সাঙ্কেতিক বা প্রতীকি গল্প : ‘নিমগাছ' : বনফুল।
গল্পের নাম নিমগাছ। নিমগাছ এক গৃহবধুর জীবন সত্যকে দৃশ্যমান করে তুলেছে। শেষ সমাপ্ত বাক্যটিতে রয়েছে সেই চমক। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে গৃহবধুর জীবনের মূর্ছাহত মর্মবানী। ইয়েটস্ এর কথায় বলা যায় এতে Sound, Colour এবং Form একে অপরের সঙ্গে musical relationএ আবদ্ধ হয়ে সৃষ্টি করেছে one sound, one colour এবং one form। নিমগাছ হয়ে উঠেছে গৃহবধুর জীবনের প্রতীক।
এই গল্পে বনফুল প্রতীকির ঘেরাটোপে কাব্যিক আবরণের মায়াজাল বিস্তার করেছেন। নিমগাছ ও গৃহবধুর জীবনের ট্রাজেডির সুর এক, ছন্দ এক এবং অভিব্যক্তিও একই ধরণের । গৃহবধুর জীবননাট্যে নিমগাছের ট্রাজেডিকে সমাহিত করে একটি নির্বেদ ও নিমগ্ন পদ্ধতির প্রকাশ ঘটানো হয়েছে। লেখক এখানে বৃত্তের বাইরে। তিনি ইয়েটস এর মত Poetic visionary'। মনশ্চক্ষে তিনি পরিদৃশ্যমান জগৎকে দেখেছেন। প্রকৃতি ও সংসার যেন একই ছন্দে ছন্দায়িত, একই ব্যথা বেদনার সমগোত্রীয়। তিনি নেমে এলেন কল্পলোক হতে। দেখলেন একই বেদনা একই ব্যথা পল্লবিত হচ্ছে সর্বত্র।
সংক্ষিপ্ত বাক্য সমন্বয়ে নিমগাছ, কবিরাজ ও সাধারণ মানুষের সম্পর্ক নির্ণয়ের পরই বলা হয়েছে যে কবিরাজরা নিমগাছের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাদের কথায় নিমগাছের ভেষজ সমৃদ্ধতার ইঙ্গিত প্রাধান্য পেয়েছে। এ হল বাস্তববাদীর বস্তুকে বস্তুর স্বরূপে পর্যালোচনা।
পরবর্তী বাক্যে বিজ্ঞলোকেদের পরামর্শের কথা বলা হয়েছে। তারা বাড়ির পাশে নিমগাছ দেখে খুশী এবং কমবয়সী পরিজনদের গাছটি না কাটার পরামর্শ দেন। তারা গাছটির ভেষজগুণ সম্পর্কে অভিজ্ঞ না হলেও বাস্তব অভিজ্ঞতায় তারা জানে যে নিমগাছের হাওয়া খুবই উপকারী। বস্তুকে কেন্দ্র করেই তাঁরা গাছটিকে রক্ষা করতে চান।
সাধারণ মানুষ বিজ্ঞদের পরামর্শে গাছটিকে কাটে না, তবে পরিচর্যাও করে না। গৃহস্থালির জঞ্জাল তার গোড়ায় জমা হয়ে ক্রমশঃ তা সার রূপে কৃষিজমিতে বাহিত হয়। তাঁরা নিমের পাতাকে ব্যঞ্জনের তালিকা ভুক্ত করে এবং ডাল কেটে দাঁতন রূপে ব্যবহার করে।
তিন ধরণের মানুষই বাস্তববাদী। বস্তু বিবক্ত ধারণার তারা বাইরে। তবে নিমগাছের উপকার বর্ণনা এ গল্পের উদ্দেশ্য নয়। গল্পের পটভূমিকায় আছে যৌথ পরিবারের এক গৃহবধূ যার অবস্থান নিমগাছের মতই প্রশংসিত, কিন্তু সর্বত্র অবহেলিত, জীবন দিয়ে সে সকলের সেবা করে, কিন্তু সকলেই তার প্রতি উদাসীন। পরের হিতের জন্য ছাল পাতা ডাল এবং সর্বশেষে কান্ডটিও উৎসর্গ করে নিমগাছ যেমন পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়, গৃহবধুটিও ঠিক তেমনভাবেই প্রাণপাত পরিশ্রমের দ্বারা সকলের সেবা করে সকলের অলক্ষ্যে ও অবহেলায় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। অবশেষে এল এক নতুন ধরণের লোক—সে সুবিধাবাদী নয়, উন্নাসিক প্রাজ্ঞও নয়, বস্তুতন্ত্রের উপাসকও সে নয়, সে সৌন্দর্য উপাসক, বস্তু বিবক্ত হয়ে সৌন্দর্যকে সে উপভোগ করে। লোকটি কবি। মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে নিমগাছের পত্র পুষ্প, শাখা প্রশাখা, এমন কি সমগ্র গাছটির সৌন্দর্যকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। নিমগাছের ইচ্ছা হয় তার সঙ্গে চলে যেতে, কিন্তু পারে না, মূল পৌঁছে গেছে গভীরে, শিকড়ও বিস্তৃত হয়েছে। কবি চলে যায়, নিমগাছ নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, যেমন গৃহবধুটি স্বামী, পুত্র কন্যা পরিজনদের ছেড়ে যেতে পারে না। নিমগাছের সঙ্গে গৃহবধুর এই সাদৃশ্যই গল্পের মূল বিষয়।
১০। হাস্যরসের গল্প : 'লম্বকর্ণ' : পরশুরাম
ব্যঙ্গ রচনার ক্ষেত্রে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় এর পরই পরশুরামরূপী রাজশেখর বসুর নাম বাংলা সাহিত্যে অবিস্মরণীয়। পরশুরামের symbolic hero হলেন জাবালি। রাজশেখর বসুর নায়ক নায়িকারা হাস্যরস সৃষ্টির জন্য সৃষ্ট নয়, পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে তাদের অন্তনির্হিত অসংগতি হাস্যরসের সৃষ্টিকারক। তাঁর মতে প্রতিটি মানুষই unconscious humourist অনেকক্ষেত্রে অতিরঞ্জনই হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। চরিত্র ও কাহিনী পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী। কখনও কাহিনী এগিয়ে চলে চরিত্রের হাত ধরে ; কখনও বা চরিত্রই অগ্রবর্তী হয়ে কাহিনীর স্রষ্টা হয়ে দাঁড়ায়, একে বলা হয় চরিত্র ভিত্তিক গল্প। গড্ডালিকা গল্প গ্রন্থের 'লম্বকর্ণ' এমনই চরিত্রভিত্তিক গল্প।
গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র রায় বংশলোচন ব্যানার্জী বাহাদুর, জমিদার অ্যান্ড অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট অব বেলেঘাটা বেশ এবং তার স্ত্রী মালিনী দেবী। কেন্দ্রিয় বৃত্তের সীমায় এই দুই চরিত্রকে পরিক্রমন করেছে লম্বকর্ণ—এই গল্পের সার্থক উদ্দীপক। লম্বকর্ণের আগমনে গল্পের শুরু এবং তার পরিপূর্ণতার মধ্যেই গল্পের সমাপ্তি। লম্বকর্ণই বংশলোচন ও মালিনীর মধ্যে বিরহ ও মিলনের স্রষ্টা।
খালের ধারে বৈকালিক ভ্রমনের সময় বংশলোচন বাবুর সঙ্গে লম্বকর্ণের প্রথম আলাপনটি খুবই মনোরম। রায় সাহেবের হাতের ঠেলায় সে প্রথমে ঢুঁ মেরেছে। তারপরেই হাতের চুরুট কেড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলেছে। বংশলোচনবাবু তাকে আরও একটি চুরুট দিয়েছেন। সেটিও গলাধঃকরণ করে আরো চাইতেই চুরুট না থাকায় তিনি সিগারকেস খুলে দেখিয়েছেন। অতঃপর সিগার কেস কেড়ে নিয়েই সে চিবুতে শুরু করেছে।
বাড়ী ফিরবেন বংশলোচন বাবু, কিন্তু লম্বকর্ণ তার পিছু ছাড়ে না। খোঁজ করেও মালিকের হদিশ মিলল না। ভাবলেন একে বাড়ী নিয়ে গিয়ে প্রতিপালন করবেন। কিন্তু বাধা হল স্ত্রীর সঙ্গে তার কথা বন্ধ হওয়া। জীবজন্তু পোষা তিনি মোটেই সহ্য করতে পারেন না। সুতরাং বাক্যযুদ্ধ অনিবার্য। বাক্য যুদ্ধের কাল্পনিক সংলাপ তৈরী করতে করতে তিনি বাড়ী ফিরলেন। বৈঠকখানায় দরবার তখন পরিপূর্ণ। সভাসদরা চাইলেন আগামী কালই ভোজের ব্যবস্থা করতে। নিরীহ অনাথ প্রাণীটাকে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। তাই সভাসদদের উপদেশ শুনলেন না। মেয়ে ঢেঁপীও তাকে পুষতে চায়। ছাগলের নামকরণ হল লম্বকর্ণ। উৎসাহের আতিশয্যে পিতার আদেশ অমান্য করে বাড়ীর ভিতরে আসতেই মালিনী দেবীর মুখোমুখি। চুকন্দর দারোয়ানকে ডেকে গৃহিনী আদেশ দিলেন অবিলম্বে ছাগল বিদায় করতে। টেপীর পরিত্রাতা রূপে বংশলোচন এসে চুকন্দরকে বললেন যে ছাগল গেটের বাইরে গেলেই তার চাকরি যাবে। স্ত্রী রেগে আশ্রয় নিলেন গোঁসা ঘরে। বংশলোচনবাবুর শোবার ব্যবস্থা হল বৈঠকখানা ঘরে। সেই রাত্রেই লম্বকর্ণ এক বিরাট কান্ড করে বসল। দড়ি ছিঁড়ে বৈঠকখানার ঘরে ঢুকে গীতার তিন অধ্যায় ও প্রদীপের রেড়ীর তেল ভক্ষণ করে বংশলোচন বাবুর পাশে শুয়ে পড়ল। পাশ ফেরার সময় ছাগলের স্পর্শে তিনি ভাবলেন স্ত্রী মালিনী দেবী, কিন্তু পরক্ষণেই হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ শব্দে চমকিত হয়ে তিনি চোর চোর বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। সবাই ছুটে এল, এমনকি গোঁসা ঘর হতে মালিনী দেবীও। লজ্জিত বংশলোচন মনস্থ করলেন যে পরের দিনই লম্বকর্ণকে বিদায় করতে হবে।
লম্বকর্ণকে কয়েকটি শর্তে বেলেঘাটা কেরাসিন ব্যান্ড পাটিকে দিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু পুনরায় ফিরে এল ব্যান্ড পার্টির ঢোলের চামড়া, বেহালার তাঁত, হারমোনিয়ামের চাবি আর লাটু বাবুর পাঞ্জাবির পকেট কেটে নব্বুই টাকার নোট খেয়ে। নগদ একশত টাকা খেসারত দিয়ে বংশলোচন লম্বকর্ণকে বাড়ীতে রাখলেন। পরের দিন সকলের অগোচরে লম্বকর্ণকে খালের ধারে এনে এক ঠোঙা জিলাপি খাইয়ে, তাকে মেরে খেয়ে না ফেলার জন্য আল্লা কালী বিষুর দিব্য একটি কাগজে লিখে তা লম্বকর্ণের গলায় বেঁধে দিয়ে ছেড়ে দিলেন। ফেরার পথে হঠাৎ এল কাল বৈশাখী। তীব্র ঝড় ও জলের মধ্যে পড়ে বয়স্ক বংশলোচনবাবু একটি গাছের তলায় জ্ঞান হারালেন। কতক্ষন কেটে গেছে তা তাঁর অজ্ঞাত। তবে জ্ঞান হতে দেখলেন যে তিনি কর্দম শয্যায় শায়িত এবং আত্মীয় পরিজনেরা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
এরপর লম্বকর্ণের আদর বেড়ে গেল। মালিনী দেবী এখন তার প্রতি খুবই সদয়। সে ফিরে এসে খবর দিয়েছিল বলেই না তিনি স্বামীকে ফিরে পেয়েছেন। লম্বকর্ণ শশীকলার ন্যায় বৃদ্ধি পেয়ে কেমিক্যাল সোনার শিং আর লম্বা দাড়ি নিয়ে সকলের বিদ্রূপ সত্ত্বেও বহাল তবিয়তে দিন যাপন করতে থাকল।
0 Comments