‘ছিন্নমস্তা' : আশাপূর্ণা দেবী
একাধিক ব্যক্তিকে নিয়ে পরিবার, আবার একাধিক পরিবারকে নিয়ে গড়ে ওঠে সমাজ। তাই পরিবার ক্ষুদ্র হলেও তা সমাজের প্রতিরূপ। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের রাগ অনুরাগ, স্নেহ মমতা, ঈর্ষা বিদ্বেষ এসব নিয়ে যে সামাজিক প্রেক্ষিত গড়ে ওঠে, আশাপূর্ণা দেবীর গল্পের জগৎ সেই প্রেক্ষিতেরই কাহিনী। তাঁর সহজাত গল্প বলার সুন্দর টেকনিকে তিনি পরিবারিক মানুষের মনের গহ্বরে লুকিয়ে থাকা দ্বন্দ্বমূলক অনুভূতি সমূহকে গল্প অবয়বে টেনে এনেছেন। তিনি জেন অষ্টেনের মতই সংসার জীবনে আবদ্ধ মানুষের কথা বলেছেন যা জেন অস্টেনের সাহিত্যের মতই Microcosm of life in its social aspect হয়ে উঠেছে। কোন রকমের রোমান্টিসিজম নয়, সেন্টিমেন্ট্যাল দৃষ্টি ভঙ্গিও নয়, মানুষকে তাঁরা উভয়েই চিত্রিত করেছেন সামাজিক অনুশাসনে ও ব্যক্তিগত মানসিকতার দ্বান্দিক সম্পর্কে।
নিটোল পারিবারিক গল্প রূপে 'ছিন্নমস্তা'র কাহিনী নির্মিত হয়েছে একটি ক্ষুদ্র পরিবারে মা- ছেলে ও পুত্র বধুর মনস্তাত্ত্বিক সংঘর্ষ এবং পরিণতি নিয়ে। গল্প আরম্ভ হয়েছে পুত্র বিমলেন্দুর বিবাহে বধুবরণের আয়োজনের মধ্যে। কেন্দ্রিয় চরিত্র মা জয়াবতী কিছুটা উদ্বিগ্ন। বধু আগমনের সময় হয়ে গেছে। অথচ মন্টি তার আনাড়ী হাতে আলপনা দেওয়ার কাজই শেষ করতে পারেনি। ক্ষোভে রুষ্ট হয়ে তিনি স্মরণ করেছেন তাঁর অতীত জীবনকে যখন তার শিল্প সৌন্দর্যের খ্যাতির জন্য উৎসব প্রাঙ্গণ সাজাতে ডাক পড়ত। একমাত্র ছেলের বিয়েতে বৌছত্তর সাজাবার ইচ্ছা তার বহুদিনের, কিন্তু বিধবা অবস্থায় তা আর সম্ভব নয়। জয়াবতীর জীবনের মর্মবেদনার এটাই শেষ নয়। বিমলেন্দুর জলপানির টাকা হতে কেনা বধুবরণের বেনারসীখানাও দিতে হয়েছে কনকলতাকে। তার কল্পনার শেষ নেই। সুন্দরী পুত্রবধুকে তিনি নিজের মেয়ের মত করে নেবেন। বৌ জ্বালানো শাশুড়ী নয়, হবেন সত্যিকারের মা। সেই কল্পনা এখন বাস্তবে রূপ নেওয়ার অপেক্ষায়। বিমলেন্দুর প্রতি জয়াবতীর মাতৃত্বের টানকে ইডিপাস কমপ্লেক্স তত্ত্বে রূপায়িত না করে একটি পারিবারিক চিত্রকে তুলে ধরা হয়েছে যা সাম্প্রতিক যুগ প্রভাবে দুর্বীসহ যন্ত্রনায় প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। এ গল্প তাই জয়াবতীর স্বপ্নভঙ্গের ও তার গোপন প্রতিহিংসার ।
জয়াবতী পল্লীগ্রাম হতে বধু নির্বাচন করেছিলেন এই ভেবে যে পল্লীর মেয়েরা শহরের মেয়েদের চেয়ে অধিক নম্র ও ভদ্র হবে। প্রতিভা কিন্তু পল্লীর মেয়ে হলেও শহরের মেয়েদের টেক্কা দেয়। সে বিদুষী নয়, কিন্তু মুখরা। লঘু গুরু জ্ঞান তার নেই, এমনকি স্বামীকেও বাক্যযন্ত্রনা দিতে ছাড়ে না। তার মন যেমন অশিক্ষিত, বাক অসংযত এবং ভাবভঙ্গি সম্পূর্ণ বেপরোয়া। তাকে আধুনিকা বলা হলে আধুনিকতার শ্লীলতাহানি ঘটে। এক কথায় সে সব বিষয়েই অসহ্য রকমের উগ্র। সে জয়াবতীকে বুঝিয়ে দিতে চায় যে বিবাহের পূর্বে ছেলে মা-এর হলেও, বিয়ের পর বউয়ের। সেখানে মায়ের কোন স্থান নেই। জয়াবতী সবই বোঝেন কিন্তু মুখ ফুটে কিছু প্রকাশ করেন না। যেমন সেদিন দালান ঝাঁট দেবার সময় প্রতিভার তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বাপের বাড়ীর তুলনায় তার শ্বশুরবাড়ী যে হীন একথা শুনেও কিছু করতে পারেন নি। প্রতিভাকে নয় বিমলেন্দুকে বলাও তাঁর অসম্মানজনক মনে হয়েছে। জানালা দরজার পর্দা পর্যন্ত প্রতিভার পছন্দ নয়। বিমলেন্দু চুপ করে থাকে, কিন্তু জয়াবতী পারেন না। বিমলেন্দু প্রতি সে কটুক্তি করে। বিমেলন্দুর নির্বাক হয়ে থাকা এবং মার প্রতি উদাসীনতা বিমলেন্দুকে জয়াবতীর হৃদয় হতে সরিয়ে দিচ্ছে। প্রতিভা বাপের বাড়ী যায় এবং জয়াবতী ভাবলেন তিনি যেন মুক্তি পেলেন। বধুর অপ্রিয় ভাষণ, ছেলের নির্বাক সমাধি-যা তাকে দিশে হারা করে তুলেছিল, সাময়িক হলেও তা থেকে তিনি যেন মুক্ত। বিমলেন্দুর কলকাতা চলে যাওয়াটাও পূর্বের মত আর মর্মান্তিক বলে বোধ হল না।
নববধু প্রতিভা বাপের বাড়ী হতে ফিরে এল। এবারে সে আরও উগ্র, আরও বেপরোয়া। চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলা দুমদাম হাঁটা চলায় অধিকার প্রতিষ্ঠায় সে যেন ব্যগ্র। বিমলেন্দুর উপর মায়ের অধিকার ছেড়ে দিলেও হেঁসেলের ভার জয়াবতী ছাড়েননি। কিন্তু হেঁসেল নিয়ে সংঘাত চরমে উঠল যখন প্রতিভা চা আর নিমকির ব্যবস্থা নিজে হাতে করে নিতে ব্যগ্র হল । কাপড় কাচা ও সংস্কার নিয়ে শাশুড়ী বৌ-এর বিবাদ যখন চরমে উঠেছে, তখনই মুখলাল করে প্রতিভার প্রস্থান ও কিছুপরে চা জলখাবার না খেয়েই বিমলেন্দুর বাইরে বেরিয়ে যাওয়া জয়াবতীকে তীব্র অভিমানী করে তুলল। বিমলেন্দু খেতে বসলে অভিমানী জয়াবতী প্রতিভাকে রান্নার দায়িত্ব নিতে বললেন। বিমলেন্দু জয়াবতীর মনের সঙ্কীর্ণতার কথা তুলে তাকে অভিযুক্ত করল।
এরপরেই জয়াবতীর পরিবর্তন হয়েছে। পাড়ায় বেরিয়ে বৌ-এর নিন্দায় তিনি যেমন অতিশয় ব্যগ্র হয়ে উঠলেন, বাড়ীর চৌহদ্দীর মধ্যে প্রতিভাও শাশুড়ীর নিন্দায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল। ছিন্নমস্তার মতই জয়াবতী এর পরের ঘটনায় দর্পহারী মধুসূদনের কাছে নালিশ জানিয়ে নিজের রুধির যেন নিজেই পান করলেন। ঘটনা হল বিমলেন্দু ও প্রতিভার এবাড়ী ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার পরিকল্পনা—যা জয়াবতী আড়ি পেতে শুনেছেন।
বাস চাপা পড়ে বিমলেন্দুর আকস্মিক মৃত্যু শাশুড়ী বৌ-এর এই দ্বন্দ্বকে চিরতরে নিভিয়ে দিয়েছে। কালস্রোতে সবই চাপা পড়ে যায়। বিমলেন্দুর মৃত্যুর কথাও একদিন ভুলে গেলেন জয়াবতী। প্রতিভাকে তিনি কাছে টেনে নিলেন, কণ্ঠস্বরেও মাত্রা ছাড়া মমতা, এ তার লুপ্ত হওয়া আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা, শুধুই বৌ-এর প্রতি প্রতিহিংসায়। জয়াবর্তী এখানে দ্বৈত ভূমিকায়। অন্তরে প্রতিহিংসার ছাই চাপা আগুন, কিন্তু বাইরে তিনি মহত্বে, স্বাতন্ত্র্যে পূর্বের মতই মহীয়ান। প্রতিবেশীরা তার দুঃখে দুঃখিত হয়ে বধু প্রতিভার প্রতি সমবেদনা ও করুণা দেখায় । পুত্রের অকাল মৃত্যুর শেল তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ করেছে। হৃদয় হতে ঝরছে রক্ত, এটা তার অন্তরের দৃশ্য। বাহ্যিকভাবে করুণা ও মমতার ছদ্ম আবরণে তিনি পুত্রবধুর পূর্ব আচরণের শোধ তুলছেন। যে মৃত্যু রুধিরস্বাব্বী, সেই মৃত্যুকে মূলধন করে তার এই প্রতিহিংসা চরিতার্থতাই তাকে ছিন্নমস্তার ব্যঞ্জনায় অভিষিক্ত করেছে, তিনি যেন পুত্রের মৃত্যু জনিত হৃদয় রক্ত নিজেই বিজয়োল্লাসে পান করছেন।
0 Comments