বাংলা কবিতায় ছন্দের প্রভাব ও তার সংরুপ: আব্দুল মুসরেফ খাঁন

 

   বাংলা কবিতায় ছন্দের প্রভাব  তার সংরুপআব্দুল মুসরেফ খাঁন



 বাংলা কবিতায় ছন্দের প্রভাব  তার সংরুপআব্দুল মুসরেফ খাঁন

ছন্দের কাজ আনন্দদান করা— ‘ছন্দয়তি হ্লাদয়তি সিদ্ধান্ত কৌমুদির এই বিধান বেদ-উপনিষদের পরম্পরা হতে জাত নিখিল বিশ্বের সব কিছুই ছন্দময় ছন্দহীন জীবন মৃত্যুরই নামান্তর নদীর কল্লোলে, পাখির কলতানে, সূর্যের উদয় অস্তগমাে, নট- নটীর পদবিক্ষেপে, সুরের প্রবাহে, ভাস্কর্যের চিত্রশিল্পের মহিমায়, বনভূমি অরণ্যের মর্মরতায়সর্বত্রই এক ছন্দের শ্রুতিগ্রাহ্য বা দৃষ্টিগ্রাহ্য সৌন্দর্য বিদ্যমান বলেই নিখিল বিশ্বের সব কিছুই প্রাঞ্চল সৌন্দর্যময় হয়ে ওঠে শিল্পক্ষেত্রে জীবনের ছন্দ ছন্দায়িত হয় বলেই কাব্যশিল্প এক নিগুঢ় ছন্দের বন্ধনে বাঁধা কবির আবেগের ভাষা ছন্দের স্পন্দনে স্পন্দিত হয়ে রস সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে

মানুষ যে ভাষা ব্যবহার করে তা ব্যবহারিক ভাষা, সংবাদ আদান প্রদানের ভাষা, দৈনন্দিন কাজ চালানোর ভাষা প্রেমের আনন্দ স্বল্পকাল থাকে, কিন্তু প্রেমের বেদনা সমস্ত জীবন ধরে বইতে হয় ভাষা সাধারণ গদ্যিক ভাষা কিন্তু একেই যখন ছন্দের হিল্লোলে হিল্লোলিত করে কবি বলেন, “প্রেমের আনন্দ থাকে / শুধু স্বল্পক্ষণ/ প্রেমের বেদন থাকে / সমস্ত জীবন' বা শেলী বলেন, 'Our Sweetest songs are those that tell us saddest thought'- তখনই তা কবিতা বা কাব্যের ভাষা হয়ে ওঠে ব্যবহারিক ভাষা তার জড়ধর্ম হতে মুক্ত নয় রবীন্দ্রনাথ ছন্দকে জড়ধর্ম হতে মুক্তির উপায় বলেছেন সেতারের বাঁধা তার হতে নিয়ন্ত্রিত সুরের পরিব্যপ্ত রূপ যেমন অন্তরকে স্পর্শ করে, কথ্য ভাষায় ছন্দের হিল্লোল ঠিক সেই কাজটিই করে থাকে প্রবোধচন্দ্র সেন ছন্দকে বলেছেন সুনিয়ন্ত্রিত সুপরিচিত বাক্বিন্যাস-এর শিল্পীত বাকভঙ্গি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় ছন্দকে পদবিন্যাস প্রক্রিয়ার অঙ্গরূপে দেখেছেন তাঁদের মতে ছন্দের প্রধান কাজই হল বাক্যের মধ্যে রস সঞ্চার করে শ্রুতিমধুর করে তোলা এবং কালগত ধ্বনিগত সূষমাকে উন্মোচিত করা ছন্দকে সঙ্গীতের সঙ্গে তুলনা করে রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র বলেছেন,

তটবদ্ধ নদীর মধ্যে সর্বদা একটা কলধ্বনি শোনা যায় ছন্দের মধ্যে বেঁধে দিলে কথাগুলোও সেইরকম আঘাত সংঘাত করে একটা সংগীত সৃষ্টি করতে থাকে.........বাঁধনের মধ্যে থাকাটাই গতির সৌন্দর্য, ধ্বনির সৌন্দর্য এবং আকারের সৌন্দর্য

ছন্দের ইংরাজী প্রতিশব্দ মিটার (Metre) I. V. Cunningham বলেন, “Poetry is Metrical writing. If it is anything else, I do not know what it is"-Chatman মিটারকে বলেছেন “a systematic literary Convention whereby Certain aspects of Phonology are organised for aesthetic purpose”

রবীন্দ্রনাথও এমনটাই বলেছেন,

মানবের জীর্ণবাক্যে মোর ছন্দ দিবে নব সুর

অর্থের বন্ধন হতে নিয়ে তারে যাবে কিছুদূর

ভাবের স্বাধীন লোকে

'ভাবের স্বাধীন লোক' Chatman এর aesthetic world' রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেন যে পাবর্তী পরমেশ্বরের মতই কথা ধ্বনি, সুর ছন্দ, ভাব রূপ পরস্পরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়ে ভাবলোক সৃজন করে

'সুর আপনারে ধরা দিতে চাহে ছন্দে ছন্দ ফিরিয়া ছুটে যেতে চায় সুরে

ভাব পেতে চায় রূপের মাঝারে অঙ্গ/ রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়াওঙ্কার এর ধ্বনির অনুরণন যেমন জ্যামুক্ত তীরের মত আত্মাকে ব্রহ্ম-উপলব্ধির জগতে পৌঁছে দেয়, তেমনি ছন্দের বন্ধনে বেগবান ধ্বনি শব্দার্থ ব্যতিরেকেই পাঠককে পৌঁছে দেয় রসের জগতে ছন্দের কাজ কবিতার ভূষণ হওয়া-বাচ্যার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করা কবিতা তাই ব্যঞ্জনা লোকের সামগ্রী কিন্তু সাধারণ ভূষণ যেমন বহিরঙ্গের সামগ্রী, কবিতার ছন্দ তেমন নয় ছন্দের সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক অন্তরঙ্গ যে কবিতা কষ্টকল্পিত; তার ছন্দ বহিরঙ্গ মাত্র

কবি বুদ্ধদেব বসু ছন্দকে এক সুনিয়ন্ত্রিত ভঙ্গি ভেবে কাব্যের প্রধান বাহন হিসাবে মেনে নিয়ে বলেছিলেন, “আর আমি বন্দী হয়েছি ছন্দোবন্ধনে” (দ্রৌপদীর শাড়ি) তাঁর কথায় মনে হয় যে, তিনি যেন ছন্দের বন্ধনে বাঁধা পড়তে বাধ্য হয়েছেন তাঁর দায় যেন নিতান্তই কবিতা লেখার দায় রবীন্দ্রনাথ ছন্দোবন্ধনে মাধুরীকে পেতে চেয়েছিলেনঅধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে যা মোক্ষ, রবীন্দ্র পরবর্তী কবিদের কাছে তা হতে পারে সর্বনাশের পথএমনটাই বলেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কবিতার ভাবে ভাবাবিষ্ট হলেও প্রতি ছত্রে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব মৌলিকতা সর্বত্রই দৃশ্যমান স্বকীয় মৌলিকতা রক্ষার স্বার্থেই পরবর্তী কল্লোল যুগের কবিরা রবীন্দ্র বলয় হতে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন ছন্দ ভাঙার যে কাজ রবীন্দ্র পূর্ববর্তী কালে মধুসূদন আরম্ভ করেছিলেন এবং সমকালীন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যে বিষয়ে কৃতবিদ্য হয়েছিলেনতা কিন্তু ছন্দ হতে মুক্তির পথ নয় একে বলা যায় ছন্দের পরীক্ষা নিরীক্ষা কল্লোল যুগের কবিরাও তা পারেন নি ছন্দমুক্তি ঘটেছে আধুনিক কবিতায় কিন্তু সে আলোচনা পরবর্তী বিষয় চর্যাগীতি হতে ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরএই সুদীর্ঘ ইতিহাসে ছন্দের বাঁধা ধরা গণ্ডির মধ্যে বৈচিত্র্য সৃজন করতে চেয়েছেন ভারতচন্দ্র তিনি কর্ণেন্দ্রিয়কে বেশি প্রাধান্য দিতে সংস্কৃত ছন্দের দ্বারস্থ হয়েছেন তোটক-তৃনক-ভূজঙ্গ প্রয়াত ইত্যাদি সংস্কৃত ছন্দ বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে নতুন বৈচিত্র্য নিয়ে এল সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কাজ করেছেন, মন্দাক্রান্তা, মালিনী প্রমুখ বহু সংস্কৃত ছন্দকে বাংলা ছন্দের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করেছেন এই ছন্দের যাদুকর সংস্কৃত, ইংরাজী এবং বাংলা- এই ত্রি ভাষার ছন্দ নিরুপণের রীতি এক নয় ইংরাজীতে Prosody এবং Scan করার সময় সিলেবেলের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় একটি সিলেবেলে একাধিক Vowel থাকতে পারে, তার মধ্যে একটি vowel vowel sound হবে যেমন glide বা goal একটাই vowel sound, তাই এদের বলা হয় Monosyllabic কিন্তু Be-long, little, এগুলির ২টি vowel sound, এবং Elec-tri- ci ty তে ৫টি vowel sound বর্তমান একটি word বা শব্দে একাধিক সিলেবেল থাকলেও একটিই তার মধ্যে accented হবে ac'-ci-dent শব্দটিতে তিনটি syllable থাকলেও প্রথম syllable stress পড়েছে কিন্তু accident শব্দটিকে যখন inflic- tio:: সহযোগে লম্বা করা হয় অর্থাৎ ac-ci dental করা হয়, তখন stress পড়ে প্রথম তৃতীয় syllable- কিন্তু প্রথমটিতে stress পড়লেও তা তৃতীয় syllable অপেক্ষা কম জোর পড়ে সে কারণে তৃতীয়টিকে বলা হয় Primary accented এবং প্রথমটিকে বলা হয় Secondary accented syllables / Article, preposition, Conjunction প্রভৃতি কোন সময়েই Accented হয় না দুই বা তিনের অনধিক Syllable নিয়ে একটি measure বা foot হয় নিচের উদাহরণে প্রতি foot একটি accented syllable আছে

A'll this/ toi'-l for hu'-man/ cul'-ture"

দুইটি সিলেবেল যুক্ত foot যদি accented syllable unaccented syllable এর দ্বারা অনুসৃত হয়, তবে তাকে বলা হয় Trochaic |

"ni'-gh-er / sti'll and / hi'-gh-er."

(Bose & Sterling 47 'Elements of English Rhetoric and Prosody 20 বিভিন্ন Prosodic name, Metrical formula এবং example এর তালিকা এখানে উদ্ধৃত করা হল)

Prosodic name

1. lambus

2. Trochee

3. Dautyl

4. Anapaest

5. Amphibrach

কবিতার চরণে একাধিক foot এর সমন্বয় ঘটলে এক হতে ৭ম পর্যন্ত তার নাম হল, Monometer, Dimeter, Trimeter, Tetrameter, Pentameter Hexameter এবং

Heptameter ইংরাজী scanning এর একটি উদাহরণ হল

For bold/ in heart/ and áct/ and word/ was hé

when-év/er slán/ der breathed/ a-gainst/ the ki'ng-lambi'c Pentameter

 সংস্কৃত ছন্দ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, “বৃত্তমক্ষর সংখ্যাতং জাতিমাত্রা কৃতা ভবেৎঅর্থাৎ প্রতি চরণের অক্ষর গণনার দ্বারা যে ছন্দ হয় তা বৃত্ত ছন্দ এবং মাত্রা গণনার দ্বারা হয় জাতি বৃত্ত ছন্দের তিনটিভেদ, যথা সম, অর্ধসম বিষম চারটি চরণে সমান সংখ্যক অক্ষর থাকলে হয় সম, ১ম তৃতীয় চরণে সমসংখ্যক এবং দ্বিতীয় চতুর্থে সমসংখ্যক অক্ষর থাকলে হয় অর্ধসমবৃত্ত এবং চারটি চরণেই অসম সংখ্যক অক্ষর থাকলে তা বিষম বৃত্ত বৃত্ত ছন্দে দশটি সংকেত অক্ষর বর্তমান যথা , , , , , , , , এবং শেষের দুটি এবং একটি অক্ষর নিয়ে এবং বাকিরা তিনটি অক্ষর মিলে এক একটি গণ হয় স্ত্রীগুরু বা গণের তিনটিই গুরু; স্ক্রিলঘুশ্চা নকারো' বা 7 গণের তিনটিই লঘু, ‘ভাদিগুরুবা -গণের প্রথমটি গুরু শেষ দুটি লঘু, পুনরাদিলঘু র্য বা -গণের প্রথসটি লঘু এবং শেষদ্বয় গুরু, জো-গুরু মধ্যগত বা -গণের প্রথম শেষ লঘু, মধ্য গুরু- মধ্যবা -গণের প্রথম শেষ গরু, মধ্য লঘু, ‘সোহন্ত গুরু বা -গণের প্রথম দুইটি লঘু, শেষের টি গুরুতোহন্ত লঘু স্তবা -গণের প্রথম দুটি গুরু এবং শেষেরটি লঘু, এবংগুরু রেকো গকারস্তু লকারো লঘুরেককঃ অর্থাৎ গণের যথাক্রমে গুরু বর্ণ লঘু বর্ণ বৃত্ত -দের একটির নাম মালিনী এর সূত্র হল যুতেয়ং মালিনী ভোগি লোকৈঃ' অর্থাৎ প্রতিপাদে ----- ক্রমে ১৫টি অক্ষর থাকে যেমন সি নু বিধ্বংশৈ মাত্রা ছন্দ মাত্রা ভিত্তিক, চারটি মাত্রা নিয়ে পাঁচটিগণ হ্রস্ব স্বরের এক মাত্রা, দীর্ঘস্বরের

মাত্রা, যুক্ত ব্যঞ্জনের পূর্ববর্তী স্বর দুই মাত্রা এবং অনুস্বর বিসর্গ যুক্ত স্বর দুই মাত্রা রতি সুখ সারে গতমভি সারে মদনম নোহর বেশম্

এখানে মাত্রার ৭টি পর্বে ২৮টি মাত্রার দ্বারা চরণ রচিত হয়েছে সুতরাং সংস্কৃত ছন্দে অক্ষর মাত্রা উভয়েই বিশেষ গুরুত্ব পায়

বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র্য হেতু বাংলা ছন্দের নিয়মনীতিরও স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান ইংরাজী সংস্কৃত দুই ভাষারই সঙ্গে বাংলা ছন্দের মূলগত পার্থক্য বর্তমান বাংলা ছন্দ নিরূপণে যে উপাদানগুলি অত্যক সেগুলি হল, ধ্বনি, দল বা অক্ষর, মাত্রা, পর্ব বা পর্বাঙ্গ, ছেদ যতি, পদ বা পংক্তি, স্তবক এবং লয় ধ্বনি হল মানুষের কন্ঠ হতে উচ্চারিত স্বর এর রূপ দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়- বলা যায় শ্রুতিগ্রাহ্য ইংরাজী Syllable এর মত বাংলার দল বা অক্ষর আছে অক্ষর ব্লতে সেই হ্র স্বতম অংশকে বোঝার যা বাগ্যন্ত্রের স্বল্পতম প্রয়াসে বা এক ঝোঁকে উচ্চারিত হয় ইংরাজীর vowel sound এর মত একটি অক্ষর বা দলের মধ্যে একটি মাত্র স্বরধ্বনি থাকবে

sound হবে যেমন glide বা goal একটাই vowel sound, তাই এদের বলা হয় Monosyllabic কিন্তু Be-long, little, এগুলির ২টি vowel sound, এবং Elec-tri- ci ty তে ৫টি vowel sound বর্তমান একটি word বা শব্দে একাধিক সিলেবেল থাকলেও একটিই তার মধ্যে accented হবে ac'-ci-dent শব্দটিতে তিনটি syllable থাকলেও প্রথম syllable stress পড়েছে কিন্তু accident শব্দটিকে যখন inflic- tio:: সহযোগে লম্বা করা হয় অর্থাৎ ac-ci dental করা হয়, তখন stress পড়ে প্রথম তৃতীয় syllable- কিন্তু প্রথমটিতে stress পড়লেও তা তৃতীয় syllable অপেক্ষা কম জোর পড়ে সে কারণে তৃতীয়টিকে বলা হয় Primary accented এবং প্রথমটিকে বলা হয় Secondary accented syllables / Article, preposition, Conjunction প্রভৃতি কোন সময়েই Accented হয় না

দুই বা তিনের অনধিক Syllable নিয়ে একটি measure বা foot হয় নিচের উদাহরণে প্রতি foot একটি accented syllable আছে

A'll this/ toi'-l for hu'-man/ cul'-ture"

দুইটি সিলেবেল যুক্ত foot যদি accented syllable unaccented syllable এর দ্বারা অনুসৃত হয়, তবে তাকে বলা হয় Trochaic |

"ni'-gh-er / sti'll and / hi'-gh-er."

(Bose & Sterling 47 'Elements of English Rhetoric and Prosody 20 বিভিন্ন Prosodic name, Metrical formula এবং example এর তালিকা এখানে উদ্ধৃত করা হল)

Prosodic name

1. lambus

2. Trochee

3. Dautyl

4. Anapaest

5. Amphibrach

কবিতার চরণে একাধিক foot এর সমন্বয় ঘটলে এক হতে ৭ম পর্যন্ত তার নাম হল, Monometer, Dimeter, Trimeter, Tetrameter, Pentameter Hexameter এবং

Heptameter ইংরাজী scanning এর একটি উদাহরণ হল

For bold/ in heart/ and áct/ and word/ was hé

when-év/er slán/ der breathed/ a-gainst/ the ki'ng-lambi'c Pentameter

 

সংস্কৃত ছন্দ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, “বৃত্তমক্ষর সংখ্যাতং জাতিমাত্রা কৃতা ভবেৎঅর্থাৎ প্রতি চরণের অক্ষর গণনার দ্বারা যে ছন্দ হয় তা বৃত্ত ছন্দ এবং মাত্রা গণনার দ্বারা হয় জাতি বৃত্ত ছন্দের তিনটিভেদ, যথা সম, অর্ধসম বিষম চারটি চরণে সমান সংখ্যক অক্ষর থাকলে হয় সম, ১ম তৃতীয় চরণে সমসংখ্যক এবং দ্বিতীয় চতুর্থে সমসংখ্যক অক্ষর থাকলে হয় অর্ধসমবৃত্ত এবং চারটি চরণেই অসম সংখ্যক অক্ষর থাকলে তা বিষম বৃত্ত বৃত্ত ছন্দে দশটি সংকেত অক্ষর বর্তমান যথা , , , , , , , , এবং শেষের দুটি এবং একটি অক্ষর নিয়ে এবং বাকিরা তিনটি অক্ষর মিলে এক একটি গণ হয় স্ত্রীগুরু বা গণের তিনটিই গুরু; স্ক্রিলঘুশ্চা নকারো' বা 7 গণের তিনটিই লঘু, ‘ভাদিগুরুবা -গণের প্রথমটি গুরু শেষ দুটি লঘু, পুনরাদিলঘু র্য বা -গণের প্রথসটি লঘু এবং শেষদ্বয় গুরু, জো-গুরু মধ্যগত বা -গণের প্রথম শেষ লঘু, মধ্য গুরু- মধ্যবা -গণের প্রথম শেষ গরু, মধ্য লঘু, ‘সোহন্ত গুরু বা -গণের প্রথম দুইটি লঘু, শেষের টি গুরুতোহন্ত লঘু স্তবা -গণের প্রথম দুটি গুরু এবং শেষেরটি লঘু, এবংগুরু রেকো গকারস্তু লকারো লঘুরেককঃ অর্থাৎ গণের যথাক্রমে গুরু বর্ণ লঘু বর্ণ বৃত্ত -দের একটির নাম মালিনী এর সূত্র হল যুতেয়ং মালিনী ভোগি লোকৈঃ' অর্থাৎ প্রতিপাদে ----- ক্রমে ১৫টি অক্ষর থাকে যেমন সি নু বিধ্বংশৈ মাত্রা ছন্দ মাত্রা ভিত্তিক, চারটি মাত্রা নিয়ে পাঁচটিগণ হ্রস্ব স্বরের এক মাত্রা, দীর্ঘস্বরের মাত্রা, যুক্ত ব্যঞ্জনের পূর্ববর্তী স্বর দুই মাত্রা এবং অনুস্বর বিসর্গ যুক্ত স্বর দুই মাত্রা রতি সুখ সারে গতমভি সারে মদনম নোহর বেশম্

এখানে মাত্রার ৭টি পর্বে ২৮টি মাত্রার দ্বারা চরণ রচিত হয়েছে সুতরাং সংস্কৃত ছন্দে অক্ষর মাত্রা উভয়েই বিশেষ গুরুত্ব পায়

বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র্য হেতু বাংলা ছন্দের নিয়মনীতিরও স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান ইংরাজী সংস্কৃত দুই ভাষারই সঙ্গে বাংলা ছন্দের মূলগত পার্থক্য বর্তমান বাংলা ছন্দ নিরূপণে যে উপাদানগুলি অত্যক সেগুলি হল, ধ্বনি, দল বা অক্ষর, মাত্রা, পর্ব বা পর্বাঙ্গ, ছেদ যতি, পদ বা পংক্তি, স্তবক এবং লয় ধ্বনি হল মানুষের কন্ঠ হতে উচ্চারিত স্বর এর রূপ দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়- বলা যায় শ্রুতিগ্রাহ্য ইংরাজী Syllable এর মত বাংলার দল বা অক্ষর আছে অক্ষর ব্লতে সেই হ্র স্বতম অংশকে বোঝার যা বাগ্যন্ত্রের স্বল্পতম প্রয়াসে বা এক ঝোঁকে উচ্চারিত হয় ইংরাজীর vowel sound এর মত একটি অক্ষর বা দলের মধ্যে একটি মাত্র স্বরধ্বনি থাকবেপ্রেমকথাটি বিশ্লেষণ করলে , , , পাওয়া যায় এবং এর মধ্যে '' স্বরধ্বনি, বাকি সব ব্যঞ্জন সুতরাংপ্রেম' একটি অক্ষর অক্ষর এর বিভাগটি নিম্নরূপ

-অক্ষরদল

স্বরান্ত / মুক্ত (open)

যৌগিক স্বরান্ত/মুক্ত

মৌলিক স্বরান্ত/মুক্ত

হলন্ত, ব্যঞ্জনান্ত, রুদ্ধ (closed)

বিপাশা = ----- তিনটি অক্ষরই স্বরান্ত এবং মুক্তদল

ভারত = ---, এখানে দুটি অক্ষর বা দল প্রথমটি স্বরান্ত, ‘রত' ব্যঞ্জনান্ত রূদ্ধ বাংলা ছন্দেমাত্রা' বা 'কলারগুরুত্ব অপরিসীম সাধারণত মুক্ত অক্ষরে ১মাত্রা এবং রুদ্ধ অক্ষরে মাত্ৰা হয়

স্মরণ সরণি পরে ফুল ফোটে থরে থরে -

প্রথম অংশে অক্ষর কিন্তু মাত্রা দ্বিতীয় অংশে অক্ষর মাত্রা দলবৃত্ত ছন্দে দল মাত্রেই মাত্রা কিন্তু কলা বৃত্তে তা হয় না কোন দল দীর্ঘ বা প্রসারিত রূপে উচ্চারিত হলে মাত্ৰা হয় ৷ক ঠিন্ কের সু ঠা ম্ পিন্ জর দল ১৪ মাত্রা মাত্রা নির্ণয়ের কয়েকটি সাধারণ নিয়ম আছে

দলবৃত্ত বা স্বর বৃত্তের ক্ষেত্রে দল বা অক্ষর মাত্রেই মাত্রা

কলাবৃত্ত/ মাত্রা বৃত্তের ক্ষেত্রে মুক্তদল মাত্রা রুদ্ধদল মাত্রা

অস্ত্র বৃত্ত / মিশ্র কলাবৃত্তের ক্ষেত্রে মুক্তদল পদের আদি মধ্য রুদ্ধ হলে মাত্রা হয় এবং একক পদান্ত রুদ্ধ দল মাত্রার হয় হয়

শ্বাসাঘাত যুক্ত বা অপ্রসারিত রুদ্ধ দল মাত্রার, কিন্তু প্রসারিত রুদ্ধ দল মাত্রার

সংযুক্ত বর্ণের পূর্বস্বর দীর্ঘ হলে তা মাত্রার এবং প্লুত স্বর মাত্রার ইংরাজীতে যার নাম metrical pause সংস্কৃতে তাই যতিযতির্জিহেষ্ট বিশ্রাম স্থানং কবিভিরুচ্যতে (ছন্দোমঞ্জুরী) বাংলায় তারই নাম ছন্দোযতি ভাব-ঐক্য, অর্থবোধ এবং পর্ব পরম্পরা রক্ষা করে উচ্চারণে সুষমা আনে প্রবোধচন্দ্র সেনের মতে যতি পাঁচ প্রকার কিন্তু অমূল্যধন বলেছেন প্রকার এবং তারাপদ ভট্টাচার্য বলেছেন তিন প্রকার তবে সাধারণ নিয়মানুযায়ী পর্বের পর লঘু বা হ্রস্ব যতি, চরণের পর পূর্ণ যতি, এবং পদের পর মধ্য যতির ব্যবহার হয় তবে অমিত্রাক্ষর ছন্দে, গদ্য কবিতায় এবং প্রবহমান পয়ারে যতির নিয়ম খাটে না সেখানে পদে পদে ব্যতিক্রম

এক হ্রস্ব যতি হতে অন্য আর এক হ্রস্ব যতির মধ্য অংশের নাম পর্ব প্রধা ছন্দগুলিতে পর্ব সমতা বজায় থাকলেও প্রবহমান ছন্দে পর্ব অসামাত্রিক হয় রিদম বা প্রবাহ বা লয় বিভিন্ন কবিতা ভাবের তারতম্য অনুসারে কখনও দ্রুত লয়ে, কখনও বা বিলম্বিত লয়ে পাঠ করা হয় এই লয়কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন স্পন্দন, উজ্জ্বল বাবু একে ছন্দস্পন্দ বলতে চান এর ইংরাজী নাম Rhythm | Rhythm সম্পর্কে J.A. Cuddon বলেন, "In verse and Prose, the movement or sense of movement Communicated by the arrangement of stressed and unstressed syueables" কবিতায় রিদম্ অপরিহার্য এবং তা metrical pattern এর উপর নির্ভরশীল নদীর প্রবাহের মতই এর গতি বলেই এর নাম ধ্বনি প্রবাহ যা সৃষ্টি হয় মাত্রা অনুযায়ী লঘু গুরু ধ্বনির সুনিয়ন্ত্রিত বিন্যাসে কবিতার মধ্যে এই সাঙ্গীতিক উপাদানই কবিতার প্রাণ কবিতার ভাবও হয়ে ওঠে গানের সুরের মত হৃদয়স্পর্শী হয়তো সে কারণেই ফরাসী সিম্বোলিষ্টরা কবিতার মধ্যে সুরের ছন্দকে বেশি গুরুত্ব দিতেন বোদলেয়ার একে বলেছেন ‘evocative bewitchment' এবং ম্যাল্যার্মে বলেছেন 'the repeated images formed a code as recognizable as a scale in music' | Paul verlaine এর কথাও একই, “the nature of poetry as “Music above all else”, আর্থার সিম্স্ এই ছন্দস্পন্দ বা প্রবাহকে শব্দ পরম্পরা সহযোগে বাশিল্প গড়ে তোলার আত্মা স্বরূপ বলে বর্ণনা করেছেন এলিয়ট মনে করেন যে এই ধ্বনিস্পন্দনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ভাবের বীজ যা কবিতার মধ্যে ভাবরূপের বিন্যাস ঘটায়

আসলে ছন্দস্পন্দ ধ্বনি প্রবাহ ইত্যাদি যাই বলা হোক না কেন, তা শব্দ সমষ্টি যার মধ্যে থাকে একটি ধ্বনিময় শব্দ এবং অন্য শব্দগুলি এই প্রবাহের সহযোগী ‘The Philosophy of Rhetoric' I. A. Richards সেই কথাই বলেছেন “The me `n- ing we find for a word comes to it only with respect to the meaning of other words we take with it.' ছন্দস্পন্দের মধ্যে একটি শব্দ বা শব্দাংশ ধ্বনিময় এবং অপরগুলি নিম্নগ্রামে বাঁধা থাকার কারণ একটাই এবং তা হল বৈচিত্র্য সৃজন অন্যথায় কবিতা হয়ে পড়ে আবর্তনহীন একঘেয়ে

শ্বাসাঘাত

ইংরাজীর Accent এর মতই বাংলার শ্বাসাঘাত যাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ঝোঁক, দিলীপ রায় বলেছেন প্রস্বন এবং প্রবোধচন্দ্র সেন মোহিতলাল মজুমদার বলেছেন প্রস্বর অমূল্যধন ছড়ার ছন্দ বা দলবৃত্ত ছন্দকে শ্বাসাঘাত প্রধান ছন্দ বলেছেন বৃষ্টি পড়ে/টা পুর টুপুর/র্ন দে এল বা এখানে প্রতিপর্বের প্রথম অক্ষরে শ্বাসাঘাত পড়েছে মিল বা Rhyme অলঙ্কার শাস্ত্রে অনুপ্রাস বলতে যা বোঝায়, ছন্দশাস্ত্রে তারই নাম মিল প্রবোধচন্দ্র সেন মিলের নাম দিয়েছেন উপযমক' কবিতার এক পর্বের পদের বা চরণের অন্ত্যধ্বনির সঙ্গে পরবর্তী এক বা একাধিক পর্বের বা পদের বা চরপর অন্ত,নির সাদৃশ্য থাকলে তাকে মিল বলে ইংরাজীতে শেষ stressed vowel হন riyming words যেমন gate-fate, fish-dish, smiling-filing তি বাংলায় মিল তিন প্রকার যথা পর্বান্ত মিল, পদান্ত মিল অন্ত্যমিল পদান্ত মিলের উদাহরণ যেমন 'দুই বিঘা জমি’ “ধিক ধিক ওরে শতধিক তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি যখনই যাহার তখনই তাহারএই কি জননী তুমি

এই কবিতাংশে পর্ব মিল অন্ত্য মিলদুই আছে পদান্তিক মিলের উদাহরণ হল:, “কোন দূর শতাব্দের’- কোন এক অখ্যাত দিবসে নাহি জানি আজইংরাজী প্রধান রাইম এর সংখ্যা প্রায় রকম যদি শেষ stressed vowel শেষ syriable থাকে তবে তা masculine, কিন্তু unstressed হলে হবে faminine. Wrenched rhyme, eye-rhyme, mosaic-rhyme, auto rhyme, internal and ex- ternal rhyme, Leonine rhyme, anaphoric rhyme, initial or medial rhyme, mono rhyme ইত্যাদি

স্তবক বা Stanza

স্তবক হল একাধিক চরণের সুশৃঙ্খল সুসংহত সমাবেশ যা নির্দিষ্ট কোন ভাববে প্রকাশ করে গদ্যের যেমন পরিচ্ছেদ, কবিতার তেমনি স্তবক ইংরাজীতে stanza হল a group of verse lines ইংরাজী stanza গঠন বৈচিত্র্য কয়েকটি ভাগে বিভক্ত যেমন Couplet হল rhymed line এর মিল বিশিষ্ট Couplet এর আবার দুটি ভাগ, octosyllabi Couplet Heroic Couplet. "The longest tyranny that ever swayed / was that wherein our ancestors betrayed light Their free born reason to the stagirite/ And made his torch their u: 'versal So truth, while only one supplied the state/ Grew scarce and dear and yet sophisticate" (Dryden) Triplet হল তিন লাইনের স্তবক বিশিষ্ট, একে “tercet” বলা হয় 'Who e'er she be/ That not impossible she / That shall command my heart and me." (Richard Crashaw) Terza Rima হল interlocking tercets যার ছন্দ মিল aba-b-c-b-cdc | Dante' Divina Commedia' Terza Rima তে রচিত, তবে ইংরাজীতে Thomas Wyatt হলেন এর অগ্রদূত"My mother's maids, when they did sew and spin They sang sometimes a song of the field mouse That for because her livelihood was but thin." ‘The quatrain’ হল ব্যালাড stanga যার ছন্দ ab-ab Gray এর ‘Elegy written ১২১ in a Country Churchyard” এই ছন্দে লেখা Rhyme royal এর প্রবর্তকচসার সাত লাইনের lambic Pentameter এর স্তবক যার ছন্দ মিল হল aba-bb, cc | Ottava Rima' হল লাইনের স্তবক যার ছন্দ মিল ab- ab-ab-c.c বায়রনের “Don Juan” এই ছন্দে লেখা The Faerie queene” এর স্রষ্টা Spenser তিনি Spensarian Stanza' স্রষ্টা এর ছন্দ প্রক্রিয়া হল ab-ab-bc-bc-c. বাংলা স্তবকের উদাহরণ স্বরূপ রবীন্দ্রনাথের 'সোনার তরীর অংশ তুলে ধরা যায়

গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে

দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে

ভরা পালে চলে যায় কোন দিকে নাহি চায়

ঢেউগুলি নিরূপায় ভাঙে দু-ধারে

প্রকৃতি বিচারে বাংলা ছন্দ মোটামুটি তিন প্রকারের

() স্বরবৃত্ত বা দলবৃত্ত বা শ্বাসাঘাত বৃত্ত

() অক্ষর বৃত্ত বা মিশ্র বৃত্ত বা মিশ্র কলাবৃত্ত

() মাত্রা বৃত্ত বা কলাবৃত্ত মূলপর্ব মাত্রার, প্রতিপদের প্রথম অক্ষরে শ্বাসাঘাত, দ্রুতলয়ের ধ্বনিস্পন্দ, মুক্ত রুদ্ধ সকল অক্ষরই এক মাত্রার হলে তা স্বরবৃত্ত হয়

বৃষ্টি পড়ে টা পুর টুপুর নদেয় এলো বান

শিব ঠাকুরের বিয়ে হল র্তি কন্যে দা

মূল পর্ব বা ১০ মাত্রার, ধীরলয় শোষণশক্তিসম্পন্ন, একটানা সুর হলে অক্ষর বৃত্ত

মরিতে চাহিনা আমি/সুন্দর ভুবনে = + , মানবের মাঝে আমি/বাঁচিবারে চাই + মূলপর্ব মাত্রায় হলে, মুক্তদলে মাত্রা, প্রসারিত হলে মাত্রা, রুদ্ধদলে মাত্রা, ধ্বনিঝঙ্কার সমন্বিত বিলম্বিত লয় হয় তা মাত্রাবৃত্ত

নিরাবরণ বক্ষে তব নিরাভরণ দেহে

চিকন সোনা লিখন ঊষা আঁকিয়া দিল স্নেহে

বাংলা কাব্য কবিতায় উপরিউক্ত সাধারণ নিয়মের বহু ব্যতিক্রম যেমন আছে, তেমনি আছে ছন্দের নিয়মনীতি সংক্রান্ত নানা মত তিনটি প্রধান ছন্দের সঙ্গে যুক্ত হয় ছন্দোবন্ধ হল ছন্দের আকৃতি প্রকাশক বাংলায় সুপ্রাচীন ছন্দোবদ্ধ হল পয়ার, মহাপ্রয়ার, একপদী, দ্বিপদী, ত্রিপদী চৌপদী ইংরাজীতেও এগুলি আছে এবং তাদের নাম Triplet, quatrain ইত্যাদি পয়ার হল একটি রূপকল্প যার মাত্রা গণনা করা হয় অক্ষর বৃত্তের নিয়মানুসারে এর মাত্রা + , আট অক্ষরের পর যতি সুর সংযুক্ত ধীর গতি, দুটি চরণ এবং চরণান্তিক মিলসম্পন্ন

মহাভারতের কথা অমৃত সমান +3

কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান

পয়ারের একটি রূপভেদ মহাপ্রয়ার মহাপ্রয়ার নাম রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক প্রদত্ত এর মাত্রা সংখ্যা ১৮ ( + ১০) দুই পর্বে বিভক্ত দুটি চরণ যার অর্ন্তমিল বর্তমান

কথা জানিতে তুমি ভারত ঈশ্বর সাজাহান, ১০

কাল স্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধনমান ১০

পয়ার মহাপ্রয়ারে প্রতি চরণের শেষে ভাবের পূর্ণ বা আংশিক পরিসমাপ্তি ঘটে, কিন্তু প্রবহমান পয়ারে ভাব কল্পনা এক চরণে সমাপ্ত না হয়ে পরবর্তী চরণ বা চরণ সমূহের প্রবাহিত হয় প্রবহমান পয়ারে প্রতি চরণে ১৪ মাত্রা, কিন্তু প্রবহমান মহাপ্রয়ারে প্রতি চরণে ১৮ মাত্রা মিল থাকতেও পারে আবার নাও পারে অমিল প্রবহমান পয়ারের স্রষ্টা মধুসূদন এবং এর অন্যনাম অমিত্রাক্ষর

অমিত্রাক্ষর, গৈরিশ, মুক্তক এবং গদ্য কবিতার ছন্দকে আধুনিক কালের ছন্দ বলা হয় অমিত্রাক্ষরের স্রষ্টা মধুসূদন পয়ারের বেড়া ভেঙে অমিল প্রবহমান পয়ারের সাহায্যে ইংরাজী Blank verse এর অনুসরণে অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি করেন ষোড়শ শতকে Earl of Surrey Aeneid অনুবাদ করার কালে free verse এর অনুকরণে lambic Pentam- eter-এর ৫টি stressed যুক্ত অমিল চরণ ব্যবহার করেন অনুপ্রাণিত হয়ে Sackville Norton ‘Gorbodue' নাটকে এই ছন্দ প্রয়োগ করেন এর পরেই Blank verse এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে Heywood হতে Milton, Dryden হতে Romantic Poets এমনকি আধুনিক যুগে TS Eliot পর্যান্ত Blank verse ব্যবহার করেছেন হেউড এর

'A woman killed with kindness' ব্যবহৃত Blank verse এর নমুনা হল;

....... O speak no more!

For more than this I know, and have recorded

with in the red-leaved table of my heart.

Fair, and all beloved, I was not fearful

Bluntly to give my life into your hand,

And at one hazard all my earthly means."

অমিল প্রবহমান পয়ারকে ভেঙে মধুসূদন যে অমিত্রাক্ষর সৃজন করলেন, তার নমুনা হল, “হে বরদে, তব বরে চোর রত্নাকর/ কাব্য রত্নাকর কবি! তোমার পরশে, সুচন্দন বৃক্ষশোভা বিষবৃক্ষ ধরে/ হায়, মা, হেন পুণ্য আছে কি দাসে কিন্তু যে গো গুণহীন সন্তানের মাঝে / মুঢ়মতি, জননীর স্নেহ তার প্রতি সমধিকমধুসূদনের অমিত্রাক্ষরের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল ভাবের প্রবহমানতা, চৌদ্দ মাত্রার চরণ, যতিও ছেদে স্বাধীনতা, অক্ষর বৃত্তের নিয়মানুসরণও তান প্রধান অমূল্যধনের ভাষায় অমিত্রাক্ষর হল 'ছাদের শিকল ভাঙার ছন্দ', রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায় যে এই ছন্দে পয়ারের ধ্বনি শ্রেণীকে নানাপ্রকারে কুচকা আওয়াজ করানো যায় বাংলা সাহিত্যের রূপরীতি হেম নবীন এর মতই রবীন্দ্রনাথও অমিত্রাক্ষরের ব্যবহার করেছেন নানা কবিতায়

আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে,

কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে বিপুল অঞ্চল তলে

গিরিশচন্দ্র অমিত্রাক্ষরের ভাঙা রূপকে সাধুভাষার সহযোগে মুক্তকের মত মিল রেখে সৃষ্টি করলেন গৈরিশ ছন্দযাক্ মম প্রতিজ্ঞা অতলে/ রহুক দ্রৌপদী এলোকেশে চিরদিন, কুশলে কৌরবকুল/রহুক হস্তিনাপুরেচরণ বিন্যাসে অসমতা এবং প্রবহমানতার দিকে লক্ষ্য রেখে ভাবানুযায়ী চরণ সন্নিবেশ ঘটিয়ে পয়ারের বেড়া ভাঙলেন রবীন্দ্রনাথ, নাম দিলেন মুক্তক মিলহীনতা কবিতার বৈশিষ্ট্য এবং স্বাধীন শুধুমাত্র ছন্দ বিন্যাসেই নয়, আছে স্তবকেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু কাব্য কবিতার মুক্তক ছন্দ ব্যবহার করেছেন আসলে মুক্তক প্রবহমান পয়ারের বিবর্তিত রূপ এবং ইংরাজী Free verse বা verse libra - অনুগামী

দুঃখে সুখে দিন হয়ে যায় গত/ স্রোতের জলে ঝরে পড়া ভেসে যাওয়া ফুলের মতো অবশেষে হল/মুঞলিকার বয়স ভরা ষোলো” ‘পলাতকা’, ‘বলাকা বহু কবিতাই মুক্তক ছন্দে লেখা মুক্তক বাংলা কবিতার ছন্দ মুক্তি রূপে দেখেছেন আধুনিক কালের কবিরা,

 নিতান্ত বোতাম টিপে সহস্র যোজন দূরে কোনো/ গৃহস্থের স্বচ্ছল সংসার ধ্বংস করা যায় যায় নাকি?” ..নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মানব সংসারে কার্নিশে বেড়াল কাঁদে, মাঝে মাঝে কান্না শোনা যায়/ কখনো গভীর রাতে হিম ঘুমে কাক ডেকে ওঠে / কী যেন না পেয়ে এই ছন্নছাড়া গলির ভিতরে /মানুষ সতর্ক হয়, অন্ধকারে ফোঁপায় সর্বদা / আগুন যথেষ্ট আছে/ কবি আছে/ কর্তব্য আছে/ এক মুষ্টি ভাত নেই, ভাতের গন্ধও নেই কোনখানে/ শক্তি চট্টোপাধ্যায়/ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন

গদ্য কবিতা যেন পার্বতী পরমেশ্বরের অর্ধ নারীশ্বর মূর্তি স্বাধীন বৈচিত্র্যময় গদ্যের সঙ্গে ছন্দবন্ধনেও মুক্ত কবিতার এক অপূর্ব সমন্বয়যার স্রষ্টা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ গদ্য কাব্যশৈলীর প্রবর্তনা শিল্পিত, রসরূপাত্মক, ভাবব্যঞ্জনাময় এবং গাম্ভীর্যও সৌন্দর্য মণ্ডিত রবীন্দ্রনাথ গদ্য কবিতার বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ে বলেছেন যে গদ্য কবিতার ভাবছন্দ ছন্দ স্পন্দের উপর নির্ভর করে সমাসবদ্ধপদ, দীর্ঘায়তন শব্দের ব্যবহার, পর্ব বৈচিত্র্য এবং কথ্য রীতির বাকভঙ্গিগাকে কুক্ষীগত করে ধ্বনিসৌন্দর্যে সমাসীন

ইংরাজীতে গদ্য কবিতা বা Prose Poem কে বলা হয় “A Camposition Printed as Prose but distinguished by elements Common in Poetry such as elabo- rately Contrived rhythms, figures of speech, rhyme, internal rhyme assonance, consonance 'nd startling images". Aloysius Bertrand এই ধরণের রচনার প্রথম স্রষ্টা বোদলেয়ার, রিমবাড, অস্কারওয়াইন্ড, অ্যামিলাওয়েল, টি.এস. এলিয়ট প্রমুখ কবিরা গদ্য কবিতা রচনায় দক্ষতা দেখিয়েছেন

শুনেছি একদিন চাঁদের দেহ ঘিরে/ ছিল হাওয়ার আবর্ত / তখন ছিল তার রঙের শিল্প/ ছিল সুরের মন্ত্র, ছিল সে নিত্যনবীন/ বাঁশিওয়ালা

আধুনিক কবিতা সবই মুক্তছন্দের গদ্য কবিতা

রবীন্দ্রনাথ

গুরুমশাই/ অন্ধকারে কে দেখবে মানচিত্রখানা?/মাথার মধ্যে দৃশ্য নানা/ স্মৃতির মধ্যে অজস্র ফুল,/ তার সুবাসেই দেশকে পাচ্ছি বুকের কাছে

নীরেন চক্রবর্তীএকদিন/ সিঁড়িবেয়ে নেমে আসে কেউ/ নিজেরই শরীর ভরা পাতালের দিকে/ এসে দেখে/ বড়ো বেশি ভুল হয়ে গেছে/ এখানে দিগন্ত নেই দিকও নেই কোনো জল নেই আছে শুধু জংলী গুল্মের/ সমারোহশঙ্খ ঘোষ / বাবরের প্রার্থনা একদিন সিঁড়ি বেয়ে

বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদ ষোল মাত্রার পংক্তিতে এবং পাদাকুলক ছন্দে রচিত

যেমন কা তরুবর পঙ্গুবি ডাল +8+8+8 : ১৬ মাত্রা

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের অধিকাংশ পদই পয়ারের দীর্ঘ ত্রিপদী কাব্যে মাত্রা বৃত্ত নেই, তবে অপভ্রংশের মাত্রা বৃত্ত এবং বাংলার অক্ষর বৃত্তের মিশ্রণ আছে পদাবলী সাহিত্যে পয়ার ছাড়াও স্বরবৃত্ত, অক্ষর বৃত্তের প্রয়োগ ঘটেছে : কৃত্তিবাসী রামায়ণ কাশীরাম দাসের মহাভারতে পয়ারের প্রাধান্য বর্তমান ছন্দ রীতিতে প্রথম বৈচিত্র্য এনেছেন ভারতচন্দ্র অক্ষর, মাত্রা, পর্বগুণে ছন্দ রীতির যে বন্ধন তাতে তিনি নিয়ে এলেন স্বাধীন বৈচিত্র্য, ছন্দকে, করলেন শ্রবণ সুখকর এর জন্য তিনি সংস্কৃত ছন্দশাস্ত্রের দ্বারস্থ হয়েছেন ভুজঙ্গপ্রয়াত তোটক তৃণকের ছন্দকে বাংলা কবিতায় প্রয়োগ করে তিনি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পথকে সুগম করে দিলেন রবীন্দ্র যুগের এই ছন্দের যাদুকর মূলত ছন্দকে উপজীব্য করে তোলেন রবীন্দ্রপ্রভাব হতে দূরে থাকার জন্যে তিনিও সংস্কৃতের বহু ছন্দকে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এনেছেন 'কুহু কেকা'পিঙ্গল বিহ্বল ব্যথিত নভতল কইগো কই মেঘ উদয় হও” (মন্দ্ৰাক্রান্তা), 'উড়ে চলে গেছে বুলবুল' (মালিনী) ছাড়াও পঞ্চ চামর বিদ্যন্মালা প্রভৃতি ছন্দে কবিতা রচনা করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ ধ্বনির সাহায্যে যেন ছবি এঁকেছেন যেন কানে শোনার ছন্দ অক্ষর গুণে গুণে ছন্দ নিরুপণের যুগ অতীত চোখে দেখা ছন্দের চেয়ে কানে শোনার ছন্দই যুগের ধর্ম সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর 'পদাতিক' কাব্যে কানে শোনার ছন্দকেই গুরুত্ব দিয়েছেন,

শতাব্দী লাঞ্ছিত আর্তের কান্না/ প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা, আর না/ পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা” (সে দিনের কবিতা) “বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল, যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালোবাসবে সেদিন আমার বুকেও এরকম আতরের গন্ধ হবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (কেউ কথা রাখেনি)

এখানে ছন্দ আছে, কিন্তু তা কানে শোনার ছন্দ এবং কথা বলার ছন্দ একে বলে বাকস্পন্দ আধুনিক কালে এই বাকস্পন্দ বা মুখের ভাষা কবিতার প্রকরণ হয়ে উঠেছে কবিতার মধ্যে নানা মতবাদ, নানা তত্ত্ব এসে ভিড় করেছে গদ্য ছন্দে এসবই মানানসই ... ছন্দ স্পন্দ বা বাস্পন্দের ভিত্তিই হল শব্দ স্পন্দের যে প্যাটার্ন তৈরি হয়, তার মধ্যেও কিছু শব্দ ধ্বনিময় বাকি গুলি নিম্নগ্রামে বাঁধা, ধ্বনির আবর্তনে সুরের সঙ্গতি ঘটে

আর বানাবো উঁচু কানের ঘোড়া/ আর বানাবো লেজ ওঠানো সং আর দেখাব ফুটো ঘড়ির ওড়া/ মানবো না আর মানবো না বন্ধনজয় গোস্বামী/বজ্র বিদ্যুৎ ভর্তিখাতা/ভোজবাজীউন্মও বালক তার মাউথ অর্গানে দুপুরকে/ চমকে দিয়ে সন্দেহ প্রবণ কিছু মানুষ ব্যতীত দালাল পুলিশ গাড়ি চকিত কুকুর অ্যাসকণ্ট/রেস্তোরাঁকে বানালো দর্শক.......শামসুর রহমান/ দুপুরে মাউথ অর্গান রবীন্দ্রনাথ হতে শুরু হয়েছে ছন্দের মুক্তি খোঁজার পথ আধুনিক যুগের কবিরা কি ছন্দহীন? আসলে আধুনিক কবিতার ভাষা বদলেছে, ভাবের বিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু আঙ্গিক বদলায়নি বৈচিত্র্য এসেছে ঠিকই, কিন্তু তা ছন্দকে অস্বীকার করে নয় জয় গোস্বামী যখন লেখেন,

বিচ্ছিরি লোক বিচ্ছিরি লোক/ বনের মধ্যে ঠিক ছিলি তুই

নৌকো ধরলি নগরে উঠলি/ কিসের জন্য? কিসের জন্য?” (কবি)

কথ্য ভাষার বাক স্পন্দের ভাবের বৈচিত্র্যে কবিতাটি সম্পূর্ণ আধুনিক, কিন্তু ছন্দের অতীত নয়

মল্লিকা সেনগুপ্ত যখন লেখেন,

এস্ত চোখ লাস্যতায় আচ্ছাদিত বিষাদ কালো মেঘে আম্রপালী বাঁচতে চায় সমাজ চায় প্রমাণ লোপ হোকছন্দস্পন্দে স্বরবৃত্তের দোলা, কিন্তু মেজাজ মাত্রাবৃত্তের

রাবীন্দ্রিক, কিম্বা জীবনানন্দীয় ঢং-এর কবিতা লেখা যুগে সম্ভ, নয় ঠিকই, কিন্তু স্বাধীনতা তো আর স্বৈরাচার নয়, তাই ছন্দের আকুতিকে বহন করে চলেন আধুনিক কবি যদি ভাবা হয় যে ছন্দের মুক্তি অবশ্যম্ভাবী রূপে কবিতায় প্রয়োগ করতে হবে, তবে তা হয়ে উঠবে কৃত্রিম, হয়ে উঠবে দুর্বোধ্য, অর্থ বোঝার ইঙ্গিত কবিকে ডেকে জেনে নিতে হবে কবিতার ক্ষেত্রে সে বড় দুর্দিন

 

 

 

 

 

 

Post a Comment

0 Comments