মহাতপা অগস্ত্যমুনির উপাখ্যান

 মহাতপা অগস্ত্যমুনির উপাখ্যান 


বনবাস পর্বে যুধিষ্ঠির সহ পঞ্চভ্রাতা বিভিন্ন তীর্থে ভ্রমণ করতে করতে এক সময় অগস্ত্যমুনির আশ্রমে গেলেন। সেখানে লোমশ ঋষিকে জিজ্ঞাসা করলেন- “হে মুনিবর! শুনেছি মহর্ষি অগস্ত্য বাতাপি দানবকে বিনাশ করেছিলেন। কিভাবে তিনি তা করেছিলেন, দয়া করে শোনান।”

লোমশ ঋষি বললেন- “কুরুনন্দন, পূর্বে মণিমতী পুরীতে ইশ্বল নামে এক দৈত্য বাস করতো। তার ভাই-এর নাম ছিল বাতাপি । একবার এক তপস্বী ব্রাহ্মণকে ইম্বল বলল- “ভগবন! আমাকে বর দিন যাতে আমি দেবতাদের মতো সুন্দর একটি পুত্র পাই”।”

ব্রাহ্মণ ইহুলকে এই বর দিতে অস্বীকার করলে ইশ্বল ক্রোধে নিজের ভাই বাতাপিকে ছাগল বানিয়ে তার মাংস রান্না করে ব্রাহ্মণকে খাওয়ালেন। ইশ্বলের বিশেষ ক্ষমতা ছিল যে, সে মৃত যে কোন প্রাণীকে ডাকলে সেই প্রাণীটি জীবিত হয়ে তখনই তার সামনে এসে হাজির হতো।”

ব্রাহ্মণ ভোজন করানোর পর বিপ্লবের যখন বিশ্রাম করছিলেন তখন চীৎকার করে ইহল ডাক দিল- 'বাতাপি । সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণের পেট চিরে হাসতে হাসতে বাতাপি বেরিয়ে এল। এইভাবে ছাগলের মাংস খাইয়ে ঈশ্বল ব্রাহ্মণকে হত্যা করেছিল।

অন্যদিকে মহামুনি অগস্ত্য একদিন লক্ষ্য করলেন যে, তাঁর পিতৃপুরুষেরা মাথা নিচু করে একটি গর্তে ঝুলছেন। তিনি এর কারণ জানতে চাইলে বেদজ্ঞ পুরুষেরা উত্তর দিয়েন- "বসা আমরা তোমার পূর্বপুরুষ। এখন শুধুমাত্র তোমার সন্তানলাভের আশার দিন গুনছি। তোমার যদি কোন পুত্র-সন্তান হয়, সেই পারবে আমাদের দুঃখ মোচন করতে। তার দ্বারাই আমরা মুক্তিলাভ করতে পারবো।”

মুনিবর তখন বুঝালেন যে, পূর্বপুরুষদের উদ্ধার লাভের জন্য তার সন্তান লাভ করা খুবই প্রয়োজন। তাই তিনি বললেন- “হে পিতৃগণ। আপনাদের মনের ইচ্ছা

আমি পূর্ণ করব। আপনারা আর উদ্বিগ্ন হবেন না।”

এরপর ভগবান অগস্ত্য বিয়ের জন্য মনোমত পাত্রীর সন্ধান শুরু করলেন। কিন্তু বহু চেষ্টা সত্ত্বেও কোথাও তেমন কোনো যোগ্য পাত্রী পেলেন না। মুনিবর তখন বিভিন্ন প্রাণীর উৎকৃষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কল্পনা করে একটি স্ত্রী মূর্তি নির্মাণ করলেন এবং পুত্র কামনায় তপস্যারত বিদর্ভরাজকে তা প্রদান করলেন। এরপর যথাসময়ে, সৌদামিনীর মত রূপলাবণ্য-সম্পন্না এক কন্যা বিদর্ভরাজ পরিবারে জন্ম নিল । সকলের আশীর্বাদে সেই কন্যার নাম রাখা হলো ‘লোপামুদ্রা'। ক্রমে সেই কন্যা বড় হলো। বিবাহযোগ্যা হলো। তাকে দেখে মুনি অগস্ত্য বিদর্ভ রাজাকে বললেন- “মহারাজ! আমি সন্তানলাভের আশায় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দয়া করে আপনি আপনার কন্যাকে আমার হাতে সম্প্রদান করুন।”

মুনিবরের প্রস্তাব শুনে বিদর্ভরাজ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি তখন তাঁর সহধর্মিণীর কাছে গিয়ে এ বিষয়ে মতামত জানার জন্য বললেন- “প্রিয়ে। অগস্ত্য মুনি উগ্র-স্বভাবসম্পন্ন। তাঁকে কন্যা দেবো না বললে তিনি যে ভীষণ অসন্তুষ্ট হবেন তাতে কোনো সন্দেহ নাই। “তাই বলো, এখন আমার কি করা উচিত ?”

ইতিমধ্যে লোপামুদ্রা তাঁর পিতামাতার উদ্বেগ লক্ষ্য করে বললেন- “হে পিতা! আমাকে নিয়ে আপনারা অযথা দুশ্চিন্তা করবেন না। প্রত্যেকেরই ভাগ্য ঈশ্বর-নির্দিষ্ট। আমাকে মুনিবরের হাতে সমর্পণ করুন। এ নিয়ে আপনারা আর অন্য কিছু ভাববেন না।”

এরপর যথা-নিয়মে মহাত্মা অগস্ত্য ও রাজনন্দিনী লোপামুদ্রার বিবাহ সম্পন্ন হলো। বিয়ের পর মুনিবর বললেন- “প্রিয়ে! তুমি তোমার দামি পোশাক-পত্র ও অলংকারাদি ত্যাগ কর। আমার সঙ্গে সন্ন্যাসিনীর বেশে চলো।”

মুনিবরের নির্দেশমত লোপামুদ্রা তখন সব কিছু ত্যাগ করে সন্ন্যাসিনীর বেশ গ্রহণ করলেন। তারপর গঙ্গাতীরে গিয়ে যোগ্য স্ত্রীর মতো স্বামীর সঙ্গে কঠোর তপস্যার মা হলেন।

এভাবে কিছুদিন চলার পর ভগবান অগস্ত্য একদিন লক্ষ্য করলেন যে, তপস্বিনী লোপামুদ্রা ঋতুমতী হয়েছেন। তা দেখে মুনিবরের মনে সহবাসের ইচ্ছা জন্ম নিল। এবং স্ত্রীকে তিনি তা জানালেন।

তখন লোপামুদ্রা লজ্জাবনত হয়ে বললেন- “মুনিবর! আমি জানি সন্তান পাওয়ার জন্যেই বা সন্তান লাভের আশার আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন। কিন্তু এখন আমার আপনার কাছে একটি আবদার আছে। আমি চাই— পিতৃগৃহে আমি যেমন বিছানায় রাত্রি যাপন করতাম সহবাসকালে আমাদের জন্য আপনিও সে রকম শয্যার আয়োজন করবেন। সেই সঙ্গে আপনিও উত্তম পোশাকে মালা, অলংকার ইত্যাদি পরে আমার সঙ্গে সহবাস করবেন। আমাকেও এই উপলক্ষ্যে দিব্য বস্ত্র-অলংকার ইত্যাদি পরিয়ে আপনার যোগ্য করে তুলবেন।”

অগস্ত্য বললেন— “প্রিয়ে! তোমার পিতার যেমন প্রচুর ধন সম্পত্তি আছে, আমার তেমন নেই। আমি এত কিছু কিভাবে সংগ্রহ করব ?”

লোপামুদ্রা বললেন- “নাই থাক। তবে এই পৃথিবীতে যত ধন সম্পদ আছে, আমি জানি, আপনি আপনার তপস্যার বলে তা নিমেষে সংগ্রহ করতে পারেন।”

মুনিবর প্রত্যুত্তরে বললেন- “ভদ্রে! তুমি যথার্থই বলেছো। তবে তপস্যা-বলে এই ধনসম্পদ আহরণ করলে তপস্যার ক্ষয় হয়। তাই তপস্যার ক্ষয় হবে না, এমন কোন পথ জানা থাকলে বলো।”

লোপামুদ্রা তা শুনে হাসতে হাসতে বললেন— “আমার ঋতুকাল শেষ হতে আর বেশি দেরি নেই। তাই আপনি যা করার তাড়াতাড়ি করুন। না হলে পুত্র লাভের আশা অপূর্ণই থেকে যাবে।”

স্ত্রী'র ইচ্ছাপূরণের জন্য মুনিবর অগস্ত্য তখন বাধ্য হয়ে রাজা শ্রুতবার কাছে গেলেন। নৃপবর মহামুনিকে যথাযোগ্য শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে তাঁর আগমনের কারণ জানতে চাইলেন।

তখন অগস্ত্য বললেন- “হে নরপতি! আমি ধনলাভের আশায় আপনার কাছে এসেছি। আপনি অন্যের ক্ষতি বা অভাব না রেখে আমাকে যথাসাধ্য অর্থদান করুন।”

রাজা তখন তাঁর সকল আয় ও ব্যয়ের বিস্তারিত বিবরণ মুনির সামনে তুলে ধরলেন। তারপর বললেন- “হে তপোধন! এবার এই ধনসম্পত্তি থেকে আপনি আপনার ইচ্ছামত অংশ গ্রহণ করুন।”

মুনিবর বুঝলেন, রাজার আয়-ব্যয় সমান সমান। এর থেকে অর্থ গ্রহণ করলে অন্যের অভাব হবেই। তাই রাজার কাছ থেকে অর্থগ্রহণ সমীচীন নয়।

তখন রাজা শ্রুতাকে সঙ্গে নিয়ে মুনিবর রাজা ব্রঃশ্বের কাছে গেলেন। রাজা ব্রধ্নহ ও মুনিকে পাদ্য, অর্থ ইত্যাদি দিয়ে অর্চনা করে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন।

অগস্ত্য বললেন- “মহারাজ! ধনলাভের আশা নিয়ে আমি আপনার কাছে এসেছি। আপনি অন্যের ক্ষতি বা অভাব না ঘটিয়ে আমাকে যথাসাধ্য অর্থদান করুন।'

রাজা ব্রধ্নশ্বও তাঁর আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত হিসাব মুনিকে দিয়ে বললেন- “হে মহাত্মা! আমার এই ধন-সম্পত্তি থেকে আপনি আপনার বিবেচনামত অর্থ গ্রহণ করুন।”

বলাবাহুল্য, রাজা ব্রধ্নশ্বেরও অতিরিক্ত কোন ধন-সম্পত্তি ছিল না। তাঁরও আয়- ব্যয়ের হিসাব শ্রুতবার মতো সমান-সমান ছিল। অগস্ত্য তাই তাঁর থেকেও কোন অর্থ সংগ্রহ করা অনুচিত ভেবে সেখান থেকে বিদায় নিলেন।

এরপর অগস্ত্য, শ্রুতবা এবং ব্রঃশ্ব তিনজন একত্রিত হয়ে রাজা এসদস্যুর কাছে গেলেন। এবং সেখানেও একই কারণে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহে মুনি অগস্ত্য ব্যর্থ হলেন।

তখন সেই রাজারা সব দিক বিবেচনা করে মহামুনি অগস্ত্যকে বললেন- “হে ব্রাহ্মণ! দানবেন্দ্ৰ ইশ্বল খুবই ধনবান। চলুন, আমরা তাঁর কাছে গিয়ে অর্থ সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করি।”

এইভাবে পরামর্শ করে মহামুনি অগস্ত্য তিনজন রাজাকে সঙ্গে নিয়ে দানবরাজ ইশ্ববের কাছে গেলেন। ইশ্বল মহর্ষি সহ নৃপতিদের দেখে তাঁদের যথাসাধ্য সমাদর করলেন। তারপর তাঁদের খাওয়ানোর জন্য ছাগরূপী নিজের ভাই বাতাপিকে ভাল করে রান্না করলেন। রাজন্যবর্গ বাতাপিকে রান্না করা হচ্ছে দেখে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

মহর্ষি অগস্ত্য তখন বললেন- “হে রাজর্ষিগণ! আপনারা বৃথা চিন্তা করবেন না। আমি একাই বাতাপিকে ভক্ষণ করবো।” –এই বলে মহর্ষি আসনে বসে ভোজন শুরু করলেন। দানবরাজ ইশ্বল হাসি মুখে একটু একটু করে মুনিকে বাতাপির সমস্ত মাংস আনন্দ করে খাওয়ালেন। খাওয়া শেষ হলে ইশ্বল তারস্বরে বাতাপিকে আহ্বান করলেন। মুনিবর অগস্ত্য তখন ভীষণ শব্দ করে বায়ু নিঃসরণ করলেন এবং বললেন— “ইশ্বল! আমি ইতিমধ্যে বাতাপিকে হজম করে দিয়েছি। বাতাপি আর কখনো ফিরে আসবে না। তাই তাকে আর ডেকো না।”

বাতাপির এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যু সংবাদে ইশ্বল পুরোপুরি ভেঙে পড়লেন। তারপর উপস্থিত রাজন্যবর্গসহ মহাতপা অগস্ত্যকে নতজানু হয়ে বললেন- “মহাশয়গণ! আপনারা কি কারণে এখানে এসেছেন। দয়া করে বলুন।” মহামুনি অগস্ত্য তখন হাসতে হাসতে বললেন- “ওহে অসুর। আমরা সবাই তোমাকে যথেষ্ট ধনশালী মনে করি। আসলে আমার কিছু অর্থের প্রয়োজন। আর এই রাজারা এতটা ধনী নন যে, তাঁরা আমার অর্থসংকট দূর করতে পারেন। তাই তুমি অন্যের অভাব না ঘটিয়ে সাধ্যমত অর্থ আমাকে যাতে দান কর সেই আশায় আমি তোমার কাছে এসেছি।”

দানবরাজ ইহুল অগস্ত্যকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন- “হে মহাশয়! আমি আপনাদের যা দিতে মনস্থ করেছি তা যদি আপনি বলে দিতে পারেন, তা হলে আমি অবশ্যই আপনাকে অর্থ দান করবো।”

অগস্ত্য বললেন- “অসুররাজ! তুমি এই রাজাদের প্রত্যেককে দশ হাজার গোরু এবং সমসংখ্যক স্বর্ণমুদ্রা এবং আমাকে বিশ হাজার গরু এবং সম সংখ্যক স্বর্ণমুদ্রা, একটি সোনার রথ এবং দুটি দ্রুতগামী ঘোড়া দিতে সংকল্প করেছো।”

তিনি আরও বললেন— “তুমি অনুসন্ধান করে দেখ, তোমার সামনে যে রথটি রয়েছে তা সুবর্ণময়— কি-না ?”

মুনিবরের কথা শুনে দানবরাজ পরীক্ষা করে দেখলেন, মুনিবরের বচন অভ্রান্ত । রথটি সত্যিই স্বর্ণনির্মিত। তখন অসুররাজ আর বিন্দুমাত্র দেরি না করে তাঁদের প্রচুর ধনরত্নাদি দান করলেন এবং বিরাব ও সুরাব নামের দুটি অশ্ব ঐ রথটিতে জুড়ে দিলেন। এরপর মহর্ষি অগস্ত্য ধনরত্নসহ রাজাদের নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে তাঁর আশ্রমে পৌঁছালেন । রাজারা তখন মহর্ষির অনুমতি নিয়ে নিজ নিজ গৃহে গমন করলেন। ভগবান অগস্ত্য তারপর তাঁর সহধর্মিণীর পছন্দের জিনিসপত্র তাঁর হাতে তুলে দিলেন । লোপামুদ্রা মহর্ষির কাছ থেকে আকাঙ্ক্ষিত ধনরত্নাদি পেয়ে খুবই খুশি হলেন। অগস্ত্য তখন বললেন— “কল্যাণী! আমি তোমার ব্যবহারে পরম তৃপ্তি পেয়েছি। এখন তোমাকে পুত্র বিষয়ক কিছু জরুরি উপদেশ দিচ্ছি, মন দিয়ে শোনো। তুমি এক হাজার পুত্র চাও না, এক হাজার পুত্রের সমতুল্য ক্ষমতাশালী শত পুত্র, বা এক সহস্র ব্যক্তির সমান পরাক্রমী দশ পুত্র বা সহস্রতেজা এক পুত্র কামনা কর ?”

লোপামুদ্রা বললেন- “হে তপোবন! একজন বিদ্বান ও উত্তম চরিত্রসম্পন্ন পুত্র বহু সংখ্যক অসাধু পুত্রের চেয়ে সব বিষয়ে শ্রেষ্ঠ। তাই আমার একটি মাত্র বিদ্বান ও চরিত্রবান পুত্রই যথেষ্ট। আপনি আমাকে ঐরকম একটি উত্তম পুত্র দিন।” মহর্ষি তাঁর স্ত্রী'র কথায় পরম সন্তুষ্ট হলেন। এবং অত্যন্ত যত্ন ও নিষ্ঠার সঙ্গে স্ত্রী'র গর্ভে পুত্র-সঞ্চার করে বনে চলে গেলেন।

এর সাত বছর পর লোপামুদ্রার কোল আলো করে জন্ম নিল মহাকবি দৃঢ়স্যু। অগস্ত্য-নন্দন বাল্যকালে পিতার গৃহে “ইয়’ অর্থাৎ আগুন জ্বালানোর কাঠ বহন করতেন বলে তাঁর নাম হয়েছিল 'ইরবাহ”। পুত্রকে দেখে মুনিবরের আনন্দের সীমা ছিল না। বলাবাহুল্য, ইরবাহ পিতৃপুরুষকে পিণ্ডদান করে তাঁদের পরমগতি-প্রাপ্ত করেছিলেন। মহাতপা অগস্ত্য এভাবে তাঁর পূর্ব পুরুষদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছিলেন।


Post a Comment

0 Comments