মহেশ' : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়


মহেশ' : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়


শরৎচন্দ্রের 'মহেশ' গল্পে পরিবেশিত জীবন রস মুক পশুকেও জীবন্ত চরিত্র করে তুলেছে। গফুরের জীবনে মহেশই ঘটনার স্রষ্টা, তার মৃত্যুতেই গফুরের গ্রামত্যাগ ও জীবন যাপন পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটেছে এবং মহেশের কৃতকর্মাদিই সমস্যার সৃষ্টিকারী। গল্পের আরম্ভ মহেশকে কেন্দ্র করে, পরিসমাপ্তি ও তার মৃত্যুতে। গফুরের শেষ আবেদন মূল সঙ্কট মুহূর্তের শীর্ষ বিন্দুর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।

জমিদার শিবচরন কাশীপুরের একচ্ছত্র দন্ড মুন্ডের কর্তা। গ্রামটি ছোট, জমিদার আরও ছোট। কিন্তু তার প্রতাপে প্রজাদের টুশব্দ করার উপায় নেই, গল্প অবয়বে মাত্র একবার ছাড়া সব সময়েই সে নেপথ্যবাসী। গফুরকে শাস্তি দেবার জন্য তার একবার উপস্থিতি ইংল্যান্ডের রানী বা আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতির মত। সব কর্মই তার নামে ঘটে, তিনি কোথাও সশরীরে নেই, অথচ সর্বত্র বিরাজমান।

গফুর জমিদারের জমি বর্গা চাষ করে। পর পর দুবছর অনাবৃষ্টির পর এ বছর যেটুকু ধান খড় হয়েছিল, সবই জমিদার দেনার দায়ে বাজেয়াপ্ত করেছে। মহেশের জন্য কিছু খড়ের আর্জি গফুর পেশ করেছিল, কিন্তু জমিদার তা সরাসরি না মঞ্জুর করে দিয়েছে। অথচ এই জমিদার সম্পর্কেই তর্করত্ন বলেছে, “গো হত্যা হলে, কর্তা তোকে জ্যান্ত কবর দেবে, সে যে সে বামুন নয়।”

এই তর্করত্নের চরিত্র অসঙ্গতিতে ভরা, ‘বামুনের মেয়ে'র গোলক চাটুজ্যে বা ‘পল্লী সমাজ' এর বেণী ঘোষালের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত। টোলের শিক্ষা, তর্করত্ন উপাধি সবই ব্যর্থ হয়েছে। সে বোঝে নি যে 'সবার উপরে মানুষ সত্য'। অপরকে কষ্ট দিয়ে বা অপরের নিগ্রহে সে আনন্দ পায়। ‘মহেশ’ গল্পে তার নীচতা, ভণ্ডামি এবং অন্তঃসার শূন্যতা খুবই প্রকট। তার কণ্ঠে গফুর হয়েছে ‘গফরা’, নাম বিকৃত করে ডাকার মধ্যে তার আভিজাত্য বোধই প্রকাশ পায়। মেয়ে আমিনা বাবার জ্বর হয়েছে জানাতেই তর্করত্ন ক্রোধে ফেটে পড়ে বলেছে ‘ডেকে দে হারামজাদাকে, পাষণ্ড, ম্লেচ্ছ। গফুর মুসলমান বলেই তর্করত্নের কাছে সে ম্লেচ্ছ। জ্বরতপ্ত গায়ে গফুর বেরিয়ে আসতেই তর্করত্ন তাকে শাসিয়ে বলেছে যে গো হত্যা হলে জমিদার তাকে জ্যান্ত কবর দেবে। তর্করত্ন যেন বলতে চেয়েছে যে গফুরের মত মানুষের চেয়ে গরুর জীবন অনেক দামি। পণ্ডিত তর্করত্নের কাছে গরু পবিত্র জীব। কিন্তু ধর্ম এখানে আসল বস্তু নয়, তার উপলক্ষ্যই প্রাধান্য পেয়েছে। ব্রাক্ষ্মণ জমিদার মহেশের মুখের গ্রাস খড়টাও বাজেয়াপ্ত করেছে, আর তা সমর্থন করেছে পণ্ডিত তর্করত্ন। গরুর নাম মহেশ শুনে হেসেছে। গফুর এই তর্করত্নের কাছেই কাহনটাক খড় ধার চেয়েছে এবং বলেছে যেমন করে পারে শুধে দেবে। তর্করত্ন ব্যঙ্গ করে বলেছে “যেমন করে পারি শুধবো, রসিক নাগর, যা যা সর, পথ ছাড়'। ফলমূল ও ভিজা চালের গন্ধ পেয়ে মহেশ মাথা নেড়ে তর্করত্নের দিকে আসতেই ভীত তর্করত্ন বলেছে 'আ মর শিঙ্ নেড়ে আসে যে, গুঁতোবে না কি। জীবিকায় হাত পড়তেই তর্করত্ন সরে পড়তে চেয়েছে। গফুর বলেছে, “গন্ধ পেয়েছে, এক মুঠো খেতে চায়। উত্তরে তর্করত্ন বলেছে, খেতে তা বটে, যেমন চাষা তার তেমনি বলদ। খড় জোটে না, চালকলা খাওয়া চাই। নে, নে, পথ থেকে সরিয়ে বাঁধ, যে শিঙ্ কোনদিন দেখছি কাকে খুন করবে।” তর্করত্নের গোভক্তি কর্পূরের মত উবে গেছে। গল্পের মুখ্য আবেদন গফুর ও মহেশের হৃদয় সম্পর্কের উপরে নিহিত। জমিদারের অত্যাচার, তর্করত্নের ব্যঙ্গ বিদ্রূপ সব কিছুই বাহ্যিক দিক হতে এই সম্পর্কটিকে প্রাধান্য দিয়েছে। এই গল্পে যা কিছু ঘটেছে তা মহেশকে কেন্দ্র করে। জমিদার ও তর্করত্নের কাছে গোরু পবিত্র জন্তু হলেও, মুসলমান গফুরের কাছে তা নয়। পক্ষান্তরে এটি তাদের খাদ্য বলেই গল্প আবেদনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গফুরের কাছে মহেশ গৃহপালিত জন্তু বিশেষ নয়, সে তার অপত্যের স্থানাধিকারী। অভাব অনটনের সময় পিতা মাতা অভুক্ত থেকে সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য ব্যাকুল হয়। তর্করত্নের সঙ্গে কথা বলার সময় মহেশ সম্পর্কে গফুরের কণ্ঠে যে আর্তি ফুটে উটেছে তা অপত্য স্নেহের সমতুল। “চালে খড় নেই, একখানি ঘর, বাপবেটিতে থাকি, তাও না হয় তালপাতার গাঁজা গোঁজা দিয়ে এ বর্ষাটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু না খেতে পেয়ে আমার মহেশ মরে যাবে।”

নৈবিদ্যর পুঁটলি নিয়ে তর্করত্ন যখন চলে গেল, গফুরের চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। মহেশের মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে সে বলেছে “মহেশ তুই আমার ছেলে, তুই আমাদের আটসন প্রিতিপালন করে বুড়ো হয়েছিস। তোকে আমি পেট পুরে খেতে দিতে পারিনে—কিন্তু তুই তো জানিস, তোকে আমি কত ভালবাসি।” এরপরেই গফুর যা করেছে তা দেখে ছোট্ট আমিনাও চমকে উঠেছে। একমাত্র একটি ঘর, তাও চালে শতেক ছিদ্র। সেই ভাঙ্গা ঘরের পিছনের চাল হতে এক আঁটি খড় টেনে মহেশের মুখের কাছে দিয়ে বলেছে। “শিগগির করে একটু খেয়ে নে বাবা। দেরি হলে আবার।” দুপুরে খাবার সময় সেই এক অভিনয়। জ্বর হওয়ার ভান করে নিজে অভুক্ত থেকে সে ভাতের থালাটা মহেশের সামনে ধরে দিয়েছে। মহেশের দৌরাত্ম্যে ক্ষুব্ধ গফুর খোঁয়াড় হতে মহেশকে ছাড়িয়ে এনে বুড়ো কসাইকে বেচে দিতে চেয়েছে। কিন্তু বুড়ো কসাই এর মুখে চামড়ার দাম শুনেই তার অন্তর মহেশের অমঙ্গল কামনায় হাহাকার করে উঠেছে। জমিদারের নাম করে সে কসাইকে ভাগিয়ে দিয়েছে এবং জমিদারের কাছারিতে প্রদত্ত শাস্তি প্রাপ্য বলে মেনে নিয়েছে। মহেশের জমিদারের বাগানে ফুলের গাছ খাওয়া, ধান ছড়ানো এবং জমিদারের ছোট মেয়েকে মাটিতে ফেলে দেওয়া ইত্যাদি কাজের জন্যে জমিদার পেয়াদা পাঠিয়েছে গফুরকে ধরে আনতে। জন মজুর খেটে ফিরেআসা এবং রোগ ভোগে দুর্বল ও অনশন ক্লিষ্ট তৃষ্ণার্ত গফুর বিরক্ত হয়ে জমিদারের পেয়াদাকে বলেছে। 'মহারাণীর রাজত্বে কেউ কারও গোলাম নয়। খাজনা দিয়ে বাস করি।আমি যাব না।” পরাক্রমী জমিদারের এতটা সহ্য হয় নি। সুতরাং কাছারিতে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রহার ও অশেষ লাঞ্ছনা। কোনক্রমে জর্জরিত গফুর দেহটাকে টানতে টানতে বাড়ি ফিরে এল। এর পরেই ঘটেছে সেই অন্তিম ঘটনা। আমিনার আর্ত চীৎকারে সে বাইরে এসে দেখল যে আমিনা পড়ে আছে মাটির উপর। ভাঙা কলসী হতে জল পড়ছে এবং সেই জল মরুভূমির মত নিঃশেষে শুষে নিচ্ছে মহেশ। গফুরের প্রতিক্রিয়াটি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্যতা। মেরামতের জন্য যে লাঙলের মাথাটা সেখানে রেখেছিল, তাই দু হাত দিয়ে সজোরে মহেশের অবনত মাথার উপর আঘাত করল। এই ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়াটি শিল্পোৎকর্ষতাতে উজ্জ্বল।

একটিবার মাত্র মহেশ মুখ তুলিবার চেষ্টা করিল। তাহার পরেই তাহার অনাহার ক্লিষ্ট শীর্ণদেহ ভূমিতলে লুটাইয়া পড়িল। চোখের কোণ বাহিয়া কয়েক বিন্দু অশ্রু এবং কান বাহিয়া কয়েকফোটা রক্ত গড়াইয়া পড়িল। বার দুই সমস্ত শরীরটা থর থর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। তারপরে সম্মুখ ও পশ্চাতের পা দুটো তাহার যতদূর যায় প্রসারিত করিয়া দিয়া মহেশ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিল।” এরপরেই গফুরের গ্রাম ত্যাগ। মহেশের প্রায়শ্চিত্তের জন্য একমাত্র সম্বল পিতলের ঘটি আর থালাটিকে রেখে মেয়ের হাত ধরে ফুলবেড়ের চটকলের দিকে এগিয়ে চলেছে বাংলার ভূমিহীন কৃষক। পথের ধারে বাবলাগাছের তলায় দাঁড়িয়ে শেষবারের জন্য গ্রামের দিকে তাকিয়ে আল্লার দরবারে সে অক্ষমের নালিশ জানিয়েছে। ‘আল্লা, আমাকে যত খুশী সাজা দিও। কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেছে। তার চরে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ করো না।”


Post a Comment

0 Comments