্নিদেবের স্ত্রী) অরুন্ধতী ছাড়া বাকি ছয় ঋষি পত্নীর (সম্ভূতা, অনসূরা, ক্ষমা, সন্নতি, প্রীতি, ও লজ্জা) ছদ্মবেশ ধারণ করে ছ'বার অগ্নির সঙ্গে মিলিত হন। এর ফলে ছ’মাথা, দ্বাদশ বাহুযুক্ত যে কুমারের জন্ম হয় তিনি ত্রিভুবনে কার্তিক নামে খ্যাত হন। আলোচ্য গল্পে অগ্নিদেব সম্ভূত সেই দেব কার্তিকেরের অপূর্ব জন্মকথা তুলে ধরা হলো।

মূল গল্পটি মহাভারতের বনপর্বের ২০১-২৩৭ তম অধ্যায়ে পাওয়া যায়। বুধিষ্ঠির মার্কণ্ডের ঋষিকে জিজ্ঞাসা করলেন- “হে ভার্গবশ্রেষ্ঠ! অগ্নিদেবের বিষয়ে অনেক কিছুতো বললেন। এখন অগ্নিপুত্র কার্তিক কিভাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে সম্পর্কে যদি বলেন, তা শুনে ধন্য হই।”

ঋষিশ্রেষ্ঠ মার্কণ্ডেয় বললেন— “পাণ্ডবনন্দন! পুরাকালে দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে নিত্য বিবাদ লেগে থাকতো। ঐ সব যুদ্ধে দানবরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জয়লাভ করতো। তখন দেবরাজ দেখলেন যে দিনে দিনে তাঁর সৈন্য সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। তাই দেব সৈন্যদের রক্ষা করা এবং তাদের যোগ্য নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন তেজস্বী সেনানায়ক নিয়োগ করা বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। মনের মধ্যে এই রকম চিন্তা চলছে, সেই সময় তিনি একদিন মানস পর্বতে গিয়েছিলেন। তখন হঠাৎ তিনি এক নারীকণ্ঠের কাতর আর্তনাদ শুনতে পেলেন— “কোন পুরুষ এখানে কাছাকাছি থাকলে তাড়াতাড়ি এসে আমাকে বাঁচান। ”

দেবরাজ সেই ডাক শুনে সেখানে পৌঁছালেন এবং বললেন— “ভয় পেয়ো না, আমি আছি।” দেখলেন দুদ্ধর্ষ কেশী দানব ভয়ংকর গদা হাতে নিয়ে একটি মেয়েকে হরণ করার চেষ্টা করছে। সেই দৃশ্য দেখে দেবরাজ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন- “ওরে দুরাচারী! কেন তুই এই মেয়েটির উপর বলপ্রয়োগ করছিস ? আমি দেবরাজ বজ্রধারী ইন্দ্র, আমার সামনে তুই এর কোন ক্ষতি করতে পারবি না।”

কেশী বলল— “ওহে ইন্দ্ৰ! তুই এই মেয়েটিকে আমার হাত থেকে কিছুতেই রক্ষা করতে পারবি না। তোকে ক্ষমা করে দিচ্ছি। প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরে যা।” – এই বলে সে তার ভয়ংকর গদাটি ইন্দ্রকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল।

পুরন্দর সেই গদাটি বজ্রাস্ত্র প্রয়োগ করে ভেঙে গুড়িয়ে দিলেন। কেশী তখন আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বিশাল বড় পাথরের একটি চাঁই ইন্দ্রকে ছুঁড়ে মারল। পাথরটি আসছে দেখে ইন্দ্ৰ নিজের অস্ত্র প্রয়োগ করে তাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিলেন। আবার সেই পাথরের একটি টুকরো গিয়ে কেশীর গায়ে পড়তে কেশী বেশ চোট পেল। এরপর সে ভয় পেয়ে মেয়েটিকে ফেলে দ্রুত পালিয়ে গেল। দানব কেশী চলে গেলে দেবরাজ কন্যাটিকে জিজ্ঞাসা করলেন- “শুভাননে! কে তুমি ? তোমার পিতা কে ? কিভাবে এখানে এলে ?”

কন্যাটি উত্তর দিলেন- “আমি প্রজাপতি কন্যা দেবসেনা। আমার বোনের নাম দৈত্যসেনা। আমরা দু'বোন। পিতাকে জানিয়ে খেলাধূলা করার জন্য এই পর্বতে নিয়মিত আসতাম। কেশী রোজ আমাদের অনুসরণ করতো। আমার বোন তাকে পছন্দ করতো। কিন্তু আমি তাকে একদম পছন্দ করতাম না। তাই সে ইতিমধ্যে আমার বোনকে হরণ করতে সফল হলেও আমাকে পারেনি। আজ সুযোগ বুঝে আমার উপর জোর খাটাচ্ছিল। ভাগ্যিস আপনি এসে আমাকে রক্ষা করলেন। এখন আপনি আমার জন্য একজন পরাক্রমী বীরপুরুষ ঠিক করে দিন, যাকে আমি স্বামী রূপে বরণ করতে পারি।”

ইন্দ্র বললেন— “আমার মা দক্ষকন্যা, অদিতি। তাহলে তুমি হলে আমার মাসতুতো বোন। তাই নিঃসঙ্কোচে বলো, তুমি কেমন স্বামী চাও ?”

কন্যাটি বললেন— “হে দেবরাজ। আমি একজন অবলা, তবে আমার বাবার আশীর্বাদে আমি এমন একজনকে স্বামী-রূপে পাবো যিনি দেবতা, দানব, যক্ষ, কিন্নর প্রভৃতি সকলের কাছে শক্তিমান পুরুষ হিসাবে স্বীকৃতি পাবেন। যিনি দিগ্বিজয়ী বীর হবেন।'

দেবরাজ ইন্দ্র কন্যাটির কথা শুনে চিন্তায় পড়লেন। কারণ মেয়েটি যেমন সর্বগুণসম্পন্ন পতি চাইছেন, হাতের কাছে তিনি তেমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছেন না। তখন তিনি সেই কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে ব্রহ্মলোকে চললেন। তারপর প্রজাপতি ব্রহ্মাকে প্রণাম করে বললেন- “হে বিধাতা! আপনি এই মেয়েটির জন্য উপযুক্ত কোন সৎপাত্রের সন্ধান দিন।”

ব্রহ্মা প্রত্যুত্তরে বললেন- “হে দানবনিসূদন। মহাতেজা অগ্নি থেকে এক মহাপরাক্রমশালী বালক জন্ম নেবে। সে-ই হবে এই কন্যার পতি। ঐ বালক আবার তোমার সেনাধ্যক্ষ হিসাবেও নিজেকে যোগ্য করে তুলবে।”

প্রজাপতি ব্রহ্মার কথা শুনে পুরন্দর অত্যন্ত খুশি হলেন। তারপর ব্রহ্মদেবকে নমস্কার জানিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। এরপর তাঁরা সেখানে উপস্থিত হলেন যেখানে ঋষি বশিষ্ঠ সহ অন্যান্য মুনি-ঋষিরা যজ্ঞ করছিলেন। ঋত্বিকেরা বিভিন্ন দেবতার নাম ধরে ধরে তখন হব্য আহুতি দিচ্ছিলেন। আমন্ত্রিত দেবতারাও সেই যজ্ঞে উপস্থিত হারে যজ্ঞের ভাগ নিচ্ছিলেন। এক সময় অগ্নিদেবকে যখন আহ্বান করা হলো তিনিও যাক্সে এসে যজ্ঞের ভাগ নিলেন। তারপর হঠাৎ অগ্নিদেব ঋবিপরীদের দেখে বিচলিত বোধ করতেন। বদিতীরা তখন কেউ বসে ছিলেন, কেউ বিশ্রাম করছিলেন, কেউ আবার নির্বাচক ছিলেন। তাদের হাতোদের রূপ-সৌন্দর্য ভগবান হুতাশনকে মোহবিষ্ট করলো। তিনি তখন চিন্তা করলেন পরিপাটীরা কেউই আমার প্রতি অনুরক্ত হননি। অথচ আমি এক তরকা হচ্ছি। তাঁর এই ভাবান্তর তাঁকে নিদারুণ লোন যে, তিনি অগ্নিগৃহে প্রবেশ করে হগুত্রে প্রবেশ করলে তাঁর শিখাগুলি তিনি তখন আদার সরে হরে । সেই আলো-স্মৃতি এরপর মহবি-জরাদের স্পর্শ করল। কিন্তু তাতেও কোন মহিলাই তাঁর প্রতি অনুরাগ দেখালেন না। কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন অত্যন্ত পতিব্রতা এবং শুদ্ধাচারী। তখন অগ্নিদেব অনুতপ্ত হয়ে নিরাশ চিত্তে দেহত্যাগ করার উদ্দেশ্যে বনে চলে গেলেন।

ইতিমধ্যে দক্ষকন্যা অগ্নি-পত্নী ‘স্বাহা' মানস চক্ষে সমস্ত ঘটনা অবলোকন করলেন। স্থির করলেন ঋষি পত্নীদের রূপ ধরে তিনি অগ্নিদেবের অশান্ত মনকে শান্ত করবেন। এর ফলে স্বামীর প্রতি তাঁর নিজের টান যেমন বাড়বে, তেমনি স্বামী অগ্নিদেবও স্ত্রী-সঙ্গ পেয়ে আনন্দিত হবেন। সেইমত প্রথমে তিনি ঋষি অঙ্গিরার স্ত্রী শিবার রূপ ধারণ করে দেব হুতাশনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং বললেন- “আমার নাম শিবা, আমি আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছি। আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন। বাকি ঋষিপত্নীরা আমাকে পরামর্শ দিয়ে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।”

অগ্নিদেব বললেন— “আমি অত্যন্ত প্রণয়াকাঙ্খী হয়ে পড়েছি, এটি ঠিক। কিন্তু তা তুমি কি করে জানলে ? বাকি ঋষি-পত্নীরাইবা আমার এই দুর্বলতা কি করে

জানলো।”

শিবারূপী স্বাহা বললেন— “আপনি চিরকালই আমাদের প্রণয়াস্পদ ছিলেন। কিন্তু আপনাকে বলতে সাহস পেতাম না। এখন আপনার দিক থেকে সংকেত পেয়ে আজ মনের কথা খুলে বললাম। এখন আমার মনোবাসনা পূর্ণ করুন।”

তখন হুতাশন আবেগাপ্লুত হয়ে স্বাহার পাণিগ্রহণ করলেন। দেবী স্বাহা এরপর অগ্নির তেজ-জ্যোতি হাতে নিলেন এবং ঐ স্থানে দীর্ঘক্ষণ থাকা ঠিক নয় ভেবে স্থানটি ত্যাগ করলেন। এরপর বনাঞ্চল থেকে বেরিয়ে স্বাহাদেবী শ্বেত পর্বতে উপস্থিত হলেন। সেই স্থানটি ভয়ঙ্কর রাক্ষস-রাক্ষসী, ভূত-পিশাচ সহ নানারকম পশু-পাখিতে পরিপূর্ণ ছিল। স্বাহা সেই দুর্গম শ্বেত-পর্বতে সেই অগ্নিজ্যোতি (বীর্য) একটি সুবর্ণকুণ্ডে রাখলেন। এরপর পুনরায় বনে গিয়ে বাকি ঋষি-পত্নীদের রূপ ধারণ করে একই ভাবে তিনি মহাতেজা অগ্নির সঙ্গে সমাগম করলেন। শুধুমাত্র অরুন্ধতীর রূপ ধারণ করতে তিনি পারলেন না। কারণ অরুন্ধতী ছিলেন অসামান্য পতিব্রতা এবং দিব্য-স্বভাব সম্পন্না। এইভাবে মোট ছ'জন মহর্ষি পত্নীর রূপ ধারণ করে দেবী স্বাহা প্রতিপদ তিথিতে ছ'বার অগ্নিরেতঃ কাঞ্চনকুণ্ডে রাখলেন। সেই তেজোদ্দীপ্ত বীর্য থেকে এক দিব্যকান্তি পুত্র জন্ম নিলেন। তাঁর নাম রাখা হল ‘স্কন্দ'।

সেই শিশুটি ছিল ছ'টি মাথা এবং যথাক্রমে বারোটি চোখ, বারোটি কান ও বারোটি হাত-সম্পন্ন । দ্বিতীয়া তিথিতে তার বৃদ্ধি সামান্য হলেও তৃতীয়া তিথিতে তার সুস্পষ্ট গঠন সম্পন্ন হয়েছিল। চতুর্থীতে তার প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল। ভোরের নবোদিত সূর্যের মতো তার দ্যূতি দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে, এই সন্তান একজন সর্বগুণ-সম্পন্ন, বলশালী এবং মহাতেজা পুরুষ। ত্রিপুরাসুর বিনাশক মহাদেব, দৈত্য নিধনের জন্য যে বিশাল ধনুকটি রেখেছিলেন, মহাবালী কুমার সেই ধনুকটি হাতে নিলেন। তারপর ভীষণ হুংকার করে জগতের সকলকে হতবাক করে দিলেন। ঐ সময় চিত্র এবং ঐরাবত নামের দুটি বিশাল সাপ তাঁর দিকে ছুটে এলো। তখন সেই কুমার তাদের দিকে হুংকার দিতে দিতে এমন ভাবে তেড়ে গেলেন যে, সাপ দুটি ভয়ে সেই স্থান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলো।

এরপর সেই মহাতেজা পর্বত শিখরে উঠে একইভাবে হুংকার দিতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার অধিবাসীরা ভয়ে জড়সড় হয়ে তাঁর কাছে এসে আত্মসমর্পণ করলো। তিনি তাদের সান্ত্বনা দিলেন এবং ধনুক থেকে অসংখ্য শর নিক্ষেপ করে তাদের আশ্বস্ত করলেন। প্রসঙ্গত, সেই সময় যাঁরা তাঁর আশ্রয় নিয়েছিল তাদের তাঁর পার্ষদ বলা হয়েছিল।

এরপর ভয়ংকর একটি বাণ নিক্ষেপ করে তিনি হিমালয়-নন্দন ক্রৌঞ্চকে শরবিদ্ধ করলেন। পর্বতের সেই ছিদ্রপথ দিয়ে এখনও হাঁস ও শকুন ইত্যাদি নিত্য যাতায়াত করে। সেই বাণে বিদ্ধ হয়ে ক্রৌঞ্চ আর্তনাদ করতে করতে মাটিতে পড়ে গেল। সেই দৃশ্য দেখে অন্যান্য পর্বতগণ ভয়ংকর আর্তনাদ করে দিশেহারা হয়ে পড়ল। কুমার স্কন্দ তাতেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। তিনি তাঁর বাণবর্ষণ ক্রিয়া চালিয়ে যেতে লাগলেন। ইতিমধ্যে ঐ রকমই একটি শক্তিশালী অস্ত্রের আঘাতে শ্বেতগিরির একটি বিশাল চূড়া ভেঙে পড়ল। তখন সকল পর্বত ভয়ে ভীত হয়ে পৃথিবী ত্যাগ করে আকাশগামী হলো। এইভাবে চারদিকে যখন একটা তীব্র ভয়ের বাতাবরণ, কি হয়, কি হয় পরিস্থিতি; তখন হঠাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিল। পৃথিবী তখন নিরুপায় হয়ে কুমার-স্কন্দের কাছে গেলেন। কুমার তখন তাঁকে অভয় দিলে পৃথিবীর সব ফাটল জুড়ে গেল। পৃথিবী স্বাভাবিক হলো। সেই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে পর্বতকুল নতজানু হয়ে সেই বালকের শরণাগত হলো এবং তাঁরাও একইভাবে অভয় পেয়ে পৃথিবীতে নিজ নিজ স্থানে ফিরে এলেন। সেই থেকে জগৎবাসী প্রতি শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে তাঁর নিত্য পূজা শুরু করলো।

কুমার-স্কন্দের এই আস্ফালনের কথা তখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। চতুর্দিকে তাঁরা শক্তি ও তেজের প্রকাশ সবাইকে চমকে দিচ্ছে। পৃথিবী জুড়ে তখন নানারকম শব্দ শোনা যাচ্ছে। মহর্ষিগণ এই অবস্থার প্রতিকারের জন্য তৎপর হয়ে উঠলেন।

ইতিমধ্যে এই সন্তান কার ? কে বা কারা এর মা ? –এ নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয়েছে। চৈত্ররথ বনে যারা নিয়মিত বসবাস করতেন তারা বললেন— ভগবান অগ্নিদেব সপ্ত ঋষিদের ছয় পত্নীর সঙ্গে এক হয়ে এই অনর্থ ঘটিয়েছেন। কেউ কেউ বললেন, না, না, এ সুপর্ণীর কাজ। পরিস্থিতি যখন সত্যিই জটিল হচ্ছে তখন স্বাহা বললেন; এ আমারই সন্তান। এই বলে তিনি সেই কুমারের কাছে গিয়ে বললেন— “বৎস! আমি তোমার জননী।”

বনবাসীরা অবশ্য তখনও বলে যাচ্ছিলেন এই ছর ঋষি-পত্নীই ষড়াননের মাতা । সপ্তঋষিরা যখন এই সংবাদ শুনলেন তখন ঐ ছর ঋষি তাঁদের স্ত্রীদের ত্যাগ দিলেন। তখন অগ্নিজায়া স্বাহা ষড়ঋষিকে আশ্বস্ত করে বললেন; আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না। এ সন্তান আমারই। ঋষিশ্রেষ্ঠ বিশ্বামিত্র অবশ্য এই ঘটনার আদ্যোপান্ত জানতেন। তিনি তাই প্রথম কুমারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাঁর স্তব করলেন। পরে শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী তেরো রকমের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান এবং জাতকর্ম করে তিনি কুমারের মাহাত্ম্য কীর্তন করলেন। সেই থেকে তিনি কুমারের বিশেষ প্রীতিভাজন হয়ে উঠলেন। এরপর তিনি সপ্তঋষিদের উদ্দেশে বললেন— “হে মহর্ষিগণ! আপনাদের সহধর্মিণীরা এই ঘটনার সঙ্গে মোটেই জড়িতা নন।” এই বলে তিনি সবাইকে মূল ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বললেন। কিন্তু তাতেও ঋষিদের মন থেকে সন্দেহ দূর হলো না।

তখন দেবতারা ইন্দ্রকে বললেন— “হে ত্রিদশনাথ! আপনি এক্ষুনি এই কুমারকে সংহার করুন। না হলে ত্রিলোক জুড়ে এ যা অনর্থ শুরু করেছে তাতে বড় কিছু বিপদ ঘটে যাবে। একে আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। আর আপনি যদি এর বিনাশ না করেন, তাহলে আমাদের মনে হয় ও খুব শীঘ্র আপনাকে এবং আমাদের পরাজিত করে ইন্দ্রত্ব অধিকার করে বসবে।”

দেবরাজ প্রত্যুত্তরে বললেন— “দেবগণ! এই পরাক্রমী বালক নিজের বিক্রমে বিশ্ববিধাতা ব্রহ্মাকেও জয় করতে পারে। আমি কোন্ ছার!”

দেবতাগণ তখন বললেন- “হে ইন্দ্ৰ! বেশ বুঝতে পেরেছি আপনার বলবীর্য- বুদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। না হলে এমন কথা আপনি কি করে বললেন? তাহলে সকল লোক মাতাদের বলছি আপনারা সবাই মিলে এই বালককে বিনাশ করুন।”

লোকমাতাগণ তা শুনে 'তথাস্ত' বলে প্রস্থান করলন।

এরপর সেই মায়েরা বালক সুন্দকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করে মনে মনে চিন্তা করলেন, আমরা এই দিব্যকান্তির বিনাশ কিভাবে করবো ? এ কাজ কিছুতেই করা যাবে না। এই ভেবে তাঁরা কুমারকে পুত্র স্নেহে বললেন— “তুমি আমাদের সন্তানতুল্য। তোমাকে পুত্রস্নেহে বরণ করছি। তুমি আমাদের মা রূপে গ্রহণ করো।”

কুমার তখন সেই লোকমাতাদের মাতৃবন্দনার মাধ্যমে যথোচিত সম্মাননা জ্ঞাপন করলেন। এবং তাঁদের অভিলাষ পূর্ণ করলেন। ইতিমধ্যে দেব হুতশন সেখানে উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখে কুমার যথাযোগ্য পূজার্চনা করলেন। অগ্নি তাতে সন্তুষ্ট হয়ে সকল মা'দের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাকে ঘিরে ধরলেন।

অন্যদিকে স্কন্দের বল ও পরাক্রমের কথা দেবতাদের মাধ্যমে দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে পৌঁছালো। তিনি তখন এই মহাবলী বালককে স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে দেবসৈন্য সহযোগে অগ্রসর হলেন। অবশ্য এই বালককে পরাজিত করার ব্যাপারে শুরু থেকেই তাঁর মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ ছিল। কুমার ইন্দ্রকে যুদ্ধসাজে দেখা মাত্রই তাঁর প্রতি আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে গেলেন এবং উভয়পক্ষ পরস্পর পরস্পরকে ভীষণ তর্জন- গর্জন দেখাতে লাগলেন।

প্রারম্ভিক পর্বে কুমারের হুঙ্কার ধ্বনির তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে বহু দেবসেনা অচেতন হয়ে পড়লো। তা দেখে অন্য সৈন্যদের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল। কেউ কেউ ভয়ে পিছু হটতে লাগলো। তখন কুমার আরও ক্রুদ্ধ হয়ে মুখ থেকে অগ্নি- উদ্গীরণ করতে লাগলেন। তার ফলে বহু সৈন্য চোট, আঘাত এবং ক্ষত-বিক্ষত হতে লাগল। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর হতচকিত, ক্ষত-বিক্ষত দেবসেনারা পাবকনন্দন স্কন্দের কাছে আত্মসমর্পণ করলো।

দেবরাজ ইন্দ্র তখন একা হয়ে পড়লেন। তিনি এবার মরিয়া হয়ে কুমার স্কন্দের উপর বজ্র নিক্ষপে করলেন। সেই অস্ত্রের আঘাতে কুমারের দক্ষিণ-অঙ্গটি আঘাত প্রাপ্ত হলো। এবং সেখান থেকে একজন যুবক পুরুষ বেরিয়ে এলেন। সেই বীর পুরুষ রণসাজে সজ্জিত, দিব্য কুণ্ডল, শক্তি ও স্বর্ণকবচ পরিহিত। স্কন্দের শরীরে ভয়ংকর বজ্রাস্ত্র আঘাত করা সত্ত্বেও তাঁর শরীর থেকে তেজস্বী পুরুষ প্রকাশিত হওয়ায় তাঁর নামকরণ হলো ‘বিশাখ'। আর এই তেজস্বী পুরুষের আবির্ভাবে এবার ইন্দ্র স্বয়ং খুব ভয় পেয়ে গেলেন। তখন অনেকটা অসহায় হয়ে হাতজোড় করে তিনি স্কন্দের সহানুভূতি প্রার্থনা করলেন।

বলা বাহুল্য, এরপর স্বদের রুদ্ররূপ ধীরে ধীরে প্রশমিত হলো। তিনি ইন্দ্রকে অভয় দিলেন, আর এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত দেবতা ও দেবসৈন্যরা হর্ষ ও উল্লাস ধ্বনি করলেন। আনন্দে বাদ্যধ্বনি করতে লাগলেন।

তখন ঋষিরা বললেন— “দেবশ্রেষ্ঠ। তুমি সর্বগুণ সম্পন্ন। তোমার কল্যাণ হোক। তোমার বয়স মাত্র ছ’দিন। এই ছয় দিনেই তুমি ত্রিলোক জয় করেছো। তুমি এবার ইন্দ্র হয়ে ত্রিলোকবাসীদের নিরাপত্তা ও অভয় দান করো।”

কুমার স্কন্দ তখন বললেন— “হে মুনিবরগণ! ইন্দ্র ঠিক কি কাজ করেন ? তিনি কিভাবে দেবতাদের রক্ষা করেন ?”

ঋষিরা প্রত্যুত্তরে বললেন— “তিনি তাঁর বল, তেজ ও দীপ্তি দিয়ে সকলকে সুরক্ষা দেন। তাঁদের সকলের ইচ্ছাপূরণ করেন। আবার কোন দুরাচারী অসুর স্বর্গলোকের শান্তি বিঘ্ন করতে এলে তিনি তাঁদের দমন করেন। অবশ্য দেবতারাও তাঁর সকল নির্দেশ, অনুশাসন ইত্যাদি মেনে চলেন। বাস্তবে তিনিই দেবশ্রেষ্ঠ। যদি কোন স্থানে সূর্য না থাকে তিনিই সেখানে সূর্য। আবার যেখানে চন্দ্র নেই, তিনিই সেখানে চন্দ্রমা রূপে আবির্ভূত হন। তিনিই জগতের কল্যাণে অগ্নি, বায়ু, জল বা পৃথিবী হয়ে প্রকাশিত হন। হে বীরশ্রেষ্ঠ, এইগুলি হলো ইন্দ্রের কাজ বা কর্তব্য। তবে তুমিও ইন্দ্রের ন্যায় বীরশ্রেষ্ঠ। তাই তুমি ইন্দ্রত্ব পদে অধিষ্ঠিত হও।”

ইন্দ্ৰ তখন বললেন— “হে মহাবাহো। তুমি আজ ইন্দ্ৰত্ব পদে অভিষিক্ত হয়ে আমাদের সকলের সুখ-সমৃদ্ধির কারণ হও।”

তখন কুমার স্কন্দ বললেন- “হে বীরশ্রেষ্ঠ! ইন্দ্র পদে আমার কোন আগ্রহ নেই। বরং আমি আপনার সেবক হিসাবে থাকতে চাই।”

ইন্দ্র বললেন— “তোমার বিক্রম অসাধারণ। তুমি দেবতাদের যে কোন শত্রুকে দমন করার ক্ষমতা ধরো। তোমার তেজে সকলে বিস্মিত, অভিভূত। আমার দুর্বলতা সকলের সামনে ধরা পড়েছে। তাই আমি ইন্দ্রত্ব পদে আসীন থাকলে সকলে আমাকে মর্যাদা দেবে না । অবজ্ঞা করবে। তখন তোমার আমার মধ্যে নানান কারণে দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। তাই আমার প্রস্তাব তুমি ইন্দ্রত্ব পদ গ্রহণ করো।”

প্রত্যুত্তরে স্কন্দ বললেন— “হে দেবরাজ! আপনি ত্রিলোকপতি। আমি আপনার আজ্ঞাবাহী এবং অনুগত। আমাকে ক্ষমা করবেন।”

ইন্দ্ৰ তখন বললেন— “হে মহাবলী! তোমার কথায় উৎসাহ পেয়ে আমি ইন্দ্ৰত্ব পদ স্বীকার করছি। কিন্তু যদি সত্যিই তুমি আমার আজ্ঞাবহ ও অনুগত হও তাহলে দেবসেনাপতি হয়ে সমগ্র দেবকূলকে রক্ষা করো।”

স্কন্দ তখন বললেন- “হে সুররাজ! তাই যদি আপনার বাসনা হয়, তাহলে দেবগণের স্বার্থসুরক্ষা, গো ব্রাহ্মণের মঙ্গলসাধন এবং অসুর-দানবদের ধ্বংস করার জন্য আমাকে দেব-সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করুন।”

ঋষি মার্কণ্ডেয় বললেন— “মহারাজ! স্কন্দের ইচ্ছানুসারে এরপর দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে দেবতাদের সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করলেন। মহর্ষিরা সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁকে পূজার্চনা ও আশীর্বাণী শোনালেন। সেই সময় ভগবান মহাদেব হঠাৎ সেখানে হাজির হলেন। তিনি বিশ্বকর্মার তৈরি একটি দিব্য মালা তাঁর গলায় পরিয়ে দিলেন। অগ্নিদেব দিলেন একটি লাল রং-এর ধ্বজা, যা সব সময় তাঁর রথে উড্ডীন থাকতো।”

যিনি প্রাণীদের প্রচেষ্টা, দ্যুতি, শান্তি ও শক্তি এবং দেবগণের যশ ও জয় বৃদ্ধিকারী শক্তি সেই স্বয়ং অগ্নিদেব সেখানে এলেন। তাঁর শরীরে জন্মের সঙ্গে উৎপন্ন হওয়া কবচে দেব কার্তিক প্রবেশ করলেন। সেই কবচ যুদ্ধের সময়ই স্বয়ং প্রকটিত হতো। শক্তি, ধর্ম, দীপ্তি, কান্তি, লাবণ্য, শান্তি, সমৃদ্ধি, শত্রুদমন, আর্ত-সুরক্ষা ইত্যাদি অশেষ গুণসম্পন্ন ছিলেন কুমার স্কন্দ তথা দেবসেনাপতি কার্তিক। অবশ্য তাঁর কার্তিক নামকরণের পেছনে যে কারণটি ছিল তা হলো— ছ'জন কৃত্তিকা বা ধাত্রী তাঁকে শিশু অবস্থায় যত্ন ও লালন পালন করেছিল বলে তাঁর নাম হয়েছিল কার্তিক । দেব সেনাপতি রূপে কার্তিক প্রতিষ্ঠিত হলে দৈবসৈন্যরা একে একে এসে তাঁকে অভিবাদন জানালেন। তিনি তাঁদের সকলকে আশ্বস্ত করলেন।

দেবরাজ ইন্দ্রের তখন কেশী দৈত্যর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া কন্যা দেবসেনার কথা মনে পড়লো। তিনি স্থির সিদ্ধান্তে এলেন যে, ব্রহ্মা এঁকেই এই পাত্রীর পতিরূপে নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। তিনি আর কালহরণ না করে দেবসেনাকে মূল্যবান বস্ত্রালঙ্কারে সুসজ্জিতা করে কার্তিকের সামনে আনলেন। বললেন— “দেবশ্রেষ্ঠ! আপনার জন্মের বহু পূর্ব থেকেই প্রজাপতি ব্রহ্মা এই কন্যাকে আপনার জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। আপনি এখন শাস্ত্র সম্মতভাবে এঁকে পত্নীরূপে বরণ করুন।”

কার্তিকেয় তখন সেই কন্যার পাণিগ্রহণ করলেন। দেবগুরু বৃহস্পতি হোম-যজ্ঞ সহকারে তাঁদের বিবাহ অনুষ্ঠানে ঋত্বিকের দায়িত্ব পালন করলেন। দেবসেনা সেই থেকে কার্তিকের পার্টরাণি হলেন। সেই অসাধারণ গুণসম্পন্না কন্যা এরপর ভাগ্যলক্ষী রূপে ত্রিলোক পূজিতা হলেন।


Post a Comment

0 Comments