কবিতার আকাশে সাম্যবাদী কবিবৃন্দ : আব্দুল মুসরেফ খাঁন
বাংলা কবিতার আকাশে বামপন্থী সাম্যবাদী কবি অনেক আছেন। সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছাড়াও যাঁরা বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরন চট্টোপাধ্যায়, দীনেশ দাস, সমর সেন, অরুণ মিত্র প্রভৃতির নাম অনায়োসেই করা যায়। সুকান্ত ভট্টাচার্য-এর প্রথম দিকের কবিতায় রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিকতা ও আদর্শবাদের ছায়াপাত ঘটলেও, পরের অধিকাংশ কবিতাই সাম্যবাদী আদর্শের স্মারক হয়ে উঠেছে। এসব কবিতায় নির্যাতিত, শোষিত, লাঞ্ছিত ও পরাধীন দেশের মানুষের জন্য কবি কণ্ঠে যেমন সহানুভূতি ও আন্তরিকতা ফুটে উঠেছে, তেমনি বিস্তার ধ্বনিত হয়েছে শোষক, সাম্রাজ্যবাদী এবং অত্যাচারীর প্রতি। তাঁর সম্পর্কে জগদীশ ভট্টাচার্য লিখেছেন, 'যে কবির বাণী শোনবার জন্য কবিগুরু কান পেতেছিলেন, সুকান্ত সেই কবি। শৌখীন মজদুরী নয়, কৃষাণের জীবনের সে ছিল সত্যকার শরিক। লেনিন প্রদর্শিত মার্কসীয় তত্ত্ব ও মায়াকোভস্কি এবং হুইটম্যানের বিপ্লবী চিন্তার ছায়া পড়েছে তাঁর কবিতায়। জগদীশ বাবুই বলেছেন, “তাঁর প্রথম দিকের অনেক রচনাতেই দলীয় শ্লোগান স্পষ্ট ছিল, কিন্তু মনের নাবালকত্ব উত্তীর্ণ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার আত্মবিশ্বাস ও অত্মপ্রকাশকে অনন্য পরতন্ত্র করে তুলেছিল।” কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এই শ্লোগান ধর্মীতার কথা স্বীকার করেই বলেছেন, 'হাজার হাজার কন্ঠে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত যে ভাষা হাজার হাজার মানুষের মনে নানা আবেগের তরঙ্গ তুলেছে, তাকে কবিতায় সাদরে গ্রহন করতে পেরেছিল বলেই সুকান্ত সার্থক কবি।”
একথা অত্যন্ত সঠিক যে সুকান্ত মানুষের কবি – মনুষ্যত্বের মূল্যবোধের কবি - যুগ প্রতিষ্ঠার কবি, সমাজ সমস্যার কবি। তার কবিতা জীবন প্রতিষ্ঠার মৃত্যুপন সংগ্রামও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে ঘেরা নবযুগের বিপ্লববাদ। সুকান্ত 'এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য' করে যেতে চান, কেননা এই বিশ্ব সেই বাতিওয়ালার ‘যে সন্ধ্যায় বাতি জ্বালিয়ে ফেরে / অথচ নিজের ঘরে নেই— যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য। কবিতার প্রয়োজন নেই, কারণ “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।” তাই বিপ্লবের প্রয়োজন, প্রয়োজন ‘আঠারো বৎসর বয়সের তরুণদের। ‘গোপনে বিদ্রোহ জমে, জমে দেহে শক্তির বারুদ / প্রাসাদ বিদীর্ন করা বন্যা আসে শিকড়ে শিকড়ে।” এ সবই সচেতন কাব্যনিষ্ঠা; এই নিষ্ঠা সম্বন্ধে কবি বিষ্ণু দে বলেছেন 'এই ভাবেই সে মিশে গেছে বৃহতের দলে।” সাম্যবাদী ভাবনায় একাকার হয়েও তার কবিতায় প্রতীক, চিত্রকল্প এবং রূপকের সমাবেশ ঘটেছে। শ্রেনী বে সমাজের প্রত্যাশায় পদ্যছন্দের লালিত্যে বদলে প্রযুক্ত হয়েছে গদ্যছন্দের কাঠিন্য। পরিণতির পূর্বেই কবি জীবন অস্তমিত। তবু বলতে হয় “যে ফুল না ফুটিতে, পড়েছে ধরণীতে, জানি হে জানি - তাও হয় নি হারা।” সুকান্ত ভট্টাচার্যের চেয়ে সাত বছরের বড় সুভাষ মুখোপাধ্যায়। উভয় কবির দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিত ও জীবনস্বপ্ন মোটমুটি একই রকম। সূর্যের দক্ষিণ হতে উত্তরায়নের মতই সুভাষের জীবনে বাম হতে দক্ষিণায়ন ঘটেছে, কিন্তু তা অনেক পরের ঘটনা তাঁকে নিয়ে যত বিতর্ক, তা এই পরিবর্তনকে ঘিরে। এই পরিবর্তনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বামপন্থী সাম্যবাদী। বিপ্লবী পদাতিকের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে সুগভীর লজ্জা লজ্জা ভীরুতার জন্যে, জীবন সংগ্রামের প্রতি অনীহার জন্যে, চিন্তা ও কর্মের মধ্যে দোলাচলতার জন্যে; “শতাব্দী লাঞ্ছিত আর্তের কান্না / প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা;/ মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বনে থাকা যায় না / পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা।” (সে দিনের কবিতা / পদাতিক) কবি নেমে আসেন একেবারে তৃণমূল স্তরে, যেখানে আছে হাজার হাজার মানুষ ‘নিজভূমে পরবাসী’, যেখানে প্রান্তিক লোভে পরজীবীদের নিষ্ঠুর চোখ' ও ‘ক্ষুরধার নখ’, যেখানে ‘ইতিহাস অর্থনীতির হাতে বাঁধা', কবির জিজ্ঞাসা তাদের কাছে ‘কমরেড আজ নবযুগ আনবে না?' পুরানো যুগ বদলে নবযুগ চাই সুভাষের ‘পদাতিক’ বহন করে এনেছে নবযুগের বার্তা। সুভাষের কবিতায় তাই ব্যক্তিত্বের সংঙ্কট নেই, নিঃসঙ্গতা বা বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিব্যক্তি নেই, রোম্যান্টিক প্রেম কাহিনী নেই, তাই কবিতার প্রকাশ কম, রাজনৈতিক বক্তব্যই প্রাধান্য পায়। গাঁয়ের বধু শহরে এসে রবীন্দ্রনাথের নিঃসঙ্গতাকে অনুধাবন করে না; স্বামী চলে গেছে, তাই একা হয়ে যাওয়া বধু ভাবে “লেকের জলে মরণ যেন ভালো।” সুভাষ একই সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মী এবং কবি। এই দুই বিপরীত ভাবধারা একই মানসিকতায় শোভা পায় কিনা – সে বিষয়ে 'কালের পুতুলে' সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বুদ্ধদেব বসু। কিন্তু সরোজ মুখোপাধ্যায় 'কালান্তর' গ্রন্থে বলেছেন “ (পদাতিকে) কবি অভিমানের বর্মটি খুলে তিনি পথচারী মানুষের মতো, বিমর্ষ, ক্ষুব্ধ, বিদীর্ণ জগতে বাঁচতে, লড়তে চান। ইয়েটস-এর ‘প্রেরক' কবিতায় সেই সারস্বত আশীর্বাদ ধন্য দেশপ্রেমিক কবির মতো তিনিও 'পিনটা' খুলতে চান। তাই তিনিও সেদিন পদাতিক।
আসলে আধুনিক যুগ সময়ের দ্বিতীয় স্তরে সমর সেন, সুভাষ ও সুকান্তের আবির্ভাব। আধুনিকযুগের জটিল জীবন সংগ্রামের অভিব্যক্তি নিয়ে এঁরা মাথা ঘামান নি। সহজ সরল বাঁধাধরা ফরমূলায় এঁরা এগিয়ে গেছেন। সুভাষের কাব্যে আছে ‘দ্বন্দ্ব ও সংঘাত' এর ইতিহাস। জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতেই তিনি সহজ সরল কথ্য ভাষা, কথা বলার আঙ্গিক এবং কাহিনী বলার টেকনিক প্রয়োগ করেছেন। দীপ্তি ত্রিপাঠী এবং বাসন্তী কুমার মুখোপাধ্যায় এই দিকটির উল্লেখ করে বলেছেন যে সুভাষের কবিতায় রবীন্দ্র অনুসরণ বা বিরোধিতা কোনটাই নেই। এঁরা সাম্যবাদী কবি এবং এটাই তাঁর পরিচয়; কারণ কবিতার দর্পনে জনতার জীবন প্রতিফলিত, যুগের ইতিহাস ছন্দোবদ্ধ। “Subhas wears his robes well,
infact, they now seem to have grown into his skin” বলেছেন বুদ্ধদেব বসু। সুভাষের কবিতায় পুরাণ প্রসঙ্গ যেমন শকুনি, কুম্ভকর্ণ, দধীচির হাড় ইত্যাদি, চিত্রকল্প, ভাষাছন্দ, স্তবক বিন্যাস, এবং আন্তজাতিক রাজনীতি, রূপকথা, লোককথা, নাটকীয়তা এবং বাকভঙ্গী ইত্যাদির ক্ষেত্রে নতুনত্বের বলিষ্ঠতা এনেছেন। কবিতার গদ্যধর্মী লিরিকের উপাদান এবং ছোটগল্পের কথন রীতি মনে হয় তাঁর নিজস্ব প্রবর্তনা। ১৭। কবিতার আকাশে নীরেন্দ্র-শঙ্খ-শক্তি ও সুনীল
‘নীল নির্জন’ এর কবি নীরেন্দ্র চক্রবর্তী শব্দব্যবহারের নতুনত্বে বৈদগ্ধ্য ও তাত্ত্বিকতাময় কবিতার আকাশে নিয়ে এলেন নতুন সৌরভ যা রোম্যান্টিক সুরমূর্ছনায় আনন্দ ও বেদনার ঝর্ণায় স্নিগ্ধ করল পাঠককে। তিনি সন্ধানে ফিরেছেন আদর্শ সমাজ ও আদর্শ মানুষের, কথা দিয়ে ছবির পর ছবি সাজিয়ে মালা গেঁথেছেন। সে ছবি কখনও আশা, নিরাশার, ব্যথা বেদনার, বিশ্বাস অবিশ্বাসের, ভালোবাসা ও প্রবঞ্চনার। গদ্যের কথ্য ভাষায়, সংকেতের রহস্যময়তায়, কোমলে কঠোরে তাঁর কবিতা এগিয়ে চলে, পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে। বাস্তব হতে কল্পনার জগতে তিনি বাস্তব অভিজ্ঞতার উপলব্ধিকে জীবনের ভাষ্য রূপে বিধৃত করেছেন। মানুষকে নিয়েই উদ্দীপ্ত তাঁর কল্পনা – human- ity is the Man's nature বলেছেন জহর সেন মজুমদার। তাই মানুষের জীবনবীক্ষায় উঠে এসেছে বেদনাবোধ একাকীত্ব ও অসহায়তার যন্ত্রণা। তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, ‘শিয়রে মৃত্যুর হাতকে, অনুভব করেছেন পারস্পরিক হিংসার মধ্যে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা যেদিকে তাকান “শুধু অন্ধকার, শুধু অন্ধকার,” প্রশ্ন করেন আমার উদ্যানে আরও কতগুলি হত্যাকান্ড সংঘঠিত হবে?” নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় উত্তরণ ঘটেছে নীরক্ত করবী', 'নক্ষত্র জয়ের জন্য', 'কলকাতার যীশু' প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে। সময়কে অন্বেষণ করেছেন আগামী দিনের মানুষের জন্যে। সময় চেতনার আঙ্গিকে তিনি আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সমগ্রতার নাগাল পেতে চেয়েছেন। “প্রচলিত ঈশ্বর সাধনায় নয়; ভিখিরি মায়ের সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশুর মধ্যেই কবি কলকাতার যীশুকে দেখতে পেয়েছেন, যে শিশু টালমাটাল পায়ে জনতার আর্তনাদ, অসহিষ্ণু ড্রাইভারের দাঁতের ঘষটানির ভ্রুক্ষেপ অগ্রাহ্য করে মূর্ত মানবতার মতো বিশ্বকে দুহাতে পাবার জন্যে মুহূর্তে চলমান জীবন থামিয়ে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। এই শিশুর সরলতা ও মানবতাই কবির আকাঙক্ষা।” বলেছেন বার্ণিক রায়। বিধ্বস্ত জীবন কবির কাম্য নয়, প্রেম প্রীতি ভালোবাসাময় জীবন যে সমন্বয়ের পথে বিষণ্ণ একাকীত্বকে ধ্বংস করে সেই সমাজ তিনি চান। 'কলঘরে চিলের কান্না' কবিতায় সেই আর্তি যা মনে করায় একাকী মানেই বিচ্ছিন্নতা, অসহায়তা, স্থবিরতা - যা অনিবার্যভাবেই ধ্বংস সাধক। 'অমন ধারালো শুকনো বুকফাটা আর্তনাদ আমি কখনো শুনিনি।'
কখনও কবি ফিরে যান শৈশবের সেই কুহকিনীর জগতে। বলেন “কতকাল, বলো আরও কতকাল / দুরে থেকে আমি দেখব লুকিয়ে / রাতের প্রগাঢ় পর্দা সরিয়ে উকিমারে কবিতার রং এর খেলা সোনালি সকাল, / হিজলের ফ্রেমে ফুটে ওঠে শিশু সূর্যের মুখ?' তিনি ছুটে যেতে চান মায়াময় ধরণীর বাহুর মধ্যে। ইতিহাস চেতনায় তিনি জেনেছেন “অন্ধকারে ভয়ের আকাশে আলো দেওয়া / যায় না যায় না. / কেননা, ক্ষুধার অন্ন, পিপাসার জল দিতে হলে, / অন্ধকারে আলো দিতে হলে / আরও কিছু দিতে হয় / প্রেম দিতে হয়।” ক্ষত বিক্ষত মানুষের চেহারায় কবি আশাহত। চারিদিকে নাস্তির হুঙ্কার। গুরুমশাই অন্ধকারে দেশ দেখান চতুর্দিকে অন্ধকার। কবি অন্ধকার চাননা আলো চান। অমল কান্তিও তাই হতে চেয়েছিল রোদ্দুর হতে চেয়েছিল ‘অমল কান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।' এই না পাওয়ার বেদনাকে ছাপিয়ে নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় ফুটে উঠেছে মানুষের প্রতি মমত্ববোধ। নিসর্গ প্রকৃতির জীবনানন্দীয় রূপরস-গন্ধ-বর্ণ সমাবেশে মানুষের জন্যে রেখেছেন নির্মল আনন্দ। আধুনিক কবিতায় এনেছেন সত্যের দীপ্তি। দুর্বোধ্যতার খোলস ছেড়ে গ্রহনযোগ্য করে তুললেন কবিতার ভাব ও ভাষা। কবিতার অর্থে তিনি বুঝিয়েছেন “আমি চতুর্দিকে চোখ রেখে রেখে / পৃথিবীর পায়ের ডগার থেকে মস্তক অবধি যা কিছু দেখতে পাচ্ছি, প্রতিটি নিঃশ্বাসে / যা কিছু গ্রহণ করেছি বুকের ভিতরে, যা কিছুতে হাত রাখছি, কিংবা বাঁ পায়ের / লাথি মেরে হটাচ্ছি যা কিছু তাহাই কবিতা।”
স্বাধীনতার পরবর্তীকালীন আর্থ সামাজিক তথা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট শঙ্খ ঘোষের কবিতার পটভূমি। কালোবাজারী, চোরাশিকারী, উদ্বাস্তুতে ভরে যাওয়া ফুটপাথ, নারী মেধের ফলাও কারবার, বাতাসে বারুদের গন্ধ, সর্বাঙ্গীন অবিশ্বাস আর অনিশ্চয়তা ইত্যাদিতে মুখর পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে সংবেদনশীল কবি সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। এই দায়বদ্ধতাই তাঁকে মানবতার পূজারী করেছে। এলিয়ট কথিত Waste Land-এর শুকনো মাটিতে সৌন্দর্যের অমরাবতী সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। তিনি অনেকটাই স্বপ্ন বিলাসীর মতো। স্বপ্ন সত্য নয় জেনেও স্বপ্ন দেখেন হাজার দুয়ার খুলে সীমান্ত পার হয়ে যাওয়ার। তিনি বামপন্থী, কিন্তু কবি রূপে সব সীমানার ওপারে। মার্কসীয় দর্শনে আরোপ করলেন সাধারণ মানুষের জীবন মাহাত্ম্য, বিজ্ঞানের ভয়ঙ্করতায় শুভত্বের মহিমা আনলেন, মনোবিজ্ঞানের যৌণতার উপরে স্থান দিলেন বিকলাঙ্গ মানসিকতার শবব্যবচ্ছেদকে। তাঁর বহুমাত্রিক কবিতায় কোথাও তিনি ভাঙার কথা বলেন নি; বলেছেন গড়ার কথা। বিষাদ আছে, বিক্ষোভ বা হতাশা সবই আছে, এ সবই মিশে আছে অস্থি-মজ্জায়, কিন্তু তা অত্যন্ত চাপা, মানুষের বেদনায় তাঁর দুঃখটাই বড় হয়ে উঠেছে, মুখ্য হয়ে উঠেছে বিশ্বাস ও উপলব্ধি। ‘তৃণময় শান্তি হব আমি' – এই তাঁর প্রতিজ্ঞা। মানুষকে সান্ত্বনা দেন, 'বিমুখ হয়ো না মগ্ন পৃথিবীর প্রাণের প্রবাহে”। বলেন, “তোমার দুখানি রক্ত রাঙানো হাত / আমার মাথায় রাখো, মার্জনা করো।” তিনি বিশ্বাস করেন যে উগ্র একদিন কোমল হবে, প্রবল অত্যাচারী আপনা হতেই ধ্বংস হবে নয়তো ক্ষমা ভিক্ষা করবে।
‘জাবাল সত্যকাম’-এর মত কিছু কবিতায় পুরাণকে ব্যবহার করা হয়েছে মানব যন্ত্রনার অভিব্যক্তি প্রকাশে। এমনই ইতিহাসের কাহিনী নীরস তথ্য না হয়ে ‘বাবরের প্রার্থনা'র মত কবিতায় মানব হৃদয়ের অন্তর্দ্বন্দ্বের তাৎপর্যবাহী হয়ে উঠেছে। আসলে শঙ্খ ঘোষ সমন্বয়ধর্মী। ইতিহাসের কালচেতনার মধ্যেও তিনি সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। কবি স্বয়ং কবিচেতনাকে বিশ্লেষণ করেছেন এই বলে, “মানুষের মধ্যে আরেকখানা মানুষ এই নিয়েই তার জীবন অথবা মৃত্যু। এই টুকরো গুলিকে সে হয়তো জুড়ে নেবার চেষ্টা করে প্রাণপন, কিন্তু তখনই তৈরী হয় আরো একটা নতুন অসংলগ্ন টুকরো। এই টুকরোর কোন শেষ নেই, তেমনি তাকে লগ্ন করার চেষ্টারও অন্ত নেই কোনো। এইভাবে চলতে থাকে দিনের পর দিন। আমারও তেমনি একটুকরো থেকে অন্য টুকরোয় অবিরাম যাওয়া, পা তোলা পা ফেলার মতো এক কবিতা থেকে আর এক কবিতায় পৌঁছানো।” “আমি এখন অনঙ্গ অন্ধকারের হাত দেখিনা, পা দেখিনা, তখন তোর জরায় ভর করে এ আমায় কোথায় নিয়ে এলি ?” অন্ধ কানাগলিতে ঘুরে মরা জটিল সমাজ নিয়ম শৃঙ্খলাহীন, ছন্দহীন। জটিল সমাজের জীবন যন্ত্রনা, একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার পরিমিতিহীন অস্বাচ্ছন্দ্য, নিয়তির নির্মম নিষ্ঠুরতা, অবচেতনের বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্নতা ও মানসিক ভারসাম্যহীনতার পুঁতিগন্ধময় নারকীয় পরিবেশে শক্তি চট্টোপাধ্যায় জননীকে প্রশ্ন করেন ‘এ আমায় কোথায় নিয়ে এলি ?” এখানেই কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়-এর আত্ম জিজ্ঞাসা।
বার্নিক রায় শক্তির কবিতা সম্বন্ধে বলেছেন, “শক্তি অস্থির, অশান্ত, অব্যবস্থিতচিত্ত, কিন্তু দুরন্ত দূর্বার অথচ শক্তিমান। ওঁর মনে কৈশোর যৌবনের স্বপ্ন নেচে বেড়ায়, তাই প্রতিটি বস্তুকে নূতন চোখে দেখতে পারেন, ওঁর চোখে নূতন ছবি ভেসে ওঠে। জগৎ ও জীবন ওঁর কাছে চলমান, কোথাও স্থির হয়ে নেই, ষ্টেশন হতে ষ্টেশনে অনবরত চলেছে; ট্রেনে চলতে গিয়ে গাঁয়ের সবুজ গাছগাছালি, বনবাদাড়, নদী, জোনাকি, আঁধার রোদ্দুর সব একসঙ্গে দেখছেন, কোথাও স্থির গম্ভীর চিত্র নেই, চলচ্চিত্রের মতো, চলচ্চিত্রের ছবির মধ্যে শব্দধনি ও সংগীত তাঁর কাব্যকে আস্বাদ্যমান করে তুলেছে। শক্তি জীবনকে ধ্যানীর মতো নীরবে, গম্ভীর ভাবে দেখতে পারেন না, ওর মনের মধ্যে জগৎ বিচিত্র বর্ণ গন্ধের উচ্ছ্বাস নিয়ে চঞ্চলতা সৃষ্টি করে, এই চঞ্চলতাই তাঁর কাব্যে রূপহীনতার— রুপ নিয়ে তরঙ্গায়িত হয়ে ওঠে।”
বিচ্ছিন্নতাবাদী আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা হতে শূন্যতা বোধ জন্ম নেয় “একা থাকি, বড় একা থাকি।” উৎকণ্ঠা ও সঙ্কট প্রতি মুহূর্তে জড়িয়ে ধরে, নিসর্গ প্রীতি ও শান্তির সন্ধানে অতীত- চারনা শুরু হয়। লড়াই বিমুখ বলেই ঈশ্বরে আস্থাশীল, উটের মতো মরু বালুকার মধ্যে আশ্রয় খোঁজেন, ভাংবন ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো। বিষাদময় সমুদ্রতীরে শক্তি একা। এ বিবাদ সংকটের; এবং সংকট সভ্যতার। কবিতার রং এর খেলা “মানুষের সব গিয়ে এখন রয়েছে হিংসা বুকে / প্রেম পরিণয় গিয়ে এখন সে রক্তের অসুখে মুহ্যমান।” মানুষের অসহায় কান্নায় বিব্রত হন কবি, “কার্নিশে বেড়াল কাঁদে, মাঝে মাঝে কান্না শোনা যায়।” কেননা “এক মুষ্ঠিভাত নেই, ভাতের গন্ধও নেই কোনখানে।” স্বার্থান্বেষী চক্রান্ত, অপরিমেয় লোভ দূর করতে ইঁদুরের প্রতীকে তাঁর ক্ষুদ্রতাকে প্রকাশ করেন। এত জল এত পাপ কবি কি শেষমেষ সবই এড়িয়ে যেতে পারেন। তাই একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হয়। “ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।' কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর অর্থই তো একা হয়ে যাওয়া, “হায় মাছি তুই সোনার বরণ / খুন করেছি হঠাৎ আমি বাঁচবো বলে একা একাই।” কবিতায় আটপৌরে বাচনভঙ্গী, শক্তির কবিতাকে দিয়েছে এক াতুন স্বাদ। বাকপ্রতিমা, ছন্দস্পন্দনও চিত্র বহুলতায় তিনি কবিতাকে এক নতুন সুরে বেঁধেছেন। জীবনানন্দীয় বিপন্ন বিষ্ময় নয়, জীবন উপলব্ধির স্তরে আত্মদহন ও আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্বপ্নময়তার ও নিসর্গ প্রকৃতির মোহমুগ্ধতায় পথ খোঁজেন। কখনও তিনি angry young man, কখনও বা প্রেমিক কবি। তিনি রোম্যান্টিক, তবে তাঁর রোম্যান্টিকতায় আছে ভিন্নতর স্বাদ। প্রেম যেন রামধনু - নানা রং এর সম্মিলন দেহ থেকে দেহাতীতে, রূপ হতে রূপাতীতে উত্তরণ। নীরা তাঁর প্রেমকাব্যের নায়িকা। “তুমিই গায়ত্রী ভাঙা মনীষার উপহাস, তুমি যৌবনের প্রত্যেক কবির নীরা।” এই নীরা যেন আনন্দময়ী বিশ্বপ্রকৃতি। “পাপীকে চুম্বন করো তুমি, তাই দ্বার খোলে স্বর্গের প্রহরী।” রবীন্দ্র প্রভাব বিদ্রোহী সুনীল কৃত্তিবাস কবিতা আন্দোলনের পুরোধা। কৃত্তিবাস পত্রিকায় তিনি কবিতা বিষয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। কবিতার প্রধান শর্তই হল রহস্যময়তা, সুনীলের কবিতায় সেই রহস্যময়তা পাক খায়, হৃদয়দোলায়। জীবনের অভিজ্ঞতা, সত্যের অনুসন্ধান, সংবেদনশীলতা, দার্শনিক অনুভূতি, সমাজচেতনা, কাল চেতনা, জীবনবোধ, প্রেমময়তা এসবই সুনীলের কবিতায় বর্তমান। প্রচন্ড প্রাণশক্তিও দূর্বার গতিবেগে তিনি এগিয়ে যান। বিষয় হতে বিষয়ান্তরে পরিভ্রমন করেন। কখনও আসে অবক্ষয়িত সমাজের কথা, কখনও বা শৈশব স্মৃতিচারণা। তিনি যতই এগিয়ে চলেন, ততই নিজেকেও রূপান্তরিত করেন—যুবনায়কের কাঠামোয় স্ফুরণ ঘটে জীবনপ্রেমিক সুনীলের। নিজের কবিতা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “কোন স্থির কাব্যাদর্শ আমার নেই। একজন কবির সমাজের সঙ্গে যুক্ত বা বিযুক্ত থাকার প্রশ্ন নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামাইনি। নারীর ভিতরে নারী, রূপের ভিতরে বিষাদ, জলের মধ্যে জল রং, গাড়ি বারান্দার নীচে উপবাসী মানুষ, শ্রেণী বৈষম্যের বীভৎস প্রকাশ আমাকে যে কোন সময়ে বিচলিত করে—এই সব বিষয়ই কখনও প্রশ্নে, কখনো বিষাদে, কখনও ব্যাকুলতায়, চিৎকারে আমি নানারকম ভাষায় প্রকাশের চেষ্টা করি।”
প্রথম বয়সে ছন্দ ও মিলের প্রতি আনুগত্য থাকলেও ছন্দোমুক্তির চেতনা সুনীলকে আধুনিক কবি করে তোলে। সহজ সরল ভাষায় লেখা তার কবিতা হতে দুর্বোধ্য নয় । সুর সঙ্গতি বজা থাকায় আবৃত্তি যথারীতিভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে। শব্দের যাদু ও কাব্যভাষায় স্বতন্ত্রতা সুনীলকে কবি রূপে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। জহর সেন মজুমদার বাংলা কবিতা : মেজাজ ও মনোবীজ'-এ সুনীলের কবিতা সম্বন্ধে বলেছেন, “ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রাণ ও প্রচন্ড গতিবেগ। যে কোন কবিতাই প্রাণ শক্তিতে ভরপুর। যে কোন কাব্য গ্রন্থই দুর্বার গতিবেগ সম্পন্ন। তিনি যতই প্রসারিত হচ্ছেন সামনের দিকে, ততই তাঁর কবিতা হতে সরে যাচ্ছে সেই যুবনায়ক, সেই উৎকণ্ঠাময় আমি, প্রতীক্ষাময় কিংবা প্রেমময় আমি। এই সব সত্তাই তাঁর কবিতায় আছে, তবে তা সেই 'রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে - এর মতো।”
সৌন্দর্য সৃষ্টিই সাহিত্যের লক্ষ্য এবং সৌন্দর্য সৃষ্টির মাধ্যমে আনন্দদানই সাহিত্যের প্রধানত অভিপ্ৰায় । গ্রীক তাত্ত্বিক প্লেটো মনে করতেন যে সৌন্দর্য স্বর্গীয় বস্তু। বস্তু জগতে এই সৌন্দর্যের প্রতিফলন ঘটে বলেই আমরা বস্তু জগৎ হতে আনন্দ লাভ করি। কিন্তু সৌন্দর্যের মূলীভূত আধারের সঙ্গে বস্তু জগতের কোন কিছুরই তুলনা করা যায় না। পক্ষান্তরে সৌন্দর্যের কারণ অনুসন্ধানে অধ্যাত্ম জগতের সঙ্গে একটা সেতুবন্ধন করা চলে। প্লেটোর মতে সৌন্দর্য একটি বিশেষ ধারণা মাত্র। অ্যারিস্টটল প্লেটোর মত অনুসরণ করেননি। তাঁর মতে সৌন্দর্য বস্তুগত এবং তা নির্ভর করে মূলতঃ তিনটি উপাদানের উপর এবং তা হল Order, Symmetry ও Definiteness | সৌন্দর্য তত্ত্বে বিষয় ও বিষয়ীর আপেক্ষিক গুরুত্ব সর্বাধিক। বস্তুবাদীরা মনে করেন সৌন্দর্য একটি অন্যতম তথ্য। অ্যারিস্টটলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জার্মান দার্শনিকেরা বস্তুর সামঞ্জস্য এবং ঐক্যকে সৌন্দর্য বলেছেন। অতীন্দ্রিয়বাদের কোন সম্পর্ক তারা স্বীকার করেন না। উপরন্তু সৌন্দর্যই যে মানব যৌন দূর্বলতার প্রধান কারণ সে কথা জানাতেও তারা দ্বিধা করেন না। ইংরাজ দার্শনিক শাসবেরি বস্তুবাদী হয়েও সৌন্দর্যের মূল যে ঈশ্বর তা স্বীকার করেছেন। ভারতীয় দর্শনের 'সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্' কে তিনি অস্বীকার করেন নি। ডারউইন মতবাদেও সৌন্দর্য বোধকে উদ্দেশ্য প্রসূত বলা হয়েছে। উদ্দেশ্যমুখরতায় চরম মাত্রা যোগ করেছেন ফ্রয়েড। তাঁর মতে শিল্পী তার অপূর্ণ মনোবাসনাকে শিল্পের মধ্যে প্রতিফলিত করে এবং এটাই তাঁর মতে সৌন্দর্য যা আনন্দ বিধায়ক। বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রও ছিলেন বস্তুবাদী। তিনি সৌন্দর্য বিষয়ে মনের কোন ক্রিয়াকে গুরুত্ব না দিয়ে শিল্পের বর্ণ, আকার গতি ও অর্থের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
অন্যদিকে যাঁরা মন্ময়পথী (Subjective) তাঁরা মনে করেন বস্তুর মধ্যে সৌন্দর্য নেই, সৌন্দর্যবোধ সম্পূর্ণ মানসিক বিষয়। ফুল আমাদের ভালো লাগে বলেই ফুল সুন্দর। মন্ময়বাদীদের মতে সৌন্দর্য বোধ বিষয়টাই বস্তুনিরপেক্ষ এবং অনুভূতি সাপেক্ষ। কোন একটি বিশেষ শিল্পের ক্ষেত্রে অনুভূতির তারতম্য হতেই পারে। কারও ভালো লাগতে পারে, আবার কারও ভালো না লাগতেও পারে। বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও আত্মিক। ইতালীয় দার্শনিক মার্সিনিও ফিসিলো এই মতবাদের হো। তাঁর মতে যা আমাদের মনকে আকর্ষন করে, তাই আনন্দদায়ক এবং যা আমাদের । নবে আকর্ষণ করে তাই সুন্দর! “আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ / চুনি উঠল রাঙা হয়ে আমি চোখ মেললুম আকাশে / জ্বলে উঠল আলো / পূবে পশ্চিমে। গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম সুন্দর/সুন্দর হল সে” (রবীন্দ্রনাথ / শ্যামলী / আমি) ইমানুয়েল কান্ট সৌন্দর্যকে বিশুদ্ধ অতীন্দ্রিয় অনুভূতি বলে মনে করতেন। দার্শনিক শিলার, ফিকটে, হেগেল, হার্বাট স্পেনসার প্রমুখ দার্শনিকেরা সকলেই স্বীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে মন্ময়বাদী মনোভাবই ব্যক্ত করেছেন।
বস্তুবাদী ও মন্ময়বাদীদের মধ্যস্থলে বিরাজিত থেকে সমন্বয় সাধন করেছেন যাঁরা তাঁরা সমন্বয়বাদী। এঁদের মতে সৌন্দর্য বস্তুগত (objective), কিন্তু তা অনুধাবন করার জন্য উপযুক্ত বিষয়ীর প্রয়োজন, অন্যথায় সৌন্দর্য ব্যর্থ হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথকে সৌন্দর্যের ধারণার দিক থেকে প্রায় সমন্বয়সাধক বলা চলে। অজিত চক্রবর্তী তাঁকে ‘সৌন্দর্যের সন্ন্যাসী' আখ্যা দিয়েছেন। তিনি যে সৌন্দর্যের পূজারী ও সাধক এ সম্পর্কে কোন দ্বিধা নেই। সৌন্দর্যের ধারণায় তিনি বস্তুকে বাদ দিতে চান নি, বিষয়ীকেও নয়। পাশ্চাত্য সাহিত্যের সৌন্দর্যের দোহাই দিয়ে পুরানো যা কিছু তা বর্জন করাকে স্বীকার করতে চাননি। সাহিত্যের বিষয় কি হতে পারে তা তিনি অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা এক পত্রে জানিয়েছেন যে, ‘যা আনন্দ দেয় তাকেই মন সুন্দর বলে, আর সেটাই সাহিত্যের সামগ্রী।' সুতরাং বস্তুর মূল্য যাই হোক না কেন, বিষয়ীর চেতনা বা অনুভূতিকেই তা অধিক মূল্য দেয়। সাহিত্যে কোন চরিত্র প্রচলিত অর্থে সুন্দর নাও হতে পারে। কিন্তু সেই চরিত্র যখন সাহিত্যে স্রষ্টার আবেগ ও সত্যানুভূতির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তা সত্য বলেই সুন্দর হয়ে এঠে। শেকসপীয়রের শাইলক' চরিত্র যতই হাস্যকর ও নিন্দিত হোক না কেন, স্রষ্টার লেখনীতে এক জীবন সত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে বলেই তা সুন্দর। সত্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা অনুভূতিমূলক। তবে এই অনুভূতি মিলন জাত যা সামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য সমূহের ঐক্যের মধ্যে পরিস্ফুট। মিলনজাত সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুভূতিই সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সুন্দর হয়। সত্যের উপলব্ধিতেই আনন্দ। এই সত্য উর্বশীর মধ্যে বিশ্বের প্রেয়সী। নারী সৌন্দর্যকে তিনি তিনি লক্ষ্য করেছেন। উর্বশী নন্দনবাসিনী দেহাতীত রূপে প্রত্যক্ষ করে বিবসনা নারীর সৌন্দর্যকে রহস্যপূর্ণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। “তারি শিখরে শিখরে / পড়িল মধ্যাহ্ন রৌদ্র ললাটে অধরে, উরু-পরে, কটিতটে, স্তনাগ্রচূড়ায় / বাহুযুগে সিক্ত দেহে রেখায় রেখায় ঝলকে ঝলকে ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য যে রূপ তাকে তিনি সুন্দরের ধ্যানের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রেয়সী, জননী ছাড়াও নারীর আর একটি রূপ নারীত্ব। এই রূপেই নারী বলতে পারে, “যাব না বাসর কক্ষে বধুবেশে বাজায়ে কিঙ্কিনী আমারে প্রেমের বীর্যে করো অশঙ্কিনী।” দুই নারী তত্ত্বকে বিশ্লেষন করেছেন; “সৃজনের সমুদ্র মন্থনে / উঠেছিল দুই নারী / একজন উর্বশী সুন্দরী / বিশ্বের কামনা রাজ্যের রানী / স্বর্গের অপ্সরী অন'জন লক্ষ্মী সে কল্যানী / বিশ্বের জননী তাঁরে জানি স্বর্গের ঈশ্বরী।” সত্য শিব-সুন্দরের মেল বন্ধনে সীমা ছেড়ে আবার তিনি অসীমের দিকে গতিবান; “সীমার মাঝে অসীম তুমি / বাজাও আপন সুর আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ / তাই এত মধুর।” 'Our sweetest songs are those that
tell us saddest thought'-এর মতই রবীন্দ্রনাথও মনে করতেন “বিরহে যত আনন্দ / মিলনে তত নাই।” বস্তুজগৎ ও চেতনাশ্রিত অনুভূতির মিলনে ‘সোনার তরী' কাব্যগ্রন্থের কবিতায় নিরুদ্দেশ সৌন্দর্য আকাঙ্খা যেমন প্রবল, তেমনি রয়েছে বিরহ জনিত আনন্দ।
Read More
·
বাংলা কবিতা ও তার সংরুপ: আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_20.html
·
বাংলা কবিতায় ছন্দের প্রভাব ও তার সংরুপ: আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_1.html
·
বাংলা কবিতায় চিত্রকল্প (Poetic
Imagery) ও তার সংরুপ: আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/poetic-imagery.html
·
বাংলা কবিতার উপজীব্য বিষয় প্রেম ও প্রকৃতি : আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_25.html
·
বাংলা কবিতায় আধুনিকতা”: আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_49.html
·
আধুনিক কালের কবিতা ও তার সমস্যা-: আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_36.html
·
বাংলা বিশিষ্ট কবির ব্যক্তিগত আত্মভাবনা ও বৈশিষ্ট্য : আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_88.html
·
কবিতার আকাশে সাম্যবাদী কবিবৃন্দ : আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_31.html
·
বাংলা কবিতার বিভিন্ন রূপ : আব্দুল মুসরেফ খাঁন
·
https://mbiknowledgestore.blogspot.com/2024/02/blog-post_51.html
0 Comments