নব্য-উপনিবেশবাদের সংজ্ঞা নিরুপন করুন? নব্য-উপনিবেশবাদের প্রসারের ঐতিহাসিক ধারাগুলি আলোচনা করুন? অথবা কিভাবে অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিকে নয়া সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়? অথবা, নব্য উপনিবেশবাদ সম্পর্কে আলোচনা করুন? অথবা নব্য-ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক শোষন সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখুন?

 

  • নব্য-উপনিবেশবাদের সংজ্ঞা নিরুপন করুন
  • নব্য-উপনিবেশবাদের প্রসারের ঐতিহাসিক ধারাগুলি আলোচনা করুন?
  • অথবা
  • কিভাবে অর্থনীতি সাংস্কৃতিকে নয়া সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়?
  • অথবা, নব্য উপনিবেশবাদ সম্পর্কে আলোচনা করুন?
  • অথবা
  • নব্য-ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক শোষন সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখুন?

জাতিরাষ্ট্রের পররাজ্য গ্রাসের প্রবণতা থেকেই সাম্রাজ্যবাদের জন্ম। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে জাতীয়তাবাদের আগ্রাসী চেহারা দেখে বিচলিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছিল ‘Nationalism' বক্তৃতামালায়। ‘Carnivorous’ ‘carnibattistic' শব্দগুলো অনেক বেদনায় ব্যবহার করেছিলেন তিনি। গান্ধিজি বলতেন, ‘Violent Nationalism, otherwise' known as imperialism, it the curse' সাম্রাজ্যবাদের মূল প্রেরণা শুধু জাতির গৌরবৃদ্ধি নয়, বরং পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় ব্যাপারটি গৌন হয়ে যায়। ১৮৯০ সালে ইংরাজিতে প্রথম 'Imperialism' কথাটি চয়ন করা হয়। এর উৎপত্তি 'Imperialiste' শব্দ থেকে। চার্লস বেয়ার্ড এর অর্থ করেছিলেন, নতুন ভূখণ্ড দখল এবং তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। ইংরেজ ফেবিয়ান উদারপন্থী লেখক জে. . হবসন আর অস্ট্রিয়ার মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হিলফারজি এর কারণ খুঁজে পেয়েছিলেন বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সক্রিয়তার মধ্যে। হবসন মনে করতেন, পুঁজিবাদী মূলধনীরা-স্বদেশে বিনিয়োগের পূর্ণ সুযোগ পায় না বলে জাতিরাষ্ট্রের সীমানার বাইরে মূলধন পাঠাতে চায়, তার জন্য যুদ্ধ করে বাইরের অঞ্চল দখল করতে চায়। থেকেই সাম্রাজ্যবাদের উত্থান। সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে হবসনের মতের বিরাট প্রভাব পড়েছিল রুশ বিপ্লবী লেনিনের উপর। হবসনের মতো লেলিনও মনে করতেন, অর্থনৈতিক স্বার্থবিস্তারই হল সাম্রাজ্যবাদের মূলকথা। তবে লেনিনের কাছে এর অর্থ আরও ব্যাপক দূরপ্রসারী ছিল। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক কারন থেকে উদ্ভুত নয়, সাম্রাজ্যবাদ নিজেই একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এটা ছিল মহাজনী মূলধনের সংগঠনের পরিমাপ এবং ধনতান্ত্রিক বিকাশের সর্বোচ্চ স্তর। লেনিন তাই তাঁর বইটির নাম দিয়েছিলেন Imperialism, the Highest stage of Capitalism (1916) তাঁর ধারণা পুঁজিবাদের একচেটিয়া অবস্থায় ব্যাংক মূলধন এবং শিল্প-মূলধনের মিলন ঘটে এবং উভয়ের বিনিয়োগের সাধারণ স্বার্থ রক্ষা করতে পারে একমাত্র সাম্রাজ্যবাদ। এই কারণেই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ একচেটিয়া পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য বলে লেনিন মন্তব্য করেছিলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই ইংরেজরা নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী বলে গর্ব বোধ করত। আফ্রিকার বাঁটোয়ারাকে তারা সাম্রাজ্যবাদী সমঝোতা হিসেবে দেখেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র বদল ঘটে। বহু উপনিবেশ সেই সময় জাতিরাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীনতা অর্জন করে তৃতীয় বিশ্ব নির্মাণ করে। ফলে পুরানো ধারার সাম্রাজ্যবাদ বজায় রাখা আর সম্ভব ছিল না। উদ্ভাসিত হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদের পরোক্ষ ধরন। এর অন্যতম অস্ত্র ছিল কোন রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় সাহায্যের নামে সাময়িক কর্তৃত্ব স্থাপন, আর অর্থনৈতিক সাহায্যের নামে ঋণমাধ্যমে মূলধনী পুঁজির বিনিয়োগ। অনেক ঐতিহাসিক একে পশ্চাৎগামী ঔপনিবেশকতা বলতে চেয়েছেন। সাধারণভাবে পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদের এই কৌশলগুলোর সমষ্টিবদ্ধ রূপকে নয়া ঔপনিবেশিকতা বা নয়া সাম্রাজ্যবাদ Neo-colonialism/Neo-Imperialism) বলা হয়। প্রসঙ্গে ঘানার প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান কউম নক্রুমা (Kwame Nkrumah) লিখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুধু সমরশক্তির সাহায্যে অন্য রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আবার আর একটি বিশ্বযুদ্ধের সম্ভবনা তৈরি করতে পারে, এই আশঙ্কায় বড় রাষ্ট্রগুলো সামরিক ব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক শক্তি প্রয়োগেরও চেষ্টা করে। এর ফলেই সৃষ্টি হয় নয়া ঔপনিবেশিকতা। লেনিনের বক্তব্যের সামান্য পরিবর্তন করে নক্রুমা তাই Neo-colonialism-কে 'Last stage of Imperialism' আখ্যা দিয়েছেন। নক্রুমার এই বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি পাওয়া গেছে হাবাল্টার রডনি' (Water Redney) How Europe Underdeveloped Africa-রচনাটি কিংবা সোস্যাল ডেমোক্র্যাট কার্ল কাউটস্কিরউগ্র সাম্রাজ্যবাদ' (Ultra Imperialism) শব্দটির চয়নে। অর্থনৈতিক ভাবে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফ্র্যানৎস ফানন (Frantz Fanon) The Wretched of the Earth নামক রচনায় উন্নত বিশ্বের উপর অনুন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার প্রশ্নটিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। নব্য-মাকর্সবাদীদের নির্ভরতা তত্ত্ব অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদকেই বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করে। অনুন্নত দেশের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগে উন্নত দেশ অনুন্নত রাষ্ট্রের অর্থনীতি এবং রাজনীতিকে নিজস্ব কূটনৈতিক পরিকাঠামোর অংশে পরিণত করে এবং তার জাতীয় সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। এইভাবেই সদ্য স্বাধীন দেশ আবার অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরাধীনতা-স্বাধীনতা-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দুর্বলতাকূটনৈতিক অর্থনৈতিক পরিণত হয়। মার্কসবাদীরা এই রূপান্তরের পর্বগুলিকে চিহ্নিত করেন :

অধীনতা। এই প্রক্রিয়ায় নয়া উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রের প্রচলিত কৌশলগুলি হল আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি, দ্বি-পাক্ষিক এবং বহু-পাক্ষিক অসম বাণিজ্যচুক্তি, পুঁজি রপ্তানি ইত্যাদি। একই সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশে প্রযুক্তির রপ্তানির মাধ্যমেও উন্নত দেশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে যে নিয়ন্ত্রণের স্বার্থ প্রত্যক্ষ উপনিবেশবাদের পেছনে কার্যকর ছিল সেই নিয়ন্ত্রণের স্বার্থই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নয়া-সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে সক্রিয়। এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার পেছনেও কার্যকর। পুঁজির ধন এবং কূটনৈতিক প্রক্রিয়া পরিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই মেরুভিত্তিক কূটনীতি একমেরুর দিকে অগ্রসর হওয়ার ফলে প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার নানা উপায় উদ্ভাবনের পাশে সাম্রাজ্যবাদেরও নতুন ধরন অনুসৃত হয়েছে। এই ধরনেরই প্রধান ভিত্তি হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বায়নের নীতি গ্রহণ করেছে।

Post a Comment

0 Comments