- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইউরোপ দুটি সশস্ত্র রাষ্ট্রজোটে কীভাবে বিভক্ত হয়েছিল ? আলোচনা করুন। অথবা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট আলোচনা করুন। অথবা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কী অনিবার্য ছিল ?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হল সমগ্র বিশ্বব্যাপী দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক শিবিরের মধ্যে শক্তি পরীক্ষা। এত বড়ো একটা সর্বগ্রাসী মহাযুদ্ধ কোনো একটিমাত্র বিশেষ কারণ বা ঘটনা থেকে উদ্ভুত হওয়া সম্ভব নয়। অনেকগুলি কারণের ফলস্বরূপ তা সম্ভব হতে পারে। সুতরাং এই কারণগুলি অনুসন্ধান করতে হবে মহাযুদ্ধের পূর্ববর্তী যুগগুলির ইতিহাসের মধ্যে। এই সময়ের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ এই কারণগুলি স্পষ্ট করে তুলে ধরতে সাহায্য করবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী যুগের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনরা করলে দেখা যায় যে, এই সময়ে বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদ অত্যন্ত উগ্র সংগ্রামশীল রূপ ধারণ করে। প্রত্যেক দেশের উৎকট জাতীয়তাবাদ নিজ নিজ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে থাকে এবং অন্যান্য জাতি সম্বন্ধে বিদ্বেষভাব পোষণ করতে আরম্ভ করে। এই উৎকট জাতীয়তাবাদ সবচেয়ে বেশি আত্মপ্রকাশ করে জার্মানিতে। জার্মাণির অনেক ঐতিহাসিক, দার্শণিক ও সমাজবিদ এই ধারণা প্রচারে যথেষ্ট সাহায্য করে। উগ্র জাতিয়তাবোধ বাস্তবে প্রকাশ পেতে থাকে বর্হিদেশে সামাজ্যবিস্তারের আকাঙ্খার মধ্য দিয়ে। বিশ্বের অন্যান্য জাতিগুলিকে পদানত করা এবং তাদের উপর আধিপত্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার প্রকৃষ্ট পথ দেখতে পেল। একমাত্র বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জাতীয় গৌরব বৃদ্ধি এবং বিশ্ব রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার সম্বব বলে বিবেচিত হল। ইংল্যান্ড ফ্রান্স, রাশিয়া প্রভৃতি রাষ্টগুলি সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রথম অগ্রসর হয়ে এই প্রধান্য অনেকখানি প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল। জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি এ ব্যাপারে একটু দেরিতে যাত্রা শুরু করে বলে প্রথমোক্ত রাষ্ট্রগুলির সাথে স্বভাবতই তাদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি হয় এবং একটি যুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি করে। শিল্প বিপ্লবের দ্রুত প্রসারের ফলে একদিকে যেমন প্রত্যেক দেশে শিল্পোৎপাদিত দ্রব্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় অপরদিকে তার সাথে কাঁচামালের চাহিদাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সুতরাৎ শিল্পোৎপাদিত দ্রব্য বিক্রয়ের বাজারে কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলির মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দেয় এবং এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলি গ্রাস করার জন্য এক নগ্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি হয়। আহত জাতীয়তাবাদ এবং অতৃপ্ত জাতীয় আকাঙ্খাও ইউরোপের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল—
১) সেডানের যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি ফ্রান্স কোনো সময়ে ভুলতে পারেনি। আলসা লোরেন পুনরূদ্ধারের প্রতিজ্ঞা থেকে সে কোনো সময়েই বিচ্যুত হতে পারেনি। লৌহখনিতে সমৃদ্ধ লোরেন অঞ্চলের প্রয়োজনীয়তা ফরাসী শিল্পপতিগণের কাছেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ন ছিল। সুতরাং জার্মানির বিরূদ্ধে ফরাসী জাতির মধ্যে প্রতিহিংসা মনোবৃত্তি দিন দিনই বৃদ্ধি পেতে থাকে।
২) ইতালির জাতীয় ঐক্যের আকাঙ্খা তখনও পরিতৃপ্ত হতে পারেনি। ‘ট্রেনটিনো ও ‘ট্রিয়েষ্ট’ তখন অষ্টিয়ার অধিনে ইতালির জাতীয় ঐক্য সম্পূর্ণ করার জন্য ইতালিতে যুদ্ধের মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল।
৩) বলকান অঞ্চলে জাতীয়তার ভিত্তিতে কোনো সময়েই ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠিত হতে পারল না। স্লাভ জাতীর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রশ্নই সবচেয়ে বেশি জটিলতার সৃষ্টি করেছিল। সার্বিয়া তার নেতৃত্বে স্লাভজাতীকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সচেষ্ট ছিল। বলকানে অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যবাদী বিস্তার প্রতিহত করার জন্য রাশিয়া স্লাভ জাতীর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আন্দোলনকে সমর্থণ করত। বলকান জাতিগুলির মধ্যে পরস্পর প্রতিযোগিতা বলকান অঞ্চলকে যুদ্ধের বহ্নিকুন্ডে পরিণত করল। উল্লেখিত কারণগুলি ধীরে ধীরে ইউরোপকে দুটি সামরিক শিবিরে বিভক্ত করে ফেলল। জার্মাণির নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য বিসমার্ক যে সামরিক চুক্তি স্থাপনের নীতি গ্রহণ করেছিল তা ১৮৮২ খ্রীঃ ত্রিশক্তি মৈত্রি চুক্তিতে পরিণতি লাভ করে। এই চুক্তির শর্ত হিসাবে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ইতালি আত্মরক্ষার প্রয়োজনে পরস্পরকে সামরিক সাহায্য দানে প্রতিশ্রুত হয়। আত্মরক্ষার প্রয়োজন হলেও বিসমার্ক সামরিক জোট বাঁধার পথ পরিস্কার করেন এবং সমষ্টিগত প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলি সমাধান করার পথ পরিত্যাক্ত হয়। বিসমার্কের পতনের পর জার্মাণি যখন সাম্রাজ্যবিস্তার ও বিশ্ব রাজনীতিতে প্রাধান্য স্থাপনের জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং এই ত্রিশক্তি চুক্তিই পরোক্ষভাবে তার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ারের কাজ করতে থাকল। এই সামরিক জোটের ফলে ফ্রান্স একটু বেকায়দায় পড়েছিল। বলকানের প্রশ্ন নিয়ে রাশিয়া ও জার্মাণির মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হওয়ার ফলে তাদের মধ্যেকার রি-ইনসিওরেন্স চুক্তি ব্যর্থ হয়ে যায় এবং ফ্রান্স এই সুযোগে রাশিয়ার সাথে মৈত্রি করতে সক্ষম হয়। ইংল্যান্ড প্রথমে জার্মাণির সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য চেষ্টা করেছিল কিন্তু পরে জার্মাণির সাম্রাজ্যবিস্তার, বিশ্ব রাজনীতিতে প্রাধান্য স্থাপন এবং নৌ-শক্তি বৃদ্ধির নীতিতে শঙ্কিত হয়ে ১৯০৪ খ্রীঃ ফ্রান্সের সাথে এবং ১৯০৭ খ্রীঃ রাশিয়ার সাথে আতাত স্থাপন করে। জার্মারির নৌ-শক্তি বৃদ্ধি ইংল্যান্ডের মনে গভীর আশঙ্কা সৃষ্টি করে। এর ফলে ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতি ও রণকৌশলের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। তা অবশ্য তখন কোনো সামরিক সাহায্যের চুক্তি ছিলনা, ত্রিশক্তির মধ্যে সংহতি রক্ষাই এর উদ্দেশ্য ছিল বস্তুত সমগ্র ইউরোপ ‘ত্রিশক্তি চুক্তি' এবং ‘ত্রিশক্তি মৈত্রী’–এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ল। সুতরাং আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলি আলোচনা ও সমাধান করার মত কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিলনা। পরস্পর সন্দেহ ও গোপন কূটনীতির সীমা অতিক্রম করে গেল। চতুর্দিকে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের ধুম্রজালে ইউরোপ আচ্ছন্ন হয়ে রইল।
এই সন্দেহ ও অবিশ্বাসের ফলে, আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই হোক বা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের খাতিরেই হোক, দুটি শিবিরই সমর সজ্জায় সজ্জিত হতে লাগল। সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি, বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা প্রভৃতি প্রায় সমস্ত দেশেরই নীতি হল। সম্ভাব্য যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র প্রচুর পরিমাণে তৈরি হতে লাগল এবং শিল্পপতিগণ তা উৎপাদন করে বেশ লাভবান হয়ে উঠল। যুদ্ধ ছাড়া এই লাভবান ব্যবসা বজায় থাকেনা বলে শিল্পপতিগন ও যুদ্ধের আবহাওয়া সৃষ্টির সড়যন্ত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ করল। ইউরোপের প্রত্যেকটি দেশেই সেই সময় জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে সমস্ত দেশের সামরিক বাহিনীতে বেশি সংখ্যক মানুষ নিযুক্ত হয়। অস্ত্র সজ্জার ফলে সমগ্র ইউরোপ এক বারুদ স্তুপে পরিণত হয়ে রইল। এইরূপ অবস্থায় যে কোনো একটি ক্ষুদ্র ঘটনা থেকেই একটি সর্বগ্রাসি মহাযুদ্ধের সূত্রপাত হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। অধ্যাপক জেমস জোল মনে করেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কারণে যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। তার মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক আন্তর্জাতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে ঘনীভূত সমস্যাগুলির সমাধান করতে প্রত্যেকটি দেশই যুদ্ধ কাম্য বলে মনে করেছিল। শুধুমাত্র রাজনীতিবিদগণই নয়, জনগণও যুদ্ধকে স্বাগত জানিয়েছিল। সন্দেহ ও অবিশ্বাসের ধুম্রজালের মধ্যে বারুদ-স্তুপ সৃষ্টি হয়ে থাকলে তাতে বিস্ফোরণ হওয়ার মত অগ্নিস্ফুলিঙ্গেরও অভাব হয়না। সে স্ফুলিঙ্গ আসল বলকান অঞ্চল থেকে । অষ্ট্রিয়া ও সার্বিয়ার দ্বন্ধের মধ্যে থেকে। অষ্ট্রিয়া স্নাভ-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি সমেত সমস্ত স্লাভজাতীকে এক রাষ্ট্রের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করাই ছিল সার্বিয়ার নীতি। রাশিয়া সার্বিয়ার এই নীতিকে সমর্থণ করত। অন্যদিকে অস্ট্রিয়া স্লাভ অধ্যুষিত বোসনিয়া ও হারজেগোভিনা দখল করে ক্ষান্ত ছিল না। বলকান অঞ্চলে তার সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব বিস্তারের জন্যও সচেষ্ট ছিল। স্বভাবতই সার্বিয়ার শক্তি খর্ব করাই তার নীতি হয়ে উঠেছিল।
বাকুনির নৈরাজ্যবাদের মূল তত্ত্ব হল—রাষ্ট্রই হল সমস্ত অত্যাচারের উৎস। ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াতে হিংসা, বলপ্রয়োগ ও লুন্ঠনের মারফৎ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এই অবস্থায় সাম্য বলে কিছু থাকে না। বাকুনিনের দৃষ্টিতে ধর্ম হচ্ছে সমষ্টিগত উন্মত্ততা অত্যাচারিত ও উৎপীড়িত জনতার দ্বারা সচেতন ভাবে সৃষ্ট একটি কুৎসিৎ ব্যবস্থা। চার্চ হচ্ছে শোষিত মানুষের দৈনন্দিন দুর্ভাগ্য ও অত্যাচার ভুলে থাকার জায়গা। পুঁজিবাদীকে তিনি অন্তর থেকে ঘৃণা করতেন। তিনি জালানের বিশেষতঃ কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত বৈপ্লবিক চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি মার্কসের শ্রেণী সংঘর্ষ ও সর্বহারা একনায়কতন্ত্র মানতে পারেননি। বলাবাহুল্য মার্কস, এঙ্গেলস, ও লেলিন বাকুনিনের নৈরাজ্যবাদের তীব্র সমালোচক ও বিরোধী ছিলেন। ১৮৭০ এর দশকে রাশিয়ার বিপ্লবী নারদোনিকদের মধ্যে বাকুনিনের যথেষ্ঠ প্রভাব ছিল। তাছাড়া ইতালি, স্পেন প্রভৃতি অর্থনীতিতে অনগ্রসর কয়েকটি দেশেও তাঁর অসংখ্য অণুরাগী ছিল। বস্তুতঃ মার্কসের জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও বাকুনিনের প্রভাব কিছু কম ছিল না। এমনকি বাকুনিন যে বিপ্লবমনস্ক কিছু মানুষকে নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন, তা কিছুটা কামসকেও প্রভাবিত করে। মার্কস একটি কঠোর নিয়মকানুননিষ্ঠ দলের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেন। লেনিনও যখন দল গঠন করেন, তখন বাকুনিনের চিন্তা তাকে প্রভাবিত করেছিল।
0 Comments