শ্রীপারাবত এর অমূল্য সংগ্রহ-01/মুর্শিদকুলী খাঁ -03 (A historical novel in Bengali by SREEPARABAT)-series -03

 শ্রীপারাবত এর অমূল্য সংগ্রহ-01/মুর্শিদকুলী খাঁ -03 (A historical novel in Bengali by SREEPARABAT)-series -03


মুর্শিদকুলী খাঁ ভেবে নিয়ে বলে—কী বুঝলে?

—কেল্লার অধ্যক্ষ বকির খাঁ তো মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন আজিম শাহের ছেলের সঙ্গে। তিনি চান আজিম শাহ মসনদে বসুন। তাই যমুনার যত নৌকো ডুবিয়ে দিয়েছেন। তাতে আজিমউদ্দীনের কিছুটা অসুবিধা হলেও, দুর্গ ছাড়া আগ্রা নগরী দখল করে নিয়েছেন। বকির খাঁ কেল্লায় অবরুদ্ধ অবস্থায় গোঁ ধরে আছেন চাবি তিনি আজিমউদ্দীনকে দেবেন না—দেবেন ভাবী বাদশাহ আজিম শাহকে। খবর পেলাম যে আজিম এখান থেকে যে আট কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিলেন সুবাদার থাকার সময় তাও কাজে লাগাচ্ছেন।

হিন্দুস্থানের তত্-তাউস নিয়ে এত যে বিরাট আলোড়ন চলছে তার বিন্দুমাত্র স্পর্শ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সাধারণ মানুষের মনে কিংবা জীবনে লাগেনি। তারা বরাবর যেভাবে দিন কাটায় সেইভাবেই কাটাচ্ছে। তারা ওসব বাদশাহ-টাদশাহকে চেনে না । সহরের মানুষ মাঝে মাঝে রূপকথার রাজা-মহারাজের মতো বাদশাহের নাম শোনে। কিন্তু সবাই মনে রাখে না। তবে মুর্শিদকুলীর নাম বাংলা আর উড়িষ্যার নগরগুলির ফারসি জানা ব্যক্তি জানে। অন্য অনেকেও শুনেছে। কারণ আগে যে এক শায়েস্তা খাঁ ছিল তার রাজত্বের মতো এই রাজত্বেও টাকায় আট মণ চাল এখনো পাওয়া যায়। যারা উচ্চ মধ্যবিত্ত অর্থাৎ মাসে অন্তত দেড়-দুইটা কাঁচা টাকা রোজগার করতে সমর্থ তারা মাসের প্রতিটি দিন পোলাও কালিয়া খেতে পারে। সুতরাং নিশ্চিন্তের জীবন।

কিন্তু তারা নির্বিকার থাকলেও দেওয়ানখানার মানুষেরা কিছু কিছু খবর পায়। তাই দেওয়ান সাহেবের মুখের দিকে তারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মাঝে মাঝে। সেই মুখ নিস্তরঙ্গ বলে মনে হয়। কোনোরকম চাঞ্চল্য সেখানে নেই। এমনকি মুর্শিদকুলী খাঁ তার বসবাসের জন্য যে চেহেল সেতু নির্মাণ করেছে, সেখানকার হারেমের মানুষরাও কিছু অনুভব করতে পারে না। পারে শুধু একজন। বেগমসাহেবা। বেগমসাহেবা জানে কিছুদিন থেকে স্বামীর রাতের ঘুমে বিঘ্ন ঘটছে, কোরান নকল করার সময় হাত অজ্ঞাতসারে মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে।

—এত চিন্তার কী আছে?

দুপুরের খানা খাবার সময় বেগমসাহেবার কথায় চমকে উঠে মুর্শিদ, বলে—চিন্তা আবার কিসের?

—আমাকে লুকিয়ে কী লাভ! আমার তো মনে হয় একজনের কাছে অন্তত মনের বোঝা হালকা করলে ভালোই হয়। আমি কি সবাইকে বলে বেড়াব

–না, ঠিক তা নয় ।

—দিল্লী আর আগ্রায় কী হয়েছে, অত ভেবে লাভ কী। মুর্শিদকুলী খেতে খেতে গম্ভীর হয়ে বলে—একটা

কটা কিছু হবে।

হবে, আমিও জানি! কিন্তু হওয়ার মধ্যে প্রভেদ আছে। ধর, ঔরঙ্গজেবের দ্বিতীয় পুত্র আজিম শাহ্ বাদশাহ হলেন, নিজে কিছুদিন বাংলার সুবাদার ছিলেন। খুব অল্প কিছুদিনের জন্যে। তবু তিনি বুঝবেন আমি এখানে ভালো কাজ করছি। আমার তিনি কেমন মানুষ আমার জানা নেই।

মনে হয় আমি এই পদে বহাল থাকব। আর যদি বাদশাহের জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহ আলম মহম্মদ মুয়াজিম মসনদে বসেন, তাহলে কী হবে বুঝতে পারছ ?

—না। বুঝিয়ে দাও।

—এও বুঝিয়ে দিতে হবে? শাহ আলমের পুত্র আজিমউদ্দীন আমাকে সহ্য করতে পারেন না। আমাকে বাংলা থেকে তল্পিতল্পা গোটাতে হবে।

—গোটাতে হয় গোটাবে। অত ভাবনা কিসের? বাদশাহের নোকরি করছ, যেখানে পাঠাবেন, সেখানে যাবে। তোমার মতো সব দিক দিয়ে কাজের মানুষকে তিনি ফেলে রাখবেন না কখনই ।

মুর্শিদকুলী খাঁ নীরব থাকে। বেগমসাহেবা বুঝবে না, পৃথিবীর একটি প্রাণীও জানবে না, বাংলার প্রতি তার নাড়ীর টানের কথা। সেকথা প্রকাশ করলে যে সে ছোট হয়ে যাবে। তাছাড়া আর একটা গোপন বাসনা যে তার অন্তরে সুপ্ত নেই একথা অস্বীকার করতে পারে না। হিন্দুস্থানের মুঘল রাজত্ব খুব বেশিদিন অটুট থাকবে' বলে মনে হয় না। তেমন হলে তার নাতি আসাদউদ্দীন হয়তো কখনো সরফরাজ উপাধি নিয়ে বাংলা আর উড়িষ্যায় নবাব হয়ে বসবে। কিন্তু একথাও বলা হবে না কাউকে। তবে বেগমসাহেবাকে কিছুদিন পরে বলতে পারবে।

এর পরে মোটামুটি পাকা খবর এলো। হুসেন আগের খবর দিয়ে আবার চলে গিয়েছে। তার ফেরার অনেক দেরি। ফিরেছে দেদার বক্স। সে যে খবর দিল, তাতে শুধু মুর্শিদকুলী খাঁ নয় এবারে বেগমসাহেবাও চিন্তিত হলো। পিতা অর্থাৎ ঔরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহ আলম মহম্মদ মুয়াজিম হিন্দুস্থানের বাদশাহ হলেন। উপাধি নিয়েছেন বাহাদুর শাহ। তাঁর এই সাফল্যের জন্য সিংহভাগ দাবি করতে পারেন পুত্র আজিম। তিনি তাঁর নিজের আটকোটি এবং বাংলা থেকে পাওয়া লুট করা অর্থ দিয়ে বিরাট সৈন্যদল গঠন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গেও ছিল বাংলা থেকে নিয়ে যাওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ সৈন্যরা। এদিকে আগ্রার কেল্লায় অধ্যক্ষ বকির খাঁ যখন শুনল ঔরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র আগ্রায় এসে উপস্থিত তখন সে স্বেচ্ছায় সঙ্গে সঙ্গে দুর্গের চাবি তার কাছে পাঠিয়ে দিল। কারণ জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই অধিকার হিন্দুস্থানের বাদশাহ হওয়ার। কেল্লা দখলে আসায় শাহানশাহ শাহজাহানের বিপুল অর্থ- সম্পদ ও মণি-মানিক্য শাহ আলমের হস্তগত হলো।

আজিম শাহের সঙ্গে যুদ্ধ হলো আগ্রার অদূরে জজুতে। আজিম শাহ পরাস্ত হলেন। তিনি এবং তাঁর দুই ছেলে বেদার বখ্ত্ এবং ভালাজা নিহত হলেন। পরে ঔরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র কামবক্‌সকে হত্যা করার পর বাহাদুর শাহ নিশ্চিন্ত হলেন। তিনি স্বীকার করলেন পুত্র আজিমের তৎপরতা এবং যুদ্ধকৌশলে তিনি জয়ী হতে পেরেছেন। তাই তিনি, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় দ্বিতীয় পুত্রকে নতুন উপাধি দেন আজিম-উস্-সান এবং বাংলা- বিহার-উড়িষ্যার সুবাদার হওয়া সত্ত্বেও তাকে দূরে না পাঠিয়ে নিজের মুর্শিদকুলীকেই তাঁর সহকারী হিসাবে কাজ চালিয়ে যেতে আদেশ প্রাসাদের হারেমে বেগমসাহেবার মুখে হাসি ফুটল। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলু-খাগড়ার প্রাণ রাখলেন। এটা ঠিক কথা। কিন্তু সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনে সুখ-দুঃখ প্রেম-প্রীতি রাগ-অনুরাগে সব কিছুর প্রবাহ অবিরাম চলতে থাকে। তাতে ছেদ পড়ে না। তাতে ছেদ পড়লে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি ব্যাহত হতে পারে। রাজারাজড়া তো মানুষের সৃষ্টি, আর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন স্বয়ং বিধাতা তাই অট্টালিকায় বাস করেও মানবী নাফিসা উন্নিসা হাঁপিয়ে উঠেছে। বাতায়ন-পথে রোজ চেয়ে থেকে থেকে তার চোখ ক্লান্ত হয় শুধু শুধু। সে দেখে সৈয়দ রেজা খাঁ রোজই আসে, বহুক্ষণ থাকে। শেষে চলে যায়। আসাদউদ্দীনকে সে অনুরোধ করেছিল লোকটা সম্বন্ধে খোঁজ নিতে। আসাদ ঠাট্টা করেছিল। সে কোনো গুরুত্বই দেয়নি প্রথমে। তারপর নাফিসা যেদিন কেঁদে ফেলল, সেদিন আসাদ গম্ভীর হয়ে বলেছিল—ঠিক আছে খোঁজ নেব । খোঁজ নিয়েছিল আসাদ। বলেছিল রেজা খাঁ দেওয়ান সাহেবের কাছে আসে রোজ। অনেকক্ষণ কাজকর্ম করে। দেওয়ান সাহেব কখনো কখনো ভূপতি রায়, কখনো বা দর্পনারায়ণকে ডেকে এনে ওকে কাজ শেখাতে বলে। ব্যস্। এইটুকুই খবর এনেছিল আসাদ। এতে তৃপ্ত হয়নি নাফিসা। আসাদের ওপর মনে মনে চটে আছে সে। কখনো যদি এতটুকু নোংরামি তার চোখে পড়ে কিংবা কানে যায় ছেড়ে দেবে না তাকে। সোজা দাদুর কাছে গিয়ে বলবে। আজও সে বারবার বাতায়নের কাছে যার আর ফিরে ফিরে আসে। নাঃ মানুষটা বড্ড দেরি করছে আজ। কী এমন কাজ। ও দেখতে অত সুন্দর হলো কী করে। সবচেয়ে ভালো লাগে ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গিটি। কী সুন্দর সোজা—যেন লেগে রয়েছে জীবটির সঙ্গে। বোঝা যায় অশ্বারোহণে খুবই পারদর্শী। শরীরের গঠনও চমৎকার। ওই বলিষ্ঠ চেহারা অথচ কোমরের কাছে সরু। বেশ দীর্ঘ—আমাদের চেয়ে অনেক লম্বা। আর আসাদ কিরকম নরম নরম মনে হয়—ও তেমন নয়। আসাদ অনেকটা আদর খাওয়া কুকুরের মতো। ও তেমন নয়। আবার বাতায়নের কাছে যায়। নাঃ আর ফিরবে না। এখানে থাকবে নাকি? কোনো কক্ষে যদি রাতে নিদ্রা যায়, তাহলে বেশ হয়। মনে হবে এই চেহেলে সেতুনে দুজনাই নিদ্রা যাচ্ছি। সন্ধ্যা হয়ে আসে। বিরক্ত হয়ে নাফিসা বেগম ডেকে ওঠে—গুল্। সাড়া পাওয়া যায় না। কোথায় গেল হতচ্ছাড়ি। গুলবিবি যেখানে বসে সেখানে দিয়ে দেখে সে নেই। মেজাজ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তার হুকুম না নিয়ে চলে গিয়েছে। এতবড় স্পর্ধা। সে আবার ডাকে। এবারও জবাব দেয় না কেউ। নাঃ, মা কাছে থাকলে এখন ওকে বিদায় করে দেওয়া যেত। দাদির কাছে এসব ব্যাপারে বলে লাভ নেই। ওদের ওপর দাদির একটু বেশি সহানুভূতি। কথায় কথায় তাড়িয়ে দিতে চায় না ।

—গুল্।

ঘরে বাতি দেবার সময় হলো, তবু সে নেই? আশ্চর্য সেই সময় থামগুলোর আড়ালে আড়ালে একটি স্ত্রীমূর্তি এগিয়ে আসছে। সে ঘরের কাছাকাছি এসে বুঝতে পারে, স্ত্রীলোকটি গুলবিবি। এত নাফিসা নিজেও নিজেকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় গুলবিবি আলগোছে পর্দা তুলে ঘরে নাফিসা দেখতে পায় থাকে। তার আসছে কেন?

| ডাকে— এদিকে আয় ।

গুলবিবি আর্তনাদ করল না বটে, কিন্তু না করলেও তার মুখখানা ভয়ে মড়ার মতো হয়ে গেল।

—কোথায় ছিলি?

গুলবিবি লক্ষ করে নাফিসা চটলে যেমন চেঁচামেচি করে তেমন কিছু করল না। তাতে তার ভীতি আরও বাড়ে। সে আমতা-আমতা করে আজেবাজে কথা বলে চলে । মাথামুণ্ডু নেই ।

–সত্যি কথা বলবি ।

—বাঘবন্দি খেলতে—

নাফিসা স্পষ্ট বুঝতে পারে, গুলবিবি মিথ্যা কথা বলছে। সে বলে—মিথ্যা বললি ? ঠিক আছে কার সঙ্গে খেলছিলি বল। তাকে ডেকে আনব।

গুলবিবি কেঁদে ওঠে।

আর সেই সময় নাফিসার নাসারন্ধ্রে অতি সুমিষ্ট আর বহুমূল্য আতরের সুঘ্রাণ এসে লাগে। এ যে খুব পরিচিত আতর। কোথা থেকে, এলো গন্ধ। সে গুলবিবির আর একটু কাছে সরে দাঁড়ায়। হ্যাঁ, তারই দেহ থেকে আসছে। নাফিসার মুখ রাগে বিকৃত হয়, তার চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে।

সে চেঁচিয়ে বলে—কোথায় গিয়েছিলি শয়তানী।

সভয়ে একটু দূরে সরে গিয়ে গুলবিবি বলে—বাঘবন্দি।

—বাঘবন্দি? আমাদের আতর তোর গায়ে এলো কী করে? এতদিনে সব বুঝতে পারলাম। মাঝে মাঝেই তোকে ডেকে পাই না,। তোকে ডাকলেই খোজা রহিম ছুটে আসত কোথা থেকে বুঝতে পারতাম না। ওর আমার ঘরের কাছে থাকার কথা নয়। এতদিনে বুঝলাম রহিমও রয়েছে এর মধ্যে। ঠিক আছে। আমি তোদের দুজনকে রাস্তার চৌমাথায় মেরে ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করছি। আমাকে চিনিস না। মুর্শিদকুলী খাঁকে চিনিস না।

সেই সময়ে রহিম এসে উপস্থিত হতে তোপের মুখে পড়ে। নাফিসা চিৎকার ওঠে— খোজা হয়েছ বলে, ভেবেছ সাত খুন মাফ? কালই তোমাকে শুলে চড়াব বেইমান, দুজ’না ষড়যন্ত্র করে আমার ভাই-এর সর্বনাশ করছ।

খোজা রহিম গুলবিবি নয়। কত ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে গিয়েছে তার ওপর দিয়ে। আজকের ঝড়ে সে গুলবিবির মতো দিকভ্রান্ত অসহায় হয়ে পড়ল না। আসলে সে মুর্শিদাবাদে এসেছে মুঘল হারেম থেকে। বাদশাহ ঔরঙ্গজেব নিজে যখন তাকে মুর্শিদকুলী খাঁর কাছে পাঠান তখন মুর্শিদকুলী হায়দ্রাবাদের দেওয়ান। সে কি আজকের কথা? তখন কতই বা বয়স হয়েছে তার? বড় জোর বাইশ। তার আগে দশটি বছর সে মুঘল হারেমে ছিল। সবার প্রিয়পাত্র ছিল। বেগমদের অতিরিক্ত প্রিয় হয়ে ওঠায় বাদশাহ তাকে হায়দ্রাবাদে পাঠিয়েছেন। একবার পরীক্ষা করিয়ে নেন সত্যিই সে খোজা কি না ।

গুলবিবির দিকে আড়চোখে চায় রহিম! ভূতলে লুণ্ঠিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে ঝড়ে বিধ্বস্ত লতার মতো । অথচ আড়াল থেকে দেখেছে আসাদউদ্দীনের শয্যায় তার বাহুবন্ধনে গুলবিবির সম্পূর্ণ অন্য এক রূপ। মেয়েটার নিশ্চয় ক্ষমতা আছে, নইলে বলেন কেন! এর চাহিদা এত বেশি বলেই ধরা সাদউদ্দীন-এর কথাই বারবার আছে, তার নামও খোজা রহিম। মুঘল হারেমের অনেক জেনানা তার উতে হাত বুলিয়ে দিয়ে পরখ করেছে, তার মধ্যে কোনো উত্তেজনার সৃষ্টি হয় কিনা। সামনের এই মেয়েটি তো ছেলেমানুষ।

নাফিসার অগ্নিবর্ষী দৃষ্টির দিকে চেয়ে সে শান্ত কণ্ঠে বলে—মনে হয় কালকের মধ্যে সৈয়দ রেজা খাঁ সম্বন্ধে কিছু খবর আপনাকে দিতে পারব। পাকা খবর

নাফিসার ক্রোধ নিমেষে কোথায় মিলিয়ে যায়। সে বলে ওঠে—ঠিক? ঠিক বলছ তো? এই শেষ সুযোগ কিন্তু ।

—খোজা রহিম বেঠিক কিছু বলে না।

—বেশ। যাও তাহলে।

—গুলবিবি আমাকে অনেক সাহায্য করে। ওর কোনো ক্ষতি হবে না তো?

–তোমাকে সাহায্য করে? আমার ভাই-এর সর্বনাশ করার জন্যে? মাকে বলে দেব। মা তোমাকে রেখেছিল ভাইকে আগলে রাখতে। www.pathagar.net

—আমি আগলে রাখি। কিন্তু বয়স বলে কথা। আপনার ভাই-এর তো আমার অবস্থা হয়নি;তাঁর সাধ আছে, যৌবন আছে। এতে তাঁর ক্ষতি হবে না। ভালোই হবে। আমি যদি বেশি আগলাতে চেষ্টা করতাম, উনি বাইরে গিয়ে কিছু করতেন। লোকে জানত।

নাফিসা ভাবে, খোজা হলে কী হবে, রহিমের মগজে যথেষ্ট বুদ্ধি । যা হয় হোক, ভাই- এর ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব তার নয়, দাদুর। এসব নিয়ে মাথা খারাপ করে কোনো লাভ নেই। তার চাইতে নিজের স্বার্থ দেখাই ভালো।

সে বলে—গুলবিবি এ যাত্রা বেঁচে গেল ।

রহিম সন্তুষ্ট হয়ে কক্ষ ত্যাগ করে। আর গুলবিবি ধীরে ধীরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। —দাঁড়া।

গুলবিবি মাথা নিচু করে দাঁড়ায়।

—এই আতর তুই নিজে লাগিয়েছিস ?

গুলবিবি মাথা নাড়ে ।

-তবে? আসাদ ?

—খামখা লগিয়ে দিল?

গুলবিবি মাথা ঝাঁকিয়ে জানায়—না।

—তুই বোবা নাকি? কথা বলতে পারিস না? কেন লাগিয়ে দিল?

—আমরা বাঁদী। গায়ে খারাপ গন্ধ থাকে— তাই ।

নাফিসা স্তব্ধ হয়ে শোনে। বেশ কিছুক্ষণ পরে বলে—কদিন গিয়েছিস ?

গুলবিবির প্রতিদিনের কথা সবিস্তারে মনে গাঁথা হয়ে আছে। সবশুদ্ধ সাতদিন সে

গিয়েছে। কিন্তু সেকথা বলা যায় না। এখনো সে জানে না, সত্যিই বেঁচে গিয়েছে কি না ।

রহিম মিথ্যা আশ্বাস দেবে না। কারণ সে-ও এর মধ্যে জড়িয়ে

মালিক তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন অন্তত। পারবেন কি না,

সাহেব খুব কড়া এ ব্যাপারে। তবু—

–বললি না? কদিন গিয়েছিস!

— দুদিন ।

তবে রহিমের যায় না। দেওয়ান চিৎকার কারে ওঠে নাফিসা — মিথ্যে বলবি না ।

—না না, আজ নিয়ে তিন দিন। —তিন দিন। কতক্ষণ থাকিস ? —ওর যতক্ষণ ইচ্ছে। —কার ইচ্ছে?

—আপনার ভাই-এর।

—আমার ভাই-এর ইচ্ছা? শয়তানী কোথাকার। আর একদিন যদি জানতে পারি, তোকে আমি পুঁতে ফেলব। যাঃ, সামনে থেকে জাহান্নমে যা।

গুলবিবি চলে গিয়ে পর্দার ওপাশে তার সেই অপেক্ষা করার স্থানটিতে গিয়ে হাঁটুর ভেতরে মাথা গুঁজে আঝারে চোখের জল ফেলে। আসাদউদ্দীনের আতরের গন্ধ, তার পরশের সুখস্মৃতি মনেও স্থান পায় না। নিজে যে সে হতভাগিনী সেই কথা মর্মে মর্মে অনুভব করে। ঈশ্বর কেন যে তাকে এ-যাত্রা বাঁচিয়ে দিলেন বুঝতে পারে না।

এদিকে খোজা রহিম পরের দিনই সৈয়দ রেজা খাঁ সম্বন্ধে পাকা খবর নিয়ে নাফিসার কাছে গিয়ে উপস্থিত হয় ।

—কী খবর রহিম?

—সব জেনে এসেছি। মুঘল হারেমে কোনো ভালো খবর জানালে বেগমরা বখশিস দিতেন। এ বান্দা অনেক পেয়েছে।

নাফিসার কৌতূহল তীব্রতর হয়। বলে—তাড়াতাড়ি বলে ফেলো। বখশিস দেবার মতো হলে দেব ।

রহিমের একটা মস্ত গুণ যে সে কখনো দাঁত বের করে হাসে না। সে যত লঘু কথা বলুক, যত রসিকতা করুক, তার মুখে হাসি দেখা যায় না কখনো। সে জানে, হাসি পছন্দ করে না হারেমের জেনানারা। আবার মুখখানা খুব কঠোর করে রাখলেও বদনাম হয়। রটে যায়, লোকটা খুন করতে পারে। সুতরাং মুখে হাসিও থাকবে না, আবার কঠোরতাও ফুটে উঠবে ন, এমনভাবে থাকতে হবে। অর্থাৎ পোষা খরগোস কিংবা কাকাতুয়ার মতো। তবে বেগমরা যদি চায় তাহলে সামান্য একটু ফিকে হাসির মতো কিংবা এক পলকের জন্যে মুখের ঠোঁট থেকে গাল পর্যন্ত সীমায় আবদ্ধ রেখে মাখাতে হবে। তার বেশি কখনোই নয়। তাহলে সম্ভ্রম থাকবে না। হ্যাঁ, খোজাদেরও সমীহ করে চলে জেনানারা। আসলে জেনানারা তো পুরুষ নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটু পুরুষকার দেখাতে হয়। । পুরোপুরি পুরুষ না হয়েও, সেটা খোজারা ভালোই জানে। তারা খোজা পরম্পরায় শিক্ষা নেয়। নোকরি ছেড়ে যাওয়া প্রবীণ খোজারা ছেড়ে যাবার আগে, খোজাগিরি করার আঁটঘাট শিখিয়ে দিয়ে যায় নতুনদের। এইভাবে চলে আসছে শিক্ষাগ্রহণ।

রহিম বোধ হয় মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। নাফিসা অস্থির হয়ে বলে ওঠে—চুপ করে আছ কেন? তুমি কি ভাবছ বখশিস্ পাবে রহিম সেলাম ঠুকে বলে—না। ওকথা আমাদের ভাবতে নেই। আমরা শুধু আল্লার বান্দা নই, আপনাদেরও বান্দা।

—তবে বলে ফেলো।

গুলবিবি বহুদিন পরে খিখিল করে হেসে ওঠে—নিজের গ্রামে যেভাবে হাসত।

—হাসলে যে।

—তোমার আওরত হতে, ধরো, রাজি হলাম। আমাকে নিয়ে তুমি করবে কী ? আমাকে মা করে দিতে পারবে।

খোজা রহিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেনা গুলবিবি, আল্লার দান মানুষ কেড়ে নিয়েছে। আমার ছেলের মা তুমি হতে পারবে না। কিন্তু অনেক খোজার ঘরে নারী থাকে। তারা দোস্ত হয়, তারা সঙ্গী হয়। জীবন বড় একঘেয়ে বিবি বয়স বাড়লে পরে নাকি একা একা হাঁপিয়ে উঠতে হয়। তখন আমরা দুজন দুজনার সঙ্গী হব। খোজারা সবাই প্রায় ধনী। আমিও কম ধনী নয়। আমার ইচ্ছা মুর্শিদাবাদে থেকে যাব। রাজি থাকো তো বল। —কিন্তু তুমি জানো আমি কী করেছি।

—তাতে কী? তোমার ক্ষমতা আছে, তাই করেছ। ওতে আমি কিছু মনে করি না। তবে আমার ঘরে একবার গেলে ওসব চলবে না। কোনো পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করা চলবে না। সবাই যেমন বোরখা পরে থাকে তেমনি পরবে। লোকে তাল খুঁজবে। কারণ, তারা জানবে আমি খোজা। কিন্তু তুমি এতটুকুও আমল দিতে পারবে না। বলো রাজি আছ? –আমি মা হবো না ?

—রহিম বলে—তবে দেখছি মালাটা আর পেলে না। এখানেই থেকে যাও। মা হবার সাধ চিরজীবনের মতো ঘুচে যাবে। আমি বড়জোর কোনো শিশুকে এনে তোমার কোলে ফেলে দিতে পারি। তাকে মানুষ করবে। অমন শিশু কত পাওয়া যায় দু-একশো কড়ির বদলে। এমনিতেই দিয়ে দিতে চায় কত লোক ।

গুলবিবির চোখে স্বপ্ন মাখিয়ে দেয় রহিম। সে ছোট একটা শিশুকে মানুষ করে তুলবে মায়ের মতো, শুধু তাকে বুকের দুধ দিতে পারবে না। তাতে কী হলো? তার একটা ঘর থাকবে। আর থাকবে বিশ্বস্ত বলিষ্ঠ রহিম। রহিম আশ্রয়দাতা হিসাবে একটুও খারাপ নয়। সে বলে—ও মালায় আমার দরকার নেই রহিম। আমি যদি যাই এমনিতেই যাব তোমার ঘরে।

রহিমের চোখের আলোয় দ্যুতি—সত্যি বলছ গুলবিবি?

—হ্যাঁ, কিন্তু কীভাবে?

– ঠিক বলেছ। কীভাবে? আমি আজ থেকে চেষ্টা করব। তুমি শুধু দেখো তোমার জীবন যেন বিপন্ন না হয়। আসাদউল্লার কাছে তোমাকে আর যেতে দেব না। থাকতে পারবে ? —পারব, যদি আমাকে একটা ছেলে কিংবা মেয়ে দাও ।

—দেবো। নিশ্চয় দেব। জান, গুলবিবি তোমার ওপর হঠাৎ আমার একটা টান এসে গেল। তোমাকে আমি খুব যত্নে রাখব। বুক দিয়ে রক্ষা করব।

—জানি রহিম। আমিও তোমার সেবা করব!

খবরটা বেশি জানাজানি হওয়ার আগেই রেজার সঙ্গে থেকে বিদায় নিলেও কাছাকাছি একটি ভালো সাদি হয়ে গেল। প্রাসাদ সে চলে গেল রেজার সঙ্গে। আর তাদের দেখাশোনা করার জন্যে মুর্শিদকুলী খাঁ ভার দিল নাজির আহমেদ বলে একজনের

ওপর। নাজির লোকটি অতি সাধারণ ঘরের। কোনোরকমে মুর্শিদকুলীর রাজস্ব আদায়ের ভার সে পেয়ে যায়। তার পর থেকেই সে মুর্শিদকুলী খাঁর নজরে পড়ে যায়। দেওয়ান সাহেব দেখে যে নাজির একজন অত্যন্ত কুশলী আদায়কারী। তার এলাকায় বলতে গেলে রাজস্ব একটুও বাকি পড়ে না। মুর্শিদ তখনো জানত না এই কর আদায়ের ব্যাপারে নাজির আহমেদ কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। যখন জানলো তখনে ভ্রুক্ষেপ করল না। বরং মনে মনে তার তারিফ করল। তাকে কিছু সৈন্য সামন্তের ভারও দিয়ে দিল। এই আস্কারা পেয়ে নাজিরের বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ পেতে শুরু করল। সে মানুষকে শাস্তি দেওয়ার নামে তাকে যন্ত্রণা দেওয়ার নব নব উদ্ভট কলাকৌশল উদ্ভাবন শুরু করল।

সেই নাজির আহমেদ মুর্শিদকুলী খাঁর নয়নের মণি হয়ে উঠেছিল বলে নাতজামাই সৈয়দ রেজা খাঁর সঙ্গে তাকে দিয়ে দিল। সৈয়দ রেজা বাংলায় তার সহকারী দেওয়ান। সুতরাং কীভাবে টাকা আদায় করতে হয় নাজিরের কাছে সে শিখতে পারবে।

নাফিসার সাদিতে তার বাবা-মাও এসেছিল উড়িষ্যা থেকে। পুরোনো জায়গায় এসেই সুজাউদ্দিন ছট্‌ফট্ করছিল। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। বয়সও বেড়েছে। তাছাড়া এক রূপসী রমণীকে সে সাদি করবে বলে মনে মনে স্থির করে ফেলেছে। ফিরে গিয়েই তাকে ঘরে আনবে। আভাসে ইঙ্গিতে জিন্নৎ-কে বেশ কয়েকবার শোনানো হয়ে গিয়েছে। তাকে বলেছে, তার বয়স হয়েছে। মেয়েরা হই হুল্লোড় তো বেশিদিন সহ্য করতে পারে না। তার ওপর কদিন পরেই আবার নাতির মুখ দেখবে হয়তো। তাই জিন্নৎকে সে মিছিমিছি জ্বালাতন করতে চায় না যখন তখন। সে তার মতো বড় বেগমসাহেবা হয়ে ধীর স্থির শান্ত জীবনযাপন করুক। স্বামীকে ছেড়ে দিক তার পছন্দমতো আর একবার সাদি করতে। সবাই তো একই সঙ্গে জোড়ায় জোড়ায় শান্ত হয়ে যায় না—বিশেষ করে পুরুষেরা।

এত কথা সুজাউদ্দিন কখনই ইনিয়ে বিনিয়ে বলত না জিন্নৎকে, যদি না তার বাবা মুর্শিদকুলী খাঁ হতেন। কারণ উড়িষ্যার দেওয়ানী তারই মর্জির ওপর। কলমের এক খোঁচায় তিনি ওই পদ থেকে তাকে অপসারিত করতে পারেন। ওদিকে রেজা নামে ছেলেটা, যেতার জামাতা হলো, সে বাংলার সহকারী দেওয়ান। আসাদকেও এই ধরনের একটা পদ দেবার কথা শোনা যাচ্ছে। সুতরাং জিন্নৎ বেগমের মূল্য কোনোদিনও কমবে না।

মির্জা রেজাও যে তার মতো সৈয়দ বংশের, এরজন্যে সুজাউদ্দিনের আনন্দ হলো। মেয়েটা জলে পড়ল না তাহলে। নিজের সাদি সম্বন্ধে তার নিজের মনের খুঁতখুঁতানি যত না থাক, শুনতে হয়েছে তার চেয়েও বেশি। দাক্ষিণাত্যে থাকার সময় অহরহ শুনেছে, এখানেও আগ্রা দিল্লী কিংবা দক্ষিণভারত থেকে যে সব উচ্চপদস্থ কর্মচারী আসা-যাওয়া করেছে তারাও বলেছে। সে ওসব গায়ে মাখেনি। সে জানত মুর্শিদকুলী খাঁ বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের পেয়ারের লোক— তার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। সুতরাং তার

করলে এই বিদেশ বিভুঁই-এ এসে সে জলে পড়বে না। পড়েওনি। তার সঙ্গে পারস্য আরব, তুরস্ক থেকে আরও কতজনা এসেছিল, কোথায় মিলিয়ে গেল সবাই। তাছাড়া ‘সৈয়দ’ সঙ্গে তার সাদি দেবার জন্যে ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল। নিজের বংশের তো তেমন ভিত্তি নেই। বাহাদুর বটে তার শ্বশুর আর এক সৈয়দকে ঠিক জুটিয়ে নিল।

শব্দটার গুরুত্ব যথেষ্ট। সেইজন্যে মুর্শিদকুলী খাঁ জিন্না মেয়েকে সাদি

নাফিসার সাদি যতটা জাঁকজমকের সঙ্গে হওয়ার কথা সবাই ভেবেছিল, ততটা হলো না । মুর্শিদকুলী খাঁ জাঁকজমক আদৌ পছন্দ করে না। তবু নাফিসা আর জিন্নৎ-এর মুখ চেয়ে কিছুটা যাতে আড়ম্বর হয়, সেই অনুমতি দিয়েছিল। এই সাদিতে সে ফারুকশিয়ারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। যদিও জানত সে আসবে না এবং আসা সম্ভবও নয়। ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদের রাস্তা কম দূর নয়। তাছাড়া সে মুঘল পরিবারের কেউ নয়, মুঘল বাদশাহের অধীনে এক কর্মচারী মাত্র। এখন ফারুকশিয়ারের পিতামহ হিন্দুস্থানের বাদশাহ এবং এই বাদশাহ হওয়ার পেছনে সব চেয়ে বেশি যাঁর অবদান তিনি হলেন তাঁরই পিতা আজিম-উস্-সান্ । তবু নিমন্ত্ৰণ তাকে করতে হয়েছে। না করলে, বিরাগভাজন হতে পারত মুঘল পরিবারের।

সাদির পরের দিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসে ছিল মুর্শিদকুলী খাঁ। এই সুযোগ তার জীবনে প্রথম এলো। পারস্য দেশ থেকে এসেছিল শুধু বেগমসাহেবাকে সঙ্গে নিয়ে। এখন সেই পরিবার কত বড়। আরও কত বড় হবে। সুজাউদ্দিনের যত দোষই থাকুক, সে সামনে এসে দাঁড়ালে চমৎকৃত না হয়ে পারা যায় না। এটাই বোধ হয় তার ওইসব বদগুণের জন্য দায়ী। আজ সুজাকে তার ভালোই লাগছিল। জিন্নৎকেও আজ হাসি হাসি দেখতে লাগছে। এতেই তো সুখ। আর একটা সুখ হচ্ছে, সে আর একজন সৈয়দকে তার পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে নিতে পারল। কিন্তু এই সুখ আর সাফল্যের পেছনে যে একটা ব্যর্থতার বড় কাহিনী রয়েছে, সেকথা, চাপা মানুষ বলেই মুর্শিদকুলী খাঁ কাউকে বলেনি—বেগমসাহেবাকেও নয়।

সৈয়দ রেজা খাঁয়ের সঙ্গে নাফিসার সাদি স্থির করার আগে সে আরও একজনের সঙ্গে চেষ্টা করেছিল। সাধারণত মুর্শিদকুলী খাঁ এ-পর্যন্ত এত বেশি প্রতিপত্তির অধিকারী ছিল যে সে নিজেই বাংলার কোথায় কাকে ফৌজদার কিংবা অন্য কোনো পদে পহাল করতে হবে ঠিক করত। বাদশাহ ক্বচিৎ কখনো কাউকে ওখান থেকে নিয়োগ করে পাঠাতেন তাতে মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও মুখে কিছু বলতে পারতেন না মুর্শিদকুলী খাঁ। তাই বহুখ্যাত এবং পরম সম্মানীয় আমীর খাঁয়ের পৌত্রকে যখন পাঠানো হলো তখন প্রথমে মনে মনে বিরক্ত হলেও তাকে অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত হলো। অভ্যর্থনা তাকে করতেই হবে—যে সে ব্যক্তি নয়, আমীর খাঁর পৌত্র সৈফ খাঁ ।

কিন্তু অভ্যর্থনা করতে এসে সেই তরুণকে দেখে মন গলে গেল মুর্শিদকুলী খাঁর একেই বলে বড় ঘরের ছেলে। যেমন চেহারা, তেমনি কথাবার্তা আর আদব-কায়দা। এক কথায় মনকে আকৃষ্ট করে নেয়। সে সঙ্গে সঙ্গে তাকে পুর্নিয়ার ফৌজদার করে পাঠায়। কিছুদিন পরেই খবর পেল সৈফ খাঁ বীরনগরের জমিদার বীরশাকে জমিদারী থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারপর শুনল আরও অনেক জমিদারকে কয়েদ করেছে। এইভাবে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করেছে। এসব শুনে মনে মনে মুর্শিদকুলী খাঁ যখন তারিফ করছে, সৈফ খাঁ তখন দেখল পুর্নিয়া থেকে পাওনা যা পেল, গত বছরের তুলনায় এমন নয়। অর্থাৎ বাকিটুকু সৈফ খাঁ নিজে রেখে দিয়েছে। তা হোক, বড় ঘরের বড় ব্যাপার। সে যথারীতি সৈফ খাঁকে মুর্শিদাবাদে নিমন্ত্রণ করল এবং মনের ইচ্ছাটা তার কাছে প্রকাশ করল। অর্থাৎ নাফিসাকে সে যদি গ্রহণ করে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সৈফ খাঁ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। বলল, তার পরিবারের কিছু এটা সম্ভব নয়। সৈফ খাঁ প্রত্যাখ্যান করেছিল বলেই রেজা খাঁকে নির্বাচিত করতে হলো। অবিশ্যি রেজা

খাঁয়ের বংশ ভালো। কিন্তু সৈফ খাঁ যেন আকাশের চাঁদ। দেখাই যায় শুধু, হাত দিয়ে ধরা যায় না। শেষ পর্যন্ত ধরা গেলেও না। তবে এই ব্যর্থতার কাহিনী বাইরের কাকচিলও জানে না। হ্যাঁ, সৈফ খাঁ অবশ্য জানে। কিন্তু এসব কথা তার মুখ থেকে কখনো বের হবে না। তার পিতামহ আর কেউ নন, স্বয়ং আমীর খাঁ। তবু রেজাও ভালো। চটপটে ছিমছাম, বংশের তুলনা নেই। আবার আসাদ সাদীর পরে বলল, নাফিসার আগে থেকেই নাকি একে পছন্দ। শুনে থ' হয়ে গিয়েছিল মুর্শিদকুলী। কী করে পছন্দ হলো? না, বাতায়ন পথে দেখত রোজ নাকি। সেই থেকে হারেমের কয়েকটা জানালা বন্ধ করে দেবার হুকুম দিয়েছে সে। এ সব অনাচার চলতে দেওয়া যায় না।

সৈফ খাঁকে ওপর থেকে চাপানো হয়েছিল। প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে তার সঙ্গে একটা সুহৃদসুলভ সম্বন্ধ গড়ে উঠেছিল মুর্শিদকুলী খাঁর! খাতির করে তার উপাধিও একটা দিয়ে ফেলেছিল সে। উপাধিটা হলো জেস্

কিন্তু তাই বলে ঘন ঘন এভাবে বাদশাহের কাছ থেকে নিযুক্তি নিয়ে বাংলায় লোক এলে, কাঁহাতক সহ্য করা যায়? বাদশাহ তো এখন ঔরঙ্গজেব নন। বর্তমান বাদশাহ বাহাদুর শাহ তাকে কখনোই পছন্দ করেন না। কারণ তার সঙ্গে তাঁর পুত্র আজিম-উস্- সানের সম্পর্ক ভালো ছিল না। তবু ওঁদেরও অর্থের প্রযোজন রয়েছে। অর্থ কমলে চলবে না, অথচ কাজে হস্তক্ষেপ চলবে—দুটো জিনিস একসঙ্গে চলতে পারে না। আজিমের ও কথাটা বোঝা উচিত বাস্তবতার খাতিরে। তাকে যতই অপছন্দ করুক তার প্রেরিত টাকার পরিমাণকে অপছন্দ করে না নিশ্চয়।

তবু বাদশাহের এক উজিরের পৃষ্ঠপোষকতায় আর এক উচ্চবংশীয় যুবককে পাঠানো হলো। নাম তার সৈয়দ আবু তোরাব। এর আর কিছুই নয়, ওদের খাইয়ে পরিয়ে রাখা ব্যবস্থা করা। নইলে স্থানীয় মানুষদের দিয়ে যে বাংলার কাজকর্ম খুব ভালোভাবে চলছে সেকথা কি বাদশাহ জানেন না? ভালোই জানেন ৷

আবু তোরাবের প্রতি মৌখিক যতটুকু ভদ্রতা সেটুকু দেখাল বটে কিন্তু অন্তর হিম- শীতল মর্শিদকুলী খার। এও তো এসেছে লুঠতে, সবাই যা করে। নইলে রাজধানীতে কিংবা নিজের দেশে মর্যাদা থাকে না। মনে মনে ঠিক করে নেয় মুর্শিদকুলী খাঁ, কোনোরকমের সহযোগিতা আর নয়। বরং যদি পারা যায় পদে পদে বাধার সৃষ্টি করবে, অসুবিধায় ফেলবে এদের। নইলে তার নিজের কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে যেতে বাধ্য। এরা সব নিজেদের ভাবে বাদশাহের লোক বলে। আর কারও কাছে বিশ্বস্ত থাকার দায়দায়িত্ব এদের নেই। তাছাড়া মীর আবু তোরাবের সঙ্গে আজিম-উস্-সানের কি রকম একটা সম্পর্ক আছে। সুতরাং পায়া বেশ ভারী। কিন্তু যতই পায়া ভারী হোক তাকে পাঠানো হয়েছে মোক্ষম ফৌজদার করে। মনে মনে মুর্শিদকুলী খাঁ সন্তুষ্ট হলো। পাশেই । ভূষণার মহম্মদপুরের সীতারাম। বাদশাহের কাছ থেকে রাজা উপাধি জোগাড় করে চুটিয়ে রাজত্ব চালাচ্ছে। একটা সৈন্যদলও তৈরি করেছে। যুদ্ধবিদ্যাটাও আয়ত্ত করেছে ভালো। যথেচ্ছভাবে আশে- পাশের জমিদারী দখল করে নিয়ে সমৃদ্ধ হচ্ছে। খুনখারাবি করলে কী হবে, লোকটার জনপ্রিয়তা আছে বলে মুর্শিদকুলী খাঁ শুনেছে। একজন মুসলমান ফকিরের সে পরম ভক্ত।

তাঁরই নাম অনুসারে সে মধুমতী নদীর তীরে বাগজানী গ্রামকে উন্নত নগরে পরিণত করে নাম রাখে মহম্মদপুর। এদিকে তার এলাকায় অনেক মন্দিরও তৈরি করেছে-লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির, দশভুজার মন্দির, কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির। এককথায় লোকটা যেমন বুদ্ধিমান করিতকর্মা তেমনি ঠ্যাটা। মীর আবু তোরাবকে সহজে ছেড়ে দেবে না। মুর্শিদকুলী খাঁ নিজেও ওকে ঘাঁটায় না। এখন তো সীতারাম বিরাট ভূখণ্ডের অধীশ্বর। সে যখন নলদি পরগনায় রাজস্ব আদায়কারী হিসাবে নাম করে সবে একটু শক্তিশালী হয়েছে তখনি তার ক্ষমতা দেখে ফৌজদার নরুলা তাকে আক্রমণ করতে সাহসী হয়নি, এখন মীর তোরাব তাকে আক্রমণ করলে ফ্যাসাদে পড়বে—ভালোই হবে। মুর্শিদকুলী খাঁ লক্ষ করেছে আবু তোরাব নিজের বংশ আর বিদ্যার অহংকারে তার সঙ্গে একটু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথা বলেছিল।

কিছুদিনের মধ্যেই সৈয়দ আবু তোরাব বুঝল সে শক্ত পাল্লায় পড়েছে। যেভাবে সীতারাম প্রতি পদে তাকে অবহেলা করে খুশি মতো কাজকর্ম করছে, সেভাবে চললে তার ফৌজদারী দুদিনেই বেহাল হয়ে যাবে। সে মুর্শিদকুলী খাঁর কাছে সাহায্যের আবেদন জানাল। মুর্শিদকুলী খাঁ চুপচাপ বসে থাকেন। ভাবখানা এবারে অত অহংকার কোথায় যায় দেখা যাবে। আবু তোরাব বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করে বুঝল সাহায্য পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সে তখন পীর খাঁ নামে একজন আফগানকে সেনাপতি নিযুক্ত করে দুশো সৈন্য তাকে দিয়ে বলল সীতারামকে দমন করতে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য আবু তোরাবের। কিছুদিনের মধ্যেই চরম অঘটন ঘটে গেল। ভূষণার সর্বত্র সীতারামের চর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পীর খাঁকে নিযুক্ত করার পরের দিনই সীতারাম খবরটা পেয়ে গেল। সে তার সৈন্যদের আদেশ দিল, পীর খাঁর সৈন্যদের আক্রমণ করতে হবে আড়ালে আড়ালে থেকে। সম্মুখ যুদ্ধ কখনই নয়। অনেকটা শিবাজীর ধরন। তবে শিবাজীর ওখানে অসংখ্য ছোট বড় পাহাড় ছিল, এখানে ঝোপ জঙ্গলের সাহায্য নিতে হবে। পীর খাঁয়ের সৈন্যরা কোথাও নদী পার হচ্ছে জানতে পারলে আগেভাগে গিয়ে নৌকোগুলো ডুবিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হলো। ফলে পীর খাঁ নাকানি চোবানি খেতে লাগল।

এরই মধ্যে একদিন সৈয়দ আবু তোরাব কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে এক বনের ভেতরে শিকার করতে গেল। শিকারের পেছনে ছুটতে ছুটতে চলে গেল সীতারামের এলাকার কাছাকাছি। আর পড়বি তো পড় ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা সীতারামের সৈন্যদের মধ্যে গিয়ে পড়ল। সে নিমেষে তার ভুল বুঝতে পারল।

চেঁচিয়ে উঠল—আমি ফৌজদার সৈয়দ আবু তোরাব

সৈন্যরা বিশ্বাসই করল না। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস লোকটা পীর খাঁ। ফাঁদে পড়ে মিথ্যে বলছে। তারা বাঁশের তৈরি গদা দিয়ে আবু তোরাবকে পিটিয়ে মেরে ফেলল।

সীতারামের কাছে খবর গেল পীর খাঁ মরেছে। সে খুশি হয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে বনের প্রান্তদেশে চলে আসে, যেখানে তোরাবের মৃতদেহ, নিয়ে হয়েছিল।

সীতরাম ঘোড়া থেকে নেমে মৃতদেহের কাছে এসে এক পলক দেখেই চমকে উঠে বলে—তোরা সর্বনাশ করেছিস। এ যে ফৌজদার সাহেব। তোরা এঁকে মেরে ফেললি শেষে? আমার সব সাধ সব আকাঙক্ষা গুড়িয়ে দিলি?

সৈন্যরা ফ্যালফ্যাল করে প্রভুর দিকে চেয়ে থাকে। তারা ভাবে লোকটা সত্যি কথাই বলেছিল। বিধু সর্দার গাঁজা খেয়ে সব গুলিয়ে দিয়েছে। নইলে, ফৌজদার সাহেবের চেহারা আর পোশাক দেখে তাদের বিশ্বাস হয়েছিল। তারা মেরে ফেলত না। বন্দি করে রাজার কাছে নিয়ে আসত।

সীতারাম স্তব্ধ হয়ে যায়। সে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আবু তোরাবের গায়ের রক্ত পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করে। তারপর খুব সম্মানের সঙ্গে তার শবদেহ পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু মনে মনে বুঝতে পারে তার স্বাধীন রাজত্ব গড়ার স্বপ্ন দেখার দিন শেষ হয়ে এসেছে। এবারে সমস্ত মুঘলশক্তি তার টুটি চেপে ধরবে। মুঘল বাদশাহের পরাক্রম ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তেমন নেই। বাংলাতেও মুর্শিদকুলী খাঁর পরে তেমন কোনো শক্ত লোক আসবে বলে মনে হয় না। সে তাই তার স্বপ্নকে রূপ দেওয়ার জন্যে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল। এরা সব শেষ করে দিল। তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনাই রাখল না। তবু সীতারাম এদের কিছু বলে না। কতটুকুই বা বোঝে এরা? যতটুকু করে ভালোর জন্যেই করে। এই বিধু সর্দার একবার তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। বিষধর সাপের উদ্যত ফণাকে সে নির্ভয়ে হাত দিয়ে চেপে ধরে মাটিতে রেখে পা দিয়ে পিষে মেরে ফেলেছিল। আজ সে মারাত্মক ভুল করে বসেছে, যা শুধরে নেওয়া যায় না। যদি সম্ভব হতো বিধু সর্দার নিজের প্রাণ দিয়েও তা করত।

খবরটা শুনে মুর্শিদকুলী খাঁ কেঁপে উঠল। হ্যাঁ ভয়েই কাঁপলো—যে ভয়, সে ভেবেছিল, বহুদিন আগে তাকে ত্যাগ করেছে। এমন চূড়ান্ত অঘটন ঘটার কথা সে কল্পনা করেনি। মনে মনে সে স্বীকার করে সীতারামকে অতটা বাড়তে দেওয়া মারাত্মক ভুল হয়েছে। নাফিসার সাদির ব্যাপারে মনটা কিছুদিন প্রফুল্ল ছিল। এখন নিমেষে সেই প্রফুল্লতা উধাও হয়ে গেল। সে ভেবে উঠতে পারে না, বাদশাহ, বিশেষ করে আজিম-উস-সান এই ঘটনার কথা শুনলে তার কপালে কী ঘটবে। কিন্তু সে সব পরের কথা। এই মুহূর্তে সীতারামকে বন্দি করতে কিংবা হত্যা করতে সৈন্য পাঠাতে হবে। এতটুকুও দেরি নয়। যদিও দেরি যথেষ্টই হয়ে গিয়েছে।

এত বেশি বিচলিত হয়ে পড়ে মুর্শিদকুলী খাঁ যে সীতারামের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবার জন্যে সে একজন উপযুক্ত সেনাধ্যক্ষের নাম মনে করতে পারে না।

বেগমসাহেবা খবরটা শুনে খুবই উতলা হয়েছিল। তাই মুর্শিদের অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে বসেছিল। ভোরবেলা খবরটা এলো মুর্শিদ বাইরে গিয়েছে। তাই বলে কোরান নকলের সময় আসবে তো। এমন কখনো হয় না। অনেক পরে মুর্শিদকুলী খাঁ এলো বটে, কিন্তু ছট্‌ফট্ করতে লাগল ৷

—অত ছট্‌ফট্ করছ কেন? তোমাকে এমন হতে কখনো —ব্যাপারটা ঘটেছে আমার গাফিলতিতে। তাই

-বুঝেছি। কিন্তু অস্থির হয়ে কোনো লাভ হবে না।

। সুস্থির হতে পারছি না।

—একজন দক্ষ সেনাপতি পাচ্ছি না, যাকে পাঠাতে পারি সীতারামকে বন্দি করে আনতে।

—একটা কথা বলব ?

—বল।

—একজন সেনাপতি বেশ কিছুদিন হলো এসে বসে রয়েছে। বসে থেকে থেকে সে নিষ্কর্মা হয়ে গেল। তাকে কাজটা দাও। মনে হয় সে সহজে পারবে।

মুর্শিদকুলী খাঁ বেগমসাহেবার মুখের দিকে চেয়ে বলে—কে সে? —আমার ভাই বস্ আলি খাঁ, যাকে তুমি হাসান আলি বলো।

—হ্যাঁ। তাই তো। ওর নাম মনেও আসেনি। আসলে ওকে তোমার ভাই বলেই জানি।

ও যে এখানে কাজ করতে এসেছে সেকথা মনে থাকে না।

—ওকে পাঠাও।

— ঠিক ।

সেইদিন মধ্যাহ্নের পর দেওয়ান খানায় গিয়ে বস্ আলির নেতৃত্বে সৈন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করে মুর্শিদকুলী খাঁ। সে দর্পনারায়ণ আর ভূপতি রায়কে বলে, আশপাশের সব জমিদারদের খবর পাঠাতে, সবাই যেন বক্‌স্‌ আলিকে সব রকমের সাহায্য করে। যারা সাহায্যে গাফিলতি করবে কিংবা সীতারামকে তাদের জমিদারীর ভেতর দিয়ে পাঠাতে সাহায্য করবে তাদের জমিদারী কেড়ে নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে শাস্তিও পেতে হবে তাদের।

রঘুনন্দন দর্পনারায়ণের পাশে দাঁড়িয়ে আদেশটি শুনল। সে ইতিমধ্যে অনেক বলেকয়ে তার ভাই রামজীবনের জন্য একখণ্ড ছোট্ট জমিদারীর ব্যবস্থা করে দিয়েছে রাজশাহীতে। খাজনা পত্তর ঠিক মতো দিচ্ছে।। মুর্শিদকুলী সন্তুষ্ট তার প্রতি। রঘুনন্দন দেখল, সীতারামকে দমনের ব্যাপারে রামজীবন যদি বেশ একটু আগ বাড়িয়ে উৎসাহ দেখায় তাহলে দেওয়ান সাহেব আরও সন্তুষ্ট হবে। সে লোক মারফত ঘটনার বিবরণ দিয়ে পত্র পাঠাল। দাদার চিঠি পেয়েই রামজীবন সঙ্গে সঙ্গে লোক-লস্কর নিয়ে ছুটল বক্‌স্‌ আলি খাঁকে সাহায্য করতে।

চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে সীতারামের বিশেষ কিছু করার ছিল না। সে দু-একজন জমিদারকে অনুরোধ করেছিল, আর কিছু নয়। তাকে একটু পথ দিতে, যাতে সে দূরে চলে যেতে পারে। সামান্য সময় পেলে মানুষ তার ভাগ্য ফিরিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু জমিদাররা এককাট্টা। একদিন তারা সীতারামের উপস্থিতিতে বিনয়ে গদগদ হতো, এখন উদ্ধত। সীতারামকে চিনতেই পারে না ।

সুতরাং কোনো উপায় রইল না। ওই বিরাট বাহিনীর বিরুদ্ধে তার সামান্য কয়জন বিশ্বস্ত অনুচরকে লড়তে দিয়ে লাভ কী?

প্রাণে মরবে। তার চেয়ে সে নিজেই ধরা দেবে।

হাতে পায়ে গলায় খাঁ এবং তাই দিল। স্ত্রী পুত্র পরিবারের ভার কার কাছে দিয়ে যাবে? চেষ্টা করে বিফল হলো। সুতরাং সবাই বন্দি হলো। বস্ আলি খাঁয়ের লোকেরা লোহার শেকল পরিয়ে মহা আনন্দে মুর্শিদাবাদে নিয়ে এলো। করল না। সীতারামের শরীর মুখ গরুর চামড়া দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো। তাকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হলো মুর্শিদাবাদের পূর্ব প্রান্তে বড় রাস্তার ওপর। এই রাস্তা দিয়েই লোকে জাহাঙ্গীর নগরে যায়। এই রাস্তার পথিকরা মুর্শিদাবাদের খবরাখবর জাহাঙ্গীর নগরে

গিয়ে বলে। মনে মনে মুর্শিদকুলী খাঁ ভাবে, এত পথিকের মধ্যে অনেকেই সেখানে গিয়ে প্রচার করবে নিশ্চয় সীতারামের কী শাস্তি হয়েছে। ফারুকশিয়ার শুনবে সেকথা। শত হলেও সৈয়দ আবু তোরাবের সঙ্গে তাদের রক্তের সম্পর্ক আছে।

সীতারামকে রাস্তার পাশে শূলে দেওয়া হল, তার পরিবারের সবার ভাগ্যে প্রথমে জুটল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তারপর একসময় তাদের কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বেচে দেওয়া হলো ।

সেদিন সীতারামের মৃত্যুর পর মুর্শিদকুলী খাঁ কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে দেওয়ান খানায় বসে ছিল। সেই সময় রঘুনন্দন এসে খবর দিল তাঁর শ্যালক বস্‌ আলি খাঁ দেখা করতে চায় । —হ্যাঁ নিশ্চয়। নিয়ে এসো।

রঘুনন্দন ইতিমধ্যে বস্ আলির সঙ্গে কথা বলেছিল। জিজ্ঞাসা করেছিল রামজীবন কোনো সাহায্য করেছিল নিশ্চয়। নিজেকে রামজীবনের দাদা বলে পরিচয় দিল। সেকথা শুনে বস্‌ আলির খুব আনন্দ। সে রামজীবনের সুখ্যাতিতে পঞ্চমুখ। রঘুনন্দন বুঝল তার কথামতো রামজীবন লম্ফঝম্প ভালোই করেছে।

বস্ আলি ঘরে ঢুকতে মুর্শিদকুলী খাঁর মুখে হাসি ফোটে। বলে—তুমি এসে পৌঁছবার আগেই তোমার শিকারকে খতম করা হয়ে গিয়েছে।

—শুনলাম পথে আসতে আসতে ।

—অসুবিধা হয়েছিল কোনো ?

—একটুও না। আর রামজীবন আমাকে খুব সাহায্য করেছে। —তাই নাকি? ও তো এই রঘুনন্দনের ভাই ।

—শুনলাম ওর কাছে।

—যাক্, তুমি একটা ভালো কাজ করেছ। যাও বিশ্রাম নাও।

বক্‌স্‌ আলি চলে গেলে মুর্শিদকুলী খাঁ রঘুন্দনকে বলে—তোমার ভাই তো পাকা জমিদার হয়ে উঠেছে দেখছি।

—না হুজুর। এমন কিছু নয়। আপনি স্নেহের চোখে দেখেন, তাই অমন মনে হচ্ছে। —কস্‌ আলি নিজে বলল, শুনলে না? ওকে সীতারামের জমিদারীটা দিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে বলো দর্পনারায়ণকে।

—যে আজ্ঞে ।

দর্পনারায়ণকে গিয়ে বলতেই সে অবাক হয়ে বলে ওঠে— তুমি আরম্ভ করেছ কী রঘুনন্দন ?

—আজ্ঞে।

—আজ্ঞে ফাজ্ঞে নয়। সারা বাংলার জমিদারিগুলো তোমার ভাই কুক্ষিগত করবে নাকি? এরমধ্যেই তো তিনটে হয়ে গেল ।

—আমার কী দোষ? দেওয়ান সাহেবের অভিরুচি।

দর্পনারায়ণ হেসে বলে—তা তো বুঝতেই পারছি। আমার মাথার মধ্যে কানুনগোগিরি

pathway net

গিজগিজ করছে। আর তোমার মাথার মধ্যে কত কী যে আছে ভেবে পাই না। তুমি জাফর

খাঁকে টেক্কা দিতে পারো ।

—জাফর খাঁ? ও মনে থাকে না। আপনি আর কিশোর রায় ছাড়া কাউকে বড় একটা

ও নামে ডাকতে দেখি না। দর্পনারায়ণ বলে --মুসলমান কর্মচারীরা ওই নামেই ডাকে— যারা বাদশাহের কাছ থেকে আসে।

—তা হতে পারে।

—সীতারামের জন্যে তোমার কষ্ট হচ্ছে না ?

—আমি ভাবিনি। আপনার ?

—আমিও ভাবার চেষ্টা করিনি। দেখছি তুমি ছেলেমানুষ হলেও মাথাটি তোমার যথেষ্ট পাকা। জয়নারায়ণ এতদিন আমার কাছে কাজ করে মাথার চুল পাকালো। কিন্তু তার বুদ্ধি কোথায় যেন ঠেকে রয়েছে।

এত ব্যস্ততা, ধর্মানুশাসন অনুযায়ী — দৈনন্দিন জীবনে এত ঋজুতা। হিন্দুস্থানের বাদশাহের প্রতি এত আনুগত্য—সব কিছুর মধ্যেও মুর্শিদকুলী খাঁর হৃদয়ের এককোণে একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। আশঙ্কাটি হলো, আজিম-উস্-সান, বলতে গেলে সর্বশক্তিমান হয়েও, তাকে কেন এখনো রেহাই দিয়ে চলেছেন। তার ওপর বাদশাহজাদার ক্রোধের যে পরিসীমা নেই একথা শুধু সে কেন দর্পনারায়ণ জয়নারায়ণ এমনকি ইদানীং রঘুনন্দনও জেনে ফেলেছে। পুরোনো কর্মচারীদের মধ্যে কে না জানে? নদি ফৌজদের লেলিয়ে দিয়ে তাকে হত্যা করার প্রচেষ্টা—এ সব তো এখন প্রবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও বাদশাহজাদা তার সম্পর্কে কেন যে কোনোরকম আগ্রহ দেখাচ্ছে না, যে আগ্রহ তাকে বিপদে ফেলে, তার সম্মানে আঘাত হানে। হতে পারে, এইভাবে সে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে চলেছে মুর্শিদকুলী খাঁর মনে। কখন কী হয়, অজানা আশঙ্কার চাপ। একটা কিছু করে ফেললে শেষই হয়ে গেল। কিন্তু আজিম উস্-সান্ সম্বন্ধে যতটুকু জেনেছে মুর্শিদকুলী খাঁ, তাতে অতটা কুট বলে মনে হয় না। সে সাহসী, বীর যোদ্ধা, বুদ্ধিমানও বটে। কিন্তু কূট কৌশল সে তেমন রপ্ত করতে পারেনি। বরং তার কনিষ্ঠ পুত্র ফারুকশিয়ার এ ব্যাপারে বেশ এগিয়ে। তার মস্তিষ্ক ঠান্ডা— বুদ্ধিও খেলে ভালো।

তবু আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছিল মুর্শিদকুলী খাঁর। সব কিছুই করছে, কিন্তু নিজের ভেবে করতে পারছে না। হারেমের খোজা ও বাঁদীর অবস্থা তার। শুষ্ক কর্তব্য করে যাচ্ছে।

অবশেষে এলো সেই আঘাত। প্রথমে তাকে বাংলার দেওয়ানী থেকে অপসারিত করা হলো। রাখা হলো শুধু উড়িষ্যার সহ সুবাদার হিসাবে। এবং সেই আঘাত সামলাতে না সামলাতে তাকে পাঠানো হলো দাক্ষিণাত্যের দেওয়ান করে।

আত্মীয় স্বজন চেনাজানা সবার চোখে বিহ্বলতা। কিন্তু মুর্শিদকুলী খাঁ দাঁতে দাঁতে চেপে সব সামলে নিল। জীবনের পথ সব সময় কুসুমাস্তীর্ণ থাকবে এমন কোনো কথা নেই। তবু তো এই রাজ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ কম ছিল।

জিয়াউল্লাকে তার জায়গায় বাংলার দেওয়ান করে সবাই এসে চুপি চুপি দেখা করে গেল। বড় শান্তিতে

।। দেওয়ান খানায় এমন কি দর্পনারায়ণ

অবধি শান্তিতে ছিল। মুর্শিদকুলী খাঁ মনে মনে ভাবল, লোকটা বেঁচে গেল। সে যদি

এখানকার দেওয়ান হিসাবে বহাল থাকত তাহলে দর্পনারায়ণের আয়ু অনেক সংক্ষিপ্ত হতো। অপমানের জ্বালা জীবনে সে ভোলে না ।

সবাই বিমর্য হলো, কিন্তু চোখের জল ফেলল মাত্র দুজন ভূপতি—আর কিশোর। কেন চোখের জল ফেলল? আর তো কেউ কাঁদল না? সেই কথাই সে জিজ্ঞাসা করে ভূপতিকে

—শুধু তোমরাই কাঁদছ । কেন ?

—জানি না ।

—তোমরা পুরুষ নয়? হিন্দুরা বড় নরম ধাতের হয়।

—–হয় তো তাই। আপনি চলে যাচ্ছেন, মনে হচ্ছে আমরা অভিভাবক হারাচ্ছি। —বাজে কথা। তোমরা ভেবেছ আমি চলে গেলে তোমাদের নোকরি যাবে। সেই ভয়ে কাঁদছ !

দুজনাই প্রতিবাদ করে ওঠে। তারা বলে মুর্শিদকুলী খাঁ যদি চায় তারা কাজ কর্ম ছেড়ে আবার গ্রামে ফিরে যাবে।

—খুব বাহাদুরী। আর নতুন দেওয়ান সব শুনে ভাববে, তোমরা দুজন আমার লোক। তোমাদের অস্থির করে তুলবে। কাজ করে যাও। ফালতু ওসব মেয়েলিপনা ত্যাগ করো।

এক সময় রঘুনন্দন এসে দেখা করে। তার নিজের জন্যে ভয় নেই। সে জানে, তাকে কেউ সরাতে পারবে না। তাকেও না, দর্পনারায়ণকেও না। তবে তার রামজীবনের জমিদারীর কী হবে, বুঝে উঠতে পারে না। রামজীবন বলতে গেলে এখন সব চেয়ে বড় জমিদার। নতুন দেওয়ান জিয়াউল্লা যদি জমিদারীর বর্তমান ব্যবস্থা পাল্টে দেয় তাহলে রামজীবনের সর্বনাশ হয়ে যাবে, কিন্তু সেকথা বিদায়ী দেওয়ানকে সে জানাতে পারে না।

মুর্শিদকুলী খাঁ ওর মনের কথা টের পেয়ে যেন বলে ওঠে— রামজীবনের জন্যে ভাবতে হবে না। যেভাবে টাকা দিচ্ছে ওভাবে দিয়ে গেলে যে কোনো দেওয়ানকে একশোবার ভাবতে হবে ওর জমিদারী কেড়ে নেওয়ার আগে।

ওপর থেকে শুধু মুর্শিদকুলী খাঁ সম্বন্ধে হুকুম এসেছে। আর কারও সম্বন্ধে আসেনি। সুতরাং সুজাউদ্দিন যেখানে আছে সেখানে রইল। এমন কী নাত-জামাইকেও সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়। হয়তো একে একে ওদের সবাইকে সরতে হতে পারে একদিন। কিন্তু এখন তারা এখানে থাকে । নাফিসা মৃদু আপত্তি তুলেছিল। ওর চাইতে ওর মায়ের আপত্তি তীব্রতর ছিল। সে একা পড়ে আছে উড়িষ্যায় । সুজাউদ্দিন নতুন বেগমকে নিয়ে ব্যক্ত। জিন্নৎ নিজেকে বড় অবহেলিত বলে মনে করে। মাঝে নাকি আপন মনে বকবক করত। মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ ভেবে মুর্শিদকুলী খাঁ ঢাকা থেকে এক বিখ্যাত হাকিমকে পাঠিয়েছিলেন। হাকিম ফিরে এসে মুর্শিদকুলী খাঁকে আসস্ত করে যায় যে ওটা সাময়িকভাবে হয়েছিল। সব ঠিক আছে।

আসাদউদ্দিন সম্বন্ধে একটু ভাবনা হয়েছিল তাকে সঙ্গে নেবে, রেখে যাবে। শেষ পর্যন্ত রেখে যায়। রেখে যায় বেগমসাহেবার পরামর্শে। নইলে নাফিসা ভাবতে পারত, তার আর রেজা খাঁর চাইতে আসাদের মূল্য বেশি দেওয়া হলো। তাদের দুজনার প্রাণের যেন মূল্য নেই। মুর্শিদকুলী খাঁ ভাবে, কদিন আগে দোয়াও এলি না তাঁদের প্রাণের তুলনায় আসাদের প্রাণের মূল্য ছিল অনেক বেশি। তাকেই সে ভাবত তার উত্তরাধিকারী। আর সেই

উত্তরাধিকারিত্ব শুধু দেওয়ানী বা সুবাদারীতে শেষ হয়ে যেত না। কিন্তু এখন চিত্র পালটে গিয়েছে। এখন ওসব প্রশ্ন ওঠে না। এখন সবার জীবনের মূল্য সমান। নতুন জায়গায় এই বয়সে গিয়ে সে প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার কতটা করতে পারবে সন্দেহ আছে। কারণ হিন্দুস্থানের সোনার খনিকে সে পেছনে ফেলে যাচ্ছে। এই শ্যামল সমতল ক্ষেত্র জীবনে আর কি সে দেখতে পাবে?

পথের মধ্যে বেগমসাহেবা এক সময় বলে ওঠে—চলো, ফিরে যাই।

—পাগল হলে? বাংলায় ফেরার কথা ভাবছ কী করে? এ কি আমার মর্জি? —আমি বাংলার কথা বলিনি

!

—তবে? কোথায় ফিরে যাব?

—যেখানে থেকে এসেছিলাম। দক্ষিণ ভারতে গিয়ে আর কী হবে? বরং চলো ফিরে যাই পারস্য দেশে। ওখানে আপন পরিবেশে শেষ কয়টা দিন শাস্তিতে কাটিয়ে দেব ।

মুর্শিদকুলী খাঁ বেগমসাহেবার মুখের দিকে চায়। মনে হলো বেগমসাহেবা স্বপ্ন দেখছে। তার নয়ন দুটি খোলা অথচ কোনো বিশেষ দিকে সে তাকিয়ে নেই। এমনকি মুর্শিদকুলী খাঁর দিকেও নয়।

মুর্শিদকুলী খাঁ ভাবে, তুমি না হয় তোমার দেশে ফিরে যাবে কিন্তু আমার দেশ ? তোমার দেশের দিকে যত অগ্রসর হব আমার দেশকে তত পেছনে ফেলে যাব। আমার দেশের সেই হেলানো বটগাছ কোথায় পাব? সেই পুরোনো আম আর নিমের গাছ? সেই জোনাকির ভিড়? বাংলায় থেকেও হয়তো ভূপতি রায়ের গ্রামে আর যাওয়া হতো না। তবু মনে হতো, কাছে আছি ইচ্ছে করলেই গিয়ে দেখে আসতে পারি।

নানা কথা ভাবতে ভাবতে মুর্শিদকুলী খাঁ বেগম সমভিব্যাহারে দক্ষিণ ভারতে গিয়ে পৌঁছেছিল। এই সময়টা তার জীবনের এক অন্ধকার অধ্যায়। কারণ উদ্যমের কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।

কিন্তু নিশ্চয় ঈশ্বরের কৃপা তার ওপর ছিল। নইলে নবোদ্যমে জীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু করার সম্ভাবনা তার হতো না। একসময় যা তার জীবনে ঘটতে ঘটতে ঘটেনি, বাংলার নবনিযুক্ত দেওয়ানের ভাগ্যে সেটা ঘটে গেল, বছর ঘুরে কয়েক মাস পার হতে না হতে দেওয়ান জিয়াউল্লা নক্‌দি ফৌজের হাতে নিহত হলো। সেবারে যেটা ছিল অভিনয় এবারে তা সত্যি। নক্‌দি ফৌজ তাদের প্রাপ্য পাচ্ছিল না। আর বাংলার মতো সুবাকে সুনিপূণভাবে শোষণ করার ক্ষমতা কার আছে? অধিকাংশ দেওয়ান গোদুগ্ধ দোহন করতে গিয়ে বাছুরকে মেরে ফেলে। বাংলায় জনগণকে বাঁচিয়ে রেখে, সেখানকার উৎপাদনে এতটুকু বাধার সৃষ্টি না করে প্রতিবছর অগাধ ধনরাশি বাদশাহকে প্রেরণের ক্ষমতা মুর্শিদকুলী খাঁ ছাড়া দ্বিতীয় কারও আর নেই। আজিম-উস্-সানকেও শেষ পর্যন্ত এই কথাটা স্বীকার করতে হলো। এবং তারই মতো নিয়ে মুর্শিদকুলী খাঁকে আবার পাঠানো হলো প্রত্যাবর্তনের পথে মুর্শিদকুলী খাঁর মনে হলো যেন বাংলায় । ফিরে পেয়েছে। মনের আর দেহের যে শক্তি চিরবিদায় নিয়েছে বলে মনে হয়েছিল তা সত্য নয়। বুঝতে পারল, কিছুই

হারায়নি সে। হারিয়েছিল শুধু আশা। তাই আকাঙ্ক্ষাও অন্তর্হিত হয়েছিল। আর আকঙ্ক্ষা চলে গেলে জীবনের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না ।

বাড়ির দাওয়ায় বসে বেগমসাহেবাকে প্রশ্ন করে মুর্শিদকুলী খাঁ—তোমার নিশ্চয় খুব খারাপ লাগছে?

—কেন বলো তো ?

—নিজের দেশ পারস্যে যেতে পারলে না বলে। আবার ফিরে যেতে হচ্ছে সেই বাংলায়।

-কে বলেছে তোমাকে ?

–এর মধ্যে ভুলে গেলে? বাংলা ছেড়ে চলে আসার সময় কী বলেছিলে? —কী বলেছিলাম?

–বলেছিলে, দক্ষিণ ভারতে গিয়ে আর কাজ নেই। চলো দুজনে আবার ফিরে যাই পারস্য দেশে, একদিন যেমন দুজনে এদেশে এসেছিলাম।

—বলেছি নাকি? নিশ্চয় মাথার ঠিক ছিল না। বাংলায় আমার জিন্নৎ পড়ে রইল, নাফিসা আর আসাদ রইল, আমি চলে যাব পারস্য দেশে? আমাকে অত স্বার্থপর ভাবো নাকি? আমি কি অতটা হৃদয়হীন?

—কে বলেছে তুমি হৃদয়হীন! আমি শুধু মনে করিয়ে দিলাম তোমার উক্তিটি। আসলে ওকথা আমারও মনে হয়েছিল। ভেবেছিলাম চলে যাব। কী হবে এখানে থেকে । যে টাকা সঙ্গে আছে স্বচ্ছন্দে কেটে যাবে বাকি জীবন। আমার জীবন বিলাসবহুল নয়। অবশেষে মুর্শিদাবাদে এসে পৌঁছোয় ওরা।

মুর্শিদাবাদ যেন নতুন করে জেগে উঠল। আগের কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল । সাধারণ লোকে বলাবলি করতে থাকে, যাঁর নামে এই শহরের নাম, তিনি না থাকলে শহরের প্রাণ থাকে? কয়জন ওকে চেনে জাফর খাঁ নামে ?

সব চেয়ে আগে আসে ভূপতি রায় আর কিশোর রায়। তারা সসম্ভ্রমে মাথা নিচু করে নমস্কার করে।

—মুর্শিদকুলী খাঁ লক্ষ করে ভূপতির শরীর বেশ খারাপ তবে তার উল্লেখ না করে বলে, কী ভূপতি, কেমন ছিলে তোমরা?

—বেঁচে ছিলাম। সাপ যেমন শীতকালটা কাটায়। —সাপের মতো কাটিয়ে বেশ কথা শিখেছ দেখছি। ভূপতি লজ্জা পেয়ে যায়। একথা সে বলতে চায়নি।

পরে দেখা করতে আসে রঘুনন্দন। সে বলে—সবই করছিলাম হুজুর কিন্তু কেমন যেন অসহায় মনে হতো নিজেকে। আমার কাজের তারিফ করারও কেউ ধমক দেবারও কেউ ছিল না। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগত।

। ভুল করলে মুর্শিদকুলী খাঁ বুঝল রঘনন্দন অন্তরের কথাই বলেছে ।

ভাই-এর খবর কী?

জিজ্ঞাসা করে—তোমার

—আপনি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তার পেছনে লেগেছিল অনেকে। মতলব ছিল তার জমিদারী থেকে কিছুটা ভাগ বসাতে।

—কে তারা ?

—তাদের নাম বলতে আদেশ দেবেন না হুজুর। কারণ আমি তাদের ডেকে বলতেই তারা নিরক্ত হয়।

—তোমার কথা শুনল ?

—তাই তো দেখলাম হুজুর। বলেছিলাম, আপনি চিরকালের জন্যে চলে যাননি। আবার ফিরে আসবেন ।

—একথা বললে ? কেন বললে ?

—বিশ্বাস করুন। আমার মনে হতো আপনি ওখানে বেশিদিন থাকবেন না।

—এটা মনে হওয়ার কারণ?

—একদিন ঠিক ভোরবেলা একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখেছিলাম। দেখেছিলাম, না; সেকথা বললে আপনার সম্মানে আঘাত লাগবে।

—বলে ফেলো। স্বপ্ন যখন, বলতে অনুমতি দিলাম ।

—নাটোরে এক জাগ্রত কালী আছেন। হিন্দুদের খুব বিশ্বাস। স্বপ্ন দেখেছিলাম, খুব ঝড়-ঝঞ্ঝা হচ্ছে, আমি যেন নৌকো করে কোথায় যাচ্ছিলাম। হঠাৎ নৌকো উলটে গেল। নৌকোয় আরও আরোহী ছিল। দেখলাম তাদের অনেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য কী আপ্রাণ চেষ্টা করল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুহাত মুঠো করে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তলিয়ে গেল। আমারও দম শেষ হয়ে আসছিল, শরীর জমে যাচ্ছিল। ডুবে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ সেই কালীর কথা মনে হলো। আমি তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম মনে মনে । কেটু পরেই দেখি আকাশের গায়ে মা কালী। হাসি মুখে ডান হাত তুলে অভয় দিচ্ছেন আর একটি নৌকো দেখিয়ে দিচ্ছেন। নৌকোটি কাছে আসতে দেখি ওটিতে আপনি বসে রয়েছেন। আমাকে তুলে নিলেন নৌকোয়।

মুর্শিদকুলী খাঁ গম্ভীর হয়ে যায়। সে জানে রঘুনন্দন তাকে সন্তুষ্ট করতে মাঝে মাঝে একটু বাড়িয়ে বলে। তাতে সে কিছু মনে করে না। কারণ সে কাজ জানে এবং নিপুণ ভাবে করতে পারে। কিন্তু আজকের ঘটনা শুনে তার বিশ্বাস হলো স্পপ্নটা রঘুনন্দন দেখলেও দেখতে পারে।

—ঠিক আছে রঘুনন্দন। যাও কাজ করোগে। দর্পনারায়ণের খবর কী?

রঘুনন্দন বলতে পারে না জিয়াউল্লাকে নতুন দেওয়ান পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল দর্পনারায়ণ। বলতে পারে না কারণ বয়োজ্যেষ্ঠ। তাছাড়া বলতে গেলে তার গুরু। দর্পের কাছেই কাজ শিখেছে। সে দর্পের ইচ্ছা ছিল কিছু কামিয়ে নেওয়ার। মুর্শিদকুলী খাঁ ফিরে আসায় সেটা বন্ধ হয়ে গেল।

রঘুনন্দন বলে—তিনি এখুনি আসছেন। একটা কাজে আটকে মনে মনে মুর্শিদকুলী খাঁ ভাবে, দর্পনারায়ণকে ডাঙায়

ঝোলাতে হবে। দেখা যাক্, ফিরে যখন এসেছি

গিয়েছেন।

আরও বড় টোপ নিলে হবে।

মেদিনীপুরকে উড়িষ্যা থেকে বিচ্ছিন্ন করে সুবে বাংলার সঙ্গে যুক্ত করার বহুদিনের ইচ্ছা এতদিনে পূরণ করল মুর্শিদকুলী খাঁ। জিনিসটা এতদিন পরে স্বাভাবিক হলো। উড়িষ্যার

সঙ্গে থাকার সময় মেদিনীপুরকে কিরকম নিঃসঙ্গ বলে মনে হতো। আদায়ের ব্যাপারে, সৈন্য প্রেরণের ব্যাপারে মেদিনীপুর মুর্শিদাবাদের অনেক কাছে।

কিন্তু এই কাজ শেষ করতে না করতে হুগলি নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়ে গেল। হুগলির ফৌজদার জিয়াউদ্দীন সাক্ষাৎ বাদশাহ দ্বারা নিযুক্ত। এজন্যে তার আত্মম্ভরিতা বরাবরের। সে নিজেকে ভেবে এসেছে স্বাধীন বলে। বাংলার দেওয়ান বা নাজিমের তোয়াক্কা সে কোনোদিনও করেনি। হুগলি ফিরিঙ্গিদের ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি বড় ঘাঁটি। তাদের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এসেছে জিয়াউদ্দীন। তারাও খুশি হুগলির ফৌজদারের ওপর। কিন্তু মেদিনীপুর উড়িষ্যার অন্তর্গত থাকার সময় মুর্শিদকুলী খাঁর মনের ভেতরে যেমন একটা অস্বস্তি ছিল, জিয়াউদ্দীনের হামবড়া ভাবের জন্যেই তেমনি তার ভেতরে একটা জ্বালা ছিল। ঔরঙ্গজেবের সময়ে এ বিষয়ে বাদশাহকে কিছু বলতে সে সাহস পায়নি। বাহাদুর শাহের সময় তো বলার প্রশ্নই ছিল না। কারণ আজিম-উস্-সান বাদশাহকে সব ব্যাপারে পরামর্শ দেয়। আসলে নরম প্রকৃতির বাদশাহের নামে আজিমই দেশ চালায়।

কিন্তু এবারে দক্ষিণ ভারত থেকে ঘুরে আসার পরে মুর্শিদকুলী খাঁর মনের জোর আর জেদ দুটোই বেড়ে গিয়েছে। সে বুঝেছে তাকে ছাড়া বাদশাহের আর উপায় ছিল না বলেই বাংলায় ফিরিয়ে এনেছেন। অর্থাৎ প্রকারান্তরে মুর্শিদকুলী খাঁর জয় হয়েছে। তাই সে সোজাসুজি বাদশাহকে লেখে যে হুগলিতে একজন স্বাধীন ফৌজদার থাকায় প্রশাসনের খুবই অসুবিধা হচ্ছে। এ যেন একই এলাকায় দুই শাসনকর্তা। এর একটা বিহিত করা দরকার। জিয়াউদ্দীনকে এই মুহূর্তে অপসারিত করা দরকার। জোরালো যুক্তি দেখে বাহাদুর শাহ সম্মতি জানালেন। বললেন, হুগলির জন্য মুর্শিদকুলী খাঁ নিজের পছন্দমতো একজন ফৌজদার যেন নিযুক্ত করে।

সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদকুলী একজন কুশলী মুঘল কর্মচারী, ওয়ালী খাঁ যার নাম, তাকে পাঠাল হুগলিতে সৈন্যসামন্ত দিয়ে। জিয়াউদ্দিন বুঝল তার দিন শেষ। সে হুগলির কেল্লা পরিত্যাগ করে হিন্দুস্থানের রাজধানীর দিকে যাবার জন্যে বাইরে চলে এলো।

জিয়াউদ্দিনের পেশকার হলো এক বাঙালি। নাম কঙ্কর সেন। অনেক পয়সা করেছে সে। সেও খাতাপত্র নিয়ে জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো।

ওয়ালী বেগ খবর পেল পেশকারও প্রাক্তন ফৌজদারের সঙ্গে রওনা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সে আপত্তি জানালো। বলে পাঠাল যে, হিসাবপত্র না বুঝিয়ে দিয়ে পেশকারের যাওয়া চলবে না। জিয়াউদ্দিন ঘাবড়ে গেল। বলল কী করবে কঙ্কর ?

—সর্বনাশ। আমি থাকলে যে আপনিও ফ্যাসাদে পড়বেন। অনেক উল্টোপাল্টা ব্যাপার আছে হিসাবে। আপনি তো জানেনই। বাইরে থেকে যতটা সম্ভব আমি ঠিক করে রেখেছি। কিন্তু নতুন ফৌজদার তো ওপর ওপর দেখবেন না। উনি সব জানতে চাইবেন। ধরা পড়ে যাব, হুজুর। কিছুর নাড়ী-নক্ষত্র

—তাহলে তুমিও চলো। কিন্তু ওরা যে তোমাকে

দেবে না।

—ফিরিঙ্গিরা আপনার সহায়। ওদের সৈন্যসামন্ত বেশি হলে কী হবে, ওরা এখানে

নতুন এসেছে। ফিরিঙ্গিরা আপনাকে সাহায্য করলে ওরা পারবে না। আমি হুজুর আপনার সঙ্গে সারা জীবন থাকতে চাই।

—ঠিক আছে।

ওদিকে ওয়ালী খাঁ শুনল জিয়াউদ্দিন কঙ্কর সেনকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। সে বাধা দেবার জন্য প্রস্তুত হলো।

জিয়াউদ্দিন তার সৈন্য সাজালো চন্দননগর আর চুঁচুড়ার মাঝামাঝি একটা জায়গায় সামনে পরিখা খুঁড়ে ফেলল। ওয়ালী বেগ ইদ্‌গার মাঠে দেবীদাসের পুকুরের ধারে তার সৈন্য-সামন্ত জড়ো করল। সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদাবাদে খবর পাঠানো হল, যত সত্বর সম্ভব একজন যোগ্য সেনাপতির অধীনে সৈন্য পাঠাতে। মুর্শিদকুলী খাঁ রেগে গেল। সে সঙ্গে সঙ্গে দিলীপ সিং-এর অধীনে অশ্বারোহী আর পদাতিক সৈন্য পাঠাল। সেই সঙ্গে ফিরিঙ্গিদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য হুমকি দিয়ে একটি পত্রও পাঠাল।

জল রীতিমতো ঘোলা হয়ে গিয়েছে দেখে জিয়াউদ্দিন আতঙ্কিত হয়ে উঠল। কিন্তু কঙ্কর সেন প্রাণের ভয়ে তাকে প্রবোধ দিয়ে বলল--আপনি হুজুর, ওদের সেনাপতি দিলীপ সিং-এর কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠান।

ভীত জিয়াউদ্দিন ক্ষেপে গিয়ে বলে ওঠে—তাতে হবেটা কী?

কঙ্কর সেন বলে—আপনি লোক পাঠান হুজুর। আমি সব ব্যবস্থা করছি। —কী ব্যবস্থা? তুমি যুদ্ধ জানো নাকি?

আজ্ঞে না। আমি কৌশল জানি।

কী কৌশল ?

—আপনি যাকে পাঠাবেন, সে যেন একটা লাল রঙের কোর্তা গায়ে দিয়ে যায়। সে যখন দিলীপ সিং-এর সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবে, তখনই আসল কাণ্ড ঘটবে। —কী ঘটবে?

—ফিরিঙ্গির গুলিতে দিলীপ সিং লুটিয়ে পড়বে হুজুর।

কঙ্কর সেন কথাটা শেষ করে খুব হাসতে থাকে। জিয়াউদ্দিনের মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। বঙ্কর তো দারুণ বুদ্ধিমান। সে বলে—সেই ফিরিঙ্গিটা? সেই যে

—হ্যাঁ হ্যাঁ হুজুর। অব্যর্থ লক্ষ। লোকটা কোর্তা না পরে মাথায় লাল রঙের শালও জড়িয়ে নিতে পারে। তবে হুজুর সে যেন কথা বলার সময় একটু দূরে থাকে। কামানের গোলার ব্যাপার।

–ঠিক আছে, ঠিক আছে।

সেইদিন ঠিক ভর দুপুরে মাথায় লাল শাল জড়িয়ে একটি লোক চলল দেবী দাসের পুকুরের দিকে। ওয়ালী খাঁয়ের লোকেরা সঙ্গে সঙ্গে বুঝল সন্ধির প্রস্তাব আসছে। লোকটির মাথার শাল খসে পড়ছিল। তাড়াতাড়ি আবার ভালো করে জড়িয়ে নিল। শীতের সময় হলেও দুপুরে ওভাবে শাল জড়িয়ে নেওয়া

লোকেরা তাকে খুব কাছে আসতে দেয় না ।

লোকটা বলে—আমি আগের ফৌজদার সদৃশ লাগান ওয়ালী খাঁয়ের সাহেবের কাছ থেকে আসছি।

সিপাহশালার দিলীপ সিংকে একটা পত্র দেব। তিনি কিছু বললে, আমার মালিককে গিয়ে জানাব। দিলীপ সিং তখন আদুড় গায়ে স্নানের পূর্বে তেল মাখছিল। সেই অবস্থাতেই শিবির থেকে বেরিয়ে আসে। লোকটির কাছ থেকে পত্রটি হাতে নেয়। লোকটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে

দুচারটে কথা বলে। খুব অপ্রাসঙ্গিক এবং নির্বোধের মতো কথা। দিলীপ সিং অবাক হয়, বিরক্তও হয়।

ঠিক সেই সময় একটি গোলা এসে তার দেহকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। আচমকা এই নিদারুণ ঘটনা সবাইকে হতচকিত করে দেয় সৈন্যরা ছোটাছুটি শুরু করে। আর ওয়ালী খাঁ উপায়ান্তর না দেখে কেল্লার ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

জিয়াউদ্দিন হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করতে থাকে—এবারে কী হবে কঙ্কর? এবারে যে মুর্শিদকুলী খাঁ আমার টুটি চেপে ধরে জবাই করবে।

—কী যে বলেন হুজুর। এখুনি চলুন, পালাই। এই তো সুযোগ। কোনো রকমে বাদশাহের কাছে পৌঁছোতে পারলে আর ভয় নেই।

ওরা হাতি-ঘোড়া যা পায়, সব নিয়ে ছোটে দিল্লীর পথে। আর দিলীপের সৈন্যরা তার ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহটির সৎকারের ব্যবস্থা করে যথাসাধ্য শাস্ত্রীয় মতে। দিলীপ সিং মানুষটা সিপাহীদের প্রিয় ছিল। সেনাপতি বলে নিজেকে আলাদা করে সরিয়ে রাখত না। তাদের সঙ্গে সহকর্মীর মতো মিশত।

ওয়ালী বেগ ফৌজদার হয়ে বসল বটে। কিন্তু আসল পাখি পালিয়েছে। অনেক টাকাই তছরুপ করেছে নিশ্চয়। সে মুশিদাবাদে সবিস্তারে সমস্ত জানিয়ে দূত পাঠাল ।

মুর্শিদকুলী খাঁ সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অস্ফুট উচ্চারণ করে-কঙ্কর সেন। কাঁকর সেন। কাঁকরের মতো পায়ের নীচে পিষে ফেলতে হবে।

সেই সময় দর্পনারায়ণ পাশে দাঁড়িয়েছিল হিসাবের খাতা দেওয়ান সাহেবের সামনে ধরে। মুর্শিদকুলী খাঁ মনে মনে ভাবে এই কঙ্কর হলো দ্বিতীয় ব্যক্তি যার নিস্তার নেই। আর সামনে যে অতি বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে হলো প্রথম ব্যক্তি। এদের ক্ষমা নেই । তবে অনেক খেলিয়ে তবে এদের পৃথিবী থেকে সরাতে হবে। বড় মাছ, সহজে ধরা দেয় না। গভীর জলের মাছ

—দর্পনারায়ণ।

—বলুন হুজুর।

এবারে রঘুনন্দনকে নিয়ে একটা বিরাট কাজ করতে হবে। আমি চাই জমিদারীগুলোর সুনির্দিষ্ট এলাকা হোক। কর আদায়ে সুবিধা হবে—শাসনেরও সুবিধা। একটা স্পষ্ট ধারণা হবে সবার। সম্ভব এটা?

—নিশ্চয় সম্ভব হুজুর। রঘুনন্দনকে পেলে করে ফেলব।

—ঠিক আছে। আর কদিন পরেই রবি উল-আওয়ালের সেই পুণ্য দিনগুলি। তার পরই শুরু করে দিন ।

বছর আগে স্বপ্ন

সেই পবিত্র দিবস অবশেষে এসে গেল। কোরান নকল করার দেখেছিল মুর্শিদকুলী খাঁ এই দিনগুলি সার্থকভাবে পালন করবে বলে। মনের মধ্যেই এতদিন ছিল সেই ইচ্ছা। পূরণ করা হয়নি। দক্ষিণ ভারতে চলে গিয়েছিল। এবারে ফিরেছে। আর তাকে কেউ এ-দেশ ছাড়া করবে বলে মনে হয় না। কারণ দিনকাল অনেক বেশি জটিল হচ্ছে। সাগরপারের ওই ফিরিঙ্গিগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যে ওস্তাদ।

এখানকার ব্যবসায়ীরা তাদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে চলতে পারে না। হুগলির ফৌজদার জিয়াউদ্দিন তো তাদের হাতের পুতুল হয়ে পড়েছিল। তাদেরই এক গোলায় দিলীপ সিং-এর মতো মানুষকে হারাতে হয়েছে। ওদের ক্ষমা নেই। আজিম-উস-সানদার-উল- জারবে ওদের টাকা তৈরির অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই অনুমতি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ব্যবসাতে যে সব সুযোগ-সুবিধা পেত, তাও আর নেই। অন্যান্য ব্যবসায়ীর মতো ব্যবসা করুক। কোনো খাতির নেই। ওরা মিষ্টি কথায়, উপহার দিয়ে মন গলাতে ওস্তাদ। কিন্তু এ বান্দা সেই মানুষ নয়। ওরা শত চেষ্টাতেও এ বান্দার মন ভেজাতে পারবে না। তবে ওসব কথা এখন নয়। এই কটা দিন আর কিছু নয়। মনকে পবিত্র রাখতে হবে। এই দিনগুলোতে মনে মনে প্রতীক্ষা করতে হবে, সুবার গরিবদের কষ্ট লাঘব করার জন্য সতত চেষ্টা করতে হবে। যারা নিপীড়িত তাদের নিষ্কৃতি দেবার প্রয়াস চালাতে হবে। এই দিনে প্রতি বছর সংকল্প করতে হবে, গরিবরা যাতে বেশি দামে খাদ্যশস্য না কেনে। কেউ যদি তাদের ঠকায় তাহলে তাকে চরম শাস্তি দিতে হবে । মহলদার, ওজনদার, দোকানদার কারও নিস্তার নেই। মুর্শিদকুলী খাঁ ঠিক করে, প্রতি সপ্তাহে সে রাজ্যের খাদ্যশস্যের মূল্যের তালিকা নিজে যাচাই করবে। কারও কোনো গাফিলতি দেখলে তাকে গাধার পিঠে চাপিয়ে সারা শহরে ঘোরানো হবে।

হ্যাঁ, এই পবিত্র দিনগুলো তার প্রতিজ্ঞা গ্রহণের দিন। আর সেই সঙ্গে নগরীর মানুষ যাতে আনন্দ পায় সেই ব্যবস্থা তো করতেই হবে।

তাই করা হলো, মহীনগর থেকে লালবাগ এই দীর্ঘপথ নদীর ধার বরাবর আলোকসজ্জায় সজ্জিত করার ব্যবস্থা হলো। আর সে কি সাধারণ আলো? মসজিদ গাছপালা সব আলোয় আলোময়। হাজার হাজার মানুষকে নিযুক্ত করা হলো একই সঙ্গে চিরাগবাতি জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য। যেন মুহূর্তে সব বাতি জ্বলে ওঠে।

সেই দিন সন্ধ্যায় নদীর দুই কূল মানুষের ভিড়ে জমে উঠল। কত মানুষ। দীর্ঘ প্রতীক্ষা তাদের। শুনেছে একই সঙ্গে সব উদগ্রীব। এমন সময় কামানের গর্জন। সঙ্গে সঙ্গে সব বাতি জ্বলে উঠল। দুই তীরের মানুষ আনন্দে চিৎকার করে উঠল। মুর্শিদকুলী খাঁ নিজে দাঁড়িয়ে সেই আনন্দ কোলাহল শুনে আত্মপ্রসাদ অনুভব করল। কিন্তু আরও বাকি আছে। এপারের মানুষেরা বুঝতে পারল না। কিন্তু দূর থেকে ওপারের মানুষেরা বিস্ময়ে চেয়ে দেখল চিরাগগুলো কোথাও মসজিদের রূপ নিয়েছে। কোথাও গাছের রূপ নিয়ে হাসছে। সব চেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, কোরানের বাণী ফুটে উঠল মসজিদের বেদিপ্রান্তে। আবার চিৎকার ওপার থেকে। এপারের মানুষরা প্রথমে বুঝতে পারেনি, ওদের অত উৎসাহ কেন। পরে বুঝতে পেরে শত শত নৌকোয় নদী অতিক্রম করতে শুরু করল। ওপার থেকে দেখবে বলে। নিষ্কর্মা দরিদ্র মাঝিরা ভীষণ উৎসাহিত হয়ে ওঠে। তারা অর্থের স্বাদ পেয়েছে। এক বাহ, দুদ কতবার পারাপার করতে হবে। পার করে দেবার সময় তারা জানতে চায়, এই বছর শেষ কিনা। প্রতিবছর কি হবে? আশ্বস্ত হয়। প্রতিবারই এই ব। অর্থাৎ বছরের কয়েক এই উৎসব হবে। মাসের জীবন ধারণের পয়সা তারা পেয়ে যাবে ফি বছর এই দিনগুলোতে। খোদা মেহেরবান। ওদিকে নদীর ধারে আলোকসজ্জায় আর এদিকে কদিন ধরে মুর্শিদকুলী খাঁ নিজে নিবাসে বিনম্রভাবে অভ্যর্থনা জানাতে থাকে প্রতিদিন শেখ, উলেমা, সৈয়দ ও আরও সব

ধার্মিক ব্যক্তিদের। তাঁরা এই কদিন তার নিবাসে আহার গ্রহণ করবেন। মুর্শিদকুলী খাঁ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভক্তের মতো তাঁদের খানাপিনার তদারক করে চলে। শুধু তাঁরাই বা কেন? সাধারণ জীবজন্তুও বাদ পড়ে না। রাতের পেচকেরাও এই খাদ্যের অংশীদার। কল্পনা আজ বাস্তবে পরিণত। মুর্শিদকুলী খাঁর হৃদয় এতদিনে সম্ভবত ভাবাবেগে আপ্লুত হলো—যে ভাবাবেগকে সে সংযত রাখে নিষ্ঠুরভাবে। তার ধারণা ভাবাবেগ দুর্বল মানুষের একটা দোষ।

এই কদিন শুধু মসজিদে নয়, বহু স্থানে হাজার হাজার পাঠক উচ্চকণ্ঠে কোরান পাঠ করে চলে। ওদিকে তার ও অন্যান্য নকলনবীশের নকল করা অসংখ্য কোরান পাঠানো হল মক্কা ও মদিনা, নাজাফ ও কারবালা, বাগদাদ আর খোরাসান, জিদ্দা এবং বসরায়। দেশের ভেতরে আজমীর পাণ্ডুয়া প্রভৃতি পুণ্যস্থানে পাঠানো হলো কোরানের নকল।

এইভাবে সুদীর্ঘ বারোদিন ধরে চলল পবিত্র দিবস পালন। সবাই মুর্শিদকুলী খাঁর

প্রশংসা না করে পারল না।

জাহাঙ্গীর নগরে বসে ফারুকশিয়র এ-খবর শুনলে। তার মা সাহেবউন্নিসাও শুনলেন। কিন্তু তাদের মনে বিশেষ কোনো দাগ পড়ল না। আজিম-উস-সান এখানে থাকলে ঈর্ষান্বিত হতেন। কিন্তু এই সময়ে তাঁর পক্ষেও এই ব্যাপারে মাথা ঘামানো বোধহয় সম্ভব হতো না । কারণ ফারুকশিয়রের মতো তাঁরও মন পড়ে থাকত দিল্লী আর আগ্রার ঘটনার দিকে । বাহাদুর শাহ ভীষণ রকম অসুস্থ, তাঁর পীড়া শুধু দেহের নয়, মস্তিষ্কেরও।

ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকেই ফারুকশিয়রের ইচ্ছে ছিল সেও ঢাকা ত্যাগ করে মুর্শিদাবাদে গিয়ে বসবাস করবে। তৈমূরবংশের সন্তান বলে মনে তার গর্ববোধ আছে, ঠিকই, কিন্তু পিতা আজিম-উস-সানের মতো আত্মম্ভরিতা তার আদৌ নেই। সে অনেক বেশি বাস্তববাদী। সে ঠিক করে নিয়েছিল মুর্শিদকুলী খাঁর সঙ্গে আর সংঘর্ষ নয়। তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত। তেমনি তার কাছাকাছিও থাকা উচিত। জাহাঙ্গীর নগরে সে পড়ে ছিল নিঃসঙ্গ অবস্থায়। কারণ দেশের সবাই মানে আসল রস রয়েছে মুর্শিদাবাদে। যত কিছু টাকা-পয়সার লেনদেন সব এখানে। সে যদি মুর্শিদাবাদে থাকে তাহলে সুবাদার আজিম-উস-সানের প্রতিনিধি হিসাবে এখানে তার গুরুত্ব বেড়ে যাবে, আর মুর্শিদকুলী খাঁ দরবারী নিয়মনিষ্ঠা যেভাবে পালন করে তাতে নিশ্চয় নিয়মিতভাবে এসে তাকে দর্শন দিয়ে যাবে। লোকটাকে অবিশ্বাসী বলে কিছুতে মনে হয় না। বরং বাদশাহের প্রতি একটু বেশিমাত্রায় বিশ্বাসী এবং নিঃসন্দেহে অনুগত ফারুকশিয়ারের মুর্শিদাবাদে আসা পেছিয়ে গিয়েছিল একটি সামান্য কারণে। সে মুর্শিদকুলী খাঁয়ের নাতনীর সাদিতে যোগ দেবার আমন্ত্রণ এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে অনেক দেরিতে এল। নইলে আগেই চলে আসত। তারপর মুর্শিদকুলী খাঁ যাওয়ায় সে এখানে আসার তাগিদ আর অনুভব করেনি তখন। মুর্শিদকুলী খাঁ জান-মান দিয়ে তাকে আসতে সাহায্য ভারতে চলে অসুবিধা যাতে না হয়, সেই ব্যবস্থা করে দিল। লালবাগের প্রাসাদে শাহাজাদার বসবাসের ব্যবস্থা করা হলো। লালবাগের প্রাসাদে ফারুকশিয়ার স্থিত হয়ে বসলে একদিন মুর্শিদকুলী খাঁ এসে সসম্ভ্রমে তাকে কুর্নিশ করে জিজ্ঞাসা করে - শাহাজাদা, আপনার কোনোরকম অসুবিধা মুর্শিদকুলি খাঁ-এ

থাকলে আমাকে বলবেন। নতুন জায়গায় এসেছেন, সেই জন্যে জানতে চাইছি।

ফারুক সন্তুষ্ট হয়ে বলে—তেমন কোনো অসুবিধা নেই। অসুবিধা হলে নিশ্চয় বলব। আচ্ছা আমার দৈনদিন খরচাপাতি দেখাশোনার জন্যে কোনো লোক দিতে পারেন? নিয়াজ খুব বুড়ো হয়ে গিয়েছিল বলে, ওকে আনিনি সঙ্গে।

—অবশ্যই লোক দেব আপনাকে। হিসাব নিয়েই আমি থাকি। আচ্ছা, কোনো হিন্দু দিলে আপনার আপত্তি আছে?

—হিন্দু কখনো রাখিনি

—ঠিক আছে। অন্য কাউকে দেব।

—না না, হিন্দু দিতে পারেন। একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে। আপনি শুনি ওদের ওপর বড় বড় দায়িত্ব দিয়েছেন।

মুর্শিদকুলী খাঁ কথাটা শুনে একটু হাসতে পারত, কিন্তু হাসে না। আসলে সে বরাবর কম হাসে। সে দেওয়ানখানায় এসে ভূপতি রায়কে ডাকে।

ভূপতি রায় এসে দাঁড়াতে প্রশ্ন করে—তোমার ছেলের নামটি কী যেন ? —গোলাপ।

—বার নাকি?

—কী বললেন হুজুর ?

মুর্শিদকুলী খাঁ বুঝতে পারে মুখ দিয়ে আলগা কথা বের হয়ে পড়েছে। ভাবে, ভূপতির ছেলের নাম এই প্রথম জিজ্ঞাসা করল সে। ভূপতির তাতে কিছু মনে করার কারণ নেই। কিন্তু সে মনে মনে জানে, মানুষ অনেক রকমের ফাঁদে পড়ে জীবনে। হৃদয়ের কোমল বৃত্তিনিচয়কে বেশি বাড়তে দেওয়ার সুযোগ দিলে এই ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা খুব বেড়ে যায়। সুতরাং কোমলতাকে কোনো প্রশ্রয় নয়——আবেগকে রুদ্ধ করতে হবে।

মুর্শিদকুলী খাঁ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে—না কিছু না। আমি বলছি গোলাপকে ফারসি শিখিয়েছ ?

—হ্যাঁ, খুব ভালো শিখেছে। ফারসিতে শায়রি লেখে।

—খেয়েছে।

——হুজুর ?

–না বলছি কি, শুধু ওই সবই লেখে নাকি? আমিও তো একটু লেখালেখি করি। আবার অন্য কাজও করি। গোলাপ কি অন্য কাজ করে?

—করে, কিন্তু মন নেই। ওদিকে আবার পদাবলীও লেখে।

—সেটা কী জিনিস ?

—চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি যেমন লিখেছেন হুজুর।

—আমি ওসব বুঝি না। তুমি ভুল করেছ ভূপতি

। ভেবেছিলাম

তোমার পরে তোমার

জায়গায় গোলাপকে বসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে যাব। সেটি আর হলো না। এখানে বসাবার আগে, ছোট-খাটো দায়িত্ব দিয়ে দেখতাম।

তুমি

সুযোগ হারালে।

—এজন্যে সংসারে আমার কম অশান্তি নয়। কিন্তু ছেলেটা হয়েছে অন্যরকম। জানি,

ওর কপালে দুঃখ আছে।

মুর্শিদকুলী খাঁ একটু আশাহত হলো। সে অন্য একজনকে ফারুকশিয়ারের কাছে দিল। লোকটা মুসলমান।

ফারুকশিয়ার প্রশ্ন করায় মুর্শিদকুলী খাঁ বলে—ভেবে দেখলাম, মুসলমান থাকাই ভালো। তাছাড়া লোকটা মুঘল আদব-কায়দা জানে ।

লাহোরে বাহাদুর শাহের অসুস্থতার খবর ফারুকের জানা ছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে যে তাঁর মৃত্যু হয়েছে সেই খবর তার জানা ছিল না। আজিম-উস-সানের দক্ষতার ওপর তার অগাধ আস্থা । জানে যুদ্ধবিদ্যায় তার পিতা সর্বশ্রেষ্ঠ। পিতার জ্যেষ্ঠ ভাই মৈজদ্দিন কিংবা অন্যান্য ভাই জেহান শাহ আর রাকিয়া ওমান পিতার সমকক্ষ কখনো নয়। মৈজদ্দিন তো অপদার্থ ।

ফারুকের ধারণা হয়তো মিথ্যা নয়, কিন্তু পিতৃ চরিত্রের সবটুকু তার জানা ছিল না। মৈজদ্দিন জ্যেষ্ঠ হয়েও কখনো পিতা বাহাদুর শাহের কাছে থাকতে চাইত না। তার মনে মনে একটা অভিমান, আজিম তার চাইতে বয়সে ছোট হলেও পিতার পক্ষপাতিত্ব তার প্রতি। তাকে কাছে রেখে দিয়ে বড় বড় পদ দিয়েছেন। মৈজদ্দিনের এই অভিমানের ফলে আজিম-উস-সান পিতার মৃত্যুর পর সবটুকু সুযোগ পেয়ে গেল। সে পিতার ধনসম্পদ পেল, তাঁর সৈন্য-সামন্ত পেল, হীরা-জহরৎ পেল এমনকি সিংহাসনও পেল। আর অতি সহজে এতবড় সুযোগ পেয়ে যাওয়ায়, সে ভেবে বসল, উপযুক্ত বলে এটা তার প্রাপ্য তার চিরকালের আত্মগরিমা বহু গুণ বেড়ে গেল। ফলে আমীর-উল-ওমরাহ জুলফিকার খাঁয়ের মত শক্তিধর, বুদ্ধিমান এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে অবহেলা করার দুঃসাহস দেখালো। আর সঙ্গে সঙ্গে পাশায় চাল পাশাতে শুরু করল। আমীর-উল-ওমরাহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের ডেকে নিয়ে বোঝাল আজীম-উস-সান বাদশাহ হলে কপালে অশেষ দুর্গতি আছে। সুতরাং তাকে পরিত্যাগ করা উচিত। সবাই আজিমের ব্যবহারে তিক্ত-বিরক্ত। তারা বাকি তিন ভাই মৈজদ্দিন, জাহানশাহ আর রফিয়াস্ সান্ এর সঙ্গে যোগাযোগ করল। তারাও আগ্রহে হাত বাড়িয়ে দিল।

এই সময় বাদশাহের সমস্ত সৈন্য লাহোরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছিল। আর শিবির স্থাপন করা হয়েছিল রাবি নদীর এক দিকে। আজিম-উস-সানের শিবির ছিল নদীর অপর পারে । সুতরাং বাদশাহের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাদশাহের শিবির দখল করে নিতে তার অসুবিধা হয়নি। বাকি তিন ভাই এর শিবির ছিল শহরের ওই দিকে।

কিন্তু আত্মসন্তুষ্টি আজিমকে পথে বসালো। সে সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ভাইদের আক্রমণ করলে তার জয় ছিল অবধারিত। অথচ সে ভাবল অন্য কথা। ভাবল সৈন্যরা আমীর- ওমারহ সবাই জানে বাদশাহের যাবতীয় সম্পত্তি তার দখলে। সুতরাং কেউ তাকে ছেড়ে যাবে না। সে নিশ্চিন্ত হয়ে পরিখা দখল করতে হুকুম দিল। আক্রমণ সে

থেকে। ওরা আক্রমণ করুক।

সে যখন ভবিষ্যতের সুখস্বপ্নে বিভোর সেই সময় আমীর-উঃ নিজে পরামর্শে অন্যান্য ভাইরা লাহোরের কেল্লা থেকে গোলন্দাজদের বের করে এনে আজিম-উস-সানের সৈন্যের ওপর কামান দাগতে শুরু করল। এইভাবে চারদিন কেটে গেল। আজিমের সঙ্গে ছিল তার অপর পুত্র করিমউদ্দিন। সে

তার শিবিরেই বসে রইল। সামনে এগিয়ে গেল না। সৈন্যরা একটু ভীত হয়ে পড়ল। কার হুকুমে চলবে তারা? কেউ নেই। সেই সময় তারা দেখল বড় বড় সৈন্যাধক্ষরা সবাই একে একে গিয়ে অপর পক্ষে যোগ দিচ্ছে। তারাও পালাতে শুরু করল।

শত্রুপক্ষরা এগিয়ে আসতে লাগল ধীরে ধীরে। আজিমের স্বপ্ন ভাঙল বড় দেরিতে। সে দেখল হিরে-জহরৎ আর ধনসম্পত্তির লোভে কেউ তার সঙ্গে থাকল না। তারা চলে গিয়েছে অন্য ভাইদের পক্ষে। এমন কি সিপাহীরাও পালিয়েছে।

আজিম কাপুরুষ নয়। সে বুঝল এতটুকুও আশা আর অবশিষ্ট নেই। তবু মরণপণ যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল সে। করিমউদ্দিনকে ডেকে বলে—আমি ওদের আক্রমণ করতে যাচ্ছি। তুমি কী করবে?

—এখন আক্রমণ করে কোনো লাভ আছে?

—শেষটুকু না দেখা পর্যন্ত লাভ-লোকসানের হিসাব করা যায় না। তুমি কী করবে? -আপনি যুদ্ধে যাচ্ছেন যখন আমি বসে থাকব না। আমিও যাব।

সৈন্যদের বাকি যারা সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছিল, যারা যুগের সঙ্গে তাল মানিয়ে চলতে শেখে না। পুরোনো মালিকের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে যেতে চায়, তাদের দুইভাগে ভাগ করে পিতাপুত্র শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আজিম-উস-সান চেপেছিল একটা হাতিতে আর করিমউদ্দিন বেছে নিয়েছিল অশ্ব।

তাদের আক্রমণে মৈজদ্দিন প্রথমে হতচকিত হয়ে গেল। সত্যিই সেই আক্রমণ অত্যন্ত জোরাল। বিপরীত কিছু ঘটে যাবার মতো উপক্রম হলো। কিন্তু ভাগ্যের পাল্লা তাদের দিকে হেলে পড়ল। একটা কামানের গোলা সোজা গিয়ে আঘাত করল আজিম- উস-সানের হাতিকে। হাতিটি তখন ছিল ঠিক রাবি নদীর পাড়ে একবারে কূল ঘেঁষে। গোলার ধাক্কায় বিধ্বস্ত হাতিটি নদীর জলে গিয়ে পড়ল। আর আজিম? সে কি জলে পড়ল? তার মৃতদেহ তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। একটি দেহ পাওয়া গেল বটে কাছে- পিঠে। দেহটির মুখ বিকৃত, দেহে শত আঘাত চিহ্ন। আজিমের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু এই কি আজিম? এই পোশাকে? এমন কিছু রাজকীয় পোশাক নয়। তিন ভাই বুঝতে পারে না। অনেক নিহত সৈন্যের মতো আজিমের দেহও কি তবে রাবি নদীর জলে হারিয়ে গেল? আসল সিদ্ধান্তে কেউ আসতে পারল না। তবে এটুকু বোঝা গেল আজিম-উস-সান মৃত। যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যাবার মতো কাপুরুষ সে

নয়।

করিমউদ্দিন যুদ্ধক্ষেত্রে ধরা পড়ল। তাকে কিছুদিন কয়েদ করে রাখা হলো। তারপর মৈজদ্দিনের নির্দেশে হত্যা করা হলো। মৈজদ্দিন হিন্দুস্থানের বাদশাহ হয়ে উপাধি নিল জাহাঙ্গীর শাহ। তৈমূরবংশের চিরপ্রচলিত একটি নিয়ম রয়েছে

মধ্যে শত্রুর

শেষ রাখতে নেই। বিশেষ করে তারা জানে ধমনীতে যদি একই রক্ত

হয়, পেছনে

তারা আরও বিপজ্জনক। তাই করিমউদ্দিনের পর মৃত্যু নেমে এলো দুই ভাই জাহান শাহ্ আর রফিয়াস্সানের ওপর। এরপর ঠিক আট মধ্যে আরও একত্রিশ-বত্রিশ জন তৈমূর বংশীয়কে কোতল করে জাহাঙ্গার শাহ ভাবলেন এবারে নিশ্চিত।

কিন্তু বাদশাহ কি ভুলে গিয়েছিলেন সুদূর বাংলায় রয়েছে আর একজন তৈমূর

শোণিত-ধারা-তরুণ যে তাঁর প্রধান শত্রু আজিম-উস-সানের পুত্র, যে এখনো পিতার মৃত্যুর পরও নায়েব নাজিমের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে? ভোলেননি নিশ্চয়। হয়তো উপায় নির্ধারণের জন্য সময় নিচ্ছিলেন।

লালবাগের প্রাসাদের নিভৃত কক্ষে সাহেবউন্নিসার চাপা ক্রন্দন কারও কর্ণগোচর হলো না । এমন কি ফারুকশিয়ারের বেগম কিংবা তাদের শিশুকন্যা মিলেখি নেমাজও শুনতে পেল না। তবে লাহোরের ঘটনা শুনে সারা প্রাসাদে শোকের ছায়া নেমে এলো। খবরটা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ শহরবাসীরাও বিপদাক্রান্ত হলো। তারা অনেক অত্যাচারী সুবাদার দেখেছে, সেই তুলনায় আজিম উস্-সান অনেক ভালো ছিল। জাহাঙ্গীর নগরে তো স্বাভাবিক জীবনযাত্রা প্রবলভাবে নাড়া খেল। ওখানেই আজিমের বাস ছিল।

খবরটা শুনে মুর্শিদকুলী খাঁর প্রতিক্রিয়া হলো অন্য রকমের। সে বাদশাহের কাছ থেকে ফরমানের অপেক্ষা করতে থাকে। মুঘলদের রীতি রয়েছে কেউ তত্ তাউসে বসে নিজেকে শাহানশাহ হিসাবে ঘোষণা করার পর সব প্রদেশে খবর পাঠায় যে এখন থেকে সে বাদশাহ। সুতারং সমস্ত সুবাদার ও দেওয়ান সেই অনুযায়ী কর্তব্য করবে।

ইতিমধ্যে মুর্শিদকুলী খাঁ একটু দ্বিধান্বিত হয়ে ফারুকশিয়ারের সঙ্গে তার আচার-আচরণ কীরকম হবে সেকথা ভেবে। ফরমান আসলে কোনো কথা নেই। কিন্তু আসার আগে সে কী করবে?

শেষে এক অপরাহ্ণে সে তার দেহরক্ষীকে সঙ্গে নিয়ে লালবাগ প্রাসাদে যায়। ফারুকশিয়ার তাকে দেখে একটু বিস্মিত হয় ।

—আপনি? আপনার লোকটিকে ফেরত চান ?

—না শাহজাদা, আমি দুঃখ জানাতে এসেছি। আমাদের সুবাদারের মৃত্যু হয়েছে, আপনি তাঁর পুত্র! আপনার বেদনায় আমি ব্যথিত। তাছাড়া আপনি এখনো আমাদের নায়েব নাজিম। আপনার প্রতি কর্তব্য আমার শেষ হয়ে যায়নি।

—ফরমান এলে ?

——তখন অন্য প্রশ্ন ।

—যা হোক, আমার দুঃখের দিনে আপনি এসে সমবেদনা জানিয়েছেন, একথা মনে থাকবে। মুর্শিদকুলী খাঁ ধীরে ধীরে লালবাগ প্রাসাদ থেকে বের হয়ে আসে। নিজেকে হালকা বলে মনে হয় তার। একটা বড় কর্তব্য পালন করা হলো। কর্তব্য করেছে সে আইনমাফিক এতটুকু এদিকে-ওদিকে হয়নি।

সে এখন। মেরে ফেলেছে আর ফারুকশিয়ার মুর্শিদকুলী খাঁর গমন পথের দিকে তাকিয়ে ভাবে, ফরমান এলে লোকটি তাকে আর চিনতে পারবে না। এর ধরনই সেই রকম। কিন্তু আজ খবর এসেছে একমাত্র সে ছাড়া তার নিকট-আত্মীয়দের মৈজদ্দিন। তাকেও রেহাই দেবে না। সে মৃত্যুকে বরণ করতে প্রস্তুত। কিন্তু তার শিশুকন্যা, বয়স এখন যার সবে ছয় বছর। আধো-আধো মিষ্টি কথা বলে। ওকে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে সে চলে যেতে দিতে পারে না। তার বেগম আর মা-ই বা কী দোষ করেছে? ওরা বাঁচুক। তার প্রাণের বিনিময়েও যদি বাঁচতে হয় বাঁচাবে সে। কিন্তু সেইভাবে তো বাঁচানো

যাবে না। তাকেও ওদের সঙ্গে যেতে হবে। কিন্তু কোথায় ?

হ্যাঁ, সমুদ্রপথে পালাবে সে। হিন্দুস্থানের আর কোথাও তার স্থান হবে না এই মুহূর্তে মসনদ যার, সব কিছুই তার। দেশের কারও বিবেক-বুদ্ধি আছে কি? বাদশাহের দিকে সবাই ঢলে পড়ে কেন? টাকার লোভে, পদের লোভে আমীর ওমরাহরা বাদশাহকে সমর্থন করতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষ সেদিকে যায় কেন? মনে হয়, কোনো কিছুতে তাদের আসে যায় না। কে গেল আর কে এলো, তাদের বয়ে গেল। এতে তাদের কোনো লাভ- লোকসান নেই। কেউ আশ্রয় নিলে তারা ধরিয়ে দিয়ে মজা দেখে। এতে সাময়িক উত্তেজনা উপভোগ করা যায়।

সমুদ্রপথেই চলে যাবে সে। তবু সব কিছু ঠিক করার আগে মা সাহেবউন্নিসাকে একবার জিজ্ঞাসা করতে হবে। সে লক্ষ করেছে, তিনি যে স্বামীর মৃত্যুতে কেঁদেছেন একথা কাউকে জানতে দিতে চান না। তাঁর চোখে অশ্রুর পরিবর্তে লক্ষ করেছে সে আলোর ঝকানি। প্রথম দেখে চমকে উঠেছিল। এখন একটু অভ্যস্ত হয়েছে দেখতে দেখতে। মায়ের নিজের কোনো চিন্তা থাকতে পারে। পিতা আজিম-উস-সানও মায়ের পরামর্শ নিতেন। হয়তো মা তাঁর কাছে থাকলে হিন্দুস্থানের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত।

মা তাঁর কক্ষের এককোণে বড় বাতায়নের সামনে ভূমিতে স্তব্ধ হয়ে বলেছিলেন। উন্মুক্ত বাতায়ন। সামনে রক্তবর্ণ সূর্য ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছে। সেই আলোয় মায়ের মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে।

ফারুকশিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে ডাকে— মা!

-বলো।

–হিন্দুস্থানে আমাদের স্থান নেই।

—কী বলতে চাইছ?

–বলছি আমার কোনো ছেলে নেই আপাতত। মসনদের দাবিদার হবার মতো কাউকে দেখি না আমার বংশে।

-কেন মসনদের দাবিদার তুমি হতে পারো না? কতই বা বয়স তোমার? অল্প বয়সে সাদি হয়েছে বলে মেয়ে হয়েছে। পরে ছেলেও হতে পারে। বাদশাহজাদাদের সবার এমন হয়। —জানি। কিন্তু তেমন আশা দেখছি না।

-কেন ?

—আমার তাই মনে হচ্ছে। আমি বলছি কি সাগর পাড়ি দিযে কোথাও কিছুদিন আশ্রয় নিলে সবাই বাঁচবে। ভাবার অবসর পাওয়া যাবে। ছেলে হলে উপযুক্তভাবে মানুষ করা যাবে।

সাহেবউন্নিসা উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ান। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে পুত্রের দিকে চেয়ে বলেন--- সাগর পারি দিতে চাও? হ্যাঁ দেবে। এই সাগরও লবণাক্ত কিন্তু রক্তবর্ণ। যে দেখছ সূর্য ডুবছে, ওই রকম। যুদ্ধ করে রক্তের সমুদ্র তোমাকে পার হতে হবে ফারুকশিয়ার । সেইজন্যেই তোমাকে আমি গর্ভে ধারণ করেছিলাম। একবার ভাবো, তোমার পিতার মুখখানা। একবার ভাই করিম-এর কথা মনে কর তো? কি? পালাবে ?

ফারুকশিয়ারের ধমনীর রক্তও উদ্দাম ছোটাছুটি সুরু করে। সে বলে—না। প্রতিশোধ নেব। —হ্যাঁ। ব্যবস্থা করো।


Post a Comment

0 Comments