ফ্রান্সে এবং অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রে জুলাই বিপ্লবের প্রভাব কি ছিল ? অথবা ফ্রান্সে ১৮৩০-এর জুলাই বিপ্লবের ফলাফল আলোচনা করুন?

 

  • ফ্রান্সে এবং অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রে জুলাই বিপ্লবের প্রভাব কি ছিল ? অথবা ফ্রান্সে ১৮৩০-এর জুলাই বিপ্লবের ফলাফল আলোচনা করুন?

                                                          ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লবের প্রভাব কেবল ফ্রান্সেই সীমাবদ্ধ ছিলনা। এই বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও দেখা যায়। জুলাই বিপ্লব ইউরোপের সর্বত্র গণ-আন্দোলনের উৎসাহ যোগায়। যার ফলে ১৮১৫ খ্রীঃ ভিয়েনা বন্দোবস্ত প্রায় নস্যাৎ হবার উপক্রম হয়। ইউরোপের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকদের সম্মুখে এই বিপ্লব এক গভীর সমস্যার সৃষ্টি করে। ১৮১৫ খ্রীঃ তাঁরা সকল রকমের বিপ্লবের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এবং ইউরোপে শান্তি বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে ইউরোপের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগন ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লব স্বীকার করে লুই ফিলিপ-এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন,যদিও তা করা ছাড়া তাদের অন্য কোনো উপায় ছিলনা। প্রকৃতপক্ষে ১৮৩০ খ্রীস্টাব্দের বিপ্লব ভিয়েনার বন্দো টকে বানচাল করে দেয়। এই বিপ্লবের সার্থকতায় উৎসাহিত হয়ে বেলজিয়াম পোল্যান্ড, জার্মাণী ইতালরি জনসাধারণ অত্যাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ভিয়েনা কংগ্রেস বিধান অনুযায়ী বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্সের বিরুদ্ধে হল্যান্ডকে শক্তিশালী করা। কিন্তু এই সংযুক্তি বেলজিয়ানরা পছন্দ করেনি, কারণ ভাষা কৃষ্টির দিক থেকে ওলন্দাজ বেলজিয়ানদের মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। সেই কারণেই বেলজিয়ানরা পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে। কিন্তু হল্যান্ডের রাজা এই দাবি অগ্রাহ্য করলে বেলজিয়ানগন প্যারিস নাগরিকদের পথ অনুসরণ করে বিদ্রোহী হয়। হল্যান্ডের রাজসেনা বিদ্রোহীদের নিকট পরাজিত হয়। বেলজিয়ামগণ অস্থায়ী জনসভা আহ্বান করে বেলজিয়ামের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৮৩১ খ্রীঃ বেলজিয়াম হল্যান্ড থেকে বিমুক্ত হয় লিওপোল্ড রাজপদে অধিষ্ঠিত হন।

                                         ফরাসী বিপ্লবের ফলে বেলজিয়াম স্বাধীনতা লাভ করল কিন্তু অপরদিকে পোল্যান্ড স্বাধীনতা হারায়। ভিয়েনা ব্যবস্থানুযায়ী উদারপন্থী জার প্রথম আলেকজান্ডার পোল্যান্ডের অধীশ্বর হয়ে সেখানে স্বায়ত্বশাসন কায়েম করেছিলেন। প্রথম আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই জার নিকোলাস পোল্যান্ডের স্বায়ত্বশাসনের অধিকার বাতিল করলে তাতে ঘোর অশান্তির সৃষ্টি হয়। ফরাসী বিপ্লবের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে পোলেরা বিদ্রোহী হয়ে একটি অস্থায়ী শাসনতন্ত্র রচনা করেন। ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লবের ঢেউ জার্মানিতেও এসে পৌঁছায়। বিচ্ছিন্নভাবে সেখানে গণ-আন্দোলন আরম্ভ হয়। উত্তর-জার্মাণীতে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলি তাদের শাসনকর্তাদের থেকে বলপূর্বক উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র আদায় করে। অপরদিকে দক্ষিণ জার্মাণির শাসকবর্গ গণআন্দোলনের চাপে উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র সমর্থণ করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে মেটারনিকের সাহায্য লাভ করে এই শাসকগন নতুন শাসনতন্ত্র বাতিল করে স্বেচ্ছাতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। জুলাই বিপ্লবের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ইতালির গুপ্ত সমিতিগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে। পার্মা, মোডেনা পোপশাসিত অঞ্চলে জনসাধারণ সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। কিন্তু অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলার মেটারনিক অত্যন্ত কঠোর হাতে সেই বিদ্রোহ দমন করেন। ফলে অস্ট্রিয়ার প্রতি ইতালীবাসীদের ঘৃণা বিদ্বেষ আরও গভীর হয়ে ওঠে। জুলাই বিপ্লবের কয়েক বছরের মধ্যেই স্পেন পর্তুগালে গণতান্ত্রিক শাসন স্থাপিন হয়। কিন্তু তা যে জুলাই বিপ্লবের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সম্ভব হয়েছিল তা নয়। উত্তরাধিকারমূলক দ্বন্দ্ব অভ্যন্তরীন পরিস্থিতির ফলেই তা সম্ভব হয়েছিল।

এরুপ বলা হয়ে থাকে যে, জুলাই বিপ্লব ইউরোপে বিপ্লবীয় মনোভাব ভাবধারাকে জাগরিত করেছিল মাত্র। কিন্তু জাতীয় আশা-আকাঙ্খা চরিতার্থ করতে পারেনি। একমাত্র বেলজিয়াম ছাড়া আর কোথাও জনগণের আশা আকাঙ্খা পরিতৃপ্তি লাভ করেনি। তথাপি এটি অস্বীকার করা যায়না যে বিপ্লবী ভাবধারার এই জাগরণ একেবারেই ব্য হয়নি। জার্মাণি, ইতালী পোল্যান্ডের বিপ্লবীগণ বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য প্রস্তা হয়েছিল এবং ইউরোপের প্রায় সর্বত্র বিপ্লববাদী সমিতিগুলি সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। একদিকে থেকে ১৮৪৮ খ্রীঃ বিপ্লবকে জুলাই বৈপ্লবিক শক্তির চূড়ান্ত জয়লাভ সম্ভব না হলেও এই বিপ্লব ছিল ১৮১৫ খ্রীঃ ভিয়েনা কংগ্রেস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রক্ষণশীল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রথম বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। ডেভিড থমসন এর মতে, “১৮১৫ ১৮৩০ খ্রীঃ মধ্যবর্তীকালে ইউরোপে যে বিপ্লব সংঘটিত হয়, তা ১৮১৫ খ্রীঃ রাজনৈতিক রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তে ফাটল ধরায়।



Post a Comment

0 Comments