রোমান্টিক গল্প : 'একরাত্রি' : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রমথ নাথ বিশীর মতে ‘একরাত্রি' একটি অপূর্ব সৃষ্টি। প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত একটি সুগীত সঙ্গীতের মতো ধ্বনিত হইয়াছে।' সরোজ মিত্র গল্পটিকে 'সুরধর্মী' বলেছেন এবং ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভূদেব চৌধুরী গল্পটিকে অপরিসিম লাবণ্যময় রোমান্টিক গল্প বলেছেন।
না পাওয়ার বেদনা হতে ট্রাজিক রস নিষ্পন্ন হয়। কিন্তু ‘একরাত্রি' গল্পটি ট্রাজেডি নয়, এই কারণে যে সব ব্যর্থতাই বিরহের বিষয় নয়। সার্কাসে clown যেমন কোন সিরিয়াস খেলার নকল করতে গিয়ে হাস্যরসের সঞ্চার করে, গল্পটির মধ্যে সামর্থ্যতা সম্বন্ধে বিবেচনাহীন আকাঙ্ক্ষাই সেরূপ কৌতুকাবহ পরিণতি সৃষ্টি করেছে। গল্পের প্রথমাংশে এক যুবকের স্বেচ্ছাকৃত আত্মবঞ্চনা এবং তার পরিণামে আত্মগ্লানিসূচক প্রতিক্রিয়া এবং সর্বশেষে এক বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে গল্পটি আদ্য, মধ্য ও অন্তযুক্ত এক ভাবাশ্রয়ী কাহিনী। বিশেষ হতে নির্বিশেষে এবং একটি বহু কাঙ্খিত মুহূর্তকে অনন্ত মুহূর্তে পরিণতি গল্পটির সর্বপ্রধান উপাদান।
সুরবালা নায়কের নর্মসহচরী। শৈশবকালে 'বরবউ' খেলার মধ্যে উভয়পক্ষীয় অভিভাবকেরা তাদের ভবিষ্যত জীবনের একটা Projection করে নিয়েছিলেন। তাদের প্রশ্রয়েই নায়কের মনে সুরবালার প্রতি একটা অধিকারবোধ জাগ্রত হয়েছিল। তারুণ্যের শুভ পদার্পনে নায়ক গ্রামীন পরিবেশে ছেড়ে এলেন শহরে বিদ্যার্জ্জনের আশায়। পিতা চেয়েছিলেন পুত্র চৌধুরী জমিদারদের যে কোন একটা সেরেস্তায় গোমস্তা হয়ে বসুক। কিন্তু নায়কের ধ্রুবতারা নীলরতন যে কলকাতায় পালিয়ে লেখা পড়া শিখে কালেক্টার সাহেবের নাজির হয়েছে। নায়ক অতখানি উঠতে না পারলেও জজ আদালতের হেডক্লার্কতো হতে পারবে।
কিন্তু কলকাতার জীবনে কিছুদিনের মধ্যেই নায়কের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল। ধ্রুবতারার আসন হতে নীলরতনের পদচ্যুতির পর সেখানে আসন গ্রহণ করলেন ম্যাটসিনি, গ্যারিবালডি প্রমুখ রাষ্ট্রনায়কেরা। তাঁদের জীবনদর্শন স্মরণ করেই দেশ সেবায় মনোনিবেশ এবং চাঁদার খাতা হাতে বাড়ি বাড়ি উপস্থিতি জোর কদমে শুরু হল।
নায়কের বয়স এখন আঠারো, পিতার সিদ্ধান্তে বিবাহের বয়স অতিক্রান্ত। উভয়পক্ষ সুরবালার সঙ্গে বিবাহ স্থির করে খবর পাঠালেন, কিন্তু নায়ক অসম্মত হল। এখন ঠিক বিবাহের সময় নয়। দেশের সেবায় নায়ক চাঁদা সংগ্রহে ব্যস্ত রইলেন, অন্যদিকে রামজীবনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুরবালা স্বামীগৃহে চলে যান। খবরটা নায়কের কাছে যখন এল, নায়ক শুনলেন, কিন্তু অন্তরে কোন ব্যাকুলতা টের পেলেন না।
এর পরই নায়কের ভাগ্যবিপর্যয়। পিতার মৃত্যুতে স্বপ্নের ফানুশ ফেটে গেল, নগ্ন বাস্তবতা ভয়ঙ্কর মূর্তি নিয়ে এসে হাজির। বেসামাল নায়ক মফঃস্বলের একটা ছোট সেকেন্ড মাস্টারির চাকরি পেল। দেশ সেবার মানসিকতায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভবিষ্যতের সৈনিক তৈরি করতে নায়ক কাজে যোগ দিল। কিন্তু সেখানেও বাধা। কর্তৃপক্ষের বংশবদ হেডমাস্টার গ্রামার ও অ্যালজেব্রার বাইরে কোন কথাই তাকে বলতে দিলেন না।
এ পর্যন্ত কাহিনী প্রচলিত ছক ধরে এগিয়েছে। এই বাঁধা ছকে সিরিয়াস তেমন কিছু নেই। এশুধু বাস্তবজ্ঞান বিবর্জিত এক তরুণের স্বপ্ন, যার স্বপ্নের ফানুস ফেটে গিয়ে নগ্নবাস্তবের সামনে দিশেহারা অবস্থা। গল্পে কৌতুকের উপাদান আছে। সুরবালার সঙ্গে নায়কের সম্পর্ক পার্বতী ও দেবদাসের মত সিরিয়াস নয়। এ তার নিজের স্বখাত সলিলে ডুবে মরা। নায়িকার বিয়ে এবং জীবনের ছন্দপতনের পর কাহিনীর বিন্যাস খুবই প্রানান্তকর প্রয়াস বুঝেই রবীন্দ্রনাথ এ গল্পে মগ্ন চৈতন্যের তত্ত্ব আরোপ করেছেন। নায়কের মগ্ন চৈতন্যে সুরবালার স্মৃতি অমলিন। গল্পের পরবর্তী অংশ মগ্ন চৈতন্যে সুরবালার স্মৃতি উদিত হল নায়কের মনের ক্যানভাসে। শুরু হল নায়কের হৃদয় বিদারণ যন্ত্রনা।
কিন্তু এই যন্ত্রনা অনুভূত হয়েছে অনেক পরে। সুরবালা উকীল রামলোচনের সঙ্গে এখানেই বাস করে একথা জেনেও সুরবালা সংক্রান্ত কোন ভাবনা চিন্তা নায়কের হৃদয়ে স্থান পায়নি। মগ্ন চৈতন্যের দ্বার সেদিনই উন্মোচিত হয়েছে যেদিন নায়ক রামলোচনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে তার বাড়িতে যায়। পাশের ঘরে চুরির টুং টাং আওয়াজ, শাড়ির খস খস শব্দ এবং মৃদু পদধ্বনির মধ্য দিয়ে নায়কের মনের ক্যানভাসে উদিত হল সুরবালার সেই চোখ যা বিশ্বাস, সবলতা এবং শৈশব প্রীতিতে ভরা, ঘন কৃষ্ণ পল্লবে ঢাকা স্থির স্নিগ্ধ দৃষ্টির স্বর্গীয় আভায় উজ্জ্বল। মনের ক্যানভাসে সুরবালা আর সঙ্গে সঙ্গে হৃদয় বিদারণ যন্ত্রনা—এ যন্ত্রনা তার নিজের কৃতকর্মের, নিজের অবিমৃষ্যকারিতার। এর পরেই শুরু inner conflict. সমাজ বিন্যাসের কথা ভাবতে ভাবতেই মনে এসেছে আক্ষেপ। রামলোচনের সঙ্গে নিজের তুলনা করে সে সিদ্ধান্তে এসেছে যে রামলোচনের কোন অধিকারই ছিল না সুরবালাকে বিয়ে করার। মগ্ন চৈতন্যের হাত ধরে উঠে আসা শৈশব স্মৃতির যন্ত্রনা হতে নায়কের মুক্তি মিলেছে বিভীষিকাময়ী মৃত্যু প্লাবনে। এখানেই নায়কের হতাশা, আক্ষেপ ও অনুশোচনা সবই অন্তর্হিত হয়েছে মৃত্যুরূপী মহাপ্রলয়ের মধ্যস্থলে জীবনের শাশ্বতরূপকে প্রত্যক্ষ করে। নায়ক উপনীত হয়েছে চৈতন্যের শীর্ষ সীমায়।
‘আজ সমস্ত বিশ্ব সংসার ছড়িয়া সুরবালা আমার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। আজ আমি ছাড়া সুরবালার আর কেহ নাই। কবেকার সেই শৈশবের সুরবালা, কোন এক জন্মান্তর, কোন এক পূরাতন রহস্যান্ধকার হইতে ভাসিয়া এই সূর্য চন্দ্রালোকিত লোক পরিপূর্ণ পৃথিবীর উপরে আমারই পার্শ্বে আসিয়া সংলগ্ন হইয়াছিল, আর আজ কতদিন পরে সেই আলোকময় লোকময় পৃথিবী ছাড়িয়া এই ভয়ঙ্কর জনশূন্য প্রলয়ান্ধকারের মধ্যে সুরবালা একাকিনী আমারই পার্শ্বে আসিয়া উপনীত হইয়াছে। জন্মস্রোতে সেই নবকলিকাকে আমার কাছে আনিয়া ফেলিয়াছিল, মৃত্যুস্রোতে সেই বিকশিত পুষ্পটিকে আমারই কাছে আনিয়া ফেলিয়াছে—এখন কেবল আর একটা ঢেউ আসিলেই পৃথিবীর এই প্রান্তটুকু হইতে, বিচ্ছেদের এই বৃন্তটুকু হইতে খসিয়া আমরা দুজনে এক হইয়া যাই।”
এর পরেই হয়েছে নায়কের শাশ্বত উপলব্ধি। দেহ তৃষ্মার অতীতে, কামনা বাসনার সীমিত গণ্ডির বাইরে, কিছু না পাওয়ার বেদনার উর্ধ্বে, সব পাওয়ার এক অনিবচনীয় আনন্দে নায়কের শূন্যভান্ডার পূর্ণ হয়ে উঠেছে। সে এই চৈতন্যের উচ্চ শিখরে উঠে বলতে পেরেছে সুরবালা থাক তার স্বামী পুত্র নিয়ে। নায়ক অপেক্ষা করবে শাশ্বতজীবনে তার নায়িকার জন্যে। ধরার খেলা সাঙ্গ করে সুরবালা আবার তার কাছে ফিরে আসবে। এ অধিকার বোধ সুরবালার দেহের উপর নয়, তাঁর আত্মার উপর।
0 Comments