না' : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়


'না' : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়


তারাশঙ্করের সাহিত্যে প্রবৃত্তিই মানুষের নিয়তি। নিয়তির হাত হতে মানুষের মুক্তি নেই। নিয়তির অনিবার্য পরিণামকেও এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এই প্রবৃত্তিরূপিনী নিয়তির হাতে অসহায় মানুষের মার খাওয়ার মধ্যেই তাঁর গল্প উপন্যাসে Tragicএর স্বরূপ নিহিত। মানবজীবনে এই নিয়তির লীলা কখনো পরিদৃশ্যমান, কখনো বা কার্যকারণ পরম্পরায় গ্রথিত, আবার কখনও বা জীবন রঙ্গমঞ্চের কৃষ্ম যবনিকার অন্তরালবর্তিনী। তারাশঙ্করের দৃষ্টি জীবনের অতলান্ত গভীরতায় এই নিয়তি নিয়ন্ত্রিত চিরন্তন জীবন রহস্যের সন্ধান করেছে। বিশ্লেষণ নয়, ব্যাখ্যাও নয়, এ শুধু রহস্যের গ্রন্থিমোচন। তারাশঙ্করের ‘না’ গল্পটি একটি নিটোল গল্প। এ গল্পের একটি বড় অংশে ব্রজরাণীর চরিত্রের বিবর্তনকে তুলে ধরা হয়েছে। ব্রজরানীর উচ্চারিত 'না' শব্দটিকে ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনায় শোভিত করে তিনি চরিত্রের এই বিবর্তনকে অনিবার্য নিয়তি লাতি রসপরিণতি প্রদান করেছেন। মানুষের সজ্ঞান প্রচেষ্টাকে পরাভূত করে নিয়তির বিধানে শাস্তি পেয়েছে কালীনাথ ও অনন্ত, আর সেই নিয়তির বিধানেই ব্রজরাণীর সব সংশয় সব ক্ষোভ দূর হয়ে মানসিক প্রশান্তি এসেছে ক্ষমা সুন্দরের পরম করুণায়। গল্পের শুরুতেই আট বছর পূর্বের ঘটে যাওয়া একটি ঘটনাকে কাহিনী সুত্ররূপে তুলে ধরা হয়েছে। আট বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া এক নৃশংস হত্যা কান্ডের দায়রা আদালতে বিচার। আগামীকাল নিহত কালীনাথের স্ত্রী ব্রজরানীর সাক্ষ্যের দিন।

পরের অনুচ্ছেদে লেখক আলোকপাত করেছেন ব্রজরাণীর উপরে। সন্ধ্যার অন্ধকারে ধ্যান নিমগ্না ব্রজরানী। তার দাদা হরদাসবাবু বোনকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে আগামীকাল তার সাক্ষ্যের দিন। হরদাসবাবু প্রস্থান করলেন, কিন্তু সেদিনের ভয়ঙ্কর স্মৃতির আলোড়ন ব্রজরানীর অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে তুলল। এই ভীতি, এই আতঙ্ক আট বছর ধরে তাকে তাড়া করে ফিরেছে। ব্রজরাণী চোখ বুজলেই সেই ভয়ঙ্কর শব্দ শুনতে পায়। সেই মৃত্যুর হুঙ্কার, প্রথমে হাত, পরে রক্তাপ্লুত দেহে তার স্বামীর ভূমিতে লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য—একি মুহূর্তের জন্যও ব্রজরানী ভুলতে পারে। আতঙ্কে শিউরে উঠে সভয়ে সে নীচে নেমে আসে।

এরপরেই হরদাস ব্রজর মামা শ্বশুর অর্থাৎ অনন্তের বাবা ও শ্বশুরের ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন নিয়ে আগমনের সংবাদ প্রদান করল। ব্রজরানী ক্ষমা প্রার্থনার কথায় উত্তেজিত না হলেও যে মুহুর্তে সে শুনল যে ওঁরা ক্ষমার বিনিময়ে ব্রজর ছেলেকে অর্থ সাহায্য করবেন, ব্রজরানী জ্যা মুক্ত তীরের মত উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলেছে 'না'।-

কাহিনী এর পরে ফ্লাশব্যাক পদ্ধতিতে বর্ণিত হয়েছে। পরস্পর মামাতো পিসতুতো ভাই এবং পরস্পর পরস্পরের বন্ধু কালীনাথ ও অনন্ত। কালীনাথ বড় এবং এম. এ পাশ। অনন্ত অশিক্ষিত কিন্তু বন্দুকের লক্ষ্য অব্যর্থ। শিকার করে তারা মাংস খেত এবং কালীনাথের আমদানি করা গাঁজার কল্কেতে টান দিত।

কালীনাথ ও অনন্ত উভয়েই অবিবাহিত বলে একদিন ঘটক এল। ঘটকের সিদ্ধান্তে বিত্তশালী চাকুরে বংশের মেয়ে ব্রজারাণীর সঙ্গে অনন্তর, এবং আধুনিক আলোকপ্রাপ্ত প্রাচীন জমিদার বংশের মেয়ের সঙ্গে কালীনাথের বিবাহ স্থির হল। দুই বন্ধু পরস্পরের হবুশ্বশুর বাড়ীতে মেয়ে দেখতে গেল। অনন্ত গেল কালীনাথের জন্যে মেয়ে দেখতে এবং কালীনাথ গেল ব্রজারাণীর বাড়িতে অনন্তের জন্য মেয়ে দেখতে। কিন্তু ব্রজরানীকে দেখে কালীনাথ এতই মুগ্ধ হয়ে গেল যে ব্রজকে পাবার আশায় সে উভয়ের হবু শ্বশুর বাড়ীতে বেনামী পত্র লিখল। এই বেনামী পত্রে পাত্রদের সম্পর্কে নানাবিধ খারাপ কথা বর্ণিত হল। এবং এর ফলে বিবাহ প্রায় ভেঙে যাওয়ার সামিল হতেই ঘটকের চাতুরিতে পাত্রী বদল করে বিবাহ দিবস ধার্য্য হল।

শুভদিনে উভয়ের বিবাহ হয়ে গেল। ব্রজরানী হল কালীনাথের স্ত্রী এবং বিদ্যানুরাগী প্রাচীন জমিদার তনয়ার সঙ্গে অনন্তর বিবাহ হল। প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত হয়ে কালীনাথ নিজেই ডেকেআনল তার নিয়তিকে। নিয়তির মঞ্চে প্রবেশ ঘটল অনন্তর হাত ধরে। ফুলশয্যার রাতে নববধু জানতে পারল যে অনন্ত লেখাপড়া বিশেষ জানে না। ক্ষুব্ধ বধু অনন্তকে প্রত্যাখ্যান করায় মর্মাহত অনন্ত ঘর হতে বেরিয়ে কালীনাথের ঘরের পাশে গিয়ে নবদম্পতির মধুর প্রেমালাপ শুনে মর্মাহত হয়ে ফিরে এল। অনন্ত ভাবল যে বেনামী পত্রের ঘটনা না ঘটলে ব্রজরানী তারই স্ত্রী হতে পারত। ক্ষুব্ধ অনন্ত জানালার বাইরে একটা পেচকের কণ্ঠস্বর শুনে বন্ধুক হতে গুলি করল।

অষ্টমঙ্গলায় শ্বশুর বাড়ী গিয়ে লেখাপড়া শেখার জন্য শ্বশুর শাশুড়ীর অনেক পরামর্শ শুনতে হল। সে বুঝল যে তার নববধু সব কথাই ফাঁস করে দিয়েছে। সে মর্মাহত হয়ে বাড়ী এসে নেশার মাত্রা বাড়িয়ে দিল। ঘটনা তীব্রভাবে এগিয়ে চলল । অনন্তর শ্বশুর অনন্তর বাবাকে পূর্বেকার বেনামী চিঠিটি পাঠিয়ে দিয়ে অভিযোগ করল যে সমস্ত বিষয়টিই তাঁর দ্বারা সমাপন হয়েছে। অনন্তর বাবা তাঁর স্ত্রীকে জানালেন মেয়েকে না পাঠালে তিনি আবার অনন্তর বিয়ে দেবেন। মার হাত হতে অনন্ত বেনামী পত্রখানি নিয়ে দেখল যে এটা কালীনাথের লেখা। পত্র সমেত সে কালীনাথের বাড়ীতে এসে কালীনাথকে বলল যে পত্রখানি তার শ্বশুর দিয়েছেন তার বাবাকে। পত্রখানি যেহেতু কালীনাথের লেখা তাই এটা তার কাছে থাকাই ভাল। বিবর্ণমুখ কালীনাথকে পত্রখানি দিয়েই অনন্ত বাইরে এল। অনন্তর শ্বশুর বেহাই এর সংকল্পে প্রায় ভীত হয়েই কন্যাকে পাঠিয়ে দিলেন। যেদিন নববধু এল, সেদিনই ব্রজরানীর বাপের বাড়ীর শহরে ফুটবল দল নিয়ে অনন্তের খেলতে যাওয়ার কথা। অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে সে ঠিক করল যে খেলার পরই সে বাড়ী ফিরে আসবে। কিন্তু বধু পরিবর্তনহীনা। পূর্বেকার মতই সে অনন্তর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে থাকায় ক্রুব্ধ অনন্ত বধুকে হান্টার দিয়ে প্রহার করে বাড়ী হতে বেরিয়ে গেল।

ফুটবল খেলতে যাওয়ার পূর্বে সে কালীনাথের বাড়ী গিয়ে ব্রজরানীর হাতে চা জল খাবার খেয়েছে। তার অবৈধব্য ব্রতের ব্রাক্ষ্মণ হতে রাজী হয়েছে এবং খেলার পর ব্রজারানীর পিত্রালয়ে যাওয়ার অনুরোধও রক্ষা করেছে। আহারাদির পর তন্দ্রাচ্ছন্ন অনন্ত ব্রজরানীর মা ও ভ্রাতার কথোপকথন শুনতে পেয়েছে। মা বেনামী চিঠির সত্যতায় সন্দেহ প্রকাশ করায় ভ্রাতা হরদাস জানিয়েছে যে সেই চিঠি কালীনাথই লিখেছে। ব্রজকে খুব পছন্দ হওয়ায় সে এই কাজ করেছে। অনন্ত শুনল এবং তার মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হলেও শেষরাত্রে সে সিদ্ধান্ত নিল যে জীবনে প্রশংসা ও শান্তি পাওয়ার জন্য লেখাপড়া তাকে শিখতেই হবে।

কিন্তু নিয়তি নিয়ন্ত্রিত অনন্তর সে সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার উপায় থাকল না। বাড়ী ফিরে এসে সে শুনল যে মা ও বাবাকে অপমান করে বধু বাপের বাড়ী চলে গেছে। মায়ের বাধা সত্বেও অনন্ত শ্বশুর বাড়ী গিয়ে শ্বশুরের পায়ে পড়ে ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু অনন্তর শ্বশুর কন্যার প্রতি অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে তাকে হান্টার দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে বাড়ী হতে বের করে দিয়েছে।

বাড়ী ফিরে অনন্ত আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে বন্দুক নিয়ে বাড়ী হতে বের হয়েছে। সেদিনই অবৈধব্য ব্রতের জন্য ব্রাক্ষ্মন বরণের ডালা সাজিয়ে অপেক্ষা করছে ব্রজরানী। পথের মধ্যে অনন্তকে দেখে সে স্বামীকে অনুরোধ করেছে অনন্তকে ডাকার জন্যে। আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে বের হওয়া অনন্তর কানে প্রবেশ করল কালীনাথের আহ্বান। এ আহ্বান যেন কালীনাথের নয়, এ আহ্বান তার নিয়তির। অনন্ত উঠে এসেছে বাড়ীর ভিতরে। ব্রজরানীর আর্দ্রস্বর, কালীনাথের ক্ষমা প্রার্থনা সব কিছুকে অস্বীকার করে সেই বলদর্পী যুবক কালীনাথকে কুকুরের মত হত্যা করেছে পরের পর গুলি দিয়ে। দ্রুতপায়ে গ্রামের বাইরে গিয়ে বন্দুকের নল মুখে পড়ে ট্রিগার টেনেছে। কিন্তু আত্মহত্যা করা তার হল না। যেহেতু বন্দুক গুলিশূন্য।

ঘটনার দশদিন পরে অনন্ত যখন দুর্গম পার্বত্য পথে ধরা পড়ল, সে তখন ঘোর উন্মাদ। আট বছর চিকিৎসার পর সুস্থ হতেই তাকে বিচারের জন্য কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে। এবার সাক্ষ্য দেবে ব্রজরানী লোকপূর্ণ আদালত কক্ষের সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ব্রজরানীর চোখ পড়ল অনন্তর প্রতি। “শুভ কেশ, শীর্ণ, ন্যুব্জদেহ, স্তিমিত বিহ্বল দৃষ্টি' লোকটিকে জোড় হাতে আসামীর কাঠগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ব্রজরানী বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। দীর্ঘ আট বছর ধরে সে স্বামী হন্তার শাস্তির জন্যে প্রার্থনা করেছে। কিন্তু ঐ শীর্ণদেহ ন্যুব্জ বৃদ্ধ কি তার স্বামী হন্তা? কোথায় সেই দৃপ্ত দাম্ভিক বলশালী যুবক? একি সেই মানুষ না অন্য কেউ? এতো সেই স্বামী হন্তা নয়। ব্রজরানীর চোখে জল, হৃদয়ের মধ্যে এক রুদ্ধ আবেগ—যে আবেগে সে কম্পিত। এই মুহূর্তে তার চোখের সামনে সময় চেতনা জট পাকিয়ে গেছে। আট বছর তার স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে কেটেছে, এই আট বছর ধরে সে প্রত্যক্ষ করেছে বলদৃপ্ত সেই যুবাকে। ঠিক এই মুহূর্তে সে সময় সম্পর্কে সচেতন নয় বলেই সরকারী উকিলের প্রশ্নে ব্রজরানী সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়েছে 'না'। কিম্বা কঠোর প্রতিশোধ পরায়নাতার আবরণ ছিন্ন করে, ব্রজরানী তাঁর মাতৃহৃদয়ের ক্ষমাশীলতার মধ্যে ফিরে গেছে। সরকারী উকিলের কথামত স্বামীঘাতককে সনাক্ত না করে সে হয়ে উঠেছে দেবী।

নিয়তির বিধানে সে আজ কালীনাথের বিধবা, অথচ স্বাভাবিক ভাবে সে অনন্তর স্ত্রী হতে পারত। বেনামী পত্র দিয়ে কালীনাথ নিজের নিয়তিকে ডেকে এনেছে। যে পাপ সে করেছে, মৃত্যু দিয়ে সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছে। নিয়তির নিষ্ঠুরতায় অনন্ত তার হত্যাকারী। কিন্তু সার্বিক বিচারে অনন্তর কিই বা করার ছিল!

এর পরেও ব্রজরানী দুইবার 'না' শব্দ উচ্চারণ করেছে। ছেলের ভবিষ্যতের জন্য অর্থ সাহায্য দিতে আসা মামা শ্বশুরকে সে প্রত্যাখ্যান করেছে 'না' বলে। মা যখন তাকে নীচে শুতে ডাকল, যাতে ব্রজরানী ভয় না পায়। সে উত্তরে বলেছে 'না'।

দীর্ঘ আট বছর পরে সে ভয়হীন নিশ্চিন্ততায় নিদ্রাভিভূত হয়েছে।

Post a Comment

0 Comments