দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে আফ্রিকা ও এশিয়ায় জাতিয়তাবাদের বিকাশের মধ্যে তুলনা করুন? অথবা, আফ্রো-এশিয়া জাতিয়তাবাদের উদ্ভব ১৯৪৫ এর পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?

 

  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে আফ্রিকা এশিয়ায় জাতিয়তাবাদের বিকাশের মধ্যে তুলনা করুন?
  • অথবা, আফ্রো-এশিয়া জাতিয়তাবাদের উদ্ভব ১৯৪৫ এর পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?

ইউরোপীয় ঔপনিবেশের শেষ সীমান্ত ছিল আফ্রিকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়েও ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, পোর্তুগাল স্পেন তাদের আফ্রিকান উপনিবেশগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল; কিন্তু আফ্রিকার জাতীয়তাবাদের উন্মেষের ফলে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা হয়। ১৯৪৫ খ্রীঃ আফ্রিকা মহাদেশে তিনটি মাত্র স্বাধীন দেশ ছিল; যথা-ইথিওপিয়া, লাইবেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু ১৯৭০ খ্রীঃ নাগাদ অন্ততপক্ষে ৫২টি স্বাধীন আফ্রিকান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। ১৯৫০ এর দশক থেকে ব্রিটিশ গভঃমেন্ট ব্রিটিশ-ঔপনিবেশিকরণের অপরিহার্যতার বিষয়টি মেনে নেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে প্রতিরোধ করার বদলে তা সহজসাধ্য করার ব্যাপারে সচেষ্ট হয়। ১৯৬০ এর দশকে আফ্রিকান নেতৃবৃন্দ নতুন উৎসাহ অনুপ্রেরণার দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন এবং নতুন জাতি গঠনের চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হন। আফ্রিকানদের জাতীয় গোষ্ঠীগত বিন্যাসটি Decolonisation এর প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছিল। আফ্রিকার বিভিন্ন উপনিবেশগুলি যারা স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে সেগুলির সীমানা ঔপনিবেশিকেরা কৃত্রিমভাবে নির্ধারিত করেছিল। কোনো একটি ঔপনিবেশিক একই জাতি গোষ্ঠীভুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের বসবাস ছিল না কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই লোকেরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করত। আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ রাজনৈতিক ঐক্য সম্পর্কে সচেতনতা Decolonisation এর সময় থেকেই নির্ধারিত হয়েছিল। তবে আফ্রিকার ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া কিছুটা বিলম্বিত হয়েছিল। গোষ্ঠীগত আনুগত্যের বিষয়টি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের ক্ষেত্রে কিছুটা বিলম্বের কারণ হয়ে উঠেছিল এবং স্বাধীনতা উত্তর পর্যায়েও এই সমস্যা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পক্ষেও মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে কার্যত কোনোরকম প্রতিরোধ ঘটেনি এবং সামরিক সাহায্য ছাড়াই ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখা সম্ভবপর হয়েছিল। কতগুলি ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ঔপনিবেশগুলিতে 'Protectorate System'-এর মাধ্যমে স্থানীয় আফ্রিকান শাসক গোষ্ঠীকে স্বায়ত্তশাসনের সীমিত অধিকার প্রদান করা হয়েছিল। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউরোপীয় শাসকেরা ‘Divide and Rule' নীতির মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থাকে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার প্রতি আফ্রিকানদের এক ধরণের ভীতি আশঙ্কা কার্যকরী হওয়ার দরুন শাসকদের বিরূদ্ধে কোনোরকম প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। ক্রমশ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে থাকে। আফ্রিকানদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটলে তাদের জ্ঞান অভিজ্ঞতার দিগন্ত প্রসারিত হয়। এছাড়া আফ্রিকায় ইউরোপীয়দের উপস্থিতিও আফ্রিকান সমাজে পরিবর্তনের সূচনা করে। বিশেষ করে শহরগুলিতে এই পরিবর্তন আরও বেশি মাত্রায় চোখে পড়ে। ইউরোপীয়রা কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে অর্থনীতি শিক্ষাগত বিষয় সুযোগের সৃষ্টি করে। ফলস্বরুপ উক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ঔপনিবেশিক শাসনের হতাশা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। এই সামান্য শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার আকাঙ্খা অর্থাৎ 'Africans Movement-এর আকার ধারণ করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই আফ্রিকানদের মধ্যে কিছু অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে, কারন বিশ্বব্যাপী মহামন্দা এই অসন্তোষকে আরও তীব্র করে। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার জোরালো প্রসার ঘটে। পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে ঔপনিবেশিক আন্দোলন আফ্রিকানদের প্রভাবিত করে। এহেন পর্বে নেহেরু সর্বত্রই জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে স্বাগত জানায়। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করা হয়। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রতিষ্ঠা, আফ্রো-এশিয়া জাতীয়তাবদকে উৎসাহিত করে। জাতীয়তাবাদের সূত্রপাত নিঃসন্দেহে এশিয়া আফ্রিকার মতো দেশগুলির ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে কাজ করেছে একথা বলাই বাহুল্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পর্বে ব্রিটিশ শাসন ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশের উপনিবেশগুলিকে গুটিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। এরপর আফ্রিকা বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিকতার জাল ছিন্ন করতে সক্ষম হয় এবং বিভিন্ন দেশের একটি মডেলে রূপায়িত হয়। এক্ষেত্রে কোরিয়ার নামও উল্লেখ করা যায়। যদিও তৎকালিন পর্বে রোডেশিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এইভাবে আফ্রো এশিয়া জাতীয়তাবাদকে ১৯৪৫ এর পরবর্তী পর্বে গোটা ইউরোপে স্বাধীনতার চাহিদাকে বহুগুন বৃদ্ধি করেছিল। উপরিউক্ত দেশগুলি স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ঘটনা দেখে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঔপনিবেশিক শাসনে জর্জরিত মানুষের কাছে স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক চেতনা বহুগুনে বৃদ্ধি পায় এবং তারা একে একে স্বাধীনতা অর্জন করে।

Post a Comment

0 Comments