কর্ণের জন্মকথা

কর্ণের জন্মকথা

কর্ণ, মহাভারতের অন্যতম একটি প্রধান চরিত্র। তিনি ছিলেন পাণ্ডব মাতা কুন্তী এবং সূর্যদেবের সন্তান। আর পাঁচজনের মতো কর্ণের জন্ম কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না । মাতা কুন্তী কুমারী অবস্থায় কর্ণের জন্ম দিয়েছিলেন। তাই তাঁকে বাকী সন্তানদের মতো মাতৃত্বের পরিচয় দিতে পারেন নি। লোকলজ্জার ভয়ে জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে শিশুপুত্রকে তিনি নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। অধিরথ (পালক পিতা এবং সূত অর্থাৎ, সারথী) সেই শিশুটিকে নদীতে ভাসমান দেখতে পেয়ে বাড়িতে আনেন এবং তাকে লালন পালন করতে থাকেন পরম স্নেহ ও মমতায়। তাই কর্ণের পরিচয় হয় সূত্রপুত্র। কর্ণের জন্ম হয়েছিল দেবতার ঔরষে । তাই তিনি ছিলেন কবচ-কুণ্ডল পরা বিশ্ববিজয়ী বীর। কিন্তু দুর্ভাগ্য সারা জীবন তাড়া করেছিল কর্ণকে । তাঁর মা কুন্তী হলেও কর্ণ ছিলেন পাণ্ডবদের প্রধান শত্রু দুর্যোধনের মিত্র এবং কৌরব শিবিরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর যোদ্ধা। দুর্যোধন তাঁকে বন্ধু হিসাবে পাওয়ার জন্য নিজের অঙ্গ রাজ্যটি (বর্তমান ভাগলপুর, মুঙ্গের) দান করেছিলেন। ফলে সেই থেকে তাঁর আর এক পরিচয় হয়েছিল— ‘অঙ্গরাজ কর্ণ” । কর্ণের জীবন ছিল আজন্ম যোদ্ধার জীবন । তিনি ছিলেন মহাভারতের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। কিন্তু দুঃখ হলো এই যে, ভাগ্য ও বিজয়লক্ষ্মী কখনোই কর্ণকে সঙ্গ দেননি। যার ফলে কর্ণ শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হলেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন উপেক্ষিত, অবহেলিত এবং দুর্ভাগ্য-পীড়িত এক চরিত্র ।

ব্যক্তিগত জীবনে কর্ণ ছিলেন একজন প্রকৃত দানবীর । তিনি নিয়ম করে প্রতিদিন পিতা সূর্যকে অর্ঘ্য দিতেন। ঐ সময় কোন ব্রাহ্মণ তাঁর কাছে কিছু চাইলে তিনি তা পূরণ করতেন নির্দ্বিধায়, হাসিমুখে, বিনা বাক্যব্যয়ে। লোকশ্রুতি এই যে, বর্তমান হরিয়ানা রাজ্যের কর্ণেল শহরটি কর্ণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কর্ণ চরিত্র, পরবর্তীকালে অনেক মহান স্রষ্টা ও প্রতিভাধরদের লেখনীতে নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে সাহিত্যিক অনুষঙ্গে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ' নাট্য-কাব্যটি এমনই একটি অনন্য সাহিত্য কীর্তি। মহাভারতের এই মহান ব্যক্তিটি আজও সকলের কাছে bঅমর হয়ে আছেন তাঁর ত্যাগ, বীরত্ব, সাহসিকতা, দানশীলতা, মহানুভবতা ও নিঃস্বার্থপরতার অনন্য গুণে।

এখন তুলে ধরা হলো মহাভারতের কর্ণ চরিত্রের অপূর্ব জন্ম বৃত্তান্তটি যা, বনপর্বের ৩২-৩৮ অধ্যায়ে পরিবেশিত আছে।

কর্ণের জন্ম বৃত্তান্তের মূলে ছিল মাতা কুন্তীর বিশেষ আশীর্বাদী মন্ত্র, যা তিনি লাভ করেছিলেন একজন ব্রাহ্মণের কাছ থেকে। তা বলতে গিয়ে মুনিবর বৈশম্পায়ন রাজা জনমেজয়কে বললেন—“মহারাজ! প্রাচীনকালের কথা। একদিন এক তেজস্বী দীর্ঘদেহী, দণ্ডধারী, দাড়ি বিশিষ্ট এক ব্রাহ্মণ এলেন রাজা কুন্তীভোজের কাছে। তিনি ছিলেন শুদ্ধাচারী স্বাধ্যায় সম্পন্ন, অনিন্দ্যসুন্দর, অগ্নির ন্যায় দীপ্তিময় এক পুরুষ। তিনি রাজা কুন্তীভোজকে বললেন— মহারাজ! আমি আপনার বাড়িতে ভোজন করতে চাই । কিন্তু আমার কথা হলো আপনার লোকজন যেন আমার অপছন্দ, এমন কোনো কাজ না করে। আমি আমার ইচ্ছামত যেখানে, যখন খুশি যাবো এবং ফিরে আসবো। আমার শয়ন এবং বিশ্রামের সময় কেউ কোন রকম অপ্রিয় আচরণ করবে না। এগুলি যদি আপনি মেনে নেন, তাহলে আমি আপনার ভবনে কিছুদিন থাকবো।”

রাজা কুন্তীভোজ তা শুনে খুশি হয়ে বললেন— “আপনার যেমন ইচ্ছা।” তারপর রাজা বললেন— “মহারাজ! পৃথা নামে আমার এক কন্যা আছে। কন্যাটি আমার ধর্মপরায়ণা, সচ্চরিত্রা এবং নম্র স্বভাবের। আমার বিশ্বাস তার ভক্তি ও পরিচর্যায় আপনার এখানে থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না।”

এই বলে ব্রাহ্মণকে যথাযোগ্য পূজা আর্চনা করে তিনি কন্যা পৃথার নিকট গেলেন। বললেন— “বৎসে! ঐ ব্রাহ্মণ আমাদের বাড়িতে কিছুদিন থাকতে চাইছেন। আমি তাঁকে থাকতে বলেছি। আমার ইচ্ছা তাঁকে দেখাশুনা ও পরিচর্যা করার জন্য তুমিই উপযুক্তা। তুমি তো জানো ব্রাহ্মণেরা খুবই তেজস্বী এবং একটু উগ্র স্বভাবের হন। তাঁদের তপস্যা-লব্ধ শক্তি এতটাই প্রবল যে, তাঁরা মুহূর্তে অনেক কিছু ঘটিয়ে দিতে পারেন। এই যে আকাশে ভগবান সূর্যদেবকে দেখছো, ব্রাহ্মণ নমস্কার করলে তবেই তিনি উদিত হন । মহাসুর বাতাপি ও তালজঙ্গ ব্রাহ্মণদের অভিশাপে প্রাণ হারিয়েছিল। তাই তুমি উনার সেবা-যত্নে কোন অবহেলা করবে না। উনি পছন্দ করেন না এমন কিছু করবে না। এতে তোমার মঙ্গল হবে। তুমি ব্রাহ্মণের আশীর্বাদ পেয়ে ধন্যা হবে।

আমি জানি তুমি বৃষ্ণি বংশের রাজা শূরসেনের প্রিয়তমা কন্যা, বসুদেবের ভগিনী। তোমার বাবা নিজে খুশি হয়ে বাল্যাবস্থায় তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

তুমি আমার পুত্র-কন্যাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তুমি বৃষ্ণি বংশে জন্মগ্রহণ করলেও আমাদের বংশে বড় হয়েছো। রাজবংশে তোমার জন্ম হয়েছে। তাই তোমার মধ্যে বহু অসাধারণ গুণের প্রকাশ ঘটেছে । এখন নিজের সব কিছু অহংকার, অভিমান ইত্যাদি ভুলে তুমি ব্রাহ্মণ সেবায় আত্মনিয়োগ করো। এই আমার ইচ্ছা।”

কুন্তী বললেন— “হে রাজেন্দ্র! আপনি বিপ্রবরকে যেভাবে কথা দিয়েছেন, আমি সতর্ক হয়ে তাঁর মনোমত সকল কাজ সেভাবেই করবো। তাঁর সেবা-যত্ন ও দেখাশুনার কোনো ত্রুটি আমি করবো না। তিনি সকাল, দুপুর, সন্ধ্যে, রাত্রি যখনই আসুন না কেন, আমি মোটেই বিরক্ত হবো না। মহারাজ! একে ব্রাহ্মণ সেবা, তার উপর আপনার আদেশ; এর চেয়ে আমার পক্ষে দায়িত্ব পালনের আর কি ভালো সুযোগ হতে পারে ? আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি তাঁর প্রতি সব সময় যত্নশীল থেকে তাঁর মন জয় করতে পারবো।”

কুন্তীর কথা শুনে রাজা কুন্তীভোজ তাঁকে স্নেহাশীষ জানালেন। তারপর তাঁকে ব্রাহ্মণ সেবায় নিয়োজিত করলেন। ব্রাহ্মণের সঙ্গে কুন্তীর পরিচয় করিয়ে দিয়ে রাজা বললেন- “হে ব্রাহ্মণ! এই আমার কন্যা, কুন্তী বা পৃথা। চিরকাল আদর আহ্লাদে বড় হয়েছে। ও যদি কোন দোষ-ত্রুটি করে বসে, তা নিজ গুণে আপনি ক্ষমা করে দেবেন। ব্রাহ্মণেরা বৃদ্ধ, বালক ও তপস্বীদের অপরাধে ক্রুদ্ধ হন না।”

ব্রাহ্মণ তখন ‘তথাস্তু বলে রাজা কুন্তীভোজের কথায় সম্মতি জানালেন। রাজা এরপর বিপ্রবরকে এক শ্বেত প্রাসাদে রাখার বন্দোবস্ত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজনন্দিনী পৃথা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে শুদ্ধ মনে ব্রাহ্মণ সেবার কাজ শুরু করে দিলেন।

প্রসঙ্গত, অতিথি ব্রাহ্মণের চাল-চলন শুরু থেকে কোন নিয়ম মেনে চলতো না । তিনি কখনো সকালেই ফিরে আসব বলে বেরিয়ে যেতেন। কিন্তু ফিরতেন সন্ধ্যাবেলায়। কিন্তু পৃথা তাতে এতটুকু বিরক্ত হতেন না। তিনি ব্রাহ্মণসেবার নিমিত্ত, আসন, পাদ্য, ভোজন, শয়ন ইত্যাদি সব সময় তৈরি রাখতেন এবং নিজে সতর্ক হয়ে থাকতেন। তিনি কখনো দ্বিজবরকে কটু কথা বলা, বা ঐ রকম অপ্রিয় কোনো কাজ করতেন না। বরং বিপ্রবর মাঝে মাঝে পৃথাকে নানা রকম আদেশ করতেন। কিংবা এমন সব জিনিসপত্র চেয়ে বসতেন, যেগুলি হাতের কাছে পাওয়া যেতো না। কিন্তু পৃথা প্রত্যাশিত সেইসব বস্তু নিমেষে সংগ্রহ করে ব্রাহ্মণকে খুশি রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন।

কুন্তীভোজ প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যায় কন্যাকে জিজ্ঞাসা করতেন- “বসে! বিপ্রবর তোমার পরিচর্যায় কোন অসন্তোষ দেখান নি তো! "

কন্যা উত্তর দিতেন— “পিতা! তিনি আমার সেবা যত্নে খুবই সন্তুষ্ট আছেন।” কন্যার এমন উত্তর শুনে রাজা কুন্তীভোজ নিশ্চিন্ত হতেন।

এভাবে এক বছর অতিক্রান্ত হলো। ব্রাহ্মণ দেখলেন, রাজকন্যা তাঁর প্রতি সদা- সতর্ক ও যত্নশীল হয়ে পরিচর্যা করছেন। তাঁর কাজে কোনো ত্রুটি নেই। তখন একদিন হঠাৎ খুশি মনে ব্রাহ্মণ বললেন- “কল্যাণী! আমি তোমার সেবা যত্নে খুশি হয়েছি। তুমি এখন তোমার মনোমত বর আমার কাছে চাইতে পারো, যা ইহলোকে যে কোনো মানুষের পক্ষে দুর্লভ।”

কুন্তী বললেন— “বিপ্রবর! আপনি এবং আমার পিতা উভয়ই যখন প্রসন্ন হয়েছেন। তখন আমার আর চাওয়ার মতো কোনো বর আছে কি ?”

ব্রাহ্মণ বললেন— “অনিন্দিতা! তুমি আমার কাছে কোনো বর না চাইলেও আমি তোমাকে দেবতাদের আহ্বান করার জন্য একটি মহামন্ত্র প্রদান করছি। এই মন্ত্র দিয়ে তুমি যখন যে দেবতাকে ডাকবে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে তোমার সামনে আসবেন। তোমার অধীন হবেন। এবং তোমার ইচ্ছাপূরণ করবেন।”

ব্রাহ্মণ দেবতা এমন মন্ত্র দান করলে কুন্তী (পৃথা) অভিশাপের ভয়ে দ্বিতীয়বার না বলতে পারলেন না। তখন তিনি তাঁকে অথর্ববেদ শিরোভাগের মন্ত্রগুলি উপদেশ দিলেন।

মন্ত্রপ্রদান হয়ে গেলে তিনি রাজা কুন্তীভোজকে বললেন- “রাজন! বেশ সুখে- স্বাচ্ছন্দ্যে আপনার ভবনে এতগুলি দিন অতিবাহিত করলাম। এবার আমার যাবার সময় হয়েছে। ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।”

এরপর ব্রাহ্মণের কাছ থেকে পাওয়া মন্ত্রটি কতখানি কার্যকরী, তা যাচাই করতে কুন্তীর খুব ইচ্ছা হলো। এমন সময় একদিন হঠাৎ লক্ষ্য করলেন যে, তিনি কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছেন। স্বাভাবিকভাবে তাঁর মধ্যে তখন একটু লজ্জা- লজ্জা ভাব। প্রাসাদের আরামদায়ক শয্যায় বসে তিনি ভোরের রক্তিম সূর্যদেবকে দেখছেন। হঠাৎ দিব্য দৃষ্টিতে কবচ কুণ্ডলধারী বিবস্বান সূর্যনারায়ণকে দর্শন করলেন। তখনই ব্রাহ্মণ-প্রদত্ত মন্ত্রখানিও তাঁর স্মরণে এলো । তিনি বিধিমতো আচমন ও প্রণামাদি করে সূর্যদেবকে আহ্বান করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আদিত্যদেব উপস্থিত হলেন কুন্তীর সামনে। তাঁর দেহ পিঙ্গলবর্ণ, শঙ্খের ন্যায় গ্রীবা, লম্বিত বাহু, মাথায় মুকুট, হাতে বাজুবন্ধ, তেজোময় দিব্যকান্তি-শরীর। তিনি যোগশক্তির সাহায্যে দুই রূপ ধারণ করলেন। একটির দ্বারা পৃথিবীকে আলোকময় করলেন। অন্য রূপ দিয়ে পৃথা, তথা কুন্তীর সামনে দাঁড়ালেন।

মধুর কণ্ঠে কুন্তীকে বললেন— “কল্যাণী। তোমার মন্ত্রের প্রভাবে আমি তোমার অধীন হয়েছি। এখন বলো আমি কি করবো ?”

কুন্তী বললেন- “ভগবন্! আপনি যেখান থেকে এসেছেন, সেখানে ফিরে যান। আমি কৌতূহলী হয়ে আপনাকে ডেকেছিলাম। তাই আমার প্রতি প্রসন্ন হোন। আমার আপনার কাছে কিছু চাওয়ার নেই।”

দেব দিবাকর বললেন— “সুহাসিনী! তুমি আমাকে ফিরে যেতে বললে অবশ্যই ফিরে যাবো। কিন্তু দেবতাদের কোন উদ্দেশ্যপূরণ না করে ফিরিয়ে দেওয়া অন্যায় ৷ তুমি চেয়েছিলে আমার দ্বারা তোমার গর্ভে কবচকুণ্ডলধারী, মহাপরাক্রমী, তেজোদ্দীপ্ত একটি সন্তান পেতে । তাই তুমি নিজেকে আমার কাছে সমর্পণ করো । আমি তোমাকে মনোমত পুত্র সন্তান উপহার দিতে পারবো।”

রাজনন্দিনী কুন্তী বললেন- “হে দেব! আমি আমার শিশু সুলভ আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। আমার পিতা, মাতা ও অন্যান্য গুরুজনেরা আছেন, তাঁদের অন্ধকারে রেখে আমার এভাবে দেহদান করা শাস্ত্রসম্মত নয়। হে দিবাকর! আমি একজন বালিকা। ব্রাহ্মণের দেওয়া মন্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে গিয়ে আমি আপনাকে আহ্বান করে ফেলেছি। তাই আমার অনুরোধ আপনি আপনার বিমানে চেপে দেবলোকে ফিরে যান। আমার অপরাধ মার্জনা করুন।”

প্রভাকর বললেন- “সুন্দরী! তোমার পিতা, মাতা বা গুরুজনেরা তোমার প্রভু নন। অবিবাহিতা নারী তার পছন্দের পুরুষকে কামনা করে বলেই তাকে কন্যা বলে। কন্যা পরাধীন নয়, স্বাধীন। তাই তুমি এই কাজে এগিয়ে এলে কেউ তোমাকে দোষ দিতে পারবে না। নিজের ইচ্ছার মনোমত কাজ করাই সঙ্গত। মানব সমাজে বিবাহের নিয়ম-রীতি, কাল্পনিক, ঈশ্বর নির্দিষ্ট বা শাস্ত্রোক্ত নয়। আমি তোমাকে নিশ্চিত করছি, আমার সাহায্যে তোমার গর্ভে এক যশস্বী পুত্র সন্তান জন্ম নেবে। তারপর তুমি পুনরায় কন্যারূপ ফিরে পাবে।

কুন্তী পুনরায় বললেন- “হে আদিত্য! আপনি যদি আমাকে পুত্র উপহার দেন, তবে সে যেন দিব্য অভেদ্য কবচ ও কুণ্ডল প্রাপ্ত হয়। ”

সূর্য প্রত্যুত্তরে বললেন- “তুমি যেভাবে চাইছো, সেভাবেই হবে। তোমার পুত্র মহাবলী, ধার্মিক এবং অভেদ্য কবচ ও কুণ্ডলদ্বয় পাবে।”

কুন্তী বললেন— “হে বিভাবসু ! তাহলে আপনি যা চাইছেন, তা করুন।”

কুন্তীর সম্মতি পেয়ে দেব দিবাকর সহবাসের জন্য কুন্তীর নাভি স্পর্শ করলেন। তাঁর তেজঃপ্রভাবে কুন্তী তখন হতচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। এরপর ভগবান সূর্য তাঁর সহস্র কিরণ দিয়ে কুন্তীকে মোহিত করলেন। এবং যোগবলে সূর্য তাঁর গর্ভ সঞ্চার করলেন। কিন্তু তাঁর কুমারীত্ব নষ্ট করলেন না। এরপর সূর্য প্রস্থান করলেন।

মাঘ মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে পৃথার গর্ভ সঞ্চারিত হয়। এই অলৌকিক ঘটনার বিন্দু-বিসর্গ রাজবাড়ির এক ধাত্রী ছাড়া আর কেউ জানতে পারলো না। কুন্তী তখন এক দেবদর্শন, সোনার ন্যায় উজ্জ্বল কবচকুণ্ডলধারী এক পুত্রের জন্ম দিলেন। শিশুপুত্র ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধাত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে কুন্তী একটি মঞ্জুষা (মোম বিছানো বেতের ঝুড়ি) আনলেন। তার পর চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কুমারী মা কুন্তী তাঁর সন্তানটিকে ঐ ঝুড়িতে রেখে তাতে একটি ঢাকনা দিয়ে অশ্ব নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে বললেন— “বৎস! অন্তরীক্ষের সকল ভূত, জলচর কিংবা মর্ত্যের সকল প্রাণী তোমার মঙ্গল করুন। দিব্য প্রাণীরা তোমার সহায় হোন। কোনো শত্রু যেন তোমার কোনো ক্ষতি না করতে পারে। আকাশে বিচরণকারী পবনদেব এবং তোমার পিতা সূর্যদেব তোমাকে রক্ষা করুন। এই কবচ-কুণ্ডল হলো তোমার বিশেষ লক্ষণ বা পরিচয়, যা দেখে আমি চিরকাল তোমাকে চিনে নিতে পারবো।”

এইভাবে বিলাপ করতে করতে তারপর লোক জানাজানির ভয়ে কুন্তী ধাত্রীসহ দ্রুত পিত্রালয়ে ফিরে গেলেন।

ওদিকে বেতের ঝুড়িতে (মঞ্জুষা) শায়িত শিশু কর্ণ ভাসতে ভাসতে অশ্বনদী থেকে চর্মন্বতী (চম্বল) নদীতে গিয়ে পড়লো। শেষে যমুনা নদীতে গিয়ে পড়লো। তারপর সেটি ভাসতে ভাসতে গঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়লো, যার অনতিদূরে সূত অধিরথের বাড়ি, চম্পাপুরী।

অধিরথ হলেন রাজা ধৃতরাষ্ট্রের মিত্র এবং রাজপরিবারের রথ সারথী। তাঁর পত্নী রাধা একজন প্রকৃত সুন্দরী। তাঁদের কোনো সন্তানাদি ছিল না। তাঁরা সন্তান লাভের আশায় অনেক পূজা-যজ্ঞ করেছিলেন। সেদিন হঠাৎ গঙ্গায় ভাসমান অবস্থায় ঐ মঞ্জুষাটি প্রথম রাধার নজরে আসে। তিনি কৌতূহলী হয়ে মঞ্জুষাটি স্বামীকে দিয়ে নদী থেকে তুলিয়ে আনেন। তাঁরা মঞ্জুষা অর্থাৎ বেতের ঝাঁপির ঢাকনা খুলে দেখেন যে, তরুণ সূর্যের ন্যায় এক দেবশিশু তার মধ্যে শুয়ে আছে। তাঁরা সেই শিশুটিকে দেখে অবাক হয়ে যান। এবং পরম আনন্দে তাকে কোলে তুলে নেন।

অধিরথ তখন তাঁর স্ত্রী রাধাকে বললেন- “প্রিয়ে! আমি এমন ফুটফুটে চাঁদের টুকরো শিশু কখনো দেখিনি। মনে হয় ভগবান আমাদের দুঃখ ভেবে এমন একটি সন্তান উপহার দিয়েছেন।”

এই বলে শিশুটিকে তিনি তাঁর স্ত্রী রাধার কোলে তুলে দেন। রাধা সেই দেবশিশুটিকে পেয়ে বিধিসম্মতভাবে গ্রহণ করলেন। তারপর পরম যত্নে নিজের সন্তানের মতো লালন-পালন করতে লাগলেন । এইভাবে সেই দিব্য বালক ক্ৰমে বড় হতে লাগলো । বালকের বসু বর্ম (সোনার কবচ) এবং স্বর্ণ কুণ্ডল দেখে ব্রাহ্মণেরা তার নাম দিলেন ‘বসুষেণ’ বা বৃষ। সেই পুত্র আবার সূতপুত্র হিসাবেও খ্যাতিমান হলো। দিব্য কবচধারী হওয়ায় কুন্তী অর্থাৎ পৃথা দূত মারফৎ খবর পেলেন যে তার পুত্র এক সূতের বাড়িতে বড় হচ্ছে। তিনি তা জেনে নিশ্চিন্ত হলেন। ঐ বালক বড় হলে পিতা অধিরথ তাকে হস্তিনাপুরে পাঠিয়ে দিলেন অস্ত্রশিক্ষা লাভের জন্য।

দেব আদিত্যের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে কর্ণ হয়েছিল। এটি একটি গোপনীয় ঘটনা। তিনি সূত পরিবারের সন্তান হিসাবে বড় হয়েছিলেন। তাঁর কবচকুণ্ডল দেখে অনেকে ভাবতেন যে, এই সন্তান মোটেই সামান্য নয়। যুধিষ্ঠির ভাবতেন কর্ণ যুদ্ধে অজেয়- যা তার কাছে চিন্তা কারণ ছিল। কর্ণ মধ্যাহ্নে স্নান করে জলে দাঁড়িয়ে সূর্যকে অর্ঘ দিয়ে স্তব পাঠ করতেন। সেই সময় ব্রাহ্মণরা এসে কিছু দান চাইলে কর্ণ তাদের ফিরিয়ে দিতেন না । এই হলো কর্ণের আর এক উজ্জ্বল পরিচয়।


Post a Comment

0 Comments