শ্রীপারাবত এর অমূল্য সংগ্রহ-01/মুর্শিদকুলী খাঁ -01(A historical novel in Bengali by SREE PARABAT)-series -01

 শ্রীপারাবত এর অমূল্য সংগ্রহ-01/মুর্শিদকুলী খাঁ (A historical novel in Bengali by SREEPARABAT)-series -01

'অগ্রজ

প্রয়াত সমীরকুমার গোস্বামীর স্মৃতির উদ্দেশে

ঢাকাজাহাঙ্গীর নগর

সুবাদারের প্রাসাদ সামনে বিস্তৃত প্রাঙ্গণ তারপর সড়ক অনেক দূরে নদী প্রাসাদের অলিন্দে একটি আরামপ্রদ আসনে বসে সেই নদী তীরবর্তী কর্মব্যস্ততা অবলোকন করছিল স্বয়ং সুবাদার আজিমউদ্দিন

গ্রীষ্মের উত্তপ্ত মধ্যাহ্ন অনেকটা গড়িয়ে গিয়েছে তবু উষ্ণ বাতাসের হলকা এসে লাগছে চোখে মুখে আগ্রার উত্তাপ অনেক গুণ বেশি তবু সওয়া যায় এখানকার গরম খালবিল নদীনালা থেকে যতটা সম্ভব জলীয়বাষ্প নিয়ে এসে শরীরকে অস্বস্তিতে ফেলে বড় অথচ কেটে গেল প্রায় চার বছর হ্যাঁ, আরও বেশ কয়েক বছর কাটাতে চায় সে তার টাকার দরকার হিন্দুস্থানের তত্-তাউসে বাবাকে কিংবা নিজেকে বসাবার জন্যে অনেকঅনেক টাকার প্রয়োজন তার বাংলার সুবাদার সে কিন্তু তাই বলে, একথা ভুলতে পারে না যে, মুঘল বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের পৌত্রও সে তার পিতা বাদশাহের জীবিত পুত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভুলতে পারে না সে একথামুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারে না তাই দূরে নদীর তীরে বড় বড় নৌকো আর জাহাজ নির্মাণরত সূত্রধরদের ব্যস্ততা তার মনকে নাড়া দেয় না অথচ এই সূত্রধরেরা জগৎ বিখ্যাত নদীতে ভাসমান গহনা নৌকোগুলোর বৈচিত্র্যও তার হৃদয়ে, শুধু আজ বলে নয়, প্রথম যখন এসেছিল তখনও কোনো ঔৎসুক্য জাগায়নি প্রথম থেকেই সে জানে, রাজধানী থেকে এত দূরে এই সুদূর অস্বাস্থ্যকর প্রান্তে পড়ে আছে শুধু অর্থের জন্যে তার পিতৃব্য শাজাহান-পুত্র সুজা সেইজন্যে এসেছিল, শায়েস্তা খায়েরও উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন এছাড়া ফিদাই খাঁ, শাহজাদা মুহম্মদ আজম, খান-ইজহান বাহাদুর, ইব্রাহিম খাঁ সবার লক্ষ ছিল একই নইলে এখানে কে থাকে? কদিন পরেই তো বর্যা নামবে কী নিদারুণ অবস্থা হবে পথ পথঘাটেরভাবা যায় না শায়েস্তা খাঁয়ের মতো বিপুল অর্থ নিয়ে যেতে পারলে এভাবে থেকেও সুখ

কিন্তু তা বোধহয় সম্ভব হবে না স্বয়ং বাদশাহ যে তার প্রতি স্নেহপ্রবণ হয়েও এমন কাজ করবেন কে জানত! তিনি শত্রুতা করেছেন হ্যাঁ, জেনেশুনেই শত্রুতা করেছেন শত্রুর তো অভাব নেই কেউ তাঁকে বলেছে, রাজকোষে অর্থ জমা দেবার চেয়েও ব্যক্তিগত ঐশ্বর্য বৃদ্ধিতে তার ঝোঁক বেশি তাই বাদশাহ একজন নতুন মানুষকে দেওয়ান করে পাঠিয়েছেন তার ওপর খবরদারি করতে হ্যাঁ, দেখেশুনে ভেবে-চিন্তে পরখ করে তবেই পাঠিয়েছেন লোকটিকে নইলে এত অল্প সময়ের মধ্যে এভাবে তার অর্থ উপার্জনের প্রতিটি পথ রুদ্ধ করে দিল কোন যাদুবলে ?

ভাবতে ভাবতে মাথার ভেতরটা গরম হয়ে ওঠে আজিমউদ্দিনের বাদশাহ নিজে তৈমুর বংশের হয়ে তাঁরই রক্তধারা যার ধমনীতে প্রবহমান, তার মাথা এভাবে হেঁট করে দিলেন

একজন অজ্ঞাতকুলশীল মানুষের কাছে? অজ্ঞাতকুলশীল তো বটেই লোকটার জন্ম খানদানি মুসলমানী বংশেও নয় এখানকার কোনো এক বিন্দু ব্রাহ্মণের সন্তান নাকি বাদশাহ কি জানতেন না একথা বাদশাহ আলমগীর না জেনেশুনে তো কোনোই কাজ করেন না

সূর্য আরও নীচে নামে আজিমউদ্দিন লক্ষ করে তার দুই পুত্র করিমউদ্দিন আর ফারুকশিয়ার দুটো ঘোড়ায় চেপে প্রাঙ্গণ অতিক্রম করে সড়কের দিকে যাচ্ছে দুজনেই কৈশোরে পা দিয়েছে বেশ কিছুদিন হলো সে নিজে আর নিজেকে তরুণ বলতে পারে না তার পিতা মহম্মদ মুয়াজিম তো প্রায় বৃদ্ধ তবু বাদশাহ আলমগীর বহাল তবিয়তে রাজত্ব করে চলেছেন বিধাতা এক একজনকে বড় বেশি পাইয়ে দেন

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আজিম সেই সময় খুব সুপরিচিত আতরের সুঘ্রাণ পায় সে জানে, পিছন দিকে হাত বাড়ালেই একগুচ্ছ ঘন নরম কেশদামের সঙ্গে একটি মসৃণ গ্রীবা তার হাতের বেষ্টনীতে ধরা পড়বে তবু নিশ্চেষ্ট বসে থাকে সে পৃথিবীটাকে বড় বেশি নীরস, বর্ণহীন আর নিরর্থক বলে মনে হয় তার কাছে তবে বেগম সাহেবউন্নিসা পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে জেনে সে তৃপ্তি পায় এককালে বেগম তার তারুণ্যে যেমন আগুন লাগিয়েছিল, এখন তেমনি সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে পারে এমন বাস্তববাদী নারী তার প্রথম জীবনের উদ্ভট ক্রিয়াকলাপ কীভাবে হাসিমুখে মেনে নিত, সায় দিত, সেকথা আজিম প্রায়ই ভাবে সাহেবউন্নিসা শুধু তার বেগম নয় এখন, তার পরামর্শদাতাও বটে

পেছন থেকে সুমিষ্ট কণ্ঠে উচ্চারিত হয়সুবাদার সাহেব বড় বেশি অন্যমনস্ক আজ আমি জানি

চকিতে পেছন ফিরে আজিম প্রশ্ন করেকী জানো?

-তোমার মনের কোথায় কাঁটা বিধছে সেই খবর আমি রাখি

না রাখলেই অবাক হতাম

সাহেবউন্নিসা হেসে ফেলে বলেতার জন্যে এভাবে মুখ গোমড়া করে বসে থাকলে

কাজ হবে?

বেগমকে হাত ধরে টেনে কাছে বসিয়ে বলেকী করতে বল তুমি ? —সরিয়ে ফেলো

কী বললে ?

বেগম সাহেবার যে আয়ত নেত্রের বিলোল কটাক্ষ এককালে আজিমকে সম্মোহিত করে রাখত, এখনো যা তাকে মুগ্ধ করে, সেই চোখের দৃষ্টি ঝলসে ওঠে বাদশাজাদার হাতের ওপর চাপ দিয়ে বেগম বলেঠিকই বলছি আরও স্পষ্ট ভাষায় যদি শুনতে চাও তো বলি, মহম্মদ হাদিকে, যাকে বাদশাহ নাম দিয়েছেন কারতলব খাঁ, তাকে সরিয়ে ফেল ঝপট্

তবু স্পষ্ট হলো না কোথায় সরাব? উড়িষ্যায় ? বিহারে ?

না, মাটির নীচে

আজিমউদ্দিন চুপ হয়ে যায় তার মনের অতি নিভৃতে যে বাসনা বাসা বেঁধেছিল সেটি আজ ভাষা পেল

হুঁ শেষ পর্যন্ত বোধহয় ওই পথই

হবে

শেষ পর্যন্ত? বলছ কী তুমি বাদশাহজাদা? যার লক্ষ দিল্লী আর আগ্রার তত্-তাউস্

তাকে আরও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয় সময় খুব কম বাদশাহ আলমগীরের বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই কোনো ব্যাপারে হোঁচট খেলে, অন্য একজন এগিয়ে যাবে তোমাকে পেছনে ফেলে আজিম উঠে দাঁড়ায়ঠিক আজই ব্যবস্থা নিতে হবে

কিন্তু কী করে?

হ্যাঁ, কী করে?

-তোমাকে একটা কথা বলব? কিছু মনে করবে না?

না তুমি তো জানোই, তোমার যৌবনের দাম ষোলো আনা দিই না বটে, হাজার হলেও তৈমুর বংশে জন্ম আমার, কিন্তু তোমার মস্তিষ্কের দাম আমি সব সময় দিয়ে থাকি

বেগম সাহেবার মুখে বিষণ্ণ হাসি ফুটে ওঠে আজিমের জীবনে সে তো আর একমাত্র নারী নয় তবু আজিম তাকে সবচাইতে পছন্দ করে, তার পরামর্শের গুরুত্ব দেয় এইটুকুও কম নয় তাছাড়া যদি আজিম কখনো দিল্লীর মসনদে বসতে পারে, তাহলে করিম কিংবা ফারুকদুজনার একজনের কপাল খুলবেই এতো জানা কথা

সাহেবউন্নিসা বলে,—দেখো, তোমার বুদ্ধি আছে, সাহস আছে তুমি যুদ্ধ-ক্ষেত্রে ভালো নেতৃত্ব দিতে পার তুমি তোমার ব্যবহারে আমীর ওমরাহদের তুষ্ট করতে পার কিন্তু তবু তোমার একটা দুর্বলতা রয়েছে

আজিমউদ্দিনের ভ্রূ কুঞ্চিত হয় বলেসেটা কী ?

এক এক সময় কোনো অজ্ঞাত কারণে তুমি শত্রুপক্ষকে অবহেলা করো মাঝে মাঝে ভেবে বসো, তারা দুর্বল তুমি কখনো-সখনো অপরের ছল-চাতুরী বুঝতে পার না অন্যের খোসামোদে তুমি অল্পতেই গলে যাও তৈমূর বংশের বড়াই করতে হলে, দিকটাও ভাবতে হবে

——আমাকে একটা দৃষ্টান্ত দেখাও

ছোটখাটো কত দৃষ্টান্তই আছে তবে সবচেয়ে শেষের দৃষ্টান্ত এই কারতলব খাঁয়ের ব্যাপারে লোকটা মাত্র কয়েক বছর হলো এসেছে সবাই ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছে তুমি সুবাদার হলেও আসলে চাবিকাঠি এই লোকটির হাতে তোমার মর্যাদায় ঘা লাগে না? এতদিন নিজে পয়সা উপায় করতে, ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের বন্দোবস্তু ছিল লোকটা সব বন্ধ করে দিয়েছে একে একে সে বাদশাহকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাঠিয়ে তাঁর মন জয় করে নিয়েছে তুমি সব দেখেও চুপচাপ এখনো বসে বসে ভাবছ, কী করবে আজিমের ইচ্ছে হয়, তার এককালের অতি প্রিয় নারীকে দুহাতে ভুলে ওপর থেকে ছুড়ে নীচে ফেলে দেয় কিন্তু না বেগমসাহেবা ঠিক কথা বলেছে

সে পায়চারি করতে করতে বলেআজই ব্যবস্থা নেব আবদুল ওয়াহেদকে ডেকে পাঠাচ্ছি

সে আবার কে? নাম শুনিনি কখনো

নক্দি ফৌজ ওর তত্ত্বাবধানে থাকে

ওকে সম্মত করানো যায় কি না

কী বললে? তুমি না সুবাদার তোমার কথায় ওরা উঠবে বসবে

তা তো জানি বেগমসাহেবা কিন্তু মাইনাটা নিতে যে ওদের কারতলব খাঁয়ের কাছে

হাত পাততে হয় আসলে ওরা নগদ পয়সার বিনিময়ে কাজ করে সেইটাকেই একটা

উপলক্ষ করতে হবে একদল ফৌজ গিয়ে মাইনা পায়নি এই অজুহাতে লোকটাকে ঘিরে ধরে আক্রমণ করবে

সাহবেউন্নিসা মনে মনে আজিমউদ্দিনের বুদ্ধির তারিফ না করে পারে না অথচ এই বুদ্ধির গোড়ায় মাঝে মাঝে ধোঁয়া না দিলে চলে না, এমন ঝিম্ মেরে যায়

সে বলেওসব হলো তোমাদের, মানে পুরুষদের ব্যাপার তুমি ভালো বুঝবে, কী করতে হবে আমি শুধু জানি মহম্মদ হাদি বেঁচে থাকতে তুমি সুবাদার হয়েও সম্মান রাখতে পারবে না এক আকাশে দুই চাঁদ?

এবারে আজিম ক্ষেপে ওঠেকী বললে? কাকে চাঁদ বলছ? জানো, ওর বাবা খেতে পেত না বলে দেওয়ান হাজি সফি ইস্পাহানীর কাছে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেয় তবেই না আজ কারতলব খাঁ ওকে তুমি পবিত্র চাঁদের সঙ্গে তুলনা করছ? তুমি না— ——আমার অপরাধ হয়েছে তবু তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী

হ্যাঁ সেই রকমই চেষ্টা করছে বটে কিন্তু ওর ধমনীতে কার রক্ত কেউ জানে? আজ দেওয়ানীতে এত পারদর্শী তার কারণ ফারসি ভাষা ভালো করে রপ্ত করেছে পারস্য দেশে বহু বছর কাটিয়ে তারপর ধর্ম বাপ হাজি সফির সঙ্গে সঙ্গে থেকে টাকা পয়সার ব্যাপারটা খুব ভালো বুঝতে শিখেছে কিন্তু অস্ত্র ধরার বেলায় দেখতে পাবে আবদুল ওয়াহেদের লোকের সামনে কেমন মোরগের মতো ছট্ফট্ করতে করতে মরবে

বেলা পড়ে আসে নদীর পার ধূসর হয়ে আসে প্রাচীরের ওপারের সড়কের ওপর মানুষের আনাগোনা কিছু দূরে একটা বাজার আছে সেখানে কতরকম দ্রব্যের কেনাবেচা বিশষত বস্ত্রশিল্পের বিপুল সম্ভার দেখা যায় ওখানে বিদেশিদের ভিড় বেশি বিক্রি হয় সরবর্তী, মলমল, আলাবালী, তঞ্জীব, তেরিন্দাম, নয়নসুখ, ডুরিয়া, জামদানী আরও কত কী দুর থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসে আজিমউদ্দিন কান পেতে শোনে এখনি প্রাসাদের বাতিগুলো একে একে জ্বলে উঠবে

সাহেবউন্নিসা সামনের দিকে একটু ঝুঁকে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে বলেআপনার নমাজের সময় হলো আমার ধৃষ্টতা মাপ করে দেবেন শাহজাদা

আজিম অন্যমনস্ক অবস্থায় হাসে তার মনের মধ্যে দুটি নাম বারবার ঘোরাফেরা করতে থাকেকারতলব খাঁ আর আবদুল ওয়াহেদ আবদুল ওয়াহেদ আর কারতলব খাঁ

সন্ধ্যার প্রাক্কাল কারতলব খাঁ তার প্রিয় ঘোড়ায় চেপে নগর পরিভ্রমণে বেরিয়েছিল এটা তার শখ বললে ভুল হবে তার জীবনে শক বলে কোনো পদার্থ নেই যা করে সব কিছুর পেছনে কারণ রয়েছে আর সেই কারণের প্রধান লক্ষ কীভাবে বাদশাহের কাছে এই বাংলা থেকে বেশি পরিমাণে অর্থ পাঠানো যায় মনে পড়ে তার, বাদশাহ কাছ থেকে বিদায় নেবার সময়ের কথা সেইদিন তাকে বাংলার দেওয় আর বাংলারই এক নগর গঙ্গাতীরবর্তী মুখসুদাবাদের ফৌজদার বলে ঘোষণা করেন বাদশাহ বলেন, – তোমার পালক পিতা হাজী ইস্পাহানী খুব সুদক্ষ দেওয়ান তুমি তাঁর কাছে কাজ শিখেছ আমি লক্ষ করেছি, দেওয়ান হবার পুরোপুরি যোগ্যতা তোমার রয়েছে তুমি সুদক্ষ, কুশলী, কর্তব্য-পরায়ণ আমার আশা তুমি ভালো চালাতে পারবে একটা কথা বলছি, দিল্লী ছেড়ে

এই বয়সে সখ করে আমি দক্ষিণ ভারতে পড়ে নেই, সেকথা তুমি জানো আমি চাই মৃত্যুর আগে এই দেশকে ঠান্ডা করতে আর তার জন্যে অর্থের প্রয়োজন তোমার কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ চাই পৌত্র সুবাদার আজিমউদ্দিন, আমার আশা ঠিক পূরণ করতে পারছে না, যে কোনো কারণেই হোক অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে আমি তোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিলাম আজিমউদ্দিনও ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না যদি করে, খবর পাঠিও আমাকে, ওকে আমি ওখান থেকে সরিয়ে অন্যত্র পাঠাবো টাকা চাই বুঝলে, টাকা চাই

কারতলব খাঁ বিনীতভাবে মাথা নুইয়ে বলে, যে সে বুঝেছে আসলে সেই দিনই মহম্মদ হাদিকে বাদশাহ কারতলব খাঁ উপাধি দেন সেদিন বাদশাহের চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তার রেখা সে ফুটে উঠতে দেখেছিল সেইসঙ্গে পাশাপাশি দেখেছিল একটা হতাশার ছায়া জীবন শেষ হয়ে আসছেদক্ষিণ ভারতকে বুঝি পদানত করা গেল না

কারতলব খাঁ গম্ভীরভাবে বলেছিল, বাদশাহ, আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই মনদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব আমি আজ থেকে জানব, এই মসনদই আমার মালিক মসনদে যিনি আরূঢ় থাকবেন, তাঁর কাছে বাংলা থেকে প্রতি বছরের সংগৃহীত অর্থ ঠিক এসে পৌঁছবে কখনো অন্যথা হবে না

আলমগীর কারতলবের এই কৌশলী জবাবে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন তার পরে দুই বার সে অর্থ পাঠিয়েছে দুই বৎসরের আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে বাদশাহ সন্তুষ্ট হয়ে তাকে চিঠি দিয়েছেন তাছাড়াও মাঝে মাঝে উৎসাহ দিয়ে চিঠি পাঠান এই চিঠিগুলো কারতলব খাঁয়ের কাছে প্রেরণার উৎস স্বরূপ

সন্ধ্যা আরও ঘনিয়ে আসে কারতলব খাঁ তার অশ্বকে নদীর দিকে চালিত করে সেখানকার কর্মব্যস্ততায় সে দেশের নাড়ির স্পন্দন অনুভব করে বেশ কিছুদিন মুখসুদাবাদে যাওয়া হয়নি সেখানকার ফৌজদার সে তাছাড়া ঢাকার চেয়ে মুখসুদাবাদ লোকালয়টিকে তার পছন্দ বেশি জায়গাটি বাংলার ঠিক মাঝখানে পাশ দিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত সমস্ত দেশের ওপর নজর রাখতে ওই জায়গাটি চমৎকার বিদেশি ব্যবসাদাররাও ওখান থেকে শুরু করে সাগর সঙ্গমের আগে পর্যন্ত অনেক জায়গায় ব্যবসা করে কুঠিও বানিয়েছে বিদেশিদের ঠিক পছন্দ করে না কারতলব খাঁ তাদের বশে রাখতে গেলে ঢাকার চেয়ে মুখসুদাবাদ মোক্ষম স্থান

সামনে বিপরীত দিক থেকে দুই ঘোড়সওয়ারকে এগিয়ে আসতে দেখে কারতলব খাঁ হতে পারে বাদশাহের পৌত্র সুবাদার আজিমউদ্দিনের লোকজন যেই হোক, কারতলব খাঁকে দেখে নিশ্চয় অশ্ব থেকে অবতরণ করে সম্মান জানাবে অপেক্ষা করে সে দুই অশ্বারোহীকে আরও কাছে আসতে দেয় কিন্তু একি! যে সুবাদারের দুই তরুণ-সন্তান, করিম আর ফারুক তাড়াতাড়ি কারতলব ঘোড়া থেকে নেমে রাস্তার পাশে সরে দাঁড়ায়! দুই তরুণকে অভিবাদন জানায় এদের মধ্যে বাদশাহী রক্ত

একদিন বসতে পারে সুতরাং এরা সম্মানীয়

ওরা দুজনাও অবতরণ করে করিমউদ্দিন

দেওয়ান সাহেব!

আপনাদের দেখতে পেলাম কিনা

মসনদে এরা

এভাবে নেমে পড়লেন কেন

তাতে কী? আপনি কত সম্মানেরবাদশাহের চেয়ে নই

আমরা কি বাদশাহ !

কারতলব খাঁ বলেবাদশাহের শকটও আমার কাছে সম্মানের বস্তু বাদশাহের নৌবহরও

করিমউদ্দিন কৌতুক অনুভব করে সে ঠাট্টা করে কিছু বলতে গেলে ফারুক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে-আপনার এই মনোভাবকে আমিও সম্মান দিই দেওয়ান সাহেব

ফারুকের সংযত ব্যবহারের প্রশংসা মনে মনে না করে পারে না কারতলব সে জানে কীভাবে অন্যের সম্মান আদায় করতে হয় অপরকে সম্মান দিয়েও সম্মান আদায় করা যায় অথচ তার বাবা আজিমউদ্দিন অন্য ধরনের মানুষ সে অপরকে অবহেলা করে সম্মান পেতে চায় তাই বোধহয় সবক্ষেত্রে সফল হয় না যেমন হয়নি জবরদস্ত খাঁকে তুচ্ছ করে জবরদস্ত-এর মতো অমন বিশ্বস্ত বীর সেনাপতির সাফল্যকে হেয় চোখে দেখায়, সে মনের দুঃখে দক্ষিণ ভারতে ফিরে গিয়েছে অথচ তার মতো মানুষের কত প্রয়োজন এই বাংলায়

কারতলব খাঁ বলেঅন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগে বাড়ি ফিরে যান শাহজাদা করিমউদ্দিন বলে ওঠেকেন? কেউ খুন করবে নাকি?

হিন্দুস্থানের সর্বত্র আপনাদের মিত্র, সব জায়গায় আপনাদের শত্রু

তাই বলে এই ঢাকা নগরীতে ?

হ্যাঁ, সেইজন্যেই আরও বেশি করে বলছি কারণ এখানে আপনারা থাকেন সহজেই আপনাদের ওপর নজর রাখা যায়

বাইরে আসব না? বন্দী নাকি আমরা?

করি উদ্দিনের কথাবর্তা কারতলব খায়ের ভালো লাগে না তবু প্রশ্নের উত্তর না দেওয়াটা হবে বেয়াদপি সে বলেকিছু দেহরক্ষী সঙ্গে নিয়ে এলে ভালো হতো হুঁ, দেহরক্ষী আমাদের সঙ্গে অস্ত্র আছে

ফারুক তার অগ্রজকে বলেদেওয়ান সাহেব গুপ্তঘাতকের কথা বলছেন তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় না

শাহজাদারা চলে যায় কারতলব খাঁ আবার এগোতে থাকে তাকে একটু চিন্তান্বিত দেখায় আজ যদি সে বাদশাহের অনুগ্রহ না পেত তাহলে তার অবস্থাও জবরদস্ত খাঁয়ের মতো হতো সুবাদার আজিমউদ্দিন আভাসে ইঙ্গিতে বহুবার তার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছে, তাকে অপদস্থ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু সইতে হবে এই ঢাকা নগরীতে তার থাকা চলবে না মুখসুদাবাদই তার আসল স্থান তার দেওয়ানীর কাজ ওখান থেকেই ভালো চলবে প্রথমেই আফগানী, পারসিক, তুর্কী, পাঠান, সব উচ্চাভিলাষী মক্ষিকাকুলকে ওখান থেকে তাড়াতে হবে ওদের সবার এক লক্ষ্য কী করে পয়সা লুটবে ওদের দিয়ে চলবে না তার দেওয়ানীর কাজে নিতে হবে স্থানীয় হিন্দুদের কারা পাসের ।। মাথা তাদের চমৎকার উচ্চাশা বিশেষ কিছু নেই সামান্য একটু সুখস্বাচ্ছন্দকিছু টাকাকড়ি কোঠাবাড়ি এরা বিশ্বাসঘাতকতা খুনখারাবি করতে সাহস পাবে না এরা অর্থের হিসাবে কারচুপি করলে একটু মোচড় দিলেই

সত্যি কথা বলে ফেলবে যে কোনো কারণেই হোক চারিত্রিক দৃঢ়তা এদের তেমন নেই বোধহয় বহুদিন রাজত্ব ভোগ করেনি বলে রাজকীয় চরিত্র হারাতে বসেছে

কে যেন কারতলব খাঁয়ের অন্তর থেকে বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বলে ওঠেতুমি নিজে কি মহম্মদ হাদি? তোমারও যে গোড়ায় গলদ আজ ধার করা নাম কারতলব খাঁ পেয়ে নিজেকেই ভুলে গেলে? মহম্মদ হাদি নামটিও তো ধার করা তোমার পালক পিতার দেওয়া আসল নামটি কী? তোমার পূর্বপুরুষরা কি রাজত্ব করত?

বিমর্ষ হয়ে পড়ে কারতলব খাঁ সত্যিই সেই নাম আজ আর মনে নেই তার বিশেষ কোনো নামকরণ তখনো হয়তো হয়নি, যখন সেই অজানা গ্রামের দরিদ্র ব্রাহ্মণ তাকে হাজি সফী ইস্পাহানীর হাতে সমর্পণ করেছিল সেইদিনের কথা মন থেকে মুছে গিয়েছে বললে মিথ্যা বলা হবে মনে আছে তাকে একটা কিছু বলে ডাকা হতো, ভাও মনে আছে কিন্তু কী বলে? সেটা স্মরণে আনতে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে অথচ সেই গাঁয়ের দিগন্তবিস্তৃত মাঠ আর মাঠের পাশে গ্রামের প্রান্তদেশে সেই অদ্ভুত-দর্শন বটগাছের কথা আজও তার মনে আছে মনে আছে, তার অতি শীর্ণ এক মা ছিল সে চিরকালের জন্যে চলে আসার সময় সেই মা পাতায় ছাওয়া কুঁড়েঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ভাঙা গলায় কেঁদে উঠেছিল মনে আছে এসব কথা কিন্তু মনে থেকেও আর লাভ নেই শত চেষ্টা করেও সেই গ্রাম কি আর খুঁজে পাবে সে? পাবে না আর পেলেই বা কী লাভ তাছাড়া সে মুসলমান ইসলামকে সে তার রক্তের সঙ্গে হৃদয়ের সঙ্গে কলিজার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে সে এক অপরিসীম পরিতৃপ্তি পেয়েছে তাই আজ ফেলে আসা জীবনকে খুঁচিয়ে তুলতে চায় না ভালো লাগে না সেই জীবন সম্বন্ধে তার কিছুমাত্রও ধারণা নেই তবে সেই জীবন কখনই শান্তির হতে পারে না ইসলাম যার ধর্ম নয়, সে কী করে শান্তি পায়? সে কি বিধাতার কাছে এভাবে আত্মসমর্পণ করতে পারে? বোধহয় না

অন্ধকার ঘনিয়ে আসে কারতলব খাঁ ঘোড়ার ওপর চুপচাপ বসে থাকে তাকে নিজের খুশি মতো চলতে দেয় জানে, বিশ্বস্ত জীবটি তাকে তার গৃহে নিয়ে গিয়ে থামবে বেশ গরম পড়েছে তাই রাস্তাঘাটে মানুষজনের আনাগোনা ভালোই আছে পথিপার্শ্বে দোকানপাটে কেনাবেচা চলছে এখনো রাস্তার কয়জন মানুষই বা দেওয়ান সাহেবকে চেনে তাছাড়া বাদশাহের বংশধর সুবাদার সাহেবই হলো এদেশের প্রধানতম চরিত্র তার তুলনায় সবাই গৌণ কিন্তু কারতলব জানে এর মধ্যেই যেভাবে জমিদারীর ব্যবস্থা সে করেছে, যেভাবে কর আদায় আরম্ভ হয়েছে তাতে দেশের প্রধান প্রধান ধনী ব্যক্তিরা ইতিমধ্যেই তাকে সমীহ করতে শুরু করেছে বাদশাহের আনুকূল্য থাকলে দুদিন পরে তাকে সবাই ভয় পেতে শুরু করবে তখন সুবাদার তাদের মন থেকে ধুয়ে মুছে যাবে এই জন্যেই আজিমউদ্দিন তাকে সহ্য করতে পারছে না ওষুধ ধরতে করেছে সুবাদারের নিজেরও অসদুপায়ে উপার্জনের পথ বন্ধ হয়েছে এখন বাংলা উড়িষ্যার সব সংগৃহীত অর্থের মাত্র একটি গন্তব্যস্থলসেটি হলো নের বাদশাহদের অর্থকোষ অশ্বটি দাঁড়িয়ে পড়ে আঙিনায় এসে হাজির হয়েছে দুজন লোক বাতি হাতে নিয়ে ছুটে আসে একজন দেওয়ান সাহেবের হাত থেকে লাগাম নেবার জন্যে অপেক্ষা করে অন্যজন বাতি নিয়ে তার পথ দেখবার জন্য অপেক্ষা করছে

কারতলব খাঁ অবতরণ করে ওপর দিকে চেয়ে তার আবাসগৃহের বাতায়নে দৃষ্টি ফেলার চেষ্টা করে অন্ধকারে দৃষ্টি পড়ে না কিন্তু জানে তার বেগম সাহেবা ঠিকই নজর রেখেছে তার প্রতি অন্যথা হয়নি কখনো জীবনে তার এই একটি নারীই এসেছে এবং টিকে আছে পালক পিতা হাজি সফী ইস্পাহানীর মৃত্যুর পর সে যখন পারস্যদেশ থেকে হিন্দুস্থানে ফিরে আসে বেগমকে নিয়ে তখন অনেকে তাকে হালকা রসিকতা করে বলেছিলআবার কষ্ট করে বেগমকে অতদূর থেকে সঙ্গে করে আনলে কেন? এখানে কি বেগমের অভাব হবে? কয়টা চাই ?

মনে মনে জ্বলে উঠলেও মুখে কিছু বলেনি কারতলব খাঁ সে চিরকাল তার মস্তিষ্ককে হিসাব করে ব্যবহার করে বেফাঁস কিছু করে না তবে সে প্রমাণ করতে পেরেছে এতদিনে, নারীর প্রতি অহেতুক লালসা তার নেই খাদ্য পোশাক-পরিচ্ছদ সুরাকিছুতেই নয় সে মুসলমান অপব্যয়কে সে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে সে খোদাতায়লার প্রতি সমর্পিত প্রাণ সেই পথে যে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে তার ক্ষমা নেই

পথপ্রদর্শককে চলে যেতে বলে নিজেই গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে কারতলব খাঁ বাতির দরকার নেই একাই যেতে পারবে অন্ধকারে চলতে চলতে এক কোণে অস্পষ্ট হাসির শব্দ শুনতে পায় থমকে দাঁড়ায় নারী কণ্ঠের হাসি এই অন্ধকারে? তারই আবাসগৃহে? ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সে কন্যা জিন্নৎউন্নিসা? সে এই অন্ধকারে হাসছে? কেন ? আর কেউ আছে নিশ্চয় চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে কারতলব খাঁয়ের সে ঠিক করে ফেলে তেমন কিছু দেখলে নিজের কন্যাকেও রেহাই দেবে নাএকমাত্র কন্যা বলে নিস্তার পেয়ে যাবে, তা যেন না ভাবে জিন্নৎ দেখেশুনে তার বিয়ে দিয়েছে আফসার তুর্কী বংশীয় এক যুবকের সঙ্গে এসব ব্যাপারে পুরুষদের সে ক্ষমা করলেও করতে পারে কিন্তু নারীদের? কখনো নয় আর এত জায়গা থাকতে তারই আবাসগৃহে ?

কোমর থেকে তরবারি বের করে পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় সে আগে ওই বদমাইশের খুনে অস্ত্রটিকে সিক্ত করে নিতে হবে, তারপরে জিন্নৎ-এর সঙ্গে বোঝাপড়া এমন দেখেশুনে সাদি দেবার পরেও এই অবস্থা?

কিন্তু নিজের মেয়ের ওপর হঠাৎ এই অবিশ্বাস কেন তার? জিন্নত তো কখনো তার চরিত্রের কোনো রকমের দুর্বলতা দেখায়নি পর্যন্ত তবে? হারেমে যুবতী কোনো নারী নেই বলে? থাকবে না কেন? বেগমসাহেবার পরিচারিকারা আছে অন্য বাঁদীরা আছে

চোয়াল শক্ত করে এগোয় কারতলব খাঁ কিন্তু সেই কোণে গিয়ে পৌঁছোবার আগেই অন্ধকারের মধ্যে এক শক্তিশালী পুরুষ তাকে ধাক্কা দিয়ে ছুটে পালিয়ে যায় কারতলব খাঁয়ের চোখ দিয়ে আগুন ছোটে আর সেই আগুনেই বোধহয় দেখতে পায় দেয়ালের কোণে যে নারী তার দিকে বিভীষিকা মাখানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপছে সে তার কন্যা জিন্নৎউন্নিসা নয়একজন পরিচারিকা

চেষ্টা করেও প্রথমে কারতলব খাঁয়ের মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হয় না হাতে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও অন্ধকারের সুযোগে পুরুষটি পালালো

বাঁদীর এত স্পর্ধা!

"সহ্য হয় না তার ওপর এই

যুবতীটির নাম মনে করতে পারে না কারতলব কিন্তু তার নম্রতা সেবা-পরায়ণতায়

তাকে পছন্দই করত সে হয়তো মেয়েটির হাল্কা স্নিগ্ধ সৌন্দর্যই এর কারণ কিন্তু তাই বলে ক্ষমা সে পাবে না বেগমের শত অনুরোধেও নয় তার বেগম তাকে দোষারোপ করতে পারে এই বলে যে তার অতি-মিতব্যয়িতার পাগলামীর জন্যে ধরনের পাপ কাজ প্রাসাদে ঘটতে পারে এত অন্ধকার অনেক কিছুর সুযোগ করে দেয় সে চায় না সুবাদারের আবাসগৃহের মতো তার অট্টালিকা সন্ধ্যা নামতে না নামতেই আলো-ঝলমলে হয়ে উঠুক তার গায়ে মুঘল রক্ত নেই ব্যভিচারের মতো অমিতব্যয়িতাও তার না-পছন্দ

এগিয়ে এসো

মেয়েটি এক-পা দু-পা করে এগিয়ে আসে অন্ধকার চোখে সয়ে গিয়েছিল বলেই তাকে চিনতে পেরেছিল সে আর ওরা অনেক আগে থেকে এখানে ছিল বলে, তাকে দেখতে পেয়েছিল সে দেখার অনেক আগে

কে ওই পুরুষ?

মেয়েটি তার পায়ের কাছে ভেঙে পড়ে তার মুখ দিয়ে অদ্ভুত ধরনের চাপা কাতরোক্তি বের হয় কারতলব খাঁ অর্থোদ্ধার করতে পারে না

চাপা গর্জন করে বলেকে পালালো ?

মেয়েটি মরিয়া হয়ে মাথা ঝাঁকায় বলতে চায় না কারতলব মেয়েটির বাহু বেষ্টনী থেকে তার পা মুক্ত করার জন্যে ছুড়ে দেয় একটি পা পরিচারিকা কেঁদে উঠে মাথা ঝাঁকাতে থাকে তবু সে বলতে চায় না

কারতলব খাঁ ক্রোধে কাঁপতে থাকে যেন সেই বহু-কথিত মুঘল হারমের অনাচার তারও হারেমে ভাবা যায় না অসহ্য তার জীবনের কৃচ্ছ্রসাধন, তার সংযম ধর্মানুরাগ সবকিছুর মুখে এই ঘটনা চুনকালি মাখিয়ে দিয়েছে পরদিন ভোর হবার আগে এই নারীর দেহ বুড়িগঙ্গার অতলে তলিয়ে যাবে সন্দেহ নেই কিন্তু কে ওই অসংযমী পুরুষ? তাকে ধরতে হবে এই নারী জানে

বলবে না?

না না পারব না কিছুতেই না

এভাবে অস্বীকার করছে কেন ?

জিন্নৎ-এর স্বামী সুজাউদ্দিন মহম্মদ খাঁ সম্বন্ধে কানাঘুষা কিছু শোনা যাচ্ছে ছেলেটা ভালো বংশের জেনে জিন্নৎ-এর সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ করেছিল সে তখনো বাংলায় আসেনি তখনো হায়দরাবাদের দেওয়ান সে সেখানে ওর সম্বন্ধে কিছু শোনা যায়নি।। বরং অনেকে প্রশংসা করেছেন কারতলব নিজেকেও একটু গর্বিত ভাবত হাজার হলেও সে তার বংশের উৎস কোথায় সেকথা ভুলতে পারে না পারে না বলে, তার সংকোচ কম নয় বাদশাহী আমলে বাদশাহের স্নেহভাজন হয়েও সে যেন অনেকটা সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে তার দ্বিধা যদিও বাদশাহ ঘুণাক্ষরেও এমন ইঙ্গিত কখনো তাকে দেননি তিনি তাকে পছন্দ করেন বলে দেননি কিন্তু অন্য কেউ যে কোনো সময়ে বলতে পারে কাফের বংশের রক্ত তার ধমনীতে উৎসের কটাক্ষ কেউ যাতে না করতে পারে, তাই সে সাচ্চা মুসলমান হতে চায় মনে মনে সে জানে আলমগীরের মতো ধার্মিক ব্যক্তিও প্রতিদিনের প্রতিটি অভ্যাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার সঙ্গে পারবেন না সে অনেক মুর্শিদকুলি খাঁ-

এগিয়ে এর জন্যে তার গর্ব একটুও নেই ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির আবার গর্ব কী? পরিতৃপ্তিঅপরিসীম পরিতৃপ্তি লাভ করা যায় ধর্মানুসরণে, নিষ্ঠার সঙ্গে সবকিছু পালন করে সে ভাবতে পারে না, তার জন্ম হিন্দু পরিবারে ভাবতে পারে না বলেই ইসলামকে আরও আঁকড়ে ধরেছে মনেপ্রাণে ধর্মের ব্যাপারে কোনো ভাঁওতা নেই, কোনো আপস নেই

বাংলায় এসে জামাতা সুজাউদ্দিন সম্বন্ধে মাঝে মাঝেই নানা কথা শোনা যাচ্ছে কন্যা জিন্নৎকে প্রশ্ন করলে সে চুপ করে থাকে এক পুত্র আর এক কন্যার জন্মদাত্রী হয়েও বোঝা যায় সে সুখী নয় বেগম সাহেবাকে প্রশ্ন করলে বলে, সবাই তোমার মতো হবে তার কী মানে আছে? অদ্ভুত উত্তর কী যেন চেপে যায়

পরিচারিকা চোখের জলে পা ভাসিয়ে দেয় কোনো লাভ নেই নিজের গৃহে অনাচার সে সহ্য করবে না সে জানতে চায় আসল অপরাধী কে কিন্তু মেয়েটি বলবে না কিছুতেই না বলুক

আলো হাতে কে যেন এগিয়ে আসছে বেগমসাহেবা এতক্ষণ আগে ঘোড়া থেকে নেমেও ওপরে উঠছে না বলে বোধহয় কৌতূহলান্বিত হয়েছে বেগমসাহেবা তাই কাউকে না পাঠিয়ে নিজেই এগিয়ে আসছে দাসদাসী পরিবৃত হয়ে থাকার অভ্যাস তার নেই হতে দেওয়া হয়নি নিজে যেমন সে সাধারণভাবে থাকে বেগমকেও তেমনি শিখিয়েছে বাঁদী যারা আছে, তারা অন্য কাজ করে

স্বামীকে অন্ধকারের মধ্যে ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেগমসাহেবা স্তম্ভিত হয়তুমি? এখানে? কী করছ ?

কারতলব খাঁ ভূলুণ্ঠিত পরিচারিকাকে দেখিয়ে দেয়

কে? যে দেখছি মতি কী করছে তোমার কাছে

আমার কাছে আর করার কী আছে? একেই জিজ্ঞাসা করো

মতি এবারে সশব্দে কেঁদে হামাগুড়ি দিয়ে বেগমসাহেবার পা জড়িয়ে ধরে কী! কী হয়েছে !

আমার দোষ নেই বেগমসাহেবা আমাকে লোভ দেখানো হয়েছিল আমি ভুলেছিলাম তাতে

কিছুই তো বুঝতে পারছি না কে লোভ দেখিয়েছিল ?

মতি চুপ করে থাকে বেগমসাহেবা অদ্ভুত দৃষ্টিতে একবার স্বামীর দিকে চায় তার এত বছরের বিশ্বাসের মূলে কি নাড়া লাগল?

.

কারতলব খাঁ গম্ভীর হয়ে বলেআমি সেই কথাটা উদ্ধারের চেষ্টা করছি কে? তোমার কী মনে হয় ?

বেগমসাহেবার মুখ সামান্য একটু বিবর্ণ হয় যেন কিন্তু অত অল্প

বিবর্ণতা কারও চোখে পড়ার কথা নয়

মতি বলুক ওকেই বলতে হবে

না না আমি পারব না বলেও রক্ষা

কারতলব খাঁ সন্দিহান হয় এই জবাবে বলে বলে দিলেও নিস্তার পাবে না? বটে?

এত উঁচুদরের মানুষ?

সেই সময় অন্ধকার ভেদ করে ভূতের মতো আবির্ভূতা হয় কন্যা জিন্নৎউন্নিসা সেই সামান্য আলোয় জিন্নৎ-এর চোখ জ্বলতে থাকে

সে বলেহ্যাঁ, খুব উঁচুদরের মানুষ কত বড় বংশ তোমার তো মনে হয়েছিল বুঝি তোমার ধমনীতেও তুর্কী রক্ত বইতে শুরু করবে

কারতলব খাঁ চেঁচিয়ে ওঠেকী বলছিস তুই? এসব কথার মানে কী ?

মানে খুব স্পষ্ট আমি সন্দেহ করেছিলাম, মতির সঙ্গে তোমার জামাতার কথা বলার ধরনে অনেকদিন আগেই সন্দেই করেছিলাম টোপ অনেকদিন আগেই ফেলেছিলসত্যি! সুজাউদ্দিন !

কারতলব খাঁয়ের মুখের ওপর কেউ যেন একখাবলা কালি নিক্ষেপ করে নিজেকে বড় দুর্বল বলে মনে হলো তার আজ যদি সুজা না হয়ে তার নিজের ছেলে হতো? হ্যাঁ, তাহলে কঠোর শাস্তি দিতে পারত কিন্তু জামাতার ওপর কি মানুষের টান বেশি থাকে? না, থাকে না তবু বোধহয় কন্যার অসহায়তার কথাই সব পিতার অন্তরে বড় হয়ে দেখা দেয়

সেই রাতেই সবাই জেনে গেল হারেমে কোনো সন্দেহজনক চরিত্রের নারীর স্থান নেই এমন কি কোনো অল্প পরিচিত নারীও হারেমে প্রবেশ করতে পারবে না বিশ্বস্ত পুরাতন খোজারা ছাড়া অন্য কোনো খোজাও ভেতরে আসতে পারবে না ভবিষ্যতে

সুজাউদ্দিন কিছুদিন সবাইকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলল তবে মতি বাঁদীর দেখা কেউ পায়নি সেই রাতের পরে তার কথা কেউ আলোচনাও করে না আর শুধু জিন্নৎ মনে মনে নিজেকে অপরাধী ভাবে সে সুজাউদ্দিনকে হাড়ে হাড়ে চেনে মতির সাধ্য ছিল না তাকে অস্বীকার করা প্রথমত সুজা ভীষণ রকমের সুপুরুষ, তার ওপর তার প্রভাব প্রতিপত্তি মতির মতো রূপসী রমণীকে প্রলুব্ধ করবেই এক সময় না এক সময়ে তাই ওভাবে সব বলে না দিয়ে বরং মতিকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে পারত তাহলে তাকে পাতালপুরীর ওই গুপ্ত প্রকোষ্ঠে দিনের পর দিন না খেয়ে শুকিয়ে মরতে হতো না এর চেয়ে নদীর জলে হাত পা বেঁধে ডুবিয়ে দেবার যে মতলব তার বাবা প্রথমে করেছিল সেটাই ভালো ছিল এত জানাজানি হতো না তার ছেলে আসাদউল্লা আর মেয়ে নাফিসা পর্যন্ত জেনে গিয়েছে আসাদউল্লার ভাবগতিক দেখে মনে হয় বাপের মতো দুশ্চরিত্র হবে তার মনটা নরম বলে, যাকে তাকে জাপটে ধরতে পারবে না ভীতু প্রকৃতির লুকিয়ে লুকিয়ে সুন্দরী বাঁদীদের দেখে চোখে চোখ পড়লে লজ্জা পেয়ে যায় এককথায় ওটা একটা অপদার্থ তবে নাফিসা সাধারণ হয়েছে কিন্তু একেবারেই ছোট এখনো পরে কী হবে কে জানে !

নক্দি ফৌজের দলপতি আবদুল ওয়াহেদ চালাক চতুর মানুষ

খুব সে তো আর সাধারণ সিপাই সামন্ত নয় যে বেতনের ঠিক-ঠিকানা নেই তার ফৌজ পেটে গামছা বেঁধে যুদ্ধ বিগ্রহ করে না ফেল কড়ি মাখো তেল

সৈন্য সামন্তদের চেয়ে তাদের পার্থক্য সেইখান ব্যাপার সব অন্য সাধারণ

তবু কি আশা মেটে? সাধারণ মানুষ যারা

নানা কাজকর্ম করে খায়, তাদের ভয় দেখিয়ে চাপ সৃষ্টি করে নানান্ ভাবে অর্থ উপার্জনের

ফিকিরে থাকে দলের কিছু লোককে সঙ্গে নিয়ে সে তাই অবসর সময়ে নগরে এবং নগরপ্রান্তে ঘুরে ফিরে বেড়ায়

তাঁতী আর জোলা পাড়ায় ঘুরছিল ওয়াহেদ্ একদিন ঘরে ঘরে তাঁত ডুগডুগ ফটাশ ফটাশ করে তাঁতের শব্দ, মাকুর ছোটাছুটির আওয়াজ প্রতি ঘরে কোথাও ঝপট্ তৈরি হচ্ছে কমদামি ডুরে শাড়ি আর গামছা, কোথাও উঁচুদরের জামদানী, নয়নসুখ আর তেরিন্দাম সেখানে তাঁতের শব্দ অমন উদ্দাম নয় অতি সতর্ক শব্দ, কোনো তাঁতে তৈরি হচ্ছে শুধু শিরবান্ধানি আবার কোথাও ঘরের দরজার চৌকাঠে বসে বয়স্ক তাঁতী অতি যত্নের সঙ্গে মসলিনের ওপর কারুকার্য করছে হয়তো বছরের পর বছর একই কাজ করে যাচ্ছে একখানা কাপড়ের ওপর ওয়াহেদ প্রায় সবারই নাম জানে নাম জানলে কাজ হয় যাদুর মতো নইলে কত্তা, মিয়া বলে মানুষকে বশে রাখা যায় না মসলিন কাপড়ের ওপর যে কাজ করছিল, ওয়াহেদ জানে তাকে বিরক্ত করে কোনো লাভ নেই বরং ঘোর বিপদে পড়বে সে কাপড়টি তৈরি হচ্ছিল খোদ বাদশাহের ছেলে আকবর, যিনি বিদেশে মারা গিয়েছেন তাঁর কন্যার জন্য নগরীর সবাই জানে সেকথা দাম পড়বে সাড়ে চার হাজার টাকা উরে আল্লা ভাবাই যায় না যে দেড় টাকা পায় মাসে, সে সারামাস প্রতিটি দিন পোলাও আর কালিয়া খায় আর এই কাপড়ের দাম সাড়ে চার হাজার টাকা ওই টাকায় নাকি পাঁচেট কিংবা শেরগড় পরগনার অনেকটাই কিনে নেওয়া যায় সুতরাং বৃন্দাবন তাঁতীকে না ঘাঁটিয়ে তাকে আপন মনে কাজ করতে দিয়ে সে যায় মোজাহার জোলার ঘরের সামনে

মোজাহার ভাই, কী করছ?

আর বলবেন না বাজার একেবারে খারাপ বিক্রিবাটা কিছু নেই এই দেখুন পাঁচখানা ডুরিয়া করে রেখেছি পড়ে থেকে থেকে শেষে ইঁদুরে কাটবে

তোমার কাছে যখনই আসি, তখনই বাজার খারাপ আর সবাই তো একথা বলে না তোমার ওই জানালা দিয়ে রাস্তাটা অনেক দূর অবধি দেখা যায় আমাকে আসতে দেখলেই তাঁত বন্ধ হয়ে যায় আর বাজার খারাপ হয়ে যায়

ওয়াদেহের কণ্ঠস্বরে উষ্ণতা প্রকাশ পায় তাতে মোজাহার ঘাবড়ে যায় কিন্তু সত্যি সে গরিব ওয়াহেদকে সে বছরে একবার বড় জোর সন্তুষ্ট করতে পারে পোষ্য তার সাত আট জন এক টাকায় আট মন চাউল কিনে আর থাকে কী?

তবু ওয়াহেদ ওয়াক্ থু করে থুথু ফেলে স্থানত্যাগ করে যে পিঁপড়ের পেটে গুড় নেই, সেই পিঁপড়ের পেট টিপে ধরে লাভ নেই বরং হরিশ্চন্দ্র তাঁতীর ঘরে যাওয়া ভালো সে আজকাল নাকি আলবালি আর তঞ্জীব বোনায় খুব নাম করেছে তার ছেলে গোবিন্দ নাকি বেশ হাত পাকিয়েছে

যে হরিশ্চন্দ্র সময় ভালোই কাটছে মনে হয়

গোবিন্দর গা জ্বালা করে এখনি তার বাবা উঠে ঘরের মধ্যে গিয়ে কড়ির বস্তা থেকে এক থলি কড়ি নিয়ে এসে এই বদমাইশটার হাতে দেবে

দেবের

মধ্যে

হরিশ্চন্দ্র মুখে কৃতার্থের হাসি ফুটিয়ে বলেকি ভাগ্য, আপনি এসে গিয়েছেন

অনেকদিন বাঁচবেন

ওয়াহেদ এক গাল হেসে বলেকেন ? কেন ?

আপনার কথাই তো ভাবছিলাম কতদিন দেখিনি ভাবলাম, নিশ্চয় পথ ভুলে গিয়েছেন

না না ভুলব কেন? কত কাজ থাকে সুবাদার সাহেবের কাছের লোক আমরা তা তো বটেই

তা হরিশ্চন্দ্র

আরে কথা পরে হবে গোবিন্দ কী করছিস মুসলমানের হুঁকোটা এগিয়ে দে ছিলিম তৈরি আছে আমি লাগিয়ে দিচ্ছি হুঁকোর মাথায়

না না ওসব এখন থাক তুমি হরিশ্চন্দ্র মানুষটা খুব ভালো

হেঁ হেঁ, আপনাদের কৃপায়

সেই সময় বাইরে অনেক লোকের কথা শোনা গেল ওয়াহেদের দুই সঙ্গী বাইরে মুখ বাড়িয়েই বলে ওঠেবেলায়েৎ আসছে অনেকের সঙ্গে

বেলায়েৎ হচ্ছে নকদি ফৌজের লোক তার এখানে আসার কথা নয় বিরক্ত ওয়াহেদ বাইরে গিয়ে দাঁড়াতেই বেলায়েৎ ছুটতে ছুটতে কাছে আসে তার মুখের চেহারা দেখে ওয়াহেদের বিরক্তি মুহূর্তে অন্তর্হিত হয় পরিবর্তে একটা ভয় বুকের ভেতরটা কাঁপিয়ে

দেয়

বেলায়েৎ বলে ওঠেসুবাদার সাহেবের লোক আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে খবর চলে গিয়েছে, আপনাকে পাওয়া যাচ্ছে না

ওয়াহেদ চেঁচিয়ে ওঠেকে বলল আমাকে পাওয়া যাচ্ছে না এই তো আমি তুমি পেলে না আমাকে ?

ওয়াহেদ তখন রাস্তা দিয়ে ছুটতে আরম্ভ করেছে আর বেলায়েৎ তার পেছনে পেছনে দৌড়োচ্ছে সেইভাবেই ওয়াহেদ চিৎকার করতে করতে বলেওরা বলল, আমাকে পাওয়া যাচ্ছে না, আর তুমি চুপ করে থাকলে ?

আমি তো বললাম, পাওয়া যাবে তাই তো এসেছি

কী করে বুঝলে পাওয়া যাবে? কী করে তুমি জানলে এখানে আসব? কে বলেছে তোমাকে ?

বেলায়েৎ বলেআন্দাজে আগের দিনে নদীর পারে সূত্রধরদের কাছে গিয়েছিলেন, তাই ভাবলাম আজ এখানকার পালা

আগের দিনের খবরও তুমি পেয়ে গিয়েছ?

সেইজন্যেই বলি আমাকেও সঙ্গে নিতে আমি আরও কয়েক জায়গার খবর জানি

-কোথায় ?

সঙ্গে নিলে বলতে পারি

ওয়াহেদ তখনো বেশ জোরে হাঁটছে তাঁতীপাড়ার সব

থেকে উঁকি দিয়ে মানুষ

কৌতূহলান্বিত হয়ে দেখছে সবাই ওর মৃত্যু কামনা করে ব্যাটাকে সুবাদার সাহেব বরখাস্ত

করলে বেশ হয় কিংবা শুলে দিলে পয়সা নিয়ে নিয়ে ছিবড়ে করে ছাড়লো

বেলায়েৎ-এর কথায় ওয়াহেদ বলেবেশ নেব তোমাকে সঙ্গে

শাঁখারিপাড়ায় চেষ্টা করেছেন কখনো? না

তাই তো বলছিলাম আরও আছে

কোথায় ?

পরে বলব এখন সুবাদার সাহেবকে সামলান মনে হলো খেপে আছেন

শেষ কথাটা বেলায়েৎ বানিয়ে বলল ওয়াহেদ ভাবে জাহাঙ্গীর নগরে তার শত্রুর অভাব নেই তাকে ফুলে ফেঁপে উঠতে দেখে অনেকের চোখ টাটায় কে কী লাগিয়েছে

কে জানে

সুবাদার সাহেবের বাড়ির সামনে এসে সে থমকে দাঁড়ায় সামনে ফটক সে পেছনে তাকিয়ে দেখে বেলায়েৎ আর দলের অন্যেরা দূরে দাঁড়িয়ে আছে বেলায়েৎ ইসারা করে বলে ভেতরে ঢুকে যেতে লোকটা ভীষণ চতুর

সেই সময়ে আজিমউদ্দিনের খাস কর্মচারী মফিজউদ্দিন তাকে দেখতে পেয়ে দ্রুত এগিয়ে এসে বলেকোথায় ছিলেন এতক্ষণ আপনাকে বহুক্ষণ থেকে খোঁজা হচ্ছে

মফিজউদ্দিন এমন কিছু উঁচু পদের মানুষ নয় কিন্তু আজিমউদ্দিনের কাছের লোক বলে সবাই তাকে সমীহ করে ওয়াহেদও করে মফিজউদ্দিনও ব্যাপারে খুব সচেতন সে জানে বর্তমান সুবাদার যদি বাংলা মুলুক ছেড়ে চলে যায় তাহলে তাকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করা হবে

ওয়াহেদকে আজিমউদ্দিনের কাছে পৌঁছে দিয়ে মফিজ চলে যায় শরীরের ওপরের অর্ধাংশ সোজাভাবে সামনে ঝুঁকিয়ে ওয়াহেদ কুর্নিশ করে আজিমউদ্দিন স্থিরভাবে তার দিকে চেয়ে থাকে ওয়াহেদ তার অপরিচিত নয়, কিন্তু আজ তাকে প্রথম অভিনিবেশ সহকারে দেখল এবং বুঝল লোকটা ক্রুর, খল তাকে দিয়ে সব কিছু করিয়ে নেওয়া যায়নক্দি সিপাহীদের টাকা-কড়ি ঠিক মতো দেওয়া হচ্ছে? আমি বলছি কি দেওয়ান গড়িমসি করছেন না তো ?

ওয়াহেদের মনের ভেতরে খটকা লাগে আবার কেমন কথা? এই রকম ওস্তাদ দেওয়ান সাহেবের ওপর সন্দেহ হয়েছে? নাকি তাকে যাচাই করতে চাইছেন সুবাদার সাহেব দেওয়ান সাহেবের কৌশল কি না কে জানে

সে বলেআমাদের কোনো অসুবিধা নেই এই দেওয়ান সাহেব আসার পর থেকে সেই দিকে আমরা নিশ্চিন্ত

তাই নাকি? আমি যদি বলি তোমাদের ঠিকমতো পাওনা দেওয়া হচ্ছে না? তাহলে তোমার কী বলার আছে?

ওয়াহেদের হেঁচুকি ওঠার অবস্থা সুবাদার সাহেবের মনের ভেতরে

দেখে নিতে পারত সেটা যখন সম্ভব নয় তখন না-ছুঁই পানি

একবার যদি

হবে

সে সম্ভ্রমের সঙ্গে বলেআপনি খুদাবন্দ যখন একথা বলছেন, তখন সে কথা ঝুট্ হবে

কী করে ?

ঠিক তাহলে তুমি বলছ যে দেওয়ান সাহেব তোমাদের পাওনা গণ্ডা ঠিক মতো দিচ্ছেন না

ওয়াহেদের মনে প্রবল দ্বন্দ্ব সুবাদার সাহেব তাকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিতে চান তারপর একবার যদি সে স্বীকার করে তাহলে দেওয়ান সাহেবের কানে যাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে তার নোকরি খতম্

সে জবাব দেবার আগে এদিক ওদিক ইতস্তত চাইতে থাকে আর সেই সময় সুবাদার সাহেবের পেছনে একটি সুদৃশ্য চিক-এর আড়ালে নারীর একজোড়া চক্চকে চোখ নজরে পড়ে আর সেই নারীর নির্দেশে একজন দাসী চিকের বাইরে একটু এসে ওয়াহেদকে ইসারা করে স্বীকার করে নিতে বলে

সে ভাবে, বাব্বা ক্রীতদাসীর রূপেই মাথা ঘুরে যায় এদের যৌবন কি আর হেলায় অস্তমিত হয়? নিমক ঝাল চাটনির মতো বাদশাহের আত্মজনের ভোগে লাগে চিকের আড়ালে ওই চক্চকে চোখের অধিকারিণী নিশ্চয় বেগমসাহেবা সুতরাং তাঁর নির্দেশ পাওয়া গিয়েছে এখন মাথা নীচের দিকে করে ঝাঁপিয়ে তাকে পড়তেই হবে অন্যপথ নেই সে বলেদেওয়ান সাহেব কি আর আমাদের দিকে নজর দেন? তাহলে ভাবনাই থাকত না

এই দেওয়ান সাহেব মরে গেলে কেমন হয় ?

ওয়াহেদ এতক্ষণে সব বুঝে ফেলেছে বলে-আমরা নিস্তার পাই আপনি মালিক, আপনিই পারেন ওঁকে এই মুলুক থেকে সরিয়ে দিতে

হ্যাঁ পারি তবে তোমার সাহায্যে

আমি সামান্য

আজিমউদ্দিন ধমকে ওঠেশোনো, যা বলছি ওই কারতলব খাঁয়ের পেছনে লোক লাগাও হ্যাঁ, তোমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত কিছু লোককে লাগাও তারপর সুযোগ মতে, একদিন তাকে রাস্তাঘাটে ঘিরে ধরে চেঁচামেচি শুরু করে দাও, বকেয়া পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে দেবার জন্যে, বুঝেছ?

জরুর, হুজুর কিন্তু তারপরে যে উনি আমাদের আস্ত রাখবেন না

তারপরে কার পরে?

ওই চেঁচামেচি হই-হট্টগোলের পরে?

তারপরে তো দেওয়ান কারতলব খাঁ কবরের নীচে চলে যাবে তোমার লোকেরা ছেড়ে দেবে নাকি ?

ওয়াহেদের মাথা বন্ধ করে ঘুরতে থাকে তার সামনে বসে রয়েছে স্বয়ং বাদশাহ আলমগীরের পৌত্র যেন অবিশ্বাস্য তার মনে হতে লাগল বুঝি মেঝেতে আছড়ে পড়বে অতি কষ্টে সামলে নিয়ে সে মুখের দাঁতগুলো বের করে গদগদ কণ্ঠে বলেএবারে পরিষ্কার বুঝে ফেলেছি খোদাবন্দ

কবে থেকে লোক লাগাচ্ছ ?

-আজ থেকে

কত দিনের মধ্যে কাজ হাসিল করতে

প্রথম সুযোগে

-ব্যস্ যাও

ওয়াহেদ টলছিল দেওয়ান সাহেব কী সাংঘাতিক সে জানে তার গায়ে হাত? তবু উপায় নেই টলতে টলতে সে আজিমউদ্দিনের প্রাসাদ ত্যাগ করে

যেদিন নগরীর বাইরে গিয়েছিল কারতলব খাঁ, যেদিন ফিরতে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, সেদিনই প্রথম নজরে পড়েছিল তার, কে যেন তাকে অনুসরণ করছে ভাবল, হতে পারে কারও কৌতূহল দেওয়ানের পদটি তো নগণ্য নয় তার ওপর মুখসুদাবাদের ফৌজদাসে লোকে হয়তো ভাবে এত যার ক্ষমতা, এত যার অর্থবল সে একা একা এভাবে ঘোরাফেরা করে কেন? ভাবতে পারে সামান্য একটু ক্ষমতা যার আছে, তার বিলাসিতার অন্ত নেই এই নগরীতে অথচ সে খুবই সাধারণ, সঙ্গে দেহরক্ষীও রাখে না

কিন্তু তার পরের দিনও, তার পরের দিনও কে বা কারা তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে সন্দেহ দানা বাঁধে কারতলব খাঁয়ের ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ সে তার ওপর সব ব্যাপারেই সে হিসাবি এক আর একে যে দুই হয় একথা তার অবিদিত নয় সে ধারণা করে নেয়, তাকে হত্যার চেষ্টা হলেও হতে পারে বাংলার রাজস্বের অপব্যয় সে রোধ করেছে যথেচ্ছভাবে লুটপাট করে কেউ নিজের অর্থভাণ্ডারকে আর স্ফীত করতে পারছে না সবাই ফুঁসছে সুবাদার আজিমউদ্দিন বিশেষ করে ভীষণ বেকায়দায় পড়েছে বাদশাহের কাছে কোটি টাকার ওপর অর্থ পাঠাতে সফল হয়েছে সে তার সুনাম বেড়েছে সুতরাং আজিমউদ্দিন ক্রুদ্ধ হবেই

একদিন সন্ধ্যায় নমাজের পরে সে বেগমসাহেবাকে আর কন্যা জিন্নৎউন্নিসাকে ডেকে বলেএমন দিন আসতেও পারে যেদিন আমার বাড়ি ফেরা হবে না

উভয় নারী অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাটার মর্মার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে এই ধরনের ধোঁয়াটে কথা বলার অভ্যেস মহম্মদ হাদি বা কারতলব খাঁযের নেই তাই দুজনাই নীরব কারতলব বলেমনে হয় আমার পেছনে লোক লেগেছে

বেগমসাহেবার প্রশ্নকী জন্যে ?

আমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার জন্যে

অস্বাভাবিক কিছু নয় একথা তোমার না জানার কথা নয় পারস্য দেশ থেকে এসেছ বলে তুমি পারসিক হয়ে যাওনি তোমার মূল যে এদেশে; আমির ওমরাহ সবাই ভালোভাবে সেকথা জানে বাদশাহ যখন তোমাকে হায়দারাবাদের দেওয়ান করলেন, তখনকার দিনের কথা মনে নেই? রাতারাতি বন্ধুরা শত্রু হয়ে উঠল এদেশে এসে তুমি কী ভাবতে আরম্ভ করেছিলে, পুরোনো বন্ধুরা শত্রুতা ভুলে গেল ?

না, সেকথা ভাবিনি

তবে সঙ্গে দেহরক্ষী রাখো না কেন? কতবার বলেছি তোমার

দায়ী থাকবে অন্য কেউ নয়

বেগমসাহেবার মুখে ধরনের কড়া কথা বহুদিন

কন্যার মুখের দিকে চায় সেই মুখ নির্বিকার

হলে তুমিই

কারতলব খাঁ সে এবারে

দেখে মনে হয় আজকাল পৃথিবীর

ওপর তার সমস্ত আকর্ষণ যেন সে হারিয়ে ফেলেছে কেন এমন হয়েছে, এখন অনেকটা

স্পষ্ট সুজাউদ্দিন এককথায় চরিত্রহীন

কারতলব খাঁ ভাবে, সংসারের এই অশান্তি, বিপদ বিরুদ্ধাচরণের মধ্য দিয়ে তাকে ধীরে শান্তভাবে পথ করে চলতে হবে ইসলাম তাকে তাই শিক্ষাই দিয়েছে ক্ষেত্রে সে একাতবু অবিচল

বেগমসাহেবা স্বামীর চোখের মধ্যে কী দেখল কে জানে, চড়া স্বরকে হঠাৎ নম্র করে বলেতোমার গায়ে হাত দেয় কার সাধ্য? তুমি পাঁচ ওত নমাজ পড় তুমি বছরে তিনমাস রোজা করো, তুমি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কোরান নকল করে যাচ্ছ দিনের পর দিন কে তোমার গায়ে হাত দেবে?

তুমি বিশ্বাস করো ?

হ্যাঁ রীতিমতো করি - জিন্নৎ?

জিন্নৎ বেশ কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল তারপর বলেআমি ঠিক জানি না আল্লার ওপর বিশ্বাস রাখা এক জিনিস আর দীর্ঘজীবী হওয়া আর এক জিনিস

বেগম সাহেবা অসহিষ্ণু হয়ে বলেকী বলতে চাস তুই ?

আমি বলতে চাই, খোদাতায়লার প্রতি সমর্পিত প্রাণ হলে নিশ্চয় শান্তি পাওয়া যায় বিপদে শক্তি পাওয়া যায়, সহ্য করার ক্ষমতা সহস্রগুণ বাড়ে তাই বলে আমি দীর্ঘজীবী হবই একথা হলফ করে বলা যায় না

কেন, যায় না ?

আল্লা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অনেক কিছু সাধন করেছেন তাতে আমার ভূমিকা কিছুই নয় তাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখা মনে হয় তাঁর কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নাও হতে পারেযতই আমি সমর্পিত প্রাণ হই না কেন আমাকে দিয়ে তিনি তাঁর উদ্দেশ্য সাধন করলেই আমি কৃতাৰ্থ

তোকে একথা কে বলেছে?

কে আবার বলবে? আমার মন

বেগমসাহেবা উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন---তোর মনটা পচে গিয়েছে

কারতলব খাঁ একহাত উঁচু করে বলে ওঠেআঃ তোমরা থামো

নিজের জীবনের মূল্য অপরিসীম তার কাছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো রাজকোষে অর্থপ্রেরণ অর্থের স্রোতধারা একটু ক্ষীণ হলেই বাদশাহের অনুগ্রহের ধারাও কমে যাবে, একথা সে ভালোভাবে জানে বাদশাহের অনুগ্রহ নির্ভর করে স্বার্থের ওপর তাই সে কোনো বিশেষ বাদশাহের প্রতি আবেগে অনুরাগে আপ্লুত হবে না কখনো বাদশাহ আলমগীর এখন তখত্তাউসে আছেন বলেই তিনি তার মালিক কিন্তু আজই যদি তিনি সিংহাসনচ্যুত হন, তখন তাঁকে আর চিনবে না কারতলব খাঁ যদিও উপাধিটা তিনিই দিয়েছিলেন নতুন যিনি দণ্ড কারতলব খাঁয়ের

সর্বেসর্বা অন্য কাউকে সে চিনবে না সুতরাং সারাজীবন তাকে এই মুলুক থেকে অর্থ প্রেরণের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে গতবারে এক কোটি পাঠিয়েছে, পরে আরও বেশি পাঠাতে চেষ্টা করতে হবে আর সেটা সম্ভব কারণ দূর থেকে বাংলা মুলুককে মনে হয় বুঝিবা পরিত্যক্ত কিন্তু হিন্দুস্থানের কোথাও যদি ব্যবসায়ের ক্ষেত্র থাকে তা হলো

এই দেশ নইলে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে ওই ফিরিঙ্গিরা এখানে এসে ভিড়

করত না

স্বামীকে হঠাৎ চিন্তামগ্ন দেখে বেগমসাহেবা কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে স্থানত্যাগ করে স্বামীর মধ্যে কখনো সে কোনো উচ্ছ্বাস দেখেনি এমন কি যৌবনেও নয় সব সময় মস্তিষ্ক ঠান্ডা প্রতিটি কাজে হিসাব প্রতিহিংসা গ্রহণের ব্যাপারেও তাই কখনো কেউ যদি তার ক্ষতি করে কিংবা শত্রুতা করে, সে নীরব থাকে তার সঙ্গে আগের মতোই স্বাভাবিক ব্যবহার করে এমনকি কখনো কখনো আরও ভালো ব্যবহার করে তারপর কোনো একদিন সুযোগমতো তার ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে সেই প্রতিহিংসা হয় বড় মর্মান্তিক৷ বেগমসাহেবার কাছে তখন মানুষটাকে আর মানুষ বলে মনে হয় না তবু সে মানুষই তাই শত সহস্র গুণের মধ্যে দোষও কিছু কিছু আছে

অবশেষে যে আশঙ্কায় দিন কাটছিল কারতলব খাঁয়ের সেই দিনটি এলো সুবাদার আজিমউদ্দিন যতই তাকে অপছন্দ করুক, তবু সে সুবাদার তার ওপর সে বাদশাহের পৌত্রবলা যায় শাহজাদা তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে কখনো কুণ্ঠিত হয় না কারতলব খাঁ মাঝে মাঝে আজিমউদ্দিনের প্রাসাদে গিয়ে সে তার সম্মান জানিয়ে আসে বাদশাহ টাকা-পয়সার ব্যাপারে তাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন বটে, কিন্তু সুবাদার তো করেননি সুবাদার সবার ওপরে

সেদিনও সে কোরান নকল করার পর পোশাক পরে রওনা হয় একবার ভাবে দেহরক্ষী কাউকে নেবে তারপর আর নেয় না সঙ্গে তো অস্ত্র থাকেই নগরীর প্রকাশ্য পথে সৈন্যসামন্ত নিয়ে কেউ তার ওপর চড়াও হবে না কিন্তু কিছুটা পথ অতিক্রম করতে এক উন্মুক্ত স্থানে তার ঘোড়া মাথা উঁচুর দিকে তুলে হঠাৎ থেমে পড়ে সন্দিগ্ধ হয় কারতলব খাঁ ঘোড়াটি এই ধরনের অদ্ভুত আচরণ যতবার করেছে, ততবারই একটা না একটা কিছু ঘটেছে এক অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে জীবটির নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় সে হয়তো কিছু ঘটতেও পারে সে ঘোড়াটির পেটে পা দিয়ে খোঁচা দেয়, ছোট্ট বেত দিয়ে সামান্য একটু আঘাত করে, তবু সে সামনের ওই সংকীর্ণ গলির ভেতরে প্রবেশ

করতে চায় না

বাধ্য হয়ে অপেক্ষা করে কারতলব খাঁ ওই উন্মুক্ত স্থানটিতে চারদিকে একবার দৃষ্টি মেলে সে কোথাও কেউ নেই তারপর সামনের গলির দিকে নজর পড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে কিছু অস্ত্রধারী সামনের লোকটিকে তো চেনে আবদুল ওয়াহেদ নক্দি সিপাহীদের টাকা-পয়সা সে নেয়

ওয়াহেদ সামনে আর তার পেছনে আরও পাঁচ ছয় জন ওরা কারতলবকে ঘিরে দাঁড়ায়

কী ব্যাপার? এভাবে দাঁড়িয়েছ কেন?

ওরা চোখ রাঙিয়ে বলেজানেন না? মাগনা

পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে দিন সব

নিচ্ছেন, পয়সা কই? আমাদের

ওরা হইচই শুরু করে মুহূর্তে কারতলব খাঁ বুঝতে পারে ওদের উদ্দেশ্য শাহজাদা

শেষ পর্যন্ত ওদের খেপিয়ে তুলল? ওদের আসকারা দিতে হয় কখনো? তাছাড়া ওদের প্রতিটি পাওনা-গণ্ডা মেটানো আছে এটা অজুহাত তাকে হত্যা করার অজুহাত

দাঁতে দাঁত চেপে কারতলব খাঁ তরবারি উন্মোচিত করে বলে ওঠেমেটাচ্ছি তোদের পাওনা-গণ্ডা আয়

প্রচণ্ড বেগে সে আক্রমণ করে আবদুল ওয়াহেদকে হকচকিয়ে যায় সে বর্ম-পরা নেই তার কয়েকজন আহত হতেই ওরা পালায় ওদের মনে বিদ্বেষ ছিল না বলে মরিয়া হয়ে আক্রমণ করতে পারল না কারণ ওদের বেতন খুব নিয়মিত দেওয়া হয়, যা প্রত্যাশা অতীত

ক্রোধে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কারতলব খাঁ ঘোড়া ছুটিয়ে দেয় আজিমউদ্দিনের বাড়ির দিকে আজ একটা হেস্তনেস্ত সে করতে চায় কিছুতেই ছাড়বে না এর জন্যে দিল্লীর মসনদের অমর্যাদা হয়তো কিছুটা হবে কিন্তু এখন নরম হলে অমর্যাদা আরও বাড়বে তাছাড়া তার নিজেরও একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে শুধু দাসত্ব করার জন্যে সে এখানে বসে নেই

আজিমউদ্দিনেরও কপাল মন্দ অন্যান্য দিনে এই সময়ে তিনি হারেমে থাকেন আজ বাইরে এসে ওয়াহেদের প্রতীক্ষা করছিলেন কালকে তাকে কড়াভাবে ধমকে দিয়েছেন অনর্থক সময় নষ্ট করার জন্য ওয়াহেদ আর মাত্র একটি দিনের সময় চেয়ে নিয়েছিল কিন্তু তার পরিবর্তে স্বয়ং কারতলব খাঁকে দেখে সে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে তার পোশাকে ছিটেফোঁটা রক্তের দাগও চোখে পড়ে

কী? দেওয়ান সাহেব! আপনি?

বিশ্বাস হচ্ছে না বোধহয় ভাবছিলেন নক্দি ফৌজের সেই শয়তানটা এসে আপনাকে কুর্নিশ করে দাঁড়াবে হাসিমুখে

মুহূর্তে আজিমউদ্দিন বুঝতে পারে এই তীক্ষ্ণবুদ্ধির মানুষটির কাছে সে ধরা পড়ে গিয়েছে ওয়াহেদ একটা বেআক্কেলে বেকুফ ওর উপর ভার দেওয়া ভুল হয়েছে কিন্তু কারতলব খাঁ-এর মতো মানুষ শিষ্টাচার পর্যন্ত ভুলে গেল? সোজা তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে? অস্বস্তির ব্যাপার

ধমনীর তৈমূর-রক্ত তাকে সংযত করল সে বলেদেওয়ান সাহেব যতই উত্তেজিত হন, শিষ্টাচার ভুলতে আগে কখনো দেখিনি এই জাহাঙ্গীর নগরীর নদীতে বাদশাহী জাহাজ আসলে দেওয়ান সাহেবকে দেখেছি সেই জাহাজকে অবধি সেলাম জানাতে দিল্লীর দিকে মুখ করে বাদশাহকে কুর্নিশ করতে অথচ

ভুল ভেবেছিল আজিমউদ্দিন দেওয়ান সাহেবের ধমনীতে তৈমূর রক্ত না থাকতে পারে কিন্তু তার হৃদয়ে আবেগ উচ্ছ্বাসের বালাই বলতে কিছুই নেই কিন্তু সে আবেগের অভিনয় করতে পারে সময় মতো উচ্ছ্বাসও দেখাতে পারে-

কার্যোদ্ধারের খাতিরে

আজিমউদ্দিনের একেবারে কাছে এগিয়ে

সেটাও কৃত্রিম

খাঁ আজিম বসেছিল একটি

আসনে সামনা সামনি আর একটা আসন ।। সেটি সজোরে টেনে নিয়ে আজিমের ঠিক সামনে বসে সে হাঁটুতে হাঁটু ঠেকে যায় আজিম স্তম্ভিত কিন্তু দেওয়ানের চোখের পাতা

পড়ছে নাএকই দৃষ্টিতে সে চেয়ে থাকে বাংলার সুবাদারের চোখের দিকে সেই চাহনি আর সহ্য হলো না আজিমের তার মধ্যে অপরাধবোধ ক্রিয়া করতে শুরু করে তার চোখের পলক পড়ে

এতক্ষণ যেন এই অপেক্ষাতেই ছিল কারতলব খাঁ সে বলেআমি অনেক সহ্য করেছি আর নয় যদি ভেবে থাকেন এইভাবে শত্রুতা চালিয়ে যাবেন, আজ তার অবসান ঘটাব আমার কাছে ছোরা আছে সেই ছোরা আমূল বসিয়ে দেব আপনার বুকের বাঁ দিকে তারপর না, তারপর আমি আর বাঁচতে চাই না বাদশাহের কাছে আমার ঋণের শেষ নেই তিনি আমার পালক পিতাকে দেওয়ানী দিয়েছেন তাঁর মৃত্যুর পরে আমাকেও সেই পদ দিয়েছেন আপনাকে হত্যা করে আমিও বাঁচব না এই যে ছোরাআপনাকে শেষ করে নিজেও শেষ হবো আজ নিন, প্রস্তুত হন কারতলব খাঁ উঠে দাঁড়িয়ে নিমেষে কোমরের ছোট্ট খাপ থেকে ছোরা নিষ্কাষণ করে আজিমের তৈমুর-রক্ত মনে হলো আবার মাথা চাড়া দিল সে ভীত হয়ে পড়ল না সেইভাবেই বসে থেকে বলেআমি বুঝতে পারছি দেওয়ান আমার অন্যায় হয়েছে আমি আর লোক জানাজানি হতে দিতে চাই না আপনি সব ভুলে যান আমরা দুজনা বাদশাহের প্রতিনিধি হয়ে মিলেমিশে কাজ করব এবার থেকে

আজিমউদ্দিনের অবিচলতা কারতলবকে মুগ্ধ করে সে জানল না, আজিম অবিচলিত থাকলেও আসলে সে ভয় পেয়েছে মরণের ভয় নয় তার ভয় আলমগীর খবর জানলে তাকে ছেড়ে দেবেন না কারতলব খাঁ তাঁর নিজের লোক তাঁর কাজে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা সুবাদার হয়েও তার নেই

কারতলব বলেআমার পেছনে এভাবে আততায়ী লাগিয়ে ছিলেন বলে আমি অশিষ্ট আচরণ করেছি আজ

জানি, দেওয়ান সাহেব ঠিক আছে সব ভুলে যান

সেইদিনই ফিরে গিয়ে কারতলব বাদশাহের কাছে সমস্ত ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে একটি পত্র প্রেরণ করে বিশষ দূত মারফত শেষে সে প্রার্থনা জানায় নিজের মতো স্বাধীনভাবে যখন কাজ করার উপায় নেই তার, তখন বাদশাহ যেন অনুগ্রহ করে তাকে এই কাজ থেকে অব্যাহতি দেন দেশের অন্য কোথাও তাকে যে কোনো কাজে নিযুক্ত করুন তাতেই সে সন্তুষ্ট থাকবে

বাদশাহের কাছ থেকে উত্তর এলো অচিরে তিনি স্পষ্ট লিখেছেন, কারতলব খাঁ তার সমস্ত কাজের জন্য দায়বদ্ধ শুধু স্বয়ং বাদশাহের কাছে পৃথিবীর আর কারও তার কাজে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই সুতরাং সে নিজের খুশি মতো স্বাধীনভাবে যেন কাজ চালিয়ে যায় তিনি তার কাজে অত্যন্ত সন্তুষ্ট

বাদশাহ আলমগীর নিজের হাতে আর একখানা পত্র লিখে

আজিমউদ্দিনকে তিনি লিখলেন : কারতলব খাঁ হিন্দুস্থানের শাহেনশাহের ব্যক্তিগত কর্মচারী তার সম্পত্তির যদি সামান্যতম ক্ষতি হয় কিংবা তার দেহে যদি চুলের মতো আঁচড় লাগে তাহলে আমি নিজে তোমার ওপর প্রতিশোধ নেব, বুঝলে খোকা ?

আজিম পিতামহের পত্র পেয়ে বিমর্ষ হলে প্রতিঠালেন পৌত্র

বুঝতে পারল বাড়তি টাকা রোজগারের পথ আর রইল না অথচ সেই টাকার অত্যন্ত প্রয়োজন বাদশাহের বয়স হয়েছে যে

কোনো সময় অঘটন ঘটে যাবে তখন ভায়েদের মধ্যে যে লড়াই বাধবে তাতে প্রচুর টাকার দরকার হ্যাঁ শুধু টাকা টাকার লোভ দেখিয়ে আমীর ওমরাহদের বশে রাখা যায় একমাত্র টাকাই সৈন্য সংগ্রহে সাহায্য করে টাকা রসদ যোগায় বাদশাহ এটা কী করলেন তিনি কি চান না তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মহম্মদ মুয়াজিম তাঁর মৃত্যুর পরে হিন্দুস্থানের বাদশাহ হোন ? এখন যখন তাঁর প্রিয় পুত্র আকবর আর জীবিত নেই? বৃদ্ধের মনোভাব বুঝতে পারা বড়ই কঠিন চিরকাল নিজের চারদিকে ধোঁয়ার জাল বিস্তার করে রহস্যময় হয়ে রইলেন তিনি

তবু এতসবের মধ্যেও মাঝে মাঝে আজিমউদ্দিন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে চার বছর আগের সেই ঘটনার কথা তাকে বড় বেশি পীড়িত করে সে তখন ঢাকার সুবাদারী গ্রহণের জন্য অগ্রসর হচ্ছিল পথে আফগান বিদ্রোহী রহিম শাহ্-এর অত্যাচার কাহিনী তার কানে এলো রহিম তখন বর্ধমান এবং আশপাশের সমস্ত এলাকা অত্যাচারে জর্জরিত করছিল প্রচুর ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করছিল হত্যা করছিল নির্বিচারে বর্ধমানের মহারাজাও তার সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হলেন আজিমউদ্দিন দেখল রহিমকে পরাস্ত করা তার সব চাইতে বড় কাজ রহিমকে হত্যা করতে পারলে বাংলায় সে সম্মান পাবে তাই সব ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাকে পরাস্ত আর হত্যা করল বর্ধমানের রাজার ছেলেকে পিতার রাজ্য ফিরিয়ে দিল সে ফলে সত্যিই তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হল বাংলায়

সেই সময় সে একদিন তার দুই পুত্র করিমউদ্দিন, আর ফারুকশিয়ারকে পাঠালো সুফী সাধক বায়েজিদের কাছে দুজনেই তখন বলতে গেলে বালক দূর থেকে সাধককে দেখে ফারুক তাড়াতাড়ি তার অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করে বিনয়ের সঙ্গে আনত মস্তকে তাঁর সামনে গিয়ে হাজির হয় আর করিম উদ্ধতের মতো ব্যবহার করল সুফী বায়েজিদ করিমের ওপর চটে গেলেন তিনি ফারুকের হাত ধরে তাকে পাশে বসিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করলেনআজ আমি বলছি তুমি হিন্দুস্থানের অধীশ্বর হবে

সাধককে সঙ্গে নিয়ে ফারুক পিতার কাছে এলো আজিমউদ্দিন একথা সেকথার পর প্রার্থনা জানালেন তিনি যাতে ভবিষ্যতে কোনোদিন বাদশাহ হতে পারেন সুফী বায়েজিদ প্রার্থনা শুনে মর্মাহত হলেন তিনি বললেনআমার জ্যা থেকে তীর ইতিমধ্যেই নিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছে তোমার কনিষ্ঠ পুত্রকে বলে দিয়েছি সে হিন্দুস্থানের শাহেনশাহ হবে আর তো উপায় নেই শাহজাদা

এই দৃশ্য জাগ্রত এবং স্বপ্নাবস্থায় দেখে প্রায়ই আজিমউদ্দিন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন দেওয়ান কারতলব খাঁ-এর ঘটনাও যেন ইঙ্গিতবহ তত্-তাউস অধিকারীর তালিকায় তার নাম কখনো উঠবে না মুঘল বংশের সহস্র সহস্র সন্তান-সন্ততির মধ্যে সে একজন অজানা অচেনা বংশধর হয়েই থাকবে তবু ফারুক যদি কখনো বাদশাহ হয়, যদি তার পিতা মুয়াজিম বাদশাহ হতে পারেন, তাহলে তার নামটাও কখনো

হলেও হতে পারে ভবিষ্যতেএইটুকুই সান্ত্বনা

কারতলব খাঁ মনস্থির করে ফেলে সে আর সুবাদার

সঙ্গে একই নগরী জাহাঙ্গীরাবাদে থাকবে না বিশ্বাস নেই, কখন শাহাজাদার কী মতি হয় হয়তো পথের কাঁটা সরাতে তাকে গায়েবী খুন করে বসবে এই নগর কোনোদিনই তার ভালো লাগে না এখানে বসে সারা বাংলার রাজস্ব আদায়ের অনেক অসুবিধা শহরটি দেশের ঠিক মধ্যবর্তী অঞ্চলে

নয় যাতায়াতে সুবিধা নেই সেই দিক দিয়ে মুখসুদাবাদ আদর্শ স্থান পাশ দিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত যোগাযোগ ব্যবস্থা সুন্দর সেখানকার ফৌজদার সে তার আলাদা সম্মান সেখানে

বেগমসাহেবাকে ডেকে সে তার সিদ্ধান্তের কথা জানায় শুনে বেগমসাহেবা খুশিই হলো জিন্নৎ-এর মুখে বহুদিন পরে এক ঝলক হাসির রেখা ফুটে উঠল কারতলব খাঁ বুঝল, মনে মনে কেউ এখানে নিশ্চিন্তে ছিল না বিশেষ করে জিন্নৎ-এর আনন্দের কারণ স্বামী সুজাউদ্দিন তার পুরোনো পাপ-সংস্পর্শগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, কিছুদিন অন্তত বশে থাকবে

কিন্তু জিন্নৎ কত দিক সামলাবে তারা যখন মুখসুদাবাদে যাত্রার পরিকল্পনা করছিল ঠিক তখনই প্রাসাদ শীর্ষের এক ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে সায়াহ্নের রক্তিম সূর্যালোকে আর এক দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছিল অতি সঙ্গোপনে সেখানে নায়ক হলো কৈশোর উত্তীর্ণোদ্যত এক তরুণ আর নায়িকা হচ্ছে জ্বলন্ত যৌবনবতী এক তরুণী প্রথমজন জিন্নৎ-পুত্র মীর্জা আসাদউল্লা আর অপরজন নীতিনিষ্ঠ কারতলব খাঁয়ের সতর্ক প্রহরাধীন হারেমের আর এক বাঁদীনাম হাসানবিবি

হাসানবিবি বেশ কিছুদিন ধরেই লক্ষ করছে তার প্রতি আসাদউল্লার লোলুপতা বেশ মজা লাগত ভীরু আসাদ এগোতে সাহস পাচ্ছিল না বয়স কতই বা তবু কিছু কিছু তরুণ যেমন প্রথম থেকেই মরিয়া, তেমন নয় এদের নিয়ে খেলা করতে কত সুখ আসলে খেলা করতে এবং নিজে খেলতে বরাবরের আনন্দ হাসানবিবির মনে আছে তার গাঁয়ের তোফাজ্জলের কথা কতই বা বয়স তখন ওই বয়সেই তোফাজ্জুল কী দুর্দান্ত ছিল সে- তাকে যৌবনের স্বাদ প্রথমে পেতে শিখিয়েছিল তারপর সে হাঠৎ কোথায় চলে গেল আর হাসানবিবি উঠতি যৌবন নিয়ে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকল দেশে এলো দুর্ভিক্ষ পেটে অন্ন নেই সাধের যৌবন শুকিয়ে যেতে বসল সে নগরীতে পালিয়ে এসে পাকেচক্রে পড়ল এই হারেমে আজ সে আর স্বাধীন কেউ নয় সে বাঁদী শুধু নয়, সে ক্রীতদাসী কপাল তাকে এপথে এনেছে কিন্তু তাই বলে যৌবন চলে যায়নি এখানেই সে সুযোগ পেয়েছে মতিবিবির কঙ্কাল এখনো পড়ে রয়েছে আরও কত কঙ্কাল পড়ে আছে পাতালের ওই গুপ্ত প্রকোষ্ঠে তার ঠিক নেই এতটুকু অন্যমনস্ক হলে কারতলব খাঁয়ের হারেমের বাঁদীদের অন্য কোনো শাস্তি নেই মতিবিবি কার সোহাগে স্থানকাল ভুলেছিল সে জানে শুধু মতিবিবি তো নয়, হাসানবিবিও তার আদর খেয়েছে চূড়ান্তভাবে তখন মনে হয়েছিল সে তো বাঁদী নয়, সে বাংলার শাহেনশাহ যদি কেউ থাকে তার বেগম কিন্তু বড় ক্ষণস্থায়ী সেই বাস্তবস্বপ্ন অল্পেতেই ভেঙে যায় আবার সে বাঁদী হয়ে যায় আবার ছোটাছুটি বেগমসাহেবার মন রাখতে জীবনটা বিস্বাদ মনে হয়

গিলে ফেলে মধ্যে জমে থাকা ফেলত ঠিক তেমনি আজ

আসাদের ভাবগতিক দেখে সে আজই টোপ ফেলে সঙ্গে সঙ্গে আসাদউল্লা ছেলেবেলায় বর্ষার পরে সে দেখেছে গাঁয়ের জলে বড়শীর টোপ ফেললে টাকি মাছ সঙ্গে সঙ্গে

তাকে ওপরে চলে আসতে

কিছুক্ষণ আগে তাকে একা পেয়ে আলগোছে হাতের বলে, নিজেও যতটা কমনীয় ভঙ্গিতে উঠে এলে বাচ্চা ছেলের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া যায় সেইভাবে উঠে এসে এই ঘরে ঢুকেছে একটু পরেই ছায়াপাত সেইদিকে চেয়ে দেখে

উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠেছে তরুণ হাসানবিবি তখন ওখানকার শক্ত কাঠের শয্যায় গা এলিয়ে দিয়ে ওকে কাছে ডাকে এগিয়ে আসে

বসবেন না?

আসাদ বসে তাকে আড়ষ্ট দেখায়

হাসানবিবি তার হাত দুখানা টেনে নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরে কি রকম কেঁপে ওঠে আসাদ হাসানবিবি তাকে দুহাতে জাপটে ধরে বুকে টেনে নেয় তাকে চুমু খায় কতবারতুমি আমাকে খাবে না চুমু?

আসাদ খেপে ওঠে চুমুতে ভরিয়ে দেয়

এবারে হাসানবিবির মধ্যে আগুন ধরে ছয় মাস আগে ছেলেটির বাবা তাকে কতভাবে আনন্দ দিয়েছিল সেদিন সে ছিল নিশ্চেষ্ট তার করার কিছুই ছিল না আর আজ তাকেই সব করতে হবে হ্যাঁ সময় বড় কম সে আসাদকে ছাড়িয়ে ছুটে গিয়ে দরজায় খিল দিয়ে আসে তারপর বিবস্ত্র হয়ে বলেআমাকে তোমার ভালো লাগছে ?

খুব

তবে চুপচাপ আছো কেন ?

হাসানবিবি দরজা বন্ধ করে দিলেও, অতিরিক্ত উত্তেজনায় পাশের ছোট জানলাটা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল স্নেই জানালার দিকে পড়ন্ত রোদের মধ্যে এগিয়ে আসে আর এক মূর্তি সন্তর্পণে এক পা এক পা করে দূর থেকে আসাদকে সে চোরের মতো ওপরে উঠতে দেখেছিল কারতলব খাঁয়ের সঙ্গে মুখসুদাবাদে চলে যাবার ব্যাপারে আলোচনা সেরে সে একটু আগেই বের হয়ে এসেছিল

ছাদে আসাদকে না দেখতে পেয়ে তার মনে সন্দেহ জাগে স্বভাবতই ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠের দিকে দৃষ্টি যায় ওখানে কে থাকে সে জানে না কারও থাকার কথা নয় কারণ ওটি হারেমের অন্তর্ভুক্ত বর্ষাকালে হঠাৎ বৃষ্টি এসে গেলে তারা ওখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে মনে আছে কিন্তু এখন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ আসাদউল্লা ওখানেই আছে কী করছে?

এগিয়ে যায় জানালার দিকে প্রতিপদে দ্বিধা যদি তেমন কিছু দেখে কী করবে? শেষে আসাদ এই বয়সেই বাপের মতো হয়ে উঠল? না না, অতটা কি হবে? তো সাহসী নয় সুজাউদ্দিনের মতো ভীতু সবে যৌবন এসেছে, তাই একটু চাঞ্চল্য দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয় সেটাই স্বাভাবিক আসলে সে পুরুষ-নারী তো নয় নারী অপেক্ষা করে, পুরুষ এগিয়ে যায় কিন্তু তাই বলে নোংরামি করবে?

জানালার সামনে গিয়ে ভেতরের দৃশ্য দেখে সে স্তম্ভিত হয় তার কণ্ঠ কে যেন চেপে ধরে সে লজ্জায় সরে আসে তার ছেলে, আর ওই শয়তানী ওকে তো সুজার সঙ্গেও একবার ঘনিষ্ঠ অবস্থায় প্রায় দেখে ফেলেছিল সে সুজা খুব কৌশলে দিলেও বুঝতে মোটেই অসুবিধা হয়নি জিন্নৎ-এর কিন্তু আজ যে

করবে? কাকে দোষ দেবে?

অবস্থা কাটিয়ে নিজের ছেলে কী

জিন্নৎ ছাদের প্রান্তে বসে পড়ে দুহাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে নিঃশব্দে কাঁদে গলা দিয়ে স্বর বের করতে ভয় যদি ওরা শুনে ফেলে? সে কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত দিয়ে বুক চেপে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামে

 

 

 

 

 

 

 

 



Post a Comment

0 Comments