পরশুরাম কথা

 পরশুরাম কথা

প্রাচীন সাহিত্য অনুসারে পরশুরাম হলেন বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার। ‘পরশুরাম' শব্দটির অর্থ‘কুঠার’। পুরাণ মতে তিনি ত্রেতা এবং দ্বাপর যুগ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তাঁর পিতা জমদগ্নি ছিলেন ব্রাহ্মণ, কিন্তু মা রেণুকা ছিলেন ক্ষত্রিয়বংশীয়া। এভাবে বিচার করলে তিনি হলেন ব্রহ্মক্ষত্রিয়। এবং আসলে তিনি ছিলেন ঠিক তেমনই— প্রথম যোদ্ধা- ঋষি। তাঁর মাতা ছিলেন অযোধ্যার, সূর্যবংশের। এই বংশেই রামচন্দ্র জন্মেছিলেন।

তিনি কঠোর তপস্যা করে শিবের নিকট থেকে ‘পরশু’ লাভ করেছিলেন। স্বয়ং মহাদেব ছিলেন তাঁর অস্ত্রগুরু। কথিত আছে তিনি সমুদ্রের আগ্রাসন থেকে দক্ষিণ- ভারতের কোঙ্কণ ও মালাবার উপকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল রক্ষা করেছিলেন। তাই ঐ অঞ্চলকে বলা হয় ‘পরশুরাম ক্ষেত্র' । ক্ষত্রিয়রাজ কার্তবীর্যার্জুন তাঁর নিরীহ পিতাকে হত্যা করেছিলেন বলে তিনি কার্তবীর্যের বংশের সবাইকে বিনাশ করেছিলেন। তবে এতেই তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হয়নি। তিনি এরপর কুঠার যোগে গোটা পৃথিবী একুশবার ঘুরে ক্ষত্রিয়শূন্য করেছিলেন। ক্ষত্রিয়দের হত্যা করে তাদের রক্ত দিয়ে পরশুরাম পাঁচটি হ্রদ পরিপূর্ণ করেছিলেন। কিন্তু এরপরই তাঁর মধ্যে অনুশোচনার উদয় হয় । তিনি পিতৃপুরুষদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এবং অনুরোধ করেন এই পাঁচটি হ্রদই যেন পূণ্যতোয়ায় পরিণত হয়। তাঁর পিতৃপুরুষগণ তাঁকে পাপমুক্ত করেন। পাঁচটি রক্ত হ্রদ তাঁদের আশীর্বাদে একসাথে সমস্ত-পঞ্চক বা কুরুক্ষেত্র বলে পরিচিতি লাভ করে।

পরবর্তীকালে তিনি ভীষ্ম ও কর্ণকেও অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছিলেন। রামায়ণ ও মহাভারতের ছত্রে ছত্রে আমরা পাই তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। এই গল্পে এখন পরিবেশিত হচ্ছে সেই জগদ্বিখ্যাত যোদ্ধা-ঋষির অমৃতময় জীবন কথার সংক্ষিপ্ত নানান দিক । মহাভারতের ‘বনপর্বে অধ্যায় ১৫০-১৫২’তে, এই বিষয়ের মূল আলোচনা লক্ষ্য করা যায়।

পাণ্ডব-প্রধান যুধিষ্ঠির ভাইদের সঙ্গে নিয়ে মহেন্দ্র পর্বতে একরাত কাটিয়ে মুনি ঋষিদের অভিবাদন জানাতে থাকলে মহর্ষি লোমশ, ভৃগু-অঙ্গিরা-বশিষ্ঠ এবং কাশ্যপ ঋষির সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের পরিচয় করিয়ে দিলেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তখন মহাত্মা পরশুরামের শিষ্য অকৃতব্রণকে নমস্কার জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— “মহাশয়! শুনলাম ভগবান পরশুরাম সাধুদের সঙ্গে দেখা করতে আসছেন ? আমি এই সুযোগে তাঁকে দেখার অপেক্ষায় আছি।”

অকৃতব্রণ বললেন— “মহারাজ! আপনি যে এখানে এসেছেন ভগবান পরশুরাম তা যোগবল প্রভাবে জেনে নিয়েছেন। আপনার প্রতি তাঁর যে প্রীতির সম্পর্ক আছে, তাতে আমার মনে হয় তিনি খুব শীঘ্র আপনাকে দর্শন দেবেন। তপস্বীরা সাধারণত চতুর্দ্দশী ও অষ্টমী তিথিতে দর্শন দেন। আগামীকাল চতুর্দশী। আশা করি আপনি আগামীকালই তাঁর দর্শন পাবেন।”

যুধিষ্ঠির বললেন- “আপনি ভগবান পরশুরামের একান্ত অনুগত শিষ্য। তিনি ইতিপূর্বে যে সব বীরত্বের কাজ করেছেন, আপনি তা সবই জানেন। তিনি কিভাবে এবং কোন্ কোন্ ক্ষত্রিয়দের পরাজিত করেছিলেন ? – তা যদি বলেন ?”

অকৃতব্রণ বললেন— “মহারাজ! ভৃগু বংশোদ্ভূত জমদগ্নিনন্দন ভগবান পরশুরামের জীবন জুড়ে রয়েছে অত্যাশ্চর্য নানান কাহিনি । তিনি হৈহ-বংশীয় রাজা কার্তবীর্যার্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাঁকে বধ করেছিলেন। কার্তবীর্যের এক হাজার হাত ছিল। তিনি দত্তাত্রেয়ের বরে একটি সোনার রথ পেয়েছিলেন। এবং পৃথিবীর সর্বত্র তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠত হয়েছিল। কার্তবীর্য সেই রথে আরোহণ করে দেবতা, ঋষি, যক্ষ প্রমুখ সকলের উপর অত্যাচার চালিয়েছিলেন। তখন সকল দেবতা এবং ঋষিগণ সমবেত হয়ে অসুরদমন বিষ্ণুকে বললেন— 'ভগবান, সৃষ্টিরক্ষার জন্য আপনি কার্তবীর্যকে সংহার করুন।”

সেইমতো ভগবান বিষ্ণু কার্তবীর্য বধের উপায় খোঁজার জন্য ইন্দ্রের সঙ্গে পরামর্শ করতে লাগলেন । এবং এ বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে বদরিকাশ্রমে প্রবেশ করলেন।

সেই সময় কনৌজ প্রদেশে ‘গাধিনামা' নামে একজন বিখ্যাত রাজা ছিলেন। তিনি এক সময় বনে গিয়ে বসবাস করতে লাগলেন। বনবাসকালে তাঁর এক অপরূপা কন্যা জন্মগ্রহণ করলো, নাম সত্যবতী। ভৃগুনন্দন ঋচীক সেই কন্যাকে দেখে গাধিরাজকে বললেন— “মহারাজ! আমি আপনার কন্যার পাণিগ্রহণ করতে চাই।”

সেই অনুসারে গাধিরাজ ঋচীকের হাতে নিজ কন্যাকে সম্প্রদান করলেন। এরপর ঋচীক ধর্মপত্নীকে সঙ্গে নিয়ে নানা স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এই সময় মহর্ষি ভৃগু সেখানে উপস্থিত হলেন এবং নিজ পুত্র এবং নব-পুত্রবধূকে দেখে আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বললেন- “বসে! তুমি বর প্রার্থনা কর। আমি তোমাকে বর প্রদান করবো।”

তখন নববধূ সত্যবতী তাঁর মাতা এবং নিজের জন্য পুত্র প্রার্থনা করলেন।

ভগবান ভৃগু খুশি হয়ে বললেন- “ভদ্রে! তুমি ও তোমার জননী ঋতুস্নানের পর দুটি আলাদা আলাদা গাছে আলিঙ্গন করবে। তুমি উডুম্বর এবং তোমার মা অশ্বত্থ গাছকে জড়িয়ে ধরবে। আমি গোটা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে যত্ন করে দুটি চরু (সিদ্ধান্ন) সংগ্রহ করে এনেছি। তোমাদের দিলাম। তোমরা ভক্তিভরে চরু ভোজন করবে।” — এই বলে মহামুনি ভৃগু সেখান থেকে অন্তর্হিত হলেন।

কিন্তু আশ্চর্যজনক হলো এই যে, সত্যবতী এবং তাঁর মা বৃক্ষ-আলিঙ্গন এবং চরু ভোজন বিষয়ে মুনিবরের নির্দেশের সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করে বসলেন।

এরপর বহুকাল কেটে গেল। ভগবান ভৃগু একদিন দিব্যজ্ঞান প্রভাবে বিপরীত- ধর্মী ঘটনাটি জেনে পুনরায় সেখানে এলেন। এবং বললেন— “হে কল্যাণী! আমি যেমনটি বলেছিলাম, তোমরা তার ঠিক বিপরীত কাজটি করেছো। তাই তুমি এবং তোমার মা ঠিক বিপরীত গুণসম্পন্ন সন্তান লাভ করবে। তোমার গর্ভে এক ক্ষত্রিয়- সুলভ ব্রাহ্মণ সন্তান এবং তোমার মা'র গর্ভে ব্রাহ্মণ সুলভ বলবান, সদাচারী, তেজস্বী এক সন্তান জন্মগ্রহণ করবে।”

সত্যবতী তা শুনে শ্বশুর মহাশয়কে বিনয়ের সঙ্গে বললেন- “পিতা! আমার যেন এমন পুত্র না হয়। বরং এমন লক্ষ্মণযুক্ত কোন পৌত্র যদি জন্মায় তাতে ক্ষতি নেই।”

তখন ঋষিবর 'তথাস্তু বলে তা অনুমোদন করলেন। যাইহোক, যথাসময়ে এরপর সত্যবতীর কোল আলো করে এক তেজস্বী, সদাচারী পুত্র জন্মগ্রহণ করলো। দিনে দিনে জমদগ্নি এরপর বড় হতে লাগলেন। ক্রমে সেই বালক মনযোগ দিয়ে বেদ পড়তে পড়তে খুব অল্প সময়ে বেদজ্ঞ এবং সুপণ্ডিত হয়ে উঠলেন। চারটি বেদেই তাঁর ব্যুৎপত্তি তৈরি হলো। এমন সময় একদিন রাজা প্রসেনজিৎ-এর কাছে এসে মহাতপা জমদগ্নি তাঁর কন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। রাজা এই প্রস্তাব এক কথায় মেনে নিয়ে তাঁর কন্যা রেণুকাকে শুভলগ্নে আচার-নিয়ম মেনে সম্প্রদান করলেন।

এরপর মহাতপা জমদগ্নি রেণুকাকে সঙ্গে নিয়ে আশ্রম জীবনে ফিরে গেলেন। ধ্যান, জপ, সাধন-ভজন ইত্যাদি ধর্মানুষ্ঠানের মধ্যে নিজেদের নিয়োজিত করলেন। সময়ের ব্যবধানে তাঁদের পাঁচটি সন্তান জন্মগ্রহণ করলো। তাদের মধ্যে পরশুরাম ছিলেন সবচেয়ে ছোট। কিন্তু গুণ বিচারে তিনি ছিলেন সকল ভাইদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। একদিন সন্তানেরা ফল সংগ্রহের জন্য আশ্রমের বাইরে গেলে মা রেণুকা স্নান করতে বেরোলেন । তিনি তখন স্নান করে ফিরছেন এমন সময় পথের ধারে ধনী রাজা চিত্ররথের জলক্রীড়া তাঁর নজরে এলো। এই দৃশ্য দেখে রেণুকা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন এবং রাজার প্রতি তাঁর অনুরাগ তৈরি হ’ল। তিনি তখন হতচেতন ও বিকারগ্রস্ত হয়ে আশ্রমে ফিরে এলেন । তাঁর এমন অবস্থা দেখে ঋষি জমদগ্নি মানসচক্ষে সব কিছু বোঝার চেষ্টা করলেন। তাঁর স্ত্রী'র যে চিত্তচাঞ্চল্য ও মানসিক বিকৃতি ঘটছে তা মুনিবর স্পষ্ট বুঝতে পারলেন। তিনি তখন পতিভ্ৰষ্টা ব্রহ্ম তেজঃচ্যুতা সহধর্মিণীকে ধিক্কার জানালেন। এরপর একে একে রুক্মবাণ, সুষেণ, বসু এবং বিশ্বাবসু প্রমুখ প্রথম চারপুত্রকে ঋষি জমদগ্নি ডেকে বললেন- “তোমরা তোমাদের মা'কে হত্যা করো।”

পিতার কথায় চার পুত্রই হতচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলেন। তাদের মুখ থেকেও কোন কথা বেরোলো না। তখন মুনি ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের অভিশাপ দিলেন— ‘যাতে তারা জড়ভরত, সংজ্ঞাবিহীন ও পশুদের মতো হয়ে যায়। এমন সময় সেখানে কনিষ্ঠ পুত্র পরশুরামের আবির্ভাব হলো। তাকে দেখে মহাতপা ঋষি বললেন— “বৎস! তুমি কোন কিছু না ভেবে এখুনি তোমার পাপাচারিণী মাতাকে হত্যা কর।'

পরশুরাম পিতৃবাক্য পালনের জন্য তখনই তাঁর মাতার শিরশ্ছেদ করলেন। কিছুপরে মুনিবরের ক্রোধ প্রশমিত হলে তিনি পরশুরামকে বললেন— “পুত্র! আমার আদেশে তুমি অত্যন্ত দুষ্কর এই কাজটি করেছো। তাই তুমি তোমার পছন্দমত বর আমার কাছে চাইতে পার।”

পরশুরাম বললেন- “পিতা! যদি প্রসন্নই হয়ে থাকেন তা হলে আমার জননীর পুনৰ্জ্জীবন দিন। আমি যে তাঁকে হত্যা করেছি, তা তাঁর স্মৃতি থেকে মুছে দিন, যাতে তাঁকে বধ করে আমি যে পাপ করেছি, সেই পাপ স্পর্শ থেকে আমি উদ্ধার পাই। আমার ভ্রাতাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে দিন। এছাড়া যেন যুদ্ধে অজেয় এবং দীর্ঘায়ু হই— এই বরগুলি আমাকে দিন।”

মহাতপা তেজস্বী জমদগ্নি পুত্র পরশুরামের সকল কামনা পূর্ণ করলেন।

একবার জমদগ্নির সন্তানেরা অন্যান্য দিনের মত সাংসারিক কাজে আশ্রমের বাইরে গেছেন। ঐ সময় অনুপ দেশের রাজা কার্তবীর্য জমদগ্নির আশ্রমে এলেন। রাজাকে দেখে ঋষি-পত্নী রেণুকা যথোচিত সমাদর ও আতিথেয়তা দেখালেও রণোন্মত্ত রাজা কার্তবীর্যের পুত্রেরা সহজেই সামাদতিকে হত্যা করে তখন তিনি ' রাম। যা রানা' বলে পুত্রকে ডাকছিলেন। এখানে মহামুনি আমারিতে বধ করে সহবানের পুত্রেরা চলে গেলেন।

কিছু পরে পরশুরাম সমির সংরহ করে আরামে ফিরে এলেন। তাঁর পিতাকে এভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, তখন তিনি শোকে, পুরে নির্বাক হয়ে গেলেন। তারপর পিতৃশোকে বিনাশ করে শিয়ার পরিস পারলৌকিক ক্রিয়াদি নিয়ম মেনে সম্পন্ন করলেন। এই ঘটনাকে এতখানি যা দিয়েছিল যে, তিনি এরপর প্রতিজ্ঞা করলেন, মোটা পৃথিবী তিনি ক্ষত্রিয়শূন্য করে দেবেন। মহাবলী জামদানি হয়েছিলেন যে, তাকে ত সাক্ষাৎ যমের মতো মনে হচ্ছিল। তিনি এরপর একটি কার্তবীর্যের সকল শুরকে হত্যা করলেন। সেই সময় অন্যান্য যে সব করি তাদের পক্ষ নিয়েছিল তিনি একে একে সকলকে শমন ভবনে পাঠালেন। ভূত ফুল-তিলক শতনাম এভাবে একুশবার পৃি পরিক্রমা করে যেখানে যত ক্ষত্রিয় দেখতে পেয়েছিলেন সকলকে সাহার করেছিলেন। তিনি এর জরিয় নিবন করেছিলেন যে, সেই সব রিয়াদের রক্তে স ক্ষেত্রের পাঁচটি সরোবর শোণিত পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

ঐ সময় পূর্ব পিতামহ মহামুনি ঋচীক সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁকে অভিলষিত বর প্রদান করেন। এবং ক্ষত্রিয় বা বন্ধ করার পরামর্শ দেন। পরশুরাম এরপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলেন। তারপর দেবরাজ ইন্দ্রের সন্তুষ্টির জন্য ঋত্বিকদের ভূমি দান করতে

মহামুনি কাশ্যপকে যান করলেন এক সুকর্ণার কৌ: ব্রাহ্মণ আদেশ অনুসারে ঐ বেদীটিতে পর পর করে ভাগ করে নিলেন। এই কারণে তখন থেকে তাঁরা বানায়ন' নামে পার হলেন। এরপর পরশুরাম মহেরা পর্যন্ত বসবাস করতে লাগলেন।


Post a Comment

0 Comments