তৃতীয় নেপোলিয়ণের পতনের কারণ কি? তাঁর কাজের মূল্যায়ণ করুন?

 

  • তৃতীয় নেপোলিয়ণের পতনের কারণ কি? তাঁর কাজের মূল্যায়ণ করুন?

                           সমস্ত জার্মান জাতিকে প্রাশিয়ার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করবার জন্য বিসমার্ক ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর হন। অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যা থেকে ফরাসি জাতির দৃষ্টি ফেরাবার জন্য সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন এই যুদ্ধে অগ্রসর হতে বাধ্য হন, কিন্তু সেডানের যুদ্ধে তিনি পরাজিত পরে বন্দী হলে সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটল একমাত্র সেডানের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলেই যে তৃতীয় নেপোলিয়ণের এবং দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল তা নয়, একটি যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের ওপরই কোনো সম্রাটের সম্পূর্ণ ভাগ্য নির্ভর করে না। তাঁর পতনের কারণ তাঁর রাজত্বকালে ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত আছে। দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাবলী এবং তাঁর পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা তাঁর পতনের পথকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল, – সেডানের যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় না ঘটলেও তৃতীয় নেপোলিয়নের পতন রোধ করা যেত না।

                             তাঁর রাজত্বকালের ইতিহাসে তাঁর কৃতিত্বের অনেক পরিচয় পাওয়া যায়। একদিক দিয়ে বিচার করলে তিনি একজন ক্ষমতাবাণ পুরুষ ছিলেন, কারণ ফ্রান্সের জটিল অবস্থাকে চালিত করে তিনি তাঁর স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।নেপোলিয়ননামের মোহে আকৃষ্ট ফরাসি জনসাধারণের এক বিরাট অংশের সমর্থণ তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর রাজত্বকালের প্রথমদিকে তিনি অভ্যন্তরীণ পররাষ্ট্র নীতিতে কিছু সাফল্য অর্জন করেছিলেন। সিংহাসনে আরোহনের আগে ঘোষিত প্রতিশ্রুতি অণুযায়ী তিনি কয়েকটি অভ্যন্তরীন গঠনমূলক সংস্কারসাধন করেছিলেন এবং ফরাসি ঔপনিবেশিক বাণিজ্যিক স্বার্থবৃদ্ধি জনগণের আর্থিক অবস্থার উন্নতি সাধন করে তিনি দেশে কিছুটা শ্রদ্ধাও আর্জন করতে পেরেছিলেন। প্রথম দিকে পররাষ্ট্রক্ষেত্রেও তিনি ফ্রান্সের মর্যাদা প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু এইসব কিছুই তাঁকে পতনের হাত থেকে রক্ষণ করতে পারেনি। কয়েকটি শক্তিশালী কারণ তাঁর এই পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল।

() তৃতীয় নেপোলিয়নের পতনের একটি প্রধান কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে স্বৈরতন্ত্রের কোনো স্থান ছিল না। ১৮৩০ ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দের বিপ্লব দুটি এটিই প্রমাণিত করেছিল যে, ফ্রান্সের জনসাধারণ স্বৈরতন্ত্রকে বেশিদিন বরদাস্ত করতে প্রস্তুত ছিল না। কিছুদিনের জন্য নেপোলিয়ন বাহ্যিক আড়ম্বর বৈদেশিক ক্ষেত্রে, কিছু সাফল্যদ্বারা জনসাধারণকে চমৎকৃত করতে সমর্থ হয়েছিলেন বটে, কিন্তু যতই দিন যেতে লাগল, তাঁর ক্ষমতা স্বৈরাচারী শাসনের প্রকৃত রূপ সকলের কাছে ধরা পড়ল। সুতরাং জনসাধারণের বিরোধিতা সম্রাটের প্রতি তাঁদের অনাস্থা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল

() বিভিন্ন শেণীর মুখপাত্র বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির কোনোটিকেই তিনি স্থায়ীভাবে আপনার স্বপক্ষে ধরে রাখতে পারেননি, বিভিন্ন স্বার্থ বিরোধী দলগুলির মধ্যে তিনি প্রায় সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করতেন, ফলে তিনি কার্যত কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারেননি।

() সমাজ সংস্কার যথেষ্ট করা হয়নি বলে সমাজতন্ত্রিক দল স্বভাবতই তাঁর বিরুদ্ধে ছিল। 

() তিনি অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করেছিলেন সত্য, কিন্তু তাঁর অবাধ বাণিজ্যিক নীতি দেশের শিল্পপতিদের একাংশ সমর্থন করতে পারেননি। 

() তাঁর ইতালিয় নীতি ফরাসি যাজক শ্রেণীর মনঃপূত হয়নি, এবং 

() জাতীয়তাবাদী দল পোল্যান্ড মেক্সিকোর ব্যাপারে তাঁর কার্যাদির তীব্র প্রতিবাদ করেছিল।

() তিনি প্রথম নেপোলিয়নের আদর্শ কর্মপন্থা ফরাসি জাতির সম্মুখে উপস্থিত করে তাদের মনে এক গভীর আকাঙ্খা উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তিনি সেই আকাঙ্খার পরিতৃপ্তি সাধন করতে পারেননি। যে পররাষ্ট্রনীতি দ্বারা তিনি ফরাসি জনসাধারণকে চমৎকৃত করে রাখবেন ভেবেছিলেন, ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে তাঁর ব্যর্থতা আরম্ভ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জনপ্রিয়তাও কমতে আরম্ভ হয়।

() তিনি স্যাভয় নীস দখল করে ইতালিবাসী ইংরেজ জাতির সমর্থণ হারিয়েছিলেন, এবং পাইডমন্ট-সার্ভিনিয়ার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তিনি অস্ট্রিয়াকেও বিরূদ্ধ শক্তিতে পরিণত করেন। 

() ফরাসি জাতি পোলদের জাতীয় আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিল, কিন্তু পোলদেরকে খালি মুখের সমর্থন ছাড়া কার্যক্ষেত্রে সাহায্য না করাতে তিনি একদিকে যেমন জাতীয়তাবাদীদের হতাশ করলেন, অপর দিকে রাশিয়াকেও শত্রুতে পরিণত করলেন। 

() মেক্সিকো অভিযান তাঁর অদূরদর্শিতারই পরিচয় দেয় এবং তাঁর সাম্রাজ্যের ভিত্তির মূলে প্রচন্ড আঘাত হানে। 

() অষ্ট্রিয়া প্রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বাঁধলে তাঁর নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে থাকা তাঁর পররাষ্ট্রনীতির চূড়ান্ত ব্যর্থতা সূচিত করে। সেই সময় স্যাডোয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার পরাজয়, পরে ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়ান যুদ্ধে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে তৃতীয় নেপোলিয়নের পরাজয়ের রাস্তা প্রস্তুত করেছিল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তখন তিনি মিত্রহীন হয়ে পড়েছিলেন। পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার ফলে তৃতীয় নেপোলিয়নের জনপ্রিয়তা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছিল এবং পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ব্যর্থতা তাঁর পতন সুনিশ্চিত করেছিল।

পরিশেষে বলা যায় সেডানের যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় ফরাসি দেশের অভ্যন্তরীণ আন্দোলনকে তীব্র করে তুলল। তৃতীয় নেপোলিয়নের জনপ্রিয়তা আগেই কমে গিয়েছিল। এই পরাজয়ের ফলে তা ব্যাপক বিদ্বেষে পরিণত হল। সুতরাং তৃতীয় নেপোলিয়ন তাঁর সাম্রাজ্যের পতন ঘটল এবং জনসাধারণ আর একবার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করল।

Post a Comment

0 Comments