বাংলা কবিতার উপজীব্য বিষয় প্রেম ও প্রকৃতি : আব্দুল মুসরেফ খাঁন
বাংলা কবিতার উপজীব্য বিষয় প্রেম ও প্রকৃতি : আব্দুল মুসরেফ খাঁন
‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্'। পৃথিবীর যে কোন সাহিত্যের আদিমতম পর্যায় হতে মধ্যযুগ পর্যন্ত কাব্য কবিতার প্রধান উপজীব্য রস হল শৃঙ্গার রস এবং উপজীব্য বিষয় হল প্রেম ও প্রকৃতি। অবশ্য ইংরাজী সাহিত্যের অ্যাংলো স্যাকসান যুগে হিরোয়িক পোয়েম প্রচলিত ছিল। বিভল ইংলিশ লিটারেচার এর প্রায় সবটাই হিরোয়িক পোয়েম বা ধর্মীয় কবিতার রমরমা। কাব্য কবিতায় প্রেমের অভিষেক ঘটল চসারের কবিকর্মে। ফরাসী কাব্য 'রোমান ডিলা রোজ'- এর ভাষান্তরের ক্ষেত্রে চসার সৃষ্টি করলেন প্রেমের সুরভি। প্রেমের সঙ্গে ক্রোধ, হিংসা ঘৃণাকে চরিত্রের মাধ্যমে রূপায়িত করে সৃজন করলেন অপূর্ব নাট্যরস। মৃতা ডাচেসের দীর্ঘ প্রেমকাহিনী (The Book of Duches), সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষ্যে সঙ্গিনী নির্বাচন (The Parlia- ment of Fowls), প্রেমের বিভিন্ন রূপকে ক্যান্টার বিউরী গল্পের বিভিন্ন অংশে পরিবেশন করেছেন জিওফ্রে চসার। ফরাসী দেশেও রোমান ডিলা রোজ-এর পূর্বে লিরিক কবিতার প্রচলন থাকলেও সেভাবে প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা রচিত হয়নি। সংস্কৃত সাহিত্যে শৃঙ্গার রসান্বিত প্রেম কাব্যের অভাব নেই। এ বিষয়ে কবি কালিদাসই প্রথম ও শেষ কথা। বিরহের কাব্য ‘মেঘদূত -এ যক্ষের বিরহ, উন্মাদ প্রেমিক মূর্তি, মেঘের যাত্রাপথের অপরূপ সৌন্দর্য, সৌন্দর্যময়ী অলকাপরীব বর্ণনা— এ সবই কবির আত্মগত ভাবোচ্ছাসে ব্যঞ্জনাময়। 'কুমার সম্ভব' এর কাহিনী পুরাণ হতে গৃহীত হলেও কাহিনীতে প্রাণসঞ্চারের কৃতিত্ব কালিদাসের। এই কাব্যে শিবের প্রতি গৌরীর প্রেমই উপজীব্য বিষয় এবং শেষের দিকে অশ্লীলতার সীমাহীনতা লক্ষ্য করে সমালোচকেরা ঐ সর্গগুলিকে প্রক্ষিপ্ত বলে উল্লেখ করেছেন। ‘ঋতু সংহার কে অপরিণত রচনা বলে মনে করা হয়। তবে মানুষের মনে প্রকৃতির প্রভাব, মানবীয় চিত্তবৃত্তিতে প্রকৃতি বিলাস বৈভব আসক্তি ও উদ্দীপনা আদিরসের প্লাবনে প্লাবিত। প্রেমের মধ্যে একটা আদিম ভাব থাকেই যা বহিঃপ্রকৃতির অত্যন্ত নিকটবর্তী। এ কাব্যে প্রতিটি ঋতু কেমন করে প্রেণিক প্রেমিকার মধ্যে প্রেমকে জাগ্রত করে তা অত্যন্ত মুন্সীয়ানার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। সংস্কৃত কাব্যে শৃঙ্গার রসেরই আধিক্য। এ প্রসঙ্গে ভর্তৃহরির শৃঙ্গার শতক, উৎপ্রেক্ষাবল্লভ-এর 'সুন্দরীশতক', ভট্টবীরেশ্বরের অন্যোক্তিশতক এবং অমরুর ‘অমরু শতক' -এর নাম উল্লেখ করা যায়।
বাংলা সাহিত্যেও আদি ও মধ্যযুগের কবিতায় শৃঙ্গার রসের প্রাধান্য বর্তমান। চর্যার পদকর্তা বলেন “জোইনি তঁই বিনু ঘনহি ন জীবমি। তো মূহ চুম্বী কমল রস পীবমি”, ‘গীতগোবিন্দ’-এর রচয়িতা জয়দেব বলেন, “রতিসুখসারে গতমভিসারে মদন মনোহর বেশ-ন কুরু নিতম্বিনি গমন বিলম্বন মুগর তং হৃদয়েকাম।” গীতগোবিন্দে ভোগলাঞ্ছিত কৃষ্ণ রাধার চরণে অনত হয়ে বলেন 'দেহি পদপল্লব মুদারম।' এই কাব্যের বিষয় বৈচিত্র্যের অপেক্ষা সাঙ্গীতিক কর্ষতাই প্রাধান্য পেয়েছে।
‘অল্পে অল্পে বিকশিত’ হয়ে ওঠা রাধা প্রেমিক কবি বিদ্যাপতির কবিতায় বিরহের গান গায় “এ সখি হামারি দুঃখের নাহি ওর/ এ ভরা বাদর মাহ ভাদর / শূণ্য মন্দির মোর”। চণ্ডীদাসের রাধা স্বয়ম্ভু যুবতী, আকুল হয়ে বলে, ‘সখী কেবা শুনাইল শ্যাম নাম/ কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিলগো/ আকুল করিল মোর পরান।” জ্ঞানদাসে প্রেমের আর এক রূপ— প্রতি অঙ্গের সঙ্গে অঙ্গ মিলিয়ে এক হয়ে চাওয়া। “রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মনভোর প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।” চণ্ডীদাস ফুটিয়ে তুলেছে রাধা কৃষ্মের প্রেমের স্বরূপ।
“এমন পীরিতি কভু নাহিদেখি শুনি/পরাণে পরাণ বাঁধা আপনা আপনি দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া/ আধ তিল না দেখিলে যায় সে মরিয়া।” নায়িকা পরকীয়া, তাই রোম্যান্সই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। বৈষ্ণব পদকর্তারা রা । কৃষ্ণের লীলা বিষয়ক পদাবলীতে মর্ত্য চেতনার অনুরণন ঘটিয়েছেন। রবীন্দ্র কণ্ঠে তাই বিস্ময়ের সুর। “শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান।” পূর্বরাগ, অনুরাগ, মান অভিমান, অভিসার, প্রেমলীলা, বিরহ, মিলন ‘এ কি শুধু দেবতার।” মুকুন্দরামে রোম্যান্টিক প্রেরণা নেই, ভারতচন্দ্রে আছে রতিরস ও ব্যঙ্গরসের তুফান। বাংলা সাহিত্যের ‘রূপরেখা’-য় গোপাল হালদার বলেছেন ‘রসের মূল্য আজ কাব্যের বাজারে কমে গিয়েছে। রস বলতে বোঝাত আদি রসের চাতুর্য। মূলত ভারতচন্দ্রের শৃঙ্গার রস ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে উঠতে সক্ষম হয়নি।
প্রেম তার বৈচিত্র্য নিয়ে ফিরে এসেছে মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যে। Heroidies এ ইউলিসিসের প্রতি পেনিলোপের বা হিপোলিটাসের প্রতি ফেইড্রার মতই দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা বা সোমের প্রতি তারা যৌবনের প্রেম ও বিরহের কথা সম্পর্ধ কণ্ঠস্বরে প্রকাশ করেছে। অবশ্য বাসন্তীর সঙ্গে মেঘনাদজায়া প্রমীলার সংলাপে প্রেমের বিরহের দিক সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। “বামেতর আঁখি মোর নাচিছে সতত/ কাঁদিয়া উঠিছে প্রাণ. .”। মধুসূদনে আছে ক্লাসিক গঠন মহিমার অন্তরালে সৌন্দর্য চেতনার উপলব্ধি এবং প্রেমতন্ময় রোমান্টিক চেতনার উচ্ছ্বাস। Captive Lady ও সনেটগুচ্ছে এই চেতনা যেন Erotic Sensation বা প্রেম-সংবেদনার রোমান্টিক যৌবন স্বপ্ন। Captive Lady তে যে প্রেম চেতনার শুরু, তা ‘তিলোত্তমা সম্ভব' কাব্যে বিশ্ব সৌন্দর্য সত্তায় পরিণত। কবি কীটসের Hyperion এর Endymion এর এ এক অপূর্ব নির্যাস।
ইংরাজী সাহিত্যে প্রথম রোমান্টিসিজমের অবির্ভাব ঘটে এলিজাবেথীয় যুগে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে রোমান্টিসিজমের পুনরাবির্ভাব ঘটে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, শেলী, কীটস্ ও বায়রণের হাত ধরে। এলিজাবেথীয় যুগে যা ছিল নবলব্ধ অভিজ্ঞতার উদ্দাম প্রকাশ, রোমান্টিক রিভাইভ্যাল বা পুনরাবির্ভাবের যুগে তাই হয়ে উঠল রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধান, রহস্যময়তার অস্পষ্টতায় মহিমাময় বিরাটত্বের সন্ধান, বিশ্বসৌন্দর্যের মধ্যে অখন্ড সৌন্দর্যলোকের সন্ধান। অতীতচারী রোমান্টিসিজম ঐতিহাসিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বলেই বিশ্বাস করে কালের অখণ্ড রূপকে। অতীত হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত একই ট্রাডিশান সমানে চলেছে। মানবসত্তার অখণ্ডরূপের বিজয় পতাকা বহণ করে, মানুষের স্বাধীন সত্তা বিকাশের অনুকূলে আত্মার বন্ধন মুক্তির অভিপ্রায়ে রোমান্টিসিজম দাবী করে মানুষের চেতনাস্তরকে উন্নীতও উদ্বোধিত করতে।
ইংরাজী সাহিত্যের রোমান্টিকতার লক্ষণ বিচার করে বাংলা সাহিত্যের রোমান্টিকতার সন্ধান পাওয়া যাবে না, কারণ বাংলা রোমান্টিসিজমের অনুধ্যান ঘটেছে প্রেম ও প্রকৃতি চেতনায়, সঙ্গীতধর্মও অধ্যাত্ম ভাবনায়। প্রথম দুটি ভাব উভয় দেশের সাহিত্যে বর্তমান, কিন্তু শেষের ভাবদ্বয় বাংলার নিজস্ব সম্পদ। ইংরাজ কবি ব্লেকের মতই যুগ সন্ধিক্ষণের কবি হলেন ঈশ্বর গুপ্ত। তিনি প্রকৃতিকে স্বতন্ত্র মূল্য দিয়ে ঋতুশালার নিসর্গ চিত্র অঙ্কন করেছেন। প্রেম ও প্রকৃতি নিয়ে গীতি কবিতার বন্যা সৃজন করেছেন ভোরের কবি বিহারীলাল। এর পরেই কবিতার রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রসাহিত্য রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন এবং তাঁর কবিমানসে যুক্ত হয়েছে প্রাচীন সংস্কৃত বিশেষ করে কালিদাসের কাব্যের ছায়া এবং পা চাত্যের ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী, কীটস্, গেটে প্রমুখ কবিদের জীবন সাধনার প্রভাব। তাঁর প্রেমচেতনা মর্ত্য মানবকে ঘিরে নন্দিত। রবীন্দ্রপ্রেম চেতনা ইন্দ্রিয়বন্ধনে আবদ্ধ নয়, ভোগের ধেও সীমায়িত নয়, প্রেম তাঁর কাছে পূজার অপর নাম। এই পূজাকেই বলা যায় সৌন্দর্য সম্ভোগ। উর্বশী এই সৌন্দর্যের প্রতীক। যে মাতা বা কন্যা বা গৃহিণী নয়, সে এক পরিপূর্ণ সৌন্দর্য-শাশ্বত অমলিন এবং অবিমিশ্র মাধুর্যময়।
রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি চিন্তা পৃথক কোন বিষয় নয়, মানব চিন্তার সঙ্গে তা ওতঃপ্রোত ভাবে জড়িত। আত্মপরিচয়ে তিনি নিজেই বলেছেন “এই জীবনযাত্রার অবকাশকালে মাঝে মাঝে শুভমুহূর্তে বিশ্বের দিকে যখন অনিমেষ দৃষ্টি মেলিয়া ভালো করিয়া চাহিয়া দেখিয়াছি তখন আর এক অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করিয়াছে। নিজের সঙ্গে বিশ্ব প্রকৃতির এক অবিচ্ছিন্ন যোগ, এক চিরপুরাতন একাত্মতা আমাকে একান্তভাবে আকর্ষণ করিয়াছে।” তিনি মনে করেন যে লক্ষ কোটি বছর ধরে তিনি বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে বিদ্যমান। তাঁর এই অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে ‘সমুদ্রের প্রতি’, ‘বসুন্ধরা' প্রভৃতি কবিতায়। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে অনুসরণ করে তিনি এই অনুভূতিতে আবিষ্ট হলেও, উপনিষদীয় ব্রহ্মবাদ তাঁর অন্তরবাণীর অনুধাবনে অবশ্যই সহায়ক হয়েছে। ‘সর্বং ঋল্বিদং ব্রয়” অর্থাৎ বিশ্বপ্রপঞ্জের সব কিছুই যদি ব্রয় বস্তু হয় এবং কবি নিজেও যদি ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ ভাবে উত্তরিত হন, তবেই এ ধরনের অনুভূতি সম্ভব। অনুভূতির ভিত্তি নির্মাণে উপনিষদীয় ব্রয়বাদ সক্রিয় না হলে শুধুমাত্র বিজ্ঞান ও যুক্তি অবলম্বনে এই মহান ভাবশীর্ষে উত্তরিত হওয়া যায় না। ‘প্রভাত উৎসবে' তিনি বলেন, ‘হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি/ জগৎ আমি সেথা করিছে কোলাকুলি” তিনি গাইলেন, “আকাশ ভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ/ তাহার মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান/ বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।”
‘বসুন্ধরা’ কবিতায় অনন্ত তত্ত্বকে অন্তর দিয়ে অনুভবের চেষ্টা; 'ওগো মা মৃন্ময়ি,/ তোমার মৃত্তিকা মাঝে ব্যাপক হয়ে রই/ দিগ্বিদিকে আপনারে দিই বিস্তারিয়া / বসন্তের আনন্দের মতো।” বিশ্বপ্রপঞ্জের যাবতীয় বিষয়ের সঙ্গে তাঁর নাড়ীর সম্পর্ক। সর্বত্র তিনি প্রকৃতির এই লীলাকে অনুভব করেন। সর্বত্রই বিশ্ব চৈতন্যের বিকাশ। এর মধ্যেই কবি তাঁর নিজের স্থান খুঁজে পান। পাখির গান, নদীর সঙ্গীত, পুষ্প, লতা পাতার সজল চোখের সরল হাসি, মধ্যে তিনি শুনতে পান ‘বিশ্ব বাঁশির ধ্বনি’।
“হঠাৎ উঠে উচ্ছ্বসিয়া কহে আমার গান/ সেই খানে মোর স্থান।”
রবীন্দ্র সমসাময়িক কালের পরই এসে পড়ে আধুনিক কাল। কল্লোলের কবি গোষ্ঠীর রবীন্দ্র বিরোধিতাই আধুনিকতার সৃজন ঘটায়। এ যুগের কবি বোদলেয়ার অনুরক্ত বুদ্ধদেব বসু ‘রূপসী বাংলার’ কবি জীবনানন্দ, ম্যালার্মের অনুগামী সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ‘ফেরারী ফৌজ’-এর কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র, এলিয়ট শিষ্য বিষ্ণু দে, এবং আরও অনেকে শবদেহ ব্যবচ্ছেদের মতই— জীবনকে তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান করেন, অবচেতনের গহীনে ডুব দিয়ে তুলে আনেন রত্নরাজী এবং নাগরিক চিন্তার প্রসারতা কামনায় যৌনতা, রাজনীতি, সমাজনীতি, বিজ্ঞান, পুরাতন ভাবনা চিন্তার নবমূল্যায়ণ ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পায় ।
0 Comments