- ১৯১৯-১৯৩২ পর্যন্ত আমেরিকার বিদেশনীতি আলোচনা করুন?
- অথবা
- ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির সময় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতির বিপ্লব এসেছে'-আলোচনা করুন?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হয়েছিল। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের পশ্চিম গোলার্ধে আধিপত্য ও প্রতিপত্তি বিস্তারের ব্যাপারে উদ্যোগি ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে ইউরোপীয় দেশগুলির কাছে মূল সমস্যা ছিল মূলত ডলারের ঘাটতি। এসময় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত সফল রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হয় ৷ এই আর্থিক সমস্যায় গোটা ইউরোপে যখন প্রসার হচ্ছে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বস্তুত বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বিপুল পরিমাণ পুঁজি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কুক্ষিগত ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এহেন পর্বে, পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত প্রাধান্য এবং পশ্চিম ইউরোপে আমেরিকিকরন প্রধান বিষয় হয়ে দাড়িয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-এর উদ্দেশ্য হয়ে দাড়ায় পশ্চিম ইউরোপে আধিপত্য ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করা। বলা বাহুল্য সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্দেশ্য কিন্তু তা ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত গোটা ইউরোপকে রসদ এবং সম্পদের দ্বারা পুনরুজ্জীবিত করা, মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদেশনীতিতে এটি ছিল মূলগত পার্থক্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। ইউরোপীয় শক্তিগুলি দুর্বল হয়ে পড়লে রাজনৈতিক দিক থেকে শূণ্যতার সৃষ্টি হয়। মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র এক ‘Super power' এর ভূমিকায় অবতীর্ন হয়। বলাবাহুল্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খুব একটা ভোগ করতে হয়নি বলে আর্থিক ও বিদেশ নীতির দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখনও অনেক সক্ষম ছিল। কিন্তু তাদের মূল সমস্যা ছিল আত্মতুষ্টিতে ভোগা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য। এই একাধিপত্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতি পর্যালোচনা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই পর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছিল। সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে এসে তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিকে অটুত রাখার চেষ্টা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পর্বে একাই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। ১৯৩৭ খ্রীঃ পর থেকে ইউরোপে যুদ্ধের আবহ শুরু হতে থাকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট স্পষ্টভাবে অনুভব করেন যে, হিটলারের আক্রমণাত্মক মনোভাব শিঘ্রই ইউরোপ তথা সমগ্র বিশ্বে পুনরায় বিপর্যয় ডেকে আনবে। সুতরাং তিনি ইউরোপের যুদ্ধ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোরাষ্ট্র নীতি পরিবর্তন করার প্রয়োজন সম্পর্কে মার্কিন জনগনকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। তাঁর মতে দুই দশককাল ধরে অনুসৃত বিচ্ছিন্ন থাকবার নীতি ইউরোপের ভবিষৎ পর্যায় থেকে আমেরিকাকে রক্ষা করতে পারবে না। সাম্প্রতিক প্রবর্তিত নিরপেক্ষতা মূলক আইনগুলি রুজভেল্ট সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করতে পারেননি এবং ইউরোপে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নিরপেক্ষতামূলক আইনগুলি বাতিল করার জন্য মার্কিন কংগ্রেসের নিকট আবেদন করেন। যাতে জার্মাণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত ইউরোপের রাষ্ট্রগুলিকে মার্কিন সরকার সাহায্য করতে পারে। ফ্রান্সের পতন ঘটলে এবং ইতালি হিটলারের পক্ষে যোগদান করলে সমগ্র ইউরোপের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশঙ্কিত হয়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অক্ষশক্তি বর্গের বিরূদ্ধে এক প্রবল জনমত সৃষ্টি হয়। মার্কিন জনগণ অনুভব করেন যে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মতো গণতান্ত্রিক দেশগুলির পতন ঘটলে অক্ষশক্তি বর্গের আক্রমণ থেকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র আমেরিকাও নিরাপদ থাকবেনা। প্রকৃতপক্ষে ইতিমধ্যে অক্ষ শক্তিবর্গের ঘোষণা—'এই বিশ্বে লুপ্ত প্রায় গণতন্ত্রের কোনো স্থান নেই'। মার্কিন জনগনকে ইউরোপের গণতান্ত্রিক দেশগুলির প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলেছিল। এতক্ষনে অক্ষশক্তিবর্গ কর্তৃক শৃঙ্খলাবদ্ধ ইউরোপের দেশগুলির মুক্তি সাধনে নৈতিক দায়িত্ব গ্রহণে প্রয়োজনীয়তা মার্কিন জনগণ অনুভব করে। স্বভাবতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হয়। ১৯৪০ খ্রীঃ মার্কিন কংগ্রেস বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা প্রবর্তন করেন। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডার সঙ্গে যুগ্ম প্রতিরক্ষা সংস্থা গঠন করেন। ১৯৪০ খ্রীঃ জার্মান ব্রিটেনের ওপর বিমান আক্রমণ শুরু করলে মার্কিন জনগণের অধিকাংশ বিশ্বের গনতান্ত্রিক দেশগুলির অনুকূলে যুদ্ধে যোগদানে জন্য উদগ্রিব হয়ে ওঠে। হিটলারের সাম্রাজ্যবাদ সমগ্র বিশ্বের ধ্বংস সাধনে বদ্ধপরিকর, এই সত্য উপলব্ধি করে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট আমেরিকাকে সামরিকভাবে প্রস্তুত করতে লাগেন এবং ১৯৪১ খ্রীঃ ব্রিটেনকে সাহায্য করার জন্য প্রয়োজনীয় ল্যান্ডলিজ আইন প্রনয়ন করেন। এইভাবে ইউরোপের যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোরাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন ঘটায়।
0 Comments