চীনে ৪ঠা মে'র আন্দোলন কেন হয়েছিল? কী ভাবে চীনের জনজীবন এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল?

 

  • চীনে ৪ঠা মে' আন্দোলন কেন হয়েছিল? কী ভাবে চীনের জনজীবন এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল?

                                                ৪ঠা মে আন্দোলন চীনা বিপ্লবের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। এই আন্দোলনকে সামাজিক, রাজনৈতিক বৌদ্ধিক বিপ্লব বলে অভিহিত করা হয়েছে। সামাজিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে এই আন্দোলনের ফলে পুরনো ঐতিহ্য থেকে চীন মুক্তি পেয়েছিল। উদারপন্থীদের মতে, এই আন্দোলন পুরনো চিন্তাধারা, পুরনো নীতিবোধ, পুরনো মূল্যবোধ থেকে চীনের মানুষকে মুক্ত করেছিল এবং চীনে নবজাগরণ এনেছিল। ইউরোপের দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করে এই আন্দোলন চীনকে আধুনিক করে গড়ে তোলায় প্রয়াসী হয়েছিল। অনেক উদারপন্থীর মতে ১৮ শতকে ইউরোপে যেমন মুক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঠিক সেইরূপ চীনেও ঐতিহ্যের পরিবর্তে মুক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই আন্দোলনের ফলে যুবক সমাজের মন থেকে ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়েছিল।

রাজনৈতিক বিপ্লব : এই আন্দোলন ছাত্র আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও এর প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী। প্রকৃতি বা চরিত্রগত দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায় এই আন্দোলন রাজনৈতিক দিক দিয়ে চীনে এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছিল। আন্দোলনের সময় বিপ্লবীরা স্লোগান তুলেছিল—‘দেশকে বাচাও' এই স্লোগান ছিল তৎকালীন পরিষ্কার করে সেখানে কৃষি খামার গবাদি পশুর চারণক্ষেত্র, উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি চীনের রাজনৈতিক দুর্দশার বিরূদ্ধে সোচ্চার জাতীয়তাবাদী প্রতিবাদ। বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী করে এক অসম্ভব কাজের নজীর সৃষ্টি করেছিল। ইয়েনানের মুক্তাঞ্চলে নারীরা প্রশাসনিকভাবে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হওয়ার প্রয়াস দেখিয়ে প্রগতিতে সামিল হয়েছিলেন। গ্রামাঞ্চলে নারী সংগঠনগুলি মেয়েদের সামাজিক পারিবারিক অত্যাচার থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করত। স্থানীয় কমিটিগুলিতে ৮শতাংশ মেয়ে পেরেছিল মাত্র অল্প কয়েকজন উচ্চশিক্ষিতা মহিলাই কেবলমাত্র পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন করতে পেরেছিলেন। CCP ইউনানে ঘাঁটি তৈরি করার পর ইউনানে সাম্যবাদ গড়ে তুলেছিলেন যা রাশিয়ার পছন্দ ছিল না। ফলে এরপর রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কিন্তু পশ্চিমের বেশকিছু কমিউনিষ্ট ব্যক্তিগত উদ্যোগে চীনে এসেছিলেন। নোসাকা শক্তি চীনের অভ্যন্তরে যে সব কাজ করেছিল, সেগুলিকে ছাত্র সমাজ মেনে নিতে পারেনি। ছাড়া -সম চুক্তির ভিত্তিতে বিদেশি শক্তিবর্গ যেভাবে চীনকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধেছিল তার বিরুদ্ধে চীন ছাত্র সমাজ গর্জে উঠেছিল। চীনকে তাদের শোষনের মৃগয়া ভূমি করার এবং চীনের রাষ্ট্রীয় অখন্ডতাকে বিনাশ করার জন্য যে প্রচেষ্টা বিদেশী শক্তি বর্গ করেছিল, চীনের ছাত্রসমাজ এর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু করেছিল তা চীনের ইতিহাসে নতুন দিগন্তের সূচনা করে। আন্দোলনকারীরা চীনের ঐতিহ্যগত সব বিষয়ের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। তারা চীনের ঐতিহ্যগত পিতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথাকে মানেন নি। সমাজ রাষ্ট্রীয় জীবনে চীনে নারি জাতির কোনো মূল্য ছিল না তারা নারী জাতিকে গৌরবের ভূমিকায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য অনেক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এজন্য অনেকইে বলে থাকেন ৪ঠা মে' আন্দোলন ছিল চরিত্রগত দিক _ দিয়ে নারীবাদী আন্দোলন মূলত রাজনৈতিক দিক দিয়ে এই আন্দোলন ছিল বিদেশী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশাত্ববোধক আন্দোলন।

গনতান্ত্রিক বিপ্লব : চেন-তু-শিউ এর মতে এই আন্দোলন ছিল গণতান্ত্রিক বিপ্লব। কিন্তু মাও-সে-তুঙ এই আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলতে রাজি হননি। মাও এর মতে এই আন্দোলন ছিল সাম্রাজ্যবাদ সামন্ততন্ত্র বিরোধী বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এই আন্দোলনের চরিত্র সম্পর্কে মাও-সে-তুঙের বক্তব্য যে একেবারে সঠিক তা বলা যাবে না। তাঁর ব্যাখ্যা স্ব বিরোধীতা অতিরঞ্চন দোষে দুষ্ট। তিনি এই বিপ্লবের পিছনে লেনিনের প্রভাবকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, বলশেভিক বিপ্লবের আগেই চীনে সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সাংস্কৃতিক আন্দোলন না হলে ৪ঠা মে' আন্দোলন সংগঠিত হত না।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব : প্রকৃতিগত দিক দিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে, এই আন্দোলন ছিল চীনের সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এই আন্দোলন মাতৃভাষার বিকাশের পথকে সহজ করেছিল। সমগ্র চীনে এই বিপ্লব ছড়িয়ে পড়েছিল। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে চীনে সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক বিশ্বজনীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। মার্কিন বুদ্ধিজীবী ডিউই- বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি, ব্রিটিশ দার্শনিক রাসেলের সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা, রোমা-রোঁলা টলস্টয়ের মানবতাবাদ এবং মার্কস এঙ্গেলসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ চীনা ছাত্র বুদ্ধিজীবীদের গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল।

অর্থনৈতিক বিপ্লব : ঠা মে আন্দোলনকে সামাজিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব বলে উল্লেখ করা হলেও এক অর্থনৈতিক বিপ্লব বলা যায়। আন্দোলনকারীরা বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী বিশেষ করে জাপানি পন্যকে বয়কট করেছিল। চীনা বাজারে জাপানি পন্যের আলাদা এক মর্যাদা থাকায় চীনের পন্য তেমন বিক্রি হত না আন্দোলনকারী ছাত্ররা জাপানি পন্যকে বয়কট করলে চীনের বাজারে বৈদেশিক প্রতিযোগীতা থেকে চীনা পন্য মুক্তি পেয়েছিল। চীনের বনিকদের স্বার্থকে ছাত্ররা পুরণ করেছিল। চীনা বণিক সমাজ নিজেদের স্বার্থে ছাত্রদের এই আন্দোলনকে সাহায্য করেছিল।

চীন ৪ঠা মে' আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছিল। শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি রাজনীতি সকল ক্ষেত্রে চীনে আমুল পরিবর্তন এসেছিল। চীন তার ঐতিহ্যের বেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত করার সুযোগ পেয়েছিল। ১৯২০ সাল নাগাদ চীন আধুনিক পৃথিবীর অঙ্গ হয়ে ওঠে। চীনের রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা সার্বভৌমত্ব যেমন রক্ষিত হয়েছিল তেমুনি শিল্পায়নের বুনিয়াদ রচিত হয়। শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বুর্জোয়ারা গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। চীনের আধুনিকিকরণ শুরু হয়। আত্মপ্রত্যয়ী চীন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির বাধাকে উপেক্ষা করে নিজের মুক্তির পথকে নিজেই খুঁজে নিয়েছিল। এই আন্দোলনের সব দিক ভালো ছিল না। এর অনেক নেতিবাচক দিক ছিল। এই আন্দোলন যতটা ধ্বংসাত্মক ছিল ততটা গঠনাত্মক ছিল না। এই আন্দোলনের পরিণতি ভালো হয়নি। আন্দোলনের প্রথম দিকে ব্যক্তি স্বাধীনতার উপরে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনের শেষে তা হয়নি। ব্যক্তির থেকে দলকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয় তা ছাড়া এই আন্দোলনের আর একটি ত্রুটি হল আন্দোলনকারীরা চীনের পুরোনো ঐতিহ্যকে আক্রমন করে এবং পশ্চিমী সভ্যতার গুনগান করে সঠিক কাজ করেনি। মননশীলতার ক্ষেত্রেও এই বিপ্লব কোন মৌলিক অবদান রাখতে পারে নি।

গুরুত্ব : পিকিং সমরনায়কদের সরকার জাপান ফ্রান্সের সাহায্য নিয়ে আন্দোলন দমন করেচিলেন কিন্তু এর প্রভাব ছিল সুদুরপ্রসারী। এর তাৎক্ষরিক ফল ছিল কয়েকজন জাপানি মন্ত্রীর পদচ্যুতি হওয়ার ঘটনা। কিন্তু এই আন্দোলন থেকে যে ঘটনা শুরু হয়েছিল তা ১৯৪৯ সালের গণপ্রজাতান্ত্রিক চীনের আধুনিকিকরনে সাহায্য করেছিল। এর ফলে চীনে রাজনৈতিক মেরুকরণ স্পষ্ট হয়। সারাদেশ জড়ে ঐক্যের ভাব জেগে উঠেছিল। চিন্তা জগতে পশ্চিমীকরনের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। যদিও চীন আধুনিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য গ্রহণ করেনি।

Post a Comment

0 Comments