বাংলা কবিতা ও তার সংরুপ: আব্দুল মুসরেফ খাঁন

 

বাংলা কবিতা তার সংরুপ: আব্দুল মুসরেফ খাঁন



বাংলা কবিতা  তার সংরুপআব্দুল মুসরেফ খাঁন

সংস্কৃত শাস্ত্রে অলঙ্কারের অর্থ সৌন্দর্যসাধক বা শোভাবর্ধক সুতরাং 'ব্যকবিতায় অলঙ্কার প্রয়োগের অর্থই হল কাব্যের সৌন্দর্যতত্ত্বকে প্রকাশ করা আচার্য বামন বলেছেন, ‘কাব্যং গ্রাহ্যম্ অলঙ্কারাৎ' দণ্ডী তাঁর কাব্যাদর্শে বলেছেন, “কাব্যশোভাকরা ধর্মান্ অলঙ্কারান্ প্রচক্ষ্যতে অর্থাৎ যে সব ধর্ম কাব্যের শোভা করে তাই অলঙ্কার অলঙ্কারকে ব্যাপক সঙ্কীর্ণ দুই অর্থে ব্যবহারের প্রচলন থাকলেও কাব্যক্ষেত্রে বিভিন্ন ভঙ্গির বর্ণনায় সঙ্কীর্ণ অর্থেই ব্যবহৃত হয় আলঙ্কারিক ভামহ প্রমুখ কোন কোন আলঙ্কারিক অলঙ্কারকে কাব্যের বহিরঙ্গ গুণ বলে বর্ণনা করলেও সাহিত্যদর্পণকার বিশ্বনাথ অলঙ্কারকে কাব্য মধ্যে স্বঃতপ্রবিষ্ট গুণধর্ম বলে বর্ণনা করেছেন ভামহ প্রমুখ প্রাচীন আলঙ্কারিকেরা শব্দ এবং অর্থভেদে অলঙ্কারের দ্বিবিধ প্রকরণের কথা বললেও পরবর্তীকালের আলঙ্কারিকেরা শব্দ, অর্থ, শব্দার্থ রসগতএই চার প্রকারের অলঙ্কারের কথা বলেছেন ভারতীয় নন্দনতত্ত্বে অলঙ্কারের প্রভাব কাব্যদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদির মতই নিবিড়ভাষা ছন্দ' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ কাব্য কবিতায় অলঙ্কার ছন্দ সম্বন্ধে বলেছেন,

মানবের জীর্ণ কাব্যে মোর ছন্দ দিবে নব সুর,

অর্থের বন্ধন হতে লয়ে তারে যাবে কিছু দূর

ভাবের স্বাধীন লোকে..

'সাহিত্য' প্রবন্ধেও তিনি বলেছেন,

 অরূপকে রূপের দ্বারা ব্যক্ত করিতে গেলে বচনের মধ্যে অনির্বচনীয়তাকে রক্ষা করিতে হয় নারীর যেমন শ্রী এবং হ্রী, সাহিত্যের অনির্বচনীয়তাটিও সেইরূপতিনি মনে করতেন যে ভাষার মাধ্যমে ভাষাতীত স্তরে উন্নীত হওয়ার জন্য ভাষার মধ্যে যে দুটি উপাদান মিশ্রিত হয় তার নাম চিত্র সংগীত দুটিই অলঙ্কার, প্রথমটি অর্থালঙ্কার এবং অপরটি শব্দালঙ্কারসাহিত্যধর্ম' প্রবন্ধে এই অলঙ্কার সম্বন্ধে তিনি আরও বলেছেন যে কাব্যের ভাব ভাবনাকে প্রকাশ করার সময় অলঙ্কার আপনা হতেই উদ্ৰীক্ত হয় অনেকটাই চরমের প্রতিরূপ এবং অলঙ্কৃত বাক্যই কাব্য এরই নাম রস সাহিত্য যার প্রকাশমানতার মূখ্য উদ্দেশ্য হল বিশুদ্ধ আনন্দরূপকে ব্যক্ত করা

অলঙ্কারের সঙ্গে কাব্যের সম্বন্ধ নির্ণয়ে রীতিবাদী বামন কাব্য মধ্যে সৌন্দর্যকে উদ্দেশ্য এবং অলঙ্কারকে বিধেয় বলেছেন অর্থাৎ সৌন্দর্যই কাব্যের মুখ্য বিষয় যা অলঙ্কার ছাড়া প্রকাশ পায় না কাব্য দেহ তাই কোন শব্দার্থময় সংগঠন নয়; সৌন্দর্যবোধে উত্তীর্ণ এবং গুণ সমুজ্জ্বল অলঙ্কার সেই সৌন্দর্য প্রকাশমানতার প্রাণ কাব্য সৌন্দর্য কাব্যালঙ্কারের সম্পর্ক বাচ্য বাচকের একাত্মতায় নিবিড় কাব্যালঙ্কার কাব্য সৌন্দর্যের কারক রূপে কাব্য মধ্যে যে চমৎকৃতি সৃজন করে রবীন্দ্রনাথ তাকে মানসিক আনন্দ রূপে আখ্যাত করেছেন তাঁর মতে আনন্দ সুগভীর সামঞ্জস্যের, সংস্থান সমাবেশের, দূরবর্তীর সঙ্গে যোগ সংযোগের এবং পাশ্ববর্তীর সহিত বৈচিত্র্য সাধনের আনন্দ অনুভববেদ্য, স্থায়ী গভীর

পাশ্চাত্যে অলঙ্কারের প্রতিশব্দ রেটরিক (Rhetoric) এবং অ্যারিস্টোটলের রেটরিকতত্ত্ব সর্বাপেক্ষা প্রাচীন রেটরিক অর্থে অ্যারিস্টোটল বুঝিয়েছেন, “the art of using lan- guage for Persuasion in speaking, writing or in oratory' অ্যারিস্টোটলের পরবর্তীকালে ‘De Invertione' গ্রন্থের রচয়িতা সীসেরো (Cicero) ছিলেন well-accom- plished Rhetorician' তাঁর সময় থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত এই বিষয়ে যে সব নিয়ম প্রবর্তিত হয়েছে তা ক্রমানুসারে পাঁচ ভাগে বিভক্ত বিভাগগুলি হল, invention, arrangement, style, memory, এবং delivery” খ্রীস্টপূর্ব পনের শতাব্দীতে ‘Ars Poetica' প্রণেতা হোরেস Poetic diction Poetic style সম্পর্কে বলেছেন যে কবিতার ভাষা সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত ভাষা হতে পৃথক হবে, কেননা কবিতার উদ্দেশ্যই হল সৌন্দর্য সৃষ্টি (creation of beauty) তিনি শব্দের পরিবর্তনশীলতাকে স্বীকার করে সুপারিশ করেছেন যে “freedom should be used with moderation.” | Longinus তাঁর ‘on the sublime' চমৎকৃতি বা sublimity উৎপন্ন হওয়ার পিছনে উপযুক্ত চমৎকার শব্দ নির্বাচনের গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়েছেন তাঁর মতে “Beautiful words are the very light of lofty thought' এই প্রসঙ্গে তিনি metaphors, Hyperboles প্রভৃতি ফিগার অব স্পিচ্-এর ব্যবহার সুপারিশ করে harmonius arrangement of words এর কথা বলেছেন

Longinus ‘harmonius arrangement of words' এর যে কথা বলেছেন সেই প্রসঙ্গে টি.এস.এলিয়ট ব্যাখ্যা করে Longinus এর মতকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন যে কবি তাঁর ব্যবহৃত শব্দ সম্ভারের ইতিহাস বৈচিত্র্য, পরিসীমা, সুরধর্ম প্রভৃতির সাহায্যে অন্তর মধ্যে উদ্গত আবেগকে কবিতার মধ্যে প্রকাশ করেন (The poet may be concerned solely with expressing in verse- using all the resources of words, with there history, connotation, their music - this obscure impulse'. Three voices of Poetry) এলিয়ট 'The music of Poetry-তেসুরধর্ম' কথাটির ব্যাখ্যা করে বলেছেন “The music of poetry then must be a music latent in the Common speech of the time” অর্থাৎ কবিতার সুরধর্ম হল কবির সমকালীন সাধারণ লৌকিক ভাষার সুর প্রকৃতি' হোরেস যে কথা বলেছিলেন, আধুনিককালে এলিয়ট তার বিরোধিতা করে ওয়ার্ডসওয়ার্থের নির্দেশিত পথকে সমর্থন করেছেন

পল ভ্যালেরি (Paul Valery) 'Poetry and Abstract thought'- কবিতার ধ্বনি, ব্যঞ্জনা, অর্থ, রূপকল্প এবং বিষয় ইত্যাদির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে দোলকের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যে কবিতায় রূপকল্প বিষয়ের মধ্যে, শব্দ এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দৃশ্যের মধ্যে, কবিতার ভাব প্রকাশ ভঙ্গির মধ্যে এমন একটি সামঞ্জস্যের প্রতিফলন ঘটে যা কেবল কবিতার বিভিন্ন দিক কবিতাতেই সম্ভব এলিয়টও এই কথাটিই বলতে চেয়েছেন যে কবিতার সুর এবং তার অর্থউভয় নিয়েই গোটা কবিতা কবিতা অবশ্যই প্রাথমিকভাবে শ্রুতিবেদ্য, কিন্তু সর্বোপরি তা অনুভববেদ্য উভয়ই কবিতার অলঙ্কার স্বরূপযেনসোনার হাতে সোনার কাকন' – পাঠকের কাছে এই প্রাপ্তি যেন অদ্বৈত অনুভূতির ধ্বনির তরঙ্গময়ী সুর মূৰ্চ্ছনায় সুইনবার্ণ বর্ণনা করেছেন Aphordite’

"A Perilous gooddess was born And the waves of the sea as the calm Clove, and the foam at her feet Fawning rejoiced to bring forth A fleshly blossom, a flame Filling the heavens with heat To the cold white ends of the north White rose of the white water"

উব্বর্শীর বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথের লেখনী হতে প্রসূত হয়েছে,

বৃন্তহীন পুষ্পসম আপনাতে আপনি বিকশি/কবে তুমি ফুটিলে উর্বশী আদিম বসন্ত প্রাতে উঠেছিলে মন্থিত সাগরে/ডান হাতে সুধা পাত্র, বিষপাত্র লয়ে বাম করে /তরঙ্গিত মহাসিন্ধু মন্ত্রশান্ত ভুজঙ্গের মতো/পড়েছিল পদপ্রান্তে উচ্ছসিত ফনা লক্ষ শত করি অবনত . কিশোরীর রূপের সম্মোহ বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে অবলোকন করে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকিশোরীকবিতায় লিখেছেন;

 কানে জোড়া দুল দেখে তার/ঝুমকো-জবা দোলায় দুল তার সরু সাঁথির সিঁদুর মেখে/রাঙা হল রঙন ফুলপ্রেমের কাব্য অর্কেষ্টা'শাশ্বতী' কবিতায় অসাধারণ উক্তি; “একটি কথার দ্বিধা থরথর চূড়ে/ ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে/ থামিল কালের চিরচঞ্চল গাতিঅমিয় চক্রবর্তী দূরযানী-দুইবেলাকবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন এক সুরময় অনুকারের চিত্রকল্প,

সৃজনের তাপ বীর্যবশে,/প্রশমিত তেজ হয়ে ঊর্ধ্বে ওঠে, জ্যোতিষ্মান, সপ্তধাতু ধারণ মিশ্রণ হোমানলে শান্তি বারি পড়ে তাতে, চিত্তে বয় শান্ত বায়ু, মানুষের সভ্যতায় দেখা দেয় শহর সমাজ ” ‘দময়ন্তী কবি বুদ্ধদেব বসুর কবিতায়, নিবু নিবু যৌবন শিখার পূর্ণ প্রজ্জ্বলন,

যে মুহূর্তে বাসনা বিহ্বল নীবী/ খসে পড়ে দেখা যায় কালের প্রলয় জলে সর্বঘ্ন তিমির তলে অলজ্জবদ্বীপ / অমনি থমকে কাল, অদৃষ্টের করালকুহেলি দীর্ণ করে আদিম পরুষ / লভে সপ্তদশ দ্বীপা সসাগরা পৃথিবীরেরক্তাক্ত সময়ের উপমার কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী; ‘এখন আমরা এক ভিন্ন লোকালয়ে / দাঁড়িয়ে রয়েছি নাটকের উৎস সন্ধানে এখন আমরা যেন-এক সময়ে / দাঁড়িয়ে রয়েছি এখন আমরা ভয়ে ভয়ে / দাঁড়িয়ে রয়েছি ক্রোধে দীপ্ত দুর্বাসার মত সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেন, ‘শোনরে মালিক, শোনরে মজুতদার তোমার প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড় হিসাব কি দিবি তার'

বিচ্ছিন্নতা বোধের যন্ত্রনায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর কবি মন কেঁদে ওঠে;

মানুষ যে ভাবে কাঁদে, তেমনি কি কাঁদে পশুপাখি ?

একা থাকি, বড় একা থাকি ভিতরে

ভিতরে একা, অরণ্যের মধ্যিখানে একা

ঘরে বাইরে একা”......(মানুষ যে ভাবে কাঁদে মানুষ বড় কাঁদছে)

কবি শেলীর মতই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আশার গান শোনান, “বাইরে যদিও গভীর অন্ধকার/বুকের ভিতর বৃষ্টির ঝরঝরানি, যেন পিপাসায় শিশুরা হাত বাড়ায় কান্নায় ধোয়া পৃথিবীর রাত ভোর হয়ে গেল ভেবে

উপরের কবিতাংশগুলি হতে একথা সুস্পষ্ট যে কথা বা শব্দ সুর ছাড়াও শব্দার্থের ব্যাপকতা শব্দধ্বনির বিশিষ্টতা ইত্যাদি পরিপূর্ণভাবে একত্র হয়ে অনুভূতির সমগ্রতায় পর্যবসিত হয়েছে I. A. Richards একেই বলেছেন “the meaning we find for a word comes to it Musicat words only with respect to the meaning of the other words we take with it’. সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য অন্যান্য সব কিছুর সঙ্গে অন্বিত থেকেই গীতময় শব্দবন্ধ তার বিশিষ্টতা অর্জ্জন করে

পর্যন্ত আলোচনায় দেখা গেল যে কাব্য তার অলঙ্কার এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা কবি কীটস্ এর ‘The eve of st Agnes' কবিতায় মেডলিনের শয়ন গৃহের বর্ণনায় শব্দার্থ, ধ্বণি মাধুর্য, সুর সংহতি, চিত্ররূপ এবং অনুভূতি এমন ভাবে একে অপরের সঙ্গে মিশে আছে যে একের অনুপস্থিতি ঘটলেই সমগ্র কবিতাটিরই ছন্দপতন ঘটবে এবং অর্থ হানি ঘটবে :

"A casement high and triple-arch'd there was All garlanded with carvan imageries of fruits and flowers, and bunches of knot-grass And diamonded with Panes of quaint device, In numerable of stains and splendid dyes. As are the tiger-moth's deep damask'd wings, And in the midst, among thousand heraldries, And twilight saints, and dim embazonings, A shielded scutche 1 blush'd with blood of Queens and kings"

শব্দবন্ধ, সুর, অনুভূতি, ভাব, ছন্দ অলঙ্কার সব মিলে মিশে প্রকাশমানতার দ্যোতনায় অপূর্ব ভাবতরঙ্গ সৃজন করে রবীন্দ্রনাথের কবিতা

অপূর্ব রহস্যময়ী মূর্তি বিবসননবীন শৈশবে স্নাত সম্পূর্ণ যৌবন পূর্ণস্ফুট পুষ্প যথা শ্যামপত্র পুটে / শৈশবে যৌবনে মিশে উঠিয়াছে ফুটে এক বৃন্তে’. . . . . . . (মানসী / অহল্যার প্রতি) অথবা, অয়ি প্রিয়া/চুম্বন মাগিব যবে, ঈষৎ হাসিয়া বাঁকায়ো না গ্রীবাখানি, ফিরায়ো না মুখ / উজ্জ্বল রক্তিমবর্ণ সুধাপূর্ণ মুখ রেখো ওষ্ঠাধর পুটেভক্ত ভৃঙ্গ তরে / সম্পূর্ণ চুম্বন এক হাসি স্তরে স্তরে সরমসুন্দর”. ... (সোনারতরী / মানস সুন্দরী) ইংরাজীতে Simile এবং Metaphor দুই প্রধান ফিগার অব স্পিচ বাংলায় বা সংস্কৃতেউপমাঅলঙ্কারের দ্বারা উভয়কেই বোঝায় Simile বা উপমা বলতে দুই পরস্পর অসম্বন্ধী বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্য আবিষ্কারকেই বোঝানো হয় এই অলঙ্কারের চারটি স্তর থাকে, যথা উপমেয় বা প্রকৃত বর্ণনীয় বস্তু, উপমান বা সাদৃশ্য প্রদর্শনকারী বস্তু, সাধারণ ধর্ম বা যা সাদৃশ্য সূচক, এবং বাচক বা দ্যোতক শব্দ

বাগর্থাবিব সম্পৃক্তৌ বাগর্থ প্রতিপত্তয়ে

জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতী পরমেশ্বরৌ৷৷

এখানে উপমেয় পার্বতী পরমেশ্বর, উপমান : বাগর্থ, সাধারণধর্ম-সম্পৃক্ততা, বাচক:— ইব

সব লেখা” “আঙুলের নিচে সাপের খোলসের মত ঠাণ্ডা, স্যাঁতসেঁতে আমারবুদ্ধদেব বসু’ ‘পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন'— জীবনানন্দ "Higher and higher/From the earth thou springest Like a cloud of Fire".........(To a skylark/shelley) Like a gorgeous dream/Her sights and sounds (Gitanjali/Tagore) উপমার সঙ্গে অনির্বচনীয় চিত্রকল্প সন্নিবেশিত হলে তা হয়ে ওঠে Homeric ..... When such murmur filled The assembly as when hollow rocks retain The sound of blustering winds, which all night long Had roused the sea, now with hoarse cadence full Sea-faring men o'erwatched, whose bark by chance Or pinnace, anchors in a craggy bay after the tempest" (Paradise lost/Milton)

বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনওমেঘনাদবধেউপমার সঙ্গে ব্যাপক চিত্রকল্প যুক্ত করেছেন

পশিলা পুরে রক্ষ অনীকিন

রণবিজয়িনী ভীমা চামুণ্ডা' যেমতি

রক্তবীজে নাশি দেবী, তাণ্ডবে উল্লাসে

অট্টহাসি রক্তাধরে, ফিরিলা নিনাদে,

রক্তস্রোতে আর্দ্রদেহ দেবদল মিলি

স্তুতিলা সতীরে যথা,— আনন্দে বন্দিলা

বন্দিবৃন্দ রক্ষঃ সেনা বিজয় সংগীতে

সিমিলি' সঙ্গে মেটাফরের পার্থক্য form , substance নয় High Suggestive ness হল মেটাফরের বৈশিষ্ট্য এখানে যে সাধর্ম বা সাদৃশ্য কল্পনা করা হয় তা বস্তুত আরোপিত (implied) বাংলায়লুপ্তোপমাঅনেকটাই Suppressed Metaphor-এর মত বাচক শব্দ অথবা সাধারণ ধর্ম লুপ্ত হয়ে লুপ্তোপমা সৃষ্টি করে ; কখনও বা উপমানও লুপ্ত হয়

“The ship ploughs the sea' বা'I can not rest from travel; I will drink life to the less"-(Ulysses/Tennyson) “দুটি স্বচ্ছ নেত্র হতে/ কাঁপিত আলোক নির্মল নির্ঝর স্রোতে/চূর্ণরশ্মি সম” “সে সবার কণ্ঠস্বর কর্ণে আসে মম/সমুদ্রের তরঙ্গের কলধ্বনি সম/তব কাব্য হতে

ইংরাজীতে যা Allegory বাংলায় তা রূপক রূপকে উপমান উপমেয়ের বৈসাদৃশ্যকে গোপন করে উভয়কে অভেদ রূপে দেখানো হয় ইংরাজীতে Allegory' দুটি অর্থ; একটি-প্রাথমিক বা বহিরঙ্গের অর্থ, অপরটি অর্ন্তনিহিত অর্থ রবীন্দ্রনাথেরভিখারীকবিতাটি রূপক কবিতা রামপ্রসাদী সঙ্গীতেও রয়েছে উপমান উপমেয়ের অভেদ তাৎপর্যএমন মানব জমিন রইল পতিত/ আবাদ করলে ফলতো সোনাইংরাজী Hyperbole এর সঙ্গে বাংলা অতিশয়োক্তির কিছুটা সাধারণ মিল আছে Hyperbole কোন বস্তু বা ব্যক্তিকে তার প্রকৃত অবস্থা অপেক্ষা অধিক গুরুত্ব দিয়ে বা অধিক হীনভাবে বর্ণনা করা হয়

“In every wound of Caesar, that should move The stones of Rome to rise and mutiny".......... Shakespeare অতিশয়োক্তিতে উপমানের একাধিপত্য

আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ/চুনি উঠল রাঙা হয়ে”—রবীন্দ্রনাথ বাংলায় যাকে সমাসোক্তি বলা হয়, তার সঙ্গে ইংরাজী Personifica.ion বা Pathetic fallacy মিল অমিল দুই- বর্তমান অচেতন বস্তুর উপর মানবিক গুণ প্রযুক্ত হলে Personification হয় যেমন Shelley' 'The Cloud' নিসর্গ বস্তু বা অবচেতনের বর্ণনায় যদি মানবিক অনুভূতি প্রযুক্ত হয়, তবে তা Pathetic fallacy মানুষের দুঃখ দেখে প্রকৃতি কাঁদছেএই প্রকারের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ

“Earth felt the wound; and nature from her seat, •

sighing through all her works, gave sings of woe.".......Milton

 

সমাসোক্তি সেক্ষেত্রে আরও ব্যাপক অর্থে প্রযুক্ত হয় মানবিক গুণ ধর্ম বা মানবিক অনুভূতির অচেতন বস্তুর উপর প্রয়োগ ছাড়াও বিপরীত ভাবের বর্ণনার মধ্যেও এই অলঙ্কার প্রযুক্ত হয়

তুমি প্রভাতের শুকতারা/ আপন পরিচয় পালটিয়ে দিয়ে/ কখনো বা তুমি দেখা দাও/ গোধুলির দেহলিতে/ এই কথা বলে জ্যোতিষী সূর্যাস্ত বেলায় মিলনের দিগন্তে/রক্ত অবগুণ্ঠনের নীচে / শুভদৃষ্টির প্রদীপ তোমার জ্বালো/ সাহানার সুরে”..... (তুমি প্রভাতের শুকতারা/শেষ সপ্তক/ রবীন্দ্রনাথ) ইংরাজী Epigram বাংলার বিরোধালংকার বিরোধ না থাকলেও বাহ্যত বিরোধ দেখিয়ে অলঙ্কারের চমৎকারিত্ব প্রকাশ করা হয় অবশ্য বিরোধের পর্যাবসান থাকতে হবে এবং তার একটি নিগুঢ় অর্থ থাকবে Epigram এর সংজ্ঞাও একই “It is an Aparent Contradiction in language which by Causing a temporary shock, rouse our attention to some important meaning underneath. “Our Sweetest songs are those that tell of saddest thought.” (Shelley) “There is a pleasure in Poetic pain”- Cowper

জীবনে যত পূজা হল না সারা/জানিহে, জানি তাও হয়নি হারা যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে/ যে নদী মরুপথে হারানো ধারা জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা”. গীতাঞ্জলী/রবীন্দ্রনাথ কারণ আছে, কিন্তু তদনুরূপ কার্যের উৎপত্তি না ঘটলে বাংলার বলা হয় বিশেষোক্তি অলঙ্কার এবং ইংরাজীতে তাকে বলা হয় ‘Innuendo'

সুন্দরী সে প্রকৃতিরে জানি আমিমিথ্যা সনাতনী

সত্যেরে চাহিনা তবু, সুন্দরের করি আরাধনা

গুপ্ত অর্থ সংকেতের বিষয়কেও 'Innuendo' বলা হয় বাংলায় তা ব্যাজস্তুতি অতি বড় বৃদ্ধপতি সিদ্ধিতে নিপুণ/কোন গুণ নাই তার কপালে আগুন কুকথায় পঞ্চমুখ, কণ্ঠভরা বিষ/ কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।।

এখানে নিন্দা ছলে স্তুতি করা হয়েছে

বাংলায় যাহা ব্যঙ্গোক্তি ইংরাজীতে তাই Irony | Irony বা ব্যঙ্গোক্তি তখনই হয়, যখন অর্থ যা বলতে চাওয়া হয়, তার সম্পূর্ণ বিপরীত হয়

"Yet Brutus says he was ambitious/ And Brutus is an honourable man"

(Shakespeare) “কী সুন্দর মালা আজি পরিয়াছ গলে প্রচেত”........মধুসূদন ক্রমানুসারে একাধিক বস্তুর বিন্যাসের চমৎকারিতায় পর্যায় অলঙ্কার হয়, ক্রমোৎকর্ষ বা ক্রমাপকর্ষদুই হতে পারে পড়িল মধ্যাহ্ন রৌদ্র ললাটে অধরে/উরু পরে কটিতটে স্তনাগ্রচুড়ায় বাহুযুগে, সিক্ত দেহে রেখায় রেখায় /ঝলকে ঝলকে” .......(রবীন্দ্রনাথ) ক্রমোৎকর্ষ হলে ইংরাজীতে বলে Climax "Black it stood as Night, Fierce as ten Furies, Terrible as Hell"-Milton ক্রমাপকর্ষ হলে anti climax হয়;

"A man so various, that he seemed to be

Not one, but all mankind's epitome

who in the course of one revolving moor

Was lawyer, statemen, fiddler and buffoon"......Dryden

বাংলা কবিতায় অলঙ্কার সমুহের চমৎকারিতা সৃজনের দায় আছে বিশ্ব সাহিত্যের বিশেষ করে ইংরাজী সাহিত্যের সংস্পর্শে এসে ইংরাজীর বহু Figure of Speech বাংলা কাব্য কবিতার প্রবেশ লাভ করেছে বাংলার অনুপ্রাস, ইংরাজীর Alliteration এবং onomatopoeia কে সাধারণভাবে বলা যায় ধ্বন্যুক্তি বাংলায় অনুপ্রাস মাত্রেই ধ্বন্যুক্তি এবং বিষয়ে বাংলার ঐশ্বর্য ইংরাজীর onomatopoeia চেয়ে অনেক বেশী বাংলা কাব্য কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ ঘটেছে সরাসরি সংস্কৃত রীতি অনুসারে প্রতিটি অলঙ্কারের বিভিন্ন শ্রেণী আছে যেমন ধরা যাক উপমার কথা সংস্কৃত রীতি অনুযায়ী উপমার শ্রেণী বিভাগ হল পূর্ণোপমা, লুপ্তোপমা, মালোপমা স্মরণোপমা, প্রতিবস্তুপমা ইত্যাদি ইংরাজীতে আছে Simile Metaphor রূপকের ভাগগুলি হল নিরঙ্গরূপক, সাঙ্গরূপক, পরস্পরিত রূপক, অধিকারুঢ় বৈশিষ্ট্য রূপক ইত্যাদি ইংরাজীর Allegory মধ্যে এই ঐশ্বর্যের সন্ধান মেলে না ইংরাজী Figure of Speech এর Synecdoche, Hypallage, Metongmy, Chiasmus প্রভৃতির কোন প্রত্যক্ষ প্রভাব বাংলা কাব্য কবিতায় নেই আংশিক কিছু প্রভাব থাকলেও তা শব্দও অর্থের বহিরঙ্গ ব্যঞ্জনা রূপে বিবেচিত হয়

ভাবের উৎকর্ষতা বৃদ্ধিই অলঙ্কারের উদ্দেশ্য হলেও কবিতা বোঝার ক্ষেত্রে অলঙ্কার তেমন কোন কাজে আসেনা কবি অলঙ্কার শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করে কবিতা লেখেনা না ভাব প্রকাশের মূর্ছনা মুহূর্তে তিনি কাব্যে যে অলঙ্কার প্রয়োগ করলেনতা তাঁর অজ্ঞাতেই ঘটে যায় এটা সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া পাঠকও অলঙ্কার বিষয়ে পণ্ডিত নন কবিতার মধ্যে কি কি অলঙ্কারের প্রয়োগ ঘটেছে তা সম্যক অবহিত না হয়েই কবির অনুভূতি ভাবের রাজ্যে প্রবেশ করেন

দেখেছিল, বেহুলাও একদিন গাঙুরের জলে ভেলা নিয়েকৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায় সোনালী ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল হায়, শ্যামার নরম গান শুনেছিল, — একদিন অমরায় গিয়ে ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়”(জীবনানন্দ) উপরের কবিতাংশের ভাব অনুভূতি হৃদয়ঙ্গম করার জন্যে পাঠক যেমন গুনতে বসবেন না কতগুলি অলঙ্কার এবং কি ধরনের অলঙ্কার কবিতার ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে,

কিন্তু অনুভব করবেন যে বাংলার সৌন্দর্যের সঙ্গে পুরাণকে মিশিয়ে বাংলার এক আঞ্চলিক পুরাণাশ্রিত জীবনচিত্রকে কবি তুলে ধরেছেন ভাবটুকু বোঝার জন্য অলঙ্কারের জ্ঞান না থাকলেও চলে

 

 

 

Post a Comment

0 Comments