বাংলা প্রবন্ধ : মুসলিম ব্রতাচার :হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রেক্ষাপট

 

মুসলিম ব্রতাচার :হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রেক্ষাপট: বাংলা প্রবন্ধ  : লেখক  : আব্দুল মুসরেফ খাঁন

                                                     বাঙলায় হিন্দু মুসলমানের সামাজিক ধর্মীয় আচরণ পদ্ধতিগতভাবে পৃথক হলেও উভয়ের শেকড় যেন একই মাটি থেকে রস আহরণ করেছে। আমরা জানি যে হিন্দুরা পৌত্তলিক এবং ঈশ্বরের নানা রূপে বিশ্বাসী। তাঁরা তাঁদের সাধন-ভজনে একাগ্রতা আনার জন্য দেবদেবীর মূর্তিকে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত করে। অন্যপক্ষে মুসলমানেরা এক আল্লায় বা পরমেশ্বরে বিশ্বাসী, তাঁর কোন শরীক [ভাগিদার] নেই এবং তিনি নিরাকার। তিনিলাম ইয়ালিদ-ওয়ালাম ইউলাদ' [তাঁকে কেউ জন্ম দেননি, তিনিও কাউকে জন্ম দেননি] প্রতিটি সাধারণ মুসলমানেরআল্লা' সম্পর্কে ধারণা এই। অর্থাৎ ইসলামে বিগ্রহ বা মূর্তিপূজা একেবারেই নিষিদ্ধ। অন্যদিক থেকে আলোচনা করলে দেখা যায় যে মুসলমানেরাও ঈশ্বর সাধনায় কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতীকী ভাবনাকে সামনে রাখেন। আমরা ইতিহাস পাঠে জেনেছি যে মানুষ সৃষ্টির আদিতে পিতাআদম’[first man accepted to Jewish, Christian and Muslim scriptures] এবং মাহাওয়া’ [Hebrew—Eve.]-কে বেহেস্তের [স্বর্গের] সমস্ত ফল খাওয়ার নির্দেশ দেওয়া থাকলেওগেঁহুফল খেতে নিষেধ করা ছিল। কিন্তু শয়তানের কারসাজিতে নিষিদ্ধ ফল তারা ভক্ষণ করে। এর শাস্তি স্বরূপ তাঁরা স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হন। পৃথিবীতে এসে তারা প্রশ্ন করলো যে এবার থেকে তারা কাকে সামনে রেখে আল্লার গুণ সঙ্কীর্তন করবে? তখন ঐশী বাণী হল যে পৃথিবীর বুকে আল্লারআরশ কুশি' [সিংহাসন throne of god] একটা ছায়া ফেলা হচ্ছে। সেটাকে পিতা আদম এবং মাতা হাওয়া চিহ্নিত করে রাখুক এবং তাকে সামনে রেখেই নামাজ বা সানাত [prayer, blessings) আদায় করুক। খোদার এই 'আরশ কর্শি' গায়ে আল্লার একশত গুণের নাম লেখা আছে। এই শতেক গুণের নাম 'দোয়া গঞ্জল আরশ' যে ছায়াটি পিতা আদম এবং মাতা হাওয়া ঘিরে রাখল তার নাম হল কাবা শরিফ/বাইতুল্লা ['আল্লার ঘর’—sacred building of Mecca, Muslim Holy of Helios containing the black stone] এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে মুসলমানেরা হজ-এর নামাজ পড়ার সময় কাবা ঘরকে সামনে রেখে বা কাবাকে উদ্দেশ্য করে নামাজ পড়েন। -প্রসঙ্গে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে সমগ্র ইসলাম দুনিয়ায় একটাই কাবা ঘর আছে। কাবার ছবি ব্যবহৃত হলেও কাবার কোন 'মডেল' [Replica] বানিয়ে বা সামনে রেখে কেউ নামাজ পড়ে না বা পড়া নিষিদ্ধ। ভাবে যদি দুটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচার-আচরণকে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায় তবে অন্তত উভয়ের লৌকিকস্তরে অন্তরশায়ী একটি মিল বা সাদৃশ্য দেখা যেতে পারে। বাঙলার [ভারতের অন্যত্রও] হিন্দু মহিলারা স্বামী-পুত্র-পরিবারের জন্য নানা ব্রত- পালনের মাধ্যমে মঙ্গল বা শুভ কামনা করেন। অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন : 'কিছু কামনা করে যে অনুষ্ঠান সমাজে চলে তাকেই বলি ব্রত' [বাংলার ব্রত' ১৩৬৭ : পৃ. ] পৌরাণিক যুগে আমরা দেবতাদেরও নানাব্রত পালন করতে দেখেছি। পরবর্তী কালে লোকায়ত সমাজে প্রায় মহিলারাই ব্রত পালন উদ্যাপন করে থাকেন। অন্যপক্ষে মুসলমান মহিলারাও তাঁদের স্বামী-পুত্র-সংসারের মঙ্গল কামনায় ব্রত পালন করে থাকেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে মুসলমান সমাজের মাঙ্গলিক ব্রতাচারের কয়েকটি যেমন মেয়েরা পালন করে, আবার কিছু কিছু ব্রতাচার পুরুষেরাও উদ্যাপন করে। সে-যাই হোক মুসলমানী ব্রতাচারগুলির নাম এইরকম :দশ বিবির কথা— [মহিলা]। সৈয়দাবিবির কথা— []   চটপট মুরাদবিবির কথা—[] রাইমাবিবির কথা— [] পাঁচপীরের কথা—[পুরুষ]  সত্যপীরের কথা—[উভয়ে]হাসান-হোসেনের কথা— [] হানিফ পালোয়ানের কথা—[]   বাবা মখদুম সাহেবের মান্নত—[উভয়ে]  দাদা মোহবুব পাথর-চাপড়ির মান্নত—[] নফল রোজা নামাজের মান্নত—[]।বারো ইমামের কথা— [] খাজা খিজিরের মান্নত— [] মহরম চাঁদের লাল-সবুজ পোশাকের মানত— [বালক]। শেষের ব্রতাচারটিতে মান্নত করে বাড়ির মেয়েরা, কিন্তু উদ্যাপন করে সাত থেকে আঠারো বছর বয়স্ক বালকেরা। এখানে আমি কয়েকটি নির্বাচিত ব্রতাচারের কথাউপচারফল বা কামনা এবং আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গগুলির আলোচনা করবো দশবিবির কথা প্রথমে জেনে নেবো দশবিবির নাম ফাতেমা-উল-জহরা [বাঃ তাঃ আঃ]।  বিবি মরিয়ম।সায়রা বিবি। আশিয়া বনি ইসরাইল  হাজেরা বিবি।জয়নাব বিবি।   কুলসুম বিবি সোগরা বিবি।কোবরা বিবি। সাখিনা বিবি।

পারিবারিক কোন বিপদ বা কোন মনস্কামনা সিদ্ধির উদ্দেশ্যে, অথবা স্বামী-পুত্রের মঙ্গল সাধনের জন্য উক্ত দশবিবির মান্নত করা হয়। এই মান্নত কেবল বিবাহিতা মেয়েরাই করতে পারে, এবং কেবল তারাই এই কাহিনী বলে শোনে। এই ব্রতকথার শ্রোতা বিবাহিতা মহিলা হতেই হবে, দশের বেশি হতে পারে কিন্তু দশের কম হলে চলবে না ঋতু চলাকালীন কোন মহিলা দশবিবির কাহিনী বলতে বা শুনতে পারবে না। পুরুষের এই কাহিনী বলা বা শোনা নিষেধমা ন্নত শুরু থেকে দশ দিনে দশবিবির কথা বলা হবে এমন ভাবে যে শেষ বিবির কাহিনী বলার দিন হবে বৃহস্পতিবার। কথা যেদিন শেষ হবে,—অর্থাৎ দশদিনের মাথায় যে উপচারগুলি লাগবে সেগুলি হলো : মলিদা দিয়ে দশটি লাড্ডু তৈরি করতে হবে।  মলিদা হল নিম্নলিখিত উপকরণগুলি দিয়ে তৈরি একটি উপচার: ময়দা। চিনি। ছহুড়া [খুরমা] গড়ি [শুকনো নারকেল] পোস্ত। ঘি। একটা কোরাকুন্ডা-[মাটির সরা] যেটাতে দশটা মলিদার নাড় রাখা হবে। দশটা বেলফুল। দশটা সাজা পান।এই হলো দশবিবির সিন্নি। ব্রত উদযাপনের দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দশ ব্রতকারিণী পশ্চিম দিকে মুখ করে বসবে এবং যিনি দশবিবির কথা পাঠ করবেন তিনি 'দুই রাকাত নফল নামাজ' পড়ে কথা বলা শেষ করবেন। পড়া শেষ হলে দশজনের হাতে একটা করে মলিদার নাড, একটা সাজা পান একটা বেলফুল এক একজনের হাতে সিন্নী হিসাবে তুলে দেবেন। এখন এই দশবিবির কাহিনী কি এবং কেন তাঁদের কাহিনী ব্রতকথা হিসাবে প্রচার পেলকাহিনী একটু বর্ণনা করে, সে-বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু বলবো। এই প্রসঙ্গে আরো বলি যে দশবিবির প্রত্যেকের পৃথক পৃথক কথা বেশ বড়। তাই প্রত্যেকের বিষয়ে আলাদা আলাদা আলোচনা না করে মাত্র দু-জনের বিষয়ে এখানে বলা হবে। এবং তারপরে কেন তাঁদের কথা ব্রতাচারের অঙ্গীভূত হলো তাও বলা হবে।

বিবি মরিয়ম

ইনি একজন সাধক দরবেশের কন্যা যাঁর দায়িত্ব ছিল একটি ঈশ্বরের উপাসনালয়কে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা অধিকন্তু মহিয়স কন্যার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন আল্লার পয়গম্বর [ভগবানের দূত] ইসা আলায়হে ওয়া সাল্লাম'—যিনি ছিলেন খ্রিস্ট ধর্মের প্রবর্তক। এই মহিয়সীর উপর নানান অত্যাচার হয়েছে, কিন্তু তিনি আল্লার প্রতি অগাধ আস্থা এবং বিশ্বাস রেখেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তিনি কখনও কোন অবস্থাতেই ঈশ্বরে ইমান [বিশ্বাস] হারান নি।

ফাতেমা উল জরা [রাঃ তাঃ আঃ]

ইনি ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত আহাম্মদ মোস্তাফা মহম্মদ মোস্তাফা সাল্লোল্লাহো আলায়হে ওয়া সাল্লমা'-এর জ্যেষ্ঠা কন্যা। আজীবন ইনি সমস্ত হতদরিদ্র মহিলাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সামাজিকভাবে এবং ধর্মীয় দিক থেকে সহযোগিতা করতেন। ইনি কারবালা প্রান্তরের হতভাগ্য দুই শহিদ ইমাম হাসান [রাঃ তাঃ আঃ] এবং ইমাম হোসেন [রাঃ আঃ]-এর মাতা। অশেষগুণবতী এই মহিয়সী মহিলার গুণকীর্তন করে শেষ করা যাবে না। ইনি আল্লার অত্যন্ত প্রিয়পাত্রী ছিলেন। দশবিবির মধ্যে এঁর স্থান সর্বোচ্চে। তাঁর আদর্শ যতিজীবনকথা প্রতিটি মুসলিম রমণীর অবশ্য শ্রব্য। এখন আমরা জানতে চাই যে কিভাবে উক্ত দশবিবির কথা প্রচার পেল এবং তাঁদের পূর্ব- জীবনকথা ব্রতাচারের অঙ্গীভূত হল। 'দশ বিবিওঁ কি কাহানী' গ্রন্থের লেখক মহম্মদ আবু- ইয়াকার আজীমবাদী নাসির কথিত দশবিবির মাহাত্ম্যসূচক কাহিনী এই রকম: কোন এক দেশে দুই ভাই পাশাপাশি বাস করতো। তাদের মধ্যে বড় ভাই অত্যন্ত ধনী, আর ছোট ভাই খুবই গরীব ;অর্ধেক দিন দু-বেলা দু-মুঠো ভাতও জুটতো না। দারিদ্র্য দূর করার জন্য একদিন ছোটভাই বউ-ছেলেমেয়েকেবাড়িতে রেখে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়লো। এরপর বেশ কয়েক মাস কেটে গেলো তার কোন খবর পাওয়া গেল না। কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পরেও ছোট ভায়ের কোন খবর পাওয়া গেল নাস্ত্রী-সন্তানদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়লো। কিছুতেই আর পেট চলে না। শেষে একদিন ছোট বউ বড় ভাসুরের বাড়িতে কাজ নিলো। কিন্তু তারাও আত্মীয় বলে বেশি করে খাটিয়ে নিলোকিন্তু হাত উপুড় করলো না   আল্লার দয়া হলো। এক রাতে স্বপ্নে দেখলো যে একজন ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢাকা মহিলা আর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আল্লার দোয়া চেয়ে কান্নাকাটি করতে লাগলো। অবশেষে বলছেন: ‘এই মেয়ে তুমি মান্নত করো যে, তোমার দুঃখ ঘুচলে, তোমার স্বামী ফিরে তুমিদশবিবি ব্রত পালন করবে।' সে রাজি হয়ে গেল। পরদিন তার স্বামী ফিরে এলোঅনেক টাকা পয়সা নিয়ে। তাদের অবস্থা ফিরে গেল। তখন ঘটা করে ছোট বউ দশবিবির ব্রতের আসর বসালো। নাড়ু বানিয়ে সিন্নি দিলো। তার থেকে একটা নাড়ু বড় জাকে দিয়ে এলো। বড় জা ঘৃণাভরে নাড়ু ফিরেয়ে দিল। এতে দশবিবি ক্রুদ্ধ হলেন। তারা দশবিবির কোপে পড়ে যা- খেতে যায়,—যেখানেই খেতে যায়, তাতেই পোকা কিলবিল করতে থাকে। তাদের আর খাওয়া হয় না। বড় ভায়ের বিশেষ বন্ধু পাশের দেশের রাজা। সেখানে গিয়েও একই অবস্থাখাবারে পোকা। উল্টে আর এক নতুন বিপদে তারা জড়িয়ে পড়লো। রানীর মুক্তোর মালা চুরির অপবাদে তাদের দু-জনের গর্দান যাওয়ার উপক্রম হলো। সেখান থেকে পালিয়ে এসে ভাবতে বসলো কেন তাদের এমন হলো? কি অপরাধ তারা করেছে? শেষে বড় বউ-এর মনে পড়লো যে সে ছোট জায়ের দেওয়া দশবিবির প্রসাদ খায়নিতাই এমন হচ্ছে। তখন পরম অনুশোচনায় ভুগে দশবিবির মান্নত করলো। তাদের সব দুঃখ দূরে গেল। এইভাবেদশবিবির কথাভূমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়লো।

সৈয়দা বিবির কথা:

দশবিবির কাহিনীর সঙ্গে এঁর কথার কিছু পার্থক্য আছে। সৈয়দা বিবির যিনি মান্নত করবেন তাকেই কথা শুনলেই হবে। অবশ্য সঙ্গে অন্য যে কেউই শুনতে পারে। সিন্নীর ক্ষেত্রে তেমন কোন ধরা বাঁধা উপাদান নেই, যার যেমন সামর্থ্য সেই মূল্যেরই সিন্নি চড়াতে পারে। যে কেউ যে কোন বিপদে পড়লে বা পারিবারিক অবস্থা সঙ্কট থেকে উদ্ধার পেতে হলে বা মঙ্গলময় ঈশ্বরের করুণা পেতে চায় তখনই মুসলিম মহিলাগণসৈয়দা বিবির কথা মান্নত করে। তারা এই বলে প্রার্থনা করে যে: 'আমি বিপদে পড়েছি বা আমি এই মঙ্গলজনক কাজে সাফল্য লাভ করেছি অথবা আমি বিপদ থেকে মুক্ত হয়েছি অথবা আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে, তাই আমি জনাব সৈয়দা বিবির কাহিনী - এই বিবি হচ্ছেন হজরত মহম্মদ [এঁর ওপর আল্লার করুণা বর্ধিত হোক] -এর কন্যা- ফাতিমা-উল জহুরা। ইনি আল্লার এত প্রিয় যে, তিনি যদি আল্লার কাছে দোয়া চেয়েছেন তবে আল্লা সেই প্রার্থনা মঞ্জুর না করে পারেন না। কিভাবে সৈয়দা বিবি ব্রতাচারের অঙ্গীভূত হলেন? একদিন এক স্বর্ণকারের ছেলে তার বাবার সোনা গলানোর জলন্ত ভাঁটিতে পড়ে গেল। তাই দেখে স্বর্ণকারের বউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এই ঘটনায় হজরত সৈয়দা বিচলিত হয়ে পড়লেন এবং স্বর্ণকারের বৌকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন যে, তার ছেলের কিছুই হয়নি। সে যেন জ্ঞান ফিরে পেয়ে সৈয়দা বিবিরকথাশোনে। জ্ঞান ফিরতেই স্যাকরার বউ দেখে যে তার ছেলে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে। স্বর্ণকারের বউ খুশি হয়ে দু-পয়সার সিন্নী করে সবাইকে বিতরণ করল এবং সবাইকে সৈয়দা বিবির কথা শোনার জন্য অনুরোধ জানাল। কিন্তু কেউই এই কথা শুনতে রাজি হল না। তখন স্বর্ণকারের বউ মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বনের পথে রওনা হলো। জঙ্গলের একটু গভীরে যেতেই আপাদমস্তক বস্ত্রাচ্ছাদিতা এক মহিলা তাকে বললেন: ‘তুমি এখানে বসে কেঁদোনা, আমি তোমাকে সৈয়দা বিবির কথা শোনাচ্ছি। তিনি বলতে লাগলেন : একবার এক ইহুদী হজরত মহম্মদকে [সাঃ আঃ] নিমন্ত্রণ করেছেন তাঁর কন্যার বিবাহে। হজরত মহম্মদ ইহুদীকে অনুরোধ জানালেন যে তিনি যেন জানাব সৈয়দা বিবিকেও এই অনুষ্ঠানে নেমন্তন্ন করেন। ইহুদী ভদ্রলোক বিবির স্বামী হজরত আলীর কাছে অনুমতি নিয়ে সৈয়দাকে যাওয়ার অনুরোধ জানালো, জনাব সৈয়দা বাহন আনতে বললেন। ইহুদী ভদ্রলোক বাহন আনতে গেলে জনাব সৈয়দা দু-রাকাত নফল [Voluntary act of religion the observance of which is not compulsory] নামাজ পড়ে আল্লার কাছে আর্জি জানালেন যে:- ‘হে আল্লা তার এমন কোন ভালো কাপড় নেই যা পরে সে বিয়ে বাড়ি যেতে পারে। এই প্রার্থনা শেষ হওয়ার কিছু পরেই একজন অজানা ব্যক্তি তাঁকে মূল্যবান বস্তু দিয়ে গেলো। তাই পরে তিনি সেই ইহুদী ভদ্রলোকের বাড়ি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলেন। সৈয়দা বিবি উপস্থিত হলে তাঁর রৌসনিতে সারা বিয়ে বাড়ি উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং তাঁর রৌসনি সহ্য করতে না পেরে নিমন্ত্ৰিত পাঁচশত মহিলা অজ্ঞান হয়ে পড়ল। এমনকি বিয়ের কনেও জ্ঞান হারাল। কিছুক্ষণের মধ্যে অন্যসব মহিলাদের জ্ঞান ফিরে এলেও কনের জ্ঞান ফিরল না। ফলে বিবাহ বাড়িতে কান্নার রোল উঠলো। এই অবস্থা দেখে বিবি সৈয়দা আবার নামাজে বসলেন এবং আল্লার কাছে প্রার্থনা করলেন যে : 'হে আল্লা আমি বিয়ে বাড়িতে সবার সঙ্গে আমোদ- আহ্লাদ করতে এলাম, আর বিবাহের কনের জ্ঞান ফিরছে না। এতে তো আমার বদনাম হবে। হে-আল্লা তুমি আমার মান-ইজ্জৎ রক্ষা কর।' দোয়া শেষ হতেই পাত্রীটি জ্ঞান ফিরে পেল এবং খুব ভালোভাবে বিয়ের কাজ শেষ হল। সৈয়দার আল্লাভক্তিতে অনুপ্রাণিত হয়ে পাঁচশত মহিলা তাদের স্বামী সহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল।এর পরে মহিলা স্বর্ণকারের বউকে সৈয়দা বিবির মাহাত্ম্যসূচক আরো একটি কাহিনী বলেন। স্বর্ণকারের গৃহিণী মুগ্ধ হয়ে সব শোনে এবং বিবির প্রতি ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে পড়ে, – প্রশান্ত চিত্তে বাড়ি ফিরে আসে। এইভাবে সে যখন জঙ্গল ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসছে সেই সময় সে দেখে যে, যে সমস্ত বাড়ির মেয়েরা তার কাছে সৈয়দা বিবির কাহিনী শুনতে রাজি হয়নি তাদের সবার ঘরে আগুন লেগেছে। এই বিপদের সময় স্বর্ণকারের বৌকে দেখতে পেয়ে সবাই তার কাছ থেকে সৈয়দা বিবির মাহাত্ম্য কথা শুনতে চায়। সে তখন সকলকে পবিত্র মনে একাগ্রচিত্তে সৈয়দা বিবির কথা শুনতে বলে। তারা তাই করলে তাদের মনে শান্তি ফিরে এলো এবং বাড়ির আগুন নিভে গেলযেমন ছিল আবার সব তেমনই হল। এভাবেই সৈয়দা বিবির কাহিনী মুসলিম সমাজে ব্রতাচারে পরিণত হল।

হজরত খাজা খিজির-এর মান্নত:

মুসলমানগণ হজরত খাজা খিজিরকে জলের মালিক হিসাবে মানে। মানুষের জল- জীবন। অথচ আমরা নানা সময়ে জলের অপব্যবহার করে থাকি। তাই জলের মালিক খাজা খিজিরকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য, চাঁদের হিসাব মতো শবেবরাত পরবের আগে পূর্ণিমার রাতে ছোট ছোট গোল গোল চুবড়ি তৈরি করে তাতে মাটির চেরাগ [প্রদীপ] জ্বালিয়ে জলে ভাসিয়ে দেয় মেয়েরা। পাত্রে উপচার হিসাবে সাধারণত দেওয়া হয় রুটি, আতপ চালের পায়েস। মাংসও রাখা হয়। [এই চেরাগ ভাসানোর অনুষ্ঠান মুর্শিদাবাদেবেরাভাসানো উৎসব নামে পরিচিত। দ্রষ্টব্যঅনুসূত্র']  যদি কারো ছেলে ডুবে যেতে যেতে উদ্ধার পায় তখন বাচ্চার বাবা-মা বা গুরুজন স্থানীয় কেউ মান্নত করে খাজা খিজিরের। আবার কোন মনস্কামনা পূরণ করার জন্য মেয়েরা পুকুর বা নদীর এক বুক জলে দাড়িয়ে পশ্চিম দিকে মুখ করেঅজুকরে এবং জলের পয়গম্বর খাজা-খিজিরের কাছে মান্নত করে থাকে। মনোবাঞ্ছা পূরণ হলে মান্নত শোধ করে কেউ কেউ মান্নত শোধ করার সময় মিলাদ [ যে অনুষ্ঠানে হজরত মহম্মদ-এর গুণকীর্তন করা হয় তাকে মিলাদ বলে] অনুষ্ঠান করে।

নফল নামাজ নফল রোজা:

মুসলিম সমাজে যত ব্রত-পার্বণ আছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল নফল নামাজ নফল রোজা  কেউ কোন বিপদে পড়লে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নফল রোজা নফল নামাজের মান্নত করে। আবার কারো মনোবাঞ্ছা যাতে পূরণ হয় তার উদ্দেশ্যে আল্লার কাছে প্রার্থনা করেহে আল্লা, আমার মনের ইচ্ছা বা আমার বাড়ির সকলের মঙ্গল সাধন হলে আমি তোমার উদ্দেশ্যে দুটো নফল রোজা দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ব' এই মান্নত একেবারে সোজাসুজি আল্লার কাছে নিবেদন। এই নফল রোজা রাখার জন্য তারাবি নামাজ পড়তে হয় না, তবে সেহেরী [ভোরের খাবার] করতে হয় এবং মাগরিব [সূর্যাস্ত]-এর সময় আফতার করতে হয়। এর জন্য কোন বিশেষ সিন্নী লাগে না। অতএব এই দীর্ঘ আলোচনা এবং ব্রতকথা বর্ণনার পর আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মুসলমান সমাজেও রয়েছে নানান ব্রত তার কথা। তবে হিন্দু সমাজের ব্রতকথার সঙ্গে যেমন উপবাসের অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে, মুসলমান সমাজের কোন ব্রত-পার্বণে উপবাস করার প্রথা নেই কেবল 'নফল রোজা' ছাড়া।

বেরা' বা 'বেড়া' বা 'ব্যারা' উৎসব : হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রেক্ষাপট

'মুর্শিদাবাদ শহরের বেরা উৎসব বহুকালের প্রাচীন। নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ ঢাকা হইতে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত করিবার পর প্রতি বৎসর ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার রাত্রিকালে কেল্লা নিজামতের পাশে বর্ষাপ্লাবিত ভাগীরথী বক্ষে আলোক সজ্জিত একটি বৃহৎ কদলীবৃক্ষ নির্মিত বেরা বা তরণী ভাসাইয়া এই উৎসব পালন করা হয়। নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ- বেরা উৎসবের প্রবর্তক এবং পীর খাজা খিজিরের সম্মানার্থে প্রতি বৎসর ভরা গঙ্গা বক্ষে এই আলোক উৎসব অনুষ্ঠিত হয় শিয়া সম্প্রদায় সাধারণত মহরম মাসে উপবাস [রোজা] পালন করেন। যদি কোন বৎসর ভাদ্রের শেষ বৃহস্পতিবার মহরম মাসে পড়ে তবে সেই বৎসর বেরা উৎসব নির্ধারিত শেষ বৃহস্পতিবারে না হইয়া অন্য যে-কোন বৃহস্পতিবারে অনুষ্ঠিত হয়।মুর্শিদাবাদের নবাব বংশ যে এলাকায় বসবাস করেন সেই প্রাচীর বেষ্টিত অংশের নাম কেল্লা নিজামত। নবাব প্রাসাদ তন্মধ্যে অবস্থিত। কেল্লা নিজামতের উত্তর দিকে প্রকাণ্ড ইমামবারা যাহা ভারতের মধ্যে বৃহত্তর ইমামবারা নামে বিখ্যাত। ইমামবারা নবাব প্রাসাদের পশ্চিমে দক্ষিণ বাহিনী ভাগীরথী ভাদ্র মাসে বন্যার জলে দুকুল প্লাবিত করিয়া বহিয়া যায় এবং সেই সময় কেল্লা নিজামতের পাশে খুব স্রোত থাকে। বেরা উৎসবের কয়েকদিন পূর্ব হইতে রাশি রাশি কদলীবৃক্ষ কাটিয়া আনা হয় এবং ইমামবারার অনতিদূরে বাঁশ দড়ির সাহায্যে কলাগাছগুলি বাঁধিয়া একটি সুবৃহৎ চতুষ্কোণ বেরা বা তরণী তৈয়ার করা হয়। বেরার উপরিভাগে নানাবিধ রঙিন কাগজ অপরাপর জিনিসের সাহায্যে মসজিদ, মিনার, খিলান প্রভৃতি নির্মাণ করা হয় এবং সমস্ত বেরাটি মোমের বাতি দিয়া সাজান হয়। উৎসব দিবসে গ্যাস কেরোসিনের অন্যান্য আলোকের সাহায্যে আলোকোজ্জ্বল করিয়া বেরাটিকে শক্তভাবে বাঁধিয়া রাখা হয়। রাত্রি প্রায় নয় ঘটিকার সময় নবাব প্রাসাদ হইতে হস্তী, অশ্ব, বাদ্যভাণ্ড প্রভৃতি সহ এক শোভাযাত্রা বাহির হয়। উক্ত শোভাযাত্রায় রৌপ্য নির্মিত গোশকট লোকের মাথায় করিয়া জলের দেবতা পীর খাজা খিজিরের উদ্দেশ্যে সিন্নী লইয়া যাওয়া হয় এবং উক্ত সিন্নী বেরার উপর লইয়া গিয়া জনৈক মৌলবী খাজা সাহেবের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন।পূর্ব হইতেই রঙিন ফানুসের মধ্যে শত শত বাতি জ্বালাইয়া নদীতে ভাসাইয়া দেওয়ার ফলে ভাগীরথীর বক্ষে শত শত আলোর কমল ফুটিয়া উঠে। আতসবাজি পোড়ান হয়। রাত্রি প্রায় এগারটার সময় তোপধ্বনির সংকেত করিয়া বেরা ভাসাইবার আদেশ দেওয়া হইলে উক্ত দীপ শোভিত তরণীটি বন্ধন মুক্ত করা হয়। আলোকোদ্ভাসিত বেরা অন্যান্য নৌকার সাহায্যে স্রোত মুখে ভাসিয়া চলে এবং তীরে নানারূপ বাদ্যভাণ্ড বাজিতে থাকে। বেরার উপর হইতে আতস বাজী ছাড়া হয়। নদী তীরে হাজার হাজার নরনারী আসিয়া জমায়েত হয় এবং নিকটবর্তী শহরগুলি হইতে শত শত নৌকা বেরাটিকে ঘিরিয়া ধরে। মুর্শিদাবাদের বেরা উৎসব দেখিবার জন্য বেশীর ভাগই হিন্দু জনতা সমবেত হয়। গ্রামাঞ্চল হইতে বহু মুসলমান নরনারীও আসে এবং ফিরিবার সময় ছেলেমেয়েদের জন্য রংচঙে চাঁদমালা আখ কিনিয়া লইয়া যায়। উৎসবটি মাত্র একদিনই স্থায়ী হয়। দশ-বারো হাজারেরও অধিক নরনারী এই উৎসব দেখিতে আসে। দুই শতাধিক বৎসর ধরিয়া মুর্শিদাবাদের বেরা উৎসব জেলার সর্বসম্প্রদায়ের লোককে অন্ততঃ একটি রাত্রির জন্য উৎসব আনন্দে মাতাইয়া তুলে। নবাব পরিবার হইতে বেরা উৎসব পালনের জন্য বার্ষিক অর্থ বরাদ্দ আছে। এই বেরা উৎসব সম্পর্কে মুর্শিদাবাদ ডিস্ট্রিক্ট হ্যাণ্ডবুক- উল্লেখ আছে যে :  'Another old ceremony still observed at Murshidabad, which it will not be out of place to mention here, is the Bera or festival of Khwaja Khizr. This is observed by launching tiny light ships on the river, a spectacle which may be seen to great advantage on the Bhagirathi. On certain nights in the rainy season thousands of little rafts, each with its lamp burning are floated down the stream. Their construction is very simple, for a piece of plantain or bamboo bears a sweet meat or two and the lamp. The festival is celebrated with much magnificence on the last Thursday of the month of Bhadra, [September]. A raft is constructed of plantain trees and bamboos and covered with earth. On this is erected a small fortress, bearing fireworks on its walls. At a given signal the raft is launched and floated to the further side of the river, when the fireworks are let off, their reflection on the water producing a picturesque effect. [District Handbooks, Murshidabad, 1951, by A. Mitra, p liv] “প্রতি বৎসর ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবারের রাত্রিকালে জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ খাজা খিজিরের স্মৃতির উদ্দেশ্যে আলোকমালায় বিভূষিত করিয়া বাঁশ কলাগাছের শত শত ক্ষুদ্র বৃহৎ তরণী বর্ষাস্ফীত ভাগরথীতে ভাসাইয়া দেওয়া হয়। প্রধান আলোকযান দৈর্ঘ্যে প্রস্থে যথাক্রমে ১২০ ৯০ ফুট পর্যন্ত হইয়া থাকে। মুর্শিদাবাদের গৌরবময় যুগে ইহা আরও অনেক বড় হইত। বহু সংখ্যক কলাগাছ বাঁধিয়া বাঁশ বাখারির সাহায্যে রঙীন কাগজ দিয়া নানারকম ঘর বাড়ী যুদ্ধের জাহাজ নির্মাণ করিয়া অসংখ্য প্রদীপ দিয়া এগুলিকে সজ্জিত করা হয়। ইহার চতুর্দিকে ছোট ছোট বহু যান অগণিত কমল [কপূর-পূর্ণ মাটির প্রদীপ] ভাসিতে থাকে। মুর্শিদাবাদের নবাব-বংশীয়গণ জাঁকজমকের সহিত শোভাযাত্রা করিয়া জাফরাগঞ্জের নিকট নদী তীরে গিয়া এই উৎসবে যোগদান করেন। কতকগুলি সিপাহীও নিজামতী ব্যাণ্ড খাজা খিজিরের জন্য রুটী, ক্ষীর, পান প্রভৃতি লইয়া প্রধান আলোকযানে আরোহণ করিলে ধীরে ধীরে নদীবক্ষে এই আলোকমালা সঙ্গীতযোগে চলিতে থাকে। নদীবক্ষ তীর হইতে নানা বর্ণের সুন্দর সুন্দর আতসবাজি আকাশে উঠিয়া উৎসবের সৌন্দর্য বর্দ্ধন করে। পূর্বে মুর্শিদাবাদের পশ্চিম তীরে রোশনীবাগে বাঁশ দিয়া ত্রিতল গৃহাদি নির্মিত করিয়া আলোকমালায় সজ্জিত করা হইত ; নদীবক্ষে প্রতিফলিত হইয়া ইহারা আলোক উৎসবের সৌন্দর্য বহুগুণে বর্ধিত করিত; ইহা হইতেই রোশনীবাগের নামের উৎপত্তি। এক্ষণে রোশনীবাগ অন্ধকারাচ্ছন্ন। নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁর সময় হইতে এই উৎসব চলিয়া আসিতেছে বলিয়া কথিত। ব্যারার জাঁকজমক পূর্বাপেক্ষা অনেক কমিয়া যাইলেও ইহা এখনও মুর্শিদাবাদের একটি স্মরণীয় উৎসব এবং বহু স্থান হইতে এই উপলক্ষে জনসমাগম হয় সিরাজউদ্দৌলা ব্যারার পূর্ব বৃহস্পতিবার নাওয়ারা নামে আর একটি উৎসবের প্রবর্তন করেন বলিয়া কথিত। উক্ত দিবসে বৈকাল বেলায় বহু সুসজ্জিত তরণী লইয়া নদীজলে অগণিত কদম্ব ফুলের মালা ভাসাইয়া নবাব নদীবক্ষে দরবার করিতেন। এই উৎসব বন্ধ হইয়া গিয়াছে।  [বাংলায় ভ্রমণ, ১ম খণ্ড পূর্ববঙ্গ রেলপথের প্রচার বিভাগ কর্তৃক ১৯৪০ সনে প্রকাশিত পূঃ ২৮৪-২৮৫] মুর্শিদাবাদের বেরা উৎসব সম্পর্কেযুগান্তর' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিস্তারিত বিবরণী নিম্নে উদ্ধৃত করা হইল :

মুর্শিদাবাদের বেরা উৎসব

সারাদিন দারুণ গুমোটের পর সন্ধ্যের মুখেই একচোট খুব বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাতটা তাই বেশ ঠাণ্ডা। প্রকৃতিও আর কোনও অঘটন ঘটায়নি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আকাশ। শুক্লা চতুর্থীর ক্ষীণাঙ্গী চন্দ্রকলা একবার মাথার ওপরে দেখা দিয়েই কখন উধাও হয়েছে। নক্ষত্র-চর্চিত বিশাল আকাশখানা বর্ষাস্ফীত ভাগীরথীর জলে মুখ দেখবার জন্যে ঝুঁকে পড়লেও আজ রাত্তিরে তার সুন্দর মুখে নয়, আর এক অন্য রূপে ভাগীরথী রূপময়ী হয়ে উঠেছে। বাঁশ আর কলাগাছ দিয়ে তৈরি বিচিত্রগঠন প্রকাণ্ড একটি ভেলা মোমবাতির আলোর গহনা পরে ভাগীরথীর জলে ভাসছে। বাখারি, চেঁচারির কাঠামোতে রঙ্গিন কাগজে, অভ্রে, রাঙতায় সাজানো তার মিনার, ছত্রি, বারান্দা, তোরণ। তাদের চূড়োয় চূড়োয় নিশান, ময়ূর, আলোর ঝালর। বেলোয়ারি ঝাড়-লণ্ঠনের মত অভ্রের ঢাকনার ঝোলানো মোমবাতির আলোর কারুকর্মে ভেলার সর্বাঙ্গ ভূষিত। জলের ঢেউ- ভেলা দুলছে। সেই দোলাতে চুড়ো থেকে তলা পর্যন্ত বেলোয়ারি আলোর সাজও দুলেছে ঝিলিক তুলে। এই আলোর ভেলা আর তার কম্পমান প্রতিবিম্বিত রূপটিকে বুকে নিয়ে রাতের কালো ভাগীরথী স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে যেন। এই ভেলার নাম বেড়া, ব্যারা, ব্যাড়া-সব নামও বলে কেউ কেউ। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবারের রাত্তিরে মুর্শিদাবাদ শহরে যে বিখ্যাত বেরা উৎসব হয়, সেই উপলক্ষেই ভেলাটি তৈরি হয়। মুসলমানী শাস্ত্রে জলদেবতা বলে কথিত খাজা খিজির নামে এক পীরের উদ্দেশে এই ভেলাটি উৎসর্গ করে ভাগীরথীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, নবাব নাজিমদের হাজারদুয়ারী প্রাসাদের সামনে তোপখানার ঘাট থেকে। রাত এগারোটার সময় তোপখানার কামান থেকে তোপ দেগে বেরা ভাসানোর লগ্নটি ঘোষিত হবামাত্র ভেলার তীরের সঙ্গে রজ্জুবন্ধনটি কেটে নেওয়া হয়। স্রোতের টানে হেলে দুলে রূপের আলো ছড়িয়ে ভেলা ভেসে চলে দক্ষিণ-বাহিনী ভাগীরথীর বুকে। তাকে ঘিরে অনেক নৌকোও চলে সঙ্গে সঙ্গে, আলো বাজনা-বাদ্যি নিয়ে। বাজি পোড়ানোর ধূমও পড়ে যায়

ময়ূরপঙ্খী নাও

এই উৎসবে ভেলাটিই কিন্তু সর্বস্ব নয়। চেচারির কাঠামোতে কালো কাগজ দিয়ে যে চারটি ময়ূরপঙ্খী তৈরি করা হয় আসল উৎসব তাদেরই নিয়ে। ভেলার মাঝখানে থাকে সেই ময়ূরপঙ্খী চারটি। তারা তের হাত লম্বা দেড় হাত চওড়া। ময়ূরপঙ্খী নাম, কিন্তু তাদের সামনের মুখ মকর আর পেছনের মুখ হাতীর মত। এই মকরমুখো নৌকার ওপরে মাঝখানে চৌরি-বাঙলা। রঙ্গিন কাগজের ঝালরে, নিশানে, নানান্ আভরণে, সাজসজ্জায় নৌকোগুলো বিচিত্র রূপ ধারণ করে। খুদু মিঞা নামে এক নিপুণ কারিগর বংশপরম্পরাক্রমে এই কারুকর্মটি করে আসছেন। তিনিই ভেলার সমস্ত আলোর আভরণ, গম্বুজ, মিনার, তোরণ, বারান্দা, ময়ূর,নিশান প্রভৃতি তৈরি করেন।

খাজা খিজিরের নামে সিন্নি

ময়ুরপঙ্খীগুলো ওয়াসিফমঞ্জিলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নবাববাড়ীর লোকজন মকরের মুখে ফুলের মালা বেঁধে দেন। তারপর খাজা খিজিরের জন্যে সুজির পায়েস, রুটির সিন্নি আর সোনার পিদিম্ নিয়ে বাজনা-বাদ্যি করে মিছিল আসে তোপখানার ঘাটে। ময়ূরপঙ্খী চারটি ভেলার মাঝখানে স্থাপন করা হয়। খাজা খিজিরের নৈবেদ্যও সেখানে রাখা হয়। তারপর খাজা খিজিরের নামে সোনার পিদিম্ আর ভেলার সব মোমবাতি জ্বেলে দেওয়ার রীতি। তোপখানার তোপ দাগার সঙ্গে সঙ্গে ভেলা হয় ভাসিয়ে দেওয়া। এর নাম বেরা কাটা। গোলবেরা ভাসানো ছাড়া আর একটি অনুষ্ঠান আছে, তার নাম কমল ভাসানো। কলার পেটোর ওপরে মোমভর্তি গেলাস বসিয়ে রঙ্গিন কাগজের ঘেরাটোপে সাজিয়ে সেইগুলি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ভাগীরথীর বুকে দ্রুত ধাবমান সেই বিপুল সংখ্যক আলোর কমল চোখে যেন বিভ্রম সৃষ্টি করে।

সোদো ভাসানোর সঙ্গে মিল

এটি মুসলমানী উৎসব। ভাদ্র মাসে কলাগাছের পেটোতে কাগজ দিয়ে নৌকো সাজিয়ে, তার ভেতরে এলাচদানা, বাতাসার সিন্নি রেখে, ধূপ চেরাগ জ্বেলে পীরের নামে উৎসর্গ করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার প্রথা এক সম্প্রদায়ের মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত আছে। কলকাতাতেও গঙ্গায়, পুকুরে মুসলমানদের ঐরকম নৌকা ভাসাতে দেখেছি। বাঙ্গালি হিন্দু মেয়েরাও পৌষ সংক্রান্তিতে ঠিক ঐরকমভাবেই সোদো ব্রত করেন। কলার পেটোয় নৌকো বানিয়ে গাঁদাফুল দিয়ে সাজিয়ে তার ভেতরে বাতাসা রেখে পিদিম জ্বালিয়ে নদীতে, পুকুরে ভাসিয়ে দেন তাঁরা এর নাম সোদো ভাসানো। মুসলমানদের এই বেরা ভাসানোর সঙ্গে হিন্দু মেয়েদের সোদো ভাসানোর বেশ মিল আছে। কিন্তু মুর্শিদাবাদের বেরা ভাসানোর উৎসবে যে রকম ভীড় আর জাঁকজমক হয়, বাঙলাদেশে এই উৎসবে সেইরকমটি আর কোথাও হয় বলে শুনিনি। মুর্শিদাবাদের এই উৎসবটির সূত্রপাতে নাকি নবাব-নাজিমরাই ছিলেন। এখনও এর সঙ্গে তাঁদের বংশধরদের যোগসূত্র একেবারে ছিন্ন হয় নি। তবুও এটি এখন আর সুধু নবাববাড়ীর উৎসব নয়। অগণিত সাধারণ মানুষের স্বতস্ফুর্ত যোগদানে এটি একটি প্রকৃত লোকোৎসবে পরিণত য়েছে। আর শুধু মুসলমান সম্প্রদায়েরই লোক নয়, হিন্দুরাও ওতে দলে দলে যোগ দেয় সমান উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে।

দারুণ ভিড়

এই বিচিত্র লোকোৎসবে যে বৃহৎ জনসমাগম ঘটে তার পরিচয় পেয়েছি সেদিন মুর্শিদাবাদে যেতে ট্রেনে। নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর ষ্টেশন থেকেই সেদিন ট্রেণে মুর্শিদাবাদ-যাত্রীদের ভীড় হতে শুরু করেছিল। তারপর পলাশী, বেলডাঙ্গা, বহরমপুর প্রভৃতি ষ্টেশনের তো কথাই নেই। ষ্টেশনে ষ্টেশনে দেখেছি, লোক থই থই রছে। মেয়ে-পুরুষ, বুড়ো-বুড়ি, বাচ্চা- কাচ্চার দল গাদাগাদি 'য়ে ষ্টেশনে 'সে আছে ট্রেণে চড়ার অপেক্ষায়। উত্তরে লালগোলা, ভগবানগোলা, জিয়াগঞ্জ প্রভৃতি ষ্টেশনেরও একই অবস্থা। ট্রেণে তিল ধারণের জায়গা মেলে নাভীড়ের চাপে চিঁড়ে চ্যাপ্টা 'য়ে যাবার দাখিল। শুধু ট্রেণেই নয়, বহরমপুর, জিয়াগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে দলে দলে লোক এসেছে মুর্শিদাবাদে বাসে, ট্যাক্সিতে, সাইকেলরিক্সায়। পায়ে হাঁটাও বাদ যায় নি। আর নৌকো তো আছেই। জিয়াগঞ্জ, আজিমগঞ্জ, বহরমপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে সারাদিন নৌকোবোঝাই লোক এসে নেমেছে মুর্শিদাবাদের ঘাটে ঘাটে। এই সব নৌকোর মধ্যে অনেকে কাগজের মিনারে সেজে এ্যাসিটিলিন গ্যাসের আলোর ঝাড়, গেট নিয়ে এসেছে রাতের বেরা উৎসবের ভেলার সঙ্গে যাবার জন্যে। কোনও কোনও নৌকো আবার ডায়নামো চালিয়ে ইলেকট্রিক রঙ্গিন বাল্ব আর টিউব লাইটের আলোয় সেজে এসেছে। নিজামত কেল্লার উত্তর দরজা থেকে ওয়াসিফমঞ্জিল পর্যন্ত গঙ্গাতীরবর্তী রাস্তায় খাবার-দাবার, পুতুল-খেলনা, ঘর-গেরস্থালীর জিনিসপত্রের দোকানও বসে গেছে। মাত্র একটা রাতের মামলা। তবুও লোক আসার বিরাম নেই। তোপখানার ঘাট থেকে দক্ষিণে বরাবর গঙ্গার ধারে খালি মানুষের মাথা আর মাথা। আর সেই ভীড়ের চাপ সবচেয়ে বেশী হল রাত্রি এগারোটা নাগাদ, যখন নবাব বাড়ী থেকে ময়ূরপঙ্খীর মিছিল এল আর ভাগীরথীতে বেরা কেটে ভাসিয়ে দেওয়া হল। মুর্শিদাবাদে মহরমেও খুব ভীড় হয় কয়েকদিন ধরে বেরা ভাসানো একটি রাতের উৎসব। তাতে যে ভীড় হয়, তার চাপ বোধহয় মহরমের কদিনের ভীড়কে ডিঙিয়ে যায় সহজে নবাব-নাজিমদের আমলে -উৎসবের যে জৌলুস ছিল এখন তার হাজার অংশেরও একাংশ নেই। বাঙলা, বিহার, উড়িষ্যার সুবাদার ছিলেন তাঁরা। পরবর্তীকালে অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে ক্লাইভ আর তাঁর পরবর্তী ইংরেজ ধুরন্ধরদের প্যাচে নবাব-নাজিমদের গালভরা উপাধিটুকু ছাড়া আর বিশেষ কিছু ক্ষমতা ছিল না। ইংরেজের হাতের পুতুল হয়ে তাঁরা মসনদে উঠতেন আর সেখান থেকে নামতেন। ইংরেজের মঞ্জুরকরা নিজামতী বৃত্তি নিয়েই তাঁদের সন্তুষ্ট থাকতে হত। তবুও অনেক লাখ টাকা তাঁদের হাতে আসত। সুতরাং দরাজহাতে আমোদ-আহ্লাদে টাকা খরচের ইতিহাস যে তাঁরা রচনা করে যাবেন তাতে সন্দেহ কী। অবশ্য এঁদের মধ্যে কেউ কেউ প্রজাপুঞ্জের দিকেও কিছু সদয় দৃষ্টিপাতে অর্থব্যয়ও করে গেছেন। কিন্তু নবাব-নাজিমরা বিলাসব্যসনে এমন নাম কিনে গেছেন যে, লোকে আজও কারুর অমিতব্যয়িতা দেখলে বলেনবাবী করে টাকা ওড়াচ্ছেন উনি।এ-উৎসবের প্রবর্তক কে ? মুর্শিদাবাদের বেরা-উৎসবের প্রবর্তক কে -নিয়ে নানা মত। মুর্শিদাবাদের ইংরেজ সিভিল সার্জন মেজর জে. এইচ. টাল্ ওয়াশ্ তাঁর ১৯০২ সালে রচিত ' হিস্ট্রি অফ মুর্শিদাবাদ ডিষ্ট্রিক্ট-এর ১৩৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, মুর্শিদকুলী খাঁ এই উৎসব করতেন। তিনিই মুর্শিদাবাদে -উৎসবের প্রবর্তক কিনা ওয়ালশ্ কিন্তু সে-কথার উল্লেখ করেন নি। প্রাচীন মুসলমান ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন তাঁর সিয়র-উল্-মুতাখ্ খরীন্ গ্রন্থে লিখেছেন, সিরাজদ্দৌলা মুর্শিদাবাদে -উৎসবের সূত্রপাত করেছিলেন। ডক্টর জেমস্ ওয়াইজও মুসলমান ঐতিহাসিকের মন্তব্যের জোরে তাঁর রচিত 'দি ম্যাহমেডান্স্ অফ ইষ্টার্ণ বেঙ্গলের৩৯ পৃষ্ঠায় সিরাজকেই মুর্শিদাবাদের বেরা উৎসবের প্রবর্তক বলে উল্লেখ করেছেন। ['জার্নাল অফ দি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল', তৃতীয় খণ্ড, ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ] ভোলানাথ চন্দ্র ১৮৮৫ সালে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের যে বৃত্তান্ত রেখে গেছেন তাঁর 'দি ট্র্যাভেল্স্ অফ্ হিন্দু' নামক গ্রন্থে, তার ৮২ পৃষ্ঠায় তিনি মুর্শিদাবাদের বেরা-উৎসবের বিবরণে বলেছেন, সিরাজই মুর্শিদাবাদে এই উৎসবের প্রবর্তক।যদি মুর্শিদকুলী খাঁর আমলে মুর্শিদাবাদে এই উৎসব শুরু হয়ে থাকে তবে এই উৎসবের বয়স প্রায় আড়াইশো বছর হবে। আর সিরাজের আমলে শুরু হলে এর বয়স - দুয়েক বছর তো হবেই। মুর্শিদকুলী খাঁর আগে মুর্শিদাবাদের নাম যখন মুখসুদাবাদ ছিল, কে জানে, তখন থেকে হয়তো -উৎসব চলে আসছে।

সেকালের উৎসবের চেহারা

কিন্তু দুশো-আড়াইশো বছরের মধ্যে -উৎসবের জৌলুস অনেক কমে গেছে। নবাব-নাজিমদের আমলে লাখ লাখ টাকা খরচ ' -উৎসবে। আমির-ওমরাহ, ইয়ার-বক্সিদের নিয়ে তাঁদের খানাপিনা, নাচ-গান হৈ-হুল্লোড়ের আসর জমত। বেরা যখন ভাসিয়ে দেওয়া ' তখন তার সঙ্গে নৌকোয় নৌকোয় চলত বাইজীদের অবিরাম নাচ-গান। নিজামত কেল্লার ঠিক উল্টোদিকে ভাগীরথীর পশ্চিমপারে রোশনীবাগের রোশনাই-এর কথা পুরনো ইতিহাসের কেতাবে লেখা আছে। লক্ষ লক্ষ মোমবাতিতে, সেজের আলোয়, বেলোয়ারি ঝাড়-লণ্ঠনে তৈরি আলোর মিনারে, তোরণে রোশনীবাগ ঝলমল করে উঠত। সারারাত্রি ধরে পোড়ানো আতসবাজির আলোতে উদ্ভাসিত রাত্রি। আর তখন কি প্রকাণ্ড ভেলাই না তৈরি হত। ওয়াশ্ সাহেব তাঁর মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে [১৯০২ সালের কিছু আগে লেখা] যে ভেলাটির কথা লিখেছেন, সেটি ছিল চওড়ায় ১২৫ হাত অর্থাৎ ১৮৭ ফুট। ওয়াশ্ সাহেব যখন মুর্শিদাবাদে গিয়েছিলেন, তখন নবাব-নাজিমদের একেবারে 'ড়তি দশা। নামকো ওয়াস্তে যেটুকু ক্ষমতা ছিল তাও ইংরেজ শাসকরা কেড়ে নিয়েছেন। ফেরিদুনজাই মুর্শিদাবাদের শেষ নবাব-নাজিম। তারপরে সে উপাধি অদৃশ্য হয়ে শুধুনবাব-বাহাদুরেএসে ঠেকেছে। সুতরাং উৎসব বৈভবের মাত্রাও মে গেছে। নবাব-নাজিমদের মধ্যে মীরজাফরের ছেলে মুবারকউদ্দৌলার কথায় ওয়াশ সাহেব লিখেছেন, তিনি ইদ, বেরা, দেওয়ালী প্রভৃতি উৎসবে মুক্তহস্তে অর্থ ব্যয় 'রতেন। তিনি মসনদে ছিলেন খৃষ্টীয় ১৭৭০ সাল থেকে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত। উইলিয়ম হজেস্ খৃষ্টীয় ১৭৮০ থেকে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত ভারত ভ্রমণের যে বিবরণ রেখে গেছেন, তাঁরট্র্যাভেল্স্ অফ ইণ্ডিয়াতে' তার ৩৫ পৃষ্ঠাতে মুর্শিদাবাদের এই বেরা-উৎসবের বিবরণ আছে। মনে হয় তিনি মুবারকউদ্দৌলার বেরা-উৎসবই দেখেছিলেন।সেই প্রাচীন বিরাট উৎসবের ভগ্নাংশ এখন কোনও রকমে টিকে আছে। নিজামতী ব্যাণ্ডের বদলে এখন আধুনিক ভাড়া করা ব্যাণ্ড পার্টি আসে। নৌকো থেকে লাউডস্পীকারে রেকর্ড সঙ্গীতের কমপিটিসান চলে। খাজা খিজিরের জন্যে সিন্নি নিয়ে চারটি ময়ূরপঙ্খী আজও আসে নবাব-বাড়ী থেকে জুলুস 'রে। তার জুলুস নামটুকু আছে, কিন্তু আগেকার সেই জৌলুস আর নেই। সোনার পিদিম জ্বালানো সম্বন্ধে লোকে এখন ঘোর সন্দিহান। এখন যে বেরাটি ভাসানো হয় আকারেও সেটি অনেক ছোট হয়ে এসেছে। এখন লম্বায় আর চওড়ায় দুদিকেই সেটি ৩০ ফুটে এসে দাঁড়িয়েছে। রোশনীবাগে এখন ইলেকট্রিক আলোর একটা ছোটখাট গেট তৈরি করে তার রোশনাই-এর নামের পিত্তি রক্ষে হচ্ছে। আর তোপখানার ঘাটের সামনে যেখানে লোকের ভীড় সবচেয়ে বেশী, সেখানে একটাও আলো থাকে না। অন্য জায়গায় আলোর কথা তো দূরে। বাজীর দফাও এখন রফা হয়েছে। ঘন্টাখানেকও বাজী পোড়ে কি-না সন্দেহ।

একালের অতিথি আপ্যায়ন

তোপখানা থেকে সিকি মাইল দক্ষিণে ওয়াসিফ মঞ্জিলের সামনে বাঁধানো চাঁদনীতে একালের হোমরা চোমরার দল অর্থাৎ কিছু সরকারী অফিসার আর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসেন, ভাড়া করা ভেনেস্তা কাঠের চেয়ারে বসেন। গাচে, কার্পেট, পর্দা, ঝালর, সোনা-রূপোর আঁটাসোঁটা আতরদান, পানদান, গেলাস, থালা এখন গরহাজির। কালিয়া, পোলাও, কোপ্তা কাবাবের ২৯ দফার বদলে এখন শুধু কোল্ডড্রিঙ্ক, সিগারেট, পানের খিলি দিয়েই মানরক্ষের ব্যবস্থা। -কালের হোমরাচোমরার দল এই চাঁদনীতেই 'সে স্রোতের টানে দ্রুত চলমান বেরাটি আর বাজিপোড়ানো দেখেন। নামমাত্র গোটাকতক বাজি। তাও তোপখানার ঘাট থেকে বেরার যাত্রারম্ভে জ্বালানো হয় না। হোমরা-চোমরাদের দেখবার সুবিধের জন্যে বেরা চাঁদনীর কাছাকাছি ভেসে এলেই তবে সেগুলি জ্বালানো সুরু হয়। এখন মিনিট পনেরোর মধ্যে বেরার গায়ে আঁটা কদমঝাড়, ঝরণা, তুড়ি, রংমশাল নিঃশেষ 'য়ে যায়। কিন্তু এই সব বাজি থেকে উৎসারিত ক্ষণকালীন আলোর ঝরণায় স্নান করতে 'রতে দীপময় সেই অভিনব আলোকযান যখন অন্ধকার রাত্রে রূপের ঢেউ তুলে স্বপ্ন-লোকবিহারিণী সুন্দরীর মত ভাগীরথীর দ্রুত স্রোতের টানে দক্ষিণমুখে অদৃশ্য 'য়ে যায়, তখন মানুষ আজও মুগ্ধ না 'য়ে পারে না। 

শেষ পরিণতি

নিজামতী কেল্লা থেকে মাইল দুই-আড়াই দক্ষিণে আমিনাগঞ্জে যখন ভেলাখানি গিয়ে পৌঁছয় তখন তার মোমবাতি নিঃশেষ। অভ্রের ঘেরাটোপগুলো আগুনে পুড়ে কুৎসিৎ রূপ ধরেছে। ময়ূরের চূড়ো, ঝালর, নিশান স্খলিত। আর দুপাশ থেকে হিংস্র নেকড়ের মত একদল মানুষ সাঁতরে কিংবা নৌকোয় চড়ে এসে সেই ভেলাতে লুটপাট করে তার অবশিষ্ট যা-কিছু আভরণ উপকরণ থাকে সব খসিয়ে নেয়। কম বাঁশ লাগে না এই ভেলা তৈরীতে সেই বাঁশগুলোও তারা কাড়াকাড়ি 'রে নিয়ে যায়। [বাংলার লোক উৎসব লোকশিল্প'—বজ্রমিত্র, যুগান্তর, ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৬১] ঋন স্বীকার : মাননীয় অশোক মিত্র সম্পাদিতপশ্চিমবঙ্গের পূজাপার্বণ মেলা’ [দ্বিতীয় খণ্ড]

 



Read More

আমার সাইট টি বন্ধুদের মধ্যে শেয়ার করুন। এই রকমের ধারাবাহিক আপডেট পাওয়ার জন্য আমার ইউটিউব চেন্যালটি https://www.youtube.com/@librarianeduguide সাবসক্রাইব করুন।

 

কপিলামঙ্গল কাব্যের অনুরণনেসহরইবা বাঁদনা পরব

https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_78.html

রাক্ষসখালি তাম্রলিপি : ভূমিদান সংক্রান্ত দলিল

https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_32.html

বর্তমান সময়ে শরীরচর্চার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য

https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_46.html

মহিষাদল রামায়ণপুথির জননী এক রানি

https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_23.html

বাংলা প্রবন্ধ : মুসলিম ব্রতাচার :হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রেক্ষাপট

https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2023/12/blog-post_1.html

 

 

 

 

 

Post a Comment

0 Comments