- নেপোলিয়ণের পতনের কারণসমূহ আলোচনা করুন ?
অসমান্য প্রতিভাসম্পন্ন সময় নায়ক নেপোলিয়ণের পতন আপাত দৃষ্টিতে অভাবনীয় বলে মনে হলেও তা আকস্মিক ব্যাপার ছিল না। ১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দের পর
নেপোলিয়ণের জীবনে পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং অবশেষে ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চূড়ান্ত পরাজয়ের সম্মুখীন হন। কিন্তু নেপোলিয়ণের পতন কোনো বিশেষ কারণের ফলশ্রুতি ছিল না। বহুবিধ কারণে তাঁর পতন অনিবার্য হয়ে উঠে।
(১) নেপোলিয়ণের অনমণীয় উচ্চাকাঙ্খার মধ্যেই তাঁর পতনের কারণ নিহিত ছিল। তিনি অনন্য সাধারণ প্রতিভার অধিকারী ও পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক ছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সমগ্র ফ্রান্সের একচ্ছত্র অধিপতি হয়েও তিনি সন্তুষ্ঠ ছিলেন না। তাঁর আকাঙ্খা ছিল, তিনি সমগ্র ইউরোপের ভাগ্যবিধাতারূপে এক বিরাট সামাজ্য গড়ে তুলবেন। তাঁর উচ্চাকাঙ্খা বাস্তবতার সীমা ছড়িয়ে গিয়েছিল। তিনি ভাবতেন, পৃথিবীতে এমন কিছু নেই, যা তিনি অধিকার করতে পারবেন না। কিন্তু যত বড়ো দিগ্বিজয়ী বীরই হোক না কনে মানুষের ক্ষমতারও যে একটা সীমা আছে এ কথায় তিনি বিস্মৃত হয়েছিলেন। নিরবিচ্ছিন্ন সামরিক সাফল্য সত্ত্বেও বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নেপোলিয়নের শারীরিক ও মানসিক শক্তি শিথিল হয়ে পড়ে এবং আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন।
(২) নেপোলিয়ণের অদূরদর্শিতাও তাঁর পতনের অন্যতম কারণ ছিল। পোর্তুগাল অধিকার করবার জন্য তিনি স্পেনের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবার জন্য স্পেনের অভ্যন্তরে বিক্ষোভের সৃষ্টি করলেন। তিনি নিজ ভ্রাতাকে স্পেনের ন্যায়সঙ্গত অধিপতি বলে ঘোষণা করে স্পেনজাতির আশা-আকাঙ্খার অবমাননা করেছিলেন; এর ফলে স্পেনের জনসাধারণ জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁদের বিরূদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন আরম্ভ করল। এই আন্দোলনের পরিণতি স্বরূপ সংঘটিত হল পেনিনসুলার যুদ্ধ, যা নেপোলিয়নের পতন ত্বরান্বিত করেছিল। স্পেনেই নেপোলিয়ণের সামরিক গৌরবের সমাধি রচিত হল ।
(৩) ইংল্যান্ডের অপরজেয় নৌ-শক্তি নেপোলিয়নের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ। স্থলযুদ্ধে নেপোলিয়ন অজেয় হলেও ইংল্যান্ডের নৌ-বাহিনীর প্রতিরোধের ফলে তাঁর পক্ষে শেষ পর্যন্ত সাফল্য লাভ করা সম্ভব হয়নি। ইংল্যান্ডকে হীনবল করার জন্য নেপোলিয়ন যে প্রাচ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন নীলনদের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। অতঃপর ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে সরাসরি ইংল্যান্ড অক্রমণ করার যে পরিকল্পনা তিনি গ্রহণ করেছিলেন ট্রাফালগারের নৌ-যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে তাও সফল হয়নি।
অতঃপর নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডকে হীনবল করবার জন্য কন্টিনেন্টাল সিস্টেম নামে যে অর্থনৈতিক অবোেরাধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তাও ইংল্যান্ডের নৌ-শক্তির প্রতিরোধের ফলে ব্যর্থ হল। সুতরাং ইংল্যান্ডের অজেয় নৌ-শক্তিই নেপোলিয়নের সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ করে তাঁর পতনের কারণ ঘটাল।
(৪) নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের ব্যর্থতাও তাঁর পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে স্বাক্ষরিত টিলসিটের সন্ধির পর হাতে রুশ ফরাসি সম্পর্ক ক্রমেই তিক্ত হয়ে উঠেছিল। রাশিয়ার জনসাধারণ জার আলেকজান্ডার ও নেপোলিয়ণের প্রীতিপূর্ণ সম্পর্কের বিরোধী ছিল। তারা জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ফ্রান্সের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য দাবি জানাল। এরফলে রাশিয়ার সম্রাট ‘টিলসিটের সন্ধি' অনুযায়ী কন্টিনেন্টাল সিস্টেম সফল করার জন্য নেপোলিয়নকে সাহায্য করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা পালন করতে শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেলেন। রাশিয়ার এই ব্যবহারের সমুচিত শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান আরম্ভ কিন্তু এই অভিযানে নেপোলিয়ণের সামরিক গৌরব ও শক্তি বিনষ্ট
করলেন।
(৫) স্পেন ও রাশিয়ার আদর্শ অণুসরণ করে প্রাশিয়ায়ও স্বাধীনতা সংগ্রাম আরম্ভ হল। জার্মাণির অভ্যন্তরীন ব্যাপারে অকারণ হস্তক্ষেপের ফলে নেপোলিয়ন জার্মাণির জনসাধারণকেও বিদ্ধিষ্ট করে তুলেছিল। এরফলে প্রাশিয়াকে কেন্দ্র করে জার্মাণ জাতীয়তাবাদী শক্তি নো, পালিয়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ সৃষ্টি করল। লাইপজিপের যুদ্ধে জার্মাণির সামরিক বাহিনীর কাছে নেপোলিয়ন পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। ইতালিতেও নেপোলিয়নের বিরূদ্ধে অশানুরূপভাবে জাতীয়তাবাদী অন্দোলন হয়েছিল। নেপোলিয়ণের বিরূদ্ধে স্পেন, রাশিয়া, প্রাশিয়া ও ইতালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কথা স্মরণ করে বলা যায়—It was national patriotism which crushed Napoleon.
(৬) পোপ ও ক্যাথলিক রাষ্ট্রসমূহের সাথে শত্রুতা নেপোলিয়ণের পতনের অন্যতম কারণ। পোপকে বন্দী করে তিনি রোমান ক্যাথলিক রাষ্ট্রসমূহের শ্রদ্ধা হারিয়েছিলেন। তিনি যদি উদারনীতি অবলম্বন করে রোমান ক্যাথলিক রাষ্ট্রসমূহের সমর্থণ লাভ করতে পারতেন, তাহলে এত শীঘ্র তাঁর পতন হয়ত হত না।
(৭) নেপোলিয়ণের পতনের অপর একটি কারণ হল তিনি ক্রমশ ফরাসি জনগণের আত্মবিশ্বাস ও জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেন। ক্রমাগত যুদ্ধের ফলে ফরাসি জাতির মনে অবসাদ দেখা দেয়। অভিন্ন, যুদ্ধের চাপে ফরাসি অর্থনীতির ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় এবং জনগণের দুর্দশা বৃদ্ধি পায়।
পরিশেষে বলা যায় নেপোলিয়ণের সাম্রাজ্যের পতন ছিল একপ্রকার অনিবার্য, কারণ সাম্রাজ্যের চরিত্র ছিল স্ববিরোধী ও অসংগতিপূর্ণ। সমগ্র ইউরোপে সাম্রাজ্যের জাল বিস্তার করে তিনি বিভিন্ন ইউরেপীয় রাষ্ট্রগুলিতে ফরাসি আধিপত্য স্থাপন করেন। স্বৈরাচারী শাসন প্রবর্তন করে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের জনগণের মনে বিরাগ সৃষ্টি করেছিলেন।
0 Comments