১৯৩০ এর দশকে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের তোষন নীতি আলোচনা করুন। অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য তোষণ নীতি কতটা দায়ী ? অথবা তোষন নীতির প্রেক্ষাপট আলোচনা করুন?

 

  • ১৯৩০ এর দশকে ব্রিটেন ফ্রান্সের তোষন নীতি আলোচনা করুন। অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য তোষণ নীতি কতটা দায়ী
  • অথবা তোষন নীতির প্রেক্ষাপট আলোচনা করুন?

দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালে যে বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিবিদ ঐতিহাসিক এবং পন্ডিতমহলে যথেষ্ট তর্কবিতর্ক রয়েছে সেটি হল তোষণনীতি। সাধারণভাবে এই ধারণাই প্রচলিত ছিল যে, তোষণনীতি ব্যক্তিগতভাবে চেম্বারলেনের নীতি ছিল। কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়। Anthony Adamthwaite এর মতে তোষণ নীতি অনুযায়ী ইউরোপের চারটি প্রধান রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে ইউরোপীয় শান্তি স্থিতিশীলতা বজায় রাখার কথা ভাবা হয়েছিল। RJ overy তোষণ নীতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, সাধারণভাবে তোষণনীতিকে আগ্রাসনকারীদের তুষ্ট করার একটি দুর্বল পদক্ষেপ হিসাবে মনে করা হয়ে থাকে, কিন্তু এই জাতীয় ধারণা মোটেই সঠিক নয়। overy- মতে তোষণ নীতিকে ইউরোপীয় রাষ্ট্রবর্গের স্বার্থের দ্বন্ধ সংঘাতের একটি সুষ্ঠ সমাধানের প্রয়াস হিসাবে দেখা যেতে পারে। Keth Robin তাঁর গ্রন্থে মিউলিখ চক্তি সম্পর্কে আলোচনা করলেও তোষণনীতি সম্পর্কে তিনি যে বক্তব্য রাখেন তাতে তিনি তথ্যসহকারেই দেখান যে, তোষন নীতির সমর্থক তোষননীতির বিরোধীরা একটি বিষয়ে একই ধরণের মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা হল আর এক যুদ্ধের সম্ভাবনা যতটা সম্ভব বর্জন করা AJP Taylor তাঁর ‘The origin of the second world war' তোষন নীতি সম্পর্কে একটি ইতিবাচক মূল্যায়ন করেছেন। টেইলরের মূল বক্তব্য বিষয় হল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, ইউরোপের কোনো ব্যবস্থাই জার্মাণির অন্তর্ভুক্তি ছাড়া সার্থক হতে পারত না। Taylor দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে এই বিষয়টি দেখানোর চেষ্টা করেছেন। এই দিক থেকে টেইলরের বক্তব্য হল যে, ব্রিটেন ফ্রান্স তোষণ নীতির মধ্য দিয়ে জার্মানিকে অন্তর্ভুক্ত করার যে উদ্যোগ নিয়েছিল তা যুক্তিসঙ্গত ছিল।

তোষণ নীতির সমালোচকরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকেই এই নীতির সমালোচনা করে থাকেন। ঐতিহাসিক লুই নেমিয়াব তোষন নীতির সমালোচনা করে বলেছেন যে, তোষন নীতি হিটলারের আকাঙ্খা পরিতৃপ্ত হওয়ার বদলে আকাঙ্খ আরও বেড়ে যায়। ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হিটলার আরও বেশি মাত্রায় আগ্রাসী হয়ে ওঠে। তোষন নীতির ফলে হিটলারের ধারণা হয় যে, ব্রিটেন ফ্রান্স জার্মাণির আগ্রাসনকে রোধ করার কোনো চেষ্টা করবে না। এইভাবে তোষর নীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য অনেকটাই দায়ী ছিল। তোষণ নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা ছিল এই যে, হিটলারের দাবিদাওয়াগুলিকে মেনে নেওয়া হয়েছিল কিন্তু তার পরিবর্তে জার্মানির কাছ থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা ব্রিটেন ফ্রান্স দাবি করেনি। মরিস কাওলিং তোষন নীতির সীমাবদ্ধতা আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, এই নীতি সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়নি। তাছাড়া তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, অস্ত্রশস্ত্রে সমৃদ্ধ ব্রিটেনের পক্ষে বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতি অনুসরণ করা সম্ভব ছিল এবং এই নীতি ব্রিটেনের বৃহত্তর সাম্রাজ্যের স্বার্থের পক্ষে অনুকূল হত। কাওলিং এর মতে চেম্বারলেন চেকোশ্লাভাকিয়ার স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কোনো ভুল করেননি। বরং তিনি ভুল করেছিলেন ১৯৩৮ চেকোশ্লোভাকিয়াকে গ্যারান্টি প্রদান করে। এই গ্যারান্টি মূলত একটি কৌশলগত ব্যাপার ছিল যার সাহায্যে ফ্রান্সও চেকদের চেকোশ্লোভাকিয়া বিভাজনের বিষয়টি মেনে নিতে রাজি করেছিলেন। কিন্তু এই গ্যারান্টি প্রদানের দরুন ব্রিটেন মহাদেশীয় ব্যাপার তথা পোল্যান্ড গ্রীস রোমানিয়া, তুর্কি প্রভৃতি অঞ্চলের ব্যাপারে জড়িত হড়ে পড়ে। ১৯৩৭-৩৮ চেম্বারলেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে যেভাবে পর্যালোচনা করেছিলেন Adamthwaite নানা কারণে সেগুলির সমালোচনা করেছেন। প্রথমত, জার্মানি ইতালির মধ্যে বোঝাপড়া আপোসের ব্যাপারে চেম্বারলেন অত্যন্ত বেশি মাত্রায় আশাবাদী ছিলেন, কিন্তু সেই অনুপাতে ব্রিটেন তার প্রধান মিত্ররাষ্ট্র হিসাবে ফ্রান্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ততটা আস্থা রাখতে পারেনি। ১৯৩৮-৩৯ ইঙ্গ-ফরাসি সামরিক সহযোগিতা বোঝাপড়া অনেক সমস্যারই সমাধান করতে পারত। শুধু তাই নয় ব্রিটেনের দিক থেকে সাড়া পেলে আমেরিকা ১৯৩৮-৩৯ ব্রিটেনকে অর্থনৈতিক সামরিক দিক থেকে সাহায্য করার পক্ষপাতি ছিল। কিন্তু ব্রিটেন ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ প্রদর্শন করেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে চেম্বারলেনের তীব্র অবিশ্বাস সন্দেহের দরুন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে নাৎসী বিরোধী জোট গঠন করা সম্ভব হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৩৮ এর মার্চে যে চতুঃ শক্তি চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেন সেই ব্যাপারে ব্রিটেন ফ্রান্স উপযুক্ত গুরুত্ব প্রদান করলে হয়তো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভবপর ছিল। R.J. overy তোষণ নীতির সমালোচনা করে বলেছেন যে, তোষণ নীতি সাফল্যমন্ডিত হওয়ার জন্য এই নীতিকে শক্তি প্রতিপত্তির ভিত্তিতে কার্যকরী করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে ব্রিটেন ফ্রান্স দুবর্ল ভিত্তি থেকে ব্যাপারে অগ্রসর হয়। ফলে তোষন নীতি ব্রিটেন ফ্রান্সের উদ্দেশ্য সাধনে সফল হয়নি। তোষন নীতির পিছনে ঐতিহাসিকেরা বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করলেও একথা। কখনোই অস্বীকার করা চলে না যে, তোষণনীতি অনুসরণের ফলে হিটলারের স্ট্যালিনের উদ্দেশ্য লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে এবং যুদ্ধের পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ তাদের এই ব্যাখ্যাতেই অবশ্য পাশ্চাত্য শক্তিগুলির মধ্যে যুদ্ধবাধিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আশা-আকাঙ্খা আত্মবিশ্বাস অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছিল, বিশেষ করে হিটলারের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছিল যে, তার আগ্রাসী কার্যকলাপকে ব্রিটেন ফ্রান্স বিরোধিতা করবেনা। এই কারনেই তোষননীতিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী করেছেন।

Post a Comment

0 Comments