- মহাদেশীয় ব্যবস্থা কি ছিল? এই ব্যবস্থা নেপোলিয়নের পতনের জন্য কতখানি দায়ী ছিল?
- অথবা নেপোলিয়নের পতনের জন্য মহাদেশীয় ব্যবস্থা কতদূর দায়ী ছিল?
- অথবা নেপোলিয়ন কেন মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা প্রবর্তন করেন? এই ব্যবস্থা নেপোলিয়নের পতনের জন্য কতটুকু দায়ী ?
১৮০০ খ্রীঃ এর মধ্যেই ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন উপলব্দি করেন যে, ইউরোপের সব শক্তি, তাঁর কাছে পরাজিত হয়ে তাঁর সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনে বাধ্য হলেও একমাত্র ইংল্যান্ড প্রবল পরাক্রমের সঙ্গে তার বিরূদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। নীলনদের যুদ্ধ' এবং “ট্রাফোলগারের নৌ-যুদ্ধ”-এ শোচনীয় পরাজয়ের পর তিনি স্পষ্টতই উপলব্ধি করেন যে, “সমুদ্রের রাণী” ইংল্যান্ডকে কখনোই সামুদ্রিক যুদ্ধে পরাজিত করা সম্ভব নয়। এই কারণে অন্তত দুবার ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে ইংল্যান্ডে আক্রমণের পরিকল্পনা করেও তিনি তা বাতিল করে দেন। ইংল্যান্ডকে “হাতে মারা” সম্ভব নয় বলে তিনি তাকে “ভাতে মারার” পরিকল্পনা নেন। একটি অর্থনৈতিক অবরোধের নীতি গ্রহণ করে তিনি ঘোষণা করেন যে, ইউরোপের কোনও বন্দরে কোনও ব্রিটিশ জাহাজ যেতে পারবে না এবং ইউরোপের কোনও রাষ্ট্র ইংল্যান্ড থেকে কোনও পণ্য আমদানী করতে পারবে না। ইংল্যান্ডকে পর্যদস্ত করার উদ্দেশ্যে রচিত তাঁর এই অর্থনৈতিক অবরোধের নীতি “মহাদেশীয় ব্যবস্থা” বা কন্টিনেন্টাল সিস্টেম” নামে পরিচিত। সমগ্র মহাদেশ যা নেপোলিয়ন এই সামুদ্রিক অবরোধের আওতায় এনেছিলেন বলে তার নাম হয় “মহাদেশীয় অবরোধ” বা কন্টিনেন্টাল সিস্টেম”।
ঐতিহাসিক কোবান এর মতে, নেপোলিয়ন কর্তৃক মহাদেশীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ছিল দ্বিবিধ। প্রথমত, ইংল্যান্ডের শক্তির মূল উৎস ছিল তার উন্নত শিল্প ও বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক বাণিজ্য। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্প্রসারিত ইংল্যান্ডের বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে আমদানী করা পন্যাদি এবং নিজেদের কারখানায় উৎপন্ন উদ্বৃত্ত মালপত্র ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করে ইংল্যান্ডে নিজ অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে সুদৃঢ় করে এবং বিশ্বের অন্যতম ধনশালী দেশে পরিণত হয়। নেপোলিয়ন তাই ইংরেজ জাতিকে “দোকানদারের জাত” (A Nation of shopkeepers ) বলে ব্যাঙ্গ করেছেন। তাঁর মতে, ইউরোপের বাজারে যদি ইংল্যান্ড থেকে আগত পন্যদ্রব্যের আমদানি বন্ধ করা যায় তাহলে ইংল্যান্ডের শিল্প-বানিজ্য ধ্বংস হবে, অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়বে, বন্ধ কারখানার বহু শ্রমিক ও জাহাজের নাবিকরা কর্মহীন হয়ে পড়বে এবং ব্যাবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এইসব মানুষের সমবেত বিক্ষোভের ফলে ইংল্যান্ড তাঁর সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হবে। দ্বিতীয়ত, এছাড়াও তাঁর আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল অ্যালফ্রেড কোবান, ক্লদ ফোলেন, ভি. ক্রণিন প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতে, নেপোলিয়ন মনে করেছিলেন যে, ইংল্যান্ড ইউরোপে তার বাজার হারালে ফ্রান্স তা দখল করবে। এর ফলে ফরাসী শিল্প পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবে, পৃথিবীর নানা স্থানে ফরাসি শিল্পজাত পণ্যের বাজার মিলবে এবং ফ্রান্স সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে। সুতরাং কেবল যুদ্ধ জয় নয়—শিল্পক্ষেত্রে ফরাসী প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করাও তার অন্যতম উদ্দেশ্যে ছিল। কোবাণ একেই বলেছেন, “বোনাপার্টিস্ট কোলকার্টিজম”। ফ্রান্সের শিল্পায়ণের ধারণাকে কার্যকরী করে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি ফ্রান্সের শিল্পপতিদের নতুন শিল্প গড়ে তোলার উৎসাহ দেন। বিদেশ থেকে নতুন প্রযুক্তি আমদানির ব্যবস্থা করেন। কারিগরী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কারকদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করা হয়। আলফ্রেড কোবান বলেন যে, কেবলমাত্র ইংল্যান্ডকে পদানত করাই নয়—ফ্রান্সের সম্পদ ও মহত্ব বৃদ্ধি করাও মহাদেশীয় ব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল—জর্জ রূদে বলেন যে, ফ্রান্সের শিল্পকে রক্ষা করার প্রাথমিক উদ্দ্যেশ্য নিয়ে নয়—ইংল্যান্ডকে পদাণত করাই ছিল এই পরিকল্পনার মূল উদ্দ্যেশ্য।
তৃতীয়ত, এই অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য। নেপোলিয়ন মনে করেছিলেন যে, ব্যাপক শিল্পায়ন ও ব্যাবসা বাণিজ্যের ফলে ফ্রান্সে যে পুজিপতি শ্রেণীর সৃষ্টি হবে, তারা তার স্বৈরতন্ত্রের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থণ জানাবে। শেষপর্যন্ত মহাদেশীয় অবরোধ ব্যাবস্থা ব্যার্থতায় পর্যবসিত হয়।
এই ব্যাবস্থার পিছনে নানা কারণ ছিল—
প্রথমত, এই অবরোধ কার্যকর করার প্রথম শর্তই ছিল শক্তিশালী নৌ-বাহিনী। ইউরোপের সুদীর্ঘ উপকূলভাগের ওপর নজর রাখার মতো শক্তিশালী নৌ-বাহিনী ফ্রান্সের ছিল না। অপরপক্ষে ইংল্যান্ড তার শক্তিশালী নৌ-বাহিনীর সাহায্যে “অর্ডার-ইন-কার্ডসিস’ কার্যকারী করতে সমর্থ হয়।
দ্বিতীয়ত, শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডের কারখানাগুলিতে উন্নতমাণের বিভিন্ন পন্যাদি উৎপাদিত হত এবং ইউরোপের বাজারে ওইসব পণ্যের চাহিদাও ছিল ব্যাপক। ইংল্যান্ড উল ও তুলা দ্বারা প্রস্তুত দ্রব্যাদি, চা, কফি এবং চিনির একচেটিয়া ব্যাবসা করত। ফ্রান্সের মত শিল্পে অণুন্নত একটি দেশের পক্ষে ওই চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল না। নেপোলিয়ন তাই ইউরোপবাসীকে কফির বদলে চিকোরি, আখের চিনির বদলে বিটের চিনি প্রভৃতি বিকল্পের ওপর নির্ভর করার পরামর্শ দেন। ইউরোপের মানুষ উচ্চমূল্যে ফরাসি দ্রব্যাদি কিনতে বাধ্য হয়। এরফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয় এবং ওইসব দেশের জনগন নেপোলিয়ণের প্রতি বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে।
তৃতীয়ত, ফরাসী জনগনের অবস্থাও চরমে পৌঁছায়। তারা নেপোলিয়ণের প্রতি সব আস্থা হারিয়ে ফেলে—এমনকি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চক্রান্ত ও শুর হয়। ঐতিহাসিক মারখাম বলেন “ এ সময় থেকেই ফরাসি জনসাধারণ তার সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে।”
চতুর্থত, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এমনকি ফ্রান্সেও ইংল্যান্ডজাত পন্যাদির ব্যাপক চোরাচালান শুরু হয়, যা রোধ করার শক্তি নেপোলিয়ণের ছিল না। নেপোলিয়ন এই ব্যাবস্থার অসারতা উপলব্ধি করেন এবং ইংল্যান্ড থেকে মাল আমদাণিকারকদের অর্থের বিনিময়ে গোপনে লাইসেন্স দিতে শুরু করেন। তিনি নিজ সেনাদলের ব্যবহারের জন্যে ৫০ হাজার কোট ও জুতো ইংল্যান্ডে থেকে আমদানি করেন। শেষপর্যন্ত এই ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে।
0 Comments