ছােটগল্পকার রবীন্দ্রনাথ :

 


রবীন্দ্রনাথের বড় পরিচয় কবি, বিশ্বকবি। কিন্তু সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তিনি স্বচ্ছন্দ বিচরণ করেছেন। সাফল্যের পরিমাণ হয়তাে সবক্ষেত্রে সমান নয়, তবে কাব্য-কবিতার মতাে ছােটগল্পের ক্ষেত্রেও তিনি সাফল্যের স্বর্ণশীর্ষে আরােহন করেছেন। রবীন্দ্র নাথ বাংলা ছােটগল্পের পথিকৃৎ এবং সার্থক ছােটগল্পকার। সাহিত্যের এই সর্বকনিষ্ঠ তীক্ষ্ণ এবং শক্তিশালী ধারার জনমদাতা রবীন্দ্রনাথ, প্রকৃতপক্ষেছােটগল্প শব্দটির প্রথম ব্যবহার তার কলমেই। সাহিত্য আলােচনা প্রসঙ্গেগাথা কাহিনীউপকথা, রূপকথা, পাঁচালী, গল্প, প্রভৃতি শব্দেরই আনাগােনা ছিল। চরিত্রগত পার্থক্য বােঝাতে বড়জোর বলা হত ছােট ছােট গল্প। কিন্তু ছােটগল্প এই অমােঘ শব্দটি রবীন্দ্রনাথের কলম থেকে ঝরনাধারার মতাে বেরিয়ে বিচিত্র শাখায়, বিচিত্র রূপে বর্ণে গন্ধে, ছন্দ তরঙ্গে পা ফেলে ফেলে অচিরেই প্রমাণ করে দিন সে কনিষ্ঠ হলেও হারাবার জন্যে সাহিত্য প্রাঙ্গণে আসেনি। | রবীন্দ্রযুগের হাওয়ায় অবশ্য ছােটগল্পের সম্ভাবনা কিছুটা ছড়িয়েছিল। কিন্তু যতনি। এই শিল্প রূপটিকে নিজ অভিজ্ঞতায় যথাযথ ভাবে ধরতে না পেরেছেন, ততদিন রবীন্দ্রনা, ছােটগল্প রচনায় আগ্রহ দেখাননি। তার প্রথম দিকের গল্পগুলি আবেগ-আপ্লুত, অপরিণত রচনা। ঘাটের কথা’, ‘রাজপথের কথাতেও ছােটগল্পের আঙ্গিকটি পুরােপুরি ফুটে ওঠেনি এরপরহিতবাদী’, ‘সাধনা’, ‘ভারতী’, ‘সবুজপত্র ইত্যাদি পত্রিকাকে কেন্দ্রর করেই তার ছােটগল্প রচনার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। শিলাইদহে জমিদারী পরিদর্শনে গিয়ে কবি তার রােমান্টিক ধ্যানের জগত থেকে সরাসরি নেমে এসেছেন জীবনের তুচ্ছ, প্রাত্যহিক জীবনের ছােট ছােট সুখ-দুখের সংস্পর্শে। সে যুগের নগর নয় গ্রামই খুলে দিয়েছে তার ছােটগল্পের উৎসমুখ। কাব্যের বৃহৎ দার্শনিক বােধের জগৎ থেকে গ্রাম-জীবনের মুক্ত, ক্ষুদ্র, তুচ্ছ পরিসরে এসে তিনি খুঁজে পেয়েছেন। ছােটগল্পের উপযােগী বিষয় আনন্দ-বেদনা। রবীন্দ্রনাথের ছােটগল্প সাহিত্যকে আমরা নিম্নোক্তরূপে বিভক্ত করতে পারি

) প্রেম বিষয়ক। 

) সামাজিক জীবনের সম্পর্ক বৈচিত্র্য বিষময়। 

) প্রকৃতির সঙ্গে মানব মনের নিগূঢ় সম্পর্ক বিষয়ক। 

) অতিপ্রাকৃতের স্পর্শ বিষয়ক।

() প্রেম বিষয়ক গল্প :স্মরণাতীত কাল থেকে সাহিত্যের বিচিত্র সৃষ্টিতে প্রেমচেতনা প্রেমভাবনা নানা ছন্দে, নানা গানে উচ্চারিত হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের। যে বিচিত্র গল্পগুলিতে এই প্রেমচেতনা প্রেমভাবনা লীলায়িত হয়েছে, তার মধ্যে একরাত্রি, মহামায়া, সমাপ্তি, দৃষ্টিদান, মাল্যদান, মানভঞ্জন, শেষের রাত্রি প্রভৃতি গল্প বিশেষ উল্লেখযােগ্য। গীতিকবিতার কবিত্বময় প্রকাশভঙ্গিতেএকরাত্রিগল্পটি একটি সঙ্গীতের। মতাে ধ্বনিত হয়েছে। দুর্যোগঘন রাত্রির অন্ধকারে একটি নীরব অথচ অস্থির প্রেমের জ্যোতির্ময় রূপ ধ্রুবতারার মহিমায় বিরাজ করেছে। নায়কগ্যারিবলডি হল না। সরবালাকেও পেল না। তার দুই কুলই গেল। তার পরমায়ুর সমস্ত রাত্রির মধ্যে সেই মন্দ। রাত্রিই তুচ্ছ জীবনের একমাত্র সার্থকতা। মানভঞ্জনগল্পটির প্রধান আকর্ষণ নায়িকা গিরিবালার সৌন্দর্য তার অতৃপ্ত যৌবন-চঞ্চল জীবনের প্রকাশের আকুতি। গল্পের গিরিবালা প্রেয়সী নারীর এক অপরূপ জীবন্ত চরিত্র। মাল্যদানগল্পটিতে হরিণ শিশুর মতাে সরল সহজ সদাচঞ্চল লৌকিক সংস্কারহীন এক বালিকার অন্তরে প্রথম প্রেমের সলজছ বেদনা রবীন্দ্রনাথ মাধুর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন। সমাপ্তি শেষের রাত্রি মৃন্ময়ী। মণি বালিকা বধূ। অন্তরে প্রেম চেতনার আগেই যখন বধূ হয় তখন স্বামীগৃহ আনন্দধাম। হয় না। অবশেষে মৃন্ময়ীর অন্তরে প্রেমের জাগরণ গল্পের সীমার মধ্যেই, আর মণির অন্তরের প্রেমের অরুণােদয় দেখা দেয় গল্পের দিগন্তের পরপারে।

() সামাজিক বিচিত্র সম্পর্কের গল্প : সামাজিক জীবনের সম্পর্ক বৈচিত্রের গল্পগুলির মধ্যে পাইদিদি’, পােস্টমাস্টার, ব্যবধান, দান-প্রতিদান, মাস্টারমশাই, মেঘ রৌদ্র, ঠাকুরদা, যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ, হৈমন্তি, নষ্টনীড়, স্ত্রীর পত্র প্রভৃতি। এই শ্রেণির গল্পগুলির মধ্যেদিদিগল্পটির কথা সর্বপ্রথমে মনে পড়ে। পিতৃপরিবারের অসহায় ছােটভাইকে আশ্রয়। করলে শশীমুখীর সঙ্গে স্বামীর দ্বন্দ্ব এই গল্পের অম্লমধুর দাম্পত্য সম্পর্কের পরিচায়ক।মেঘ রৌদ্রগল্পটিতে শশীভূষণের সঙ্গে গিরিবালার সম্পর্ক একটি মধুর অনিশ্চয়তায় ম্লান ছায়া মণ্ডিত হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক সামাজিক পটভূমি।দেনা পাওনা, যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ, হৈমন্তীতে রয়েছে পণপ্রথা, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার করুণ রসঘন চিত্র। স্ত্রীর পত্রগল্পে মৃণাল নারীত্বের যে মহিমা ঘােষণা করে তারই প্রতিধ্বনি আমরা পাইপলাতকাকাব্যেরমুক্তিকবিতায়

(3) প্রকৃতির সঙ্গে মানব মনের নিগুঢ় সম্পর্ক বিষয়ক গল্প : প্রকৃতি প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির পটভূমিকায় মানবজীবনের প্রেক্ষাপটে প্রকৃতিকে দেখেছেন নানাভাবে, নানা গানে। এই পর্যায়ের গল্পগুলির মধ্যে সুভা’, ছুটি, অতিথি’, আপদপ্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযােগ্য। রবীন্দ্রনাথের ছুটিগল্পটি পােস্টমাস্টারগল্পটির উলটোপিঠ। দুটিই বেদনাদায়ক। তবে বেদনার রূপ আলাদা, কিন্তু স্বরূপ এক। সুভা' গল্পটি মূক-বধির বিশালাকার জীবনের বিরাট বিশ্বপ্রকৃতির এক বিচিত্রঅন্তরঙ্গতার স্পর্শ আমরা অনুভব করি। অতিথিগল্পের তারাপদও প্রকৃতির কোলে ষড়ঋতুর মতােই এক ক্ষণিকের অতিথি।

() অতিপ্রাকৃতের স্পর্শ বিষয়ক গল্প :রবীন্দ্রনাথের অতিপ্রাকৃত বিষয়ক গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল, ‘নিশীথে’, মণিহারা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, জীবিত মৃতপ্রভৃতি।নিশীথেগল্পটিতে দ্বিতীয়বার বিবাহিত স্বামীর প্রথম স্ত্রীর ব্যাকুল প্রশ্ন কে, কে, কে গাে! এবং জীবিত মৃতগল্প কাদম্বিনীর বিড়ম্বিত জীবন, জীবিত হয়েও মৃত। এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্পক্ষুধিত পাষাণ’ De Quincey's Dream Visions -ছাড়া এর জুড়ি মেলা ভার। সর্বোপরি বলা যায়, বাংলা ছােটগল্পের পত্তন, লালন পালনের কাজ করে গেছেন তিনি। আমাদের জগৎ-জীবনের নানা সমস্যা অনুভূতি উপলব্ধি নিয়ে গল্প লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। গল্পের শিল্পরীতি এবং বিন্যাসও উচ্চমানের। চরিত্রের বিবর্তন, নাটকীয় সমাপ্তি, অতিপ্রাকৃত উপাদানকে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কাজে লাগানাে, প্রভৃতির উন্মুক্ত পটভূমিকায় মানব মনের বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছােটগল্পকার।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Post a Comment

0 Comments