- জুলাই বিপ্লবের ফলাফল?
- অথবা গুরুত্ব বা তাৎপর্য আলোচনা করুন?
ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ণের পতনের পর ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহিত ন্যায্য অধিকার নীতির ভিত্তিতে ফ্রান্সে প্রাচীন বুরবো রাজবংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুই-এর ভ্রাতা অষ্টাদশ লুই সিংহাসনে বসেন। এই সময় ফ্রান্সের রাজনৈতিক অবস্থা জটিল রূপ লাভ করে। ফ্রান্সের সিংহাসনে বুরবো রাজবংশ পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দেশত্যাগি অভিজাত ও যাজকরা ফ্রান্সে ফিরে আসে। স্বদেশে প্রত্যাগত এইসব অভিজাত ও যাজকেরা বিপ্লবী আমলের সকল সংস্কার বাতিল করে তাদের পূর্বতন অধিকার পুনঃস্থাপনে উদ্যোগি হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা উগ্র রাজতন্ত্রি দল গড়ে তোলে। এই দলের উর্দ্ধে ছিল উদারতন্ত্রী এবং প্রাজাতন্ত্রী দল।
ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই উপলব্ধি করেন যে কখনোই বিপ্লবী পরিবর্তনগুলি মুছে ফেলা যাবে না। তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করেন। তিনি পুনঃস্থাপিত রাজতন্ত্রের সাথে বিপ্লবী ভাবধারার সমন্বয়ের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। তিনি এই উদ্দেশ্যে (১৮১৪ খ্রীঃ) কয়েকটি আইনও জারি করেন যথা -
১) আইনের চোখে সকলে সমান
২) ব্যক্তি স্বাধীনতা ও
৩) সম্পত্তির অধিকার।
১৪২৮ খ্রীঃ অষ্টাদশ লুই এর মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা ডিউক অব আর্টরেস তথা উগ্র রাজতন্ত্রী দলের নেতা দশম চার্লস 'সম্রাট' উপাধি ধারন করে সিংহাসনে বসেন। তিনি ঈশ্বর প্রদত্ত রাজতন্ত্র ও পুরাতনতন্ত্রের উগ্র সমর্থক ছিলেন। তার লক্ষ্যই ছিল অষ্টাদশ লুই এর মধ্যপন্থাকে বিসর্জন দিয়ে অভিজাততন্ত্র ও ক্যাথলিক গির্জার প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠা করা। বিপ্লবের সময় যে অভিজাতদের জমি বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তিনি তাদের ক্ষতিপূরণের জন্য বিপুল পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে, ধর্মযাজকদের অধিকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। শুধু তাই নয়, নির্বাসিত জেসুইটদের দেশে ফিরিয়ে এনে উচ্চ রাজপদে নিয়োগ করেন। এই প্রসঙ্গে ওয়েলিংটন মন্তব্য করেছেন – “এটি ছিল ধর্মযাজকদের দ্বারা, ধর্মযাজকদের মাধ্যমে, ধর্মযাজকদের জন্য সরকার।” ১৮৩০ খ্রীঃ দশম চার্লস পলিগণ্যাক নামক জনৈক প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিকে তাঁর প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন। ঐ একই সালের ২০শে জুলাই অষ্টাদশ লুই এর প্রদত্ত ১৮১৪ এর সনদ বন্ধ হয় এবং ২৫শে জুলাই পলিগন্যক চারটি স্বৈরাচারি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। যার দ্বারা-
১) আইনসভা ভেঙে দেওয়া হয়।
২) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়।
৩) ভোটাধিকার সংকুচিত হয়।
৪) অল্পসংখ্যক নাগরিকদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের দিন ঘোষণা করা হয়।
এই অর্ডিনান্স জারির সঙ্গে সঙ্গে উদারপন্থি নেতা এডলফ থিরাস এর নেতৃত্বে প্যারিসের জনসাধারণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সাধারণ মানুষ ছাত্র ও শ্রমিকেরা প্যারিসের রাজপথে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পূর্বতন জাতির রক্ষীবাহিনী বিক্ষোভের সাথে যোগ দেয়। ২৭শে জুলাই থেকে প্যারিসের জনতা রাজপথে নামে এবং ২৮শে জুলাই বিদ্রোহী জনতা প্যারিসের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। ৩০শে জুলাই বিদ্রোহী জনসাধারণ দশম চার্লসকে সিংহাসনচ্যুত করে আলয়েন্স বংশের লুই ফিলিপকে ফ্রান্সের রাজা বলে ঘোষণা করেন। এইভাবে মাত্র তিনটি গৌরবময় দিনের (২৭-২৯ জুলাই) মাধ্যমে জুলাই বিপ্লব সম্পন্ন হয়।
জুলাই বিপ্লবের গুরুত্ব—ঐতিহাসিক লিপসনের মতে, ফ্রান্সের ইতিহাসে জুলাই বিপ্লব এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ঐতিহাসিক গডণ ক্রেইগ বলেন যে, দশম চার্লসের আমলে যে স্বৈরাচার স্থাপনের চেষ্টা হয়েছিল জুলাই বিপ্লবে তা ধ্বংস হয়। এই বিপ্লবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য হল—
প্রথমত, এই বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সের স্বৈরাচারী কুঁরবো রাজবংশের পতন ঘটে এবং অর্লিয়েন্স রাজবংশের অধীনে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। এই সময়ে লুই ফিলিপ তাঁর সনদে লিখেছিলেন—“ফ্রান্সের রাজা” নয়—‘ফরাসি জাতির রাজা’ উপাধি তিনি গ্রহণ করেন।
দ্বিতীয়ত, জুলাই বিপ্লব ভিয়েনা সম্মেলন কর্তৃক গৃহীত ‘ন্যায্য অধিকার নীতি'-র উপর প্রবল আঘাত হানে এবং তার আসারতা প্রমান করেন।
তৃতীয়ত, জুলাই বিপ্লবের ফলে যাজক অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রাধান্য পুনঃ স্থাপনের উদ্যোগ চিরতরে ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্রক্ষমতা সেই ধনী বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের হাতে করায়ত্ত হয়। ধনী বুর্জোয়া ফ্রান্সের শাসন ক্ষমতা দখল করে।
চতুর্থত, অধ্যাপক হবসম্ এর মতে— ১৮৩০-এর জুলাই বিপ্লবের ফলে শ্রমিক শ্রেনীর জাগরণ ঘটে এবং তারা ধীরে ধীরে ‘গনবিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
পঞ্চমত, জুলাই বিপ্লবের প্রভাবে ফ্রান্সের চিন্তাজগতে এক গভীর আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এই সময় রোমানিক লেখকদের আবির্ভাব ঘটে এবং তাঁরা বিভিন্ন ন্যায়ের প্রতি সামাজিক জনগণের দৃষ্টি আকর্ষন করে। লা-মার্টিন, মাসেট ইত্যাদি সাহিত্য কীর্তিই জুলাই বিপ্লবরে এক অনবদ্ধ ফল।
জুলাই বিপ্লবের ঢেউ ফ্রান্সের সীমানা অতিক্রম করে ইউরোপের নানা দেশে আঁছড়ে পড়ে। তাই মেটারনিক ব্যাঙ্গ করে বলেছেন যে, ‘ফ্রান্সের সর্দি হলে ইউরোপের হাচি হয়। ১৮৩০ খ্রীঃ, জুলাই বিপ্লব ইউরোপের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এক নব উন্মাদনার সৃষ্টি করে। জার্মানিতে ব্যাপক গন জাগরণ দেখা দেয়, ইতালিতে পার্মা, মডেনা ও পোপের রাজ্যের শাসন সংস্কারের দাবিতে গণ আন্দোলন মেটারনিখের চাপে স্তব্ধ হয়ে যায়। রুশ অধিকৃত পোল্যান্ডে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়, ইংল্যান্ডেও আন্দোলন শুরু হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য স্পেন, পোর্তুগাল ও সুইজারল্যান্ডে উদারতান্ত্রিক শাসন সংস্কার প্রবর্তিত হয়।
বস্তুত জুলাই বিপ্লব ইউরোপের সর্বত্র বিপ্লব জাগ্রত করলেও কোথাও জাতীয় আশা, আকাঙ্খা চরিতার্থ করতে পারেনি। অর্থাৎ এই বিপ্লব ইউরোপের আশা আকাঙ্খাকে পূর্ণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তা সত্ত্বেও বলা হয় যে জুলাই বিপ্লবের ফলে ইউরোপের ওপর প্রসারিত মেটারনিখের বজ্রপুষ্টিতে আঘাত লাগে এবং ১৮৪৮খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
0 Comments