কবির ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীল শিল্পী (as person and maker) :
কবির পরিচয় তিনি একজন সৃজনশীল শিল্পী। ব্যক্তি মানুষরূপে কবির ব্যক্তিত্ব তার শিল্পীসত্তার সঙ্গে একই সরলরেখায় অবস্থিত হতে নাও পারে, কারণ ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে বয়ঃক্রম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। পরিণত জীবনে যে অভিজ্ঞতা সে সঞ্জয় করে, তার দ্বারাই গড়ে ওঠে তার ব্যক্তিসত্তা। সৃজনশীল শিল্পীরূপে কবিসত্তার জন্ম এত সহজে হয় না। ব্লেকের ভাষায় বলা যায় 'without practice, nothing is possible'। কবিসত্তার জন্ম সম্ভাবনার জন্য চাই প্রচণ্ড অনুশীলন এবং তা সজ্ঞান প্রচেষ্টা জাত। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে তা নাও হতে পারে, তবে অনুশীলন অপরিহার্য। সরস্বতীর বরে বাল্মিকী বা কালিদাসের কবিত্ব শক্তি প্রাপ্তির গল্প মোটের উপর গল্পই, অনুশীলনের অবশ্যম্ভাবী পরিনাম রূপেই কবিত্বশক্তি তাদের মনোজগতে উদ্ভুত হয়েছিল। ব্যক্তিসত্তাকে বর্জন করে কবিসত্তা (second self) উদ্ভূত হতে পারে না। তবে কবিসত্তা ব্যক্তিসত্তা হতে অনেক বড়, কারণ জটিল মনস্তত্বের সঙ্গে তা সম্পর্কযুক্ত। কবি তার বস্তিজনা হতে স্মৃতি, বোধশন্তি, অভিজ্ঞতা, ভাবাবেগ, অন্তদাই, দ্বিধা এবং চিন্তনের সূত্রগুলি অবলম্বন করে যে বুনন সৃষ্টি করেন, মনস্তাত্বিক জটিলতার টানা পোড়েনে কবির মানসজগতে তা রূপ নেয় অন্যতর এক নতুন রূপে, যা আগে ছিল না বা যা তার ব্যক্তিসত্তা হতে সম্পূর্ণ পৃথক। ওয়ার্ডস ওয়ার্থের ভাষায় বলা যায় 'emotion recollected in tranquility'। কবি কবিতার মধ্যে ব্যক্তিসত্তার অভিজ্ঞতা, জীবন দর্শন প্রত্যক্ষভাবে উপাদান রূপে গ্রহণ করলেও ব্যক্তিসত্তার নিরীখে কবিতা কিন্তু অভিজ্ঞতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, কল্পনা সহযোগে অপর এক জগতের সন্ধান দেয়। ফ্রয়েডের স্বপ্নতত্ত্বের প্রক্রিয়ার মত (the dream work effects a virtually complete transformation of the latent content of the dream-the raw materials-the stimulus-into the mani- fest content) বা কোলরিজের Fancy. Imagination তত্ত্বে যেমন বলা হয়েছে, কল্পনার সহযোগিতায় কবিতা হল চিন্তন, আবেগ, স্মৃতি ও ইন্দ্রিয়দর্শন জাত সমন্বয় রূপের মহা উৎকর্ষতায় অতিক্রমন। রসতত্ত্ব অনুযায়ী প্রাত্যহিক জীবনের লৌকিক ভাবগুলি অলৌকিক রসে পরিণত হয়ে সার্বজনীন হয়ে ওঠে। অন্তপ্রেরণা এবং প্রকাশরূপ এ দুয়ের মধ্যে একটা দূরত্ব অবশ্যই থাকে, কিন্তু তা ঠিক স্থান ও কালের ব্যবধান নয়, এ বিদ্যুদ্বেগের মতই বেগমান। নাইটিঙ্গেলের গান শোনা মাত্রেই কীটসের মনশ্চেতনায় জন্ম নেয় 'Ode to a Nightingale' কবিতা। প্যাশান প্লে দেখেই রবীন্দ্রনাথ ‘শিশুতীর্থ' কবিতা লেখেন। আসলে বিষয়টা concentra tion-এর। এই বস্তুটি যার যত বেশী, তিনি ততই তাড়াতাড়ি কবিতার প্রকাশরূপ দিতে সক্ষম। এই ধরণের চিত্তব্যাকুলতা এবং অসাধারণ শৃঙ্খলার সমন্বয়ে গঠিত ভাষার মাধ্যমে স্বচ্ছন্দ সত্যানুভূতিই কবিতা। বায়োগ্রাফিয়া লিটারারিয়াতে কোলরিজ একেই বলেছেন- 'a more than usual state of emotion with more than usual order' | যে কোন শিল্পই ব্যক্তিমনের সৃষ্টি। ব্যক্তিমনের পৃথকসত্তা আছে বলেই একই বিষয় নিয়ে রচিত কবিতায় দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ধরা পড়ে। একেই বলে কবির মর্জি বা মেজাজ। কবির মনে যেটা সত্য বলে মনে হয়, সেটাই সত্য। কবির বিশেষ মেজাজই তাঁর সত্যদর্শনের ইন্দ্রিয়। ব্যক্তির মেজাজ অপরের থেকে পৃথক বলেই কবিতার দৃষ্টিভঙ্গিও পৃথক হতে বাধ্য। যুগের পরিবর্তনে মেজাজেরও পরিবর্তন হয়। রবীন্দ্র যুগধর্ম ও রবীন্দ্র পরবর্তী কালীন যুগধর্ম এক নয়। বর্তমান কালের খন্ডিত সত্তা অসঙ্গতির খানা খন্দে ভরা। বর্তমান কালের কবি খন্ডিত জীবনবোধকে অখন্ড ভাবরসে পারবর্তিত করে কবিতা সৃষ্টি করেন। সৌন্দর্য সম্পর্কে ধারণাও এযুগে বদলে গেছে। বুদ্ধদেব বসু 'প্রেমিক'
কবিতায় বলেছেন;
“সুন্দর না হলে যদি জীবনের পাত্র হতে কোন ক্ষতি ] নাহি হয়;
সুন্দর হবার গুঢ়, দুরুহ সাধনা ক্লেশকর তপশ্চর্যা
কে আর কলিতে যায় তবে?
তাই তিনি 'শুষ্ক নিশাচর’– 'বাসনার বক্ষোমাঝে কেঁদে মরে ক্ষুধিত যৌবন।' রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর মেজাজের পার্থক্যটা ধরা পড়ে ‘আফ্রিকা' কবিতায়। “দশ্যু পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায় বীভৎস কাদার পিন্ড — আফ্রিকার জন্যে কবির 'এসো যুগান্তের কবি/আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে/দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে,/ বলো 'ক্ষমা করো' – / হিংস্র প্রলাপের মধ্যে/সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।'
‘দময়ন্তী' কাব্যের ‘ছায়াচ্ছন্ন হে আফ্রিকা' কবিতায় বুদ্ধদেব বসু, “হে আফ্রিকা, হে গণিকা মহাদেশ,/ একদিন তব দীর্ঘ বিষুবরেখার শতাব্দীর পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকার/উদ্দীপিত হবে তীব্র প্রসব ব্যথায় আবার জীবনানন্দ এঁদের সকলের থেকে আলাদা, বলেছেন,
'আলো অন্ধকারে যাই মাথার ভিতরে/স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে।' এক বিপন্ন গাম্ভীর্য কে নিয়ে কবির যাত্রা। রবীন্দ্রনাথের মতো উপনিষদীয় প্রজ্ঞা, বিশ্বাস এবং মানবতার প্রতি আশাবাদ জীবনানন্দের ছিল না, কেন না তিনি যে যুগের মানুষ সেযুগে আশা নেই, আছে আশাভঙ্গের আক্ষেপ। কবি বিষ্ণু দের ভাষায় বলা যায়—
'এ নরকে/মনে হয় আশা নেই জীবনের ভাষা নেই'। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
‘পঞ্চ শরে দগ্ধ করে করেছ এ কী সন্ন্যাসী/বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে ব্যাকুলতর বেদনা তার বাতাসে উঠে নিশ্বাসি/অশ্রু তার আকাশে পড়ে গড়ায়ে’। বিষ্ণু দে লিখছেন,
‘পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একি সন্ন্যাসী/বিশ্বময় চলেছে তার ভোজ? মরমিয়া সুগন্ধ তার বাতাসে ওঠে প্রশ্বাসি /সুরেশ শুধু খায় দেখি গ্লুকোজ ।
ইংরাজী সাহিত্যে স্কাইলার্ককে নিয়ে কবিতা লিখেছেন দুই কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও শেলী। ওয়ার্ডসওয়ার্থের স্কাইলার্ক অসীম নীলিমায় অন্তরীন হয়েও মাটির কথা তোলে না। স্বর্গ ও মর্ত্যের প্রভেদ রেখা মুছে দিয়ে সে বিশ্ববাসীকে অপার্থিব গান শোনায়। স্কাইলার্ক হল 'Pilgrim of the sky' কিন্তু শেলীর স্কাইলার্ক 'blithe spirit' বা স্বৰ্গীয় এক আনন্দময় সত্তার প্রতীক। কবিতার শেষ স্তবকে কবির প্রার্থনা,
Teach me half the gladness/That my brain must know Such harmonious madness/From my lips would flow The world should listen then, as I an. listening now'. যুগের পরিবর্তনে মেজাজের এবং মেজাজের পার্থক্যে এক কবির সঙ্গে অন্য কবির পার্থকাটা নেহাৎই ব্যক্তিক। কিন্তু কবিতার সবটাই ব্যক্তিক হলে তা স্মৃতিচারণ হয়, কবিতা হয় না। সার্বজনীন মূল্যবোধই কবিতার প্রাণভোমরা যা ব্যক্তিক এবং নৈর্বান্তিক এ দুয়ের সমন্বয় রূপ। ব্যক্তিসত্তা হতে আসে অনুভূতি এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয় মনন। ব্যক্তিসত্তা ব্যতীরেকে নৈর্বান্তিক প্রকাশ রূপ সম্ভব নয়। ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর 'টিনটার্ন আবে' কবিতায় কবি অস্তগামী সূর্যের মধ্যে, সমুদ্রের প্রশস্ত বক্ষে, নীল আকাশের উদার ব্যাপ্তির মধ্যে, প্রবহমান বাতাসে এবং মানুষের মানসলোকে যে শক্তি পরিব্যাপ্ত দেখেছেন, মননের দ্বারা তাকে তিনি উপলব্ধি করেছেন ঐশী শক্তির পরিব্যাপ্ত রূপে-
*A motion and a spirit, that impels
All thinking things, all objects of all thought
And rolls through all things'.
কিন্তু তাঁর “The Prelude' কবিতায় self examination ও self expression-এর ঝোঁক বেশী থাকায় নন্দনতত্ত্বের দিক হতে প্রেলিউড সার্থকতায় উন্নীত হয়নি, ধারাবাহিকতা রক্ষাই প্রাধান্য পেয়েছে। কোলরিজ অলৌকিকতাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য "the willing suspension of disbelief for the moment'-এর কথা বলেছেন, কেননা তাঁর মতে এই suspension of disbelief-ই তৈরি করে 'the poetic faith'। যুগের পরিবর্তনে অতিপ্রাকৃত পরিবেশ রচনার পটভূমিকা বদলে গেছে।
কবি হলেন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা (seer)। গ্রীকযুগ হতে কবির সম্বন্ধে এইরকম ধারণা প্রচলিত থাকলেও রোমান্টিক যুগে এই ধারণা বদলে যায়। বহির্জগৎ হতে কবিতার উপাদান সংগ্রহ পদ্ধতি কল্পনাতত্ত্বের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়। রোমান্টিক কবিরা ছিলেন অন্তর্মুখীন, স্রষ্টারূপে তারা আত্মলীন বলেই তাদের কাব্য কবিতায় অতিশয্য দোষ দৃষ্ট হয়।
আধুনিক যুগে পুরাতন সব কিছু দ্রুত ইতিহাস হয়ে যায়। নতুন মাত্রা সংযোজিত- হয়, জটিল হতে জটিলতর হয়ে ওঠে মানবিক জীবন যাত্রা, পরিবেশ ও পরিস্থিতি। বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় পুরানো মূল্যবোধের বল্কল খসে পড়ে। মানবতার অবনমন, বক্র ও জটিল মনোবিকলন, সার্বিক অবক্ষয় ও নৈরাশ্যক্ষুদ্ধ যন্ত্রণা হতে কবিরাও রেহাই পেলেন
(the poets are oppressed both by science and society and felt more than usual sense of crisis)। কবিতার রূপ, আঙ্গিক, বিষয়বস্তু, ছন্দ, ভাষা—সব কিছুই বদলে গেল। ভাষা হয়ে উঠল দুর্বোধ্য, ইঙ্গিতবাহী এবং প্রতীকধর্মী। প্রাচীন poetic diction এবং rhetoric-এর নিয়ম কানুন বদলে গেল। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য্যবোধ প্রবল হয়ে উঠল—' পরস্পর সম্বন্ধরহিত যেন মহিমান্বিত এক একটি দ্বীপ। এ যুগের কবি শিরোমনি আয়াল্যান্ডের ইয়েটস এবং ইংরেজ কবি টি এস এলিয়ট।
সিম্বলিজমের জন্মদাতা ম্যালারূশ কবিতাকে বলেছেন, 'a poetry of suggestion from which all prosaic elements are banished. সিবলিজমের ব্যাখ্যা করে Dr. Bowra বলেছেন, 'Poetry has some of direct appeal of music |
ম্যালামের অনুগামী কবি ইয়েটস 'The symbolism of poetry' প্রবন্ধে বলেছেন যে কবির মনে যে ভাবের উদ্রেক হয় তা কথা ও সুরের সমন্বয়ে এক পরিপূর্ণ ভাবের সৃষ্টি করে। ‘When sound and colour and form are in a musical relation to one ancther, they become as it were one sound one colour and one form and evoke an e...tion that is one emotion'.
A. Richards তাঁর ‘The philosophy of Rhetoric' গ্রন্থে বলেছেন, 'A musical phrase takes its character and makes its contribution only with other notes about it, a seen colour is only what it is with respect to the other colours co-present with it in the visual field, the seen size or distance of an object is interpreted only with regard to the other things seen with it. Everywhere in perception we see this intermanimation (or interpenetration as Bergson used to call it). So with words too, but much more, the meaning we find for a word comes to it only with respect to the meaning of the other words we take with it'.
রিচার্ড যে কথাটি বলতে চেয়েছেন তা হল গীতময় শব্দবদ্ধ তার পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সম্বন্ধবিশিষ্ট হয়েই বিশিষ্টতা অর্জন করে। বিশেষ দৃশ্যের কোন বিশেষ রং দৃষ্টিগোচর অন্যান্য রং-এর সঙ্গে নিজের সমন্বয় রূপ প্রকাশ করে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা কবেই কোন একটি বিশেষ বস্তুর আয়তন বা দূরত্ব বোঝা যায়, একেই বার্গস বলেছেন আভেদন। শব্দের ক্ষেত্রেও আমরা বিশেষ শব্দের যে বিশেষ অর্থ পেয়ে থাকি তাও অন্যান্য শব্দের অর্থের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মনের ভাবকে শব্দ মননের প্রক্রিয়ায় চমকপ্রদভাবে প্রকাশ করেছেন ইয়েটস।
* Words for music perhas' ও 'A full Moon in March' কবিতা সংকলন সম্পর্কে কবি বলেছেন, “I wan, them to be all emotion and all impersonal'. 'Whatever stands in field or flood / Bird, beast, fish or man / Mare or stallion, cock or hen/Stands in God's unchanging eye/ In all the vigour of its blood/In that faith I live or die". টি. এস. এলিয়ট লিখেছেন, 'Rahpsody on a windy Night | Rahpsody হল * a musical composition of an enthusiastic nature'. "The lamp sputtered/The lamp muttered in the dark
The lamp hummed'. বাংলা কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুধীন্দ্রনাথ ও বিষ্ণু দে শব্দ, অর্থ ও সুরধ্বনির পারস্পরিক অবিভাজ্যতার নিদর্শন রেখেছেন। শব্দের অর্থ, ধ্বনি ও সুর একত্র সহাবস্থানে ফুটে উঠেছে সংহতির উল্লাস,
বিন ঝাউয়ের ঝোপগুলায় / কালারের দল চরে,
শিং শিলাম শিলার গায়/ডাল চিনির রং ধরে।ঝর্ণা : সতেন্দ্রনাথ দত্ত।
'আজিকে দেহের পালা, রিক্ত সেজে শুয়ে তাই ভাবি হয়তো বা তারই কাছে পড়ে আছে অমবার চাবি।'
উফনী/সুধীন্দ্রনাথ দত্ত 'একটি কথার দ্বিধা থরথর চূড়ে/ ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি।'—শাশ্বতী/অর্কেস্ট্রা জন সমুদ্রে নেমেছে জোয়ার/মেরুচুড়া জনহীন/হালকা হাওয়ায় কেটে। গছে কবে/ লোকনিন্দার দিন।/ হে প্রিয় আমার, প্রিয়তম মোর/আয়োজন কাঁপে কামনার ঘোর।/ কোথায় পুরুষাকার?/অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গীকার।'— ঘোড় ওয়ার/বিষ্ণু দে এ সবই প্রমাণ করে যে কবির ব্যক্তিসত্তা—ইয়েটস থাকে character বলেছেন তার কোন মূল্য নেই, আত্মিকসত্তা বা self-ই মুখ্য—বিশেষ করে কণা, ধ্বনি, সুর প্রভৃতির সমন্বয় ক্ষেত্রে। এলিয়ট বলেছেন যে কবিতায় কবি তার ব্যক্তিত্ব বা personality হতে সরে আসেন। তাঁর মতে 'poetry is not a turning loose of emotion but an escape from emotion, it is not an expression of personality but an escape from personality : কবি কেমন করে কেন্দ্রিয় ভাবটিকে প্রকাশ করবেন তা নির্ণয় প্রসঙ্গে এলিয়ট 'objective correlative'-এর কথা বলেছেন। 'A set of objects a situation, a chair of events which small be the formula of that particrlar emotion' | শেক্সপীয়ারের ‘হ্যামলেট' নাটকে 'objective correlative' অভাব লক্ষ্য করেছেন এলিয়ট এবং তার ফলে হ্যামলেটের মূল কেন্দ্রগত ভাব অপ্রকাশ্য থেকে গেছে। ডঃ উজ্জ্বল কুমার মজুমদার দেখিয়েছেন যে 'একাধারে লেখকের ব্যক্তিত্ব এবং একটি চরিত্রের সমস্যার উপস্থাপক নিরপেক্ষ শিল্প ব্যক্তিত্ব— দুইই হ্যামলেটের সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে। ব্যক্তিত্ব ছাড়া ভাবের নৈর্ব্যক্তিক প্রকাশ কল্পনা করা যায় না বলেই তিনি মনে করেন।
বিচ্ছিন্নতাবাদ নির্ভয় বর্তমান সমাজের অসঙ্গতিপূর্ণ খণ্ডিত সত্তাকেও জীবনপ্রবাহ হতে বিচ্ছিন্ন করে নৈর্ব্যক্তিক শিল্পকলার অখন্ডতায় পরিদৃশ্যমান করে তুলেছেন আধুনিক কবিবৃন্দ। ‘The Waste Land'-এ এলিয়ট যখন বলেন,
What are the roots that clutch,
what branches grow Out of this stony rubbish ? son of man,
You cannot say, or guess, for you know only
A heap of broken images, where the sun beats,
And the dead tree gives no shelter, the cricket no relief,
And the dry stone no sound of water'.
সুধীন্দ্রনাথের কন্ঠে শুনি নেতিবাদী নৈরাশ্যায় একাকীত্ব,
জীবনের সার কথা পিশাচের উপজীব্য হওয়া/নির্বিকারে নির্বিবাদে সওয়া শবের সংসর্গ আর শিবার সদভাব/মানসীর দিব্য আবির্ভাব / সে শুধু সম্ভব স্বপ্নে জাগরণে আমরা নিত্য একাকী।' (নরক) অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় বিষণ্ণতা, “অগন্য ধান-খুশি সোনালি /প্রসন্ন মেঘ/ বিষণ্ণ পুকুর জলে চাঁদের ছায়া ডোবা চাঁদের ছায়া, ডোবা চাঁদের ফালি/মা কথা কননি, আমার মা/ ডালটা বাটতে হবে পুরনো শিশুগাছের।
প্রেমচেতনার অখণ্ডরূপ উদ্ভাসিত হয়েছে বিষ্ণু দের কবিতায় 'দেখি মুহূর্ত বিশ্বে চিরন্তনেরই ছবি
উর্বশী আর উমাকে পেয়েছি এ প্রেমপুটে' (উর্বশী অর্টেমিস)
0 Comments