ফরাসী বিপ্লবের উন্মেষে দার্শনিকদের অবদান আলোচনা করুন? অথবা ফরাসী বিপ্লব সংঘটনের পশচাতে অষ্টাদশ শতকের জ্ঞানদীপ্ত দর্শনের ভূমিকা আলোচনা করুন?

 

  • ফরাসী বিপ্লবের উন্মেষে দার্শনিকদের অবদান আলোচনা করুন
  • অথবা 
  • ফরাসী বিপ্লব সংঘটনের পশচাতে অষ্টাদশ শতকের জ্ঞানদীপ্ত দর্শনের ভূমিকা আলোচনা করুন?

                               যেকোনো বিপ্লবের পূর্বে মানুষের চিন্তা বা ভাবজগতে বিপ্লব আসে। ফরাসী বিপ্লবের ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে একদল সাহিত্যিক দার্শনিকদের আবির্ভাব হয়। যারা ফ্রান্সের সমকালিন সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ধর্মীয় জীবনের সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত অনাচার দুর্নীতির তীব্র সমালোচনা করে জাতীয় জীবনে এক বৈপ্লবিক ভাবতরঙ্গের সৃষ্টি করেন। তাদের সমালোচনার ফলেই সাধারণ মানুষ এইসব অনাচার,দুর্নীতি, বৈষম্য এবং এর পাশাপাশি তাদের নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। তাদের সমালোচনার ফলে পুরোনো ব্যবস্থার ভিত শিথিল হয়ে পড়ে। পেশায় আইনজীবি বিশিষ্ট ফরাসি দার্শণিক মন্তেন্ধু ছিলেন বিপ্লব বিমুখ এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক। তিনি বেশ কিছুকাল ইংল্যান্ডে বসবাস করেন এবং ইংল্যান্ডের নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের আদর্শে প্রভাবিত হন। ১৭৪৮ খ্রীঃ প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “The Spirit of Laws' তিনি রাজার ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতার তীব্র সমালোচনা করেন এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষাকল্পে রাষ্ট্রের শাসন, আইন বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ পৃথকীকরণের দাবি জানান এই গ্রন্থখানি পরবর্তীকালে বিপ্লবী শাসনতন্ত্র রচনায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। তিনি ঘোষণা করেন যে, একই ব্যক্তির হাতে সরকারের আইন, বিচার শাসন বিভাগের দায়িত্ব থাকলে ব্যক্তিস্বাধীনতা লোপ পাবে। ' এই গ্রন্থটি এতই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, ১৮ মাসে এর ২২টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তার অপর গ্রন্থদি পার্সিয়াণ লেটার্স'- তিনি ফ্রান্সে প্রচলিত সমাজব্যবস্থা অভিজাততন্ত্র এবং রাজতন্ত্রের বিভিন্ন দুর্বলতা ত্রুটির কঠোর সমালোচনা করেন।

কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, দার্শণিক ঐতিহাসিক ভলতেয়ার ছিলেন সমকালীন ইউরোপীয় সাহিত্য জগতের মধ্যমনি এবং সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল। ভিক্টর হুগো তাঁর সম্পর্কে বলেন যে। ' তিনি মানুষ নন, তিনি একটি শতাব্দি ভলতেয়ার ছিল তার ছদ্মনাম, তাঁর জন্ম প্যারিসে। মন্তেন্ধুর মতো তিনিও কিছুকাল ইংল্যান্ডে অতিবাহিত করেন। তিনি ইংল্যান্ডের সমাজব্যবস্থাকে মুক্ত, সহিষ্ণু প্রগতিশীল বলে প্রশংসা করতেন। প্রগতিবাদী যুক্তিনিষ্ঠ ভলতেয়ার-এর কাছে যুক্তিবিরোধী সকল চিন্তা অসহ্য ছিল। তিনি ঈশ্বরবাদী ছিলেন এবং ঈশ্বর ধর্মের যে, পনীয়তাও তিনি উপলব্ধি করেন। তিনি বলেন যে 'যদি ঈশ্বর না থাকে তবেতাকে সৃষ্টি কারা প্রয়োজন আছে।' ঈশ্বরবাদী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল ক্যাথলিক গির্জা, কারণ তার মতে গির্জা ছিল প্রগতি শিক্ষার পরিপন্থী। ক্যাথলিক গির্জাকে তিনি বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত উৎপাত বলে অভিহিত করেন। তিনি বিদ্রপ শ্লেষাত্মক রচনার মাধ্যমে গির্জার দুর্নীতি, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অনাচার বৈষ্যম্যকে সর্বসমক্ষে তুলে ধরে দেশে এক জাগরণের সৃষ্টি করেন। ফরাসী দার্শনিকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বলিষ্ঠ, জনপ্রিয় প্রগতিশীল ছিলেন জাঁ জেকুইস রুশো, তাঁকে ফরাসি বিপ্লবের জনক বলা হত। তাঁরঅসাম্যের সূত্রপাতনামক গ্রন্থে তিনি দেখান যে, মানুষ সমান অধিকার নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু লোভী স্বার্থপর সমাজব্যাবস্থা তাকে বঞ্চিত করে। এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি প্রচলিত সামাজিক বৈষম্য শ্রেণীগত অত্যাচারের মূলে কুঠারঘাত করেন। ১৭৬২ খ্রীঃ প্রকাশিত তার সর্বাপেক্ষা বিখ্যাতসামাজিক চুক্তি' গ্রন্থে তিনি বলেন যে, জন্মের সময় মানুষ স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত। নানা যুক্তি তর্কের মাধ্যমে তিনি রাজার ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতাকে নস্যাং করে দিয়ে বলেন যে, জনগণই হল রাষ্ট্র সমস্ত সার্বভৌম শক্তির উৎস। ঈশ্বর নন—'জনগণের ইচ্ছানুসারে চুক্তির মাধ্যমে রাজা এই ক্ষমতা পান। এই চুক্তির মাধ্যমেই রাজা সিংহাসনে বসেছেন। সুতরাং তিনি স্বৈরাচারী হয়ে এই চুক্তি লঙ্ঘন করলে প্রজাসাধারণ তাকে পদচ্যুত করতে পারবে।

এই যুগের অন্যতম মনীষি দিদেরো দ্য এলেমবার্ট সমসাময়িক বিভিন্ন পন্ডিতের সহযোগিতায় ৩৫টি খন্ড বিশিষ্ট একটিবিশ্বকোষ' সংকলন করেন। এই গ্রন্থগুলিতে ধর্ম, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, শিল্প, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ের উপর যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনা প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থগুলি ১৭৬১-৮০ খ্রীঃ মধ্যে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থগুলিতে বিভিন্ন দার্শনিকের রচনা স্থান পায়, যা মানুষকে প্রচলিত সমাজ, রাষ্ট্র ধর্মীয় জীবনের ত্রুটি বিচ্যুতি সম্পর্কে সচেতন করে তোলে এই সময়ফিজিওক্রান্টস' নামে শ্রেণীর অর্থনীতিবিদের আবির্ভাব হয়।ফিজিওক্রান্ট’-রা মার্কেন্টহিল মতবাদ, সংরক্ষণ নীতি এবং শিল্প বাণিজ্যে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরোধী ছিলেন। তাঁরা অবাধ বাণিজ্য বেসরকারী শিল্প স্থাপনের দাবি জানান। তাঁদের মতে ভূমিই হল সম্পদের উৎস তাই ভূমির সকল মালিককেই কর দিতে হবে। ফ্রান্সের যাজক অভিজাত সম্প্রদায় বিষয়টি পছন্দ করেনি। কুইসনে ছিলেন এই মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা। এই মতবাদের অপর প্রবক্তা অর্থনীতিবীদ অ্যাডাম স্মিথ, তার ‘The Wealth of Nations ' গ্রন্থে অবাধ বাণিজ্যের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। এছাড়াও লে মেত্রি, কাঁদিলাক, হলবাখ মাবলি প্রমুখ বিশিষ্ট পন্ডিতরা জনগণের চিন্তা চেতনাকে বিপ্লবের নতুন স্তরে পৌঁছে দেন। বস্তুত দার্শণিকরা বিপ্লবী ছিলেন নাতাঁরা বিপ্লবের কথা প্রচারও করেননি। তারা পুরাতনতন্ত্রের ত্রুটিগুলি সর্বসমক্ষে তুলে ধরেছিলেন মাত্র। ফরাসি বিপ্লবের জন্য দার্শনিকদের দায়ী করা হলোঘোড়ার আগে গাড়িকে দাড় করানোর মতো। রুদে বলেন যে, সে যুগে মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভকে সমন্বিত করে একটি ভাবাদর্শ গঠনের জন্য কোনো রাজনৈতিক দল ছিলনা। দার্শনিকরাই সেই ভাবাদর্শ গঠনের কাজটি করেছিল। ঐতিহাসিক উইলার্ট-এর মতে, দীর্ঘদিনের বঞ্চনার ফলে মানুষের আশা-আকাঙ্খা অনুচ্চারিত অব্যক্ত হয়ে মনের মধ্যে গুমড়ে মরছিল। দার্শনিকরা স্বাধীন চিন্তার পথে বাধাগুলি সরিয়ে দিয়ে অস্পস্ট ধারণাগুলিকে ভাষা দিয়েছিলেন।

Post a Comment

0 Comments