বাংলা কবিতায় চিত্রকল্প (Poetic
Imagery) ও তার সংরুপ: আব্দুল মুসরেফ খাঁন
বাংলা কবিতায় চিত্রকল্প (Poetic Imagery) ও তার সংরুপ: আব্দুল মুসরেফ খাঁন
স্যার ফিলিপ সিডনী (Sir Philip Sidney) তাঁর 'Defence of Poesie' তে কবিতাকে বলেছেন “speaking Picture”, সমালোচক হোেেসর ব ব্য ‘the pcet nothing afirms
therefore never lieth” অনুসরণ করে সিডনী বলেছেন “the poet deals with. what
ought to be (the ideal) rather than with what is (the real)”, অ্যারিস্টোটল কবিতার সঙ্গে ইতিহাসের পার্থক্য নির্ণয় প্রসঙ্গে কবিতার ভাববস্তুর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সিডনী বলেছেন কবির the power of image হল “their ability to move us
to wards virtue and away from vice by means of their strong emotional appeal”. সপ্তদশ শতকে নন্দনতত্ত্বের বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, হবস্ ও লকের দর্শন সেই শূন্যতা পূরণে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের মধ্যে (experience and knowledge) সেতুর সূচনা করে। এই সেতুই হল ইমেজ যাকে বলা হয়েছে “a reproduction in the mind
of a sensation produced in Perception"
অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপে একধরণের Descriptive কবিতার উদ্ভব হয় যেখানে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর বর্ণনাই মুখ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু রোমান্টিক যুগে অর্থাৎ ‘an extra ordinary
development of imaginative sensibility'র যুগে রূশোর প্রকৃতিবাদ এবং কান্ট হতে হেগেল পর্যন্ত জার্মান দার্শনিকদের Transcendentalism এর প্রভাবে কবিতায় কবিরা হয়ে উঠলেন নিখিল বিশ্বের রূপময়তার মধ্যে অরূপের সন্ধানী, তাঁরা অনুভব করলেন যে এই বিশ্বপ্রপঞ্চ এক অতিপ্রাকৃত মহিমায় সমাচ্ছন্ন। প্রাকৃতিক ও ঈশ্বরীয় দৃশ্যাবলীর অবতারণায় ব্যবহৃত হল সিম্বল।
উনবিংশ শতকে Max
Muller এর ‘metaphorical imagery
theory' উদ্ভাবনের পর image হতে idea তে উত্তরণ ত্বরান্বিত হল। Sir
Francis Galton এর
Psychology of perception মানুষের রুচি ভেদে image তৈরির অভ্যাসের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করলেন।
বিংশ শতকের মনস্তত্ত্ববিদেরা মেন্টাল ইমাজারি সম্পর্কে অনুসন্ধানের পর সিদ্ধান্তে এলেন যে সকল কবির মানসিকতা ও প্রকাশ ক্ষমতা এক নয়। শেলী ও কীটসে। J যে পার্থক্য বা ব্রাউনিং ও টেনিসনের মধ্যে যে পার্থক্য তা মূলত মানসিক ভাবাবেগের। একারণেই একের সঙ্গে অপর কবির পার্থক্যটা প্রণিধানযোগ্য। কবিতার চিত্রকল্প বা imagery আসলে কবিতার ভাবের বাঙ্ময় ছবি। চিত্রকল্প নির্মাণে ইংরাজীর ৭টি Figures of speech
Synecdoche, metonymy, simile, metaphor, personification, allegory বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। বাংলাতেও উপমা, সমাসোক্তি, রূপক প্রভৃতি অলঙ্কার প্রত্যক্ষভাবে চিত্রকল্প নির্মাণে সাহায্য করে। প্রতীক বা সিম্বল হল আর একটি ডিভাইস যা চিত্রকল্প নির্মাণের প্রধান অংশীদার। চিত্রকল্প সৃষ্টিতে অলঙ্কার figures of speech শেষ কথা নয়।
চিত্রকল্প নির্মাণের প্রধান শর্ত হল কবির হৃদয়াবেগকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তোলা। চিত্রকল্পের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যরূপ বস্তু নিরপেক্ষ নয়। বসুও মানবকর্ম, অনুভূতি ও মননশীল চিন্তা, মানসিক অবস্থা ও কোন ভাব বা ভাবনা এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় সচেতন অভিজ্ঞতা সমূহকে অবলম্বন করে ভাষায় প্রকাশমান হয়। কবির ভাবসূত্রের মধ্যে থাকবে এমন একটা সৌন্দর্যবোধ যা auditory বা শ্রব্য, tactile বা শযোগ্য, olfactory বা ঘ্রাণযোগ্য, gustatory বা আস্বাদযোগ্য, abstract বা বুদ্ধিগ্রাহ্য এবং kinaesthetic বা শরীর স্পন্দন ও গতিশীলতার রোমাঞ্চ সমন্বিত হবে।
Peter Pedgrove-এর “Lazarus and the sea” কবিতার সবকটি ইমেজারি বা চিত্রকল্পের লক্ষণ বর্তমান।
The tide of my death came
whispering like this Soiling my body with its tireless voice, I scented the
antique moistures when they sharpened The air of my room, made the rough wood
of my bed. Standing out like roots in my tall grave
They slopped in my mouth and
entered my plaited blood Quietened my jolting breath with a soft argument Of
such measured insistence, united the great knot of my heart. They spread like
whispered Conversations Through all the numbed rippling tissues radiated Like a
tree for thirty years from the still Centre Of my salt ovum. But this calm
dissolution Came after my agreement to the necessity of it; Where before it was
a storm over red fields Pocked with the rain and the wheat furrowed With wind,
then it was the drifting of smoke From a fire of the wood, damp with sweat, Fallen
in the storm".
এ কবিতার প্রথম দুলাইন auditory বা শ্রব্য।
'Soiling' শব্দটি
tactile বা স্পর্শযুক্ত এবং এর সঙ্গে যুক্ত আরও কিছু শব্দ এবং তৃতীয় লাইন olfactory বা ঘ্রাণযোগ্য। চতুর্থ ও পঞ্চম লাইন tactile ও visual এর সমন্বয়। ষষ্ঠ লাইনে আছে tactile, olfactory এবং gustatory-র মিশ্রণ।
'quietened my Jolting breath' এবং
‘Through all the numbed rippling tissues' শব্দবন্ধ দুটি Kinaesthetic বা গতিশীল রোমাঞ্চ যুক্ত।
“But this calm dissolution" 3 Came after my agreement to the necessity of
it abstract বা বুদ্ধিগ্রাহ্য এবং 'united the great knot of
my heart' বাহ্যতঃ
visual ও kinaesthetic l
চক্ষু-কর্ণ-জিহ্বা-নাসিকা-ত্বক এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে রুপ-রস-শব্দ-গন্ধ ও স্পর্শের একত্র সমাহার কবি কীটস-এ যেমন আছে, তেমনই আছে রবীন্দ্রনাথে এবং বিশেষভাবে বা সম্পূর্ণরূপে জীবনানন্দে। শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে কীটস খুবই সতর্ক, শিল্পীর মতই তিনি শব্দ দিয়ে রূপ নির্মাণ করেন। শব্দ তরঙ্গের শ্রুতিমাধুর্য ও শব্দের ব্যবহারের দ্বারা রুপশিল্পীর ভূমিকায় নির্দিষ্টভাব, ইমেজ বা দৃশ্য পাঠকের ভাবজগতে ফুটিয়ে তোলেন।
'The eve of st. Agnes' কবিতায় মেডলিনের বর্ণনায় কীটস বলেন,
Full on this Casement shone
the wintry moon And threw warm gules on Madeline's fair breast, As down she
knelt for heaven's grace and boon Rose-bloom fell on her hands, together Prest;
And on her silver Cross soft amethyst,
And
on her hair a glory, like a saint
She
seemed a splendid angel, newly drest"
রবীন্দ্রনাথের ‘কল্পনা” কাব্যগ্রন্থের ‘স্বপ্ন' কবিতায় মালবিকা সাদৃশ্য পেয়েছে মেডলিনের। “প্রিয়ার কপোতগুলি ফিরে এল ঘরে,/ময়ুর নিদ্রায় মগ্ন স্বর্ণ দণ্ড পরে/ হেনকালে হাতে দীপশিখা/ ধীরে ধীরে নামি এল মোর মালবিকা।
দেখা দিল দ্বার প্রান্তে সোপানের' পরে/ সন্ধ্যার লক্ষ্মীর মতো, সন্ধ্যাতারা করে। অঙ্গের কুঙ্কুম গন্ধ কেশধুপবাস/ ফেলিল সর্বাঙ্গে মোর উতলা নিশ্বাস। প্রকাশিল অর্ধচ্যুত বসন-অন্তরে/ চন্দনের পত্রলেখা বামপয়োধরে। দাঁড়াইল প্রতিমার প্রায়/ নগর গুঞ্জনক্ষান্ত নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়।”
অনবদ্য চিত্ররূপময়তা প্রকাশ পেয়েছে কীটস-এর 'ode to Autumn’, এ Art ও Life beauty reality সব যেন একাকার।
"Season of mists and
mellow fruitfulness! Close bosom-friend of the maturing sun; Conspiring with
him how to load and bless with fruit the vines that round the thatch-eves
run" To bend with apples the moss'd Cottage-trees And fill all fruit with
ripeness to the core"
এর সঙ্গে তুলনা চলে ‘রূপসী বাংলা'র কবি জীবনানন্দের। রূপসী বাংলায় Pictorial suggestiveness বা চিত্রময়তার ইঙ্গিত সৃজন করা হয়েছে কথার পরে কথা সাজিয়ে, সরল প্রাঞলতায় ভরা সুর ও ছবি যেন সরাসরি হৃদয়ে প্রবেশ করে। কবি যেন প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ ও শব্দকে উপভোগ করেছেন পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে।
“এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালী জল কতদিন এসে ধুয়েছে আমার দেহ-বুলায়ে দিয়েছে চুল— চোখের উপরে তার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে— আবেগের ভরে ঠোটে এসে চুমো দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে ; এই জল ভালো লাগে, নীলপাতা মৃদুঘাস রৌদ্রের দেশে ফিঙ্গা যেমন তার দিনগুলো ভালোবাসে— বনের ভিতরে বারবার উড়ে যায়,— তেমনই গোপন প্রেমে এই জল ঝরে আমার দেহের পরে আমার চোখের পরে ধানের আবেশে যখন অঘ্রাণ রাতে ভরা ক্ষেত হয়েছে হলুদ, ঝরে পড়ে ; যখন জামের ডালে পেঁচার নরম হিমগান শোনা যায়, বনের কিনারে ঝরে যেই ধান বুকে ক'রে শান্ত শালিক্ষুদ তেমনি ঝরিছে জল আমার ঠোটের পরে—চোখের পাতায়- আমার চুলের পরে— অপরাহ্ণে রাঙা রোদ সবুজ খাতায় রেখেছে নরম হাত যেন তার ঢালিছে বুকের থেকে দুধ।”
কল্পনা (Imagination) ব্যতিরেকে চিত্রকল্প (Image) সম্ভব নয়। চিত্রকল্প ঠিক চিত্রও নয়। তবে চিত্র কবির আবেগ ও অনুভূতির সার্থক মিলনে হয়ে ওঠে চেতনালোকের সামগ্রী। চিত্রকল্প আসলে কবির ধ্যানতন্ময়তার ফসল, যাকে কোলরিজ বলেন ‘Harmonised into an organic
whole' বা লুইস বলেন “a word picture charged
with emotion and passion”. অর্থাৎ কবিতার চিত্রমালা শব্দচিত্র বলা যায় a reflection of an external
reality যাতে আছে কাব্যিক ভাব ও সৌন্দর্য এবং অনুভূতির গাঢ় প্রলেপ। ঠিক এই কারণেই যুগ সন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বর গুপ্তের নিসর্গ চেতনা মূলক কবিতাগুলি কাব্যিক ভাবসৌন্দর্যে উত্তরিত হয়নি। তাঁর নিসর্গ কবিতায় আছে ব্যঞ্জনাধর্মী কবি কল্পনার অভাব। বঞ্ছনার প্রয়োজনে যে গভীরতার প্রয়োজন তা ঈশ্বরচন্দ্রের বস্তুবাদী মানসিকতায় ছিল না। যেমন বর্ষার রাজ্যাভিষেক পর্ব উদযাপনের বর্ণনায় কবি কল্পনার চমক নেই । “চাতক ময়ুর আর জলধর ভেক,/ বর্ষাকে করিল রাজ্যেতে অভিষেক।। সেনাপতি জলধর শর বৃষ্টি করে/ স্থানে স্থানে ভেকগণ নকিব ফুকরে।। আকাশে চাতকগণ বাজাইছে তুরী/ আনন্দে কাননে নাচে ময়ূর ময়ুরী।। এমনই বস্তুবাদী বর্ণনা আছে গ্রীষ্ম, শীত ও বসন্তের। সবই প্রাচীন নিসর্গ বর্ণনার অক্ষম অনুকরণ। বস্তুবাদী খণ্ড চিত্রের বর্ণনায় কীটস্ ও রবীন্দ্রনাথ যে রকম মৌলিকতা দেখিয়েছেন, সে তুলনায় ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা কোন মৌলিকতা দাবী করতে পারে না।
রবীন্দ্রনাথ যাঁকে গুরু বলেছিলেন সেই বিহারীলাল চক্রবর্তীর ‘নিসর্গ-সন্দর্শণ' কাব্যেও আছে আত্মলীন ভাবের অভাব। সমুদ্রের বাহ্যিক রূপেই যেন তিনি বিস্মিত, অনুভূতির ভাবতরঙ্গের বিস্তার এতে নেই। নভোমণ্ডল ও ঝটিকা সম্ভোগ চিত্রও সাধারণ ভাব প্রকাশক। বঙ্গসুন্দরী'-তে কল্পনাক্রীড়ার যে ছবি বর্তমান তা নিসর্গ সন্দর্শণ'-এ নেই। উল্লাস ও বিষণ্ণতায়, চাওয়া ও না পাওয়ার বেদনায় ভরা, কল্পনা, ভাব ও সুর— তিনের মিশ্রণে চিত্র হতে চিত্রান্তরে উপনীত হওয়া বিহারীলালের ‘সারদা মঙ্গল' এক অপরূপ কাব্য। কবির মানস প্রিয়া রূপে যে সারদা ব্যক্তিক বা বিশেষ, তিনিই আবার বিশ্ব সৌন্দর্যের মূলাধার রূপে নৈর্ব্যক্তিক ও নির্বিশেষ। তবুও কাব্যের প্রথম সর্গে সাংকেতিকতার যে ঐশ্বর্য বর্তমান অন্যত্র তা নেই। সসীম ও অসীম, বিশেষ ও নির্বিশেষ, আদর্শ ও বাস্তবের টানা পোড়েনের মধ্যেও সমন্বয় সাধনের চেষ্টায় কাব্য সমাপ্ত। কাব্যটি Subjective বা আত্মলীন কাব্য, তারই মধ্যে হিমালয় বর্ণনার মত objective নিগর্স চিত্র কাব্যটির যথেষ্ট হানি ঘটিয়েছে। প্রথম সর্গ ব্যতীত অন্যত্র ভাবের অস্পষ্টতা, অলৌকিকতার মিশ্রণ, কল্পনা ও আবেগের উচ্ছ্বাস এই কথাই মনে রায় যে বিহারীলালের কবি মানস শিল্পী ও ধ্যানীর মিলন ক্ষেত্র। ধ্যানী প্রাধান্য পেলেই শিল্পী সত্তা অপ্রধান হয়ে পড়ে।
কাব্য-সৌন্দর্য, হৃদয়াবেগও অনুভূতি সহযোগে চিত্রকল্প নির্মাণে সার্থকতা প্রথম দৃষ্ট
হয় রবীন্দ্রনাথে। তাঁর অজস্র কবিতায় ভিন্নধর্মী চিত্রকল্পের ভিড়। সোনারতরীর ‘সমুদ্রের প্রতি কবিতায় কবি তিনটি স্তরে যে চিত্রকল্প তুলে ধরেছেন তা হল সমুদ্রও বসুন্ধরার মাতা পুত্রীর সম্পর্ক, পৃথিবীর শিশুরূপে সমুদ্রতীরে কবির উপস্থিতি ও নিবেদন।
‘হে আদি জননী সিন্ধু, বসুন্ধরা সন্তান তোমার/ একমাত্র কন্যাতব কোলে, তাই তন্দ্রা
নাহি আর/ চক্ষে তব।” পরের চিত্রকল্পে আছে, “আমি পৃথিবীর শিশু বসে আছি তব উপকূলে/ শুনিতেছি ধ্বনিতব......।” পরের চিত্রকল্পে কবির নিবেদন, হে জলধী, বুঝিবে কি তুমি/ আমার মানবভাষা? জান কি?- তোমার ধরাভূমি। পীড়ায় পীড়িত আজি ফিরিতেছে এপাশ ও পাশ/ চক্ষে বহে অশ্রুধারা, ঘন ঘন বহে উষ্ণশ্বাস,”
‘বসুন্ধরা’ কবিতায় শরৎ কিরণের বর্ণনায় কবি যে চিত্রকল্প তুলে ধরেছেন তা হল,
শরৎকিরণ/পড়ে যবে পঞ্চশীর্ষ স্বর্ণক্ষেত্র—'পরে
নারিকেল দলগুলি কাঁপে বায়ু ভরে/ আলোকে ঝিকিয়া, জাগে মহাব্যাকুলতা— মনে পড়ে বুঝি সেই দিবসের কথা/ মন যবে ছিল মোর সর্বব্যাপী হয়ে জলে স্থলে অরণ্যের পল্লব নিলয়ে/ আকাশের নীলিমায়....।” “মানস সুন্দরী’তে নবীনা বালিকার বর্ণনায়,
“ানে আছে কবে কোন ফুল্ল যুথী বনে/ বহু বাল্যকালে, দেখা হত দুইজনে আধো চেনা শোনা? তুমি এই পৃথিবীর/ প্রতিবেশিনীর মেয়ে, ধরার অস্থির এক বালকের সাথে কী খেলা খেলাতে/সখী, আসিতে হাসিয়া তরুণ প্রভাতে নবীন বালিকা-মূর্তি-শুভ্রবস্ত্র পরি/ ঊষার কিরণ ধারে সদ্য স্নান করি বিকচ কুসুম সম ফুল্লমুখ খানি/ নিদ্রাভঙ্গে দেখা দিতে.......” ।
এইভাবেই রবীন্দ্রনাথ চিত্রের পর চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন বলাকা, পৃথিবী, ভ্রষ্ট লগ্ন, পরিশোধ, দেবতার গ্রাস, নববর্ষা, যেতে নাহি দিব এবং নিরুদ্দেশ যাত্রা নামক কবিতায়। রবীন্দ্র সমসাময়িক যুগে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছন্দের যাদুকর নামে খ্যাত হয়েছিলেন। তিনি fancy অর্থাৎ শ্রীকুমার বাবু যাকে বলেছেন কল্পনা বিলাস— তার উপরে নির্ভর করে ছন্দের নৃত্যহিল্লোলে, চটুল শব্দের ধ্বনিময় প্রয়োগে, রং ও তুলির টানে কবিতার মধ্যে যে সব চিত্র এঁকেছেন, সেসবে কাব্যের উৎকর্ষ ও বিশুদ্ধি অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। তবে একথা সত্য যে সত্যেন্দ্রনাথ মিথ বা পুরাণকে তাঁর কবিতায় নানাভাবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার কবিতা তথ্য ভারাক্রান্ত, এমন কি নিসর্গ বিষয়ক কবিতাতেও ভাবের কোন গভীরতা নেই। অনুপ্রাসের দোলায় চিত্র স্পষ্ট হয়, তবে তাকে চিত্রকল্প বলা যায় না। সত্যেন্দ্রনাথ সম্পর্কে মোহিতলাল বলেছিলেন,
“বেদনার অর্থ রচি নিবেদিলে যাহার উদ্দেশ্যে আজীবন,— পথের পাথর মাজি মনি অমলিন
রচিলে যাহার লাগি — দৃষ্টি ক্রমে হয়ে এল ক্ষীণ
বিদায়ের কালে সে কি ললাটে চুমিল ভালবেসে” (স্মরগরল/ মোহিতলাল।) বাংলা কবিতার দুই স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ। এজন লিঙ্গুইষ্ট অপরজন ইমেজিষ্ট, কবিতার জগতে চিত্রকে সংস্থাপন করেছিলেন প্রথম জন, আর কবিতাকেই চিত্র নির্ভর করে তুললেন অপরজন। এক কথায় রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার বর্তাল জীবনানন্দে। জীবনানন্দের কবিতার যেটা চমৎকারিতা বা অভিনব উৎকর্ষতা তা হল সম্মোহনী শক্তি সম্পন্ন শব্দের নিপুণ প্রয়োগ। দর্শনের প্রেক্ষিতে কবিতা রচিত হয়, কিন্তু কবিতা দর্শন নয়। গীতিকবিতার মূর্ছনাকে, ছন্দের বাহ্যিক রূপ চাতুর্যকেও তিনি গ্রহণ করেননি। শুধুমাত্র আবেগ দিয়ে কবিতার চিত্রকল্প নির্মাণে তাঁর এই অনীহাই তাঁকে নিয়োজিত করে নতুন পথে যে পথে রহস্যপূরীর দরজা খুলবে ছন্দ, প্রতীক, চিত্র ও রূপকল্পের সমন্বিত কলা কুশলতায়। রূপালি আগুন ভরা রাত, কুয়াশায় মেঠো চাঁদ, হলুদ ঠ্যাং তোলা শালিখ, পুরুষের শিশির ভেজা চোখ, নোনা মেয়ে মানুষ, কমলা লেবুর করুণ মাংস, হিম স্তন, বেতের ফলের মত ম্লান চোখ, বা তাঁর ইতিহাস নির্ভর উপমাগুলি যেমন শ্রাবস্তীর কারুকার্য, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা ইত্যাদি উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা, ধ্বনি সুষমার সুরভিত তাঁর বিভিন্ন কবিতার রূপকল্প নির্মাণে সহায়তা করেছে। হয়তো সে কারণেই বুদ্ধদেব বসু বলেছেন তাঁর কাব্য বর্ণনা বহুল। তাঁর বর্ণনা চিত্রবহুল এবং তাঁর চিত্র বর্ণবহুল।' অধ্যাপক তপনকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন “জীবনানন্দের কাব্যে দেখা যায় রূপক রচনার অজস্রতা, যত উপমার যত ইঙ্গিতে তিনি কল্পনাকে প্রকাশ করেন সেগুলো ভাবাত্মক নয়, রূপাত্মক, চিন্তাপ্রসূত নয়, অনুভূতি প্রসূত” । তিনি সবচেয়ে কম আধ্যাত্মিক, সবচেয়ে বেশি শারীরিক, তাঁর রচনা সবচেয়ে কম বুদ্ধিগত, সবচেয়ে বেশি ইন্দ্রিয়গত। তাঁর এই বিশেষত্বই কীটস্ ও প্রির্যাফেলাইটদের কথা মনে করিয়ে দেয়।” (বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও সাহিত্য টীকা)। রবীন্দ্রনাথও তাঁর একটি কবিতাকে বলেছিলেন ‘চিত্ররূপময়'। মনে হয় তাঁর সামগ্রিক কবিকর্মের ক্ষেত্রেও একথা প্রণোজ্য। তাঁর সব ছবিই দৃশ্য-গন্ধও স্পর্শময় বলেই তা সহজেই চিত্রকল্পে মহীয়ান। কথার পর কথা দিয়ে তিনি অপূর্ব চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন।
‘রূপসী বাংলা' কবিতায় বাংলার রূপ বর্ণনায় কবি বলেন,
“বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর, অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড় পাতাটির নিচে বসে আছে ভোরের দোয়েল পাখি— চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের অশ্বত্থের করে আছে চুপ
ফণীমনসার ঝোপে শাটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে”
জীবনানন্দের কবিতা দৃশ্যময় হলেও দৃশ্যের বিষয়িভূত না হয়ে হয়েছে উপলব্ধির বিষয়। স্বচেতন আবেগে তৈরি এই উপলব্ধিতে ইমণি, সুর রিয়্যালিজম সব এক হয়ে
গেছে। কবি যেন স্বচক্ষে দেখতে পান 'রূপালি চাঁদের হাত শিশিরে পাতা।' কিন্তু এই দেখাটা তাঁর উপলব্ধি।
আধুনিক কবিদের মধ্যে চিত্রকল্প অনেক কবির অনেক কবিতাতেই বর্তমান। তবে চিত্রকল্পের সমাবেশ জীবনানন্দে যেমন অন্যান্য কবির ক্ষেত্রে ততটা নয়। সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় নৌকা একটি প্রতীক বা চিত্রকল্পের বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে। অকুল পাথারে তাই মগ্নতরী আমার যৌবন' (অর্কেষ্ট্রা, অচ.,) শিপন, দ্রব্যের ভারে যবে মোর তরী/ নিঃস্রোত জীবন পঙ্কে হয়েছিল নিতান্ত নিশ্চল/ তুমিই দেখায়েছিলে নিরুদ্দেশে আশ্রয়ের তীর/ শান্তি সুনিবিড়।” (অর্কেস্ট্রা/মূর্তিপূজা)।
ইমেজ ব্যতীত কবিতা হয় না। বুদ্ধদেব বসুর 'দময়ন্তী' রূপবর্ণনায় লিখেছেন,
‘যে মুহূর্তে বাসনা বিহ্বল নীবী/ খসে পড়ে দেখা যায় কালের প্রলয় জলে/সর্বঘ্ন তিমির তলে অলজ্জ ব-দ্বীপ,/ অমনি থমকে কাল; অদৃষ্টের করাল কুহেলি/দীর্ণকরে আদিম পুরুষ/ লভে সপ্তদশ দ্বীপা সসাগরা পৃথিবীরে” |
ইমেজের ব্যবহার অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার সমধিক— যদিও তা জীবনানন্দের মত নয়। তাঁর ‘দূরযাণী' কাব্যগ্রন্থের ‘দুই বেলা' কবিতায় আছে অনুকারের চিত্রকল্প।
“সৃজনের তাপ বীর্যবশে/ প্রশমিত তেজ হয়ে ঊর্ধ্বে ওঠে,/ জ্যোতিষ্মান, সপ্তধাতু ধারণ মিশ্রণ হোমানলে ।/ শান্তিবারি পড়ে তাতে, চিত্তে বয় শান্ত বায়ু/ মানুষের সভ্যতায় দেখা দেয় শহর সমাজ।”
আধুনিক কবিদের মধ্যে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘পূর্বরাগ’ কবিতায় আছে চিত্রকল্পের সুঠাম বিন্যাস।
“চেয়ে দ্যাখো মন/ এই ক্লান্তি এ শ্রান্তিকে ঘিরে আবার কখন/ মন কেড়ে নেওয়া মায়াবী বিকেল বিছিয়েছে জাল/নিপুণ নেশায়”
চিত্রকল্প রূপ নিয়েছে অত্যাধুনিক কবিদের কবিতাতেও।—
“যখন দ্বিপ্রহরে বর্হিগত হই আমি, ঠাকুরদাস/ আর রাস্তায় রাস্তায় আবিষ্কার করতে থাকি/ চিঁড়ের দোকান মুড়ির দোকান/ ঘুগনি-রুটির জন্য মস্তান অধ্যুষিত বৌদির দোকান/ আমি আবিষ্কার করি চা অলার বিধবাকে / যে এখনও তার স্বামীর মতোই এক কাশ চা ৮০ পয়সা নিচ্ছে/ আর খাতায় তারিখ লিখছে, ধার লিখছে, আর ধারশোধও লিখছে/ আর খাতায় পিটুনিও লিখছে কিনা দেখার জন্য আমি উঁকি মারি।” (জয় গোস্বামী/ বজ্রবিদ্যুৎ ভর্তিখাতা/ আত্মজীবনীর অংশ)
0 Comments