মার্কসবাদের অন্তর্গত ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং শ্রেনী সংগ্রামের তত্ত্ব আলোচনা করুন? অথবা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলতে কি বোঝেন ?

 

  • মার্কসবাদের অন্তর্গত ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং শ্রেনী সংগ্রামের তত্ত্ব আলোচনা করুন
  • অথবা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলতে কি বোঝেন ?

                                         আধুনিক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের জনক কার্লমার্কস ১৮১৮ খ্রীঃ জার্মাণির টিয়ার শহরে এক মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন আইনজীবি। মেধাবী ছাত্র কার্ল মার্কস বন বার্লিন বিশ্বদ্যিালয়ে আইন নিয়ে লেখাপড়া করলেও ইতিহাস দর্শনশাস্ত্রে তাঁর যথেষ্ট অনুরাগ ব্যুৎপত্তি ছিল। ১৮৪১ খ্রীঃ তিনি ইয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শণশাস্ত্রে ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন। ১৮৪২ খ্রীঃ তিনি কলোন থেকে প্রকাশিতরেইনিকো জাইঙ্গ' নামে একটি উগ্রপন্থি সংবাদপত্রের সম্পাদনার কাজে নিযুক্ত হন। বিপ্লবি ভাবাদর্শ প্রচারে জন্য প্রাশিয়া সরকার পত্রিকাটির প্রকাশ নিষিদ্ধ করে এবং কার্লমার্কস স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হন। বিতাড়িত কার্লমার্কস প্যারিসে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখানে বিশিষ্ট সমাজতন্ত্রী চিন্তাবিদদের সান্নিধ্যে এসে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতি তাঁর বিশ্বাস সুদৃঢ় হয়। এখানেই বিশিষ্ট ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর রচনা প্রকাশ হতে থাকলে ফরাসী সরকার তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ হয় এবং সরকারি আদেশে তিনি ফ্রান্স ত্যাগে বাধ্য হন। অতঃপর তিনি বেলজিয়ামের ব্রাসেলস- আশ্রয় নেন। ১৮৪৭ খ্রীঃ তিনি ব্রাসেলসে বামপন্থি শ্রমজীবিদের নিয়েকমিউনিষ্টলিগনামে এক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৪৮ খ্রীঃ লন্ডনে কমিউনিষ্ট লিগ এর দ্বিতীয় অধিবেশন উপলক্ষে মার্কসকে একটি ইস্তাহার রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। মার্কস এঙ্গেলস রচিত এই ইস্তাহারটি ১৮৪৮ খ্রীঃ লন্ডনে প্রকাশিত হয়। এর নাম 'কমিউনিষ্ট ম্যানিফেষ্টোবাকমিউনিষ্ট ইস্তাহার এই পুস্তিকাই তাঁকে খ্যাতির চরম শিখরে পৌঁছে দেয়। একে সমাজতান্ত্রিক দর্শণের বাইবেল বলে অভিহিত করা হয়। এই ইস্তাহারই হল আধুনিক সমাজতন্ত্রের প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা - The birth-cry of modern socialism’অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কির মতে, মার্কসের রচিত কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো একটি অসাধারণ গ্রন্থ। সমাজতন্ত্রবাদকে এই গ্রন্থ একটি ঐতিহাসিক পটভূমিকা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দান করে। এরপর প্রকাশিত হয় তাঁর 'Critic of political Economy' নামক গ্রন্থ। ইস্তাহারে প্রকাশিত সমাজতন্ত্রবাদী তত্ত্বই ১৮৬৭ খ্রীঃ প্রকাশিত ‘Das Capital' গ্রন্থে পুর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে।

                                   কার্ল মার্কস প্রচারিত মতবাদ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ সাম্যবাদ বা মার্কসবাদ নামে পরিচিত। কেবল 'কমিউনিষ্ট ম্যানিফেষ্টো বা দাস ক্যাপিটাল নয় -ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকনমি।দি হোলি ফ্যামিলি’, ‘পভার্টি অব ফিলজফি' প্রভৃতি গ্রন্থে তার রাজনৈতিক মতবাদ সমাজতান্ত্রিক আদর্শ বিপ্লবতত্ত্ব এবং কর্মপদ্ধতি প্রকাশিত হয়েছে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ বা মার্কবাদ মূলত চারটি স্তম্ভের উপর দাড়িয়ে আছে। সেগুলি হল

) ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা। 

) দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ

) উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব এবং 

) আন্তর্জাতিকতা।

কার্লমার্কস ইতিহাসের এক নতুন বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর এই ব্যাখ্যা ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা' ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং অর্থনৈতিক নিমিত্তবাদ নামে পরিচিত। প্রাচীন গ্রিস রোমে ক্রীতদাস স্বাধীন নাগরিক, প্রাচীন রোমে অভিজাত সাধারণ নাগরিক,মধ্যযুগে ভূমিদাস সামন্তপ্রভু এবং আধুনিক যুগে শ্রমিক শ্রেণী পুঁজিপতিদের দ্বন্দ্ব হল সেই নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়। তাঁর বিশ্বাস আধুনিক যুগের এই সংগ্রামে বিশ্বের সব মেহনতি মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণীর জয় হবেই এবং তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সর্বহারা একয়ায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করবে।

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ মার্কসবাদী দর্শণের অন্যতম প্রধান দিক। বলা হয় যে বিশ্ব প্রকৃতির মতো বিশ্বজগৎ মানব সমাজ নিয়ত পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তন আসে সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে। প্রত্যেক পরিস্থিতি ঘটনার মধ্যে তিনটি শক্তি কার্যকরী থাকেথিসিস, অ্যান্টিথিসিস সিন্থেসিস। কোনো পদার্থ বা ঘটনার মধ্যে রক্ষণশীল শক্তি বা যা বর্তমাণ অবস্থাকে ধরে রাখতে চায় তা থিসিস। পরিবর্তনকামী শক্তি বা যে শক্তি বর্তমান অবস্থাকে বাতিল করে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে চায় তা হল অ্যান্টিথিসিস। বিশ্ব প্রকৃতি মানব সমাজে সর্বদাই এই দুটি পরস্পর বিরোধী শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। এই দ্বন্দ্ব থেকেই জন্ম নেয় সিন্থেসিস অথবা বলা যায় যে, দুটি পরস্পর বিরোধী শক্তির মধ্যে সামঞ্জস্যকারী শক্তি হল সিন্থেসিস। রিকার্ডো- ‘Labour theory of value' অপরাপর ইংরেজ অর্থনীতিবিদের রচনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মার্কস উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব নীতি প্রচার করেন। দীর্ঘ নয় বছর গবেষণার পর ১৮৫৯ খ্রীঃ প্রকাশিত 'কনট্রিবিউশন টু দি ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকনমি' গ্রন্থে তিনি প্রথম এই মতবাদ ব্যক্ত করেন। তাঁর মতে, উৎপাদনের বিবিধ উপাদান অর্থাৎ জমি, কাঁচামাল, মূলধন সবই প্রকৃতির দান, এর মালিক সবাই। শ্রমিকের শ্রমের দ্বারাই এগুলি সম্পদ বা সামগ্রিতে রূপান্তরিত হয়। শ্রমিক যা মজুরি পায় তারচেয়ে সে অনেক বেশি উৎপাদন করে। একমাত্র শ্রমের মাপকাঠিতেই উদ্বৃত্ত সম্পদ বন্টিত হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে তা হয় নাপুঁজিপতিরা তা আত্মসাৎ করে। থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হল শ্রমিক পরিচালিত রাষ্ট্রকর্তৃক এর বন্টন নিয়ন্ত্রণ। মার্কসবাদ কোনো ভৌগলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়এর আবেদন আন্তর্জাতিক। তাঁর মতে, শ্রমিকের কোনো দেশ, জাতি বা ধর্ম নেই। পৃথিবীর সব দেশের শ্রমিকই একই ভাবে নির্যাতিত শোষিত। তাঁর বিশ্বাস পৃথিবীর সব দেশের শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ১৮৪৭ খ্রীঃ তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক সংগঠন—‘কমিউনিষ্টলিগ ১৮৬৪ খ্রীঃ তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়' প্রথম ইন্টারন্যাশনাল বা ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং মেনস অ্যাসোসিয়েশন ইউরোপের বহু দেশের শ্রমিক প্রতিনিধিরা এতে যোগদান করেন এবং মার্কস সংগঠনের নিয়মকানুন কর্মসূচি রচনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পরেও দ্বিতীয়, তৃতীয় চতুর্থ ইন্টারন্যাশনাল সংগঠন গঠিত হয়েছে।

Post a Comment

0 Comments