বাংলা কবিতায় আধুনিকতা”: আব্দুল মুসরেফ খাঁন

 

বাংলা কবিতায় আধুনিকতা: আব্দুল মুসরেফ খাঁন



বাংলা কবিতায় আধুনিকতা: আব্দুল মুসরেফ খাঁন

সাহিত্যে Modernism বা আধুনিকতা বলতে J.A. Cuddon বলেছেন, “modeir 's.n reveals a breaking away from established rules, traditions and conventions, fresh ways of looking at man's position and function in the universe and many experiments in form and style."

ইংরাজী সাহিত্যে ঊনবিংশ শতকের শেষ পাদ হতে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রলম্বিত সময়কে আধুনিক যুগ আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে এই সময়ে আধুনিক কবিতার প্রবক্তা হয়ে ইংরাজী সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছেন রবার্ট ব্রিজ, বাটলার ইয়েটস্, টি.এস. এলিয়ট, ডব্লিউ. এইচ অডেন, এডিথ সিটওয়েল, ডিলান টমাস প্রমুখ কবিবৃন্দ আধুনিক কবিও কবিতা সম্পর্কে David Daiches এর উক্তি হল, “The Poet was no longer the sweet singer whose function was to render in mellifluous verse and an imagery drawn with great selectivity from the world of nature a self indulged and personal imagination; he was the explorer of experience who used language in order to build up rich patterns of meaning which, however impressive their immediate impact, required repeated close examination before they communicated themselves fully to the reader. A core of burning paradox was preferred to a gloss of surface beauty......... complex, allusive, using abrupt contrasts and shifting counter-suggestions to help unfold the meaning, eliminating all conjunctive phrases or overt statements that might indicate the relation of one scene or situation to another, depending entirely on the 'music of ideas' on the patterns on symbolic suggestion set up as the poem moves".

এলিয়টের কবিতাকে বলা যায় 'Completely breaking of 19th century tradition' রোমান্টিক প্রভাবকে অস্বীকার করে ব্যক্তিসত্তার স্ফুরণ আস্তর সত্যকে উন্মোচন করাই কবিতার কাজ বলে তিনি মনে করতেন তাঁর Impersonality of Poetry তত্ত্বে তিনি বলেছেন “Poetry is not a' turning loose of emotion but an escape from emotion. It is not an expression of personality but an escape from personality." The Vaste Land' আধ্যাত্মিক ভাবে মৃত মানুষের বর্ণনায় কবি বলেন,

"Son of Man / You can not say, or guess, for you know only

A hear of broken images, where the sun beats/ And the dead tree gives no slelter, the cricket no relief/ And the dry stone no sound of water" অন্যদিকে কবি ইয়েটস হলেন ইংরাজী সাহিত্যে প্রতীক আন্দোলনের স্রষ্টা তিনি ‘The Symbolism of Poetry' প্রবন্ধে বলেছেন, ‘When sound and colour and form are . in a musical relation to one another, they became as it were one sound, one colour and one form and evoke an emotin that is one emotion”. নান্দনিক সৌকর্যে অতুলনীয় তাঁর ‘Byzantium' কবিতা "At midnight on the Emperor's pavement flit Flames that no faggot feeds, nor steel has lit, Nor storm disturbs, flames begotten of flame, when blood begotten spirits come And all complexities of fury leave, Dying in to a dance,

An agony of trance,

An agony of flame that

cannot singe a sleeve."

আধুনিক যুগে কবিতা হয়ে উঠেছে অধিকতর ইঙ্গিত প্রবণ (Symbolist), অধিকতর মেধাশ্রয়ী (cerebral) এবং অধিকতর পরিবেশ নির্ভর বিজ্ঞানের দ্রুত অনুবর্তনে এবং আর্থ সামাজিক রাজনীতির দ্রুত পরিবর্তনে পরিবেশ পরিস্থিতি যতই জটিল হয়ে উঠছে, সার্বিক অবক্ষয়ী জীবনচিত্র যতই নৈরাশ্যক্ষুব্ধ যন্ত্রণায় আর্তনাদ মুখর হয়ে উঠছে, ততই আধুনিক কবিতা জীবনমুখী অভিধায় রূপ, আঙ্গিক ছন্দ, বিষয় এবং ভাষাকে বদলে, Poetic diction এবং চিরাচরিত rhetorical expression পরিত্যাগ করে নাগরিক জীবনের প্রেক্ষাপট নির্ভর হয়ে উঠছে আধুনিক যুগে কোন গোষ্ঠীর সৃজন হয় না ব্যক্তি স্বাতন্ত্রতা প্রবলতররূপে আত্মপ্রকাশ করায় বিভিন্ন কবি বিভিন্ন ভাব মহিমায় সমুজ্জ্বল সভ্যতার সঙ্গে সাহিত্য ওত প্রোত ভাবে জড়িত বলেই আধুনিক সভ্যতার দোসর আধুনিক কবিতা নগর কেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার হাত ধরে উঠে এসেছে ধনতন্ত্র লাঞ্ছিত শূন্যতা সংশয়, নিঃসঙ্গতা নৈরাশ্য, যন্ত্রণা অবিশ্বাস

“The New Princeton Encyclopedia' তে আধুনিকতা বা modernism সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘The Concept of modernism and Post modernism have become funda- mental for isolating a distinctive experimental tradition'. সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে “The Concept of modernism much more individualist and stylized versions of Enlightenment lucidity which must resist its mythological progress, its Commitment to empricist and utilitarian values, and above all its affiliations with a sensationalized and superficial Popular Culture."

আধুনিকতার কালসীমা নির্ধারণে আছে নানা জনের নানা মত- এবিষয়ে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও যেমন, তেমনি ইংরাজী সাহিত্যের ক্ষেত্রেও উনিশ শতকের শেষপাদ হতে বিংশ শতককে আধুনিক কালসীমায় বাঁধতে চেয়েছেন অনেক ইংরেজ সমালোচক অনেকেই আবার ওয়ার্ডসওয়ার্থ, গ্যেটে থেকেই আধুনিকতার প্রাণস্পন্দন শুনতে পেয়েছেন কেউ বা আবার

কবিতার গতিপ্রকৃতি বিংশ শতকের প্রথম পাদকেই আধুনিকতার সূচক বলতে চান আসলেআধুনিকতাশব্দটাই আপেক্ষিক ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী, বায়রন, কীটস্, গ্যেটে, হাউসম্যান, এঁরা প্রায় সকলেই তাঁদের সমসাময়িক মুগে আধুনিক আবার ইয়েটস্ এলিয়ট, অডেন প্রভৃতিরাও আধুনিক আসলে প্রত্যেকে তাঁর কালসীমায় আধুনিক বাংলা কাব্য কবিতায় মঙ্গলকাব্যের কবি মুকুন্দরাম তাঁর যুগে আধুনিক, এই অর্থে আধুনিক ছিলেন রবীন্দ্রনাথও আবু সয়ীদ আইউবআধুনিকতা রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় একটি চমৎকার কথা বলেছেন তাঁর মতে আধুনিকতার কোন সংজ্ঞা নির্ণয় করা যায় না, কারণ তা স্বভাবতই গতিশীল আজকের আধুনিক কাল সেকেলে হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে আধুনিকতা সময় দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না, যায় কেবল মর্জি দিয়ে (সাহিত্যের পথে) জীবনানন্দ মনে করেনমানুষের মনের চিরপদার্থ কবিতায় বা সাহিত্যে এবং মহৎ লেখকদের হাতে যে বিশিষ্টতায় প্রকাশিত হয়ে ওঠে, তাকেই আধুনিক সাহিত্য বা আধুনিক কবিতা বলা যেতে পারে” (কবিতার কথা) সাহিত্যের পালাবদলকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন বাঁক এবং তাঁর মতেএই বাঁকটাই মডার্ণ রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন যে, যে সাহিত্য কালজয়ী, তাই আধুনিক

বিশ্বায়নকথাটি বর্তমান কালের আর্থরাজনৈতিক শ্লোগান হলেও, সাহিত্যও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশ্ববৈচিত্র্যকে স্বীয় কুক্ষীগত করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে বহুকাল আগে থেকেই যেদিন ডিরোজিও' হিন্দুস্কুলে পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার প্রবর্তন হল হয়তো আধুনিক যুগের সেটাই সুচনাকাল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধুসূদন বাংলা সাহিত্যের কাব্য, কবিতা নাটকে নিয়ে এলেন পাশ্চাত্যের আঙ্গিক ভাব সেখান হতেই শুরু এবং রবীন্দ্রনাথে তা পূর্ণতা প্রাপ্তি রবীন্দ্র প্রভাব মুক্তির স্মারক রূপে বাংলা কবিতা আধুনিকতার ধ্বজাবাহী হলেও একথা মানতেই হবে যে রবীন্দ্রনাথ নিজেই একজন আধুনিক কবি, কারণ তাঁর কাব্যে আছে চিরন্তনের অভিব্যক্তি বুদ্ধদেব বসুও সে কথা মেনে নিয়েছেন 'কালের পুতুল' গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ‘আধুনিক কথাটির সংজ্ঞার্থ যুগে যুগে বদলায়, অভিনবত্বের আকর্ষণ ক্ষণস্থায়ী, এবং সর্বশেষ বিচারে বোধ হয় এই কথাই বলতে হয় যে সেইটাই সত্যিকার আধুনিক, যেটা চিরন্তন' জীবনানন্দকবিতার কথা’-য় বলেছেনআজকের যুগের বিশেষ কতকগুলো লক্ষণ একালের কবিতায় থাকে”, জীবেন্দ্র সিংহরায় এই প্রসঙ্গকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, যে আধুনিক কবিতা রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত, চলমান সমাজ ইতিহাস সম্পর্কে পূর্ণমনস্ক এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রকরণে নব্যতন্ত্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আধুনিক বা একালের কবিতাকে ভঙ্গী প্রধান এবং বক্তব্যে অনিশ্চয়তার সমস্যা যুক্ত বলেছেন পদার্থকে সনাক্ত করা যায়, আধুনিক কবিতা পদার্থ পদবাচ্য নয় বলেই তাকে ল্যাবরেটরীর পর্যবেক্ষণে সনাক্তকরণ করা যায় না তবে বুদ্ধদেব বসুআধুনিক বাংলা কবিতা' ভূমিকায় আধুনিকতার অর্থ করেছেনসম্পূর্ণ এক নতুন সুর’- যার মধ্যে আছে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের, সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের বিস্ময়ের সুর, পরস্পর বিপরীত দুই ধারার পাশাপাশি অবস্থানও আধুনিক কবিতায় সম্ভব এখানে অর্ন্তমুখিনতার পাশাপাশি আছে বর্হিগুখিনতা, জীবনসংগ্রামের পাশেই জীবন বিতৃষ্ণা, জীবনের আনন্দ আশার সঙ্গে মহাবস্থান করে নি নৈরাশ্যবোধ

বাংলা সাহিত্যে বিশ্বায়ন ঘটে ছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যান্ত্রিক সভ্যতার নগর ভিত্তিক প্রসার, দুই বিশ্বযুদ্ধ, পুরানো মূল্যবোধের অবলুপ্তি, বুর্জোয়া ধনিক শ্রেণীর উদ্ভব, বিচ্ছিন্নতা, নৈরাশ্য, ক্লান্তি, সংশয়, অবিশ্বাসএসবই পাশ্চাত্য জগৎ হতে বাংলার জাতীয় জীবনে প্রবেশ করে শ্রীহীনতাও আর্থসামাজিক কাঠামোর ভয়াল চেহারার সঙ্গে যুক্ত হয় এদেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, কালোবাজারী, বেকারত্ব রাবীন্দ্রিক প্রশান্তির মধ্যে শান্তির সন্ধানে ব্যর্থ মানুষের কণ্ঠে ভাষা দিতে এগিয়ে এলেন তরুণ আধুনিক কবির দল ক্রিষ্টোফার কডওয়েল আধুনিকতার বিচার প্রসঙ্গে রলেছেন “when we use the word 'modern' in a general sense, we use it to describe a whole complex of culture” তাঁর মতে এই Complex পরিবর্তনশীল এবং তা অর্থনীতির ভিত্তিভূমির সঙ্গে জড়িত রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত বাংলার আধুনিক কবিরা Complex of Culture এর এয়োজনে বোদলেয়ারও ম্যালার্মের প্রতীকবাদ, জেমস জয়েসের চেতনা প্রবাহ তত্ত্ব, ফ্রয়েডও ইয়ুং এর মনস্তত্ত্ব মনবিকলন, ডারউইনের বিবর্তনবাদ, মার্কস এঙ্গেলস এর সমাজতত্ত্বকে সমাজ ইতিহাসের স্মারকরূপে গ্রহণ করলেন ইউরোপীয় ভাবধারার প্রভাব বাঁধভাঙা প্লাবনের মত প্লাবিত করল বাংলা তথা বাঙালীর কালচার সিম্বলিজম্, ইম্প্রেসনিজম, কিউবিজম্, ডাডাইজম্, সুররিয়ালিজম, ফভিজম্ এর ধারাকে আত্মস্থ করে নবযুগের তরুণ কবিরা দেশ সময়কে উপজীব্য করে নতুন আঙ্গিক প্রকরণে কালের কবিতা সৃজনে আত্মনিয়োগ করলেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী এই নতুন কবিরা পরস্পর পৃথক ভাবে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত আপন আপন স্বাতন্ত্র্য্যে বিদ্যমান হয়তো তাঁরা অনেকেই Sex-conscious, কেউ বা মার্কসবাদী, তবু তাঁদের কবিতার একটা অর্থ আছে তাঁরা জীবনের মানে খুঁজতে চেয়েছেন, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে বলেন প্রগতি যা ব্যক্তিগত মানবিক

বাংলা আধুনিক কাব্য কবিতায় ইউরোপের সাহিত্যের ধ্যান ধারণা, বিজ্ঞানও দর্শনের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না বলা চলে যে বাংলার আধুনিক সাহিত্য ইউরোপীয় সাহিত্যের পুত্র সম বা কন্যা সমা অবশ্য প্রেমেন্দ্র মিত্রনিরুক্ত' পত্রিকার এই মনস্কতাকে নির্লজ্জ কল' বিকৃতপ্রলাপবলেছেন তাঁর মতে এই বিকৃতিটাই বিদেশী আমদানী কিন্তু সুধীন্দ্রনাথ দত্তকাব্যের মুক্তিতে একথার বিরোধিতা করে বলেছেনবিশ্বের সেই আদিম উর্বরতা আজ আর নেই এখন সারা ব্রহ্মাণ্ড খুঁজে বীজ সংগ্রহ না করলে, কাব্যের কল্পতরু জন্মায় না কবি বিষ্ণু দেও এলিয়টের মহান অবদানকে বিশ্বের উত্তরাধিকার রূপে দেখতে চেয়েছেন অবশ্য বাংলা সাহিত্যে পাশ্চাত্যের প্রভাব নতুন কিছু নয় বঙ্কিম, মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, বিহারীলাল, রবীন্দ্রনাথ সকলেই পাশ্চত্যের প্রভাবের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছেন আধুনিক কাব্য কবিতার ইউরোপীয় বিশেষ করে ইংরাজী প্রভাব দোষের কিছু নয় বিশ্ব হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে একক দ্বীপের মত বাংলা সাহিত্য থাকতে চায়নি এবং তা থাকাও সম্ভবপর ছিল না কল্লোলের কবি গোষ্ঠী সকলেই প্রায় ইংরাজী সাহিত্যের ছাত্রও শিক্ষক তাদের কবিতায় ইংরাজীর প্রভাব পড়া খুবই স্বাভাবিক

আধুনিক কবিদের রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত হওয়ার বাসনাটা কেমন? সম্পর্কে বিষ্ণু দে ২৫শে বৈশাখ কবিতার লিখেছেন,

রবীন্দ্র ব্যবসা নর, উত্তরাধিকার ভেঙে ভেঙে চিরস্থায়ী জটাজালে জাহ্নবীকে বাঁধিনা, বরং আমরা প্রাণের গঙ্গা খোলা রাখি, গানে গানে নেমে সমুদ্রের দিকে চলি, খুলে দিই রেখা আর রং সদাই নূতন চিত্রে গল্পে কাব্যে হাজার ছন্দের রুদ্ধ উৎসে খুঁজে পাই খরস্রোত আনন্দেরবোদলেয়ারের ভক্ত বুদ্ধদেব বোদলেয়ারের মতই চিত্রকল্পকেও প্রতীকী রূপে ব্যবহার করেছেন তাঁরবন্দীর বন্দনারবীন্দ্র বিরোধিতা এবং আধুনিক মনোভাবের সচেতন নির্ভিক প্রকাশ প্রেমের কবি বুদ্ধদেব সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন মগ্ন চৈতন্যের প্রান্তদেশে তবু তিনি রবীন্দ্র অনুসারী রবীন্দ্র অনুভাবাপন্ন কবিমোদের তপস্যা বলে / নূতন গগনাঙ্গনে নব জন্ম লভিবে পৃথিবী”—এমনই একটা প্রতিজ্ঞা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন বুদ্ধদেব কিন্তু সেই তিনিই বন্দীর বন্দনা কাব্যের একটি কবিতায় লিখলেন

রবীন্দ্র ঠাকুর শুধু আজি হতে শতবর্ষ পরে/ কবি রূপে রহিবেন কুমারীর প্রথম প্রেমিক, প্রথম ঈশ্বর বালকের, বৃদ্ধের যৌবন ঋতু/ সকল লোকের শান্তি, সব আনন্দের সার্থকতা, শক্তির অশেষ উৎস, জীবনের চিরাবলম্বন

বন্দীর বন্দনা'য় তিনি যা বলেছিলেন 'কঙ্কাবতী'-তে তা নেই সেখানে তিনি নারী দেহের মদিরা পানে আগ্রহীদময়ন্তীতে তিনি জরার সম্মুখীনজরার জটিল রেখা শরীরেরে/ কঠিন পাথরে ঘেরে তবুনতুন পাতায় নিজের কবিতা সম্বন্ধে উপলব্ধি এখানে অনুপস্থিততাকে দেখে মন্ত্রের মতো ধ্বনিময় হয়ে উঠেছিল আমার কথা,/ সেই তো কবিতা

মধ্য তিরিশ কবিতায় গাড়ি ছুটে চলেছে যৌবনসীমা পার হয়ে বার্ধক্যের অভিমুখে সেখানে প্রহরী বলছে, “জিজ্ঞাসা কর নিজের মনকে কেন না চোখ কিছুই দ্যাখেনা মন সব দ্যাখে যাত্রীর মনে সংশয়যদি কিছুই দেখতে না পায়? উত্তরে প্রহরী বলে, “বাড়ি ফিরে গিয়ে তোমার মাকে পাবে/ তিনি কিছুই জিজ্ঞাসা করেন না শুধু কোলে টেনে নেন

একাকিত্বের বেদনা, শিল্পীর নিঃসম্পর্কর্তা এরই এটা প্রতীক বুদ্ধদেব মনে করতেন যে শিল্পীর বুদ্ধি পূর্ণজাগ্রত সংবেদনশীল বলেই, শিল্পী মানবসমাজও ভাগ্যের অংশীদার হয়েও সব কিছুকেই সুত্রধরের মত নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে দেখে থাকেন এলিয়ট impersonality theory তে একই কথা বলেছেন এদিক থেকে তিনি আধুনিক মনস্ক সবই তাঁর আত্মচিন্তা, সবই সযত্ন লালিত নিঃসঙ্গতার দ্যোতক

জীবনানন্দে প্রভাব ফেলেছেন কবি ইয়েটস ভাবও চিত্রকল্পের মাধ্যমে এবং এলিয়ট সময় চেতনার মাধ্যমে লী হান্ট বলেছিলেন, “Poetry includes whatsever of painting can be made visible to mind's eye and whatsever of music can be conveyed by sound and proportion without singing of instrumentation' জীবনানন্দের কবিতায় রয়েছে এই উক্তির প্রতিফলন তাঁর কবিতাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেনচিত্ররূপময় তার মূর্তিময়ী চিত্রকল্পগুলির কোনটি ইন্দ্রিয়লব্ধ যা শারীরিক ভাবে প্রতীয়মান, কোনটি বা দর্শনানুভূতি বা স্পর্শানুভূতির স্মারক যে ছবি তিনি কবিতায় আঁকেন দীপ্তি ত্রিপাঠী তাকে বলেছেনসামগ্রিক আবেদন বা Total effect” এই সব চিত্রকল্পে ইমপ্রেসনিষ্ট ছবির মতই যুগের যন্ত্রণা, ক্লিষ্টতা, হতাশা, বিদ্রোহ, মনুষ্যত্বহীন যান্ত্রিকতা কখনও স্পষ্ট বা স্নিগ্ধ কখনও বা দুর্বোধ্য বা অস্পষ্ট

ম্যালার্মে কে অনুসরণ করে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা কাব্য জগতে প্রবেশ নেতিবাদী জীবন দর্শনের প্রবক্তা হয়ে ম্যালার্মের মতই তাঁর কবিতাতেও morbidity আচ্ছাদন এই নেতিবাদী জীবন দর্শনের পরিচয় আছে 'উত্তর ফাল্গুনী' 'সংবর্ত অনেক কবিতায় শব্দের সমারোহের খেলায় তিনি কিছুটা দুর্বোধ্য হলেওঅর্কেষ্টা' 'ক্রন্দসীতে প্রেমের কবিতায় তিনি উজ্জ্বল তন্বী, অর্কেস্ট্রা ক্রন্দসী এই তিনখানি কাব্যকে বুদ্ধদেব বাবু বলেছেনসমতন্ত্রী’– স্বর ভঙ্গিতে বৈচিত্র্য থাকলেও সুর একটাই'

বাংলা কবিতার আকাশ খুবই প্রশস্ত কল্লোলের কবিগোষ্ঠীর মধ্যে যেমন ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, তার পরবর্তীকালে যুক্ত হয়েছে আরও অনেক কবির নাম এঁদের মধ্যে যাঁরা বিশেষ খ্যাতনামা হয়েছেন তাঁরা হলেন সমর সেন, বিষ্ণু দে, মনীন্দ্র রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুকান্ত ভট্টাচার্য, শঙ্খ ঘোষ, দীনেশ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

Post a Comment

0 Comments