শ্রীপারাবত এর অমূল্য সংগ্রহ-01/মুর্শিদকুলী খাঁ -02 (A historical novel in Bengali by SREEPARABAT)-series -02
সামনেই বেগমসাহেবা ! —একী। কী হয়েছে তোর ?
—কিছু না ।
——বললেই শুনব? তুই অসুস্থ। চল্ তোকে শুইয়ে দিয়ে হাকিম ডাকছি।
বেগমসাহেবা তার গায়ে হাত দিতেই সে হাত সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে ওঠে— হাকিম, হাকিম। হাকিম আমায় কী করবে? কেউ কিছু করতে পারবে না।
—কী হয়েছে?
জিন্নৎ-এর এইটাই সবচেয়ে যন্ত্রণা যে এতবড় অন্যায় দেখেও সে কিছু বলতে পারবে না। হাসানবিবির মৃত্যু হোক তাতে কিছু নয়। কিন্তু তার নিজের পুত্র? তার যে বদনাম হবে । একে তো স্বামীর স্বভাব সবাই জানে, তার ওপর ছেলেটা সম্বন্ধে জানাজানি হয়ে গেলে কোনো গর্বে সে বেঁচে থাকবে? না না, হাসানবিবি বেঁচে গেল। তবে মুখসুদাবাদে সে যাবে না। তাকে এখানে ছেড়ে যাওয়া যাতে হয়, সেই ব্যবস্থা সে করবে।
মুখসুদাবাদে দ্রুত যাওয়ার জন্যে পরদিনই কারতলব খাঁ দেওয়ান-ই-আমে গিয়ে কানুনগো, আমিন, শিকদার প্রভৃতি রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের স্পষ্ট বলে সাতদিনের মধ্যে তাদের সবাইকে নিয়ে সে রওনা হবে মুখসুদাবাদে। মুখসুদাবাদ হবে তাদের কর্মস্থান। কানুনগো দর্পনারায়ণ তার সহকারী কানুনগো জয়নারায়ণের মুখের দিকে চাইল। জয়নারায়ণ দর্পনারায়ণের চাহনিতে বিদ্রূপ ফুটে উঠতে দেখে তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সবার মতো সেও জেনে ফেলেছে বাদশাহ আলমগীরের চিঠির মর্মার্থ । কারতলব খাঁ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সেটা আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং তার আদেশ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে চলা উচিত। সাধারণ দেওয়ালের একটা কান থাকে, আর রাজপ্রাসাদের দেওয়ালের থাকে সহস্র কান। কারতলব খাঁ কীভাবে ছুটে গিয়েছিল বাদশাজাদার কাছে, সেখানে কী ঘটনা ঘটেছিল এবং পরে ক্রুদ্ধ বাদশাহ কী লিখেছিলেন পৌত্রকে কারও অজানা নেই, প্রাসাদের দেওয়ালের কানের মারফত। জয়নারায়ণ জানে . দর্পনারায়ণের মতো হিসাবে দক্ষ মানুষ শুধু বাংলা কেন, সারা হিন্দুস্থানেও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই গুণের জন্যে বড় বেশি গর্ব যেন মানুষটার। নিজেকে সবজান্তা ভেবে বসে আছে। কোনদিন বেশি জানার মত্ততায় নিজের বিপদ ডেকে না আনে । না বলে দলবল ওদিকে সুবাদার আজিমউদ্দিনের কাছে এসে পৌঁছলো বাদশাহের দ্বিতীয় পত্র—আরও কড়া এবং বলতে গেলে সম্মানহানিকর। বাদশাহ লিখেছেন আজিমউদ্দিন যেন তার দ্বিতীয় পুত্র ফারুকশিয়ারকে বাংলায় তার প্রতিনিধি হিসাবে সারবলন্দ খাঁয়ের কাছে রেখে দেরি না করে বিহারে গিয়ে তার রাজধানী স্থাপন করে। ফলে কারতলব খাঁ তাকে নিয়ে মুখসুদাবাদের দিকে রওনা হবার অল্পদিন পরেই তিনিও তার প্রথম পুত্র করিমউদ্দিন আর অন্যান্য বেগম এবং কর্মচারীদের নিয়ে মুঙ্গেরের দিকে করেন। কিন্তু মুঙ্গের জায়গাটা তার মনঃপুত না হওয়ায় পাটনা শহরকে তার রাজধানী হিসাবে নির্বাচিত করেন। এর পাশেও রয়েছে গঙ্গা। বাদশাহের অনুমতি নিয়ে তিনি নগরীর উন্নতিসাধন করেন এবং নিজের নামে নাম দেন আজিমাবাদ।
মুখসুদাবাদের প্রথম প্রভাত ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। পূর্ব আকাশ ঊষা লগ্নে রক্তিম হয়ে না উঠে, গাঢ় সাদা ঘোমটায় অবগুণ্ঠিত হয়ে রইল। কিন্তু সময় থেমে থাকল না তার জন্যে। দূরের মসজিদ থেকে আজানের উদাত্ত আহ্বান ভেসে এলো। কারতলব খাঁ প্রতিদিনের মতো প্রত্যূষে গাত্রোত্থান করে নমাজের জন্য প্রস্তুত হলো। প্রথম দিন হলেও সে নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু ঘটতে দেবে না ঠিক করেছে। নমাজের পর কোরান নকল করতে বসবে। ঢাকা থেকে আসার পথে সে নিশ্চিন্ত মনে অনেক কিছু ভাববার সময় পেয়েছে। তখনই ঠিক করেছে শুধু একা সে নয়, আরও অনেক অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিকে দিয়ে সে প্রতিদিন কোরান নকল করার ব্যবস্থা করবে। আর সেই সব পুঁথি পাঠাবে মক্কা মদিনা ইত্যাদি তীর্থস্থানে। তাছাড়া প্রতিদিন কোরান পাঠের ব্যবস্থাও করতে হবে। আজই কাজ শুরু করতে হবে। ধর্মকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে না রাখলে কর্ম করবে কী করে? ধর্মের বনিয়াদ শক্ত হলেই না কর্ম। বড় বড় ধার্মিক ব্যক্তিদের মাঝে মাঝে আমন্ত্রণ জানিয়ে সেবকের মতো তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে ভালোমন্দ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করবে সে।
আসলে নতুন জায়গায় স্বাধীনভাবে চলবার সুযোগ পেয়ে কারতলব খাঁয়ের মতো হিসেবি মানুষও স্বপ্ন দেখছে। তবে এ-স্বপ্ন অন্যের স্বপ্নের মতো ফানুস হয়ে আকাশে বিলীন হবে না কখনো। কারতলব খাঁয়ের স্বপ্ন অধিকাংশ সময়েই বাস্তব রূপ নেয়।
মীর্জা আসাদউল্লার ঘুম কখনো ভোরবেলা ভাঙে না। আজ ভাঙলো। হাসানবিবির ঘটনার পর থেকে তার কেমন একলা লাগে। সব বাঁদী এখানে এলো অথচ হাসানবিবি এলো না। এখানে আসার দুদিন আগে থেকেই তাকে আর দেখতে পাওয়া গেল না। না যাক্ আরও একজন আছে, খুব সুন্দরী। হাসানবিবির চেয়েও। কিন্তু তার চোখ বড় শান্ত। চোখ কথা বলে না, ভূ কথা বলে না। কেমন যেন। আর একজনকেও সে দেখেছে। নামটা জানে না। তাকে মা সব সময় সঙ্গে সঙ্গে রাখে। আসাদের দিকে আসতে দেয় না । সে বেশ ডাগর ডাগর চোখে তাকায়। সেই চোখে ভাষা আছে। আসাদকে দেখলে ঠোঁটে আলতো হাসি ফুটে ওঠে। একদিন মা ছিল না ধারে-কাছে। সেদিন আলতো হাসি আরও একটু ছড়িয়ে পড়ল মুখে। আর সঙ্গে সঙ্গে গালে টোল খেল। ওকে হাসানবিবির মতো পেলে বেশ হতো। কিন্তু মা কি দেবে?
ঘুম ভাঙতেই মনে হলো, এ তো জাহাঙ্গীর নগর নয়, এ হলো মুখসুদাবাদ। সে তাড়াতাড়ি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু কিছু দেখতে পেল না। ঘন কুয়াশা ধোঁয়ার মতো রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে। ঘর থেকে বের হয় সে। সব নতুন নতুন লাগছে। এই নগরীর একটা অন্য ধরনের গন্ধ আছে বলে মনে হলো। নাকি এই প্রাসাদের? বাইরে ঘোড়া প্রস্তুত থাকবে তো? বেড়িয়ে আসবে। কিন্তু ঘোড়া নেই। আসলে কোনো কিছুরই গোছগাছ হয়নি। সে পার হয়ে প্রধান ফটকের দিকে। একজন এসে সেলাম যায় প্রাঙ্গণ বলে, সে সঙ্গে যাবে। কিন্তু
আসাদ তাকে নিতে অস্বীকার করে। এই নতুন জায়গায় সে নিজের মতো চলবে। সে বড় হয়েছে যথেষ্ট। তার বাবা যদি তার মাকে তোয়াক্কা না করে যেমন খুশি চলে, সে পারবে না কেন? তবে তার বাবার জন্যে মায়ের মনে কষ্ট আছে সে বোঝে। বাবা সম্বন্ধে দুর্নাম আছে। খুব ছেলেবেলা থেকেই সে জানে সেকথা। তবু বাবার জন্যে একটা গর্ববোধ হয় তার। সবাই বাবাকে সমীহ করে। এমনকি দাদু অবধি —যে দাদুকে সবাই ভয় পায়। বাবা কিন্তু পায় না। বোন নাফিসা কিন্তু অন্যরকম। সে বাবাকে বরং ঘৃণাই করে। বলে, বাবা হলে কী হবে, আসলে অমানুষ। মাকে অবহেলা করে।
নাফিসার কথা মিথ্যা নয়। কিন্তু অমন চেহারা একটা খুঁজে বের করুক তো। আর কি স্বাধীন। এই তো কাল দুপুরে এসে পৌঁছোনোর পরে সবাই ঘর দেখতে ব্যস্ত—সবাই যখন হারেমের বন্দোবস্ত দেখতে লাগল তখন বাবা কোথায় বেরিয়ে গেল। মা আর দাদির মধ্যে চোখে চোখে কথা হলো। নাফিসা গম্ভীর হলো আর দাদু নমাজের সময় হয়েছে বলে চলে গেল। নাফিসার গাল টিপলে দুধ বেরোয় এদিকে বড়দের মতো কথা বলে। তারপর বাবার আর দেখাই নেই। রাতেও ফিরল না। অদ্ভুত ব্যাপার।
কুয়াশার মধ্যে পথ চলতে ভালোই লাগল আসাদউল্লার। কেউ তাকে চেনে না। কদিন পরে পরিচিত হয়ে গেলে এভাবে আর চলতে পারবে না। সবাই সমীহ করে পথ ছেড়ে দেবে। কথায় কথায় কুর্নিশের ঠেলায় অস্থির হবে। তখন পায়ে হাঁটার কথা ভাবাই যাবে না। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে বুক ভরে কুয়াশা টেনে নিতে সুন্দর লাগছে। একটা ভিজে ভিজে ভাব। সে দেখে সামনে যেন কুয়াশার শেষ নেই। বোঝা গেল নদীর কাছে এসেছে। দাঁড়িয়ে পড়ে সে। তারপর একটু এগিয়ে ভিজে ঘাসের ওপর বসে পড়ে। এভাবে জীবনে সে কখনো একা একা আসেনি। প্রাসাদের বাগান ছাড়া রাস্তায় ঘাসের ওপর কখনো বসেনি।
কিছুক্ষণ পরে কুয়াশা একটু ফিকে হয়। সূর্যের ক্ষীণ রশ্মিও দেখা যায়। আর দেখা যায় প্রায় দিগন্তবিস্তৃত গঙ্গা নদী। নদীর মধ্যে আবছা নৌকো আর বজরাও দেখা যায় দু-চারটে। কূলে অনেক জলযানের ভিড়। বেশ নতুন নতুন লাগে আসাদের কাছে। ঢাকায় নদীর এই রূপ নেই। সেখানেও অনেক নৌকো, বিশেষ করে গহনা নৌকোর গুরুত্ব সেখানে খুব বেশি। কিন্তু এত চওড়া নয় সেই নদী। সূর্য আর একটু উঠলে কুয়াশা দ্রুত মিলিয়ে যেতে থাকে। সব পরিষ্কার হয়ে যায়। এখন আর এভাবে বসে থাকা উচিত হবে না। উঠে দাঁড়ায় সে। সে সময় দেখতে পায় একটা সুসজ্জিত বজরা, সামনের দিকটা যার ময়ূরের মতো, তীরে এসে ভেড়ে। আর সেই বজরা থেকে নামে ঘাগরা পরা এক সুন্দরী। আরে এ কি! সুন্দরীর হাত ধরে হাসতে হাসতে নামছে তার পিতা সুজাউদ্দিন মহম্মদ খাঁ। মীর্জা আসাদউল্লা পেছন ফিরে দ্রুত স্থান ত্যাগ করার চোখি হয়ে যায়। সুজাউদ্দিন এক মুহূর্তের জন্যে অবাক হয়।। ভরে ওঠে। সে নর্তকীকে পেছনে ফেলে দ্রুত বলে—আরে তুমি? এত সকালে ওঠো নাকি
—আজই উঠলাম। নতুন জায়গা কিনা। সঙ্গে চোখা- তার মুখ হাসিতে এসে তার পিঠে থাবড়া মেরে —ভালোই করেছ। কী সাংঘাতিক কুয়াশা ছিল। আমার বজরা ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গিয়েছে।
আসাদ জিজ্ঞাসা করতে পারে না, মহিলাটা কে। তার বাবারও সে ব্যাপারে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে পেছন ফিরে দেখে মহিলা আবার বজরায় চলে গেল। কিন্তু তার পিতা পেছনে একবারও তাকালো না। বাবার কাছে, পৃথিবীর কোনো কিছুরই যেন গুরুত্ব নেই। তার যেন অতীতও নেই ভবিষ্যৎও নেই, শুধু বর্তমান নিয়ে তার আগ্রহ।
—এভাবে একা একা বেরিয়েছ, কেউ মানা করেনি ?
—না। কেউ জানে না। হ্যাঁ, একজন দেখেছিল। আমি শুনিনি।
—বাঃ। তবে সঙ্গে অস্ত্র না নিয়ে এভাবে এসো না একা একা। দেখো, আমার সঙ্গে অস্ত্র আছে।
আসাদ আর জিজ্ঞাসা করতে পারে না, মহিলাটি সত্যিই নর্তকী কি না। তার জানতে ইচ্ছা হয়, সে তার বাবার পূর্ব পরিচিতা কি না ।
একটু পরে সুজা প্রশ্ন করে—কালকে কেউ আমার খোঁজ করেছিল নাকি?
—জানি না ।
—দেখলাম নতুন জায়গা। কেউ চিনবে না। হেঁটে আসব একটু। তারপরে নদীর ধারে এসে দেখি বজরা বাঁধা। নাচগান চলছে বজরায় ।
নাচ গান? কারা শুনছিল?
—না, নাচগান হচ্ছিল না ঠিক। আয়োজন ছিল। শুনলাম পয়সা দিলে শোনা যায়। উঠে পড়লাম। তবে বাজনদারদের নামিয়ে দিলাম। আমার বাজনা ভালো লাগে না। নাচ দেখব, শুধু নর্তকী থাকলেই হলো।
—ওরা নেমে গেল ?
—নামবে না কেন? পয়সা দিলে নেমে যায় ।
আসাদউল্লার চোখের সামনে হাসানবিবির মুখ ভেসে উঠল। নাচেরও দরকার নেই, গানেরও দরকার নেই ।
তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে হঠাৎ—হ্যাঁ, নাচগানের আবার দরকার কী?
সুজা হঠাৎ পুত্রে কাঁধে হাত রেখে মাথাটা পুত্রের মুখের কাছাকাছি এনে বলে—কি
বললে ?
আসাদের মুখ লাল হয়ে ওঠে। সে বলে—না কিছু না
সুজা হেসে ওঠে একটু জোরে। বলে—তুমি দেখছি বেশ বড় হয়ে উঠেছ আসাদ।
জানতাম না তো।
আসাদের মুখের হাসি ফুটি ফুটি করেও ফুটল না। বলে—আমি।হতে চাই।
—বেশ। খুব ভালো। একটা জিনিস লক্ষ করেছ । তাড়াতাড়ি বড়
আমাদের পাত্তা দিচ্ছে না। শুধু
পোশাকটা একটু দামি বলে, কেউ কেউ আড় চোখে তাকাচ্ছে।
—পোশাক নয়, আপনাকে দেখছে।
—আপনার চেহারাটা দারুণ। —তাই নাকি?
—আপনি জানেন না ?
আবার হেসে ওঠে সুজা বেশ জোরে। বলে—হ্যাঁ জানি বৈকি। তোমার চেহারাও খুব ভালো হবে। আরও একটু লম্বা হবে তুমি। ভালো চেহারার লাভ আছে, বুঝলে? খুব
লাভ ।
ওরা প্রাসাদের কাছে আসতে সুজা বলে, চলো আমরা একসঙ্গে ঢুকি। বেশ মজা হবে।
কিন্তু একসঙ্গে ঢুকলেও, নিজের মা, বোন আর দাদির অসংখ্য প্রশ্নবাণের সামনে পড়তে হলো আসাদকে সারাদিন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তারা জানতে চায় সুজাউদ্দিনের সঙ্গে কোথায় তার দেখা হলো। কিন্তু একবারও সত্যি কথা বলল না সে। সে বুঝে ফেলেছে পুরুষদের সব কথা মেয়েদের বলতে নেই। তাদের ভীষণ সন্দেহ বাতিক। তারা কেমন সাদামাটা, ঠান্ডা ঠান্ডা—জীবনে যেন কিছুই করার নেই তাদের দৈনন্দিন কাজ ছাড়া। তবে ব্যতিক্রম আছে বৈকি। হাসানবিবি যেমন, বজরার ওই সুন্দরী নর্তকী যেমন। তারা পুরুষদের বোঝে। অন্য মেয়েরা কেমন যেন। নিজের যেটুকু প্রয়োজন ঠিক তেমনি হতে দিতে চায় পুরুষদের। মা আর নাফিসার সঙ্গে থেকে থেকে এই ধারণাই হয়েছে আসাদউল্লার। পিতাকে সে মনে মনে পছন্দ করতে শুরু করল। তুর্কীস্থানের যে প্রান্ত থেকে পিতা এসেছে সেখানকার মানুষজন বোধ হয় এই রকমই—উদ্দাম উচ্ছল।
হিন্দুস্থানের বাদশাহ কে? কারতলব খাঁয়ের মনে এই প্রশ্ন দিনে কতবার উত্থিত হয় তার ইয়ত্তা নেই। প্রশ্নটির উত্তর খুব সহজ—বাদশাহ ঔরঙ্গজেব। বাদশাহ ঔরঙ্গজেবকে সে খুব কাছ থেকে অনেকবার দেখেছে। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার কিছু কিছু সুযোগ তার ভাগ্যে জুটেছে। বাদশাহ তাকে ডেকে তার পালক পিতার স্থানে প্রথমে দিয়েছিলেন। তারপর হায়দ্রাবাদের দেওয়ান করেছেন। শেষে এই বাংলায় পাঠিয়েছেন। সবই বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের কৃপায়। কিন্তু হিন্দুস্থানের বাদশাহ কে? এই প্রশ্নটা মনের মধ্যে উঠলেই তার চোখের সামনে ভাসে ঔরঙ্গজেব যে আসনে বসেন সে আসনটি। হয়তো ময়ূরসিংহাসনই . ভেসে উঠত। কিন্তু বাদশাহকে তার দিল্লীতে দেখার সৌভাগ্য কখনো হয়নি। তিনি বহুদিন থেকেই দক্ষিণ ভারতে বিজাপুর গোলকুণ্ডা আমেদনগরের নবাবদের মোকাবিলা করে চলেছেন, সেখানে শিবির স্থাপন করে।
হিন্দুস্থানের বাদশাহ কে? সঙ্গে সঙ্গে সেই মহামূল্যবান আসনটি সামনে।
সেই আসনে যে ব্যক্তি বসে রয়েছেন তাঁর কোনো নির্দিষ্ট রূপ নেই। তবে রয়েছেন একজন এবং নিঃসন্দেহে তিনি বাদশাহ—দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
ঙ্গজেবের প্রতিচ্ছবি সেটি না । অতি দীন, অতি বিশ্বস্ত এক ভৃত্য।
হ্যাঁ, কারতলব খাঁ জানে, সে শুধু দিল্লীর তত
সেই তপ্ত তাউসে যিনিই আসীন থাকা অাসে ওঠে
না কেন। কারণ তাতেই তার উচ্চাশার চরিতার্থতা। সে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করতে চায় না। সে বাদশাহের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা কল্পনাও করে না। সে অতি সামান্য মানুষ—তাকে অনেক ওপরে উঠতে হবে। অনেক ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে তাকে। অনেক অর্থও সঞ্চয় করতে হবে তার কন্যার বংশের মানুষদের জন্য। তাই বলে সেই অর্থ অনাচার পাপাচার থেকে কখনই সে নেবে না। সে শায়েস্তা খাঁ নয়, সে আজিমউদ্দিন নয়। সে মহম্মদ হাদি–সম্রাটের কৃপায় আজ যাকে সবাই বলে কারতলব খাঁ। সে ঈশ্বরের দীন সেবক হয়ে অনেক উঁচুতে উঠতে চায়। সুতরাং লোভ ক্রোধ ইন্দ্রিয়সুখ তার জন্য নয়। তবে হ্যাঁ, যে তার পথে সামান্য প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে, যে এতটুকু হুল ফোটানোর চেষ্টা করবে তাকে সে উন্মত্তের মতো মেরে না ফেলে ধীরে-সুস্থে পথ থেকে সরিয়ে দেবেই। কেউ তাকে রুখতে পারবে না। এইভাবেই সে নিজেকে গড়ে তুলেছে। পাগলের মতো প্রতিশোধ নিও না। যার ওপরে প্রতিশোধ নেবে সেও যাতে ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে। তবেই তো প্রতিশোধ নেবার সুখ। অসি দিয়ে মস্তক ছিন্ন করে কিংবা কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে উড়িয়ে দিলে শাস্তিই হলো না। শাস্তি এমন হবে, যাতে মৃত্যু আসে অপরিসীম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে অতি ধীরে।
মুখসুদাবাদের দেওয়ানখানা খুব কর্মব্যস্ত স্থান হয়ে উঠল কিছুদিনের মধ্যে। বাংলায় যা আগে কখনো হয়নি, তাই হলো। জমিদারীর সৃষ্টি হলো। আর সেই জমিদারীর অধিকাংশই পেল হিন্দুরা। কারতলব খাঁ একটা জিনিস পরিষ্কার বুঝেছিল। হিন্দুদের কাছ থেকে কর আদায় করা বেশ সহজ। তারা চুরি করে, ছলচাতুরি সবই করে। তবে চাপের মুখে শক্ত হয়ে থাকতে পারে না বেশিক্ষণ, অনেকদিনের মুসলমান রাজত্বে থেকে থেকে তাদের কলিজার জোর আর তত নেই। তবে তারা তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী। তাই কারতলব খাঁ আর একটি কাজ করল। এতদিন বড় বড় পদে বহাল ছিল ভিনদেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা। তারা কেউ এসেছে তুর্কীস্থান থেকে, কেউ পারস্য থেকে, কেউ বা আফগান। এদেশের ওপর তাদের এতটুকু মমতা নেই। এদেশে কখনো তারা থাকবে না। কিছুদিন কাজ করে যে কোনো উপায়ে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে তারা চলে যাবে। আর এই টাকার জন্যে তারা ছলচাতুরী, বিশ্বাসঘাতকতা সব কিছু করে–এ অভিজ্ঞতা কারতলব খাঁযের খুব ভালোই আছে। ধরা পড়ে গেলেও, তাদের দিয়ে অন্যায় স্বীকার করিয়ে নেওয়া দুরূহ ব্যাপার। তার চাইতে বুদ্ধিমান দিশি হিন্দুরা অনেক ভালো। কাজও তারা অনেক ভালো করবে। আর কোথাও কোনোরকম অসংগতি দেখলে একটু চাপ কিংবা হুমকি দিলে সব কবুল করে ফেলবে। সুতরাং একে একে বিদেশি কর্মচারীরা বাংলা ছাড়তে শুরু করল আর তাদের স্থানে নিযুক্ত হতে লাগল হিন্দুরা। জমিদারীর পত্তন শুরু হলো ।
বাদশাহের কাছে অর্থ নিয়ে যাবার দিন ঘনিয়ে এলো। হিসাব করে দেখা গেল মুখসুদাবাদে এসে নিজের তদারকিতে সব কিছু রাখায় এবার অর্থের পরিমাণ অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক বেশি। সঙ্গে সঙ্গে কারতলব খাঁ মনে মনে ফেলল। জাহাঙ্গীর নগর থেকে যতবার সে সিপাহীদের প্রহরায় কাছে রাজকোষের অর্থ প্রেরণ করেছে ততবার সে নিজে শেষ প্রান্তে এসে সবাইকে বিদায় দিয়েছে। বাদশাহের - আনুগত্যের এটাকেও একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে সে ভাবে। কিন্তু এবারে মুখসুদাবাদে এসে স্বাধীনভাবে কাজ করে এত বেশি অর্থ সে রাজকোষের জন্য সংগ্রহ করল, আর সে নিজে সঙ্গে যাবে না? নিজেকে সঙ্গে সঙ্গে নগরীর সেখানে উপস্থিত করতে পারলে বাদশাহ খুশি না হয়ে পারবেন না। সঙ্গে করে সে নিয়ে যাবে বাংলার মসলিন, শীতলপাটি যার প্রান্তদেশ স্বর্ণখচিত, নিয়ে যাবে হস্তী, অশ্ব, এদেশী মহিষ, নেকড়ের চামড়া। তাছাড়া বাদশাহকে উপঢৌকন দেবে সে শ্রীহট্টের গঙ্গাজলী দিয়ে তৈরি মশারি, হাতির দাঁতের জিনিস, বিদেশ থেকে ফিরিঙ্গিদের আনা নানান বিচিত্র দ্রব্যসামগ্রী। বাদশাহ খুশি না হয়ে কি পারবেন? এইসব দ্রব্যসম্ভার সারা বছরে একটু একটু করে সে সংগ্রহ করে রেখেছে। এখন একটা ভালো দিন স্থির করার অপেক্ষা। যেতে হবে সেই দক্ষিণ ভারতে। কিন্তু একটা অভাবিত বাধার সৃষ্টি হলো যাবার আগে। মুঘল রীতিতে আছে দেওয়ান যতই ক্ষমতা সম্পন্ন হোক না কেন, রাজস্ব হিসাব নিকাশ সংক্রান্ত কাগজের ওপর কানুনগোর দস্তখত চাই। সুবে বাংলার মুখ্য কানুনগো হলো অতি দক্ষ দর্পনারায়ণ আর তার সহকারী হলো জয়নারায়ণ। কারতলব খাঁ দর্পনারায়ণকে বেশ আনন্দের সঙ্গেই বলে— এবারে ভাবছি নিজেই যাব বাদশাহের কাছে বেশ ভালোই হবে দেওয়ান সাহেব।
—আমি হিসাবগুলো আর একবার পরীক্ষা করে দেখলাম, সব নির্ভুল। হবেই বা না কেন। আপনার মতো কানুনগো, আমার
—আপনি মহানুভব ।
কারতলব খাঁ একটু গম্ভীর হয়ে বলে—না। আমি যেটা বাস্তব সেটা স্বীকার করি। আপনি গুণী, আপনার কদর আমার কাছে তাই বেশি। যা হোক ভাবছি আসছে সপ্তাহে বুধবারে আমি রওনা হব। আপনি দস্তখতটা দিয়ে দিন আজ।
দর্পনারায়ণ সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে—আজ হবে না ।
ভ্রুকুঞ্চিত হয় দেওয়ানের। সে প্রশ্ন করে— কেন? আজ নয় কেন?
দর্প একটু ঢোক গিলে বলে—আজ বৃহস্পতিবার। আজকের দিনে টাকা-পয়সার ব্যাপারে আমি কিছু করি না।
কারতলবের সম্মানে আঘাত লাগে। তবু ভাবে, হয়তো ঠিক কথা বলছে কানুনগো । বৃহস্পতিবারে ওদের আবার লক্ষ্মীপুজো হয়। সংস্কার থাকলেও থাকতে পারে। —ঠিক আছে, কাল আসবেন আমার কাছে। সকালের দিকে আসবেন। আমি সব প্রস্তুত রাখব।
দর্পনারায়ণ বলে—দেখি ৷
কারতলব । চমকে ওঠে। দর্পের কথার ধরনে তাচ্ছিল্য আর অনাগ্রহ ফুটে ওঠে। সে আর কিছু বলে না।
সেই দিনই সন্ধ্যার দিকে মুখসুদাবাদে ধুলোর ঝড় ওঠে। বছরের এই সময়ে অল্প স্বল্প ঝড়ের সম্ভাবনা যে না থাকে তা নয়, তবে এমন অন্ধকার করে দেওয়া ধুলোর ঝড় কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। যাকে বলে আঁধি। পথ চলতে মানুষেরা আশ্রয়ের খোঁজে বাড়ি- ঘর দোকানপাটের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আর ঝড়ের মধ্যে সহকারী কানুনগো জয়নারায়ণের সদর দরজায় সজোরে করাঘাত হয়। ভৃত্য গোবিন্দের কাজই হলো দরজার সামনে ছোট্ট কুঠরীতে বসে থাকা এবং অতিথি অভ্যাগত কেউ এলে সেই কুঠরীতে বসিয়ে রেখে ভেতরে খবর দেওয়া তারপর আগন্তুককে বৈঠকখানায় নিয়ে যাওয়া।
ঝড়ের জন্যে এমনিতেই সদর দরজায় নানান রকমের শব্দ হচ্ছিল। আশপাশের জানালাতে শব্দ হচ্ছিল। তাছাড়া খড়কুটো পাতার সঙ্গে অনেক কিছুই উড়ছিল। তাই দরজায় করাঘাত গোবিন্দ প্রথমে শুনতেই পায়নি। পরে শব্দটা বারবার হওয়ায় উঠে গিয়ে দরজা খুলতে স্বয়ং প্রধান কানুনগোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অপরাধ বোধে তার মুখখানা শুকিয়ে যায়। —জয়নারায়ণ কোথায় ?
-ভেতরে আছেন এজ্ঞে। আপনি আসুন এজ্ঞে।
তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দর্পনারায়ণকে নিয়ে গিয়ে বৈঠকখানায় বসিয়ে ছুটে ভেতরে গিয়ে জয়নারায়ণকে খবর দেয়।
জয়নারায়ণ রীতি মতো চমকিত হয় গোবিন্দর কাছে খবরটা পেয়ে। সন্ধ্যার সময় তার আহ্নিকে বসার অভ্যাস। এই সময় আহ্নিকে না বসলে আর সকালে বেলের মোরব্বা না খেলে তার শরীর আর মন ম্যাজম্যাজ করে। তবু ব্যতিক্রম যে না হয় তেমন নয়। বেল যেমন বছরের সব সময় পাওয়া যায় না। তেমনি আজকের দিনের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা হঠাৎ এসে পড়েন। কিংবা তাকেও কতসময় আটকে থাকতে হয় চেহেল সেতুনে কাজের খাতিরে। মটকার কাপড় পরে, কাঠের খড়ম পায়ে প্রস্তুত হচ্ছিল জয়নারায়ণ ঠাকুর ঘরে প্রবেশ করার জন্য। গোবিন্দের কথা শুনে তাড়াতাড়ি মটকা খুলে ধুতি পরে, ফতুয়াটা গায়ে গলিয়ে চটি পায়ে দিয়ে বৈঠকখানায় ঢুকে চিৎকার করে ওঠে—ওরে গোবিন্দ, তামাক নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি। ওঃ এমন ঝড়—দর্পনারায়ণ বলে—তামাক টামাকের দরকার নেই । বোসো। খুব জরুরি কথা আছে।
—আপনি নিজে এলেন। ডেকে পাঠালে পারতেন।
–তোমার বাড়ি এলে আমার সম্মান যাবে না। তাছাড়া এটা আমাদের দুজনেরই স্বার্থের ব্যাপার।
এরপর দেওয়ান সাহেবের কথা বলে। বলে, এখনো দস্তখত্ দিইনি। সময় চেয়ে নিয়েছি।
জয়নারায়ণ ভীত হয়। কারতলব খাঁকে সে খুব ভালোভাবে চিনতে পেরেছে। মানুষটার মতো এমন দক্ষ ব্যক্তি বাদশাহ আলমগীরও বোধহয়, নন। নইলে তাঁর এক চিঠিতে সুবাদার আজিমউদ্দিন অবধি বাংলাদেশ ছেড়ে পাটনায় গিয়ে বসতেন না। তাছাড়া কারতলব খাঁয়ের মাথার মতো হৃদয়টাও শীতল। সেখানে আবেগ ভালোবাসা প্রভৃতির কোনো স্থান আছে বলে মনে হয় না। ওই হৃদয় কখনো কারও জন্যে উষ্ণ হয়েছে বলে মনে পড়ে না। তার অনুরোধকে এভাবে ঠেকিয়ে রেখে উচিত কাজ
সে দর্পনারাণকে বলে—আমার মনে হয় আপনি সই
কালকে দিয়ে দেবেন ।ভালো করতেন ।
—বলছ কি জয়নারায়ণ। সুবাদারের কথা।
গেলে? তিনি কিন্তু পাটনার উন্নতির
জন্যে কিছু টাকা চেয়েছিলেন। ভুলে যেও না তিনি সাক্ষাৎ বাদশাহের পৌত্র।
—একটু ঝুঁকি আছে ঠিকই। তবু মনে হয় দেওয়ান সাহেবকে বাদশাহ খুব পছন্দ করেন।
অমি দক্ষিণ ভারত থেকে আসা মুসলমান কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি একথা। —না। তোমার পরামর্শ গ্রহণ করা ঠিক হবে না। তাছাড়া দস্তখত্ আমি দিতে পারি, কিন্তু তার পরিবর্তে দু এক লাখ টাকা অন্তত দিক দেওয়ান সাহেব।
চমকে ওঠে জয়নারায়ণ। বলে—আপনি টাকা চাইবেন ?
—না চাওয়ার কী আছে? বাদশাহের কাছে গিয়ে সবটা গৌরব তো নিজেই গায়ে মাখবে। আমাদের ভাগ দেবে না। এদিকে কিছু দিক অন্তত। বুঝলে, আমার মনে হয় দিয়ে দেবে। ফাঁদে পড়েছে তো।
জয়নারায়ণ নিস্পৃহভাবে বলে—যা ভালো বোঝেন করুন। আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড়। কী আর বলব। তবে আমাকে এর মধ্যে জড়াবেন না ।
ধুলোর ঝড় কমে আসছে। বাইরে আর শোঁ-শোঁ আওয়াজ হচ্ছে না। দরজা জানালাতেও তেমন ঝাঁকি লাগছে না।
একটু হতাশ হয় দর্পনারায়ণ। ভেবেছিল তার সহকারীকে সঙ্গে পাবে। পেলো না । —উঠি তাহলে।
—আচ্ছা। একটা কথা বলব ?
—বলো।
—আপনার ছেলের কথা বলছি। শিবনারায়ণের কথা। বেশ ভালো কাজ শিখেছে। তাকে এসব থেকে দূরে রাখবেন।
—একথা বলছ কেন ?
—আমার মনে হলো। আমি আপনার হিতার্থী। অনেক শিখেছি আপনার কাছ থেকে তাই বলছি।
—বেশ। মনে থাকবে।
পরদিন দেওয়ানখানায় বসতে না বসতেই দেওয়ান সাহেবের ঘর থেকে ডাক আসে দর্পনারায়ণের। প্রস্তুত ছিল সে। সারারাত ভেবে ভেবে সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলেছে । টাকা ছাড়া সই করবে না ।
কারতলব খাঁ বলে—দস্তখতটা দিয়ে দিন ।
—হ্যাঁ দেব। কিন্তু একটা কথা আছে।
—দর্পনারায়ণ লক্ষ করলে দেখতে পেত দেওয়ানের মুখ কিরকম কঠিন হয়ে উঠল। কিন্তু তারপরই স্বাভাবিক কণ্ঠে দেওয়ান বলে—বলুন কী বলতে চান।
—সই করব। কিন্তু আমার দুই লাখ টাকা চাই।
কারতলব খাঁয়ের মাথা আরও ঠান্ডা হয়ে গেল। সে শান্তভাবে বলে—অত টাকা? একটু কম করুন।
—সেটা সম্ভব হচ্ছে না দেওয়ান সাহেব। কানুনগো
বেশি ?
—ঠিক আছে।
—টাকা দেবেন তাহলে?
—না আপনার সই-এর দরকার নেই। দেখি কী করি। 'চাহিদা কি খুব
—আমার দস্তখত্ না দেখলে বাদশাহ বিশ্বাস করবেন না—আপনি দুই কোটি টাকা নিয়ে গেলেও না। বাদশাহের খাস দেওয়ান আমার দস্তখত্ না দেখলে আপনার রাজস্বের ব্যাপারে এত হিসাবনিকাশ, জমিদারীর এত নিখুঁত বিবরণ সব এক পাশে সরিয়ে রাখবেন। এতে বাদশাহ আপনার ওপর বিরক্ত হবেন।
—ঠিক আছে, আপনি আসুন
দর্পনারায়ণ একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়। ব্যাপারখানা কী? মুঘল আইন মোতাবেক তার স্বাক্ষর অপরিহার্য। তবে? বাদশাহের ওপর কি এতটা প্রভাব ফেলেছে দেওয়ান কারতলব খাঁ। সে ধীরে ধীরে স্থানত্যাগ করে।
সেই রাতে জয়নারায়ণের ডাক পড়ে কারতলব খাঁয়ের খাস আবাসে। জয়নারায়ণ জানত দর্পনারায়ণের প্রস্তাব দেওয়ান প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু তাই বলে তাকে ডাকবে কেন ?
সে যেতে কারতলব খাঁ হিসাবের কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে—আপনার একটা দস্তখত দরকার।
না?
সে ভালোভাবে দেখে বলে—এ তো কানুনগো সই করবে।
কারতলব খাঁ হেসে বলে—কানুনগো হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার সহকারী করবে
জয়নারায়ণ একটু চুপ করে থেকে বলে—নিশ্চয় ৷
সিদ্ধান্ত মুহূর্তে নেয় সে। যদিও জানে, সুবাদার আজিমউদ্দিনের ক্রোধের শিকার হতে পারে সে। আজিমউদ্দিন এতদিন যথেচ্ছভাবে টাকা নিত। কারতলব খাঁ সেটা বন্ধ করেছে বলে তার গোঁসা। শেষ পর্যন্ত তাকে পাটনায় গিয়ে উঠতে হয়েছে। যে দেওয়ানের এতটা ক্ষমতা যার ফলে সুবাদারকে সরে যেতে হয়, সেই দেওয়ানের কথা মেনে চলাই আপাতত উচিত! বিপদের ঝুঁকি কম ।
সে দস্তখত করে।
কারতলব খাঁ বলে—ভালো করলেন। মনে থাকবে ।
নির্দিষ্ট দিনে কারতলব খাঁ দলবল নিয়ে দক্ষিণ ভারত অভিমুখে রওনা হলো। সঙ্গে সারা বছরের রাজস্ব আর উপঢৌকন। পথ বড় কম নয়। অনেক দেরি হবে ফিরতে। যাবার সময় ঢাকার সুবাদার আজিমউদ্দিনের প্রতিনিধি তার পুত্র ফারুককে জানিয়ে গেল।
এ পথ দিয়ে এবার নিয়ে কম যাতায়াত করতে হলো না কারতলব খাঁযের। তবু বারবার যাবার সময় মনে হয় নতুন যাচ্ছে। সেই ছেলেবেলায়, যখন তার পালক পিতা দেওয়ান সফী ইস্পাহানী তাকে গ্রাম্য ভগ্ন কুঁড়েঘরের সামনে থেকে হাত ধরে হাতির পিঠে উঠিয়ে নিয়ে পাশে বসিয়েছিল, তখনও পথের দুদিকে এমন সমতল শস্যক্ষেত্র ছিল। তখনো দূরে কোথাও পাহাড়ের রেখা দেখতে পায়নি। ছেড়ে যাবার আগেই ছোটখাটো পাহাড়ের দেখা মিল আর। পথও এমন নরম সাদা ধুলোয় আচ্ছন্ন থাকবে না। চলার পথে প্রকৃতি তার রূপ দফায় দফায় পালটাবে। সেদিন হাওদায় বসে একবার পেছনে ফিরে দেখেছিল সে।
অথচ সে জানে এই বাংলা জমি এমন সমতল থাকবে না
দেখেছিল অবগুণ্ঠিতা রমণী মলিন শাড়ি পরনে, হাতির দিকে চেয়ে কুঁড়েঘরের সামনে আছড়ে পড়ল। এই রমণী কিছুক্ষণ আগে তাকে জড়িয়ে ধরে কুঁড়েঘরের মধ্যে ভাঙা গলায় কাঁদছিল। আর দেখল তারই পাশে সেই অতি শীর্ণ গৌরবর্ণ পুরুষটি মহিলার পতন যেন দেখতেই পেল না। সে একদৃষ্টে চেয়ে রইল হাতির দিকে। তার গলার উপবীতটা দেহের তুলনায় অনেক মলিন দেখাচ্ছিল। তখন তারও গলার কাছে কী যেন ঠেলে উঠছিল। সে বুঝতে পারছিল না কিছু। তার পালক পিতা তাকে কিছু বলল, যার অর্থ সে বোঝেনি। যে ভাষায় পালক পিতা কথা বলেছিল, সেই ভাষা আগে কখনো শোনেনি। তবু সে সান্ত্বনা পেল, কারণ পালক পিতা এক হাত তার মাথায় রাখল। সে প্রথম যখন হাতিতে উঠেছিল, তখন ভেবেছিল বুঝি নতুন কোনো খেলা। কিন্তু সেই অবগুণ্ঠিতার অমন আছড়ে পড়া দেখে সে অনুভব করল, জীবনে কখনো এখানে ফিরে আসবে না। তখনই গলাটা বুজে এল, আর নতুন মানুষটি তার মাথায় হাত রাখল ।
কুঁড়েঘরের নারী ও পুরুষ যে তার বাবা মা সেকথা সে জানত। তাই বলে ডাকত। কিন্তু মা বাবা যে খুবই আপনজন এই বোধ তার ওই বয়সের মধ্যে কখনো হয়নি। অথচ হওয়া উচিত ছিল। কুঁড়ের পাশে আমগাছটার কথা এখনো মনে আছে। অন্য পাশে নিম গাছ, যেখানে সন্ধ্যাবেলায় জোনাকি জ্বলত অগুনতি। এমন আবছা আবছা কিছু স্মৃতি তার মনে হয়েছে অনেক আগে। তবে রাস্তার পাশে সেই হেলে-পড়া বটগাছটি এখনো তার মনশ্চক্ষে ভাসে মাঝে মাঝে। অমন বটগাছ আর কখনো তার নজরে পড়েনি। অমন অদ্ভুতভাবে শুয়ে থাকা বটগাছ।
সঙ্গে হাতি আছে আজও, একটা নয়—অনেকগুলো। বাদশাহকে উপহার দেওয়া হবে। ঘোড়া আছে, মহিষ আছে আরও কত কী। কারতলব খাঁ কখনো হাতির পিঠে বসছে, কখনো ঘোড়া ছোটাচ্ছে কখনো বা বলীবর্দর গাড়ি চাপছে। পথ চলতে হবে অনেকদিন। চলার মধ্যে বৈচিত্র্য না আনলে একঘেয়ে লাগে। কিন্তু যে গাড়িটিতে বিপুল অর্ঘ্য রয়েছে সেটিকে রেখেছে ঠিক তার সামনে। চোখের আড়াল যাতে না হয়।
মেদিনীপুর অতিক্রম করার সময় কারতলব খাঁ ভাবে, এই চাকলাকে কেন যে উড়িষ্যার মধ্যে রাখা হয়েছে বোঝা দায়। মুখসুদাবাদ আর জাহাঙ্গীর নগর থেকে এটির সবকিছু দেখাশোনা করা, কত সহজ। যদি কখনো সে বাংলার সুবাদার হয়, এটিকে বাংলার ভেতরে নিয়ে আসবে। আর সুবাদার যে সে হবে এই দৃঢ়বিশ্বাস তার আছে।
উড়িষ্যা পার হয়ে যায়। কতবার যে ছোট বড় নদী খেয়ার পার হতে হলো তার ইয়ত্তা নেই। এ এক বড় ঝঞ্ঝাট। এর ওপর আবার আছে পাহাড় পর্বতের চড়াই উতরাই। ওসব জায়গায় বলদের গাড়ি নিয়ে বড় অসুবিধায় পড়তে হয়। তবু সবাই চলছে এভাবে চিরকাল।
অবশেষে একদিন দেখা গেল দুই মুঘল ঘোড়সওয়ারকে।
অগ্রগামী চর।
তাদের কাছ থেকে বাদশাহ ঠিক কোনোদিকে রয়েছেন জনে নিয়েই সেইদিকে ফিরে আভূমি নত হয়ে অভিবাদন জানায় কারতলব খাঁ তারপর সবাইকে নির্দেশ দিয়ে আরও কাছাকাছি গিয়ে শিবির স্থাপন করে। বিশ্রাম নিয়ে ছিমছাম হয়ে নিতে হবে। বাদশাহের সামনে নিজেদের উপস্থাপিত করতে হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে।
বেগমসাহেবা আসতে চেয়েছিল সঙ্গে। সে আনেনি। ধকল সহ্য করতে পারত কি না সন্দেহ। অথচ বেগমসাহেবা সেই কথাই বলেছিল তার সম্বন্ধে। বলেছিল, এই বয়সে কারতলব ধকল সইতে পারবে না। বয়সটা কম হয়নি। অতদূরে একা না যাওয়াই ভালো । সুস্থ অবস্থায় দেওয়ান সাহেবের খাতির খুব। কিন্তু মরণাপন্ন অসুস্থ হয়ে পড়লে ভয়ে কিংবা টাকার লোভে প্রাণ দিয়ে কেউ সেবা করবে না।
বেগমসাহেবা বলেছিল—বাতিল হয়ে গেলেও তোমার সেবা করতে পারব।
—তার মানে? বাতিল কেন? আমাকে কি অন্য কারও প্রতি আসক্ত হতে দেখেছ? শুনেছ কখনো?
বেগমসাহেবা অপ্রস্তুতে পড়েছিল। মুখ ফসকে যে কথা বেরিয়ে পড়েছিল তাকে ঢাকা দিতে এত বেশি আজেবাজে বকতে শুরু করল যে কারতলব খাঁয়ের মজা লেগেছিল।
দুদিন পরে বাদশাহ ঔরঙ্গজেব তাকে ডাকলেন। বিপুল অর্থ আর উপহার সামগ্রী নিয়ে সে বাদশাহ সমীপে উপস্থিত হলো। তাকে দেখে বৃদ্ধ সম্রাটের মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল। যা খুবই দুর্লভ। যারা সেখানে ছিল সবার মনে ঈর্যার সুচ ফুটল। তারা জানে, কারতলব খাঁ বাদশাহের প্রিয় পাত্র। কিন্তু তাই বলে এতই প্রিয় যে তার দর্শনে বাদশাহের মুখ হাসি-হাসি হবে? কই তাঁর ছেলেরা কাছে এলে তো অমন হয় না। তাঁর পৌত্র-পৌত্রী দৌহিত্র-দৌহিত্রী অনেকেই তো তাঁর কাছে আসে, এমন নিশ্চিন্তের হাসি তো কখনো হাসতে দেখা যায় না। অথচ যাকে নিয়ে এত ফিফিসানি সে কিন্তু জানে তার ওপর বাদশাহের বিশেষ কোনো টান নেই। পৃথিবীর এবং পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া গুটিকয়েক মানুষের প্রতি বাদশাহের ইস্পাত কঠিন হৃদয় কিছুটা উষ্ণতা দেখিয়েছে। সে হলো বিরল দৃষ্টান্ত। কারতলব খাঁ খুবই সাধারণ একজন মানুষ। সুতরাং ওসব কিছু নয়। আসলে বাদশাহ তাকে পছন্দ করেন তার কাজের জন্য। প্রথমত, সুদূর বাংলায় কোনো অশান্তি নেই আপাতত। দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো টাকা—শুধু টাকা। বাদশাহের এখন অনেক অর্থের প্রয়োজন। এই দক্ষিণ ভারতে এসে নিজের জেদের বশে যেভাবে তিনি জড়িয়ে পড়েছেন আজ বৃদ্ধ না হলে হয়তো তিনি এর থেকে মুক্ত হতে পারতেন কোনো না কোনোভাবে। কিন্তু এই বয়সে এখানকার যুদ্ধ বিগ্রহ তাঁর শরীর আর মনের ওপর ভীষণভাবে চেপে বসেছে। কবে সেই প্রথম যৌবনে এখানে এসে সফলতা দেখিয়েছিলেন, এখন আর ব্যর্থতাকে সহ্য করতে পারেন না। এখানে থাকা মানেই জলের মতো অর্থের অপচয় এবং সেই অর্থ যে জোগাবে তাকে প্রিয়পাত্র না ভেবে উপায় আছে? বলতে গেলে বাংলাই এখন হিন্দুস্থানের শাহানশাহের অর্থভাণ্ডার।
বাদশাহ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে এসে কারতলব খাঁয়ের আনা বিবিধ সামগ্রী দেখলেন। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। কিন্তু অন্য কেউ লক্ষ করুক আর না করুক কারতলব খাঁ ঠিক দেখেছে, এতকিছুর মধ্যেও বাদশাহের দৃষ্টি সেই লৌহনির্মিত সিন্দুকের ওপর বারবার গিয়ে গাড়ির মধ্যকার বিশাল ওতে। ওটিতে রয়েছে মুঘল বাদশাতে আর দে তার আরও বেশ কিছুদিনের রসদ রয়েছে ভেতরে এসে আসন গ্রহণ করলেন বাদশাহ। নিয়মমাফিক কারতলব খাঁকে অভ্যর্থনা
মনে যাই থাক, উপস্থিত আমীর ওমরাহ এবং উচ্চপদস্থ যোদ্ধৃ বেশধারীরা সহর্ষে কলরব করে উঠল। বাদশাহ বৃদ্ধ হলে কী হবে। তিনি জানেন ওরা কেউই খুশি হয়নি। ওদের মধ্যে অনেকেই এই পদগুলোর আকাঙক্ষায় বহুদিন ধরে স্বপ্ন দেখে এসেছে। এতগুলো পদ একই ব্যক্তিকে সমর্পন করায় কেউ যদি বলে যে সে খুশি হয়েছে তাহলে অন্তরের হাহাকারের টুটি চেপে ধরেই তাকে বলতে হবে। কারতলব খাঁকে এড়িয়ে ভাঙা বুক নিয়ে বাদশাহের দিকে যখন তারা হাসি-হাসি মুখে তাকিয়েছিল, তখন বাদশাহ করাতলব খাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন— তোমার আসল নামটি যেন কী ?
অতি বিনয়ে কারতলব সামনে ঝুঁকে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে—আমার নাম মহম্মদ হাদি জাঁহাপনা।
—হুঁ। তারও আগে নিশ্চয় কোনো নাম ছিল। সেইরকমই শুনেছিলাম ।
পর্বতের শীর্ষদেশ থেকে যেন তাকে নীচে নিক্ষেপ করা হলো। কারতলব খাঁয়ের কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। যা সে নিজে ভুলতে না পারলেও সবাইকে ভুলিয়ে দিতে চায়, তাকে বাদশাহ এই পরম লগ্নে এভাবে খুঁচিয়ে দিলেন? কেন? তিনি কি মনে করিয়ে দিতে চান যে যতই সে উঁচুতে উঠুক আসল মুসলমান সে নয়। খাঁটি মুসলমান হলেও আসল মুসলমান নয়।
বাদশাহের এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে সে? এর চাইতে তাকে কোনোরকম সম্মান না দেখিয়ে সাধারণভাবে শান্তিতে ফিরে যেতে দিলে বড় ভালো হতো। সে বুঝতে পারছিল, উপস্থিত সবাই তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। অভিনিবেশ সহকারে নিরীক্ষণ করছে তার হাবভাব। তাদের মুখে কৌতুক। কারও কারও মুখে বিদ্রুপের হাসিও ভেসে উঠেছে এতক্ষণে। কী বলবে সে? কী উত্তর দেবে? তাকে নীরব থাকতে দেখে তিনি অধৈর্য হয়ে উঠেছেন হয়তো।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে বলতে চাইছিল, নামটা সঠিক তার মনে নেই। দু'অক্ষের ছোট্ট নাম, কোনো মানে হয় না সেই নামের। অন্তত তার যা মনে আছে। কিংবা মানে হয়তো হয় সেই দেশের ভাষায়। সত্যিই ঠিকভাবে মনে করতে পারে না নামটা। কেউ তাকে পরে আর সেই নামে ডাকেনি বলে মন থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
সেই কথাই বাদশাহকে বলার জন্যে মুখ খুলতে গিয়ে দেখে বাদশাহ হাত উঁচিয়ে তাকে কিছু বলতে নিষেধ করছেন।
তোমার বর্তমান
তিনি বলেন—তোমার অতীত নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা আর ভবিষ্যৎ হলো মুঘল সাম্রাজ্যের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তোমার “কারতলব খাঁ” নামটা এবার থেকে একপাশে সরিয়ে রেখো। তোমার নতুন নাম আজ থেকে হলো নবাব মুর্শিদকুলী মুতিমিন্-অল্-মুল্ক অল্ আদ্দৌলা জাফল খাঁ নসিরি নাসির জং। সংক্ষেপে তোমার পরিচিত মুর্শিদকুলী খাঁ বা জাফর খাঁ
কারতলব খাঁ নিজেকে মুর্শিদকুলী খাঁ হিসাবে ভাবতে চেষ্টা করে। এবার থেকে সেই নামেই পরিচিত হবে। অনেকে হয়তো জাফর খাঁ বলেও ডাকবে। কিন্তু তার সেই শিশুকালের দু অক্ষরের ছোট্ট নামটা যেন কি? এত বছর পরে সবটুকু একাগ্রতা দিয়েও সেই নাম আর সে মনে করতে পারবে না। সেই নাম হারিয়ে গিয়েছে। সেই গ্রামও হারিয়ে গিয়েছে। আর মলিন কমদামি শাড়ি পরিহিতা রমণী আর গৌরবর্ণ অতিশীর্ণ পুরুষটি নিশ্চিতভাবে পৃথিবী থেকেই এতদিনে মুছে গিয়েছে। তার মতো হিসাবে দক্ষ ব্যক্তিও বয়সের হিসাব কষে তাদের দুজনকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না।
বাদশাহের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের শিবিরে ফেরে মুর্শিদকুলী খাঁ । নমাজের সময় হয়েছে। বাংলা থেকে আসার পথে সে কোরান নকল করতে পারেনি বিশেষ। ইচ্ছে আছে এখানে যে কদিন থাকবে একটু বেশি করে নকল করবে। আর বাদশাহ যেদিন তাকে বিদায় দেবেন, নিজের হাতে তাঁকে একখানি কোরান সে দেবে, যা বহুযত্নে দিনের পর দিন নকল করেছে। পাতলা হাতির দাঁতে তৈরি কারুকার্য খচিত মলাট তার। যাবার আগে সেইটি হবে বাদশাহের কাছে শেষ চমক। তিনি আর ভুলতে পারবেন না তাকে। শত চেষ্টাতেও পারবেন না, জীবনের বাকি কয়টি দিনে। কোরানটি জড়িয়ে এনেছে সে নয়নসুখ কাপড় দিয়ে !
বাদশাহের কাছে আগমন সম্পূর্ণ সফল হলো মুর্শিদকুলী খাঁয়ের! শুধু খেতাব নয় সে প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ফিরল। পাটনায় আজিমউদ্দিন কদিন পরে যখন এসব শুনবে, তখন তার ভেতরটা তিক্ত হয়ে উঠবে। কিন্তু দূর থেকে কোনো ষড়যন্ত্র করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। গুপ্তঘাতক পাঠিয়েও বিশষ সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না। তবু কোনোকিছুকে ছোট করে দেখে না মুর্শিদকুলী। সে জানে, তাকে ব্যতিব্যস্ত করা কিংবা বিপদে ফেলার চেষ্টা করতে পারে ‘আজিম’। সুতরাং সাবধানে থাকতে হবে।
ফেরার দিনে বাদশাহের হাতে যখন সে কোরান তুলে দিল এবং বাদশাহ প্ৰথমে নয়নসুখ কাপড়টি আস্তে আস্তে খুলে ফেললেন, যখন হাতির দাঁতের সুদৃশ্য মলাট বের হলো এবং শেষ পর্যন্ত অতি যত্নে লেখা কোরানের অক্ষরগুলো ভেসে উঠল, তখন শুধু বাদশাহ নন সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল।
ঔরঙ্গজেবের মুখ দিয়ে অস্ফুট উচ্চারিত হলো—তুমি এক অসাধারণ ব্যক্তি। আমি জানতাম সেকথা। প্রথম দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। তুমি একা যত দিক কৃতিত্বের সঙ্গে সামলাও আমি হলেও পারতাম না।
মুর্শিদকুলী খাঁ জানে বাদশাহের সঙ্গে তার জীবনে আর দেখা হবে না। বাদশাহ শীর্ণ হয়ে পড়েছেন, সামনে ঝুঁকে পড়েছেন, বাঁচারও একটা সীমা আছে মানুষের। এবারে কে বসবে ওই মসনদে? মুর্শিদ একটুও ভাবার চেষ্টা করে না। সে জানে, কাউকে ওই আসনে বসতে সে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করবে না। বিরোধিতাও করবে না কাউকে। যে বসবে তার কাছে বাংলার রসদের স্রোত অব্যাহতভাবে পৌঁছে যাবে। উপঢৌকনও যাবে। সে
ফেরার পথে সেই একই নদী পাহাড় পর্বত একই খেয়াঘাট, অরণ্য ঝোপ জঙ্গল— এমনকি নদীতে যারা মাছ ধরছে, জমিতে যারা চাষ করছে তাদেরও মনে হলো একই মানুষ, যাদের যাবার পথে দেখেছিল। যাত্রপথে লোকালয়ের ভেতর দিয়ে যাবার সময় হাটে-বাটে তেমনি কৌতূহলী মানুষ, যারা জানতে চায় অথচ কাছে আসতে চায় না। ঢেঁকিশালে রমণীরা সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। হাতি দেখে আতঙ্কিত হয় পথি-পার্শ্বের কদলীবৃক্ষের মালিকেরা। তবে ফেরার পথে হাতির সংখ্যা অতি নগণ্য। মাত্র দুটি। যাবার পথে ছিল হস্তীযূথ। অনেকের ক্ষতি হয়েছিল। হাতিরা নিজেরা যতটা না উদ্যোগী ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল তাদের মাহুতরা।
মেদিনীপুর এলো। রূপনারায়ণ পার হয়েই মুর্শিদকুলী খাঁ দুজন অশ্বারোহীকে পাঠাল মুখসুদাবাদের পথে—তারা ওখানে গিয়ে ঘোষণা করবে মুখসুদাবাদের নাম এবার থেকে হবে মুর্শিদাবাদ—মুর্শিদকুলী খাঁয়ের নামে নাম। অশ্বারোহী ছুটল লিখিত আদেশ কোমরে গুঁজে। মুর্শিদকুলী খাঁর মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল। দামামা বাজিয়ে গ্রামে-গঞ্জে সব জায়গাতেই ঘোষণা করা হবে। নগরীতে আগে হবে। বেগমসাহেবার কানে গিয়ে পৌঁছোলে প্রথমে বুঝতেই পারবে না মুর্শিদাবাদ কেন হলো। তখন ঘোষণার মর্মার্থ শুনে সবটা বুঝবে। ঘোষণায় লিখে দেওয়া আছে যে বাংলার দেওয়ান সাহেব কারতলব খাঁ এখন শুধু বাংলার নয় তার সঙ্গে উড়িষ্যারও দেওয়ান এবং সেইসঙ্গে এই দুই সুবার সহকারী সুবাদার। বাদশাহ ঔরঙ্গজেব তাঁকে সম্মানজনক খিলাতের সঙ্গে সঙ্গে নতুন উপাধি দিয়েছেন মুর্শিদকুলী খাঁ। সেই নামেই এই নগরীর নামকরণ আজ থেকে হলো মুর্শিদাবাদ । ড্রিম ড্রিম...দ্রাম দ্রাম। অতি বাস্তব মুর্শিদকুলী খাঁও যেন স্বপ্নের ঘোরে ভেরীর বাদ্য শুনে ফেলে আচমকা। তারপর লজ্জিত হয়ে হাতির হাওদার ওপর সোজা হয়ে বসে। ঘুমিয়ে পড়েছিল নাকি?
পাহাড় পর্বত পেরিয়ে বাংলার এই সবুজ সমতলের শোভা বেশ লাগে মুর্শিদকুলী খাঁর কাছে। যেন অনেক পরিশ্রমের পরে বিশ্রাম—অনেক রৌদ্রের পর, বৃষ্টি। দেখলে বোঝা মুশকিল বাণিজ্যের ব্যাপারে এই দেশ রত্নগর্ভা। ফিরিঙ্গিরা কি সাধে এখানে এসে ভিড় করেছে। কেন তারা যায়নি দিল্লীতে? কেন যায়নি রাজস্থানে? ওসব জায়গায় বাণিজ্যের রস নেই ।
মুর্শিদাবাদে মুর্শিদকুলী কবে পৌঁছাবে? আরও অন্তত তিন দিন লাগবে কম করে। ফেরার পর নিরালায় বেগমসাহেবার সঙ্গে দেখা হলে গায়ে হাত বুলিয়ে বলবে রোগা হয়ে গিয়েছে সে। অথচ তার ভেতরে কতটা শক্তি টগ্গ্ করছে বেগমসাহেবী খোঁজ রাখে না। যদি সে পরপর তিনদিন কখনো চুপচাপ বসে থাকত সেই আরবদেশি পাটকেলে রঙের ঘোড়াটার যত বাত ধরে যেত সর্বাঙ্গে। তার নমাজ, তার দীর্ঘ রোজা, তার ব্যস্ততা তাকে সক্ষম সচল রেখেছে।
একটি প্রকাণ্ড প্রান্তর অতিক্রম করে ছোট্ট এক গ্রামে প্রবেশের পথে মুর্শিদকুলী খাঁ চমকে ওঠে। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে পথের ধারের একটি হেলানো বটগাছের
দিকে। এই গাছকে সে দেখেছে বহু বহু বছর আগে একেবারে শৈশবে। হ্যাঁ, সেই গাছ। এমন গাছ পথের ধারে দুটি থাকা কি সম্ভব? বোধহয় না। হয়তো গাছটির শাখা-প্রশাখার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কাস্তের ওই শোয়ানো ভঙ্গি পৃথিবীর দুটি গাছের হতে পারে না । বুকের ভেতর ধুকধুক করে ওঠে মুর্শিদের। অথচ এমন কখনো হয় না তার। শুধু একবার এমন হয়েছিল। তখন তার নতুন যৌবন। পিতা সুফী ইস্পাহানী পারস্য থেকে ফিরে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন বাদশাহের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে। সেদিন বাদশাহ কোনো অট্টালিকায় ছিলেন না। কঙ্করময় এক পার্বত্য অঞ্চলে শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেদিন ছিল প্রচণ্ড ঠান্ডা। অথচ বাদশাহের শিবিরে প্রবেশের সময় সে ঘেমে উঠেছিল। জানত, এই প্রথম সাক্ষাৎ আসল সাক্ষাৎ। বাদশাহের নাকি অসাধারণ মানুষ চেনার ক্ষমতা। তাই ঘামের সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের ভেতর ধুক্ করছিল। সেই ধুকধুকানি কমাবার জন্যে একটু দাঁড়িয়ে পড়েছিল সে। ইস্পাহানীও তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে উঠেছিলেন ‘কী হলো?” তাকিয়ে বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন তার মানসিক অবস্থা। অপেক্ষা করেছিলেন। সেদিন বমি-বমি ভাবও ছিল। ভাবলে নিজেরই সঙ্কোচ লাগে বাদশাহের সঙ্গে দেখা করে ফেরার পথে সত্যিই বমি করে ফেলেছিল। একটা বড় পাথরের আড়ালে।
আজ তো প্রথম সাক্ষাৎকার নয়। আজ কোনো বাদশাহের সমীপে উপস্থিত হতে যাচ্ছে না সে। তবু ওই বটগাছ দেখার পর থেকে এমন হচ্ছে। সেই পুরুষ সেই রমণীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সে জানে তারা নেই। যদি এই গ্রামই সেই গ্রাম হয়, তবু তারা নেই। থাকতে পারে না। তবু যেন এক বিরাট পরীক্ষা দিতে এসেছে সে। হাতি থেকে নেমে পড়ে। দেওয়ান সাহেবকে এই অখ্যাত জায়গায় নামতে দেখে দলবল থেমে পড়ে। তারা একটু বিস্মিত হয়। কারণ গত রাত্রে তারা মাত্র দেড় ক্রোশ দূরে তাঁবু খাটিয়েছিল। তারা অপেক্ষা করে। মুর্শিদকুলী ভাবে, গাছটিকে দেখে যখন খটকা লেগেছে সবটা দেখতে হবে। তবে লাভ হবে না। কার পরিচয় সে জিজ্ঞাসা করবে গ্রামের মধ্যে? কী নাম ছিল সেই শীর্ণ গৌরবর্ণ পুরুষটির? তবু সেই কুঁড়ে ঘর যদি দেখতে পাওয়া যায়। বিমর্ষ হাসি হাসে মুর্শিদকুলী খাঁ। কত অট্টালিকা এতদিনে জীর্ণ হয়ে যায়, আর সামান্য একটা কুঁড়ে ঘরকে খুঁজে বের করা পাগলামি বৈকি। কিন্তু একপাশে সেই আমগাছ আর অন্য পাশে নিমগাছ? তেমন দুটো গাছ তো থাকতে পারে। হ্যাঁ পারে। কিন্তু তাতে কী? থাকলেই বা কী লাভ হবে তার?
কিন্তু মন মানে না। সবাইকে একটু অপেক্ষা করতে বলে সে একাই এগোয়। কিন্তু দেহরক্ষী ছাড়তে চায় না। সে বলে – আপনাকে একা যেতে দেব না।
মুর্শিদকুলী খাঁ একটু দাঁড়ায়। বলে—সঙ্গে সঙ্গে না এসে দূরে দূরে থেকো। নইলে গ্রামের লোকেরা ভয় পাবে।
—ওরা জেনে গিয়েছে, কে এসেছে।
মুর্শিদকুলী খাঁর ঠান্ডা মেজাজও গরম হয়ে ওঠে।
—কাল রাত্রে আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানে
এসেছে।
—তুমি কী করে জানলে ?
—ওরা যখন গল্প করছিল তখন শুনেছি।
করে জানল ? দুজন মানুষ গিয়েছিল। শুনে
মুর্শিদকুলী খাঁ বুঝল, তার কথা গ্রামবাসীদের না জানাই অস্বাভাবিক হতো। রাস্তাঘাটে কত গ্রামের লোক যাতায়াত করে। উঁচু দরের মানুষ সেই পথ দিয়ে গেলে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। দেহরক্ষীকে নিয়েই সে গ্রামের ভেতরে ঢোকে।
স্তব্ধ গ্রাম। লোক জন দেখা যায় না। বোধ হয় ভয় পেয়েছে। দুপুর হতে অনেক বাকি। এখন কর্মব্যস্ত থাকে সবাই।
সে একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। চারদিকে মাটির দেওয়াল। একটা কাঠের পাতলা দরজা আছে। তাই দিয়ে আঙিনায় ঢুকতে হয়। বাইরে মাটির দেওয়ালে আলপনা আঁকা——লতাপাতা আর ফুলের মধ্যে পাখি বসে আছে। বোঝা যায় বেশ অবস্থাপন্ন গৃহস্থ সাধারণত কোনো বাড়িতেই প্রাচীর থাকে না—অনেকে নানান্ রকম গাছ লাগিয়ে বাড়ির ভেতরটা একটু আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে। বাকি মানুষের ভেতর বাইরে সব এক।
এই বাড়িটায় মানুষকে পেলে বেশ হতো। কিন্তু অন্দরে ঢোকা যায় না। পথে ঘাটে কেউ নেই। একজন বৃদ্ধের কাশি শোনা গেল ভেতর থেকে।
দেহরক্ষী চেঁচিয়ে ডাকে। অনেকক্ষণ সাড়া শব্দ নেই। তার পরে বৃদ্ধ বেরিয়ে এলো। সে জানত কে এসেছে। বাইরে না এসে উপায় নেই।
সে সামনে ঝুঁকে পড়ে দুহাত জোড় করে নমস্কার জানায়। মুর্শিদকুলী খাঁর আফসোস হয়। বৃদ্ধের যা বয়স, এ গ্রাম যদি সেই গ্রাম হতো তাহলে এ হয়তো সেই উপবীতধারী পুরুষের কথা জানতে পারত। কিন্তু কী করে? তার নাম তো জানা নেই। মুর্শিদকুলী খাঁ বুঝতে পারে দেহরক্ষী দেওয়ান সাহেবের হাবভাবে রীতিমতো অবাক হয়েছে।
বৃদ্ধ বিনীতভাবে বলে—আমাকে আপনার কী আদেশ দেওয়ান সাহেব।
আশ্চর্য! জেনে ফেলেছে।
মুর্শিদ বলে–আপনার ছেলেরা কেউ নেই ?
একটু দ্বিধাভরে বৃদ্ধ বলে—তিন ছেলে বাইরে কাজে গিয়েছে। এক ছেলে আছে। তাকে আমিই লুকিয়ে থাকতে বলেছিলাম। কী জানি, কী হয়।
—ভয় নেই। আচ্ছা, এ গ্রামে কোনো বাড়িতে আম আর নিম দুটো গাছই আছে? —অনেক বাড়িতে আছে। আমার বাড়িতেও আছে।
—অনেক দিনের?
—–না, নিমগাছটা নতুন লাগিয়েছি।
—আমি বলছি অন্তত ষাট-পঁয়ষট্টি বছরের পুরোনো হবে গাছ দুটো।
বৃদ্ধের দৃষ্টিতে বিস্ময় ফুটে ওঠে। সে বলে—হ্যাঁ, ভূপতিদের বাড়ির গাছদুটো অনেক দিনের।
—আপনার ছেলেকে একটু ডেকে দিন, বাড়িটা দেখিয়ে দেবে। বৃদ্ধের কাছে সবটাই স্বপ্নের মতো মনে হয়। তার বাড়ির সামনে রয়েছেন সুবে বাংলার দেওয়ান সাহেব—যাঁর নাম শুনলে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়। অথচ তাঁকে ডেকে ভেতরে নিয়ে বসাবার স্পর্ধা তার নেই। তাছাড়া ভেতরে বসালে ঘরের কোন কোন সামগ্রী ফেলে দিতে হবে কে জানে। গিন্নী হয়তো সবই ফেলে ধুয়ে একাকার করবে। বড় অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল বৃদ্ধের। সেই সময় দেওয়ান সাহেবের হুকুম শুনে নিষ্কৃতি পায় ৷
গলায় খাঁকারি দিয়ে ডাকে—ভবানন্দ, ও ভবানন্দ শিগগির আয়।
কালো বেঁটে মতো এক যুবক ভয়ে ভয়ে এসে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে।
বৃদ্ধ বলে—দেওয়ান সাহেবকে ভূপতিদের বাড়িটা দেখিয়ে দিবি। ওঁর কোনো অসুবিধা না হয়। সব সময় সঙ্গে থাকবি। জল পিপাসা পেলে গাছের ডাব পেড়ে দিবি।
বৃদ্ধের প্রতিটি কথায় ভবানন্দ মাথাটাকে একবার ডাইনে সবটা হেলিয়ে দেয় একবার বাঁয়ে সবটা হেলায়। তার ধারণা যতটা হেলানো যাবে ততই দেওয়ান সাহেবকে যত্ন করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে ।
ভবানন্দকে দেখে গাঁয়ের অন্যান্য বাড়ি ঘর থেকে একজন দুজন মানুষ বের হয়ে পড়ে। সবাই নিজেদের অন্দরের দিকে তাকিয়ে বুক উঁচু করে চলতে থাকে। দেওয়ান সাহেবের সঙ্গে কয়জন যেতে পারে? অন্দরবাসিনীদের মনও স্বামী-গর্বে ভরে ওঠে।
একটি বাড়ির সামনে এসে ভবানন্দ দাঁড়ায়। মুর্শিদকুলী একটু হতাশ হয়। বাড়িটির চারদিকে বাঁশের বাখারি আর রাংচিতার বেড়া। তার স্মৃতিতে এ ধরনের কোনো বেড়া ছিল না। কোনো আব্রু ছিল না বাড়িটায়। সে হাতির পিঠে চেপে দূর থেকে কুটিরের সামনে রমণীকে আছড়ে পড়তে দেখেছিল স্বামীর পায়ের কাছে।
ভবানন্দ ছুটে গিয়ে একজনকে ডেকে আনে। লোকটি তাড়হুড়োয় একটা ফতুয়া গায়ে গলাতে গলাতে এসে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে মুর্শিদকুলী খাঁর সামনে ।
মুর্শিদকুলী প্রশ্ন করে—আপনার বাড়িতে পুরোনো আম আর নিম গাছ আছে? লোকটি ফারসি ভাষায় জবাব দেয়——আছে।
—আপনি ফারসি জানেন দেখছি।
—আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি আর আমার ভাই কিশোর দুজনেই ফারসি ভালো করে শিখেছি। —আপনার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে ভেতরে গিয়ে গাছ দুটো দেখতে পারি? —আপত্তি? আমার পরম সৌভাগ্য। একটু সময় দেবেন হুজুর?
—হ্যাঁ। অপেক্ষা করছি।
ভূপতি ছুটে ভেতরে গিয়ে নিজের
এবং ভ্রাতৃবধূকে বলে রান্নাঘরের ভেতরে গিয়ে
দরজা বন্ধ করে থাকতে। বলা যায় না যদি কোনোরকমে তাদের দেখতে পেয়ে যায় ।
তাদের দুজনার স্ত্রীই রূপসী।
বাইরে এসে বলে—এবারে আসতে আজ্ঞা হোক দেওয়ান সাহেবের।
মুর্শিদুকলী খাঁ ভেতরে যায়। তাকিয়ে দেখে সেই জীর্ণ কুটির নেই। তবে একটা কুটির আছে আর তার দুপাশে দুই গাছ, অনেক বড়। তবু চেনা যায়। বিশেষ করে আমগাছের ওই শ্বেতবর্ণের বল্কল। আমগাছের বাকল সাধারণত অমন হয় না। মনে
পেড়ে সেই পুরুষ ছুরি দিয়ে কেটে কেটে তাকে দিত। একটুও টক।
—এই আম কি কাঁচাবেলায় টক লাগে না?
—না হুজুর। এটা কাঁচা মিঠে আম। আপনি
কাঁচা আম না।
আম গাছ চেনেন ।
বাংলা আর উড়িষ্যার দেওয়ান বাহাদুর, দুই সুবার সহ-সুবাদার গভীর শ্বাস গ্রহণ করে।
সে বলে—আপনাদের তো মোটামুটি ভালোই চলে দেখছি।
—আপনার আর ঈশ্বরের কৃপায় মোটা ভাত ও কাপড়ের অভাব হয় না। ফারসি ভাষা জানি বলে দলিল-দস্তাবেজ লিখে কিছু হয়। তাছাড়া যজমানিও আছে।
— সেটা কী?
ভূপতি ‘যজমানের' ফারসি শব্দ জানে না। আভাসে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বুঝিয়ে দেয়। —বুঝেছি। অবস্থা তাহলে বরাবরই ভালো ?
ইতিমধ্যে ভূপতির ভাই কিশোর এসে দাঁড়ায়। সে হাঁপাচ্ছিল। কার কাছে খবর পেয়েছে দেওয়ান সাহেব তার বাড়িতে গিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে তার স্ত্রী স্বর্ণলতার কথা মনে পড়েছে। সর্বনাশ হয়ে গেল বুঝি। এসে সব দেখে শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
ভূপতি বলে—আজ্ঞে, আমরা খেতে পেতাম না। আমার বাবা সংস্কৃতে পণ্ডিত ছিলেন, কিন্তু পয়সা ছিল না। আমরা জন্মানোর অনেক আগে আমাদের দাদাকে তিনি একজন খানদানী মুসলমানের কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। সেই পয়সা তাঁর কাজে লাগে। কিন্তু সারাজীবন ম্রিয়মান ছিলেন। সবার শ্রদ্ধা হারিয়ে বসেছিলেন।
মুর্শিদকুলী খাঁর যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। নিমগাছের পাতা ঝিরঝিরে হাওয়ায় নাচছিল। ওই হাওয়ায় ছেলেবেলায় সে প্রশ্বাস নিয়েছে। এই মাটির ওপর খেলা করেছে। কোনোরকমে বলে—আপনারা দুই ভাই যথাসম্ভব শিগগির আমার সঙ্গে দেখা করবেন। ওরা যেন হতচকিত হয়ে পড়ে। কোনো অপরাধ করেনি তো? হঠাৎ দেখা করতে বলেন কেন দেওয়ান সাহেব ?
—কোথায় দেখা করব হুজুর ?
—মুখসুদাবাদ, যার নাম এখন মুর্শিদাবাদ।
–আমাদের কোনো অপরাধ হয়নি তো হুজুর ?
—কোনো অপরাধ হয়নি। আপনারা ওখানে ভালো কাজ পাবেন। পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। আপনাদের মতো অনেক হিন্দু পরিবার ওখানে আছে। গিয়ে সোজা আমার সঙ্গে দেখা করবেন। আপনাদের নাম বললেই আমি বুঝতে পারব।
মুর্শিদকুলী খাঁ আবার গাছ দুটোর দিকে তাকায়। আগের কুঁড়েঘরের অস্তিত্ব নেই। সেই পুরুষ আর রমণীও নেই। তবে তাদের দুই পুত্রসন্তান আছে।
দেহরক্ষী কিছুতেই তার মালিকের এই অদ্ভুত আচরণের মর্মোদ্ধার করতে পারল না। গ্রামবাসীদের কেউই পারল না। তারা শুধু দেখল তাদেরই ঘনিষ্ঠ দুইজন হঠাৎ যেন রাতারাতি নবাব হয়ে গেল।
বাইরে তখন প্রবল ঝড়-বৃষ্টি। কদিন ধরে বৃষ্টির বিরাম নেই। বয়স্ক ব্যক্তিরা বলাবলি করছে, তাদের খুব শৈশবে এমন বৃষ্টি একবার হয়েছিল। সেবারও গঙ্গা নদী ফুলে উঠেছিল। সর্বক্ষণ নদীবক্ষ থেকে আওয়াজ আসছিল ড্রং-ড্রং- শোঁ আওয়াজ। পদ্মার মতো গঙ্গার পাড় ভেঙে
মতো ফুলে সেই সঙ্গে শোঁ
সেবার। এবারও ভেঙেছে
উত্তরের দিকে। আরও কত ভাঙবে কে জানে।
রাত বেশি না হলেও রাস্তাঘাটে জনমনিমি+জেছি ডং-ড
। কী করে থাকবে? অট্টালিকা ছাড়া
কোনো বাড়িই নিরাপদ নয়। গাঁয়ের অনেক বাড়ি ধসে গিয়েছে। বড় বড় গাছ উপড়ে পড়েছে
অনেক বাড়ির ওপর। চাপা পড়ে মরে যাওয়ার খবরও পাওয়া গিয়েছে। কে ওসবে গুরুত্ব দেয়? ঝড় থামলে, দিনের বেলা রোদ উঠলে সবাই ছুটবে ওসব দেখতে। তখন মৃতদেহ আর ধ্বংসলীলা দেখে সহানুভূতি জাগবে মনে। অন্যের বুক ফাটা কান্না দেখে চোখে জলও আসবে। সেই সঙ্গে মনে হবে ভগবানের অশেষ কৃপা আঘাতটা তাদের ওপর দিয়ে যায়নি। কেউ ভাববে ত্রিসন্ধ্যা করার ফল নিশ্চয়। কেউ ভাববে, ফি বছর জোড়া-পাঁঠা বলি দেবার ফল কি আর নেই? কেউ ভাববে ধর্মীয় সব অনুশাসন সে অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করে, সুতরাং আল্লার রহমত তার ওপর বিশেষ ভাবেই রইবে এ তো জানা কথা
সেই ঝড় জলের রাতে এক তরুণ নগরীর রাস্তায় রাস্তায় আশ্রয়ের খোঁজে ঘুরে বেড়ায় কাক-ভেজা হয়ে। সে হাঁটা পথে এসেছে পুঁটিয়া থেকে। সেখানকার রাজা দর্পনারায়ণ ঠাকুর তাকে পাঠিয়েছে দেওয়ান সাহেবের কাছে। দর্পনারায়ণ বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ বংশীয় জমিদার। এই তরুণটিকে পাঠাবার উদ্দেশ্য তার হয়ে এখানে কাজ করবে আর সেই সঙ্গে মুর্শিদকুলী খাঁ যদি তাকে অন্য কোনো কাজে লাগায়। তরুণটি তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী এবং তার ভবিষ্যৎ যে উজ্জ্বল একথা পুঁটিয়ার দর্পনারায়ণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। সে তরুণটিকে বলে দিয়েছে, আর এক দর্পনারায়ণ রয়েছে মুর্শিদাবাদে—কানুনগো সে। খুব প্রভাবশালী।
তরুণটি দুদিন আগে গঙ্গা পার হয়েছে। তখন ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। নদীও উত্তাল হয়নি। দূর গ্রামের একজনের অতিথি হয়ে ছিল। ভেবেছিল বৃষ্টির মধ্যে গিয়ে দেওয়ান সাহেবকে দর্পনারায়ণের পত্র না দিয়ে দুদিন সবুর করে রোদ উঠলে দিলেই হবে। কিন্তু রোদ আর উঠল না। বরং দুর্যোগ বেড়ে গেল—গঙ্গা উত্তাল হয়ে উঠল। এখন তো রেগে গোঁ গোঁ করছে। তাই মরিয়া হয়ে চলে এসে এখন বিপদে পড়েছে।
তরুণটির নাম রঘুনন্দন। সেও বারেন্দ্র বংশীয় ব্রাহ্মণ। সে ভাবে, তার ভাগ্যান্বেষণে আসার ওপর ঈশ্বরের অভিশাপ নেই তো? নাকি, ঈশ্বর তার ধৈর্য আর কষ্ট-সহিষ্ণুতার পরীক্ষা নিচ্ছেন? দাঁতে দাঁতে ঠক্ঠক্ করে লেগে যাচ্ছে। তারই মধ্যে হেসে ফেলে রঘুনন্দন। ভগবান তাকে তৈরি করেও শেষে চিনতে ভুল করলেন নাকি? এ বান্দা ননীর পুতুল নয় গো ঈশ্বর! তুমি কি দেখছ কতটা শক্ত হয়েছি?
টিটিম্ করে আলো জ্বলছিল একটা ঘরের ভেতরে। দেখলে মনে হয় সরাইখানা। সজোরে ধাক্কা দিতে থাকে রঘুনন্দন। কিছুক্ষণ পরে একজন দরজা খুলতেই সে ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে। লোকটার হাতের বাতি হাওয়া লেগে দপ্ করে নিভে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার। —কে? কে তুমি। মগের মুল্ক নাকি। এভাবে ঢুকলে যে?
—-রাগ করবেন না ভাই। আর একটু বাইরে থাকলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতাম। আমি আশ্রয় খুঁজছি। মনে হলো এটা সরাইখানা—
—তাই বলে আলো নিভিয়ে দেবে? তুমি দস্যু কিনা ঠিক আছে?
—দস্যু হলে এতক্ষণে গলা টিপে ধরতাম। এই রাতের মতো
করে। এটা সরাইখানা নয় তাহলে?
—হ্যাঁ, সরাইখানা। দুর্যোগ বলে বন্ধ রেখেছি।
—একটু থাকার জায়গা, একটু খাওয়ার
—হবে। কড়ি ফেললেই হবে।
হবে না?
জায়গা দিন দয়া
—আমি যা খাব তাই হবে। গরম ভাত আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল। সব চেয়ে যা সস্তা।
—তোফা। সস্তাই ভালো। তা ভাই, আপনি কোন জাত?
—কেন? সরাইখানায় খাবেন আবার জাত ধম্মো তুলছেন কেন ?
—না, আমি সৎ ব্রাহ্মণ কিনা। অন্তত জল চলে এমন জাত না হলে মনটা খুঁতখুঁত করবে। -তোমার চেহারাই ভালো করে দেখতে পেলাম না এ পর্যন্ত। দাঁড়াও আলো জ্বালি। —কিন্তু জাতটা বললেন না তো?
—হাঁটু অবধি পৈতে—সামবেদ। গায়ত্রী জপ করে দেব?
—না না থাক্। পেন্নাম হই। পা টা কোথায় আপনার ? —দরকার নেই।
রঘুনন্দন যখন সরাইখানার মালিকের দেওয়া একটা শুকনো গামছা পরে খালি গায়ে রেড়ির তেলের প্রদীপের আলোয় পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে ঝোল ভাত খাচ্ছিল তখন, ঠিক সেই সময়, মুর্শিদকুলী খাঁর প্রাসাদের এক প্রকোষ্ঠে আর এক দৃশ্য দেখা গেল।
জিন্নৎউন্নিসার ঘুম আসছিল না। এপাশ-ওপাশ করছিল। পুত্র আসাদ এবং কন্যা নাফিসা নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে এতক্ষণ হয়তো নিদ্রিত। পুত্রের কাছে রহিম নামে এক খোজাকে রেখেছে দেখভাল করার জন্যে। হাসানবিবির সঙ্গে যে কাণ্ড করেছিল, এই মুর্শিদাবাদে এসে সেই গালে টোল খাওয়া বাঁদীটার সঙ্গেও সেই কাণ্ড বাধিয়ে বসল। ছি ছি, এবারে দেখল নাফিসা। দেখে এসে কেঁদেকেটে অস্থির। বাঁদীটাকে বাঁচানো গেল না, বাঁচাবার ইচ্ছেও হয়নি আর। সব মরুক, উচ্ছন্নে যাক্। তাই মুর্শিদকুলীর কানে' তোলা হলো কথাটা। সঙ্গে সঙ্গে দৌহিত্রকে ডাকল মুর্শিদ। আর তখনই প্রমাণ হলো, কী কাপুরুষ তার নিজের গর্ভের সন্তান। সুজার রক্ত থেকে শুধু চরিত্রহীনতাটুকুই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। তার বলিষ্ঠতা পায়নি। স্রেফ বাঁদীটার ওপর দোষ চাপিয়ে দিল। বলল, দিনের পর দিন নাকি তাকে লোভ দেখাত মেয়েটা। ছি ছি। এই হলো তার পুত্রসন্তান। তখন থেকেই খোজা রহিমকে বলা হলো, নজর রাখার জন্যে। পিতার মুখখানার দিকে চাইতে পারছিল না জিন্নৎ। থমথমে, বুঝি ঝড়ের পূর্বলক্ষণ। কিন্তু তা নয়। কিছু বলল না দৌহিত্রকে। শুধু বলল, সাদি দিতে হবে আসাদের। আসাদ কোথায় লজ্জা পাবে, তা নয় সাদির কথা শুনে মুখে হাসি ফুটল।
বাইরে তুমুল বৃষ্টি। ঝড়ের বেগ যথেষ্ট। জিন্নৎউন্নিসা এপাশ-ওপাশ করছে। ভাবছে, তার নিজেরও তো একটা চাহিদা আছে। এ একাকীত্ব আর কতদিন সইবে? যৌবন যেতে এখনো অনেক বছর বাকি। অল্প বয়সে মা হয়েছে বলে বুড়ি হয়ে যায়নি।
কথা যেদিন প্রথম জানতে পারল সেদিন ছাদে উঠে গিয়েছিল, লাঠি সুজার স্বভাবের
পড়বে বলে। কেন যে নাফিসা সেদিন কাঁদতে কাঁদতে ওপরে উঠে আসছিল। নাফিসা তখর দুই বছরের শিশু। সেদিন নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল তার জীবনে । সেই সময়ে বাঁদীরা কেউ কাছেপিঠে ছিল না। নাফিসা শুধু ছিল তার কাছে। খবরটা শোনার পর থেকে তার ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠেছিল। কী করবে বুঝতে পারছিল না। তারপর হঠাৎ
নাফিসা সেদিন মরতে দেয়নি। দেয়নি বলেই জ্বালার নিবৃত্তি হয়নি। এই জ্বালা কি শুধু মনের? না, সেকথা বললে মিথ্যে বলা হবে। দেহেরও জ্বালা রয়েছে যথেষ্ট। দিনের পর দিন বিনিদ্র রজনী কেটে যায়। সুজা তখন নিশ্চয় অন্য কোনো রমণীর দেহ নিষ্পেষিত করেছে। সুজা আর কিছু চায় না,—সৌন্দর্য নয়, শালীনতাবোধ নয়, রুচি নয়—শুধু যৌবন, জংলী যৌবন।
উঃ, আর কতদিন! পিতা আবার আজই বলেছে, সুজাকে উড়িষ্যার নায়েব সুবাদার করে পাঠাবে। কিন্তু যাকে এতবড় একটা সম্মানজনক পদ দেওয়া হলো, সে বেপাত্তা। কোথায় পড়ে থাকে কে জানে। মাঝে মাঝে যখন এসে উদয় হয় তখন মুখে এত মিষ্টি হাসি মাখিয়ে রাখে যেন সরল শিশু। পিতার মতো ধুরন্ধর মানুষও ধোঁকায় পড়ে যায় । আসলে দিল্টা তো ওর ছোট নয়। বিরাট বড়। তাই সামনে এসে দাঁড়ালে কিছু বলা যায় না। নারী হওয়া যে কী জ্বালা। ও উড়িষ্যায় গেলে ওর সঙ্গে যেতেই হবে। তখন ও হবে নিজেই নিজের কর্তা আরও লাগাম-ছাড়া হয়ে উঠবে। পরিণতি যে কী হবে জানা নেই।
কে যেন ঘরে ঢুকল? কে? কোনো বাঁদী? না কারও ভেতরে আসার হুকুম নেই। তবে কি নাফিসা? বাতিটা ইচ্ছে করে নিভিয়ে দিয়েছে। আজকাল আর বাতি জ্বালিয়ে রাখতে ভালো লাগে না। কে এলো? দরজাটা বন্ধ করে দিল মনে হচ্ছে?
সভয়ে বলে ওঠে— কে?
মানুষটি ছুটে এসে শয্যায় শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে—ভয় পেয়েছ ?
জিন্নৎ অসাড় হয়ে যায়। মানুষটাকে যে কী ভালোবাসত। তার হাতের স্পর্শে ছিল বেহেস্তের সুখ। আজও কি খারাপ লাগে? কিন্তু যখন মনে হয় ওই হাত দুটি দিয়ে কত নারীকে সোহাগ করেছে, কত কি করেছে তখন গায়ের মধ্যে ঘিঘিন্ করে ওঠে। মানুষটার স্বাদ কত নারী যে গ্রহণ করেছে কে জানে।
জিন্নৎ সুজার হাত দুটো সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু তার ভেতরটা বড় দুর্বল। বাইরে দুর্যোগ, একা একা ছট্ফট্ করছিল। খালি খালি লাগছিল। মনে মনে তো এই চেয়েছিল।
তবু বলে—সরে যাও।
-না।
-আমার ভালো লাগছে না।
—না লাগুক।
—সব তাতেই গায়ের জোর নাকি? —নিশ্চয়।
মহা মুশকিল তো। মানুষটা যা তা।
-কাদের?
—যাদের কাছে যাও।
সুজা জিন্নৎকে আরও জড়িয়ে ধরে। ধীরে ধীরে একসময় জিন্নৎ-এর প্রতিরোধ ক্ষমতা নিঃশেষিত হয়। সে জানে কালকে রাতে সুজাকে কখনো কাছে পাবে না। তবু আজ যে পাচ্ছে এটাই বা মন্দ কী? সুজা জানে একথা। তার যে প্রবল আকর্ষণ ক্ষমতা এ বিষয়ে সে সচেতন। এমন সুপুরুষকে অস্বীকার করবে কে? এমন সম্মোহন ক্ষমতা যার, এমন বলিষ্ঠতা যার, নারী তার ক্রীতদাসী।
অনেক পরে যখন বহু রাত্রির অনিদ্রার পর জিন্নৎ-এর সত্যিই ঘুম এসে যাচ্ছে তখন সুজা জিজ্ঞাসা করে—তুমি আসল খবরটা বললে না তো?
ঘুম চোখে জিন্নৎ বলে— কোন্ খবর ?
—আমরা যে উড়িষ্যায় যাচ্ছি।
—তুমি শোনোনি?
—হ্যাঁ, কিন্তু তুমি তো বলবে? তোমার মুখে শোনার স্বাদ আলাদা।
-তাই নাকি? কবে থেকে ?
—যদি বলি চিরকাল? তাহলে ঠাট্টা করবে?
—দেওয়ান সাহেব বলেছেন আসাদ আর নাফিসাকে যেতে দেবে না।
–বাঃ, উত্তম প্রস্তাব ।
—আমি কী নিয়ে থাকব? –কেন? আমাকে নিয়ে ।
জিন্নৎ ম্লান হেসে বলে—বাইরে বৃষ্টি, ঘর অন্ধকার, এই রাত্রে কথাটা শুনে মনে হচ্ছে বুঝি সত্যি কথা বললে, সকাল হতেই সূর্যের আলোয় ভুল ভেঙে যাবে।
সুজা চুপ করে থাকে।
জিন্নৎ বলে—বুঝতে পেরেছ?
সুজা তবু নিরুত্তর। জিন্নৎ দেখে সুজা ঘুমিয়ে পড়েছে কয়েক পলকের মধ্যেই। অদ্ভুত মানুষ।
সেও পাশ ফিরে শোয়।
ভূপতি রায় নিযুক্ত হলো পেশকার খালসা আর তার ভাই কিশোরকে করা হলো দেওয়ানের ব্যক্তিগত কর্মচারী। এত উঁচু পদে এভাবে দুই নবাগতকে কেন নিযুক্ত করা হলো কেউ বুঝতে পারল না। এমনকি ভূপতি ভ্রাতৃদ্বয়ও কম অবাক কৃতজ্ঞতা জানাবারও অবকাশ পেল না দেওয়ান সাহেবকে ।
কিশোরের স্ত্রীর বয়স কম এখনো, তার গা ছমছম করে না। তারা সুখ সইলে হয়। সে ভাবতে চেষ্টা করে পাল্কি করে বাপের বাড়ি থেকে কদিন আগে সে এসেছিল। তাও দুতিন বছর হয়ে গেল। সুবেদার বা দেওয়ানের কোনো সিপাহী তখন তাকে দেখেছে বলে মেনে হয় না। তবু প্রতিদিন বেলা শেষে তার স্বামী যখন বাড়ি ফেরে তখন সে অশান্বিত দৃষ্টিতে
দেওয়ান সাহেব এভাবে কারও সঙ্গে হেসে কথা বলে না। ওরা দুই ভাই শুধু নয়, দেওয়ানখানার সবাই অবাক হয়। দুই ভাইকে তারা একটু ঈর্ষার চোখে দেখে। কিন্তু শুধু ওই ঈর্ষাই, তার বেশি কিছু নয়। তারা জানে, এটা দিল্লী নয়, আগ্রা নয়, এমনকি দাক্ষিণাত্যও নয়। এখানে প্রশাসনের হাল ধরা আছে বজ্রমুষ্টিতে। এতটুকু বেতাল কিছু দেখানোর অর্থ হলো নিজের বিপদ ডেকে আনা।
সেদিন ভূপতি রায় তার হিসাবের খাতা নিয়ে গিয়ে নমস্কার জানিয়ে সামনে দাঁড়াতে মুর্শিদকুলী খাঁ বলে—কদিন খুব দুর্যোগ গেল।
—হ্যাঁ, দেওয়ান সাহেব।
-তোমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি তো?
—একটা নারকেল গাছ ছিল, ঘরের পাশে পড়েছে। ঘরের ওপর পড়লে কি হতো বলা মুশকিল ।
—যাক, বেঁচে গিয়েছ। গাছটা কেটে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করব।
ভূপতি অবাক হয়। এত সামান্য বিষয় নিয়ে কথা বলে সাহেব।
সেই সময় একজন এসে খবর দেয় এক যুবক সাক্ষাৎপ্রার্থী। এভাবে দেখা করা দেওয়ান সাহেবের অপছন্দ। তার সামনে বড় বড় জমিদাররাও সহজে আসতে পারে না। সে চায় না নিজেকে সম্ভা করে ফেলতে। জমিদাররা সবাই প্রায় হিন্দু, শুধু বীরভূমের জমিদার ছাড়া। সে একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, সে থাকেও বহুদূরে। তাছাড়া জঙ্গলাকীর্ণ ভাব জমিদারীর আয় খুব সীমিত । তাই তাকে মুর্শিদাবাদে আসা থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হয়েছে। বাকি সব জমিদারকেই আসতে হয়, খাজনা দেবার জন্যে, অন্য সমস্ত দ্রব্যসম্ভার এনে দেওয়ান সাহেবকে তুষ্ট করার জন্যে। কিন্তু যতবড় জমিদারই হোক না কেন, তারা যদি হিন্দু হয়, তাহলে মুর্শিদাবাদের পথে ঘাটে পাল্কি চেপে আড়ম্বর দেখানো চলবে না। ডুলি চাপতে হবে। পাল্কিতে উঠলে শাস্তি পেতে হবে। তারা যেন কখনো ভুলে না যায়, তারা ধনী হতে পারে কিন্তু আসল শাসকের জাত হলো মুসলমান। এই প্রভেদ না রাখলে তারা মাথায় চাপবে। তাদের বুদ্ধি আছে যথেষ্ট। তাই দাপটে না রাখলে সামলানো যাবে না।
সাক্ষাৎ প্রার্থী যুবক হিন্দু শুনে মুর্শিদকুলী খাঁ সংবাদদাতাকে প্রশ্ন করে—কোথা থেকে
এসেছে ?
—পুঁটিয়ার দর্পনারায়ণ পাঠিয়েছেন। সঙ্গে দর্পনারায়ণের পত্র আছে।
দর্পনারায়ণ মানুষটি খাঁটি। হিন্দুদের মধ্যে বেশ সম্মানজনক ব্যক্তি। মুর্শিদকুলী খাঁ লোকটিকে পছন্দ করে। সে বলে—নিয়ে এসো।
ভূপতি রায় বুঝল, দর্পনারায়ণ ব্যক্তিটি তার মতোই সৌভাগ্যবান। নইলে দেশের অনেক কেউকেটা ব্যক্তিও এত সহজে দর্শন পায় না।
একটু পরে যে যুবকটি প্রবেশ করে তাকে দেখে ভূপতি রীতিমতো আকৃষ্ট হয়। এমন কিছু বলবান নয়, বরং কিছুটা শীর্ণই বলা যায়। কিন্তু চোখেমুখে বুদ্ধির দীপ্তি, তার ভঙ্গি অনায়াস ও চট্পটে। যুবক এগিয়ে এসে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে পুঁটিয়ার রাজার পত্রটি দেওয়ান সাহেবের হাতে দেয়। দেওয়ান সাহেব সেটি মনোযোগ দিয়ে পড়ে। শেষে বলে—তুমি দর্পনারায়ণের তরফে এখানে থাকবে দেখছি। তাঁর উকিল হবে তুমি। এ বিষয়ে জানাশোনা আছে নিশ্চয়।
—আজ্ঞে, রাজাসাহেব যতটুকু শিখিয়েছেন মনোযোগ দিয়ে শিখেছি।
—হুঁ, আর কী করবে ?
—আমি এখানে কিছুই চিনি না। আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে কাজে লাগালে আমি কৃতার্থ হব।
মুর্শিদকুলী খাঁ একবার ভূপতি রায়ের দিকে তাকায়। তারপর বলে—তুমি আগামীকাল এই সময়ে এঁর সঙ্গে দেখা করবে। যদি কিছু করা সম্ভব হয় ইনি তোমাকে জানিয়ে দেবেন যুবক বিদায় নিতে মুর্শিদকুলী ভূপতি রায়কে প্রশ্ন করে—কেমন দেখলে?
—অত্যন্ত বুদ্ধিমান। শুধু বুদ্ধি নয়, চোখের চাহনি দেখে মনে হয় প্রতিভা আছে । —তুমি মানুষ চিনতে পার ভূপতি।
ভূপতি রায় মনে মনে বলে, আপনার কাছে আমি শিশু। মানুষ যদি চিনতে পারতাম তাহলে এতদিনে এত ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করেও আপনার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারলাম না? আমাদের দুই ভাই-এর ওপর কেন এত সদয় হলেন তাও রহস্যময় হয়ে রইল। মুর্শিদকুলী খাঁ বলে—ওকে কোথায় দেওয়া যায় ?
প্রশ্নটা ভূপতিকে করলেও আসলে নিজেই চিন্তা করতে থাকে। ছেলেটা সুন্দর ফারসি বলে। যে কোনো জায়গাতেই নাম করবে বলে মনে হয়।
—আচ্ছা কানুনগো দর্পনারায়ণের সঙ্গে দিলে কেমন হয়। জয়নারায়ণ তো রয়েছে এ- ও থাকুকু। পুঁটিয়ার রাজার পত্রে পড়লাম জমিসংক্রান্ত ব্যাপারে ছেলেটি অত্যন্ত পাকা আমি সারা বাংলার জমি কয়টি চাকলায় ভাগ করব ভাবছি। সেই কাজে এ দর্পনারায়ণকে সাহায্য করতে পারে। কী বলো ?
—এর চেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত আর হয় না। ছেলেটি অনেক উঠবে।
মুর্শিদকুলী খাঁ ভাবে, হ্যাঁ উঠবে ঠিকই, কিন্তু একটা সীমায় এসে ঠেকে যাবে। আর উঠবে না। সে মুসলমান নয়, এইখানেই তার ঘাটতি। সে ভাবে দর্পনারায়ণের সঙ্গে থাকুক এ। দর্পনারায়ণের গলদ এ দেখতে পারবে। তবে লোকটার কোনো
কোনো না কোনো দিনে, একটা ছুতো খুঁজে বের করতেই হবে। সে বাদশাহের কাছে যাবার সময় তার নিজের তৈরি হিসাবে দর্পনারায়ণ দস্তখত দেয়নি, একথা ভুলে যাবে না সে। চরম প্রতিশোধ নিতে হবে। তবে ধীরেসুস্থে কেউ কেউ যাতে না বোঝে, লোকটা দেওয়ান সাহেবের ক্রোধাগ্নিতে ঝলসে পুড়ে শেষ হয়ে গেল।
—আমি দর্পনারায়ণকে ডেকে পাঠিয়ে এর কথা বলছি, কাল তোমার কাছে ছেলেটি এলে কানুনগোর কাছে নিয়ে যেও।
—যে আজ্ঞে।
ভূপতি রায়ের কাছ থেকে ‘যে আজ্ঞে’ ‘জো হুজুর' শুনতে খুব উপাদেয় লাগে না মুর্শিদকুলী খাঁর। ভূপতি বেশ গৌরবর্ণ। কিশোর শ্যাম বর্ণের। ভূপতি সঙ্গে সেই গৌরবর্ণের ময়লা উপবীতধারী ব্যক্তিটির সাহায্য কল্পনা করে নিয়েছে সে। নিশ্চয় এমন দেখতে ছিল। তবে ভূপতি অতটা শীর্ণ নয়। গ্রামে থাকার সময় তবু শীর্ণ ছিল কিছুটা, কিন্তু শহরে এসে নিশ্চিন্তের জীবনে গায়ে গতরে লেগেছে। আচ্ছা, ভূপতির সঙ্গে তার চেহারার কোনো সাদৃশ্য নেই তো? ভাবতেই বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের মুখখানা ভেসে ওঠে। তিনি মহম্মদ হাদির আরও আগের নাম জানতে চেয়েছিলেন। তারও রং গৌরবর্ণ—মিল থাকা অস্বাভাবিক কখনই নয়। কিন্তু তার মুখ ভূপতির মতো শ্মশ্রুবিহীন নয়। কেউ চিনতে পারবে না এ বিষয়ে সে নিশ্চিন্ত। অনেক সময় গলার স্বরে অদ্ভুত মিল দেখা যায়। সে বাদশাহের পুত্র আর পৌত্রদের কণ্ঠস্বরে এমন সাদৃশ্য দেখে অনেক সময় চমকে উঠেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটিও কেউ বুঝতে পারবে না। কারণ সে শিক্ষা পেয়েছে পারস্য দেশে। সেখানকার উচ্চারণরীতি কণ্ঠস্বরের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে।
গ্রামে যাও কখনো ?
—আপনার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে একবার গিয়েছিলাম।
—গ্রামের লোকে কী বলে ?
—তারা বলে আপনি আল্লার আদেশ পেয়ে আমাদের নিয়ে এসেছেন। আল্লা চিহ্ন হিসাবে বলেছিলেন দুটো প্রাচীন আম আর নিম গাছের কথা।
–তোমরা বিশ্বাস করো ?
—আপনি যদি অসন্তুষ্ট না হন, তাহলে বিশ্বাস করতে ভালো লাগবে।
—তোমাদের যা খুশি বিশ্বাস করো, আমার তাতে কী?
পরদিন থেকে রঘুনন্দন দর্পনারায়ণের অধীনে নিযুক্ত হলো।
মধ্যাহ্ন কাল। সেদিনের মতো মুর্শিদকুলী খাঁয়ের কোরান নকল শেষ হয়েছে। সে ভাবে, প্রতিদিন কোরান পাঠের জন্য আরও কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষকে নিযুক্ত করলে কেমন হয় ? অন্তত দুই সহস্ৰ পাঠক যদি রাখা যায় তাহলে মন তৃপ্তি পাবে। কোরানের বাণী মানুষের যাতায়াতের পথে এভাবে উচ্চারিত হলে, কত মানুষের উপকার হবে, কত মানুষ প্রেরণা পাবে। সে আরও ভাবে এবার থেকে মহানবীর জন্ম মৃত্যু নিয়ে যে বারোটা দিন, অর্থাৎ রবি-উল-আওলার পয়লা থেকে বারো তারিখ পর্যন্ত মাহীকার থেকে লালবাচা আদি গঙ্গার ধার দিয়ে আলোকিত করে রাখবে আর এই আলোগুলোকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে দেখতে লাগবে কোরানের বাণীর মতো, কোথাও বা মসজিদের মতো বা বৃক্ষের মতো। কোরান নকল করতে করতেই এইসব কল্পনা তার মনের মধ্যে এলো। সে ভাবে, এই কদিন বহু মানুষকে খেতে দেওয়া হবে। তারা সবাই ভরপেট খাবে। শুধু তারা কেন? পশুই বা বাদ যাবে কেন? পশু-পাখিও খাবে। এমন কি রাতের পোকারাও বাদ যাবে
কাগজ কলম গুছিয়ে রাখতে না রাখতেই বেগম সাহেবা সামনে এসে উপস্থিত হয় । এই সময় কোনো কোনো দিন বেগমের কাছে সে ঠান্ডা পানীয় চেয়ে নেয়। জীবনে কোনো বিলাসিতাই তার নেই। ধর্মের অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে মনে চলার চেষ্টা করে। খাদ্যে নেই বিলাসিতা। নৃত্য গীতের ধারেকাছে যায় না। যৌবনের প্রথম উন্মাদনাতেও সে তার বেগম ছাড়া অন্য কোনো রমণীকে হৃদয়েশ্বরী করেনি। অথচ কতই না সুযোগ ছিল। পোশাক- পরিচ্ছদ অতি সাধারণ। শুধু একটি বিষয়ে তার একটু আগ্রহ রয়েছে। গরমের সময়ে পানীয় হিসাবে বরফ মেশানো শরবত—যে ধরনের শরবতই হোক না কেন। আর এই বরফ সংগ্রহের ভার রয়েছে তারই অতি বিশ্বস্ত পাচক খিজির খাঁ-এর ওপর। সে ফি বছর শীতের সময় চলে যায় রাজমহলের পাহাড়ে পর্বতে। সেখান থেকে সারা বছরের বরফ সংগ্রহ করে এনে জমিয়ে রাখে। আর একটি প্রিয় খাদ্য তার আম। বরফের মধ্যে রেখে দেওয়া ঠান্ডা আম। খিজির খাঁ যার সহকারী সেই সাহাবুদ্দিন মহম্মদ এদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে। বেগম সাহেবা কাছে এসে দাঁড়াতে সে বলে—না আজ আর কিছু নয়। আজ আমার মাথায় অনেক চিন্তা।
বেগমসাহেবাকে সে তার পরিকল্পনার কথা একটু একটু করে বলে। উৎসাহ দেয় বেগম। চিরকাল উৎসাহ দিয়ে এসেছে। কখনো নিজের ইচ্ছা জোর করে স্বামীর ওপর চাপায়নি। খুব ভালোভাবে সে জানে, তাতে স্বামীদের সরে যাবার সম্ভাবনা কমে যায়। জিন্নৎ তার গর্ভের মেয়ে হয়েও একথা বুঝল না। উড়িষ্যায় গিয়েও তাই সেই একই কথা লেখে। বলে, সুজাউদ্দিন নাকি এক পরমাসুন্দরী মেয়েকে সাদি করবে ঠিক করে ফেলেছে। কথা শেষ করে মুর্শিদকুলী খাঁ বলে—একটু যেন অন্যমনস্ক দেখছি তোমাকে ? —না না। অন্যমনস্ক ঠিক নয়। একটা খবর দেব বলে এসেছিলাম।
—কী খবর?
—আজিম পাটনা ছেড়ে আগ্রার দিকে রওনা হয়ে গিয়েছেন। ছেলে ফারুককে এখানকার প্রতিনিধি নিযুক্ত করে গিয়েছেন।
—হুঁঃ, ফারককে প্রতিনিধি নিযুক্ত করা বা খান-ই-জাহান করা, ওসব বাদশাহের এক্তিয়ার। আমি ওসব মানি না। শাহজাদার আর এদিকে থাকার উপায় নেই বুঝলে বেগমসাহেবা?
—কেন ?
—বাদশাহ আর কদিন? তাই তাঁর ছেলেরা মুয়াজিম, মৈজদ্দিন, আজম, কামবক্স সব গিয়ে কাছাকাছি হাজির হয়েছেন। বাদশাহ চোখ বুজলেই মসনদ নিয়ে
পিতাদের মদত দিতে বাদশাহের পৌত্ররাও এগিয়ে যাচ্ছেন।
থাকতে পারেন?
—এতে তোমার কী যায় আসে ? ।
—কিছু না। আমার আরও সুবিধা।
লড়াই শুরু হবে। উস্-সান কি এদিকে আগেই হুকুম ছিল শাহজাদা ফারুকশিয়ার যেন আমার পরামর্শ মতো চলেন। এখন আমি নিজের ইচ্ছেমতো চলতে পারব।
—তুমি স্বাধীন হবে?
—তৌবা তৌবা। একথা মনেও স্থান দিও না বেগম। আমি চিরকাল হিন্দুস্থানের বাদশাহের বিশ্বস্ত হয়ে থাকতে চাই। আমি রাজনীতিক নই। আমি একজন কর্মচারী মাত্র। আমার কাজ হলো এই দেশ থেকে যত বেশি সম্ভব অর্থ সংগ্রহ করা আর সেই অর্থ বাদশাহের কাছে প্রেরণ করা।
–তোমার নিজের জন্যে কিছু ভাব না?
—আমার নিজের জন্যে? একটুও না। ভাবি একজনের জন্যে।
—কে? জিন্নৎ?
—না, ও তো আমার পুত্রসন্তান নয়। তবু ওর জন্যে ভাবতাম। কিন্তু ভেবে লাভ নেই। ওর জন্যে কিছু করা মানে সুজাউদ্দিনের জন্যে করা। সুজা যে এমন অমানুষ বুঝতে পারিনি। জীবনে আমার এইটি সবচাইতে বড় ভুল। বলা যেতে পারে, একমাত্র ভুল।
—তবে কার জন্য এত ভাবনা? আমার জন্যে নয় তো ?
মুর্শিদকুলী খাঁর মুখে হাসি ফোটে। বলে-এককালে যে তোমার জন্যে ভাবনা ছিল না একথা বলতে পারবে না। কিন্তু এখন আর ভেবে লাভ নেই। আমি ভাবি আসাদউল্লার জন্যে । বেগম মুচকি হেসে বলে—জানি, ওর ওপর তোমার টান বেশি। তাই ওকে কাছে রেখেছ। – কেন নাফিসাকে রাখিনি ?
—রেখেছ। সেটা টানের জন্যে নয়। অন্য মতলবে।
মুর্শিদকুলী খাঁ কৌতূহলান্বিত হয়ে উঠে। বলে—কোন মতলবে?
—সাদি দেবে মেয়েটার। নিশ্চয় কোনো ভালো ছেলে নজরে পড়েছে। তাকে ভালো পদে বসাতে চাও।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সত্যিই তোমার বুদ্ধির ধার বেড়েছে। আমার কিছু বলার নেই। —ছেলেটি কে?
—এখন নয়, সময়ে বলব। আসাদের একটা উপাধিও ঠিক করে রেখেছি। আমার জায়গায় ওকেই তো বসতে হবে।
——উপাধিটা কী শুনি।
--সরফরাজ খাঁ আলা-উ-দ্দৌলা হায়দরে জং।
-সরফরাজ। বেশ মিষ্টি নাম ।
——মিষ্টি? তা মিষ্টি বৈকি। মিষ্টির কথা ওঠায় আমার আমের কথা মনে পড়ল। পাকা আম উঠতে আর দেরি নেই। ঝড় জল শিলাবৃষ্টিতে কী রকম ক্ষয় ক্ষতি হলো এবারে, সেই খবরও জানালো না এখনো সাহাবুদ্দিন। রাজমহলে বসে বসে মজা করছে বোধ হয়। বেগম বুঝলো সাহাবুদ্দিনের কপাল পুড়লো। একবার কারও সম্বন্ধে
ধারণা যদি হয় মুর্শিদকুলী খাঁয়ের তাহলে তাকে সরে যেতে খারাপ লোকটা খারাপ নয় বলে শুনেছে বেগম, খিজির খাঁয়ের কাছে। রাজমহলে যখন খিজির যায় সে জমিদারদেন এবং এ হলে সাহাবুদি তখন সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে। বরফ সংগ্রহ করা এবং সেই বরফ মুর্শিদাবাদে পৌঁছে দেবার খরচ খরচা যেমন আশপাশের
বহন করতে হয়, তেমনি মালদহ, কোতোয়ালী, হুসেনপুর — সব জায়গায় সেরা আমের গাছগুলি রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয়
বেগমসাহেবা বলে—তুমি পাকা আম ছাড়া মুখেই তুলতে চাও না। খিজির খাঁ কাঁচা আম পুড়িয়ে বরফ দিয়ে যে সরবত বানায় সত্যিই কিন্তু উপাদেয়। খেয়ে দেখো না একদিন। আজও আছে। আনব?
—না থাক্। আমি বরং সেই লোকটার মুখে শাহজাদা আজিমউদ্দিনের কথা শুনি আগে।
—খাবে কখন?
—খেলেই হবে। আমি তো মুঘল বংশের বাদশাহ নই যে এলাহি কাণ্ড করতে হবে খাওয়ার ব্যাপারে ।
না ।
—মুঘল বাদশাহ? তুমি কি বাদশাহ ঔরঙ্গজেবকে এই পর্যায়ে ফেলো ?
মুর্শিদকুলী খাঁ সামান্য হেসে বলে—না। তিনি সত্যিই সংযমী। তবে আমার মতো কি ? —ভুলে যেওনা ওঁর জন্ম শাহানশাহ্ বংশে।
মুর্শিদকুলী খাঁর মনে হলো বেগম যেন তাকে চাকে দিল। সে আর কোনো কথা বলল
বেগম একটু অপ্রস্তুত হলো। কিন্তু সে যে অপ্রস্তুত হয়েছে একথা বুঝতে দিল না স্বামীকে। বয়স হয়েছে বলে সাত-পাঁচ ভেবে সব সময় বলতে পারে না। দু একটা এমন মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় ।
মনের বসন্ত বছরের কোনো বিশেষ মাসের তোয়াক্কা না রেখেই আসে। নাফিসার মনে সেই বসন্তের আগমনবার্তা পৌঁছাল অতর্কিতে। সেদিন ছিল প্রচন্ড গরম। কদিন থেকেই গরম চলছে। মুর্শিদকুলী খাঁর বরফের ভাণ্ডারে ঘন ঘন হাত পড়ছে। নাজির মহম্মদ বিরক্ত হচ্ছে খিজির খাঁর ওপর। খিজির খাঁর অস্বস্তি হচ্ছে। কারণ, কোনো কারণে বরফ অমিল হলে মুর্শিদকুলী খাঁ ছেড়ে কথা বলবেন না। তিনি হচ্ছেন তেমনি মানুষ যিনি কাজের কদর দেন। কাজের লোককে প্রচুর সুযোগ-সুবিধা দেন। কিন্তু কোনো অসুবিধা হলে শাস্তি অবধারিত, কোনো ক্ষমা নেই। কোনো অজুহাতে কর্ণপাত করবেন না। অথচ দেওয়ান নাতি-নাতনির চাহিদা যেন বেড়েই চলেছে। সেদিনও
নাফিসা ছটফট করছিল। কী করবে ভেবে না পেয়ে
সাহেবের দুই গরমের মধ্যে
ডেকে পাঠাল।
খিজির তখন ছিল না। নাজির মহম্মদ সব সময় এমনিতেই থাকে না। ছিল তাদের অধীনস্থ বাহার আলি। তার ওপর ছিল যে কোনো অবস্থায় হোক নাতি নাতনির হুকুম মানতে হবে। সে ছুটে গিয়ে হারেমের বাইরে দাঁড়ায়।
খোজা রহিম, সেখানে ছিল। সে বাধা দেয়। কিন্তু যে খিজিরকে ডাকতে গিয়েছিল, সে নাফিসার আদেশের কথা রহিমকে জানিয়ে দেয়। রহিম তখন নাফিসাকে দিয়ে বলে যে বাহার আলি বাইরে অপেক্ষা করছে।
নাসিফা চটে উঠে বলে—বাহারকে আমি ডাকিনি। খিজির খাঁকে ডাকো। কিংবা নাজির মহম্মদ যেন আসে।
রহিম সেকথা বাহার আলিকে বলতে, বাহার বলে যে খিজির খাঁ কাঠের গুঁড়ো আর তরমুজের ব্যবস্থা করতে বাইরে গিয়েছে। নাজির মহম্মদ এ সময়ে কখনো থাকে না ।
নাফিসা চটে গিয়ে লাফালাফি শুরু করে দেয়। খোজা রহিম হতবাক। সে ভয় পেয়ে যায়। ছুটে গিয়ে বাহারকে বলে—শিগির খিজিরকে খুঁজে আনো। নইলে আমাদের সবার গর্দান যাবে।
বাহার আলি শান্তভাবে বলে—গর্দান গেলেও উপায় নেই। খিজিরকে এখন পাওয়া অসম্ভব। বরফ গলছে বেশি করে। কাঠের গুঁড়ো খুব দরকার। তাছাড়া দেওয়ান সাহেব নিজের মুখে তরমুজের কথা বলেছেন আজকে ।
—দাঁড়াও। আবার অবস্থা বুঝে আসি। তুমি বরং তোমার গর্দান আর গলায় তেল মালিশ করো ততক্ষণ
রহিম খিজিরের কথা বলতে গিয়ে দেখে নাফিসা বেগম একেবারে শান্ত। আগের সেই রূদ্ররূপ কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে। বরং মুখে একটু হাল্কা হাসি ভেসে উঠেছে। রহিম বিস্মিত। হায় আল্লা, এত বছর বেগম আর বিবিদের নিয়ে নাড়াচাড়া করেও তাদের মনের হদিশ পেলাম না। খোজা হলে কী হবে, খোদাতায়লা পুরুষ করেই তো পাঠিয়েছিলেন। খোদার ওপর খোদগিরি করে মানুষ আর কতটুকু পালটাতে পেরেছে তাদের। মাঝখান থেকে জীবনটা বরবাদ করে দিয়েছে। হাঁপানীর রুগী যেমন বুকভরে নিশ্বাস নিতে পারে না। তারাও তেমনি পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ অনেকটাই গ্রহণ করতে পারে না। মাঝ পথে থেমে যায়। তাদের কাছে জগৎটা অসম্পূর্ণ বিকৃত।
নাফিসা জানালা দিয়ে নীচের দিকে ঝুঁকে পড়ে কিছু দেখছিল। রহিম অতি বিনীতভাবে কাছে গিয়ে তাকে বলে— খিজির খাঁকে
—ঠিক আছে। তুমি এখন যাও ।
কী মিষ্টিভাবে কথাগুলো উচ্চারণ করল নাফিসা। রহিম জানে, সে পরিপূর্ণ পুরুষ হলে এই মিষ্টত্ব তার হৃদয় ক্ষীণ করে তরঙ্গ তুলত। এমন হতে দেখেছে কত। কিন্তু তার হৃদয় স্থির—কোন আলোড়ন নেই তাতে। সে চলে আসছিল। বাহার আলির গর্দান বেঁচে গেল এ যাত্রা। সে ভাবে, আসাদউল্লার সঙ্গে থাকা পোষায়। তার মা তাকে দেখাশোনা করার জন্যই রহিমকে রেখেছে। সেও দেখাশোনা করছে। আসাদ যখন ভীষণ হয়ে ওঠে, তখন রহিম হারেমের বাঁদীদের মধ্যে কমবয়সি কারও সঙ্গে কথা বলে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে আসাদের সঙ্গে ভেট করিয়ে দেয়। তাকে নোকরি আসাদ নাকি দেওয়ান সাহেবের পদে বসবে তৃপ্ত অথচ কাক চিলও জানতে পারছে না ।
খেতে হবে। সে শুনেছে লাভ নেই। এর ফলে আসাদ বাঁদীদের মধ্যে রহিমের কদর বেড়ে গিয়েছে। বাঁদীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে গোপনে গোপনে। ফলে তার বেশ কিছু বাড়তি লাভ হচ্ছে। আসাদ পুরুষ বলেই তার সঙ্গে থাকার অসুবিধা নেই, তার মন জানা যায়। কিন্তু বেগমদের মন বোঝা সত্যিই মুশকিল।
নাফিসার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগের মুহূর্তে সে আবার ডাকে— রহিম, শোনো। খেয়েছে। আবার কোনো ঝঞ্ঝাট ঘাড়ে চাপবে কে জানে। মেয়েদের একটাই তার সহ্য হয় না। প্রতি মূহূর্তে মন বদলায়। এই রাগ, এই অনুরাগ,এই হাসি, এই কান্না সে ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
নীচের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে নাফিসা রহিমকে জিজ্ঞাসা করে—ওই যে ঘোড়ায় চড়ে আমাদের সদর দরজা দিয়ে মানুষটা চলে যাচ্ছে, কে ও ?
রহিম মূহূর্তেই চিনতে পারে। বলে—মানুষ হতে যাবেন কেন? ওঁর বয়স তো খুব কম। নাফিসা মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ায়। নাক ফুলিয়ে বলে—মানুষ নয় মানে? তবে কি জন্তু ? রহিম নাক কান মলে বলে—না না। কঢ়ি বয়স তাই বলছিলাম। বেশি বয়সের লোকদের মানুষ বলে তো।
– কে বলল তোমাকে একথা ?
—আমার তাই ধারণা ছিল। মাফ্ করে দেবেন। আমার অন্যায় হয়ে গিয়েছে। —ঠিক আছে। কী নাম ওঁর।
—খুব উঁচু বংশের। সৈয়দ রেজা খাঁ ওঁর নাম ।
নাফিসা নামটা বার কয়েক আউড়ে নেয়। বলে —যাও।
রহিম বাইরে এসে হাঁফ ছাড়ে। বাঁদীগুলো কোথায় যে উধাও হয়েছে কে তা জানে। যত সব হুজ্জোত।
নাফিসা আবার ডাকে— শোনো, শোনো ।
রহিম মনে মনে বলে, এবারে ঠেলা সামলাও। সে কাছে আসতে নাফিসা জিজ্ঞাসা করে—আচ্ছা, ও কেন আসে এখানে ?
—আমি কী করে বলব। আমি সামান্য খোজা। তবে আপনি হুকুম করলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি।
-থাক দরকার নেই। তুমি যাও ।
রহিম ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হতেই নাফিসা গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করে। নাচের ভঙ্গিমায় সারা ঘরটা একবার ঘুরে নেয়। ভাই আসাদের আচার-আচরণে এতদিন বিরক্ত হতো। একবার সেই দৃশ্য দেখার পরে ঘৃণাও যে একটু না হয়েছে তা নয়। কিন্তু এখন সে আসাদউল্লার ওইসব কার্যকলাপের মধ্যে একটা সংগতি খুঁজে পায়। আচ্ছা, আসাদ তো বাইরে যায়। ও বলতে পারে সৈয়দ রেজা সম্বন্ধে ।
সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে দেখে রহিমকে পাওয়া যায় কি না। না, সে চলে গিয়েছে। তা হোক, তার নিজের পরিচারিকা গুলবিবি পর্দার ওপাশে নিশ্চয় অপেক্ষা করছে। সে গুলবিবিকে অনুচ্চ কন্ঠে ডাকে। গুল এতক্ষণ পাতলা পর্দার ওধার থেকে ঘরের ভেতরে লক্ষ্যরাখছিল, আর ভাবছিল খোজা রহিম এতবার এ-ঘরে যাতায়াত করছে কেন ? এ ঘরের মালিকানির ভার তো ওর ওপর । রহি তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে না। তো? রহিম কি এতটা খারাপ হবে? একথা ঠিক রেবেকা যেদিন চুপিচুপি এসে তাকে
হঠাৎ সর্বাঙ্গ ঠক্ঠক্ করে কাঁপতে থাকে তার। আর সেই সময় নাফিসার ডাক শুনে তার চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে যায়। পা দুটো অবশ হয়। সে আপ্রাণ চেষ্টা করে উঠে দাঁড়াতে পারে না। সে উত্তর দিতে চায় গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না।
নাফিসা বেগম এগিয়ে আসে। গুলবিবি ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকে। —কী হয়েছে? ঘুমোচ্ছিলি ?
গুলবিবি কোনোরকমে মাথা নাড়ে।
—তবে? নেশা করেছিস ?
গুলবিবি আবার মাথা নাড়ে।
—কথা বলছিস না কেন? আমার ডাক শুনেও বেয়াদপের মতো বসে থাকিস, এত বড় আস্পর্ধা তোর?
এতক্ষণে গুলবিবির শরীরের শিরা-উপশিরায় আবার যেন রক্ত চলাচল শুরু করে। সে কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে চলে – হঠাৎ মাথা ঘুরে গিয়েছিল।
—মাথা ঘুরে গিয়েছিল? কেন? তুই কি খেতে পাস না? বল্, খেতে পাস না? —আপনার অনুগ্রহে খাওয়ার কোনো অভাব নেই ।
—তবে ?
—আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। এখন ঠিক হয়ে গিয়েছে। নাফিসা বেগমের হঠাৎ তার দাদির একটা কথা মনে পড়ে গেল। সে বড় বড় চোখে গুলবিবির দিকে চেয়ে বলে—তুই কী করেছিস। ঠিক করে বল্। কার সঙ্গে মিশেছিস ?
গুলবিবির হৃদকম্পন শুরু হয়। সে ভাবে, যদি সত্যিই তাই হয়? তবে তো নির্ঘাত মৃত্যু। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হবে কেন? এই আট-দশদিনের মধ্যেই না না—অসম্ভব। সে বলে——কার সঙ্গে মিশব। আমি হারেমের বাঁদী। পুরুষের
খোজা রহিমের সঙ্গে।
—তার কথা বাদ দে। যত পারিস মেশ তার আসাদকে গিয়ে বলতে যে আমি তাকে দেখা হয় শুধু এক কাজ কর। রহিমকে বল্ গুলবিবির বুকে কাঁপন ধরে। আসাদউদ্দীন এই কক্ষে আসবে। তখন সে পর্দার আড়াল
গুলবিবি আরও একটু অপেক্ষা করে ফিরে গিয়ে নাফিসা বেগমকে বলে—রহিমকে পাওয়া গেল না। বোধ হয় বাইরে পাঠানো হয়েছে।
নাফিসা খেপে ওঠে। চেঁচিয়ে ওঠে— তাই বলে ফিরে এলি? তোর হাত-পা নেই ? —আমি? আমি যাব ?
—তুই আমার বাঁদী কি না?
গুলবিবি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
—তবে? তুই আমার বাঁদি, তুই যাবি আমার ভাই-এর কাছে বলতে যে আমি তাকে ডাকছি। এতে দ্বিধার কী আছে?
গুলবিবির মুখে রক্তোচ্ছ্বাস দেখা যায়। সে বলে আমি তাহলে যাই।
—তাড়াতাড়ি আসে যেন।
গুলবিবি আসাদ-এর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। পা জড়িয়ে আসে। পর্দা ওঠালে এখান থেকে আসাদের শয়নকক্ষ নজরে পড়ে না। একটু ঘুরে যেতে হয়। একটা বড় থাম আছে মাঝখানে। সেই থাম সাদা সবুজ আর গোলাপি রঙে কারুকার্য করা। ফুলদানিতে ফুল ফুটে আছে। চারদিকে আরও পর্দা,—মৃদু হাওয়ায় দোল খাচ্ছে সবগুলি। একটা আলাদা জগৎ—পৃথিবীর বাইরের কোনো জগৎ যেন। অথচ দেওয়ান সাহেবের ঘর সে দেখেছে, কত সাধারণ। এতটুকুও জাঁকজমক নেই। অন্তরের নাতনিকে তিনি কিছু বলেন
না।
গুলবিবির বুকে কাঁপন ধরে। দুরু দুরু বুকে, পা টিপে টিপে সে এগিয়ে যায়। আসাদউদ্দিনের শয্যা কোনদিকে সে ভালোমতোই জানে। সেখানে হয়তো এখন নেই। তার বাঁদিকে ছোট ঘরখানাতে থাকতে পারে। কিংবা যদি শয্যায় অন্য কোনো নারীকে নিয়ে থাকে? না না, তাহলে দরজার সামনে খোজা রহিম থাকবে। সেটাই নিয়ম।
— কে?
গুলবিবি চমকে ওঠে। ঠিক পাশেই একটা জানালার ধারে আসাদ দাঁড়িয়ে ছিল। দেখতে পায়নি সে।
—গুল তুমি?
গুল মাথা নিচু করে বলতে যায়—আপনাকে —
—আরে রাখো-
আসাদ গুলবিবিকে কোলপাঁজা করে নিয়ে শয্যার ওপরে ধপ করে
চোখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে। সে বলে—আপনার বোন এখুনি
একটু দেরি হলেই লোক পাঠাবেন।
—রেখে দাও ওসব। আমি বলে ছটফট
আনতে পারেনি।
গুলবিবির যেতে বলেছেন। জানো দুদিন হলো রহিম কাউকে গুলবিবির অবরোধ আসাদের সামান্য চেষ্টাতেই আগ্রহে পরিণত হয়। গুলবিবির মনে
ইহজগৎ বলে যেন কিছু থাকে না গুলবিবির। তারপর ধীরে ধীরে তার চেতনা হয়। সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে। আসাদউল্লার হাটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বলে—আপনি এক্ষুনি যান আপনার বোনের কাছে। নইলে আমি বোধ হয় বাঁচব না।
—ব্যস্ত হয়ো না। চলো, আমি যাচ্ছি। কিন্তু একটা কথা। কাল আসতে হবে। —রহিমকে দিয়ে নাদেশ পাঠাবেন।
—ঠিক আছে।
আরশির সামনে দাঁড়িয়ে গুলবিবি নিজেকে গুছিয়ে নেয়। মাথায় অবিন্যস্ত কেশদামে হাত বোলায়। বেশবাস ঠিক করে নেয়। তারপর মুখখানা আরশির একেবারে কাছে নিয়ে গিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে। গালের ওপর লাল দাগ। এ দাগ উঠবার না। এ দাগ আসাদউল্লার দাঁতের দাগ। তার মাথা ঘুরতে থাকে।
আসাদ চমকে পেছনে ফিরে বলে—কী হলো?
গুলবিবি কাঁদতে কাঁদতে আঙুল দিয়ে আসাদকে তার মুখের ওপরের দাগ দেখায়। আসাদ হেসে বলে—ও কিছু নয়।
—সবাই জানবে।
—তাই নাকি? ভালোই তো।
ধিক্কারিত দৃষ্টিতে গুলবিবি চেয়ে থাকে পুরুষটির দিকে। এর শয্যাসঙ্গিনীর অভাব হবে না কখনো। কে বাঁচল কে মরল তাতে এর কিছু এসে যায় না। এরা দেহের ক্ষুধা মেটায়। সেও মেটাতে চেয়েছিল। কিন্তু সে নাফিসা বেগম নয়। সে সামান্য বাঁদী। তাই আজ তার মৃত্যু হবে অবধারিত। মনটিকে বিসর্জন দিয়ে শুধু দেহকে প্রাধান্য দিলে সাধারণ মানুষের শাস্তিই হয়। সেই শাস্তি তাকে পেতে হবে।
সহসা তার একটা বুদ্ধি আসে মাথায়। তার কাছে খানিকটা চুন আছে। গালে চুন লাগিয়ে দেবে। জিজ্ঞাসা করলে বলবে, বোলতা কামড়েছে। সেই ভালো।
সে আসাদের পেছনে পেছনে নাফিসা বেগমের কক্ষে প্রবেশ করে। ভাইকে দেখে নাফিসা ছুটে আসে। তার দিকে লক্ষ্য করার অবকাশ পায় না। সেই অবসরে সে ছুটে চলে যায় কক্ষ পেরিয়ে তার ছোট্ট জায়গাটিতে। সেখানে সুচের বাঁ হাতের অনামিকা দিয়ে আগে গালের সেই জায়গাটা সুচ বের করে নির্মমভাবে দুবার সুচ বিধিয়ে দেয়। চুনের পাত্রটিতে গান পাটকা থে দিয়ে দেখে চুন শুকিয়ে শক্ত হয়ে গিয়েছে। ছুটে একটু জল নিয়ে এসে ঢেলে নেয়া অনেকক্ষণ ধরে ঘষতে ঘষতে চুন বেশ নরম হয়। তখন গালে লাগিয়ে দেয়। তবু সে নিশ্চিন্ত হতে পারে না। বসে বসে হাঁপাতে
ঢাকাতেও দেখেছে, মুর্শিদাবাদে এসেও লক্ষ করেছে মুর্শিদকুলী খাঁ যে, ফিরিঙ্গিরা ব্যবসা- বাণিজ্যের ব্যাপারে জলযানের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল। জলযান ছাড়া তারা নিজেদের অসহায় বোধ করে। এটা স্বাভাবিক, কারণ তারা সাত সাগর পার হয়ে এদেশে এসেছে, তবু এর কার্যকারিতা মুর্শিদুকলী খাঁ বুঝতে পারে। তাছাড়া ফিরিঙ্গিরা ছোটখাটো মারামারিতে এগুলিকে নিপুণভাবে ব্যবহার করে। বড় যুদ্ধেও যে খুব ভালোভাবে কাজে লাগানো যায়, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অথচ এদেশে নৌকো জাহাজ নির্মাণের সব রকম ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এ পর্যন্ত কেউ উদ্যমী হয়নি। এখানে সাবরগণ সারিগান গেয়ে দাঁড় টানছে হালকা চালে, ঢাকায় দেখেছে সুন্দর সুন্দর গহনা নৌকোয় কত যাত্রী যাতায়াত করছে। তবু যেন তেমন খেয়াল নেই কারও। অথচ বীরভূমের দামরা আর ময়সারাতে কারখানায় লোহা তৈরি হয়। সেই লোহা কৃষ্ণনগরে, মুল্লারপুর পরগনায় নিয়ে গিয়ে নৌকো প্রস্তুত হয়। কৃষ্ণনগরের মাধুকর নৌকো তো বেশ নাম করা। ওদিকে ঢাকায় তো দেখেই এসেছে সূত্রধররা নৌকো তৈরি করে। অথচ বছরের অনেক সময় এদের কাজ থাকে না। যে সব গাছের কাঠে নৌকো হয় সে সব কাঠ ওখানেই পাওয়া যায়। কাঁঠাল, পিয়াল, শাল, গাম্ভারী, আর তমালের কাঠ খুঁজতে অন্য কোথাও ছুটতে হবে না। সূত্রধরদের সুনাম ফিরিঙ্গিদের দেশে পৌঁছেছে। তবু যেন সব কেমন।
মুর্শিদকুলী খাঁ নিজেও এক-আধবার একটু উদ্যোগী যে হয়নি তা নয়। কিন্তু রাজস্ব আদায় করা এবং সেই অর্থ বাদশাহের কাছে পাঠানোই তার প্রধান কাজ। এই সব দিকে লক্ষ্য করতে গেলে আসল কাজই হবে না। আর হবে না বলেই সে সৈন্যসামন্তের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে তৈরি করে আনা রণতরীও দু-চারটে বসিয়ে দিয়েছে। ওসব রাখা মানেই খরচা বেশি। তার এক সেনাধ্যক্ষ মীর বাঙালি এ বিষয়ে আভাসে যে বলেনি তা নয়। তার ইচ্ছা নয় সব কিছু কমিয়ে দেওয়া। কখন কোথা থেকে আক্রমণ আসে ঠিক নেই। সে মিথ্যা বলে না, তবে মন থেকে সায় পায় না মুর্শিদকুলী খাঁ।
ভূপতিও একদিন দেওয়ানখানায় এসে বলে—ফিরিঙ্গিরা বড় বড় জাহাজ এনেছে। ঝামেলা বাধালেই মুশকিল ।
মুর্শিদকুলী খাঁ ভ্রুকুঞ্চিত করে বলে—কেন?
ভূপতি দেওয়ান সাহেবকে শোনাবার জন্যে কথাটা অনুগ্রহ করেন বলেই দু-চারটে কথা বলে ফেলে। সে কোনোরকমে বলে—আমাদের অমন জাহাজ নেই।
—তুমি আবার যুদ্ধবিদ্যা কবে আয়ত্ত করলে?
ভূপতি সংকোচে মাটিতে মিশে যায়। সে আর কথা বলে না।
মুর্শিদকুলী বলে—ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। আসল কাজ করো ।
—যে আজ্ঞে হুজুর।
—আচ্ছা ভূপতি লোকে আমাকে কী বলে ডাকে?
ভূপতি হঠাৎ এ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে কী বলবে বুঝতে পারে না। তারপর বলে—তারা
দেওয়ান সাহেব বলে।
—না না সেকথা নয়। কোন নামে আমাকে ডাকে ?
—আজ্ঞে নগরীর নাম যা দিয়েছেন, সেই নামেই ডাকে।
—হুঁ। আমার কিন্তু ইচ্ছে লোকে আমাকে জাফর খাঁ নামে চিনুক। ওটাও তো আমার নামের অঙ্গ।
—অনেকে বলে হুজুর।
—বলে? কে বলো তো?
—আমার ভাই কিশোর। অন্য কাউকে আপনার সম্বন্ধে বলতে গেলে ওই নামে পরিচয় দেয়। বলে, ওই নামটা তার ভালো লাগে।
—আমারও। আচ্ছা তোমাদের কাকে কে যেন এসে কিনে নিয়ে গিয়েছিল?
-আমাদের বড় দাদা হুজুর। বাবা এত গরিব ছিল, খেতে পেত না। তবে আমরা জানি না। আমি জন্মাবার কয়েক বছর আগে। আমরা তো বাবার বুড়ো বয়সের সন্তান। —হুঁ, তোমার সেই দাদার নাম কী ছিল?
মাথা নেড়ে ভূপতি বলে—জানি না হুজুর। কেউ আমাদের কখনো বলেনি। আমরা ছোট ছিলাম তো। মা কিন্তু কাঁদতো।
মুর্শিদকুলী খাঁ চুপ করে যায়। মাঝে মাঝে তার এসব একটু জানতে ইচ্ছে করে। বিশেষ করে সে দেখছে, তারই সহোদর দুই ভাই তার অধীনে কাজ করছে দিনের পর দিন, অথচ তাকে চেনে না। এইভাবেই চলতে হবে। নইলে উপায় নেই। এদের ওপর তার স্নেহ রয়েছে, অচেনা হয়ে রয়েছে বলে। নইলে স্বার্থের সংঘাত শুরু হয়ে যেত। মুঘল পরিবারে তেমন হয়। ভাই হয়ে ভাই-এর বুকে ছুরি বসাতে হতো। তার চেয়ে এটা ঢের ভালো।
রঘুনন্দন এসে প্রবেশ করে। দর্পনারায়ণের অধীনে কাজ করে খুব অল্পদিনের মধ্যে সে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছে। মুর্শিদকুলী খাঁ মনে মনে স্বীকার না করে পারে না যে এই তরুণ অসাধারণ। দর্পনারায়ণের পরে এ-হবে মুখ্য কানুনগো। দর্পনারায়ণকে সরাতেই হবে এবং পৃথিবী থেকে। তবে ধীরে, খুব ধীরে। এখন হয়তো তার মনে নেই যে একদিন সে হিসাবে দস্তখত দিতে দুই লক্ষ টাকা চেয়েছিল। মুর্শিদকুলী খাঁ খুবই ভালো ব্যবহার করে তাকে অতীত ভুলিয়ে দিতে পেরেছে মনে হয়।
কথা রঘুনন্দন নমস্কার করে। এই সময় তাকে মাঝে মাঝে ডাকা হয়। নির্দেশ দেওয়া আছে কোনোরকম ভুলত্রুটি তার নজরে পড়লে সে দ্বিধা না করে এসে যেন বলে। রঘুনন্দন ধারণা করেছে যে আসলে দর্পনারায়ণের ভুলত্রুটির বোঝাতে চায় মুর্শিদকুলী । কত ভুলচুক হয় কাজ করতে, এসব সাধারণ রা কারণ অত বড় দপ্তরখানায় কত লোক কাজ করে। সবাই সমান পারদর্শী নয়। আর পারদর্শী হলেও মানুষ মাত্রেই ভুল হতে পারে।
কিন্তু সেই ভুল ধরা পড়লে সংশোধন করা হয় সঙ্গে সঙ্গে। বিশেষ করে দর্পনারায়ণ কোনোরকম খুঁত রাখা সহ্য করতে পারে না। সেইজন্যেই দর্পনারায়ণকে রঘুনন্দনের এত ভালো লাগে। সে জানে না, মুর্শিদকুলী খাঁর অভিপ্রায় কী।
মুর্শিদ বলে—যদি কখনো দেখো, কোনো ভুলভ্রান্তি ইচ্ছাকৃত, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে এসে
বলবে।
অত্যন্ত তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী বলেই রঘুনন্দন মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায় ৷ নইলে অন্য কেউ হলে বলে ফেলত— ইচ্ছাকৃত ভুলভ্রান্তি হবার প্রশ্নই ওঠে না। দর্পনারায়ণ সেই ব্যাপারে খুব সতর্ক।
মুর্শিদকুলী খাঁ বুঝতে পারে; অন্তত রঘুনন্দনের কাছে এইভাবে বলে ফেলাটা ঠিক হয়নি। সে কথা ঘোরাতে বলে—তোমার ভাই-এর নাম যেন কী ?
—আজ্ঞে রামজীবন ।
—হ্যাঁ হ্যাঁ, রামজীবন। তাকে একটা জমিদারি দেবার অভিলাষ তোমার তাই না?
রঘুনন্দন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কী করে বুঝে ফেললেন ইনি? মানুষের মনের ভেতরে প্রবেশ করার কলাকৌশল এঁর ভালোই জানা আছে। অনেক সাধু-ফকিরের এই ক্ষমতা থাকে এমন শুনেছে।
আসলে মুর্শিদকুলী খাঁ যাদের নিয়ে কাজ কারবার করে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুকরো কথাবার্তার মধ্যে তাদের মনোভাব বুঝে নেয়। দেখে নেয়, এদের উচ্চাশার পরিধি কতটা। দেখে নেয়, এদের দুর্বলতম স্থানটি কোথায়। সে আগে থেকেই জেনে ফেলেছিল, রঘুনন্দনের তার ভাই-এর উপর প্রবল স্নেহ। আর সেই স্নেহকে বাস্তবায়িত করতে সে পারে ভাই-এর নামে কিছু জমিজমার ব্যবস্থা করতে। কারণ এখন সেই দপ্তরখানার সঙ্গে সে যুক্ত। কিন্তু মুর্শিদকে ফাঁকি দিয়ে কিংবা অন্য কোনো কৌশলে ভাইকে ধনী করে তোলার মতো নীচতা তার মধ্যে নেই। তাই সোজা কথাটা সোজা ভাবেই তাকে বলে ফেলে মুর্শিদকুলী।
রঘুনন্দন শাস্ত স্বরে বলে—রামজীবন সুখে শান্তিতে থাকুক, ওর নাম ডাক হোক, এটাই আমার কামনা।
—তোমার কামনা অপূর্ণ থাকবে না। তুমি শুধু মন দিয়ে কাজ করে যাও ।
রঘুনন্দন মনে মনে ভাবে, সে ব্রাহ্মণ সন্তান। অন্যায় বিশেষ কিছু করেনি জীবনে। ভগবানের কাছে তার প্রার্থনা ফলবতী হবার সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে। বয়ঃকনিষ্ঠ হলে মনে মনে মুর্শিদকুলী খাঁকে সে আশীর্বাদ করতে পারত। আশীর্বাদ অবিশ্যি ব্রাহ্মণ হলে সবাইকেই করা যায়। তবু মুর্শিদ বিধর্মী। ওপরে যিনি বসে আছেন, যিনি যাবতীয় ক্ষমতার অধিকারী, সেই বিধাতাকে নিয়ে যত টানা-হেঁচড়া চলুক না কেন পৃথিবীতে, তিনি একই।
সেই বিধাতার কাছে রঘু-নন্দন কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা জানায় তার দেওয়ান এবং নাজিম সুবাদার যেন দীর্ঘায়ু হন ।
বাংলা উড়িষ্যার ভূপতি রায় সবই শুনলো। রঘুনন্দনের ওপর দেওয়ানের এই সন্তুষ্টি তাকে আনন্দ দেয়। দেওয়ান সাহেব। তার অনেক কাজকর্মে হিন্দুরা মনঃক্ষুণ্ণ হলেও একথা সে শুনেছে, আজিম-উস্-সানের আমলে এবং তারও আগে খাঁটি এবং গোঁড়া মুসলমান হলেও গুণীর কদর।
ভূপতি রায় জানে না, শুধু সেজন্যে নয়, হিন্দুদের ওপর নির্ভর করার আরও একটি গূঢ় কারণ রয়েছে। আর থাকলেই বা কি, সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ তো পাচ্ছে তারা। রঘুনন্দনের হাসি-হাসি মুখের দিকে চেয়ে তাই আনন্দ হয়। সে-ও তো দেওয়ান সাহেবের কৃপায় আজ ধনী, তার ভাই ধনী। তার স্ত্রী, বিশেষ করে বৌমার রূপ এখন ফেটে পড়ে। গাঁয়ের ওই বাড়িতে থাকলে কি এমন হতো? শকটে করে লোকজন নিয়ে বৌরা কি ওভাবে গঙ্গাস্নানে যেতে পারত? পৃথিবীতে বাস করেও মনে হয় স্বর্গে বাস করছে তারাই। আর এই সবের মূলে ওই গৌরবর্ণ শ্মশ্রুগুম্ফণ্ডিত ব্যক্তিটি। রঘুনন্দন নিশ্চয় উঠবে— অনেক উঠবে। তাই তার ভাই রামজীবনও উঠবে।
কাজীর বিচার। হ্যাঁ কাজীর বিচার। এই বিচার নিরপেক্ষ হবে। নিষ্ঠুর হতে হলে আদৌ এসে যায় না। আর বিচার হবে ধর্মানুগ। এর মধ্যে কোনো ফাঁক থাকা মুর্শিদকুলী খাঁর অপছন্দ। দেশে একটা গুজব খুব চালু আছে। মুর্শিদকুলী খাঁর একমাত্র পুত্র, ইসলাম ধর্মের পক্ষে যাকে ব্যভিচার বলে, তেমন কিছু করে ফেলেছিল। ফলে তার বিচার হয়, আর সেই বিচারের কাজী ছিল স্বয়ং মুর্শিদকুলী খাঁ। সপ্তাহে দুদিন সে বিচারে বসে। সেদিন নিয়মিত যে কাজী, তার ছুটি। বিচারে প্রমাণিত হলো দেওয়ান সাহেবের একমাত্র বংশধর অপরাধী। এতটুকুও দ্বিধা না করে মুর্শিদকুলী খাঁ তার মৃত্যুদণ্ড দিল এবং সেই দণ্ড সঙ্গে সঙ্গে কার্যকরী হলো। কথাটা বাংলা এবং উড়িষ্যার নিভৃত কোনো গ্রামের অরণ্যের কাঠুরিয়াকে প্রশ্ন করলে সেও বলে দিতে পারবে। সারা দেশ তাই অপরাধ করার ব্যাপারে তটস্থ। পাপী তার পাপ কাজ করার আগে বেশ কয়েকবার ভেবে নেয়। তবে স্বভাব-পাপীদের কথা আলাদা ৷
কিন্তু মুর্শিদাবাদে যারা বাস করে এবং এর আগে ঢাকায় যারা অধিবাসী তারা কখনো দেওয়ান সাহেবের কোনো পুত্রের কথা শোনেনি। তারা জানে তাঁর একমাত্র কন্যা, যে সুজার বেগম। কিন্তু দেশের জনসংখ্যার তুলনায় তারা নগণ্য। দেশের সবার মনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে অন্যায় করলে মুর্শিদকুলী খাঁ নিজের একমাত্র বংশধরকেও রেয়াত করে না। তবে সত্যিই বিচার এখানে বড় কঠোর। কাজীও নির্বাচন করা হয় খুব বেছে বেছে। কাজী হলো সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার ওপর দেওয়ান, সুবাদার তো বটেই, বাদশাহেরও প্রভাব বিস্তারের কোনো ক্ষমতা থাকে না। বাদশাহ সোজাসুজি তাকে নিযুক্ত চুনাখালির জমিদারের ঘটনার কথা এখনো মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে মুর্শিদাবাদের মানুষের। আর সেই সঙ্গে মনে হয় কাজী মহম্মদ সরফ্-এর কথা। চূনাখালির জমিদার বৃন্দাবনের কাছে এক মুসলমান মাধোনা হাবভাবে যে কোনোকারণেই হোক বৃন্দাবন সাহায্য চায়। তার কথাবার্তা বা হয়ে তাকে তাড়িয়ে দেয়। সে তখন বৃন্দাবনকে জব্দ করার জন্য একটা ফন্দি আঁটে। বৃন্দাবনের বাড়ির রাস্তার মাঝখানে ইট
সঙ্গে সঙ্গে সেই ভিখারি গিয়ে কাজী মহম্মদ সরফ্-এর কাছে অভিযোগ করে। বিচারে কোনোরকম জটিলতা নেই। ইসলাম ধর্মের ওপর এতবড় আঘাত সহ্য করার অর্থ হলো নিজেকে বেইমান প্রমাণ করা। বৃন্দাবনের মৃত্যুদণ্ড।
মুর্শিদকুলী খাঁ তখন সবে কোরান নকল করা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছে। সেই সময় একজন দৌড়ে এসে খবর দেয় চুনাখালির বৃন্দাবনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। খবরটা শুনে মুর্শিদকুলী রীতি মতো বিচলিত হয়। সে মধ্যাহ্নের খানা না খেয়েই ঘোড়ায় চেপে ছোটে কাজী মহম্মদ সর্-এর কাছে। বৃন্দাবন অত্যন্ত ভালো মানুষ একথা সে জানে। তাছাড়া বৃন্দাবন টাকা পয়সা মিটিয়ে দেবার ব্যাপারে কখনো এতটুকুও গাফিলতি করে না। মানুষটা তার পরিচিত।
কাজী সাহেব দেওয়ান সাহেবকে দেখে বলে ওঠে—দেওয়ান সাহেব যে। এই অসময়ে। খানাপিনা হয়েছে তো?
—শুনলাম, বৃন্দাবনকে আপনি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ?
—হ্যাঁ খবরটা এর মধ্যেই রটে গিয়েছে দেখছি। বেশ খুশির কথা। হ্যাঁ, মৃত্যুদণ্ড শুধু দিইনি, ওকে আমি নিজে দণ্ড দেব।
—আপনি নিজে? আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন ?
—কথাটা আর একবার বলুন শুনি। ভুলে যাবেন না বাদশাহ আলমগীরের মতো ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি অনেক দেখেশুনে আমাকে এইখানে পাঠিয়েছেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন ইসলাম ধর্মের অমর্যাদা হচ্ছে এখানে। বাদশাহের দূরদৃষ্টি আছে, কি বলেন দেওয়ান সাহেব? আপনিও শুনি খুব ধর্মাত্মা ব্যক্তি।
মুর্শিদকুলী খাঁ নম্রভাবে বলে—একটা কথা বলব ?
—হ্যাঁ বলুন, একটা কেন, হাজারটা বলুন। আজিমউদ্দীনের অনুপস্থিতিতে আপনি এখানকার মালিক। আজিম পাটনায় বসে আছেন—এদিকে আসতেও পারবেন না। আপনি খুব খুশি তাই না?
মুর্শিদের মনে হলো কাজীর চোখের মধ্যে তার প্রতি একটা ঘৃণার ভাব ফুটে উঠছে। তবু সেই দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সে কাজীকে বলে—মৃত্যুদণ্ড ছাড়া বৃন্দাবনকে অন্য কোনো দণ্ড দেওয়া যায় না ?
কাজী বিদ্রুপের সঙ্গে বলে উঠে—লোকে শুনি আপনাকে বলে আদালত—গস্তার। এই কি তার নমুনা? আপনি ওর হয়ে ওকালতি করতে এসেছেন? হ্যাঁ ওর
পেছিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
—কতটা সময়?
—ওর উকিলকে বধ করতে যতটা সময় দরকার। তারপরই ওকে মরতে হবে। মুর্শিদকুলী খাঁ ধীরে ধীরে স্থান ত্যাগ করে। সে অশ্বারূঢ় হয়েও ভাবতে থাকে। বৃন্দাবনকে সে পছন্দ করত। অথচ ওই উন্মাদের জন্যে তাকে রক্ষা করা গেল না। হঠাৎ
কিন্তু আহার সমাপ্ত হবার আগেই তার কাছে খবর পৌঁছে যায় কাজী নিজে হাতে তীর নিক্ষেপ করে বৃন্দাবনকে হত্যা করেছে। হত্যা ছাড়া কী? একে মৃত্যুদণ্ড বলা যায় না। আজিমউদ্দিনের কাছে অশ্বারোহী পাঠালো বটে মুর্শিদ কিন্তু চিঠির বয়ান পাল্টে দিল। লিখল যে, চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারল না।
পরে শুনেছিল মুর্শিদকুলী খাঁ যে বৃন্দাবনের হত্যাকাণ্ডে আজিম ক্ষুব্ধ হয়ে বাদশাহকে লিখেছিল, কাজী মহম্মদ সর্ ক্ষেপে গিয়েছে। বিনা অপরাধে সে স্বহস্তে বৃন্দাবনেকে খুন করেছে।
ঔরঙ্গজেবের উত্তর সংক্ষিপ্ত : কাজী আল্লার হয়ে কাজ করেছেন।
বাদশাহের মন্তব্যই চূড়ান্ত কিন্তু যে বাদশাহ কাজীর কলিজার জোর, সেই বাদশাহ অতি স্বাভাবিকভাবে পরিণত বয়সে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন ঔরঙ্গাবাদে। বয়স একানব্বই। খবর শুনেই মহম্মদ সর্ পদত্যাগ পত্র পেশ করল মুর্শিদকুলী খাঁর কাছে। মুর্শিদের সনির্বন্ধ অনুরোধ তাকে টলাতে পারল না। সে মুর্শিদাবাদ পরিত্যাগ করে চলে গেল। আর মুর্শিদকুলী খাঁ কল্পনা করতে লাগল হিন্দুস্থানের তত্-তাউসে কে বসবে। কারও মুখ তার মনশ্চক্ষে ভেসে উঠছে না। ওঠা সম্ভবও নয়। প্রতি বাদশাহের মৃত্যুর পর ঘন ঘন পট পরিবর্তন হয়। তাকে কিছুদিন চুপচাপ অপেক্ষা করতে হবে। তারপর যেই একটা স্থিতি আসবে, বোঝা যাবে মসনদে কে আসীন হবেন, সঙ্গে সঙ্গে বাংলা থেকে রাজস্ব আর উপঢৌকন রওনা হবে—যেখানে বাদশাহ থাকবেন। এবারে বোধহয় আর দক্ষিণ ভারত নয়—দিল্লী কিংবা আগ্রা।
ওদিকে মৃত বদশাহের শবদেহ যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তাঁর ইপ্সিত সমাধিস্থলে ঔরঙ্গাবাদের সমীপবর্তী ফকির জয়নাল আবেদিনের সমাধির পাশে তখন তাঁর তিন পুত্রের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে গিয়েছে।
মুর্শিদকুলী খাঁ জানত ফকির জয়নাল আবেদীনের প্রতি বাদশাহের কী গভীর শ্রদ্ধা ছিল। বাদশাহ বরাবরই বলতেন, মৃত্যু তাঁর যেখানেই হোক, দেহখানা যেন তাঁর আশ্রয় পায় ফকিরের সমাধির পাশে। তাতেই তিনি শান্তি পাবেন। আর তাঁর ভগিনী জাহানারার মতো তিনিও চাইতেন না যে সমাধির ওপর কোনো প্রাসাদ উঠুক, কোনো স্তম্ভ গড়ে উঠুক। অতি সাধারণ মুলমানের কবরের মতো তাঁর সমাধিস্থল যেন অনাবৃতই থেকে যায় ।
হালচাল দেখার জন্য মুর্শিদকুলী খাঁ চর পাঠায় বেশ কয়েকজনকে।
0 Comments