বাংলা বিশিষ্ট কবির ব্যক্তিগত আত্মভাবনা ও বৈশিষ্ট্য : আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
কবি বিহারীলালের আত্মভাব—
কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর অবস্থান মধুসুদনের বিপরীতে। কবিতায় আত্মকথন কবি মাত্রেরই আকাঙিক্ষত হলেও মধুসূদনে কবি প্রতিভা মহাকাব্যের পরিসীমায় ব্যস্ত ছিল। মধুসূদনের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিভাস তাই পরোক্ষাবৃত। কিন্তু বিহারীলালে গীতিপ্রবণতার উচ্ছ্বলতায় করিব অতৃপ্ত বেদনাবোধ এবং অন্তরের কাতর অনুভূতিই তাঁর হৃদয়ের প্রেরণা এই অতৃপ্ত বেদনার সঠিক কারণটি যে ঠিক কি—তা সকলেরই অজানা। ফলে, কেউ বা তাঁকে ভাবেন মিষ্টিক, কেউ বা ঠাকুরবাড়ির নতুন বৌঠান কাদম্বিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর প্রেম সম্পর্কের উল্লেখ করে থাকেন। সে যাই হোক, তাঁর বিখ্যাত কাব্য সারদামঙ্গল'এ কবির প্রেরণা তাঁর আত্মগতভাব। একটি পত্রে তিনি বলেছেন যে ‘সারদামঙ্গল' রচনার প্রেক্ষাপটে আছে তিনটি বিরহজনিত উন্মত্তভাব যথা ‘মৈত্রী বিরহ, প্রীতি বিরহ এবং সরস্বতী বিরহ। কবির কথা অনুযায়ী অনুমান করা যায় যে এই কাব্য রচনার পশ্চাতে কোন ট্রাজিক কারুণ্য অবশ্যই বিদ্যমান— যদিও তার সবটাই অনুমান নির্ভর। তবে স্পন্দিত ব্যক্তিহৃদয়ের রোমান্টিক অনুভূতি এবং নিসর্গবীক্ষার সঙ্গে তার সংহতি সাধনই কবিকে প্রথম সার্থক গীতিকবিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, 'আধুনিক বঙ্গ সাহিত্যের এই প্রথম বোধ হয় কবির নিজের কথা ।’
তিনি আরও বহু কাব্য রচনা করেছেন যার মধ্যে আছে ‘অবোধবন্ধু', 'বন্ধুবিয়োগ', ‘সঙ্গীতশতক’, ‘নিসর্গসংগীত' ও 'সাধের আসন, তবে সারদামঙ্গলই তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ। ‘বন্ধুবিয়োগ ও প্রেমপ্রবাহিনী'-তে অন্তরকথার অনাবৃত প্রকাশ ঘটেছে সুরের মুন্সীয়ানায়। আবেদন কিছুটা আধ্যাত্মিক এবং বৈষ্ণব দর্শন ও শেলীর Alastor কাব্যের সঙ্গে বহিসাদৃশ্যযুক্ত। বস্তু প্রধান কাঠামোর মধ্যে নারী বন্দনার রোমান্টিক ভাবপ্রশস্তি আছে ‘বঙ্গসুন্দরী' কাব্যে এবং এর প্রেরণাস্থল হয়তো কোঁতের দর্শন।
‘বন্ধুবিয়োগ’ ও ‘প্রেমপ্রবাহিনী'র মতই সারদামঙ্গলও আত্মভাব সমন্বিত, তবে এটি তাঁর কাব্য প্রতিভার চুড়ান্ত প্রকাশ। কল্পনার মহিমান্বিত রূপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রহস্যময়তা এবং ধ্যানতন্ময়তা। সারদামঙ্গলে একটি আভাসিক কাহিনী আছে যা গীতিকবিতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কিন্তু Personal emotion ও Passion অর্থাৎ ব্যক্তিগত অনুভূতি ও ভাববলয় যা গীতিকবিতার প্রধান অঙ্গ, তা সম্পূর্ণভাবেই এই কাব্যে বিরাজমান। কাব্যে কবি নায়কের ভূমিকায় এবং নায়িকা সারদা। এ সারদা সৌন্দর্যময়ী, চিন্ময়ী প্রেমিকা, মূর্তিমতী করুণা। তিনি সরস্বতী রূপে কখনও জননী, কখনও প্রেয়সী, কখনও বা কন্যা। আসলে Spirit of Beauty | এটাই সারদা তত্ত্ব, কিছুটা রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতার যত মিষ্টিক কবি কল্পনা যা আধ্যাত্মিকতার মোড়কে উপস্থাপিত। কিন্তু কাব্যের মধ্যে কবির বেদনা হাহাকার মর্মযন্ত্রণা, মর্মভেদী আকর্ষণ এসব এতই প্রাধান্য পেয়েছে যে সারদাকে দেবী বলে ভাবতে মন বিমুখ হয়। কবি ও সারদা যেন রোমান্টিক জুটি -- রোমিও- জুলিয়েট বা লায়লা-মজনু, মন্দাকিনীর তীরে দুপারে দুজনা। সারদাকে কাছে না পেয়ে কবির ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে আত্ম জিজ্ঞাসায়, “তবে কি সকলি ভুল!/ নাই কি প্রেমের মূল!/ বিচিত্র গগনফুল কল্পনা লতার ?” কিন্তু ভুল বুঝতেও সময় লাগে না। চতুর্থ সর্গে তিনি ফিরে যান নিসর্গ প্রকৃতির কাছে, সেখানে সারদার প্রতিভাস খুঁজে পেয়ে আশ্বস্ত হন।
সারদা দেবী কি মানবী সে আলোচনা এখানে নিরর্থক। তবে সারদা মঙ্গলে নায়ক রূপী কবির আত্মভাবের স্বরূপ বিশিষ্টতায় উন্মোচিত। গীতি কবিতার কাব্য শৈলীর পরিপূর্ণ আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এই কাব্যে। বন্ধু বিয়োগে আত্মকথন আছে, ‘সাধের আসন'-এ কবি কৃত্য আছে, কিন্তু সারদামঙ্গলে আত্মভাব প্রকাশের লিরিক শৈলী আর কোথাও নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ভোরের পাখী বলেছিলেন। অন্তত, গীতিকবিতার ক্ষেত্রে তিনি ভোরের পাখী বটেই। ডঃ শশীভূষণ দাসগুপ্তের মন্তব্যটি বিহারীলালের 'আত্মভাব'-এর পক্ষে খুবই প্রণিধানযোগ্য। “নিখিলের সমস্ত সৌন্দর্য মথিত করিয়া কবি তাঁহার কল্পলোকে যে একটি বাসনার প্রেয়সী মূর্তি সৃজন করেন, সে এ জগতের কেহই নহে। কিন্তু সেই আবার জগতের অনুপরমাণুতে মিশিয়া আছে। বাস্তব প্রিয়ার স্পর্শের ভিতর কবি খুঁজিয়াছেন সেই কল্পলোকের মানস সুন্দরীর স্পর্শ, প্রকৃতির সকল বর্ণ গন্ধ ও গানের ভিতরে কবি খুঁজিয়াছেন তাঁহারই মানস সুন্দরীর আভাস, সকল সুখে দুঃখে আশা আকাঙক্ষায় সেই মানস সুন্দরীর হাস্যময়ী মূর্তিখানি দূর দূরান্তর হইতে আভাসে ইঙ্গিতে তাহারই একটুখানি মধুময় স্পর্শ কবিকে পাগল করিয়া রাখিয়াছে। জীবনের সকল ছন্দে গানে কবি সেই মানস সুন্দরীর পূজা করিয়াছেন।”
রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতা
“যিনি আমার সমস্ত ভালোমন্দ, আমার সমস্ত প্রতিকুল ও অনুকুল উপকরণ লইয়া আমার জীবনকে রচনা করিয়া চলিয়াছেন, তাঁহাকেই আমার কাব্যে জীবন দেবতা নাম দিয়াছি। তিনি যে কেবল আমার এই ইহজীবনের সমস্ত খণ্ডতাকে ঐক্যদান করিয়া বিশ্বের সহিত তাহার সামঞ্জস্য বিধান করিতেছেন, আমি তাহা মনে করি না। আমি জানি অনাদিকাল হইতে বিচিত্র বিস্মৃত অবস্থার মধ্য দিয়া তিনি আমাকে আমার এই বর্তমান প্রকাশের মধ্যে উপনীত করিয়াছেন”। (বঙ্গভাষার লেখক)
জীবন দেবতার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র আরও বলেছেন যে জীবনদেবতাকে অবলম্বন করেই জগতের অস্তিত্বধারার বৃহৎ স্মৃতি তাঁর মধ্যে বর্তমান, ফলে বস্তু জগতের সব কিছুর সঙ্গে ঐক্য অনুভব করেন। রবীন্দ্রনাথ যাকে জীবন দেবতা বলেছেন, তাঁর বিচিত্র রূপের কথা স্মরণ করে প্রভাত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “তিনি কখনও তাঁহার প্রেয়সী, মর্গের গেহিনী, মানস স্বরুপিনী, কখনও বা অনির্বচনীয় জীবন দেবতা”। প্রশান্ত মহলানবিশ একে ঠিক কবির innerself বলতে রাজি নন, তাঁর মতে জীবনদেবতার অভিব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে Personal।
শেলীর কাছে যা ‘spirit of beauty', ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাছে যা ‘7. motion and a spirit that impels/
All thinking things, all objects of all thought/ And rolls through all things',
বিহারীলালের সারদামঙ্গলে যে সুন্দরী কুহকিনী, রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতাও সেই অপরিচিতা লীলাসঙ্গিনী, তাঁর মানস জগতের নিয়ন্ত্রা, তাঁর কাব্যের প্রেরণাদায়িনী শক্তি। মোহিত সেনের মতে এই শক্তি কখনই বিশ্বদেবতা নয়, কারণ এর দ্বারা কবির আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভোগের যথার্থতা প্রতিপাদন হয় না। অজিতকুমার চক্রবর্তী জীবনদেবতার স্বরূপকে কবির বিশ্ববোধ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে এই শক্তি যেমন কবির জীবনকে খণ্ড হতে অখণ্ডে উদ্ভাসিত করে তুলেছেন, তেমনি সেই শক্তি তাঁর কাব্যে উপস্থিতের সঙ্গে চিরন্তনের, ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্বের সংযোগ স্থাপন করেছেন। প্রমথনাথ বিশী-রবীন্দ্র কাব্য প্রবাহে জীবনদেবতাকে ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্বের সামঞ্জস্য সেতু রূপে চিহ্নিত করেছেন। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘রবিরশ্মি’তে জীবন দেবতার সঙ্গে ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘Screne and the blessed mood' এর এবং দার্শনিক ফেকনারের ব্যক্তি চৈতন্যাতীত মহাচৈতন্যের এবং H.G. Wells বর্ণিত the Driver of the Machine man এর তুলনা করেছেন। সুকুমার সেন বলেছেন যে জীবনদেবতা হল সেই ডিভিনিটি যা মানবাত্মাকে চাওয়া-পাওয়ার পথে প্রলুব্ধ করে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।
রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতার সঙ্গে বার্নার্ডশ-র Life force এর কিছু প্রভেদ আছে। বার্নার্ডশ’র Life force তত্ত্ব হল God in man-a dynamic impulse or the
will of God । এই তত্ত্ব ডারউইনের natural selection এবং ল্যামার্কের Survival of the fittest তত্ত্বের বিরোধী বলে অনেকেই Life force কে fantastic, imaginative and
semimystical বলেছেন। শ এর মতে Life force হল সেই শক্তি যা Creative evolution এর মাধ্যমে Super human তৈরি করে। বার্নার্ডশ-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতার সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য দুইই আছে। বার্নার্ড শ মনে করেন জন্মান্তরের মাধ্যমে সুপারম্যান সুন্দর প্রজন্ম সৃষ্টি করবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ জন্মান্তরের এই ফাকটুকু রাখেননি। জীবাত্মা বা ছোট আমির সঙ্গে পরমাত্মা বা বড় আমির মিলনেই সুপারম্যান সম্ভব হয়। দুজনের তত্ত্বের মূল কেন্দ্র বিন্দু এক, তবে রবীন্দ্রনাথ উপনিষদীয় পরাজ্ঞানে আবিষ্ট বলেই জীবন দেবতাকে তার লীলা সঙ্গিনী রূপে দেখেছেন।
‘সীমার মাঝে অসীম তুমি/ বাজাও আপন সুর/ তোমার মধ্যে আমার প্রকাশ/ তাই এত মধুর?
সোনারতরী কাব্যে কবির জীবন দেবতা কখনও সৌন্দর্যময়ী দেবী, কখনও বা রহস্যময়ী প্রেমিকা, কখনওবা কবিতা কল্পনালতা। সোনারতরী কবিতার যে মাঝি, মানস সুন্দরীতে সেই ‘জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। খেলার সঙ্গিনী হয়ে উঠল মর্মের গেহিনী, আবার নিরুদ্দেশ যাত্রায় অধিষ্ঠাত্রী দেবী হয়ে ওঠে রহস্যময়ী প্রেমিকা— শুধু হাসে, কথা বলে না। কবি জীবনদেবতার লীলা অনুভব করছেন প্রকৃতির মধ্যে, এই প্রকৃতি বিশ্বব্যাপী। ডঃ রামজীবন আচার্য ‘রবিতীর্থে সোনারতরী' আলোচনায় বলেছেন, শৈবালে শাদ্বলে তৃণে শাখায় বল্কলে পত্রে পূর্ণ পুষ্পদলে, তরঙ্গিত মহাসিন্ধু নীরে, সুদুর্গম মরু দেশে, হিমানী সমাবৃতমালায়, গহন অরণ্যভূমিতে, সাধারণ ধীবর পল্লীতে, আরব-তিব্বত-পারস্য জাপান ও চীনের মানুষের মাঝে রবীন্দ্রনাথ লাভ করলেন বিশ্ব সৌন্দর্যবোধ, শ্বের সঙ্গে ঐক্যানুভূতি — উপলব্ধি করলেন জীবনদেবতার লীলা। প্রকৃতিপ্রীতির সঙ্গে রোমান্টিক সৌন্দর্যবোধ ‘বসুন্ধরা' কবিতায় যেমন, তেমনই আছে 'সমুদ্রের প্রতি' কবিতায়। কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার এই দুই কবিতার সঙ্গে
‘অহল্যার প্রতি’ কবিতাটিকেও একইভাবধারার প্রকাশ বলে অভিহিত করেছেন। জড় জগতের মধ্যে চৈতন্যের বন্দনায় ডারউইনের Theory of Evolution অস্বীকৃত না হলেও গুরুত্ব পায় নি, গুরুত্ব পেয়েছে সাংখ্য দর্শন যেখানে পুরুষ মাত্রেই নিস্ক্রিয়া এবং প্রকৃতি সর্বঘটনার নিয়ামক।
প্রকৃতি যেমন ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাছে Friend, Philosopher and guide, রবীন্দ্রনাথের জীবদেবতাও তাই। রহস্যময়ী জীবনদেবতার পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ ঘটেছে “চিত্রা' কাব্যে, যদিও ‘সোনারতরী’তে তার পদধ্বনির আভাস পাওয়া যায়। অবশ্য নীহাররঞ্জন রায় ‘রবীন্দ্রসাহিত্যের ভূমিকা' গ্রন্থে সন্ধ্যাসঙ্গীতের নিসর্গ-অনুভূতির কথা বলেছেন যা পরবর্তীকালে চিত্রা, চৈতালী ও কল্পনায় জীবনদেবতার ভাবরহস্যে নিবিড় হয়ে উঠেছে।
‘চিত্রা’র অন্তর্যামী, সাধনা, জীবনদেবতা, সিন্ধু পারে, শেষ উপহার প্রভৃতি কবিতাগুলিতে জীবনদেবতার ধারণা খুবই স্পষ্ট। ‘প্রেমের অভিষেক' কবিতায় জীবনদেবতা ‘মহীয়সী মহারাণী'। যাকে কবি বলেন, “তুমি মোরে করেছ সম্রাট । ‘সাধনা' কবিতাতে তিনি দেবী যিনি সমস্ত ব্যর্থতাকে সার্থক করে তোলেন, তিনি বর্তমানকে চিরন্তনের মধ্যে, ব্যক্তিগতকে বিশ্ববোধের মধ্যে, খণ্ডকে, অখণ্ডের মধ্যে এগিয়ে নিয়ে যান। “তুমি যদি, দেবী, লহ কর পাতি/ আপনার হাতে রাখ মালা গাঁথি/ নিত্য নবীন রবে দিনরাতি সুবাসে ভাসি;/সফল করিবে জীবন আমার বিফল বাসনারাশি।”
এই জীবনদেবতাই ‘চিত্রা' কবিতায় ‘চঞলগামিনী ও বিচিত্র রূপিণী', অন্তর মাঝে তিনিই আবার ‘অন্তর ব্যাপিনী' এবং নিসর্গলোকে ‘প্রশান্ত হাসিনী’। ‘অন্তর্যামী' কবিতায় জীবনদেবতা সম্পর্কে কবি বলেছেন,
“অন্তর মাঝে বসি অহরহ/ মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ/ মিশায়ে আপন সুরে।”
এখানে জীবনদেবতা সক্রিয় হয়ে কবিকে যেন নিস্ক্রিয় করে দিয়েছে। কবি যেন যন্ত্র এবং জীবনদেবতা যন্ত্রী। দক্ষ বাজীকরের মত জীবন দেবতা যেন কবিকে পরিচালিত করেন।
‘জীবনদেবতা' কবিতায় জীবনদেবতা যে বিশ্বদেবতা নয় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কবির হাসি কান্না, সুখ-দুঃখ, জন্ম-জন্মান্তর এই জীবনদেবতাই যেন একসূত্রে বেঁধে দিয়েছেন। জীবনদেবতার তিনি যেন নায়িকা, কবিতার প্রারম্ভেই প্রশ্ন রেখেছেন “মিটেছে কি সকল তিয়াস আসি অন্তরে মম'? এই কবিতা সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর বক্তব্যটি খুবই প্রণিধান যোগ্য। তাঁর মতে জীবনদেবতা মানবী, প্রকৃতি বা কবিতা যাই হন না কেন, তিনি যেন অন্তরতম এই দেবতার বিবাহিতা বধু। এই একটি চিত্রকল্পই কবিতাটির মূল হতে শেষপর্যন্ত বিস্তৃত যার প্রতি পংক্তিতে আছে আদর্শ হিন্দু নারীর কণ্ঠস্বর।
কবিতাটির শেষের দুটি লাইন 'নূতন করিয়া লহো আর বার চিরপুরাতন মোরে/ নূতন বিবাহে বাঁধিবে আমায় নবীন জীবন ডোরে”- ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে বিবাহ অনুষ্ঠানটি রূপক। এর অর্থ হল চির পুরাতনের সঙ্গে নবীন আনন্দের মিলন। বিশ্বভারতীয় এক পত্রে (শ্রাবণ ১৩৪৯) রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমার দ্বারা যা কিছু হওয়া সম্ভব সব যদি শেষ করে থাক, এখন যদি তোমার আঘাতে আমার এ বীণা আর না বেজে ওঠে, তোমার ইঙ্গিতমাত্রে আমার মনো অশ্ব আর ছুটতে না পারে, তবে এই জীর্ণতা
অসারতা ভেঙে চুরে ফেলে আবার আমাকে নূতন রূপ নূতন প্রাণ দাও, নূতন লোকের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আমাদের অনাদিকালের বিবাহ বন্ধন-নবীকৃত করে দাও।”
‘সিন্ধুপারে’ কবিতাটি ড্রিম অ্যালোরির প্রভাব জাত। পরিবেশ স্বপ্নিল। ঠিক যেন চসারের 'The House of Fame'-এর মতই। যেন স্বপ্নের মধ্য দিয়ে কবি ছুটে চলেছেন অবগুণ্ঠনে ঢাকা রমণী মূর্তির পিছনে, কত মাঠ, কত পথ, কত প্রাসাদ পার হয়ে সিন্ধু পুলিনে কৃষ্ণ গুহায় কবি প্রবে। *রলেন। সেখানে বিবাহ বাসরে কবি অবগুষ্ঠনাবৃতার সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হলেন। এর পরে বাসর সজ্জায় অবগুণ্ঠন উন্মোচিতা রমণীকে দেখে কবি চমকে উঠলেন। ‘এখানেও তুমি জীবন দেবতা'।
“সেই মধুমুখ, সেই মৃদু হাসি, সেই সুধা ভরা আঁখি চির দিন মোরে হাসালো কাঁদালো, চিরদিন দিল ফাঁকি। খেলা করিয়াছে নিশিদিন মোর সব সুখে সব দুঃখে,
এ অজানাপুরে দেখা দিল পুন সেই পরিচিত মুখে।
এ কবিতায় জীবনদেবতা প্রেয়সী নারী, কবির অনুপ্রেরণা— নতুনের বেশে চির পুরাতন। এখানেও বিবাহ বন্ধন বিষয়টি রূপকাবৃত। এর অর্থ হল অন্তরে নব উন্মেষশালিনী প্রতিভার উন্মোচন। কবি এক নতুন উপলব্ধির দ্বারে সমাগত। নতুন বোধের ইঙ্গিতময়ী প্রেরণা রূপেই যেন এখানে জীবন দেবতার আবির্ভাব। জীবন দেবতা মূলতঃ কবি প্রতিভার ঐশ্বর্যের প্রতীক। রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা সম্পর্কে বিতর্কের শেষ নেই। এ বিষয়ে নানা সমালোচকের উক্তিও বিভিন্ন রকমের। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ এর একটা সহজ উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন “আমার সুদীর্ঘকালের কবিতা লেখার ধারাটাকে পশ্চাৎ ফিরিয়া যখন দেখি, তখন ইহা স্পষ্ট দেখিতে পাই— এ একটা ব্যাপার যাহার উপরে আমার কোন কর্তৃত্ব ছিল না। তাহাদের রচয়িতার মধ্যে আর একজন রচনাকারী আছেন।” এই রচনাকারী কি ঈশ্বর অথবা সরস্বতী "অথবা থীয়িস্টিক ধারণার মত একটি কিছু—এ নিয়ে যে বিতর্ক জমে ওঠে তার নিরসন কল্পে রবীন্দ্রনাথ অনেক পরে বলেছিলেন যে জীবন দেবতা কোন ঈশ্বর বা দেবতা নয়। এটি তাঁর যুগ্মসত্তা—একটার মধ্যে আছে আদর্শের প্রেরণার প্রকাশ এবং অন্য সত্তাটি কর্মযোগে নিযুক্ত। তবু বিতর্ক আছেই। যারা অত্যন্ত প্রগতিশীল তারা যুগ্ম সত্তাকে মেনে নিলেও জীবনদেবতার সঙ্গে জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্কটাকে অতীন্দ্রিয়দের বুজরুকি বলে মনে করেন। চিত্রা কাব্যের ‘জীবন দেবতা' কবিতায় পতঞ্জলির পুরুষ প্রকৃতিতত্ত্ব অর্ধনারীশ্বর রূপে বিরাজিত। পুরুষ শিব Potential energy নিষ্ক্রিয় ভূতলে শয়ান, আর তার বুকের উপর নিয়ন্ত্রী রূপিণী মহাকালী— প্রকৃতিরূপা (Kinetic energy)। রবীন্দ্রনাথের এ তত্ত্বকেও অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। এমন কি শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ও নয়। 'সিন্ধু পারে' কবিতা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘প্রেত বিভীষিকাময় অপ্রাকৃত কল্পনা', এর পরিণতি ‘অবাঞ্ছিত ভৌতিক এবং আরব্য উপন্যাসের স্থূল ইন্দ্ৰজালময় ভাবাবহ'। আসলে রবীন্দ্রনাথের পূর্বে এ তত্ত্বের কোন পূর্বসূরী নেই, নেই কোন দৃষ্টান্ত। যুগ যুগান্তর এবং জন্ম জন্মান্তর ব্যপী যুগ্ম সত্তার লীলাকে বোঝানোর জন্যই ড্রিম অ্যালেগরি সুলভ অন্ধকারময় অবাস্তবতার পরিবেশ গড়ে তুলতে হয়েছে। প্লেটোর Eternal ideal এবং হেগেলের Absolute ideal ই রবীন্দ্রনাথের অন্তর্যামী কবিতার ভাববলয়।
নজরুলস্বদেশপ্রেম –
রোমান্টিকতা এবং বিশ্ববোধে নজরুল এক স্বতন্ত্র সত্তা রোমান্টিকতা কবিসত্তার প্রাণধর্ম। রোমান্টিকতার অর্থ যদি কল্পনা হয়, তবে সেই কল্পনাকে বাদ দিয়ে কবিতা রচনা—কোনদিনই সম্ভব নয়। ইংরাজী সাহিত্যে পঞ্চ রোমান্টিক কবির পুরোধা ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ। ফরাসী বিপ্লবের দ্বারা প্রায় সকলেই কিছুটা আন্দোলিত হলেও বিপ্লবের প্রত্যক্ষ আঁচ লেগেছিল ওয়ার্ডসওয়ার্থের গায়ে। ফরাসী বিপ্লবের অন্যতম চিন্তানায়ক ছিলেন রুশো যাঁর প্রকৃতিবাদ ও মানবতন্ত্রী চিন্তাভাবনা বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার রূপকার। প্রকৃতির কাছে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থাপত্র তিনিই রোমান্টিক কবিদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। Harder, Schiller, Goethe, Voltaire, মাস পেইন-এর Right of man গ্রন্থ এবং কাণ্ট হতে হেগেল পর্যন্ত জার্মান দার্শনিকদের Transcendentalism এসবই ছিল রোমান্টিক পঞ্চ কবির কাব্যিক প্রেরণা। এই কবিদের মূল লক্ষ্য হল ব্যক্তিবিশেষের প্রতিভার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে অনন্ত বৈচিত্রময়ী স্বপ্ন ও কল্পনার রোমান্টিক মূৰ্চ্ছনায় অবহেলিত জনমানসের চেতনাস্তরকে উদ্বোধিত করা এই চেতনাবোধ আত্মার মুক্তির, ঐতিহাসিক চেতনার এবং ধনী দরিদ্র ভেদে মানব সত্তার এক অখন্ড রূপকল্পনার চেতনা। এই অর্থেই তাঁরা বিদ্রোহী এবং ক্লাসিসিজম্ ও নিওক্লাসিসিজমের ঐতিহ্য বিরোধী।
বাংলা কাব্যেও কবিতায় রোমান্টিকতা যে ছিল না তা নয়। চর্যাপদে এবং বৈষ্ণব পদাবলীতে যে রোমান্টিকতার স্ফূরণ ঘটেছে তা মূলতঃ ধর্মাশ্রিত যার মধ্যে স্থান পেয়েছে প্রেম ও প্রকৃতি চেতনা, অধ্যাত্মবাদ ও সঙ্গীতধর্মীতা। আধুনিক বাংলা কাব্য কবিতায় রোমান্টিকতা মূলতঃ ইংরাজী সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত। ইংরাজী সাহিত্যের রোমান্টিক কবিরা বিরাটত্বের কল্পনায় বা অসীমকে না পাওয়ায় যে বেদনা অনুভব করেছেন বাংলা সাহিত্যে তা পরাধীন জাতির দেশাত্মবোধের প্রেরণায় পর্যবসিত হয়েছে। নবীনচন্দ্র, হেমচন্দ্রে যা সঙ্কীর্ণ, নজরুলে সেটাই বিরাট। দেশ-কাল ও সামাজিক বিন্যাস জাত অতৃপ্তি রোমান্টিক কবিকে বিচলিত করে। তাঁরা তাঁদের রচনায় সেই কাল ও যুগের সমস্যাকে তুলে ধরেন, সব কিছুকে ধ্বংস করে নতুন সৃজনের স্বপ্ন দেখান। নজরুল সেই অর্থেই স্বপ্নচারী, সাম্যবাদী এবং বিদ্রোহী – এবং সবকিছু মিলিয়ে তিনি একজন রোমান্টিক।
ফরাসী বিপ্লবের আদর্শ ও স্বপ্ন বিলুপ্ত হয়েছে, ঘটে গেছে ১৯৭২-এর সেপ্টেম্বর ম্যাসাকার, ফ্রান্স আক্রমন করেছে ইংল্যান্ডকে। ওয়ার্ডসওয়ার্থের মোহ ভঙ্গ হয়। তিনি ফিরে গেলেন প্রকৃতির মধ্যে। কোলরিজের মনে হল মানুষের দুঃখ কষ্টের বুঝি কোনদিনই সমাধান হবে না, 'Such sorrows as will never Cease' সুতরাং 'I only ask for Peace'। মোহভঙ্গের বিষাদ যোগে দুই বরিষ্ট কবিই নিমজ্জমান। এই বিষাদ তাঁদের রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে। স্বাধীনতা স্বপ্ন, কিন্তু তা যে স্বপ্নের মতই অধরা থেকে যায়। বিষাদ নজরুলের জীবনে এসেছে, কারান্তরালে অন্তরীনও হয়েছেন। বিষাদকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আবার লেখনী তুলে নিয়েছেন, কামনা করেছেন ‘যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ'। ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং কোলরিজের সঙ্গে এখানেই নজরুলের তফাৎ।
সেদিক থেকে অনেকটাই মিল আছে শৈলীর সঙ্গে। উনিশ কর বয়সে 'The necessity of Atheism' লিখে অক্সফোর্ড হতে বিতাড়িত হল যে তরুণ, তিনিই পরবর্তী কালে মানবাত্মার মুক্তি কামনায় লিখেছেন Prometheus unbound যা প্রেম, বিশ্বাস, শুভবুদ্ধি, আশা, স্বাধীনতা প্রভৃতি মানবীয় গুণের প্রতীক হয়ে উঠেছে। প্রমেথিয়াস আসলে শেলীর দ্বিতীয় সত্তা। নজরুল কোন দ্বিতীয় সত্তা গ্রহণ করেন নি, যা বলেছেন সরাসরি তিনি নিজেই যেন প্রমেথিয়াস।
“আমি-সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,/আমি অবসান, নিশাবসান/ আমি ইন্দ্রানী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য/মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী/আর হাতে রণতুর্য?”
তাঁর স্বদেশ ব্রিটিশ পদানত। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে তিনি ঘোষণা করলেন, “প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায়/ তেত্রিশকোটি মুখের গ্রাস/ যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ”। যুব সমাজকে উদ্দীপ্ত করে বলেছেন, “কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট/রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী”। বিপ্লবের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি বলেন, “নবীন মন্ত্রে দানিতে দীক্ষা আসিতেছে ফাল্গুনী/ জাগোরে জোয়ান। ঘুমায়ো না ভুয়ো শান্তির বাণী শুনি”। দেশ-বলতে-শুধু- প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে বোঝায় না, বোঝায় দেশবাসীকে। শ্রেণী বৈষম্য দূর করে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠায় তিনি বলেন,
“গাহি সাম্যের গান-/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান” অন্যত্র আরও বলেছেন “জনগণে যারা জোঁক-সম শোষে তারে মহাজন কয়/ সন্তান সম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়”। আসলে দেশকে ভালবেসে তিনি দেশের মানুষকে ভাল বেসেছেন। এ বিষয়ে তিনি শেলীর সমগোত্রীয়। শেলী এঁদের বলেছেন “Leech-like to their fainting
cling". Song to the man of England" কবিতাতেও এই একই প্রতিধ্বনি বর্তমান।
দেশকে ভালবাসা, দেশবাসীকে অখণ্ড মানবতা বোধের চেতনায় উদ্দীপ্ত করা রোমান্টিক কবির ধর্ম। হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মিলিত প্রচেষ্টায় এই স্বপ্ন সার্থক এই বোধ থেকেই তিনি এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলন সেতু রচনায় হতে পারে প্রয়াসী হয়েছিলেন। একে অপরকে গ্রাস করে নেবে তা তিনি চাননি। সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছেন,
-
“জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছ জুয়া ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়কো মোয়া হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতেই জাতির জান তাই তো বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশ' খান।”
কবি বায়রণের সঙ্গে নজরুলের প্রতিভার সাদৃশ্য হল চাক্ষুষ দর্শন। বায়রন সম্পর্কে কীটস্ এই কথাই বলেছিলেন যে ‘He describes what he sees'। নজরুলের ক্ষেত্রেও তাই। তিনি যা দেখেছেন তাই লিখেছেন। ‘হেরিনু জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ’ বা ‘সে দিন দেখিনু রেলে / কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নীচে ফেলে'। নজরুল রবীন্দ্র যুগের কবি। তাঁর সামনেই বর্তমান ছিলেন যুগস্রষ্টা রোমান্টিক কবিসত্তা যাঁর রোমান্টিকতা সৌন্দর্য চেতনার মধ্য দিয়ে ইন্দ্রিয় চেতনার বাইরে মহাচৈতন্যের পথে প্রসারিত। তাঁর বিশ্বানুভূতি ও মানবতা বোধের স্ফূরণ সর্বগ্রাসী প্রতিভার যে স্তরে উন্নীত হয়েছিল, নজরুলের পক্ষে তার নাগাল পাওয়া সম্ভব ছিল না। প্রকৃতি চেতনায় তিনি তাই সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুগামী। প্রকৃতি তাঁর কাছে friend-philosopher-guide বা Teacher নয়, অথবা শেলী যেমন বলেন Destroyer or Preserver ও নয়, তিনি বায়রণের মতই প্রকৃতির সান্নিধ্যে গিয়েও ফিরে আসেন মগ্ন হতে পারেন না। তবে প্রেম চেতনায় কবি সৌন্দর্যের পুজারী ও সাধক। অনির্বান রায়চৌধুরীর মতে তাঁর নবজীবনের গান যেন যৌবনবতী প্রিয়ার দান। “হে চির কিশোরী, চির যৌবনা, তোমার রূপের ধ্যানে / জাগে সুদর রূপের তৃষ্ণা নিত্য আমার প্রাণে।” নারীকে তিনি মনে করেন প্রেরণাদায়িনী, তাপস কুমারী বা পূজারিনী। কবির প্রেমিক মন সুন্দর ও বেদনার পূদাবী। কবি যৌবনের জয়গানে বারবার জন্ম গ্রহন করতে চান। ‘গ্রহ হতে গ্রহান্তরে লয়ে যায় মোরে / বাসনার বিপুল আগ্রহে / জন্ম লভি লোকে লোকান্তরে/ সুশীল কুমার গুপ্তের মতে কবির প্রেমের আবির্ভাব দেহকেন্দ্রিক ও তীব্র জ্বালাময়, বেদনা মধুর এবং আবেগ স্পন্দিত। তাঁর এই প্রেমচেতনায় স্পন্দিত কাব্যগুলির নাম দোলনচাঁপা, ছায়ানট, সিন্ধুহিন্দোল, চক্রবাক, সুরসাকি ও চোখের চাতক ।
আসলে যে রোমান্টিকতা মিষ্টিসিজম এর পর্যায়ে চলে যায়, বা রোমান্টিক কল্পনার স্বপ্নচারিতা পর্নগ্রাফী বা অ্যাবসার্ডিটির পর্যায় ভূক্ত হয়, নজরুল সে ধরনের রোমান্টিক কবি নন। যে রোমান্টিকতা কল্পনাশক্তির সাহায্যে এমন একটি নতুন জগৎ গড়ে তুলতে চায় যেখানে শোষণ বা অসাম্য থাকবে না, জাতের নামে বজ্জাতি থাকবে না, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে আকাশ আচ্ছন্ন থাকবে না, মানব চেতনা উন্মেষে কোন বাধা থাকবে না, নজরুল সেই রোমান্টিকতায় আপ্লুত। তিনি রোমান্টিক এই কারণে যে তিনি একটি সর্বপ্রকারের শোষণ মুক্ত স্বাধীন জগতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ভারত বিধাতা' কবিতায় বলেছেন,
“অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত শুনি তব উদার বাণী / হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন পারসিক মুসলমান খৃষ্টানী
পূরব পশ্চিম হতে আসে তব সিংহাসন পাশে / প্রেমহার হয় গাঁথা”
বিশ্ববোধের পাদপ্রদীপের তলায় কবির এই বাণীকে নজরুলও তাঁর সাহিত্যে গ্রহণ করেছেন। হিন্দুধর্ম ও ইসলাম ধর্ম, উভয় সম্প্রদায়ের সাহিত্য সভ্যতা, সংস্কৃতি ও দর্শনকে
দেশাত্মবোধ ও স্বাধীনতা চিন্তায় তিনি উৎসর্গ করেছেন। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বাঙালীর সংস্কৃতি চিন্তার মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। তিনি সকল সম্প্রদায়ের সকল মানুষের ব্যথা বেদনার শরীক। তাদের সমস্যাকে সহানুভূতির মলয়বাতাসে স্নিগ্ধ করেছেন। সে কারনেই তিনি বলেছেন,
“জগৎ জুড়িয়া আছে এক জাতি সে জাতির নাম মানুষ জাতি একই পৃথিবীর স্তন্যে লালিত, একই রবি শশী মোদের সাথী।”
যতীন্দ্রনাথের দুঃখবাদ
যে প্রেমচেতনা রোমান্টিকতার এক অপরিহার্য অঙ্গরূপে কবিতার আকাশে বাতাসে পাক খেয়েছে, বিচিত্রবর্ণের রামধনু সৃজন করেছে, যে প্রেমচেতনা কবিগুরুর ‘সোনারতরী’ হতে উৎসারিত হয়ে সৌন্দর্যতত্ত্বের মধ্যে দিয়ে ইন্দ্ৰিয়াতীত চৈতন্যলোকে উত্তীর্ণ, রবীন্দ্র সমসাময়িক যুগে যতীন্দ্র নাথ সেনগুপ্ত স্বকীয়, স্বাতন্ত্র্যে ঘোষণা করলেন,“প্রেম বলে কিছু নাই/চেতনা আমার জড়ে মিশাইলে/ সব সমাধান পাই।” মানবচৈতন্যের যাবতীয় ভাব যা প্রজন্মের পর প্রজন্মের উত্তরাধিকার, যাবতীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধ যা সংস্কৃতি পরম্পরায় প্রাপ্ত, সম্প্রদায় নির্বিশেষে ভগবৎপ্রেম, অধ্যাত্মবাদ সম্পর্কিত যাবতীয় ধ্যান ধারনা – সব কিছুকে নস্যাৎ করে যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক মনন, মোহহীন দৃষ্টিভঙ্গী এবং ব্যঙ্গপ্রবন মানসিকতা নিয়ে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে আবির্ভূত হলেন সেকালের পাশ করা ইঞ্জিনীয়র যতীন্দ্রনাথ। বস্তুতান্ত্রিকতা তাঁর শিক্ষায় ও পেশায়, মননে ও প্রেরণায়। কবিসুলভ ভাবালুতা যেমন নেই, তেমনই প্রথাগত কবিতা রচনারও কোন তাগিদ নেই। তাই তিনি একক, তিনি বিদ্রোহী, শালগ্রামের বক্ষে এঁকে দিতে পারেন ভৃগুর পদচিহ্ন। বললেন,“তুমি শালগ্রাম শিলা/শোয়া বসা যার সকলি সমান, তারে নিয়ে রামলীলা (ঘুমের ঘোরে)। সে কাল ও সে যুগে রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত হওয়ার স্বপ্ন কেউ দেখেনি। তিনিই প্রথম রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত বিদ্রোহী কবি যার কবিতা উপমা ও অলঙ্কারে, ছন্দে ও চিত্রকল্পে, মনন ও দর্শনে পরিপূর্ণভাবে প্রতিবাদী। তাঁর প্রতিবাদ আত্মতৃপ্তির বিরুদ্ধে, নিছক নিসর্গ দর্শনের বিরুদ্ধে বা সৌন্দার্যানুভূতির বিরুদ্ধে – সর্বোপরি পরিপূর্ণভাবে রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে। কীটসের মত তিনি বলেননি 'Truth is beauty, beauty truth', কিংবা রবীন্দ্রনাথের মত মালবিকার রূপের বর্ননা দেওয়া বা উর্বশীর মধ্যে দেহাতীত সৌন্দার্যনুধাবন করা তার পক্ষে একান্তভাবেই অসম্ভব ছিল। তিনি নিজেকে বলেছেন 'দুঃখবাদী বৈরাগী' মানুষের লাঞ্ছনা, নৈরাশ্য, দারিদ্র, মধ্যবিত্তজীবনের সঙ্কট, অসহায় মৃত্যু এসবই যখন মানবভাগ্যের পরিণতি, তখন সুখ স্বপ্নে বা প্রেমানন্দে বিভোর হতে চাওয়া এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা। শেলীর কাব্যে হতাশা আছে, কিন্তু আশাও আছে। শেলীকে সেইজন্যই বলা হয় 'a Poet of hopes in despair'। কিন্তু যতীন্দ্রনাথে আশা নেই, কেবলই হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস। হয়তো যতীন্দ্রনাথের জীবনের মধ্যেই এই দুঃখবাদী মনোভাবের বীজ সুপ্ত ছিল। ডঃ শশী ভূষন দাসও তাই মনে করেন। ব্যক্তিগত জীবনে অসুস্থতাই হয়তো এর একটা বড় কারণ। তবে কবি হওয়ার বাসনা ইঞ্জিনীয়ারের মাথায় কেমন করে এল সে সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন যে কবিদের ভাব বিলাস যতই তার কাছে হাস্যকর ঠেকেছে, ততই এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর সোচ্চার হতে চেয়েছে। শেষ পর্যন্ত কবিতার ভাববিলাসকে আঘাত হানতে কবিতাই বেছে নিলেন। তাঁর প্রথম কাব্য মরীচিকা'র বহ্নিস্তুতিতে দুঃখের আগুন জ্বলে উঠেছে।
রক্ত বচন, ভষ্ম আশন, বিশ্বশাসন জ্যোতি
শান্তভয়াল, আঁধারের আলো, তোমায় করি গোনতি”
পরবর্তী কাব্য ‘মরুশিখা'য় তিনি বলেছেন, ‘চেরাপুঞ্জির থেকে/ একখানি মেঘ ধার দিতে পার গোবি সাহারার বুকে”। ‘ঘুমের ঘোরের এক একটি ঝোঁকে তার দুঃখ ও নৈরাশ্যবোধ সুত্রাকারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জগৎ অর্থে তিনি বুঝেছেন নিয়ম-অনিয়ম, খামখেয়ালীপনা-কাজামিলপ্রশ্নে-এ ভরা একটা নিদারুন হেঁয়ালি, ভক্তি অর্থে প্রবলের সঙ্গে এক তরফা সন্ধি, দেবতারা হলেন এক জাতের রাক্ষস। ধান ভানা ছাড়া ঢেঁকির রবের অন্য কোন উচ্চ অর্থ যেমন নেই, মানবের জীবনের নৈরাশ্য বোধই শোচনীয় পরিণাম। এসব হতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তাঁর ব্যবস্থাপত্র হল ঘুমিওপ্যাথি। এছাড়া আর কোন উপায় নেই, কেননা,
কে গাবে নূতন গীতা / কে ঘুচাবে এই সুখ সন্ন্যাস ‘দুঃখবাদী’ কবিতায় তিনি লিখেছেন;
“ছবি ও ছন্দে তোমারি দালালি করিছে স্বভাব কবি সমসুন্দর দেখে তারা গিরি সিন্ধু সাহারা গোবি তেলে সিন্দুরে এ সৌন্দর্য ভবি ভুলিবার নয়
সুখ দুন্দভি ছাপায়ে বন্ধু ওঠে দুঃখেরি জয়।”
গেরুয়ার বিলাসিতা।'
এখানে যতনা দুঃখবাদ, তার চেয়ে অনেক বেশী ব্যঙ্গ। কিছুটা স্যাটায়ার ধর্মী। ইংল্যাণ্ডে রেস্টোরেশান যুগে ড্রাইডেন, পোপ, সুইফটস্ প্রমুখ শিল্পীরা যেভাবে স্যাটায়ারের কশাঘাতে চেতনার উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছিলেন, যতীন্দ্রনাথের দুঃখবাদী মনোভাবে ব্যঙ্গের কশাঘাত সে রকমই একটা চাবুক।
যতীন্দ্রনাথের উপর নীৎসের (Nietzsche Friedrich wilhelm) প্রভাব অনেকটাই বর্তমান। নীৎসে সত্য,সুন্দর, সৎ প্রভৃতি মৌলিক ভাবধারার বর্তমান প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেছেন এবং একটি নতুন প্রজন্মের ইঙ্গিত দিয়েছেন। (He challenged the Concepts of 'the
good, the true and the beautiful as in their existing form of abstract
values............ He set his hope on the will to Power of a new race of men
who would assert their own spiritual identities'). নীৎসে আশাবাদী দর্শনের বিরোধিতা করেছেন। জগৎ সৃষ্টি ও তার শৃঙ্খলাবদ্ধ নিয়মনীতিকে মূল্যহীন বলেছেন। যতীন্দ্রনাথও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন। বিদ্রোহী বিশেষ করে রবীন্দ্র বিদ্রোহী তাকে বলা যায় না। বরং বলা যেতে পারে বাস্তব অনুরাগী কবি। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল। অবশ্য তিনি কোনদিনই রবীন্দ্রনাথের কাছ যান নি। R.K. Dasgupta-এর কারণ নির্ণয়ে বলেছেন, “It was not Pride either. It was
just a quite sense of dignity in a man who was equally indifferent to the
appro- bation of the younger Poets: রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি কবিতায় নিজেকে ‘রবীন্দ্রনাথের পাখি' বলে চিহ্নিত করেছেন।
রোমান্টিকতার কট্টর বিরোধী বলেও তাঁকে মনে করা যায় না। নৈরাশ্যের, যন্ত্রণার ছবি কবিতায় থাকলেই তাকে রোমান্টিকতা বিরোধী বলতে হবে এমন কোন নিয়মও নেই। জীবনের negative side তো সাহিত্যে থাকবেই, রবীন্দ্রনাথও এমন চিত্র চিত্রিত করেছেন। যুগ জটিল, জীবন যাত্রা জটিল সাহিত্যও তাই জটিল —যার পরিণাম নৈরাশ্য, হতাশা, অপ্রাপ্তির বেদনা, যন্ত্রনা ও মৃত্যু। জীবনের অবক্ষয়ী পরিণাম সাহিত্যের একটা বিষয়। সত্যানুসন্ধানী যতীন্দ্রনাথ তীব্রতর কর্তব্যবোধের অনুরোধে স্বপ্নপ্রবল সৌন্দর্যসন্ধানী মনকে পিষ্ট করেছেন, মনকে প্রবোধ দিয়েছেন, “যদিও এ জগতের কলজেটা জ্বলছে / মিথ্যে মিষ্টি কথা সবাই তো বলছে / তুইও তাই বলবি, / বাঁধা পথে চলবি —/ আগে পিছে আগা গোড়া আপনাকে হলবি।” রোমান্টিক স্বপ্ন প্রবণতার বিরুদ্ধে দ্বিজেন্দ্রলাল ও প্রমথ চৌধুরী যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেন, যতীন্দ্রনাথ সেই ধারার কবি। তবু রোমান্টিকতাকে সম্পূর্ণ বর্জন করতে তিনি পারেন নি। ‘মরীচিকা'-তেই তিনি যেন হঠাৎ করে ছিটকে বেরিয়ে এসে আবেগ স্পন্দিত ভাষায় বলেছেন;
“জীবনে আমার ফুটাইলে কে গো / যৌবন শতদল ? একি বিস্ময় একি সৌরভ / একি শোভা ঢল ঢল।”
এমন রোমান্টিক স্ফূরণ অন্যত্রও আছে, বিশেষ করে ত্রিযামায়' আসলে যতীন্দ্রনাথ মানবতাবাদী কবি। নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, “যতীন্দ্রনাথের দুঃখবাদ শেষপর্যন্ত নৈরাশ্যের অন্ধকারে পরিণাম হীন শূন্যতার পথে আকাঙক্ষার অতৃপ্ত জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে কোন বিবর্ণ মরুভূমির মধ্যে হারিয়ে যায়নি। তাঁর শ্লেষের আঘাত আত্মধ্বংসমূলক নয় তা আত্মসমীক্ষামূলক। শ্রমিকের দুঃখে কবি বিচলিত হন। নাটকীয়তা ও গল্পরস দিয়ে বর্ণনা করেন পাঁচীর ছেলের মৃত্যু দৃশ্য। ঘুমের ঘোরে’ কবিতায় দুঃখের অশ্রুধারায় মানবপ্রেমের জয়গান ধ্বনিত হয়েছে।
যতীন্দ্রনাথ সে অর্থে নিছক দুঃখবাদী নন। তিনি সাধারন হতে ভিন্নতর, সত্য সন্ধানী, কিন্তু রোমান্টিকতা বজ্জিত নন। বারীন্দ্র বসু বলেন যে শয়তানি ও জড়ত্বই সুখ ও শান্তির পথে বাধা আর বাধাকেই যতীন্দ্রনাথের তীক্ষ্ণ কটাক্ষ। বিশ্বঅভ্যন্তরস্থ পরমানন্দে তাঁর আস্থা না থাকলে এভাবে কটাক্ষ করা যায় না। আবার পরমানন্দে যার বিশ্বাস আছে, তাকে নিছক দুঃখবাদীও বলা যায় না।
এদিক থেকে কবি শেলীর সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য অনেকটাই। শেলী "The Necessity of Atheism' লিখেছিলেন, অথচ তিনি নাস্তিক ছিলেন না। প্লেটোর মতই তিনি বিশ্বাস করতেন নিখিল বিশ্বের মহাজীবনের ধারাকে যা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রন করে এবং জীবন যত বিচিত্রই হোক না কেন, মহাজীবনের ছন্দে তা ছন্দায়িত। যতীন্দ্রনাথ শেলীর মতই মানবতাবাদী, শেলীর মতই বিদ্রোহী, শেলী আশাবাদী, কিন্তু যতীন্দ্রনাথ আশার বাণী শোনাতে পারেন নি। তবে জগৎ প্রপঞ্চের মহাজাগতিক কার্যক্রমে আস্থা না থাকলে তাঁর কবিতার ধরা মরুপথেই নিঃশেষ হয়ে যেত ।
মোহিতলাল মজুমদারের দেহবাদ
“রবীন্দ্রনাথের জীবন কালেই কাঁর অমোঘ প্রভাব এড়িয়ে গিয়ে নয়, আত্মসাৎ করে, বাংলা কাব্যে প্রথম স্বতন্ত্র নতুন মোহিতলাল”— বলেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন “মোহিতলাল সাধারণের কাছে ইতিমধ্যেই খ্যাতিলাভ করেছেন। এই খ্যাতির কারণ তাঁর কাব্যের অকৃত্রিম পৌরুষ। অকৃত্রিম বলছি এইজন্য যে তাঁর লেখায় তাল ঠোকা পাঁয়তারা মারা পালোয়ানি নেই।” ডঃ সুকুমার সেন বলেছেন যে, তিনি প্রথম জীবনে রবীন্দ্র অনুরাগী নন ছিলেন দেবেন্দ্র সেনের অনুগামী। মানসী ও ভারতীর সংস্পর্শে এসে হয়ে উঠলেন ‘রবীন্দ্র অনুরাগী এমন কি ‘রবীন্দ্র কাব্যের নিগুঢ় রসজ্ঞ ও মর্মজ্ঞ'। এর পরেই তিনি হঠাৎ বদলে গেলেন। ঢাকায় থাকিয়া মোহিতলালের রবীন্দ্র বিমুখতা নতুন রূপ পাইল।” এমন কথাই বলেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর কল্লোল যুগ’ গ্রন্থে। “মোহিতলালকে আমরা আধুনিকতার পুরোধা মনে করতাম, তিনিই ছিলেন আধুনিকোত্তম। আধুনিকতা যে অর্থে বলিষ্ঠতা, সত্য ভাষিতা, সংস্কাররাহিত্য তা আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম তাঁর কবিতায়। কিন্তু তারপর মতে বা মনে কোনো অমিল নেই তবু কেন কে জানে মোহিতলাল বেঁকে দাঁড়ালেন।” হরপ্রসাদ মিত্র মনে করেন “মোহিতলাল তখনকার যৌবনের অনস্বীকার্য বিদ্রোহ সম্বন্ধে যথেষ্ট সজাগ ছিলেন না, ফর্ম ও স্টাইল' এর বিষয়ে তর্ক বিতর্ক মাত্রা প্রচার করে—আর্ট-এর ঘরে সত্য-সুন্দর দাস হয়ে তিনি অযথা বড়ো বেশি পরিমানে গুরুগিরি করেছেন।” হরপ্রসাদ বাবু এই গুরুগিরি করার বিষয়টাকে নজরুলের বক্তব্য বলেছেন। নজরুলের আবির্ভাবকে মোহিতলাল স্বাগত জানিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত তলানিতে পৌঁছেছিল— এমন সংবাদ একাধিক গ্রন্থেই পাওয়া যায়। সমালোচক মোহিতলালের 'ফর্ম ও স্টাইল' এর উপর গভীর প্রত্যয়বোধই কল্লোল গোষ্ঠী হতে তাঁকে পৃথক করে দেয়। অধ্যাপক তপন কুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন যে মোহিতলালের এই মানসিক পরিবর্তনের মূলে জগৎ ও জীবনের পরিবর্তনময়তাই কার্যকরী হয়েছে। অধ্যাপক কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তীও মনে করেন “মোহিতলাল ও যতীন্দ্রনাথের দেহবাদ রবীন্দ্র অরুপ- অমূর্তরই প্রতিক্রিয়া স্বরূপ।” তবে মোহিতলালের দেহবাদ প্রাকৃত নয়, বৌদ্ধিক পরিশীলনে এবং দার্শনিক মননের দ্বারা তা পরিস্ফুত।মোহিতলালের উপর প্রভাব পড়েছিল ফরাসী কবি চার্লস বোদলেয়ারের। তার মধ্যে দুইটি পরস্পর বিরোধী অনুভূতির স্ফুরণ ঘটেছিল এবং তা হল “the horror of life and the ecstasy
of life; Periods of heightened sensitivity and sensibility altering with the
monotony of the existence without meaning"। বোদলেয়ারের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হল তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতিকে metaphorical expression-এর মাধ্যমে transfuse করতেন। মোহিতলালের দেহবাদ তত্ত্বেও প্রাকৃত কোন বিষয় নেই, নারীর দেহসৌন্দর্যকে দার্শনিক মননশীলতায় পরিবর্তিত করেছেন। মোহিতলালের প্রতিভায় পাশ্চাত্যের বহু দার্শনিক ও কবির প্রভাব বর্তমান। ফ্রয়েড, হুইটম্যান, লরেন্স, ডক্টয়ভস্কি প্রমুখ দার্শনিক-কবি ও সাহিত্যিকের চিন্তাধারার ছাপ আছে তাঁর সাহিত্য চিন্তায়। তিনি শোপেন হাওয়ারের দুঃখবাদের বিরোধীতা করেছেন। নারী তার সৌন্দর্য ও তার প্রেমের মধ্যে অখণ্ড দুঃখভোগ ব্যতীত আর কিছুই নেই—এমনই মত প্রকাশ করেছেন শোপেনহাওয়ার।পতঙ্গের অগ্নিতে ঝম্পপ্রদান যেমন তার মৃত্যুর কারণ, তেমনি নারীর রূপ ও প্রেম সকলপ্রকার সর্বনাশ ও অমঙ্গলের কারণ। (The loves are the traitors who seek
to Penetrate the whole world and drudgery which could otherwise speedily reach
and end."
ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে নারীদেহ, রূপতৃষ্ণা ও যৌবন মদমত্ততার চিত্র বিরল নয়। মূলতঃ নারীর দেহ সৌন্দর্যের প্রতীক রূপেই কাব্যে এসেছে। কালিদাসের কুমার সম্ভবে পার্ব্বতীর দেহকান্তি বর্ণনা আছে। রঘুবংশ এবং শকুন্তলাতেও আছে। বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদে অল্পবিস্তর এবং পদাবলী সাহিত্যে; জয়দেবের গীতগোবিন্দে আদিরস ও নারী সৌন্দর্য, ভোগবাসনা ও রতিসাধনার বহু দৃষ্টান্ত বর্তমান। তবু ভারতীয়দর্শনে ও ধর্মে নারীকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, মনে করা হয়েছে 'নারী নরকের দ্বার'। শঙ্করাচার্য, বুদ্ধদেব প্রমুখ ধর্মীয় দার্শনিকদের বিরুদ্ধে মোহিতলাল কলম ধরেছেন। ‘মোহমুদগর’-এ শঙ্করাচার্যের, বুদ্ধ কবিতায় বুদ্ধের এবং ‘পান্থ' কবিতায় শোপেনহাওয়ারের দর্শনকে অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, যত ব্যথা পাই তত গান গাই - গাঁথি যে সুরের মালা। বুদ্ধকে প্রাণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন, ‘প্রাণ হত্যা করিবার কেবা তোমা দিল অধিকার / এর চেয়ে ক্রুর সে কি তৈমুরের লক্ষ জীবননাশ?” বুদ্ধ বলেছিলেন যে না পাওয়ার বেদনাই দুঃখ। তৃষ্ণার নিবৃত্তি নেই, তাই জীবকে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। কামনার নিবৃত্তির অর্থই মোক্ষ। মোহিতলাল এর পর্যবেক্ষণ হল : বুদ্ধদেব যেন ভিষক প্রধান রূপে বিষের ঔষধ বিধানে বিষ প্রয়োগ করেছেন।
দেবেন্দ্র মঙ্গলের পরেই রচিত হয় ‘স্বপ্ন পশারি’। এই কাব্যগ্রন্থের ‘পাপ' কবিতায় ফরাসী কবি ভিলোঁর মতই নিজস্ব ভঙ্গিমায় পাপকে আহ্বান জানিয়েছেন। এসো পাপ, এসো সুন্দরী / তব চুম্বন অগ্নি মদিরা রক্তে ফিরুক স্যরি।' এ বসুন্ধরা যেমন বীরভোগ্যা, তেমনই নারীও ।
—“ত্যাগ নহে, ভোগ, ভোগ তারি লাগি, যেই জন বলীয়ান / নিঃশেষে ভরি লইবারে পারে এতবড় যার প্রাণ' যারা দুর্ব্বল, এ উৎসবে তাদের নিমন্ত্রন নেই।
পরের কাব্য ‘বিস্মরণ’। ক্লাসিক আঙ্গিকে রোমান্টিক ভাবনার আবর্ত। “ দেহভরি কর পান কবোষ্ণ এ প্রাণের মদিরা / ধুলা মাখি খুঁড়ি লও কামনার কাচ মনি হীরা।”
উপাদান গ্রহণ, ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানের প্রভাব, বিজ্ঞান চেতনা ও সাম্যবাদী চিন্তাধারা, মননশীলতা, প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধে সংশয় ও তৎসঞ্জাত অনিশ্চয়তার উদ্বেগ, প্রেমের শরীরী রূপকে প্রত্যক্ষ করা, ভগবান ও প্রথাগত নীতিধর্মে আবশ্বাস – - এসবই প্রেমেন্দ্রর কবিতায় বর্তমান।” তবু অনেকেই তাঁকে আধুনিক বলতে কুণ্ঠিত হন এই কারণে যে রবীন্দ্র ঐতিহ্যের সচেতন বিরোধিতা তাঁর কাব্যে নেই। তিনি বিদ্রোহী ঠিকই, কিন্তু নজরুল ও সুকান্তের বিদ্রোহী সত্তার মত নন, তিনি স্বতন্ত্র এই অর্থে যে তিনি সুকান্ত বা নজরুলো মত পরাধীনতার শিকল ভাঙার গান গাননি। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেননি। তিনি নিজেকে বিদ্রোহী বলে পরিচয় দিয়েছেন, আবার জীবন বিধাতাকে নমস্কার জানিয়েছেন।
প্রেমেন্দ্র
প্রেমেন্দ্রের প্রথম কাব্য ‘প্রথমা’ চব্বিশ বছর বয়সে লেখা। প্রথম সংস্করণে কবিতা ছিল পঁচিশ, দ্বিতীয় সংস্করণে তা বেড়ে দাঁড়ায় পঁয়ত্রিশ। এই কাব্যেই রয়েছে প্রেমেন্দ্রর আত্ম ঘোষণা, তার জীবনানুরাগ এবং আশাবাদ ও দুঃখবাদের সমন্বয় রূপ। আত্মঘোষণা করেছেন ‘আমি কবি’কবিতায় ৷ তিনি নিজেকে ইতর জনের, কামারের, ছুতারের, মাঝির অর্থাৎ শ্রমজীবি মেহনতি মানুষের কবি বলে পরিচয় দিয়ে আশা-নিরাশার সমন্বয় রূপ প্রকাশ করেছেন ‘স্বপ্ন দোল' কবিতায় “যদিও সকল হাস্য - ফেনপুঞ্জতলে জানি ক্ষুব্ধ ব্যথা - সিন্ধু দোলে; যদিও অশ্রুর মূল্যে কোন স্বর্গ মিলিবেনা জানি, / হাসি-অশ্রু উচ্ছ্বলিত তবুও রঙীন/ এ বিস্বাদ জীবনের বিষপাত্রখানি / ওষ্ঠে তুলি ধরি,/নিঃশেষিয়া যাব পান করি। শুধু তার সযতন অনুরাগ স্মরি / জীবন শিয়রে বসি দোলা দেয় যে স্বপ্ন-সুন্দরী।” মেহনতি দরিদ্র মানুষ তাঁর ভগবান। আবর্জনা সঙ্কুল জীর্ণ গৃহে, আলোহীন, বায়ুহীন কক্ষে ছিন্ন শয্যায় শুয়ে আছে “রোগ-রুক্ষ-ক্ষুধা-ক্ষীণ দেহ নিয়ে দেবতা আমার।” শত্রুরা সেই দেবতার আলো চুরি করে। তার ভগবান, “বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে বন্দী মোর ভগবান কাঁদে / কাঁদে কোটি মার কোলে অন্নহীন ভগবান মোর।”
ঐ কাব্য গ্রন্থের দ্বার খোল' কবিতায় কবির আত্মকথার আর একদিক উদ্ভাসিত; অন্নে যে ভরে না বুক / তৃষ্ণা যে অতৃপ্ত থেকে যায় / প্রাণ আলো চায়' কবির মনে প্রশ্ন : “মোর মাঝে কোন্ প্রাণ মহানদ ছুটিয়াছে-অন্তহীন অসীমের লাগি।”
‘অপূর্ণ’-তে আছে আশা নিরাশার সমন্বয়, কিন্তু ‘তবু-র মধ্যদিয়ে সংশয়ও থেকে যায়, প্রশ্নমনস্কতা মাথা তোলে। জীবনে আশা অপূর্ণ থেকে যায়। কান্নাই সার - এ কান্না ‘প্রেয়সীর শ্রেয়সীর লাগি', অন্য দিকে সংশয় দ্বিধা দ্বন্দ্ব বঞ্চনা ও হতাশার। তবু; “যত কান্না ধরণীতে / তার মাঝে তুমি কাঁদ এই শুধু জানি / আর ধন্য আপনারে মানি।”
জীবন নশ্বর। কিন্তু ইহবাদী বলেই তিনি এই নশ্বরতাকে উপেক্ষা করতে চান। 'ইহবাদী' কবিতায় তিনি বলেন “ওরে অন্ধ, ওরে হতাশ / লুট করে নে যেথায় যা পাস।”
হরপ্রসাদ মিত্র বলেছেন, “ কোনোরকম প্রথাগত অর্থে তিনি স্বপ্নাঞ্জন লোভী নন। 'ভারতী' দলের স্বপ্ন নয়; মোহিতলালের প্রজ্ঞা-পীড়াময় স্বপ্ন নয়, বুদ্ধদেবের বিষাদময় স্বপ্নালুতা নয়, জীবনানন্দের মতন প্রাকৃতিক শান্তির স্বপ্নে চিরনগ্নতাও তাঁর স্বভাব নয়, তাঁর স্বপ্নপ্রবণতা বরং কিঞ্চিৎ ওমরখৈয়ামী প্রতিধ্বনির সঙ্গে জড়িত।”
অনুভূতি আর বিশ্বাস, সংশয় ও প্রশ্নমনস্কতা, ইহবাদ ও সমন্বয় প্রবৃত্তি ‘প্রথমা’ কাব্যগ্রন্থের সেতু, ফিরে আসি যদি, সংশয়, পাঁওদলে স্পষ্ট ধরা পড়ে। বিশ্বাসের সূত্রটি খুবই স্পষ্ট,
“মানবীর গর্ভ হতেই তৈমুরের জন্ম, বুদ্ধ খ্রীষ্ট দেবতা ছিলেন না। মানুষ কি তার সৃষ্টির মাঝে বিধাতার নিজের জিজ্ঞাসা।” ইহবাদের পথিক বলেই তিনি বলেছেন;
“পথই যে আমার প্রাণ – আমার অসীম পথের পিপাসা।”
প্রেমেন্দ্র মিত্রের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'সম্রাট। এই কাব্যগ্রন্থের নীলকন্ঠ' কবিতাটি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “আমার সমস্ত জীবনের শিক্ষা দীক্ষা, অভিজ্ঞতা, চিন্তা সমস্ত দিয়ে আমার একটা ধ্যান গড়ে উঠেছে। সেই ধ্যানের খোঁজ পাবে সম্রাট -এর নীলকন্ঠ' কবিতায়।” নীলকন্ঠ কবিতায় আছে পলিনেশিয়া ও আফ্রিকার আদিম রূপের উজ্জ্বলতা যা সাম্রাজ্যবাদী লোলুপতায় ক্লিষ্ট হয়ে যা.। নি। এর পাশে আধুনিক সভ্যতা যেন ফ্যাকাশে রুগ্ন'। আধুনিক সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাহীনতাই একাব্যের উপজীব্য বিষয়। 'কাঠের সিঁড়ি' কবিতায় আবার ফিরে এসেছে ইহবাদ। কাঠের সিঁড়ি উচ্চ শ্রেণীর জন্য ব্যবহৃত প্রতীকী পথ। কবি মনে করেন ‘একদিন তার স্থানুত্ব যাবে ঘুচে।”
‘ফেরারী ফৌজ’ কাব্যের কোন কোন কবিতায় মানব সভ্যতার বিস্তৃত পটে আধুনিক জীবন সমস্যা অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা দৃষ্ট হয়।
“সাত সাগরের তীরে / ফৌজদার হেঁকে যায় শোনো, / আনো সব সূর্যকণা / রাত্রি মোছা চক্রান্তের প্রকাশ্য প্রান্তরে / এবার অজ্ঞাতবাস শেষ হলো ফেরারী ফৌজের।” ফ্রয়েডের তত্ত্বানুসারে মানুষের মনের গভীরে যে আদিম অন্ধকারের রাজত্ব রয়েছে, তা বিভিন্ন প্রতীকের মাধ্যমে ফেরারী ফৌজের বিভিন্ন কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে। জীবনের প্রাত্যহিক ছবি থেকে তিনি এক আনন্দলোকে যেতে চান। যুদ্ধোত্তর বিকলাঙ্গ সভ্যতার রূপরেখা আছে ‘সাগর থেকে ফেরা' কাব্যে। 'কখনো মেঘ' কাব্যে আছে শুভ-অশুভ, মঙ্গল-অমঙ্গলের দ্বন্দ্ব। চিত্র সংযোগে অশুভের বর্ণনা প্রতীকী মর্যাদা পেয়েছে এই কাব্যে।
এসব কাব্যে পরিণত কবির চিন্তাধারা ক্রমেই পার্থিব হতে অপার্থিব আনন্দলোকের সন্ধানী। কিন্তু প্রেমেন্দ্র মিত্রের জীবন দর্শন খুঁজে পাওয়া যাবে ‘প্রথমা’, ‘সম্রাট ও ফেরারী ফৌজ' কাব্যে। সমালোচক নিখিল নন্দীর মতে 'ভাবধর্মে তিনি চরম বিপ্লব সাহিত্যের ঘটিয়েছেন সেই ‘প্রথমা’-র যুগে, যখন একই পানপাত্রে তিনি ভারতীয় ঋষির ভূমাদর্শ ও পাশ্চাত্য মনীষার বৈজ্ঞানিক চিন্তা, বিশেষত মার্কসবাদ সমান আগ্রহে গ্রহণ করলেন। চরমপন্থী না হয়েই অবিমিশ্র মানব প্রস্থানে কাব্যের স্পষ্টতর জড়তাহীন নবীন যাত্রা ।
স্পন্দিত ও ছন্দিত করলেন। প্রথম তুর্য সেজেছিল প্রেমেন্দ্রের ছুতোর, কামার, কুলি মজুরের চারণগানে,পাঁওদলের পঙ্কলগ্ন পদশব্দে, জনতার কলরবে, তারপর ব্যক্তি সাম্রাজ্য ঘোষণায়, ‘নীলকন্ঠের সিংহ হিংস্র' মৃত্যুপন আত্মসমীক্ষায়।”
এসবই প্রেমেন্দ্র মিত্রের ইহবাদ। আধুনিক সভ্যতার যন্ত্রণা কবিকে ব্যথিত করেছে। হরিণ, চিতা ও চিলের সাহায্যে মানসিকতা, আদিম বন্যতা এবং গতানুগতিকতার রহস্য সন্ধান করেছেন। জীবনের কঠোরতাকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে চাইলে কি শান্তি পাওয়া যায়? মৃত্যুর ঝুঁকি না থাকার অর্থই তো পঙ্গুত্ব। স্বাধীন মানসিকতার প্রতীক হরিণ পালাতে না চাইলে যাদুঘরে তার স্থান হয়। মৃত্যু সম্বন্ধে প্রেমেন্দ্রর ধারণা তাঁর নিজের কথাতেই ব্যক্ত। “মৃত্যু মানে intense delight। এই যে Adventure-এর কথা শোনা যায় মাঝে মাঝে, উত্তরমেরুতেই যাও আর যুদ্ধে গিয়ে বিকলাঙ্গই হও –এসবই তো মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার দুর্নিবার তাড়নায় ঘটে থাকে। Biology-র এ একটা আইন। মৃত্যু মানুষের অত্যন্ত প্রিয়। যতোদিন যৌবন, ততোদিনই মৃত্যুর স্বাদ পাওয়ার সাধনা। তারপর ভয় পাবার দিন আসে।; সেই তো বার্ধক্য। জীবনের তীব্রতম শারীরিক আনন্দ— সেও তো আত্মক্ষয়ের মূল্যে কেনা মুহূর্তের সুতীব্রতা। আমি এই মৃত্যুও রমনীতে ভেদ নাই বলেই এগিয়ে চলেছি। Ecstasy of Death আমাকে প্রতিপদে টানছে।” (দিনান্তিকা পত্রিকা ১৩৬৪)।
এই আত্মকথাই তাঁর কবি স্বভাবের মূল রূপ যা স্বভাবতই আধ্যাত্মিক! বিজ্ঞান যেখানে শেষ হয়, আধ্যাত্মিক দর্শনের শুরু সেখান থেকেই। বিজ্ঞানের প্রতি প্রীতি থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রশ্ন মনস্ক, ইহবাদী হয়েও অমৃতত্বে বিশ্বাসী। তিনি ফ্রয়েড ও মার্কসকে সত্য জেনে ইহবাদী, “মানুষের মানে চাই—গোটা মানুষের মানে’–এই মানে খুঁজে পেতেই তিনি প্রশ্ন মনস্ক আশাবাদী আধুনিক— মনেপ্রাণে রবীন্দ্রভক্ত।
“যে দ্যুতির স্পর্শ লেগে / এ সৃষ্টিও হল মধুময় / এ জীবন শাশ্বত প্রভাত। সত্তার গহন কেন্দ্রে / সুপ্তির জড়তা দাও ভেঙে / হে রবীন্দ্রনাথ (কখনো মেঘ / রবীন্দ্রনাথ)
‘কাব্যগ্রন্থ প্রসঙ্গে’ প্রেমেন্দ্র বলেছেন “পৃথিবী যদি সাময়িক উত্তেজনায় উদাসীনও হয়, তবু কবিকে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। মানুষের মনে সুর লাগানো তাঁদের কাজ, কিন্তু সেই সঙ্গে যুগে যুগে মানবতার গভীর মর্মোদঘাটন করে জীবন সত্য ভুলতে না দেওয়াও তাঁর দায়িত্ব। শেলী বলেছিলেন, 'Poets are the unacknowledged
legislators of mankind'। কবির অতিশয়োক্তি মিথ্যা দত্ত বলে উড়িয়ে দেওয়া বুঝি যায় না; যুগের মানুষ নানা কারণে উদভ্রান্ত হতে পারে, কিন্তু কবিকে তাঁর লক্ষ্যে স্থির থাকতে হবে। কারন জীবনের পরম রহস্যের চাবি শুধু বুঝি তাঁর কাছেই।”
জীবনানন্দ
জীবনের এই পরম রহস্যকে খুঁজতে গোটা মানুষের মানে খুঁজেছেন প্রেমেন্দ্র। ৭) অন্তর্মুখী নির্জনতা হতে সূর্যালোকিত পথে জীবনানন্দের পরিক্রমা বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ এক স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। কবিতা জীবনানন্দের মতে শুধুই আবেগ নির্ভর নয়;মস্তিষ্ক নির্ভরও। আলোক স্নাত কিন্তু অন্ধকারের চোরা স্রোত বয়ে চলে আলোর নীচে ছায়ার মত, বিশ্বাসের পাশেই থাকে অবিশ্বাস। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নিচয়ের গভীরে থাকে অন্যতর বাস্তবতার সন্ধান। এ এক অনির্বচনীয় বাণী যার তলায় তলায় প্রবাহিত হয় বিপন্ন সংকট, তবু তা বিরামহীন যাত্রার প্রতীক এবং লক্ষ্য তার লাবণ্যময়ী চৈতন্যলোক। তাঁর কবিতা সম্পর্কে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন “ইমেজিস্যম্, সিম্বল ও সুরিয়ালিজমের সঙ্গে জীবনের ব্যাখ্যাতীত বিষণ্ণতা, ইতিহাসের মধ্যে পথ খুঁজিবার বৃথা চেষ্টা – চারিদিকে আসন্ন অগ্রহায়নের শীতার্ত বেদনা জীবনানন্দের কবিতাকে রোমান্টিক অনুভূতির বিচিত্র রূপ রস গন্ধের প্রতীকে পর্যবসিত করিয়াছে। বিশ শতকের ব্যর্থতা, আকাঙক্ষার অপঘাত এবং পলাতক জীবনের নিঃশেষে উধাও হইয়া যাওয়া জীবনানন্দের কবি চিত্তকে আশাহীন আনন্দহীন নৈরাশ্যের যন্ত্রনায় পীড়িত করিয়াছে। মনে হইতেছে, আধুনিক জীবনের সমস্ত দুঃখ লাঞ্ছনা ও অতৃপ্তি কবির রোমান্টিক চিন্তার সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে; বাস্তবের সীমা ও সঙ্কীর্ণ দেশকাল কবির নভোচারী কল্পনার মুক্তি বিহারকে বাধা দিয়াছে, তাই তাহাকে দূর অতীত ইতিহাসের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া সঙ্কুচিত দেশকাল হইতে মুক্তিলাভ করিতে হইয়াছে।”
জীবনানন্দের আশাহীন, আনন্দহীন নৈরাশ্যের যন্ত্রনায় পীড়িত মনের খবর তাঁর প্রথম কাব্য ‘ঝড়া পালক' -এ নেই। এ কাব্যে আছে আতিশয্য পীড়িত তারুণ্যের উল্লাস। বাস্তব সংশয়ের সব অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তিনি আমাদের হাত ধরে নিয়ে গেছেন এক অপূর্ব রহস্যলোকে। এ যেন স্বপ্নের রোমাঞ্চপুরী। “ তবু এই কাব্যে কবি একটি পৃথক ভঙ্গি খুঁজেছেন মাত্র” বলেছেন হরপ্রসাদ মিত্র। তিনি আরও বলেছেন, “সেই একখানি বইএর পরে যদি তাঁর লেখা বন্ধ হয়ে যেত, তাহলেও বাংলা কবিতার ইতিহাসে তাঁর নাম অবশ্যই থাকতো, কিন্তু তাঁর একান্ত স্থায়ী বিশ্বাসটি হয়তো কৈশোরের স্বপ্ন বলেই উপেক্ষিত হত।”
জীবনানন্দের পরের কাব্য ‘ধূসর পান্ডুলিপি’। কুধদেব প্রমুখ সকল কবি ও সমালোচকেরা এই কাব্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কবি সমর সেন লিখেছেন, “পৃথিবীর ক্ষান্তিহীন সংগ্রাম তাঁকে স্পর্শ করে না। কবিতা সম্বন্ধে সোচ্ছ্বাস কাব্যিক বিচারে যাদের আস্থা নেই, বই- এর শেষ ও আগে পলায়নী বিধানে তাঁরা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, যেহেতু ‘Today we are all bound upon a wheel of fire, and there is
stronger temper in the air, we can not possibly step aside and retreat to an
ivory towe"। এই কাব্যের কবিতাগুলি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথও ‘রস ও স্বকীয়তার’ কথা বলেছেন, ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে' বলে প্রশংসা করেছেন। বুদ্ধদেব বসুও তাঁকে ‘প্রকৃতির কবি' আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘প্রেমের কবিতা বলতে যা বোঝায়, ধূসর পান্ডুলিপিতে তা একটিও নেই”।
তাঁর মতে প্রেম ও পাত্রী অপেক্ষা পারিপার্শ্বিক প্রকৃতিই কবির কল্পনায় অধিক জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এ কাব্যের বহু কবিতাতেই পাশ্চাত্য প্রভাব আছে, বিশেষ করে শেলী ও কিটস্ এর। ছোট ছোট জিনিস সূক্ষ্ম সঙ্গীতময়তায় অসাধারণ হয়ে উঠেছে এমনভাবে যা অনুভবযোগ্য কিন্তু বিশ্লেষণ যোগ্য নয়।
এই কাব্যের ‘বোধ’ কবিতাটিকে সমালোচক শীতল চৌধুরী একবোধ হতে অন্যবোধে উত্তরণের কবিতা রূপে দেখেছেন। কবিতায় আছে সেই চৈতন্য, “যে চৈতন্য ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ জগতের পর্দা সরিয়ে দিয়ে পরাবাস্তব জগতে প্রবেশ করে। রূপকের অজস্রতায়, উপমা বা ইঙ্গিতে কীটস্ ও প্রিরাফেলাইটদের মত দৃশ্য-গন্ধ-স্পর্শময় চিত্র অঙ্কণের ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি মেলে না।
“দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ / হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা / ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ।”
জীবনানন্দকে নির্জনতার কবি বলে আখ্যাত করলে তাঁর জীবনবোধের উপর আস্থা হারাতে হয়। তাঁর কবিতায় নির্জনতা আছে, পলায়নী মনোবৃত্তিও আছে, তবে তা সামগ্রিকভাবে নয়, কবির কয়েকটি বিশিষ্ট চেতনায়। ধরা যাক তার স্বপ্ন অনুভবের কথা।‘এখানে চকিত হতে হবে নাকো ত্রস্ত হয়ে পরিবার নাহিকো সময়”। জাগতিক বিশ্বের সবকিছুই শেষ হয়, কিন্তু “এই স্বপ্নের জগৎ চিরদিন রয়।” কবি তাই স্বপ্নের কাছে আত্মসমর্পন করতে চান। সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ/ বিকেলের নক্ষত্রের কাছে ; / সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে / নির্জনতা আছে। / তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।” কিন্তু স্বপ্নতো আকাঙ্ক্ষার, কঠোর সত্য বাস্তব সেখানে দিবারাত্র দ্বন্দ্ব চলে বস্তু জগতের সঙ্গে আত্মজগতের। তাই ‘বোধ' কবিতার নায়কের মানসিকতা এই দ্বন্দ্বে ক্ষত বিক্ষত হয়ে বলে,
“চোখে কালশিরার অসুখ / কানে যেই বধিরতা আছে / সেই কুঁজ-গলগন্ড মাংসে ফলিয়াছে / নষ্ট শসা পচা চালকুমড়ার ছাঁচে / যে সব হৃদয়ে ফলিয়াছে / — সেই সব।” ‘আট বছর আগের একদিন' কবিতায় সেই বিচ্ছিন্ন ক্লান্ত মানুষটিকে আত্মহত্যার যে তাও ঐ নিস্তব্ধতা। হাতছানি দিয়েছিল
-
-
অবিরাম ভার “কোনদিন জাগিবে না আর / জাগিবার গাঢ় বেদনার / অবিরাম / সহিবে না আর, / এই কথা বলেছিল তারে / চাঁদ ডুবে চলে গেল – অদ্ভুত আঁধারে / যেন তার জানালার ধারে উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে।”
চাঁদ ডুবে যায়, অদ্ভুত আঁধার, আন্তর-ক্লিষ্ট যুবক নৈরাশ্য ব্যর্থতায় যন্ত্রণা জর্জর। এরই পাশাপাশি আছে কিছু উল্লাসের ছবি। এসবই পরাবাস্তবতার রূপক যার অর্থ হল জৈবিক প্রাপ্তির মধ্যে সুখ নেই, আছে রিক্ততা।
“জানি তবু জানি / নারীর হৃদয়-গ্রেম-শিশু-গৃহ নয় সবখানি/ অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়—/ আরো এক বিপুল বিস্ময়/
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে / খেলা করে।”
এই কবিতাতেও মৃত্যু চেতনা আছে, যদিও মৃত্যু চেতনা অধিকাংশ কবিতাতেই স্থান করে নিয়েছে।ধূসর পান্ডুলিপির প্রথম কবিতাতে “যখন ঝড়িয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে / পথের পাতার মতো তুমিও তখন / আমার বুকের পরে শুয়ে রবে।” অথবা ‘জীবন’ ববিতায় ব্যক্তিগত মৃত্যুবোধ যখন কাব্যের চেহারা নেয়; “মৃত্যুরে বন্ধুর মতো ডেকেছিতো —প্রিয়ার তিন” — তখনও তা নির্জনতার বোধ থেকেই জন্ম নেয়। জীবনানন্দের কবিতায় দুইটি পরস্পর বিপরীত ধারার মধ্যে একটি স্থির থাকে, অন্যটি পরিবর্তিত হয়। মৃত্যুর চেতনায় এই পরিবর্তনশীলতা রূপ নেয়। “জানি আমি – আমি যাব চলে / তোমার অনেক আগে, / তারপর, — সমুদ্র গাহিবে গান বহুদিন / আকাশে আকাশে যাবে জ্বলে / নক্ষত্র অনেক রাত আরো / আমি চলে যাব –তবু—সমুদ্রের ভাষা/ রয়ে যাবে,— তোমার পিপাসা / ফুরাবে না।”“একদিন মৃত্যু হবে জন্ম হয়েছে সূর্যাস্তের সাথে চলে গেছে”বা/ সূর্য উদয়ের সাথে এসেছিল খেতে / ...সাতটি তারার তিমিরে / খেতে প্রান্তরে –বা“শিশু অনপনেয় ভাবে / কেবলি যুবক হল সকলেরই মৃত্যু হবে —মরণ হতেছে।”সূর্যকে ঘিরে।যুবকেরা খবির হয়েছে, চেনা-অবেলা কালবেলা / পৃথিবী মৃত্যু যখন অপ্রত্যাশিত ভাবে আসে, জীবনানন্দের মতে তা আকাক্ষিত, কারণ তা বিপন্ন বিস্ময়ের মুখ হতে, টুকরো টুকরো মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। ক্যাম্পে' কবিতায়, ‘বনলতা সেন'-এর শিকার, ‘আট বছর আগের একদিন' এবং 'অন্ধকার' কবিতায় কবির এই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। “অন্ধকারে স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছি।” কিন্তু মৃত্যু যখন দাঙ্গা হাঙ্গামা বা যুদ্ধে রূপ নিয়ে আসে কবি তার প্রতিবাদে বেদনার্ত। নিজেকে প্রশ্ন করেন, “এ আগুন, এত রক্ত মধ্যযুগ দেখেছে কখনো?” ‘রূপসী বাংলা’ কবির প্রৌঢ় বয়সের রচনা – তবুও সেখানে আছে মৃত্যুর অবসেসান। এখানে জীবনের নশ্বরতা হেতু মৃত্যুর আগমন ঘুমের সঙ্গে সামীপ্য লাভ করেছে।মৃত্যু অমোঘ সত্য, তবুও মৃত্যুকে উপেক্ষা করতেই কবি যেন প্রেমকে জড়িয়ে ধরেন।“জীবন হয়েছে এক প্রার্থনার গানের মতন তুমি আছ বলে প্রেম।” কবির ইচ্ছা “তুমি যদি বেঁচে থাক, জেগে রব আমি এই পৃথিবীর পর, যদিও বুকের পরে রবে মৃত্যু —মৃত্যুর কবর।” (প্রেম : ধূসর পাণ্ডুলিপি)। এখানে তিনি অ গবাদী, তাঁর আশাবাদ সূচিত করে মানুষের পরম বিশ্বাসকে। “মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়।” এই আশাবাদই কবির চিন্তা স্রোতকে চৈতন্যের দিকে উৎসারিত করে।“তবুও জ্ঞানের বিষন্নলোকী আলো/ অধিক নির্মল হলে নটীর প্রেমের চেয়ে ভালো সফল মানব প্রেমে উৎসারিত হয় যদি, তবে / আমরা চলেছি সেই উজ্জ্বল সূর্যের (বেলা—অবেলা—কালবেলা / অন্ধকার থেকে) অনুভবে
‘রূপসী বাংলা’ কবিতাগুলিতে ইংরাজ কবি কীটস্, জার্মান কবি রিল্কে, কবি ইয়েটস এবং ফেদেরিকো গার্সিয়া লোর্কার মৃত্যু চিন্তার তথা নির্জ্জনতাপ্রিয়তার খুব মিল আছে। ‘মহাপৃথিবী’-কাব্যের কবিতাগুলি যুগ পরিবেশ ও সময়চেতনার স্মারক। সময়চেতনা অর্থে জীবনানন্দ নিজেই বলেছেন,“মহাবিশ্বলোকের ইসারা থেকে উৎসাহিত সময় চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো, কবিতা লিখবার পথে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই এ আমি বুঝেছি, গ্রহণ করেছি।'
“সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চলে যেতে হয় / কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি/কোথাও আঘাত ছাড়া - তবুও আঘাত ছাড়া অগ্রসর সূর্যালোক নেই।”
মৃত্যুর অর্থ শূন্যতা বা অবলুপ্তি নয়, কবি এর মধ্যে প্রশান্তি খুঁজে পান, কেননা তিনি আশাবাদীর চোখে দেখতে পান, “নগরীর সিঁড়ি প্রায় নীলিমার গায়ে লেগে আছে। অথচ নগরী মৃত / সে সিঁড়ির আশ্চর্য নিৰ্জ্জন / দিগন্তের এক মহীয়সী আর তার শিশু। ঝরাপালক’ ও ‘ধূসর পাণ্ডুলিপির' ‘অন্ধকার নির্জনতা হতে জীবনানন্দ যেন বের হয়ে আসছেন। মানব চেতনা আর বোধ জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আলোকের অভিমুখে। এই মুক্তির পথের সন্ধান রূপকাশ্রিত ‘সাতটি তারার তিমিরে'। অধ্যাপক তপন কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, এ কাব্যের কবিতা “অধিকাংশই উৎকৃষ্ট, বিশেষ করে প্রথম কবিতা ‘আকাশলীনা’ একটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছশীতল জীবনানন্দীয় মূর্ছনা।' সমালোচক অশোক মিত্রের মতে একাব্যে হৃদয়োচ্চারণ স্তব্ধপ্রায়,মননস্পর্শী হয়ে তিনি আত্মদর্শনের জটিলতায় জড়িয়েছেন। সুনীল চন্দ্র সরকারের মতে এ কাব্যে emperical চিন্তা প্রধান বিশেষত্ব, এলিয়টের objective correlative-এর ব্যবহার সুপ্রচুর।
জীবনানন্দের শেষ কাব্যগ্রন্থ 'বেলা-অবেলা-কালবেলা' প্রধানতঃ সমসাময়িক জীবন যন্ত্রনা, হতাশা, গ্লানি, নৈরাশ্য ও বিচ্ছিন্নতা ভিত্তিক। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশবিভাগকে কেন্দ্র করে রচিত ‘১৯৪৬-৪৭’ কবিতায় গভীর অন্ধকার ছাড়া আলোর সন্ধান পাননি। অধ্যাপক নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, “ইতিহাসের গতি আজও শেষ হয়নি, মানুষ বহুমত, বহু প্রজ্ঞা, বহু ধর্মনায়ক আর রাষ্ট্রনায়কদের অনুগমন করে চলেছে কাল কালান্ত ধরে। সে হয়ত অনেক পেয়েছে, তবু কি সব পাওয়া হয়ে গেছে তার? কোথাও কি দেখা দিয়েছে 'অনির্বচনীয় স্বপ্নের সফলতা নবীনতা—শুভ্র মানসিকতার ভারে।” এ প্রশ্নের উত্তর নেই, তবে কবির আশা রাত্রির অবসানে দিনের মতই সেই সর্বপ্লাবী আনন্দের তরঙ্গে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, ক্ষোভ-গ্লানি, জরা-মৃত্যু একদিন নির্বাপিত হবে। এই অখণ্ড বিশ্বাসে কবি প্রার্থনা জানান;
“নবনব মৃত্যুশব্দ, রক্তশব্দ ভীতিশব্দ জয় করে মানুষের চেতনার দিন অমেয় চিন্তায় খ্যাত হয়ে তবু ইতিহাস ভুবনে নবীন
হবে নাকি, মানবকে চিনে
সেইসব সুনিবিড় উদ্বোধনে
তবু প্রাতটি ব্যক্তির বাস বসন্তের তরে
‘আছে আছে আছে' এই বোধির ভিতরে
চলেছে নক্ষত্র, রাত্রি, সিন্ধু, রীতি, মানুষের
বিষণ্ণ হৃদয়, জয় অনন্ত সূর্য, জয় অলখ অরুণোদয় জয়’
সমালোচক ও কবি তরুণ বন্দোপাধ্যায় এই উদ্ধৃতির সঙ্গে উপনিষদের ‘অসতো মা সদসময়' শ্লোকটির সমঅর্থ লক্ষ্য করে জীবনানন্দের চেতনার স্তরে উত্তরণকে প্রত্যয়ীভূত করেছেন।
আসলে কবিতার ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে কাব্যপরম্পরায় কবি এক স্থান হতে অন্যস্থানে একবোধ হতে অন্যতর বোধে, জাগতিক বৈচিত্র্য হতে চেতনার আনন্দলোকে ছুটে চলেছেন। এই ছুটে চলাই গতি এবং অনন্তের পথে গতিরূপ তরণীর কবি একজন যাত্রী, ডঃ দীপ্তি ত্রিপাঠীও একই কথা বলেছেন, “এই বিপন্ন বিস্ময় তো সৃষ্টির বেদনা। এই সিসৃক্ষা থেকেই কবির প্রাণে এসেছে গতির সঞ্চার। এই গতির সঙ্গে তাল রাখতেই কবিকে তাই যাত্রী হতে হয় অনন্তের দিকে। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন যে মানুষের জীবনে এইসব দুঃখ-দুর্দশা, খণ্ড খণ্ড জীবন ও মৃত্যুই সর্বশেষ কথা নয়। যদিও দুঃখ- দুর্দশা পৃথিবীকে অক্টোপাশের মতো গ্রাস করেছে –কিন্তু তবু মানুষ অমেয়া প্রাণশক্তিতে এই ক্লেদের বেড়াজাল ডিঙিয়ে অক্ষয় সৌন্দর্যলোকে পৌঁছতে পারবে। তার অনন্ত প্রাণযাত্রা সফল হবে।” হাজার বছর ধরে পথ হাঁটা কবির প্রেমানুভূতি কেন্দ্রীভূত হয়েছে ‘পাখীর নীড়ের মতো চোখের বনলতা সেনের মধ্যে। কবির প্রেমানুভূতিই তার উত্তরণের সোপান। বনলতা সেন কবির এই আবেগের প্রতীক। হাজার বছর ধরে পথ হাঁটার অর্থ কবি সময়ের গতিতে বাঁধা নন। বর্তমান হতে অতীতে এবং অতীত হতে বর্তমানে তথা ভবিষ্যতে তার অবাধ গতি। এলিয়টের 'objective reality of Time' তত্ত্বের সঙ্গে এই কবিতার অখণ্ড সময় নির্ধারণের সাদৃশ্য বর্তমান। ‘Four Quartets'- এ এলিয়ট বলেছেন,
"Time present and Time past
Are both contained in time future
And Time future contained in time
past."
এ হল unending extent of time বা সমাপ্তিহীন অখন্ড সময় যাকে বলা যায় transcend time বা Eternity। ‘বনলতা সেন' কবিতার প্রেমানুভুতিই পরবর্তী বৃহত্তর পটভূমিকায় বিস্তৃত হয়েছে। বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় কোথাও তার প্রাণ নেই বলে অর্থময় / জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে, জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই।” এ প্রেম ঈশ্বর প্রেমনয়, ‘ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোন সাধনার ফল' – যা মানুষের প্রতি প্রেম। 'আমরা অন্তিম মূল্য পেতে চাই প্রেমে।'
এই অর্থেই জীবনানন্দ মুক্তিপথের দিশারী – শান্তির সাধক, প্রেমের ঋত্বিক, অনন্তের পথে তরণীর কর্ণধার। অন্ধকার হতে চেতনার ধাপে ধাপে তার উত্তরণ। আলো ও অন্ধকারের দোলাচলে দুলছেন সাময়িক ভাবে, জীবনের ভাণ্ডার অভিজ্ঞতার ফসলে পূর্ণ করে পাড়ী দিয়েছেন। প্রেমের অনুভূতির শ্বেতচন্দনে চর্চিত হয়ে পনিষদের ঋষির মতই বলে গেছেন সুচেতনার উদ্দেশ্যে “এই পথে আলো জ্বেলে পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে।”
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘ক্ষণবাদ’ “মালার্মে প্রদর্শিত কাব্যাদর্শই আমার অনিষ্ট” বলেছেন সুধীন্দ্রনাথ। তিনি আরও বলেছেন, “কবিতার মুখ্য উপাদান শব্দ।” মালার্মের কাব্যকথা প্রসঙ্গে তিনি জানান যে মালার্মের ‘জটিল চিত্রকল্প অবিচ্ছেদ্য, তাঁর ভাষা ব্যঞ্জনামূলক শব্দের ধাতুগত প্রয়োগে দুরূহ, তাঁর অভিপ্রায় ব্যাকরণ মানলেও অন্বয়ের শাসনমুক্ত।” একথা সত্য যে উনিশ শতকে মনোবিকলন তত্ত্ব প্রবর্তিত হওয়ার পূর্বেই মালার্মে শব্দ সুর এবং সর্ব উপকরণ সন্নিবেশের গূঢ় রহস্যটি কবিতায় প্রয়োগ করেছেন। তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলা হয় “he * wrote methodically; he
constructed a skeleton, significant words deliber- ately scattered over his
maiden sheet, prearranged schemes of rhyme and within these limits the poem had
only to build it self." সুধীন্দ্রনাথও সেই অর্থেই শব্দবাদী, ক্লাসিক আঙ্গিকের কবি যেন ধ্রুপদী ছান্দসিক। সাংগীতিক স্পন্দনে শব্দের শাসন ধ্বনিময়তায় উত্তীর্ন। রবীন্দ্র স্নেহধন্য হয়েও রবীন্দ্র প্রভাবকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, কিন্তু রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পাঠকদের সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য “যারা কবিতাকে ছুটির সাথী বলে ভাবে, কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃৎকম্পন অনুভব করতে চায়, তাদের কবিতা না পড়াই উচিত। কবিতার গঠন যেমন প্রতি লাইন বিশ্লেষণ করে ধরা যায় না, তার ভাবার্থও তেমনি খণ্ডাকারে ধরা যায় না, তা বিরাজ মান থাকে সমগ্রের মধ্যে। তা শুধু মেঘ-বাঁশী-প্রিয়া-বিরহ-মিলন ইত্যাদি জরাজীর্ণ শব্দের করতলগত নয়, শুধু প্রেম, বেদনাও প্রকৃতিকে নিয়ে কাব্যের কারবার চলেনা, তার লোলুপ হাত দর্শন বিজ্ঞানের দিকেও আস্তে আস্তে প্রসারিত হচ্ছে। আজকের এই বিশেষ জ্ঞানের দিনে কাব্যের তরফ থেকে আমি পাঠকের কাছে সেই নির্দিষ্ট অনুশীলন ভিক্ষা করি যেটা সাধারণত অর্পিত হয় অন্যান্য আর্টের প্রতি।”(দেশ সাহিত্য সংখ্যা)
ব্যক্তিগত জীবনে সুধীন্দ্রনাথ জীবনের সত্য সন্ধানে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দর্শন” চিন্তাশীল অভিব্যক্তিকে আয়ত্ব করেছিলেন। এলিয়ট, মালার্মে, ভ্যালেরি, বোদলেয়ার, রিল্কে, এমন কি রবীন্দ্রনাথের অনুভবের দ্বারস্থ হয়েছেন। ‘কাব্যের মুক্তি' গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ‘কাব্যের মুক্তি পরিগ্রহণে এবং কবি যদি মহাকালের প্রসাদ চায়, তবে শুচিবায়ু তার অবশ্য বর্জনীয়, তবে ভুক্তাবশিষ্টের সন্ধানে ভিক্ষা পাত্র হাতে নগর পরিক্রমা ভিন্ন আর গত্যন্তর নেই।” সুধীন্দ্রনাথের কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ সালের ২৮শে জুলাই এক পত্রে জানান, “কাব্যে তোমার একান্ত স্বকীয়তা আর সমস্ত কিছুকে অতিক্রম করে প্রকাশ পেয়েছে, তোমার কবিতা যেখান থেকেই গয়না নিকনা রূপ তো তারই—নিজের চেহারা বন্ধক রেখে সে কিছুই ধার নেয়নি।” রবীন্দ্রনাথ উল্লেখিত সুধীন্দ্রনাথের কাব্যে স্বকীয়তা বলতে কি বোঝানো হয়েছে সে বিষয়ে প্রশ্ন জাগতেই পারে। সুধীন্দ্রনাথের জীবনদর্শনে যুগের প্রভাবে স্বর্ ' সিসি একারণেই বিশেষ প্রয়োজন। কালবিপর্যয়ের সেই যুগে তিনি নিজেকে ভেবেছেন ‘কালের কৌতুক', বলেছেন 'অস্তমিত বিধির আমি ভুল'। সমর সেন কবি সুধীন্দ্রনাথের অবস্থানটির পারম্পর্য বিচানে সবিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন “দুটি পৃথিবীর মধ্যে তিনি দণ্ডায়মান, তার একটি মৃত, আর একটি জন্মাবার ক্ষমতাহীন। উত্তরকালে তাঁর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই, পূর্ব কালের স্মৃতি তার কাব্যকে ভারাক্রান্ত করেছে।” পৃথিবী নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা জীবনানন্দও বলেছেন। তিনি আশাবাদী তাই আর এক পৃথিবীর তিনি স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু সুধীন্দ্রনাথের সে প্রত্যয় বা ধৈর্য কোনটাই নেই। তিনি সমষ্টির সঙ্গে ব্যক্তিকে মেলাতে না পেরে, রোমান্টিক ভাব বিলাসকে প্রত্যাখ্যান করে মরুভূমিতে মরুদ্যান খুঁজেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, 'অতল শূন্যের শেষে পড়ে আছি আমি নিরাশ্রয়’। সব কিছু দেখে শুনে তিনি বুঝেছেন সকলই নশ্বর – কিছুই থাকে না। ঐশ্বরিক ভাবনার সঙ্গে অন্বিষ্ট নন বলেই, বিকল্প কিছুকে গ্রহণ করতে পারেননি। কেননা তিনি মনে করেন চতুর্দিকে এই দুর্নিবার অবক্ষয়ের মধ্যে জড়ের সঙ্গে জীব মেলে না। নিরাশ্রয় জীব তাই স্বতন্ত্র এবং ঈশ্বর মৃত। বিশ্ব সংসারে এই একাকীত্ব, এই স্বাতন্ত্র্য এই শূন্যতাবোধই সুধীন্দ্রনাথকে শূন্যতাবাদী বা ক্ষণবাদী হয়ে উঠতে বাধ্য করে। আত্মঘোষণায় তিনি বলেন;
“আমি ক্ষণবাদী, অর্থাৎ আমার মতে হয়ে যায়/ নিমেষে তামাদি আমাদের ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ, তথা / তাতে যার জের, সে সংসারও। অথচ সময় ভূত / থেকে ভবিষ্যতে ধাবমান নয়। (উপস্থাপন)
টি. এস. এলিয়টের প্রভাব আছে তাঁর কাব্যে, কিন্তু এলিয়টের সমাধা। সূত্রে তিনি পৌঁছতে পারেন নি। The Waste Land-এর পটভূমি মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, বিশ্বব্যাপী ধ্বংসলীলা, যুদ্ধ ও দাসত্বের ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন। 'Here is no water but only rock /
Rock and no water and the sandy road' I এই অন্তঃসারহীন শূন্যতা শেষে এলিয়ট শুনিয়েছেন হোলি গ্রেল আর উপনিষদের বাণী। ‘The Hollow Men'-এর মানুষেরা “We are the hollow men / We are the
stuffed man / Leaning together / Head piece filled with straw”। এরা ধ্বংস হবে, সৃষ্টি হবে তার পরে। ‘Ash wednesday'-তে রয়েছে এই নির্যাস “The loftiest desire of each thing
is the desire of returning to its first cause"। এলিয়টের প্রভাব থাকলেও সুধীন্দ্রনাথ এতটা ভাবেন নি, ঈশ্বর তাঁর কাছে সান্ত্বনার শেষ আশ্রয়স্থল নয়। নশ্বরতা বোধে কাতর হয়েছেন রবীন্দ্রনাথও। তবে খণ্ড কাল হতে অখণ্ডের দিকে যাত্রায় এই নশ্বরতা, কাতরতা অবলুপ্ত হয়ে শাশ্বতের অনুধ্যানে তিনি মগ্ন হয়েছেন। দেহগত সৌন্দর্যবোধকে অখণ্ড সৌন্দর্যসত্তায় উন্নীত করে তিনি বিশ্ব সৌন্দর্যের মূলে উপনীত হয়েছেন। খণ্ডকাল যে এক অখণ্ড কালপ্রবাহের অংশবিশেষ তা তাঁর কাব্য কবিতায় উন্মোচিত হয়েছে। সীমার মাঝে অসীমের সন্ধানী তিনি—তবু তা ক্ষণকালকে অস্বীকার করে নয়। “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।” ক্ষণকালের দাবির কথা তিনি জানেন। “হাসি মুখে নিয়ো ফুল, তার পরে হায়/ ফেলে দিয়ো ফুল যদি সে শুকায়।” (প্রাণ / কড়ি ও কোমল)। ভৈরবীগান (মানসী) কবিতায় তিনি জানান ‘সংকটময় কর্মজীবন, মনে হয় মরু সাহারা' এবং 'এই মায়াময় ভবে চিরদিন কিছু রবে না।” এমনই আছে ‘সোনার তরী’, ‘মহুয়া’, ‘ক্ষনিকা' কাব্যেও। ক্ষণকালকে চিরকালের প্রেক্ষাপটে জন্মান্তর বাদের মধ্যদিয়ে টেনে এনেছেন, কিন্তু লক্ষ্য স্থির আছে অমৃত লোকের উৎস সন্ধানে। জীবনানন্দও প্রথম দিকের কাব্য 'ধূসর পান্ডুলিপি’, ‘রূপসী বাংলা' ইত্যাদিতে নিৰ্জ্জনতার মধ্যে মৃত্যু চিন্তায় বিভোর থেকেও শেষ পর্যন্ত চেতনার ক্রমোত্তরণে মানুষের পৃথিবীতে সুখ স্বর্গের সন্ধান দিয়ে গেছেন। কিন্তু সুধীন্দ্রনাথ তা করেন নি। তিনি ঘোরতর শূন্যবাদী নাস্তিক বলেই অমৃতলোকের চিন্তা তাঁর মাথায় আসেনি। পক্ষান্তরে বাইবেলের স্বর্গ কল্পনাকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন।
সুধীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তন্বী’ কাব্যে যৌবনের দেহজ কামনা, আবেগ, রূপানুরাগ, স্মৃতিচারণ ইত্যাদি আছে। লীলা সঙ্গিনীর সঙ্গে মিলনের প্রত্যাশায় কবি বলেন, ‘তোমার প্রমোদ কুঞ্জ রচিত কি বৈতরণী তীরে, হে মোর ক্রন্দসী?' এ কাব্যে যেমন শব্দ কুশলতা নেই, তেমনইনেই কোন দর্শন যার অভিব্যক্তি প্রকাশে কবি ছিলেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পরবর্তী কাব্য ‘অর্কেস্ট্রা’ স্ববীয়তায় উজ্জ্বল। সংশয়, নৈরাশ্য, বিষাদে ভরা কন্ঠে কবি বলেন, ‘জানি মুগ্ধ মুহূর্তের অবশেষ নৈরাশ্যে নিষ্ঠুর / তবু জীবনের জয় ভাষা মাগে অধরে আমার।' তাঁর সুখ স্বর্গ “বক্ষের যুগল স্বর্গ।” কবির ব্যক্তি মানুষ ‘অর্কেস্ট্রা’য় খুবই স্পষ্ট । এখানে ক্ষণিকের তৃপ্তিতে কবি ব্যাকুল, অন্যদিকে আলোর পথে উত্তরণের অঙ্গীকার পরস্পর বিপরীত দুই ভাবের সহাবস্থান।
কবি মানসিকতার নেতির ভাব বা নাস্তিগহ্বরের অন্ধকার গুহায় হৃদয় যন্ত্রনার বিশেষ প্রকাশ ঘটেছে ‘ক্রন্দসী' কাব্যে। সমর সেনের ভাষায় এ কাব্য শূন্যমুখী শিকড়, উৎপাটিত গাছের ছবি।' ব্যক্তিক ভাবনায় কবি ভাবেন, “নব সংসার পাতি গে আবার চলো / যে কোনও নিভৃত কন্টকাবৃত বনে মিলবে সেখানে অন্ততঃ লোনা জলও / খসবে খেজুর মাটির আকর্ষণে।” কিন্তু এই ভাবনাও সংশয় শূন্য নয়। “ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?” দেহসর্বস্ব প্রেম, বাচাল মানসিকতা, ক্ষনিক তৃপ্তির আস্বাদ - কবিকে সাময়িক শান্তি দিলেও, মর্মান্তিক হতাশার-অসহিষ্ণু প্রতিবাদও মুখর হয়ে উঠেছে। শক্তির জন্য প্রার্থনায় কবি বলেন, “হানো তীক্ষ্ণ সর্বনাশা, তীব্র ক্ষতি, বৈরিতা নির্মম / জুগুপ্সার শক্তি দাও, দাও মোরে নির্গুণ নির্বান।” কখনও বা একাকীত্বের নির্মম নৈরাশ্যে কবি কণ্ঠ স্তব্ধ হতে চায়, “জীবনের সার কথা পিশাচের উপজীব্য হওয়া / নির্বিকারে নির্বিবাদে সওয়া শবের সংসর্গ আর শিবার সদভাব / মানসীর দিব্য আবির্ভাব সে শুধু সম্ভব স্বপ্নে, জাগরণে আমরা নিত্য একাকী।” আবার ক্ষনবাদীর কন্ঠে সংশয়ও ধ্বনিত হয়, তবে কি বিরাট শূন্য শূন্য নয়?” ‘অর্কেস্ট্রা’-য় নায়কবেশী কবি কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, “মায়ামৃগী, তুমি বন্দিনী আজ আমার গেহে /আমরা অমরা আশ্রিত তব মানুষী স্নেহে', ‘উত্তর ফাল্গুনী’র ‘দ্বন্দ্ব’ কবিতায় সেই একই সুর। “আজিকে দেহের পালা, রিক্ত সেজে শুয়ে তাই ভাবি হয়তো বা তারই কাছে পড়ে আছে অমরার চাবি।” অর্কেস্ট্রার মানসিকতায় প্রত্যাবর্তন ঘটেছে উত্তর ফাল্গুনী'তে। এখানে কবির অভিজ্ঞতা তবু জন্মাবধি যুদ্ধে, যুদ্ধে বিপ্লব বিপ্লবে / বিনষ্টির চক্র বৃদ্ধি দেখে, মনুষ্য ধর্মের হল, স্তরে নিরুত্তর অভিব্যক্তিবাদে অবিশ্বাসী প্রগতিতে / যত না পশ্চাৎপদ, ততোধিক । মুখঅতীতে।” দ্বৈত সত্তার একটি যখন কবিকে ব্যক্তিসত্তা হতে বিশ্বসত্তায় উদ্বোধিত করতে চায়, অন্য সত্তাটি তখন রাশ টেনে ধরে আত্মরতিতে মগ্ন থাকার মন্ত্র দেয়। আসলে কবি আদ্যন্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইনডিভিজুয়ালিষ্ট” বলেছেন অরুন সেন। হয়তো ক্ষণবাদের অসীম শূন্যতার মধ্যে অন্তরীন হওয়ার এটাই কারণ। দশমী’তে কবির সিদ্ধান্ত অটল হয়ে ওঠে। “অতএব কারো পথ চেয়ে লাভ নেই / অমোঘ নিধন শ্রেয় তো স্বধর্মেই।” ‘দশমী’ হল আত্মজ্ঞানহীন কামুকতার শেষ দশা। যযাতির মতই ভোগাক্রান্ত, বেলাশেষে যযাতির মতোই নিরাশ্রয়। নচিকেতার মত অমৃতের সন্ধানী হতে চেয়েও সংশয়ী দৃষ্টি দূর হয়নি। রবীন্দ্রনাথের নিরাশক্তি তিনি আয়ত্ব করতে পারেন নি, তাই তার বৈদান্তিক মন নশ্বরতার বেদনায় ম্লান - তিনি ক্ষণবাদী।
অমিয় চক্রবর্তীর অধ্যাত্মবাদ
অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য, অত্যন্ত কাছের জন, তবু তিনি রবীন্দ্র ঐতিহ্যবাহী বা রবীন্দ্রবলয়ের নন, স্বকীয় দৃষ্টি ভঙ্গির অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের মত বিশ্বপরিচিতি ও বিশ্ববোধ এবং বিশ্বাসের অধিকারী হয়েও কবিরূপে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য প্রায় শতযোজন। বুদ্ধদেব বসু উভয়ের পার্থক্য নির্ধারণে বলেছেন যে উভয়ের জগৎ মূলতঃ এক, কিন্তু উপাদানে ও বিন্যাসে সম্পূর্ণ পৃথক। রবীন্দ্রনাথের মতো স্থিতিবোধ বা ব্যক্তিগত জীবনে স্থায়িত্বের ভাব অমিয় চক্রবর্তীর জীবনে নেই। “তাঁর কবিতার পটভূমিকা চার মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথের যে সানাই-এর সুর কলকাতার গলির অসঙ্গতিকে মিলিয়ে দিয়েছিল, তাকে অমিয় চক্রবর্তী প্রয়োগ করেছেন আমাদের সমকালীন পরিচিত পৃথিবীর বিবিধ, বিচিত্র, পরস্পর বিরোধী তথ্যের উপর; যে পরিবেশের মধ্যে আমরা প্রতিদিন বেঁচে আছি এবং যুদ্ধ করছি, তার মিলনমন্ত্র একেবারে তার কেন্দ্র থেকে উত্থিত হচ্ছে। এই উপাদানের আয়তনও বৈচিত্র্য তাঁকে বৈশিষ্ট্য দিয়েছে, রবীন্দ্রনাথের কাছে যে পেয়েছেন তার ব্যবহারের ক্ষেত্র আলাদা বলে তাঁর কবিতার রসবস্তু ও স্বতন্ত্র, তাঁর কাছে আমরা যা পাই, রবীন্দ্রনাথ তা দিতে পারেন না।” (কালের পুতুল)।
কবিতার রং এর খেলা আধুনিক জগতের সামাজিক তথা ব্যক্তিক সঙ্কট, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, যুদ্ধ, দাঙ্গা এবং রাজনৈতিক আলোড়ন-এ সবই কবির অভিজ্ঞতার উৎস। এ সবই তার কবিতায় এসেছে ছবির মত। একটার পর একটা ছবি সাজিয়ে গড়ে তুলেছেন ছবির ইমারত। কোথাও প্রকৃতির মধ্যে সৌন্দর্যময়তার আস্বাদ, কোথাওবা মানব জগতের বাস্তব চিত্ররূপ। কিন্তু সর্বত্রই এক শান্ত স্নিগ্ধতা, এক অনাবিল পবিত্রতা, এক ব্যাকুলতাহীন প্রশান্তি দুর্বিষহ নগর যন্ত্রনার হাত হতে মুক্তির উপায় নির্ধারণ করে দেয়। কারণ কবির চেতনার মধ্যেই সত্য, শিব ও সুন্দরের একাত্মভাব। রবীন্দ্রনাথের মত তিনিও বিশ্বাস করতেন যে শুভত্বের, সুন্দরের বিনাশ নেই। অমিয় চক্রবর্তীর স্বাতন্ত্র্য এই যে তিনি যুগের প্রয়োজনে শুভত্বের আবির্ভাবের কথা চিন্তা করেছেন এবং এই শুভত্ব অশুভকে ধ্বংস করবে না, তাকে আদ্যোপান্ত শোধন করে মিলিয়ে নেবে।
“প্রাণ নেই, তবু জীবনেতে বেঁচে থাকা / মেলাবেন।/ তোমার সৃষ্টি, আমার সৃষ্টি, তাঁর সৃষ্টির মাঝে / যত কিছু সুর, যা কিছু বেসুর বাজে / মেলাবেন।” সংগতি / খসড়া এই তার জীবন দর্শন, এটাই তাঁর কবিতার দার্শনিক তত্ত্ব। রোম্যান্টিক কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতির মধ্যে ঐশী শক্তির পরিব্যপ্ত রূপকে প্রত্যক্ষ করে মানুষ, প্রকৃতি এবং ঐশীশক্তির মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতিকে জীবন্ত সত্তা ভেবে তিনি বলেছেন,
In all things, in all natures, in the
stars
The active principle abides, from
link to link,
It circulates the soul of all the
worlds."
অমিয় চক্রবর্তী মিষ্টিক নন, সর্বেশ্বরবাদীও নন, তবু তার সৌন্দর্য পিয়াসী মন আনন্দরসের সন্ধানে প্রকৃতির মধ্যে ডুব দেয়। প্রকৃতির আনন্দ সুধা পান করে তিনি শুনতে পান মানবপ্রীতির মহামিলনের গান। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ঐশীসত্তার পরিব্যাপ্ত রূপ প্রত্যক্ষ করেছেন, অন্যদিকে অমিয় চক্রবর্তী শুনেছেন মহামিলনের গান। এ প্রকৃতি ওয়ার্ডসওয়ার্থের নয়, কীটস্-এর ইন্দ্রিয় সংবেদনশীল প্রকৃতি। কীটস্ শব্দ সম্ভারে চিত্ররূপময়তার উদগাতা। অমিয় চক্রবর্তী শব্দ সম্ভারে খণ্ড খণ্ড বিভিন্ন চিত্রের শৃঙ্খলা ও সংহতি রক্ষা করে মালা গাঁথেন। জীবনানন্দ যা পারেন নি, অমিয় চক্রবর্তী দর্শনমনস্কতায় যুগযন্ত্রনার হাত হতে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছেন। সমাজ ও বিশ্বের মঙ্গলের জন্যে মানবচেতনা ও ঈশ্বরচেতনাকে একই সরলরেখায় চিত্রিত করেছেন।
‘একমুঠো’ কাব্যের ‘চেতন স্যাকরা’ কবিতায় কবি প্রতীকের মাধ্যমে মানুষের সৃষ্টিশীল শুভ চেতনাবোধ উন্মেষের কথা বলেছেন। জনজীবনের ক্লেদাক্ত পঙ্কিল আবর্ত হতে পালিয়ে গিয়ে নয়, সকলের মধ্যে থেকে সকলের জন্যে মুক্তিকামী আত্মার শুভ উদ্বোধন চেয়েছেন। এলিয়টের ‘The Waste Land'-এর প্রভাব এ কবিতায় কিছুটা হয়তো পড়েছে বিশেষ করে খণ্ড খণ্ড চিত্রে সামাজিক বাস্তবতার নগ্নরূপকে যে ভাবে তিনি তুলে ধরেছেন, তা এলিয়ট মনস্কতার সামিল। 'The Waste Land'-এর 'A Game of Chess'- এর ‘The Fire Sermon' -এ এলিয়ট নগরজীবনের যে চিত্র এঁকেছেন তাঁর সঙ্গে ঐক্য আছে অমিয় চক্রবর্তীর খণ্ড খণ্ড চিত্ররূপের।
“আড়ৎ বেঁধে আছো বাঁচো (কিমাশ্চর্য বাঁচা) এবং,/ যমের কৃপায় মরা, অমৃতস্য অধম পুত্র, বন্দী সাঁৎসেঁতের গলির ঘরে ইঁদুর ভরা;/ নেই রাগ।—অবশ্য আছো আনন্দে/ খাও ভেজাল ঘিয়ের জিলিপি,/ শিশু কাঁদার, ধোঁয়ার সংসার, খুনে ওষুধের ছিপি/ মা-বোনকে খাওয়াত - দয়ার ডাক্তার অন্তিম লাগলে,/ তৎ পূর্বাবধি রান্নার পাকে ক'ষে ঘোরাও; নিজে ভাগলে / শক্ত সিনেমার সীটে, ইতর প্রানের গিল্টি। মুখ ভরা পান, দৃশ্য হলিউড, মোক্ষের পিলটি / ভোলার ধিক্কার, সন্ধ্যেটা কাটে / তবু রাত্রে জেগে ভাবো ভাবোই / কিছু একটা হয়তো হবে, বুঝিবা কোথাও যাবো, পাবোই / কোথাও যাবেনা, গলিতেই থাকবে / বড়ো রাস্তায় যাদের বাসা হাঁ করে দেখবে তাদের মোটর, পনেরোটা বেড়াল,/ শখের চাকর - থাকবে খাসা,” সমালোচক শীতল চৌধুরী বলেছেন “এই কবিতাকে কবি অমিয় চক্রবর্তীর এক দার্শনিকতায় আচ্ছন্ন একটি আত্মশুদ্ধি বীক্ষণের এক চৈতন্যরূপময় কবিতা বলা যেতে পারে।” শূন্যগর্ভ রিক্ততার বেদনায় এলিয়ট, সেন্ট অগাস্টাইন ও বুদ্ধের শিক্ষায় শান্তিতে প্রত্যক্ষ করেছেন, "To Carthage then I came / Burning burning burning
burning / Oh Lord thou pluckest me out / o Lord, thou pluckest / burning" মানুষের মনুষ্যত্ববোধকে, জীবনের মূল্যবোধকে উদ্বোধিত করতে তিনি সময়ের ক্লেদাক্ত পঙ্কিলতাকে দূর করতে যেন বদ্ধপরিকর। যুদ্ধের নিষ্ঠুর ধ্বংসলীলার মধ্যেও তিনি পথ ভ্রান্ত হন নি। “পারো যদি মানুষ কবি / নিয়মছন্দে প্রাণের হও নূতন / নিয়ামক, ঝড়ের মূঢ় বিশ্বে, জাতীয় পঙ্কে।/ করো বীর্যের টেকনীকে নিয়ন্ত্রন/ আদর্শিক কাজ, যা মানবের / নয় রক্তপূজা কালীর অথবা কলির ('যুদ্ধের খবর) বিবিধ আধুনিক চাতুরী নরবলির।” ছিন্নমূল মানুষের কোন ধর্ম নেই, চৈতন্যের উদ্বোধনে তারা পরান্মুখ বলেই কবির প্ৰাৰ্থনা; “নির্যাতিত দেশ, জলমগ্ন শিশু, উপড়ে ফেলা গ্রামবাসী / দাও স্বত্ব, দাও স্বত্ব / মানুষকে মনুষ্যত্ব।
কবির বাণী, কিন্তু মনে হয় যেন ধ্যানী প্রাজ্ঞের - যা মহাসমরের মধ্যে দাঁড়িয়েও গীতার বাণীর মত স্মরনীয়। এটা সম্ভব হয়েছে কবির মনোমঙ্গলের প্রবাহমানতায়, মানবজাতির প্রতিনিধিস্তরে উন্নীত হয়ে ধনী দরিদ্র, অত্যাচারী-নির্যাতিত, যুদ্ধবাজ ও শান্তিকামী সকল মানুষের মধ্যে পরমানন্দময় মৈত্রীর স্বপ্ন দেখেছেন। কোথাও কোন বিদ্রুপ নেই, শানিত কষাঘাত নেই, ঘৃণার অভিব্যক্তি নেই, সবই বলা হয়েছে চেতনালব্ধ
আত্মিকজ্ঞানে, আনন্দের আলোকে, মিলনের মহান প্রর্থনায়।
‘সবলতা আশ্চর্য করে দেবতাকে', বলেছেন রিল্কে।
“Praise this world to the Angel, not to the untellable; You
Can't impress him with the splendour You've felt; in the Cosmos. Where he more
feelingly feels You're only a novice, so show him Some simple things,
refashioned by age after age till it lives in our hands and eyes as a Part of
ourselves. Tell him things. He'll stand more astonished; as you did Beside the
roper in Rome or the Potter in Egypt."
অমিয় চক্রবর্তীর পারাপার কাব্যের ‘গাছ’ কবিতাতেও সবলতার মধ্যে দিয়েই আধ্যাত্মিক
চেতনাবোধ রূপ পেয়েছে। “মধ্যাহ্নের রিক্তপটে রৌদ্র লেগে / ঐ দেখো বৃক্ষচ্ছবি আছে জেগে / ধ্যানের মতন ।/ বিশুদ্ধ তাকে দেখো, মন। / আলোয় রয়েছে ডুবে, হাওয়া তাকে যায় স্পর্শ করে / মন্ত্র লাগে তাকে মৃত্তিকার দান / করায় প্রাণের রসপান / সর্বহীন / আছে তবু সর্বমাঝে, চেতনায় হয়েছে সে লীন / অস্তিত্বের গুঢ় যোগে পরম সত্তায়, তাই আজ সবারে সে পায়।”
রবীন্দ্রনাথ যেমন প্রার্থনা করেছিলেন;
“চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির / জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর আপন প্রাঙ্গন তলে দিবস শর্বরী / বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি, '
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে অমিয় চক্রবর্তীও তেমনটি ভেবেছেন। সীমানার বেড়াজালে আবদ্ধ বিশ্ববাসী ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে বিভক্ত। জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে হানাহানি, বৃহৎ শক্তির সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব এসব কিছুকে অস্বীকার করেই তিনি অনিঃশেষ কাব্যে 'প্রাণের ভৎসনা' কবিতায় বিশ্ববাসীকে এক যৌথ পরিবারের সদস্যরূপে দেখেছেন। ভ্রাতৃত্বের এই মেলবন্ধনই তাঁর জীবন দর্শন।
“লিপি এই রাখি তবে; যৌথ পরিবার বিশ্বে জানি
মহাকাল প্রবাহিত সর্বাস্তির বহে গূঢ় ধারা
ভাই বোন প্রতিবেশী বৃক্ষচ্ছায়া সূর্যের মুকুরে।”
বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের যুগকে কবি অস্বীকার করেন নি। কিন্তু বিজ্ঞান তাকে তথাকথিত বিজ্ঞানমনস্ক করে নি, তিনিই বিজ্ঞানকে তাঁর চেতনার মধ্যে সংযোজন ও সংহত করেছেন। এই বিজ্ঞান চেতনাই তাকে করে তুলেছে আধ্যাত্মিক। যতদিন যাচ্ছে, ততই বিজ্ঞানের সঙ্গে অধ্যাত্মবাদ-এর দূরত্ব কমে আসছে। কবি বিজ্ঞান চেতনা, কাব্য ভাবনা ও দর্শন সুলভ মনোভঙ্গীকে একত্রে মিলিয়ে আত্মার উত্তরণকে রূপকায়িত করেছেন ‘খসড়া’ কাব্যগ্রন্থের 'ইলেকট্রিক ফ্যান' কবিতায়।
ধ্বনি / ঘর্ঘর-ঘর্ঘর হ'তে .... ওম্ / ঘুরে ঘুরে শব্দের চার-পাখা এক ছায়া / শব্দ মন্ত্র কায়া / ধ্বনি— ওম্ / মনিপদ্মে হুম / লক্ষ-ভোল্ট বিদ্যুৎ-ঘোরা, I / বিশ্ব ছোটে ঝটিকায় মেলে শেষ অব্দে / কোটি কোটি ভ্রমর তুরীয় শব্দে।” বিজ্ঞান চেতনা দিয়েই তিনি মহাকালের করাল আবর্তনের রহস্য উদ্ঘাটন করেন। “অন্ধকারে উঠে দেখি হাত ঘড়ি / হাতে নয়, খোলা আকাশে / রেডিয়ম জ্বালা সময়/ দপ্ দপ্ করছে শূণ্য জুড়ি / চোখ নামাই / লক্ষ তারার তৈরী ঘড়ি / ঘণ্টা বেজেছে? চক্রে চক্রে য় কাঁটায় চলছে নেচে / কালের ডায়ালে, ঘুর্ণনায় / সুইস মেক নয়, শব্দ নেই / সেকেন্ড মিনিটের অনুপ্রাসে।”
এ যুগ যন্ত্র সভ্যতার, যুগের মানুষ যান্ত্রিকতার ছাঁচে ঢালা – অবক্ষয়িত, নির্যাতিত। কিন্তু তারা এক মহাসত্যের মধ্যে আবর্তিত। এই মহাসত্যের আবর্তনের কথা অবক্ষয়িত সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করতে পারে না। যুগন্ধর মনীষীরা এই সত্যকে জেনে প্রকাশ করেন তাঁদের বাণী ও কার্যের মাধ্যমে। এই মহাসত্য কোন ধর্মীয় তিবাদের মধ্যে সীমায়িত নয়। কোন ধর্মীয় আচার আচরণ (ritual), কোন সাম্প্রদায়িক মতামত বা নীতিগত আদর্শ এর সোপান হতে পারে, কিন্তু মহাসত্যে উপনীত হওয়ার একমাত্র পথ নয়। এই মহাসত্য ধ্যানের দ্বারা লব্ধ। কবি অমিয় চক্রবর্তী কোন ধর্মীয় সংস্কারে আবদ্ধ নন। তিনি ধ্যানী ঋষির মতই এই প্রজ্ঞাকে উপলব্ধি করেছেন। ধ্যানী যোগী ও ধ্যানী কবির মধ্যে পার্থক্য খুব সামান্যই। যেটুকু পার্থক্য আছে তা হল কবি প্রজ্ঞার দ্বারা পাসকে জেনে ভাষা ও ছন্দে তা প্রকাশ করেন। উপনিষদের ঋষি বলেন 'সর্বং খল্বিদং ব্রয়’, বেদান্ত বলে মানুষই ব্রহ্মস্বরূপ, সন্ন্যাসী বলে সবার উপরে মানুষ সত্য' কবি অমিয় বলেন “শূন্যতা অনন্ত হয়ে ফিরুক আবার / প্রসারিত মনের পূর্ণতায় / দাও কিছু নদী দৃষ্টি, সমতা সংসারে, ফুল ফল / প্রতিচ্ছবিময় পরিবেশ / প্রবাহিত মেঘছায়া / পরেপরে নিরঞ্জন নানা রঙে / আলোর আকাশে দিব্য চোখে / দেখা দিক ধুলির শ্রীভূমি / এই প্রাণ লোকালয়ে।”
মূলতঃ তিনি কবি। তাই তাঁর যাবতীয় উপলব্ধি মানব জাতির কল্যাণে, সুন্দর ও মঙ্গ লের একনিষ্ঠ পূজায় নিবেদিত। অধ্যাত্মচেতনা ব্যতিরেকে যুগের বেদনা যন্ত্রনাকে অতিক্রম করা যায় না। এটা উপলব্ধি করেই তিনি আধ্যাত্মিক চেতনা বোধের দ্বারা নিজেকে স্থিতধী করেছেন। কামনা করেছেন যে কবির মন পাক বৃহত্তর অস্মিতাবোধ পেয়েছিলেন শিল্পী বেটোফেন।
যা “শিল্পের তন্ময়ী গুরু বেঠোভেন শব্দধ্যানে একা / তর্জমা করেন সৃষ্টি মগজের সংগীতের ঝড়ে / অসম সুষম এক প্রকাণ্ড একক সিম্ফনিতে।” (সঙ্গ / পালাবদল)
বিষ্ণু দে
'এলিয়টের কবিতা আপাতদৃষ্টিতে জটিল ও দুরূহ। বিষ্ণু দের প্রথম পর্বের কবিতাও গেই। এলিয়টের কবিতার দুরূহতা সম্পর্কে যে কারণগুলি নির্দেশ করা হয়েছে তা হল তাঁর Mythical method, symbolic technique, implication, irony,
allusions, refer-ences, quotations এবং Literary remeniscences। বিষ্ণু দে'র কবিতায় দুরূহতা সম্পর্কে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তাও প্রায় এলিয়টের মতই। তাঁর কাব্যে দুরূহতা এত বেশী যে স্বয়ং কবি সমালোচক বুদ্ধদেব বসুও একবার বলেছিলেন “আমি অকপটেই স্বীকার করছি আপনার কোন কোন কবিতা আমি ভালো বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে চমকপ্রদ চিত্রকল্পের দেখা পাই ; মনের মধ্যে বিচিত্র ছবি ফোটে, আর ছন্দের কৌশল ধ্বনি মর্মরের মোহ ছড়ায়।” (কালের পুতুল)। হরপ্রসাদ মিত্র তাঁর কবিতা সম্বন্ধে বলেছো “কবিতার রাজ্যে সমকালীন 'ফ্যাশন'-এর প্রশ্রয়ে কিছু কিছু বাড়াবাড়ি ঘটে থাকে,— এও যেমন সত্য, যথার্থ কবি প্রেরণায় কবিতার ধারায় নূতন মনন, নূতন ভঙ্গি র অভ্যুদয় যে অবশ্যম্ভাবী, সেও তেমনি সত্য। যে কারণেই হোক বিষ্ণুবাবুর বেশির ভাগ লেখাই সাধারণ পাঠকের পক্ষে কতকটা দুষ্প্রবেশ্য ও কষ্টভেদ্য। সুতরাং তাঁর কবিতা পড়ে সাধারণ পাঠকের পক্ষে যে তৃপ্তি অধিগম্য তাকে বলা যায় সৎ প্রয়াসের সততা রক্ষার তৃপ্তি ।.......... তাঁর মন একাধিকবার বদলেছে, কিন্তু তাঁর কবি স্বভাবের পরিবর্তন হয়েছে সামান্যই। হয়তো তাঁর মন যত বিদ্যাময়, ঠিক সেই পরিমানে অনুভূতিময় নয়।”
বিষ্ণু দে'র কবিতার দুরূহতার কারণ হল তিনিও এলিয়টের মত ভারতীয় ও গ্রীক পুরাণের মিথ কাহিনী ও চরিত্রের মিলিত ভাবনা কবিতার মধ্যে প্রয়োগ করেছেন। এলিয়টের মতই প্রতীকী আঙ্গিক, ব্যঙ্গ, অনুপ্রাস এবং উদ্ধৃতির সাহায্য নিয়েছেন, এমন সব শব্দ ব্যবহার করেছেন যা অভিধান খুলেও ঠিকমত অনুধাবন করা যায় না। এলিয়ট “The 'ove Song of Prufrock' এ Prufrock-এর নৈরাশ্য বিহ্বল হিংস্রতা ও নারীমাংস লোলুপতার ভয়ঙ্কর ছবি এঁকেছেন প্রতীক এবং বাইবেলের ও শেকসপীয়রের নাট্যচরিত্রের প্রসঙ্গ টেনে। The Yellow fog that rubs its back
upon the window panes. The Yellow smoke that rubs its muzzle on the window
panes. Licked its tongue into the corners of the evening Lingered upon the
pools that stand in drains."
বিষ্ণু দে লিখেছেন, “কবন্ধ দুঃস্বপ্ন ঘেরে / মোক্ষহীন ভিক্ষুকের বিষন্ন আবেগ।/ হে বন্ধু এ নচিকেত মেঘ / আসন্ন মুমুর্ষাক্ষুব্ধ আমার পাতাল / ধুয়ে দিক, বজ্ৰযোগে বিদ্যুৎ অঙ্গারে /
উড়ায়ে পুড়ায়ে দিক বিহঙ্গের উজ্জীবনে / সঞ্জীবনী প্রতিষেধে, সাবিত্রির সম্পূরণে/ বেঁধে দিক হে সুশ্রুত, উদ্গতির হিরন্ময় জালে।” (জন্মাষ্টমী | পূর্বলেখ)। বিষ্ণু দে'র কবিতার মধ্যেও রয়েছে প্রতীক, পৌরাণিক মিথ এবং বিভিন্ন অনুষঙ্গ। তাঁর উর্বশী ও অর্টেমিস' কাব্যগ্রন্থে উর্বশী, উমা এবং উর্বশী, ডায়ানার পাশাপাশি আছে পুরুরবা, ট্রিষ্টান, ইসালেড, অর্জুন-চিত্রাঙ্গদা, কম্বনুনি, ভিনাস, ক্লিওপেট্রা এবং অর্টেমিস। ‘চোরাবালি’ কাব্যেও আছে ওফেলিয়া, ক্রেসিডা, দেবযানী, উলুপী, হৈমবতী, মহাশ্বেতা, উর্বশী, প্রশার্পিনা, হেলেন, মেনকা ইত্যাদির পাশে যযাতি, বিচিত্রবীর্য, দশরথ, ঋষ্যশৃঙ্গ, সাগর সন্তান, বৃহন্নলা ও শিখন্ডী। কুরুক্ষেত্র এবং ইন্দ্রপ্রস্থর পাশে আছে ট্রয়। দেশী বিদেশী মিথ নারী চরিত্রগুলি যেমন আদিম সৌন্দর্যের প্রতীক, তেমনি পাঠককে নিয়ে যায় এমন এক অনুভূতির রাজ্যে যা চিরন্তন শ্বাশ্বত। এর সঙ্গে আছে সমাজ সচেতনতার ভাবনা। এলিয়টের কবিতা বুঝতে হলে I. A. Richard যে চাবির সন্ধান দিয়েছো, বিষ্ণু দে’র ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।
"we should first allow the images and symbols to sin!
into the mind where they would gradually combine and blend into a coherent
whole." বিষ্ণু দে'র কবিতার মিথ চরিত্রগুলি বা প্রতীক অথবা চিত্রকল্পগুলিকে স্বতন্ত্রভাবে অর্থ করা যায় না। এগুলি কবিতার উপাদান হয়েছে objective - correlative-এর নিয়মে। মানস ক্রিয়ার জারণ রসে এগুলি সমবেত ভাবে কবিতার এক সামগ্রিক অর্থ প্রকাশ করে।
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উর্বশী অর্টেমিস’-এ উর্বশী ও উমার মধ্যে দিয়ে দুই বিপরীত ভাবাদর্শ তুলে ধরা হয়েছে। এযুগ অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার নয়। কবির প্রেমচেতনায় স্ফুরিত হয়েছে একালের ধ্যান ধারণা : “আসল কথাটা আমি যা বুঝি / প্রেম ফ্রেম বাজে / আসলে আমরা নতুন খুঁজি / নারীকে পুরুষ পুরুষকে নারী তাই তো খোঁজে / তার উপর তো জীবনের ধর্ম উপরি আছে/ এরি নাম প্রেম।” এ প্রেমকে অনেকে বলেছেন পান্থপ্রো যার পরিণামে আছে হতাশা, ক্লান্তি এবং নৈরাশ্য। আত্মদানই প্রেমের বিশালরূপ এবং এই বিশালতাই প্রেমকে অবিস্মরনীয় করে তোলে। তাই ওফেলিয়ার কাছে তাঁর নিবেদন, “শোনো ওফেলিয়া তোমার আত্মদানে / তোমার শরীরের সারেভির গানে গানে / জীবনের মহামৃদঙ্গে নাচে অর্ধনারীশ্বর।” তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘চোরাবালি’। ‘চোরাবালি' ও ‘ঘোড়সওয়ার’ কবিতা দুটির সম্পর্কে সুধীন্দ্রনাথ বলেছেন যে এই কবিতা দুটি শুধু রিরংসার রূপক নয়, তাদের উপর প্রকৃতি-পুরুষ বা ভক্ত-ভগবানের সম্বন্ধারোপ সহজ ও শোভন—‘ঘোড় সওয়ার' কবিতাটির মধ্যে আছে দুটি বিপরীত মুখী ধারা। প্রথমটি জনজাগরণের জোয়ার, অন্যটি বৈরাগ্য ও বিস্মৃতি। এর মধ্যেই নৈরাশ্য সত্ত্বেও আশা আছে, প্রাপ্তির কামনা আছে। ঘোড়া জনগণের প্রাণশক্তির প্রতীক। কবে/ “জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার / মেরুচুড়া জনহীন / হালকা হাওয়ায় কেটে গেছে লোকনিন্দার দিন। / হে প্রিয় আমার, প্রিয়তম মোর / আয়োজন কাঁপে কামনার ঘোর কোথায় পুরুষাকার? / অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গীকার।” প্রচন্ড গতিবেগে কবিতা উত্তরিত হয় বিভিন্ন অর্থের দ্যোতনায়, পরিশেষে চৈতন্যলোকের দিব্যজ্যোতি উন্মুক্ত হয় জাগতিক রুদ্ধ কবাট অতিক্রম করে। এলিয়টের The Waste Land-এর শেষ অধ্যায় 'What the Thunder Said'-এ আছে ভয়াবহ আত্মিক অবক্ষয়ের চিত্র।।ঢরেসিয়াস প্রত্যক্ষ করে হোলি গ্রেইলের সন্ধানে পার্সিফল ফিশার কিং এর রাজ্যে উপস্থিত। শুষ্ক বায়ু, শুষ্ক পর্বত, বজ্রের নিঘোর্ষ আছে বৃষ্টি নেই।
Here is no water but only rock / Rock and no water and the
sandy road/ The road winding above among the mountains / Which are the moun-
tains of rock without water."
এই কবিতায় বিষ্ণু দে শব্দ বন্ধের নির্মানে এবং একটি বিশেষ শব্দের বার বার পুনরাবৃত্তি করে এলিয়টের কবিতার সঙ্গীতময়তার সাদৃশ্য লাভ করেছেন। এলিয়ট ও বিষ্ণু দে উভয়েই বিশ্বের ঐতিহ্য বহনকারী। খ্রীষ্টিয় ধর্মবাণী ও উপনিষদীয় মর্মজ্ঞানকে এলিয়ট যেমন আলম্বন রূপে ব্যবহার করেছেন, বিষ্ণু দেও তেমনি চীন-রাশিয়া-স্পেন, আমেরিকা, ইংরাজী, ফরাসী ও ইটালিয়ান সাহিত্যের ঐতিহ্যকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে নিয়ে এসেছেন। তাঁর বিশ্বে ভিড় করেছে অর্জুন-হ্যামলেট উর্বশী-অর্টেমিস, ক্রবাদুরের সঙ্গীত ও বাংলার বারমাস্যা, বিপ্লবী চেতনা ও সাঁওতালজীবনের লোকায়িত সংস্কার। ‘সাহিত্যের ভবিষ্যৎ' গ্রন্থে তিনি ‘Mr. Eliot among the Arunes' আলোচনায় এলিয়টের প্রভাবের স্বরূপ নির্নয় প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘He widened and at the same time
deep- ened our vision of literature, which is creative work. In an oad way he
did in literature what Marx had done in the broader sphere of social and
political life.” এলিয়ট যেমন বলেছেন, “Unreal city / Under the brown fog of a winter down / A
crowed flowed over London Bridge, so many / I have not thought death hath
undone so many", বিষ্ণু দেও তেমনি বলেছেন,
“আশে আর পাশে, সামনে পিছনে / সারি সারি পিঁপড়ের সার / ভাবিনি আগে, ভাবিনি কখনো /
এত লোক জীবনের বলি / মানিনি আগে / জীবিকার পথে পথে এত লোক / এত লোককে গোপন সঞ্চারী – জীবন যে পথে বসিয়েছে, জানিনি মানিনি আগে / পিঁপড়ের সারি / গৌড়জনে ভিড়াক্রান্ত মধুচক্র হে শহর, হে শহর স্বপ্ন ভারাতুর।” চোরাবালির ‘কথকতা'র সুরেশ এলিয়টের প্রুফ্রক, মন দেওয়া'তেও রয়েছে প্রুফ্রকের ভাবনা।
এপিগ্রাফ (epigraph), সঙ্গীত ও শিল্পকলার বহু চিত্রকল্প, নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি (objectivity) প্রভৃতি বিষয়ে তিনি এলিয়টকে অনুসরণ করলেও, তিনি পুরোপুরি এলিয়টীয় নন। এই না হওয়ার কারণ হল উভয়ের মধ্যে জীবনদর্শন ও মানসিকতার পার্থক্য। এলিয়ট জীবনের শান্তি খুঁজে পেয়েছেন অ্যাংলো ক্যাথলিক ধর্মের প্রাঙ্গনে। তিনি ছিলেন “royalist in politics এবং classicist in literature". কিন্তু বিষ্ণু দে মার্কসীয় পদ্ধতিতে নৈরাশ্যের মধ্যে আশা এবং ধ্বংসের মধ্যে সৃষ্টির বীজ প্রত্যক্ষ করেছেন। এক্ষেত্রেই তিনি এলিয়টকে অতিক্রম করে দেশজ জীবনের সঙ্গে সেতুবন্ধনে উদ্যোগী হয়েছেন এবং সামাজিক পরিবর্তন বা বিপ্লবের কারণ অনুসন্ধান করেছেন। উত্তরণের প্রথম ফসল 'পূর্বলেখ'। দেশে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তেজনা, কবির ভাষা দুর্বোধ্যতা পরিত্যাগ করে কিছুটা সুবোধ্যতার অনুগামী। ধনতন্ত্র বিরোধী, গ্রামগঞ্জের মাটি অভিমুখী হলেও সামাজিক অবস্থাকে পৌরাণিক নাম ও ঘটনার পটভূমিকায় উপস্থানের প্রয়াস বিদ্যমান। “বিশ্বামিত্র সৃষ্টি করে আলকেমির নববিশ্ব / ভূঁইফোঁড় গায়ত্রীর বরে ইড়ার প্রণবছন্দে পুরোডাসে লালায়িত / ভাগ্য, থকা ঝরে।” কিম্বা -
“দুর্ভিক্ষ এসেছে রুদ্র মড়কের রাসভ বাহনে / ঠগে ঠগে গাঁ উজাড় / বর্গী এলো
শ্রাবনে প্লাবনে গলিত বল্লভী ঘরে মুক্তদ্বারে যুগান্ত হেযায় / নির্বোধ নির্বোধ শিশু হাসে একা আনন্দিত মনে / বসুন্ধরা দেখে তাই, হয়তো বা বাসুদেব শোনে।” গ্রাম বাংলার ভয়াবহ অবস্থা, নিজভূমে পরবাসী মধ্যবিত্ত, এদের আত্মজিজ্ঞাসা ও সমাজ বিশ্লেষণের পাশাপাশি নতুন এক মূল্যবোধের ইঙ্গিত এ কাব্যে বিদ্যমান। পরবর্তী ‘সাত ভাই চম্পা' কাব্যে রূপকথার প্রতীকে জনসমাজ ও দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সেতুবন্ধনের কথা বলা হয়েছে মার্কসবাদকে আত্মস্থ করে। মার্কসবাদী কবি ক্রমেই মানবিক আস্তিক্য বোধে আসীন। ঐতিহাসিক বোধে যে বাস্তবের ছবি তিনি এঁকেছেন তার মধ্যে কবির তীক্ত প্রতিক্রিয়াও চোখে পড়ে। 'সন্দ্বীপের চরে' কাসান্ড্রা, আইসায়া'র খেদ এবং সেই সঙ্গে সাঁওতাল কবিতা, উরাওঁগান পাশাপাশি স্থান পেয়েছে। কাসান্ড্রার মধ্য দিয়ে কবির চিত্ত বিক্ষেপ প্রকাশ পেয়েছে নিম্নের উদ্ধৃতিতে।
বলো কাসান্ড্রা, এত দুর্যোগ ছিল কোথায় / সকলে ভাবছি-প্রায় সারা দেশ, কয়েকজনার/ বাদ দিই। মুখ খোল কাসান্ড্রা, সূর্যালোকে / ঝলসিয়ে চোখ বলো কী পাপের শাসন এ হায়।” দেশের বর্তমান পরিস্থিতির নারকীয়তা প্রত্যক্ষ করে কবির চিত্রকল্পে ফুটে উঠেছে নরকের বর্ণনা।
“এ নরকে / মনে হয় আশা নেই, জীবনের ভাষা নেই / যেখানে রয়েছি আজ সে কোনো গ্রাম নয়, শহরও তো নয় / প্রাস্তর পাহাড় নয়, নদী নয়, দুঃস্বপ্ন কেবল / যেখানে মজুর নেই, চাষা নেই / যেখানে রয়েছি আজ মনে হয়, আশা নেই / বাঁচবার আশা নেই, বাঁচবার ভাষা নেই / সেখানে মড়ক অবিরত / সেখানে কান্নার সুর এক ঘেয়ে নির্জলা আকাশে / মরমে পশে না আর, সেখানে কান্নাই মৃত / কারণ কারোই কোনো আশা নেই / অথবা তা এত কম, যে কোনো নিরাশা নেই।/ চৈতন্যে মড়ক।”
ইংরাজ শাসনে জাতির পঙ্গুতা, আপোষ জনিত খন্ডিত স্বাধীনতা, সন্ত্রাসে নিঃশেষিত জাতীয় বীর্যকেই কবি স্থির করেছেন চৈতন্যময় অবস্থায় উপনীত হওয়ার পথে বাধা স্বরূপ। অতীতে যে বাস্তবের ধ্যানে তিনি মগ্ন তা বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রলম্বিত হয়। কবিতার রং এর খেলা অতীত স্মৃতি, সমকালকে ছুঁয়ে ভবিষ্যতের দিকে ধাবমান। ভবিষ্যৎও এসে মিশে যায় সমকালের পরিমন্ডলে। এখানে কবি এলিয়টের অনুগামী। এলিয়ট Four Quartets-এ 'objective reality of time'-এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন,
Time present and Time past / Are both contained in time
future / And Time future contained in Time past এর অর্থ সমাপ্তিহীন এক অখন্ড সময়। ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’-এ কবি বিষ্ণু দের সময় নিরূপণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। সমাজবাস্তবকে নরক আখ্যা দিয়ে কবি অন্যত্রও বলেছেন, “নরক কি এ-রকম? বাংলার গ্রাম ও শহরের / লক্ষজন দগ্ধগৃহ, কেউ বেশ ওসারে বহরে / নরকে জানে না শুনি আছে তারা দুরন্ত নরকে / রৌরব প্রাসাদে হাসে সাদা কালো গৌরব প্রহরে/ দধীচির হাড় জ্বলে, কী দেয়ালি বিবস্ত্র মড়কে।”
বিষ্ণু দে সম্পর্কে সুধীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘তাঁর মনীষা যেহেতু প্রতিভা ও পান্ডিত্যের যোগফল, তাই ব্যাসকুটের চর্বিত চর্বন তাঁর কাছে নূতন লাগে না। পূর্বাচার্যদের দেখে তিনি বোঝেন যে, প্রবহমান ঐতিহ্যের ব্যক্তিগত বিকাশেই বৈচিত্র্যের সন্ধান মেলে।” আধুনিক কাব্যের দুর্বোধ্যতা এবং বিষ্ণু দের কবিতা সম্পর্কে তাঁর মত এই “কবি বরঞ প্রত্নাস্থিবিদের সঙ্গে তুলনীয়। ...... চিত্তবৃত্তি নিরোধেই যেমন আত্মসমাহিতি আসে তেমনি সাময়িক নির্ভর ঘুচিয়ে স্বগত আবেগে পৌঁছতে পারলেই কবিতা সার্থক হয়। আমার বিশ্বাস, বিষ্ণু দে'র শ্রেষ্ঠ রচনা সমূহে এই আর্য সত্যের অমর্যাদা ঘটেনি।” আধুনিক কবিতার স্বাতন্ত্র্য নির্দেশ করে বিষ্ণু দে বলেছিলেন “হেথা নাই সুশোভন রূপদক্ষ রবীন্দ্র ঠাকুর।” তিনি বাংলা কাব্যের মুক্তি চেয়েছেন রবীন্দ্র অনুসরণে নয় রবীন্দ্র স্মরণে। মানব তথা সমাজের বর্তমান বিবর্তনের দুর্যোগ মুহূর্তগুলিকে অনুধাবন করার জন্য যে মনীষার প্রয়োজন তা রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনীন সত্য সত্তার নির্দেশক নয়। ‘২২শে শ্রাবণ’ থেকে ‘২৫শে বৈশাখ' কবিতায় রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ব্যাপক এবং গভীর।
প্রতি কবিরই একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। এই বৈশিষ্ট্য হল তাঁর style। কোলরিজ এই style-কে বলেছেন organic, এবং Middleton Murry তা বিশ্লেষণ করে বলেছেন, "Style is organic - not the
clothes a man wears, but the flesh and bone of his body”। style হল রক্ত মাংসের মতই অবিচ্ছেদ্য। টলস্টয়, শেকসপীয়রের মত স্রষ্টারা মানবজীবনকে চিত্রিত করার জন্যে বাস্তবের অভিঘাতকে তাঁদের স্মৃতিতে স্থান দিয়েছেন। আধুনিক কালে সমাজ বিশ্লেষণ ও মানব সমস্যা মূলক উপাদানগুলি কাব্য কবিতায় স্থান পাওয়ার অর্থ এই নয় যে কবিরা সাম্যবাদী ভাবাপন্ন বলেই এমনটা ঘটেছে বা মার্কসীয় পদ্ধতির বীক্ষণে তাঁরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বিষ্ণু দে মার্কসবাদী এটা তার পরিচয় নয়, তিনি যে একজন পন্ডিত কবি এটাই তাঁর পরিচয়। কবিরূপে তিনি পাঠকের কাছে জনজীবনের সমস্যা কতখানি নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন; সমালোচনার সূত্র সেটাই হওয়া উচিত। বিষ্ণু দে'র কবিতার বৈচিত্র্যময় ভাবপ্রবাহ একস্তর হতে অন্যস্তরে সততঃ সরমান। কিন্তু সর্বত্রই তিনি স্থির বা দর্শক।
·
বাংলা কবিতা ও তার সংরুপ: আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_20.html
·
বাংলা কবিতায় ছন্দের প্রভাব ও তার সংরুপ: আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_1.html
·
বাংলা কবিতায় চিত্রকল্প (Poetic
Imagery) ও তার সংরুপ: আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/poetic-imagery.html
·
বাংলা কবিতার উপজীব্য বিষয় প্রেম ও প্রকৃতি : আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_25.html
·
বাংলা কবিতায় আধুনিকতা”: আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_49.html
·
আধুনিক কালের কবিতা ও তার সমস্যা-: আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_36.html
·
বাংলা বিশিষ্ট কবির ব্যক্তিগত আত্মভাবনা ও বৈশিষ্ট্য : আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_88.html
·
কবিতার আকাশে সাম্যবাদী কবিবৃন্দ : আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_31.html
·
বাংলা কবিতার বিভিন্ন রূপ : আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_51.html
0 Comments