কবি ও কবিতার বোদ্ধা পাঠক :

 কবি ও কবিতার বোদ্ধা পাঠক :

কবি কবিতা রচনা করেন, পাঠক তা পাঠ করেন। একজন ভাবের প্রকাশ ঘটায়; অন্যজন কবির সামগ্রিক রূপকর্মকে অন্তরমানসে গ্রহণ করে। নিজেকে প্রকাশ করতে চাওয়া মানুষের ধর্ম। কবিও মানুষ, তাই জৈবিক প্রেরণা বশে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেতে চান। তবে কবির এই নিজেকে প্রকাশ করার ইচ্ছাটা সাধারণ মানুষের মত সরাসরি বা প্রত্যক্ষ নয়। কবিতা যেহেতু উপলব্ধির বিষয়, কবি তাই উপলব্ধ সত্যকে প্রকাশ করেন এবং আশা করেন যে পাঠক তাঁর উপলব্ধ সত্যের যথোচিত মর্যাদা দেবে। আশা করার বিষয় আছে বলেই কিছু নীতিও কবিকে মেনে চলতে হয়, যাকে বলা যায় কবির শিষ্টাচার। শিষ্টাচার লঙ্ঘিত হলে কবিও পাঠকের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে। কোন কবিতা অস্পষ্টতার জন্য পাঠকের মনে দাগ কাটতে পারেনা। এই অস্পষ্টতা আবার বিভিন্ন রকমের হতে পারে, যেমন ভাষার অস্পষ্টতার ভাবের অস্পষ্টতার উদাহরণ স্বরূপ কবি কালিদাস রায় এর 'বৃন্দাবন অন্ধকার' কবিতাটি গ্রহণ করা যেতে পারে।

নন্দপুর চন্দ্র বিনা বৃন্দাবন অন্ধকার

চলে না চল মলয়া নিল

জ্বলে না গৃহে সন্ধ্যাদীপ

ছুটে না কলকণ্ঠ সুধা

বৃন্দাবন অন্ধকার

বহিয়া ফুলগন্ধ তার

ফুটে না বনে কুন্দনীপ

পাপিয়া পিক্‌ চন্দনার

চারটি স্তবকে এই কবিতায় ছন্দ-পর্ব মিল ও স্তবক গঠনের শিল্প সৌকর্য একান্তভাবেই নিঁখুত। কৃষ্ণের বিরহে বৃন্দাবনের হাহাকারে ভরা শূন্যতাই কবিতার মূল ভাব। কিন্তু অনুপ্রাসের ঝঙ্কার, ব্যঞ্জণবর্ণের সমারোহ, ছন্দের আন্দোলন, অলঙ্কারের অপ্রতিহত সৌন্দর্য ইত্যাদি কবিতার মূল ভাব অর্থাৎ কৃষ্ণ বিরহে বৃন্দাবনের শোকস্তব্ধতাকে সেভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। মূল ভাবের অনুরণন পাঠকের হৃদয়তন্ত্রীতেও সেভাবে সাড়া তোলেনি। কালিদাসের 'কুমার সম্ভব' কাবের চতুর্থ সর্গে অতনুর বিরহে রতির বিলাপ যে প্রাধান্য পেয়েছে, তার কণামাত্রও এ কবিতায় অনুভব করা যায় না। একেই বলে ভাবের অস্পষ্টতা। তবে কবিতার থীম বৃন্দাবন ও কৃষ্ণ। তাই ভক্তির পাঠকের কাছে ইঙ্গিতটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে এবং ধ্রুব ভাবটি সফল হয়েছে। এটুকু না থাকলে একে কবিতা বলা সম্ভব হতনা।

ঊষাকালকে বলা হয় ব্রাহ্ম মুহূর্ত। এমুহূর্ত রাতের শেষে দিনের সূচযারম্ভ। এই মুহূর্তে সাধক সাধনায় রত হন, গায়ক তানপুরা নিয়ে ভৈরবীর রাগ সাধেন, শিক্ষার্থী। সময়ে গভীর মনোযোগে পাঠাভ্যাস করে। এ মুহূর্ত ৬পলব্ধির আসনে শান্ত, স্নিগ্ধ এ রূপের সামনে ভাবুকের মন আপনা হতেই নত হয়ে যায়। ঊষার অভিজ্ঞতা বর্ণনায় যখন কবি বলেন,‘টং টং টং পাঁচটা যখন বাজল ঘড়িতে / ঝাট ছাড় ঘুমের বাড়ি জাগনু ত্বরিতে মুখে কৌতুক, চোখে কৌতুক, হয়ে উৎসুক অতি/ তেতালাতে হলাম হাজির দেখতে ঊষা সতী।'এখানে কবির মনোভাব স্ফুর্তির, নিসর্গ সৌন্দর্য পিপাসার কোন চিহ্ন নেই। পক্ষান্তরে কৌতুকই যেন এ অভিজ্ঞতার ভাষাময় বর্ণনা। কল্পনা এখানে উপলব্ধির পরিবর্তে কৌতুকময়ী হয়ে উঠেছে। সবটাই কৃত্রিমতার আবরণে আবৃত্ত বলেই কবির সিদ্ধি যথোচিত হয় নি।

সংস্কৃতে বলা হয়েছে 'অপারে কাব্যসংসারে কবিরের প্রজাপতি'। কবি প্রজাপতি ব্রহ্মার মতই স্বাধীন। কলাসম্মত রদবদল ঘটিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষমতা তাঁর অবশ্যই আছে। মনের ভাব প্রকাশের জন্য নতুন শব্দ সম্ভারও তিনি প্রয়োগ করতে পারেন। তবে তাঁর মনে রাখার বিশেষ বার্তাটি W. H. Auden 'The Poet's tongue' গ্রন্থের ভূমিকায় শুনিয়ে দিয়েছেন। 'Similes, metaphors of image or idea and auditory metaphorsSuch as rhyme, assonance and alliteration help further to clarify and strengthen the pattern and internal relations of the experience described'. অর্থাৎ বর্ণনীয় অভিজ্ঞতার মানসগোচর রূপকল্পকে এবং তাদের আতান্তরীণ সম্পর্ককে পরিস্ফুট করতে এবং সুসমৃদ্ধ করতে উপমা, চিত্র ও ভাবের রূপক এবং শ্রুতিগ্রাহ্য অলঙ্কারগুলি যেমন অন্তমিল, অমিল, স্বামিল, অনুপ্রাসগুলি একান্ত ভাবেই ভাব প্রকাশন শক্তি রূপে গণ্য হয়। কবির সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক এতই সংবেদনশীল যে কবির ভুল কথা, ভুল শব্দের প্রয়োগ, ভাব প্রকাশে অস্পষ্টতা এবং সংকেত ও ইঙ্গিতের অশিষ্টতা পাঠকের মনে বিরূপ বা ভুল ধারণার সৃষ্টি করতে পারে। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর 'Preface to Lyrical Ballads' এ কবির সম্বন্ধে বলেছেন “he is a man speaking to men'. অর্থাৎ কবি হলেন একজন communicator। পাঠকের কাছে কবির দায়িত্ব হল তাঁর চিত্তা, অনুভূতি এবং রূপকল্পকে বোধগম্য করে তোলা। কোন কবিই নিজের আনন্দের জন্য লেখেন না, তাঁর সন্মুখে থাকে এক বিরাট সংখ্যক পাঠকগোষ্ঠী যাদের তিনি নিজের উপলব্ধ আনন্দকে ভাগ করে দিতে চান। কবির এই দায়িত্বটি সামাজিক তথা মানবিক। একে তিনি কোন প্রকারেই লঙ্ঘন করতে পারেন না। কিন্তু এ মতবাদের বিপরীত দিকও আছে। কবি কবিতা রচনার সময় পাঠকদের কথা কি মনে রাখতে পারেন? কবির এই পাঠক সচেতনতা কাব্যভাব প্রকাশের বিরোধী পদবাচ্য হতেই পারে, অন্তত প্রকাশরূপ যে এতে ক্ষুন্ন হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ওয়ার্ডসওয়ার্থই লিরিক্যাল ব্যালাডস্ এর ভূমিকায় কবিতার সংজ্ঞা নির্ণয়ে বলেছেন : The clearrings of poetry must flow freely and sponteneously-it can not be made to flow through artificially laid pipes.........Poetry is bor 1, not in the mind, but in the heart overflowing with feeling'. তিনি আরও বলেছেন, 'Poetry is the sponteneous overflow of powerful feeling, it takes its origin from emotion recollected in tranquility'. সুতরাং কবিতা হল প্রধানতঃ mood ও inspiration এর বিষয়। কবি কোন নির্দেশনামা অনুসরণ করে কবিতা রচনা করেন না। কবিতার উদ্ভব সম্পর্কে যে কথা ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন তা হল প্রক্রিয়া। Sensibility র উপর নির্ভর করে কবিতা লেখা যায় না। কবির intuition এবং গভীর অনুধ্যানে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দৃশ্য পট পূর্ণনির্মিত হয়। এর জন্য প্রয়োজন গভীর প্রশান্তি।

ওয়ার্ডসওয়ার্থের । তত্ত্বের মধ্যেই আপাতবিরোধীতার একটা সঙ্গতিপূর্ণ সমাধানও লক্ষ্য করা যায়। কবির ব্যক্তিত্বকে তিনি অস্বীকার না করেই বলেছেন যে কবি সেই সব পাঠকদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন যারা মানব চরিত্রের প্রাথমিক (basic) এবং সার্বজনীন (universal) সত্য সম্পর্কে অবহিত। একজন মহৎ কবির 'comprehensive soul. imaginative power, fancy বা Judgement প্রদানের ক্ষমতা এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা সাধারণ মানুষ অপেক্ষা অনেক উচ্চস্তরের। এর সঙ্গে ওয়ার্ডসওয়ার্থ যুক্ত করেছেন ‘sincerity” অর্থাৎ শিল্প সৌকর্যমন্ডিত করার জন্য দীর্ঘ পরিশ্রম সাপেক্ষ পরিমার্জনা ।

হরপ্রসাদ মিত্র মহাশয় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ' তোড়া' কবিতার দুটি স্তবক উদ্ধৃত করে প্রশ্ন রেখেছেন যে 'দুধের মত' মধুর মত, মদের মত ফুলে' তোড়া হয়ত বাঁধা যায়, কারণ এখানে ফুলের বর্ণ বৈচিত্র্যকেই বোঝাচ্ছে। কিন্তু পরের স্তবকে মধুর মত, মদের মত, দুধের মত সুরে' গান গাওয়া কি সম্ভব? কবি মধু, মদ ও দুধকে যথাক্রমে মিষ্টতা, উন্মাদনা এবং মালিন্য বিহীনতাকে বুঝিয়েছেন। ঐ তিনটের অর্থ এই ভাবে ধরলে কবিতাটি সম্পর্কে আর কোন সংশয় থাকে না। এই বোঝাটাই পাঠকের basic এবং universal সত্য সম্পর্কে জ্ঞান। বিষয় সম্পর্কে কবির কোন পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার নেই—যে কোন বিষয়কেই কবি তার কবিজনোচিত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করেন। তাঁর দক্ষতা সার্থক হয় যখন তিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পাঠককে অনুপ্রাণিত করেন। কবির মনে যে আবেগ সূচিত হয় প্রাথমিক অবস্থায় তা বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকে। emotion recollected in ranquilty তে ওয়ার্ডসওয়ার্থ যে কথাটি বলেছেন, অনুরূপ ভাবেই কবির প্রশান্তির মধ্যে শৃঙ্খলা বিন্যাসের কাজ শুরু হয়ে যায়। অবচেতনে নিহিত বিশৃঙ্খল ভাব সচেতনে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে প্রকাশ পায়।রোমান্টিক কবিদের মধ্যে কোলারিজ যাকে বলেছেন 'The willing suspension of disbelief for the moment', কীটস এর নেগেটিভ ক্যাপাবিলিটি অনেকটা একই ধরণের । উভয় ক্ষেত্রেই কবি কল্পনার ডানায় ভর করে প্রস্থান করেন সুদুর অতীতে বা মধ্য যুগের রহস্যে, সৃষ্ট হয়েছে কবির কল্পলোক। রবীন্দ্রনাথও ফিরে গেছেন বৈষ্ণব কবিদের পদাবলীর যুগে। জ্ঞানদাস লিখেছিলেন :

"রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর/প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর। হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে / পরাণ পুতলি মোর থির নাহি বাঁন্ধে ॥” 'কড়ি ও কোমল'-এ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,

“তোমার নয়ন পানে ধাইছে নয়ন/অধর মরিতে চায় তোমার অধরে তৃষিত পরাণ আজি কাঁদিছে কাতরে/তোমারে সর্বাঙ্গ দিয়ে করিতে দর্শন শুধু জ্ঞানদাসই নন, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস সকলের সৌন্দর্য তত্ত্বেই তাঁর অবাধ গতি। বৈষ্ণব কবিদের ভাব, ভাষাও সঙ্গীতকে আশ্রয় করে লিখেছেন 'ভানু সিংহের পদাবলী', বলেছেন, 'মরণরে তুঁহু মোর শ্যাম সমান'।

অতীত চারিতায় তিনি ফিরে গেছেন উপনিষদের জগতে। উপনিষদের সুরে তিনি ‘অর্ন্তযামী' কবিতায় বলেছেন;

‘অন্তর মাঝে বসি অহরহ/ মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ/ মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ /মিলায়ে আপন সুরে'।

সীমা-অসীমের মেল বন্ধনে উপনিষদ যেমন বলেছে 'পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাব শিষ্যতে', রবীন্দ্রনাথও গীতাঞ্জলীতে তেমনই বলেছেন,

সীমার মাঝে অসীম তুমি/বাজাও আপন সুর, আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ/ তাই এত মধুর।

সেই তিনিই আবার নারী সৌন্দর্যকে রহস্যপূর্ণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন চিত্রা কাব্যের 'বিজয়িনী' কবিতায়

“তারি শিখরে শিখরে/ পড়িল মধ্যাহ্ন রৌদ্র ললাটে, অধরে—

উরু পরে, কটিতটে, স্তনাগ্র চূড়ায়/ বাহু যুগে, সিক্তদেহে রেখায় রেখায় / ঝলকে ঝলকে –

উর্বশী হয়ে উঠেছে বিশ্বের প্রেয়সী। উর্বশী ও লক্ষ্মীকে কেন্দ্র করে দুই নারীতত্বকে বিশ্লেষণ করেছেন।

কোনক্ষণে/ সৃজনের সমুদ্র মন্থনে উঠেছিল দুই নারী/একজন উর্বশী সুন্দরী/বিশ্বের কামনা রাজ্যে রাণী/স্বর্গের অপ্সরী/

অন্যজন লক্ষ্মী সে কল্যানী/বিশ্বের জননী তারে জানি/স্বর্গের ঈশ্বরী।'

উর্বশী ও লক্ষ্মী, প্রেয়সী ও জননী উভয়ের মেলবন্ধনে ফুটে ওঠে নারীর অখত সৌন্দর্য, যার সঙ্গে যোগ আছে সত্য চিন ও সুন্দরের।

তিনিই আবার 'বিশ্বভরা প্রাণের' সুন্ধানী, গেয়েছেন,

“আকাশ ভরা সূর্যতারা বিশ্বভরা প্রাণ/ তাহারি মারবে আমি পেয়েছি মোর স্থান

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার প্রাণ।

‘সোনার তরী”র বসুন্ধরা কবিতায় একই অনুভূতি,

‘আমার পৃথিবী তুমি/ বহু বরষের । তোমার মৃত্তিকা সনে।

আমারে গিলায়ে লয়ে অনন্ত গগনে। অশ্রান্ত চরণে করিয়াছ প্রদক্ষিণ।'

এসবই কবির কল্পলোক যেখানে সুন্দর ও সত্য এক হয়ে যায়। যেমন কীটস

এর হয়েছিল।

'Beauty is truth, truth beauty-that is all'.

সব কবিতাই সকল পাঠক বুঝবে এমনটা নাও হতে পারে কারণ সব কবিতাই কবির একান্ত মানসিক অনুভূতির স্ফুরণ। কবিতার কোন অঙ্ক সম্মত ব্যাকরণ নেই। ভাব যখন শব্দ বন্ধে, এবং সেই শব্দ বা শব্দ বদ্ধ যখন, মনের মাধুর্যে ছন্দোবদ্ধ হয়ে ওঠে তখনই শব্দধ্বনি, ব্যঞ্জনা ও ঝঙ্কারে পাঠক মনে প্রাপ্তির এক পরিপূর্ণতা সৃষ্টি হয় এবং কবিতার অখণ্ড মৌলিকতার অংশীদার হয়ে ওঠে। আধুনিক কবিতা ক্রমেই জটিল ও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠায়, পাঠকেরা কবিতার দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এমন একটা অভিযোগের উত্তরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে কবিতা সকলের জন্য নয়, কবিতা বোঝার জন্য যে বোধ ক্ষমতার প্রয়োজন, তা যাস নেই তার কবিতা পাঠেরও কোন প্রয়োজন নেই। এসব কথার কোন ভিত্তি নেই। কবিতা যেমন রচিত হবে তেমনি পঠিত হবে। তবে আধুনিক যুগের কবিতা নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর মধ্যে সমায়িত নয় বলেই কিছুটা অবয়বহীন। তবু এক বিন্দুর সঙ্গে অপর বিন্দুর একটা ইঙ্গিতধর্মী সহমর্মিতা থাকে, পাঠকের কাজ তা অনুধাবন করা। আধুনিক সময়ে সব খণ্ডিত, সবই টুকরো টুকরো। কবির চোখেও এ সবেরই প্রতিফলন। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছেন যে এ যেন ছুটন্ত রেলগাড়ীর জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা। পিছনে ছুটছে অসংখ্য ছোট ছোট খণ্ডিত দৃশ্য, কিন্তু বহু পিছনে সমগ্রতার এক অস্পষ্ট ছবি। এযুগের নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে নীরেন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছেন :

'পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর নদীর ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আবার তিনি আশাবাদী :

‘গাছমাটি পাথর মেঘ নদীর/সাম্রাজ্য উত্তরে। যাও যাও/আত্মঘাতী ক্লান্তিকে ছাড়িয়ে/ উত্তরা খণ্ডের পথে গিয়ে / এই মূর্খ লাভ ক্ষয়ক্ষতির/ অনিবার্য যন্ত্রনা নেভাও সময়ের সঙ্কট শক্তি প্রত্যক্ষ করেছেন,

“নিশ্চিত কোথাও কোনো ভুল থেকে গেছে/ প্রধান অসুখ নিয়ে কলকাতায় ঘোরে লক্ষ্ণলোক / আজ কিছুদিন হলো তারই মধ্যে বসন্ত এসেছে/প্রত্যক্ষ পলাশে, পাশে মচকুন্দ চাঁপার নোলক/ নিশ্চিত কোথাও কোনো ভুল থেকে গেছে/ ব্যবহারে।

আবার সংহতির মাত্রা এনেছে ত ন্য এক কবিতায় ‘রুপালী মাছ, পাথর ঝরাতে ঝরাতে চলে গেলে একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এনেছেন শব্দের ম্যাজিক।

'নবীন কিশোর তোমাকে দিলাম ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ

তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট আর

ফুসফুস ভরা হাসি।

দুপুরে রৌদ্রের পায়ে পায়ে ঘোরা, রাত্রির মাঠে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা

এসব এখন তোমারই........... (উত্তরাধিকার)

জীবন প্রেমিক কবির আত্মার আর্তনাদ স্পন্দিত হয়।

'ভারতবর্ষের মানচিত্রের উপর দাঁড়িয়ে আমার পথ হারিয়ে যায়।

যেখানে ধানক্ষেত ছিল, সেখানে এখন বারুদের কারখানা।

শূণ্যতা বোধের কান্নায় গুমরে ওঠে অলোকরঞ্জন দাসগুপ্তের মানসিক প্রবনতা, 'আত্মার বয়স কতো, মাঝি ভাই! মধ্যরাত্রে উঠে

রমেন জিজ্ঞাসা করে। তুমি কখনো করপুটে

আত্মা রেখে তার উত্তাপ গ্রহণ করেছ?'

শূন্যতায় প্রতিফলিত হয়েছে মানবিক মূল্যবোধ। 'শুধু রাতের স্বপ্ন নয়' কবিতায় অরুণ মিত্রের লেখনী অস্থির হয়ে ওঠে,

“আদিগন্ত ঢেউ কি সমস্ত দুঃখে নাচায় ? / সন্তানসন্ততির মুখ/ তুমুল জলের উপর ঝুঁকে থাকে/ আমি কি তাদের যন্ত্রনার ছাঁচে দেখি?'

কবিতাকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, নিজেকে নিজের মতো করে দেখার চমৎকার জলদর্পন এক'। ডঃ কুন্তল চট্টোপাধ্যায় এর একটা সহজবোধ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। 'জলের উপর কিছু কম্পন, কিছু তরঙ্গ যখনই প্রতিবিম্ব গুলিকে ভেঙে চুরে তৈরী করেছে রূপ ও ভঙ্গির জটিল নকশা, তখনই দর্পনে আভাসিত হয়েছে বাস্তবতার অতীত, চৈতন্যের অন্তর্লীন রহস্যের চমকপ্রদ সব ছবি'। শক্তি যে সুন্দরের সাধনা করেছেন তাতে আছে প্রেম ও প্রকৃতির যুগ্ম সম্মিলন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর মতে আধুনিক কবিতা লিরিকের স্তর পার হয়ে আসা ভিন্ন ডাইমেনসানের। তিনি মনে করেন গান আর কবিতা আলাদা হওয়াই ভাল। সামাজিক দায়বদ্ধতা কবির থাকা উচিত নয়। আন্তর সৌন্দর্য ও রূপ, রূপের মধ্যে বিষাদ, শ্রেণীবৈষম্য, ধনীর গাড়ি বারান্দায় শায়িত উপবাসী—এসবই তার কবিতার বিষ

এমনি করেই বিষয় হতে বিষয়ান্তরে ছুটে চলেছে আধুনিক কবিতা। একে বোঝার জন্য যেমন বোধশক্তি সম্পন্ন পাঠক প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন কবির বাস্তবো আত্মিক উপলব্ধি। জৈবিকতার ধ্যানে মগ্ন কবির মৌলিক সৃষ্টিও পাঠকদের কাছে মেকি মনে হয়, পাঠক কবিতা পাঠ করে তার নিজের অবস্থানের হদিস খুঁজে পান না। বস্তুনিষ্ঠ বা জৈবিক হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু কোন রকমেই কবিতা যেন প্রাণহীন হয়ে না পড়ে। জটিল জীবন যাত্রায় তা জটিল হতে পারে কিন্তু দুর্বোধ্য বা দুরূহ যেন না হয়। এ প্রসঙ্গে ব্রাউনিং এর 'sordello' কবিতার আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। পত্নীর অনুরোধে *Sordello' বোঝাতে গিয়ে স্বয়ং ব্রাউনিং বলেছিলেন, 'একমাত্র ঈশ্বরই এর ব্যাখ্যা করতে সক্ষম'। ঐ কবিতা পাঠ করে একজন পাঠক এক বর্ণও বুঝতে না পেরে নিজেকে উন্মাদ ভেনে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। পরে তিনি আশ্বস্ত হন এই জেনে যে, অন্য কেউই *Sordello' র অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। অথচ সেই ব্রাউনিং লিখেছেন 'The Last Ride Together' এর মত কবিতা যেখানে প্রেম হয়ে উঠেছে সুন্দর ও শাশ্বত। *Ride, ride together for ever ride?

What if we still ride on, we two With life forever old yet now

Changed not in kind but in degree

The instant made eternity".

যদিও কবি চান পাঠক তাঁর কবিতাকে উপলব্ধি করুক, কবির এই আশা কিন্তু

সহজে পূরণ হয় না। পূরণ না হওয়ার প্রধান কারণ হল পাঠক সমাজ সব সময়েই সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে নিজেদের সীমায়িত করতে চায়। তাঁরা নিজেদের রুচি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সৃষ্টি শিল্পে আসক্ত থাকেন এবং অন্য সব বিষয়ে উদাসীন থাকেন। বিষয় হতে বিষয়ান্তরে ছুটে চলা কবিতার বিষয়বস্তু তাদের আকর্ষণ করে না।এ ছাড়াও বয়সের পরিবর্তনে শৈশবের রুচি পাল্টে যায়। তাদের মার্জিত ও শিক্ষিত এবং প্রবীন মানসিকতাও সব ধরণের কবিতাকে বা সব কবির কবিতাকে সম মর্যাদা দিতে কার্পন্য বোধ করে। তাছাড়া পাঠকেরা সমালোচনার দ্বারাও প্রভাবিত হন। বিকৃত সমালোচনায় তাঁরা আচ্ছন্ন হয়ে মহৎ সৃষ্টি কর্মকেও অবহেলা করেন। কবিতা বোঝার জন্য পাঠককে নিরপেক্ষ ভাবে, যুগ ও সময়কে অনুধাবন করতে হয়। রবীন্দ্রনাথের গোড়ার দিকের কবিতা দেশী ও বিদেশী ভাবনার দ্বারা ব্যঞ্ছিত। ইউরোপীয় সাহিত্য, সংস্কৃত সাহিত্য ও বৈষ্ণব সাহিত্যে পাঠকের পারদর্শিতা না থাকলে এ সময়ের কবিতা সম্যক অনুধাবন করা যায় না। শেষের দিকের কবিতাগুলি উপনিষদীয় ভাবধারায় পৃষ্ঠ। এ ছাড়াও আছে ইতিহাস ভাবনা, সমাজ ভাবনার উপর কবিতা। দুই যুদ্ধের মধ্যেকার সময়ের অবক্ষয়ের রূপ আছে সুধীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেবের কবিতায়। পাঠককে এই সময়কাল অনুধাবন করতে হয়। কবিতা বোঝার জন্য পাঠককেও তৈরী হতে হয়। ফ্রয়েডের স্বপ্ন ও মনোবিকলনতত্ত্ব, পরা বাস্তববাদ, মৃত্যুবের, কীটস, ইয়েটস, রিক্ষে, লোকা, এলিয়ট প্রমুখের প্রভাব, তাঁর ব্যক্তি মানসের যন্ত্রনা ইত্যাদি না বুঝলে পাঠকের পক্ষে জীবনানন্দ বোঝা সম্ভব নয়।

কবিকে যেমন আত্মকেন্দ্রিকতা বর্জন করে, সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা মেনে নিয়ে, দুর্বোধ্যতা পরিহার করে, কবিতার মধ্যে কবিতা বোঝার সূত্র নিবন্ধ করে, পাঠকের প্রতি সহৃদয় বোধ প্রদর্শন করতে হয়, পাঠককেও তেমনই কবিতা বোঝার জন্য কবি ও তার সময়কে বুঝতে হয়। কবিতা রচনা করে কবিতার চাবি পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার দায়িযমন কবির, তেমনই সে চাবির কলাকৌশল বুঝে চাবি খোলার দায়িত্ব পাঠকের।কবি ও পাঠকের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে এ ছাড়া অন্যপথ নেই। নানা পন্থা বিরতে অয়নায় :



Post a Comment

0 Comments