কবি কবিতা লেখেন কেন?

 কবি কবিতা লেখেন কেন? 


কবিতা শব্দধ্বনি, ব্যঞ্জন ঝঙ্কারের সমন্বয়ে যেন এক ধ্রুপদী ঘরাণা যা অখন্ড মৌলিকতায় বিশ্বাসী, ঈশ্বরের বাণীর মত অমোঘ যার উপলব্ধি। সুস্থ মানবতা বোধ ও পরিছন্ন মননের সবল অভিশ্রুতি বহন করে যা ধ্যানমগ্নতায় উত্তরিত। এই উত্তরণ কিছুটা রহস্যমণ্ডিত এবং রহস্য মণ্ডিত বলেই রহস্যের সমাধানে নানা মুনির নানা মত। কিন্তু কোন মতই রহস্যের আবরণ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করতে পারে না, কিছুটা আলোকপাত করে মাত্র। কবিতা রচনার যে প্রক্রিয়ার কথা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে, তার অনেকটাই কবির বুদ্ধিবৃত্তি, মননশীলতা, কল্পনার রং এ রঞ্জিত করার শিল্প দক্ষতা এবং সর্বোপরি এমন একটি ইমেজ তৈরী করার ক্ষমতা যা স্বতঃস্ফূর্ত বা সম্পূর্ণ নতুন, ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। তাই কবিকে কোন নিয়মের গণ্ডিতে বাঁধা যায় না। কবিতার ক্ষেত্রে কবি সার্বভৌম। কিন্তু সার্বভৌম হলেও তাঁকে প্রয়োজনের কথাটাও ভাবতে হয়। তিনি কবিতা লেখেন কেন? লিখে কি লাভ যদি না তা পাঠকদের চিত্ত জয় করে। পাঠক যদি কবির উপলব্ধির ভাবনাকে হৃদয়ঙ্গম করতে না পারে, তাহলে কবিতা রচনাই অসার্থক হয়ে পড়ে। আত্মপ্রকাশের ব্যাকুলতায় কবিতার জন্ম হলেও কবি তাঁর সৃষ্টিকে অপত্য স্নেহে লালন করেন। পুত্রকে লালন ও পালন করার পিছনে পিতা মাতার একটা উদ্দেশ্য থাকে। কবিও তেমনই উদ্দেশ্যের বাইরে নন। কবিতার উদ্দেশ্য বা কাজ নিয়েও গবেষণার অন্ত নেই।

পাশ্চাত্যের অ্যারিস্টোটল আনন্দ প্রদানকেই কবিতার উদ্দেশ্য বলে মনে করতেন। অঙ্কশাস্ত্রে আগ্রহী মেটাফিজিক্যাল মানসদৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্লেটো কবির ecstasy কে আদর্শ রাষ্ট্রের বিঘ্ন স্বরূপ বলে মনে করেছিলেন। তাঁর মতে কবিতার জন্য চাই বিশেষ মনোযোগের ক্ষেত্র অর্থাৎ Particular-এর প্রতি বিশেষ নিষ্ঠার ক্ষেত্র। কবিতাকে তিনি বলেছেন ‘Thrice removed from reality'। কিন্তু অ্যারিস্টোটল মনে করতেন, 'The poetic truth is much higher and universal than that of history and that poetry is more conducive to understanding than philosophy itself. অ্যারিস্টোটল কবিতার মধ্যে universal-এর স্বীকৃতিকে লক্ষ্য করে কাব্যকে বলেছেন ইতিহাসের চেয়ে এমন কি দর্শনের চেয়েও অধিক দর্শন সঞ্জাত। কবিতা বাস্তবের ফটোগ্রাফিক প্রতিকৃতি নয়। কবি particular কে ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেই general-এ চলে আসেন। এই আসাটা নির্ভর করে তাঁর ‘shaping power of imagination'-এর উপর। কবির এই concrete fact কে higher truth-এ রূপান্তরিত করার মধ্যেই আছে আনন্দের আস্বাদন। অ্যারিস্টোটল এর আনন্দবাদ প্রধানতঃ মনন ও বুদ্ধিগত এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয় ইন্দ্রিয়সংবেদনগত অনুভূতি ।

ভারতীয় অলঙ্কার শাস্ত্রেও কাব্য সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে আনন্দময় প্রক্রিয়া বলা হয়েছে।সাহিত্য দর্পনে বলা হয়েছে—'বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম’। রসগঙ্গাধর-এ ‘রমনীয়ার্থ প্রতিপাদক' শব্দকে কাব্য বলা হয়েছে। সুভাষিত রত্ন ভান্ডাগার এ যে প÷ কবির নাম দেওয়া হয়েছে তাঁদের কাব্য বা কবিতার মূল উপজীব্যই হল কৌতুক বা আনন্দ সৃষ্টি । থম্যাশ্টোর শ্চিকুর নিফর : কর্ণপূরো ময়ূরো, ভাসোহাসঃ কবি কুলগুরুঃ কালিদাসো বিলাসঃ। হর্ষো হর্ষো হৃদয়-সতিঃ পঙ্গুবানস্থ বানঃ কেয়াং নৈষা কথয় কবিতা কামিনী কৌতুকায়। উপনিষদে ব্রহ্মের তিনটি স্বরূপের কথা বলা হয়েছে—সৎ-চিৎ-আনন্দ। তৈত্তিরীয়োপনিষদে “আনন্দ ব্রহ্মেতি ব্যজানাং বা আনন্দং ব্রহ্মনো বিদ্বান্ ণ বিভেতি কুতশ্চন ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যে এবং বৈষ্ণব শাস্ত্রে সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণের আনন্দ আস্বাদনকে মূলভূতা আনন্দাংশে স্বরূপশক্তি শ্রীরাধাকে কেন্দ্র করে যে আনন্দ রসের কথা বলা হয়েছে তা পরব্রহ্মের স্বরুপসত্তা বলেই সার্বজনীন। কাব্যে বা কবিতায় সেই আনন্দরসেরই সৃজন হয় এবং সে কারণেই কাব্য পাঠে মানুষের হৃদয় পার্থিব ভোগাসক্তির ঊর্ধ্বে উঠে এক অনাস্বাদিত ও অলৌকিক আনন্দে পরিতৃপ্তি লাভ করে।

রোমান সমালোচক হোরেস তাঁর 'Ars Poetica' তে শিক্ষাদানও আনন্দ দানকে কবিতার উদ্দেশ্য বলেছেন (poets desire either to improve or to please)। কবিতায় moral maxim থাকলে তা সংক্ষিপ্ত ও ইঙ্গিত মুখর হতে হবে যাতে পাঠকের সহজবোধ্যও আয়ত্বাধীন হয়। অ্যাবারক্রম্বি (Abercrombie) হোরেসের কবিতা তত্ত্বের টীকায় বলেছেন যে, 'the magic of poetry has released it from severe condition'। কবিতা হয় 'something which can be enjoyed' I

স্যার ফিলিপ সিডনী (Sir Philip Sidney) An apology of poetry' তে কবিতাকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করেছেন। Religious, Philosophical or informative এবং true kind of poetry। ধর্মমূলক বা religious কবিতায় থাকে ধর্মবোধ ও ঈশ্বর তত্ত্বের অনুভূতি এবং সেই কারণে সে সমালোচনার ঊর্ধ্বে। দর্শনমূলক বা Phlosophical কবিতা দর্শন, ইতিহাস এবং জ্যোতির্বিদ্যা সম্বন্ধে জ্ঞানদান করে। তৃতীয় শ্রেনীর কবিতাই হল আসল কবিতা যা রুপভেদে বিভিন্ন প্রকারের; যেমন heroic, lyric, tragic, comic, satiric, lambic, pastoral, elegaic এবং epic। কবিতা তাঁর মতে সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাদাতা, কারণ ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি সমস্ত শাস্ত্ৰই concrcte facts এর উপর নির্ভরশীল। কবিতা যে শিক্ষা এবং আনন্দ দান করে তা সার্বজনীন বলেই সকল শাস্ত্রের সকল সত্যই তার মধ্যে বিরাজ করে।

রেনেসাঁ যুগে বেন জনসন (Ben Jonson) সিডনীর মতই কবিতা সম্পর্কে উচ্চধারণা পোষণ করতেন। তিনি তাঁর Discoveries এ manifold blessings of poetry সম্বন্ধে যা বলেছেন তা dignity ও ethical importance-এর দিক থেকে খুবই উচ্চ শ্রেণীর। তাঁর মতে কবিতা যৌবনে শিক্ষা, বার্ধক্যে আনন্দ, সমৃদ্ধিতে শ্রদ্ধা, হতাশায় আশা। গৃহাঙ্গনে স্বাচ্ছন্দ্য, প্রবাসে সাথীত্ব, ভ্রমণে বন্ধুত্ব এবং দেশের সমৃদ্ধি অবনতিতে অংশভাগী হওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। মোটের উপর বেন জনসন হোরেসিয়ান মডেলে কবিতার শিক্ষাদান ও আনন্দ বিধানের কথাই বলতে চেয়েছেন। ড্রাইডেন 'dramatic poesy' তে শিক্ষাদানকে সেকেণ্ডারী এবং আনন্দ বিধানকে প্রাইমারি উদ্দেশ্য বলে অভিহিত করেছেন। 'Delight is the chief, if not the only end of poesy, instruction can be admitted. but in the second place, for poesy only instructs as it delights' |

‘Life of Milton' এ ড. জনসন বলেছেন কবিতার কাজ হল 'uniting pleasure with truth by calling imagination to the help of reason' 'Life of Waller' এ বলেছেন কবিতা হল invention, by producing something unexpected, sur- prises and delights. জনসনের মতে সত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আনন্দদান করাই কবিতার উদ্দেশ্য।

Instruction না delight অথবা দুটোই দীর্ঘকালীন এই বির্তকের অবসান ঘটিয়ে রোমান্টিক যুগের কবি সমালোচক কোলরিজ 'the Biographia Literaria'-তে কবিতার প্রধান উদ্দেশ রূপে pleasure বা delight কেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে কবিতায় যে আনন্দ পাওয়া যায় তার বৈশিষ্ট্য হল truth বা সত্য প্রতিষ্ঠা। ওয়ার্ডসওয়ার্থও আনন্দদানকেই কবিতার প্রধান উদ্দেশ্য বলে মনে করলেও এই আনন্দকে 'more exalted kind বলেছেন। Truth বা সত্যকে কবিতা কল্পনার সাহচর্যে সহজবোধ্য করে তোলে। । মানবজীবন ও মানবপ্রকৃতি সম্পর্কীত জ্ঞানের বিস্তার ঘটায় ও জীবনকে উন্নত ও প্রশস্ত করে তুলতে সাহায্য করে। কবিতা বহুঅর্থসাধক—দুর্গতকে সান্ত্বনা, আনন্দের মধ্যে happy কে hap pier করা, যৌবনকে পরিশীলিত করা এবং সকলকে দর্শন, মনন, অনুভূতি ইত্যাদি গুণগুলির সাহায্যে নীতিপরায়ণ করে তোলে - 'to console the afflicted, to add sunshine by a king the happy happier; to teach the young and the gracious of every age to see, to think and feel and therefore to become more actively and securely virtuous'। শেলী Defence of poetry তে কবিতার উদ্দেশ্য সম্পর্কে moral efficacy-র কথা বলেও প্রত্যক্ষ নির্দেশ দেওয়াকে কবিতার কাজ মনে করেননি। তাঁর মতে “the highest moral effect of poetry lies in its appeal to the imagi- native and emotional faculties, in the development it gives to these it enlarges the power of the mind itself"। অর্থাৎ moral effect থাকলে তা থাকতে হবে কল্পনা ও ভাবাবেগের মধ্যে যা মনকে প্রশস্ত করবে। 'poetry strengthens the faculty which if the organ of moral nature'। তিনি আরও বলেছেন যে 'Poetry is the record of the best and happiest moments of the happiest and best minds'। কবিতা Passion, wisom, delight কে একত্রিত করে এমন এক নতুন জগৎ সৃষ্টি করে যা মূলত 'divine'। এই জগতে সব কিছুই সুন্দর। সৌন্দর্যের বিকাশ, অসুন্দরকে সুন্দর করা কবিতার কাজ। 'It marries exultation and horror, grief and pleasure, eternity and change, it subdues to union under the light Yoke all irrecon- cilable things' |

অ্যারিস্টোটলের সময় হতে রোমান্টিক যুগের শেলী পর্যন্ত সকল কবি ও সমালোচকরাই কবিতার উদ্দেশ্যকে আনন্দ প্রদান রূপেই স্থির করলেও, একথা মনে রাখা দরকার যে এই আনন্দ জ্ঞানলব্ধ নয়, অনুভূতি সাপেক্ষ। কোন বস্তুকোণ পর্যবেক্ষণ অনুমান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরেই যে সত্যের সম্মুখীন হওয়া যায় তা জ্ঞানলব্ধ সত্য। এই সত্য universal হলেও eternal নয়, কারণ পরবর্তীকালে জ্ঞানরাজ্যের সম্প্রসারণের ফলে প্রতীয়মান সত্যের রূপ পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু কবিতার সত্য উপলব্ধি স্তরের। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানব প্রকৃতির ঐক্যকে আবিষ্কার করে ওয়ার্ডসওয়ার্থের হৃদয়বেত্তা যে দিব্য আনন্দ অনুভব করেছিল, তারই উজ্জ্বল প্রকাশ তাঁর কবিতা যা যুগান্তরেও পাঠকের মধ্যে সঞ্চারিত করে এক পরম সত্যের অনুভূতি, এক পরম আনন্দ। এ আনন্দের স্বরূপ কিছুটা অ্যারিস্টোটলের ক্যাথারসিস (Cathersis) তত্ত্বের মত। ম্যাথু আর্নল্ড ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর কবিতার উপযোগিতা সম্বন্ধে বলেছেন যে তাঁর কবিতার বিষয়ই হল 'on man, on nature and on human life'। তিনি জীবনকে সামগ্রিক ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন 'high seriousness'-এর মাধ্যমে। কিন্তু কবিতার মধ্যে যে আনন্দ আমরা প্রাপ্ত হই বা যে আনন্দ কবিতা পরিবেশন করে, তা বাস্তব প্রয়োজনের অতীত নান্দনিক আনন্দ, তার সঙ্গে জাগতিক বিষয় সমুহের প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির কোন সম্পর্ক নেই। এ আনন্দ অনুভূতি সাপেক্ষ ও উপলব্ধিজাত। রবীন্দ্রনাথের কর্ণ-কুত্তী সংবাদ কবিতায় কর্ণ যখন বলেন,

...........এই শান্ত স্তব্ধ ক্ষণে / অনন্ত আকাশ হতে পশিতেছে মনে। জয়ন্তীন চেষ্টার সংগীত, আশাহীন/ কর্মের উদ্যম-হেরিতেছি শান্তি

শূন্য পরিনাম। যে পক্ষের পরাজয় / সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে কোরো না আহ্বান। জয়ী হোক, রাজা হোক পাণ্ডব সন্তান/ আমি রব নিস্ফলের হতাশের দলে। দুর্যোধনের অন্যায় অবিচারে ক্ষুদ্ধ মানসিকতায় পাণ্ডবদের প্রতি সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও, পাঠক এখানে এসেই থমকে যান। দুর্যোধনের অন্যায় যুদ্ধের কথা, পাণ্ডবদের প্রতি হিংসা ও অবিচারের কথা সব ভুলে গিয়ে কর্ণের এই স্বার্থহীন স্বীকৃতিতে, তার প্রশস্ত হৃদয়ের ঔদার্যের কাছে পাঠকের মাথা নত হয়ে যায়। হার্দিক সহানুভূতিও বিনম্র শ্রদ্ধায় এই মানসিকভাবে পরাজিত মানুষটিকে আমরা বরণীয় করে তুলি এবং তাঁর নিস্বার্থ আত্মত্যাগে পরম আনন্দ অনুভব করি।

কবিতার উদ্দেশ্য আনন্দদান করা হলেও সৌন্দর্য সৃষ্টির মাধ্যমেই এই আনন্দদানের বিষয়টি সুচারু সঙ্গত হয়ে ওঠে। এখন প্রশ্ন হল সৌন্দর্য কি? অধিকতর ভাবে বস্তু নির্ভর হলে বা অধিকতর form বা শিল্প আঙ্গিককে গুরুত্ব দিলে কবিতা কখনই যথার্থ কবিতা হয়ে উঠতে পারে না। কবিতার মধ্যে চাই 'artistic truth' বা শিল্পসত্য যাকে বলয়ের মত ঘিরে থাকবে, শিল্পগত সৌন্দর্য। কবিতায় কবির এটাই শেষতম লক্ষ্যএবং এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য তিনি মানব ক্রিয়াকাণ্ডের নির্দিষ্ট তথ্য উপাদান রূপে গ্রহণ করলেও কবির নিজস্ব একটি ভাবে তা রূপান্তরিত হয়। একজন সমালোচক বলেছেন, 'the higher the consciousness of the artist and the larger his talent the more sensitive his reaction to reality and the more significant his feeling and thoughts, and the ideas which he reflects and p. omotes in his works' | সবক্ষেত্রেই কবির লক্ষ্য হল শাশ্বত তত্ত্বকে প্রকাশ করা। মানুষের বীরত্বপূর্ণ কাজ ও তার দূর্যোগ, মানব শক্তির প্রচণ্ড তরঙ্গাকার গতি ও পতন, জুলিয়েটের পবিত্র প্রেম, ওথেলোর ঈর্ষা বিদ্বেষ, ইয়াগ্যের শয়তানিম, ফস্ট্যাসের ট্রাজেডি, বিভীষণের বিশ্বাসঘাতকতা, রাখার ট্রাজেডি, রঘুপতির কূটনীতি ও পরিণামে হৃতসর্বস্ব পরিণতি – এসবই সার্বজনীন মানব বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যুক্ত। এ সবই সাধারণ গুণধর্ম প্রতিষ্ঠার কথা। প্রাকৃতিক দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য বা বয়সৌন্দর্যই কবি মানসিকতায় আত্মিক সৌন্দর্যে বা চিত্রাত সৌন্দর্যে পরিণত হওয়ার পিছনে কাজ করে এক সুপ্রাচীন মূল্যবোধ। প্লেটো হতে হেগেল পর্যন্ত ভাববাদী দার্শনিকেরা মূর্ত সৌন্দর্যের অন্তরালে বস্তু বিবিক্ত ও মানব নিরপেক্ষ পরম সত্তাকেই সমস্ত সৌন্দর্যের মূলাপাব বলে মনে করেছেন। এই পরমসত্তা বা Absolute idea বা প্রজ্ঞা- যে নামেই তা উল্লেখিত হোক না কেন, তা perfection বা চরম উৎকর্যের প্রভাব জাত। এ সৌন্দর্য বোধ মূলত অতীন্দ্ৰিয়। প্লেটো মনে করেন যে এই সৌন্দর্যবোধ বস্তু সৌন্দর্য হতে উত্তরণের ফলে অনন্ত সৌন্দর্য স্বরূপ (symposium five dialogues of plato) | হেগেলের মতে পরিদৃশ্যমান বিশ্বপ্রপঞ্চ পরমসত্তারই বিচিত্র অভিব্যক্তি। সত্য যদি আইডির নৈর্ব্যক্তিক রূপ হয়, সুন্দর তা হলে আইডিয়ার ব্যক্ত রূপ। সুন্দরের আইডিয়া বা ভাবই সৌন্দর্য। অন্যদিকে objective idealistদের প্রধান হলেন কান্ট ও ক্লোচে। 'Critique of Judgement' এ কাণ্ট মানুষের faculty of feeling বা অনুভব বৃত্তির উপর ভিত্তি করে সর্বাকাঙক্ষামুক্ত আনন্দ সূত্র রচনা করেছেন যা থেকে পরবর্তী কালে formalism বা রুপসাস্ববাদ, Configuration theory বা রূপনির্মিতিবাদ বা বিশুদ্ধ সৌন্দর্য মতবাদ ইত্যাদি সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর মতে বস্তুর সৌন্দর্যদর্শনে মনের মধ্যে যে আনন্দের সৃষ্টি হয় তাই সুন্দর। বেনিদত্ত ক্রোচে সৌন্দর্যের বহিঃসত্তার প্রকাশকে অস্বীকার করে spiritual aesthetic synthesis বা আত্মিক সৌন্দর্য সংশ্লেষের ক্রিয়ার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ টিনটার্ন অ্যাবে তে বিশ্বব্যাপী এক আত্মিক শক্তির অস্তিত্বের কথা বলেছেন। তিনি অতীন্দ্রিয় ভাবলোকের অধিবাসী, প্রকৃতির পূজারী এবং ভাবকল্প ঋষি, তাঁর সৌন্দর্যবোধের মধ্যে রয়েছে ঐশী শক্তির লীলাদর্শন। অখণ্ড সৌন্দর্যবোধে লীন হতে না পারাটাই শেলীর বেদনা এবং এই বেদনাই হয়ে উঠেছে চিরন্তনী।

'our sweetest songs are those that tell us saddest thought' কবি কীটস আপাদমস্তক সৌন্দর্য তাপস। বস্তু বিবিক্ত বস্তু চেতনায় তিনি বিউটি মিষ্টিক এবং সৌন্দর্যের অন্তঃসত্তার নিগুঢ় উপলব্ধিতে তিনি মরমী রোম্যান্টিক। যে সৌন্দর্যবোধ কীটসের চেতনায় অভিব্যক্তি লাভ করেছে তা সত্য, শাশ্বত ও চিরন্তন। ‘A thing of beauty is a joy forever' দার্শনিক উপলব্ধির স্তরে আবার তাই হয়ে ওঠে আনন্দ ‘রূপমমৃত' এবং কীটসের ভাষায় beauty is truth, truth beauty' |

অজিত কুমার চক্রবর্তীকে সৌন্দর্যের সন্ন্যাসী বলেছেন, তিনি সৌন্দর্যসাধক রবীন্দ্রনাথ। কড়ি ও কোমলে তিনি বললেন চাহিনা আমি সুন্দর ভূবনে মরিতে এবং মানসীপর্বের নিষ্ফলকামনায় সৌন্দর্যের অন্বেষণে যিনি প্রশ্ন করলেন ‘যে অমৃত লুকানো তোমার। সে কোথায়'। সোনার তরী'র বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে তাঁর সৌন্দর্য ভাবনা যেন উপলব্ধি স্তরে উন্নীত হল।

“গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আগে পারে দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে বস্তুজগতের অভিব্যক্তির মধ্যে তিনি অনুভব করলেন,

‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ/চুনি উঠল রাঙা হয়ে।/আমি চোখ মেললুম আকাশে/জ্বলে উঠল আনো/পূর্বে পশ্চিমে/গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, সুন্দর— / সুন্দর হল সে।'

নিরুদ্দেশ সৌন্দর্য আকাঙ্ক্ষায় কবি সৌন্দর্য লক্ষ্মীর সাক্ষাৎ পেয়েও মিলিত হতে পারলেন না।

‘শ্রাবন গগন ঘিরে/ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে/শূন্য নদীর তীরে/রহিনু পড়ি/যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।'

রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে কল্পনার দ্বারাই সৌন্দর্য লোকে উত্তীর্ণ হওয়া যায়। এ লোকে সশরীরে প্রবেশ অসম্ভব। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মতে কবির অলৌকিক সৌন্দর্য সন্ধানের ভাবপট হল চিত্রাকাব্য। নীহার রঞ্জন রায়-এর মতে এ কাব্যে অন্তরতমের সন্ধানে কবির উপলখির পরিপূর্ণতা ঘটেছে। অন্তরবাসিনী সৌন্দর্যলক্ষ্মীর আরাধনায় কবি বলেছেন,

‘জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে/তুমি বিচিত্র রূপিনী...... তুমি চঞ্চলগামিনী।” উর্বশী হয়ে উঠেছে সৌন্দর্যের প্রতীক— গ্যেটের 'the eternal woman' এবং কীটস-এর ‘a thing of beauty is a joy forever'। সৌন্দর্যের চিরন্তনীরূপ প্রকাশ পেয়েছে 'বিজয়িনী', 'বিবসনা', 'পূর্ণিমা' ইত্যাদি কবিতায়।

সুতরাং সৌন্দর্যের সারকথা হল জীবন সত্যের প্রকাশ। বর্ণনা বা form বা pattern অর্থাৎ কবিতার রূপকলা—তা সে যতই ঐশ্বর্যমণ্ডিত হোক না কেন, কিছুতেই তা সত্য সৌন্দর্যকে প্রকাশ করতে পারে না। এ এক নান্দনিক আবেগ এবং মানসিক উপলব্ধির বিষয়। রবীন্দ্রনাথ 'সাহিত্যের স্বরূপ' এ বলেছেন যে সত্যে সৌন্দর্যরসের প্রাপ্তি ঘটে, যখন তা হৃদয়ের মধ্যে উপলব্ধ হয়। কীটস একেই বলেছে truth is beauty, beauty truth তাহলে সাহিত্যে বা কবিতায় কি শুধুমাত্র জীবন সত্য উপলব্ধির সাপেক্ষে যুক্তি থাকবে? সমকালীনতা বা সামগ্রিক পরিবেশ, জীবনের নেতিবাচক দিক—অন্ধকার দিক এসব উপেক্ষিত হবে? কিন্তু এই বৈসাদৃশ্য তো জীবনেরই একটা অংশ। যুগের চালচিত্রনের অন্তঃসারশূন্যতা, মানব সমাজের বিচ্ছিন্নতা ও শূন্যগর্ভ নিঃসঙ্গত, বা এলিয়ট যেমন বলেন, 'we are the hollow men, we are the stuffed men, leaning together'- এসব নিয়েই তো বর্তমান যুগের চালচিত্র। এসবই কি কবিতা বা সাহিত্যে উপেক্ষিত হবে? ‘Beauty and fool together lan" মূর্খ আর বৃসীর ভয়াবহ সঙ্গমই যুগের ধর্ম, যার ছবি এঁকেছেন এটি তাঁর The Waste Land- বা মৃত্যুর শোকাল বাস্তবতা হতে প্রদান করেছেন বাইজেন্টিনাসের লেকে। বা হল 'world of intellect, spirit and art"। এলিয়ট চেয়েছেন spiritual, sati secular salvation নয়। যুগের অবক্ষয়কে অস্বীকার নয়-time-এর সঙ্গে cerity র সম্পর্ক নির্মাণ করে বলতে চেয়েছেন "time can be conquered only though time" এই প্রসইে এসেছে তার objective comentatives

অবজেকটিভকে পরপর সাজিয়ে এক বস্তুহীন অখন্ডতায় উত্তীর্ণ করা। এরই নাম ভাবতে ঐকা। The Waste Land-এর টিরেসিয়াস এর করা ousand weeded Image বা নাগরিক জীবনের দুধনের চিত্র সামগ্রিক পরিমণ্ডলে এমন ভাবে মিশে যা সামন্তসাহীন তো নয়ই, উপরন্তু শাশ্বত জীবনের চাবিকাঠির প্রয়োজনীয়তাকেই প্রতা করে তুলেছে। এলিয়ট হয়ে উঠেছেন বিশ্বচেতনার ধারক ও প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথের পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থে 'ছেলেটা', সাধারণ মেয়ে, বাঁশি প্রভৃতি কবিতার জীবনের নস্টালজিক চিত্র আছে, কিন্তু এ সবই সামগ্রিক জীবনসত্যকে ফুটিয়ে তোলার উপাদান রূপেই কৃত। শেক্সপীয়রের ইয়াগো (ওথেলো) ম্যাকাইভেলীর আদর্শে অনুপ্রাণিত। কোলরিজের Euce a hard boiled cynic and the embodiment of motiveless malignity! সরলতা ও পবিত্রতার ট্রাজিক পরিণতি এ কাহিনী এবং বৈসাদৃশ্য থাকুক না কেন, এই নাটকের এক অপরিহার্য অন। রবীন্দ্রনাথের দাদারীর আবেদনে ধৃতরাষ্ট্র যখন বলে-

'শুধু রবে অন্য পিতা, জন্য পুত্র তার/আর কালাত্বক শুধু পিতৃ স্নেহ/আর বিধাতার শাপ, আর নহে কেহ।

বা দুর্যোধন যখন বলে,

-দেখি কতদিন বয়/প্রজার পরম স্পর্ধা -নির্বিধ সর্গের ব্যর্থ কণা আম্মাল, নিরঙ্কুদর্শের / হুংকার

বা নিজের ভুল বুঝতে পেরে লীয়ার যখন অব্যক্ত যন্ত্রণায় বলে, 'man's life is cheap as beast অথবা ম্যাকবেথের প্রলাপ (Hallucination) what hands are here: Ha! they pluck out mine eyes'- এসবের মধ্যে রয়েছে জীবনের ব্যাপক ও গভীর বৈচিত্র্য যা কাব্যে বা সাহিত্যে অখন্ডতা সৃজন করে এবং পাঠক যা প্রত্যক্ষ করে এক মানসিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে। এদের সঙ্গে পাঠকের হৃদয়বোধের যোগাযোগ নেই। সমগ্রজীবন সত্যকে উপলব্ধি করার এগুলি উপাদান মাত্র, এদের নিয়েই প্রতিভাত হয় জীবনসত্যের অন্তরালে অখণ্ড সৌন্দর্যবোধ।

সাহিত্য বা কবিতার উদ্দেশ্যের মধ্যে নীতি শিক্ষা দেওয়া আদর্শরূপে গৃহীত হতে পারে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। মোটামুটি বলা যায় যে নীতিশিক্ষামূলক কবিতা একটি বিশেষ শ্রেণীর কবিতা। প্রাচীন গ্রীসের Hesiod-এর 'works and days' ও 'Theogony' এবং ল্যাটিন কবি Lucretius-এর De Rerum Natura' ও Virgil-এর 'Georgics'নীতি বিষয়ক কবিতা যার মূল বিষয়বস্তুই হল moral principles মধ্যযুগে ইউরোপে সর্বত্রই নীতিমূলক কবিতার প্রচলন ছিল। ইংরাজী সাহিতে, Poena mole, crmulum এবং prover of Alfred নিঃসন্দেহে নীতিলেক । Gower-এর Confession mantis ও নীতি নির্দেশ। অনেকেই মনে করেন যে নীতি শিক্ষা দেওয়াই কবিতার একমাত্র উদ্দেশ্য। হোরেস তাঁর Ars poetica Boilens 'Art Poetique-তে এবং Pope এর Entry on Criticism - কবিতার উদ্দেশ্য নীতি শিক্ষামূলক হওয়ার কথা বলেছেন। নেন। তবু তিনি যে পরিশোধনের বিষয়ে ক্যাথারসিসের কথা বলেছেন তাও একধরনের নৈতিক প্রক্রিয়া। গ্রীসের মত এদেশেও আদর্শ চরিত্র সৃষ্টি ও দেবদেবীদের চরিত্রের অনুকরণ কাব্য সাহিত্যের অন্যতম প্রধান জন হলে বিবেচিত হত। কাব্য চর্চার উদ্দেশ্যই ছিল চতুঃবর্গ অর্থাৎ ধর্ম-অর্থ- কাম-মোক্ষ লাভ। রামায়ণ, মহাভারত বা অন্যান্য সংস্কৃত ক্লাসিক্যাল সাহিত্যে ধর্মদর্শন- সমাজনীতি রাষ্ট্রনীতির আলোচনা আছে প্রধানত, অধ্যাত্মবাদ ও নীতি শিক্ষার প্রকৃষ্ট উদাহরণ স্বরূপে। বাংলা সাহিত্যে বদলালের নীতিগুলি নীতি ও উপদেশাত্মক

কবিতা কি তবে ছন্দে আবশ নীতিবচন মাত্র? এ প্রশ্নকে কেউ সত্য বলে মেনে নেবেন না, কারণ কবিতা হল heightened and imaginative creation (Dryden). Art of uniting pleasure and truth' (Johnson), 'Criticism of life and a profound application of ideas to life and laws of poetic truth and poetic beauty" (Arnold)। মোটের উপর কবিতার মধ্যে ন্যায়, নীতিবোধ ও নৈতিক শিক্ষা উপাদান রুপে থাকতে পারে, কিন্তু সর্বোপরি তাকে কবিতা হতে হবে অর্থাৎ কবির অনুভূতি হৃদয়বত্তা ও কল্পনার সাহচর্যে উন্নতস্তরে সম্পূর্ণ নতুনরূপে জীবন সত্যকে প্রকাশ করতে হবে। অনেক সময়েই নৈতিকসতা ও কাব্যসত্য এক হয় না। নৈতিক সত্য নির্ভর কনে যুগ পরিবেশ ও তাৎক্ষণিক সময়ের উপর। যুগের পরিবর্তনে নৈতিক সত্যের রূপ বদল হয়। রামায়ণ ও মহাভারতের বহু নৈতিকসত্য বা নীতিবচন বর্তমান কালে দোষনীয়। দুর্যোধন বা রাবণ উভয়েই তাদের কর্মসম্পাদনে নীতির দোহাই দিয়েছে। গান্ধারীর আবেদনে রবীন্দ্রনাথ দুর্যোধনের মুখে এমন সব নীতির কথা প্রয়োগ করেছেন, তা তাৎক্ষণিকভাবে উদ্দেশ্যমূলক হলেও সত্য। শেক্সপীয়রের ইয়াগোর বক্তব্য কোনপ্রকারেই তাত্ত্বিক মুল্যহীন নয়। রাজবীর রঘুপতি বলির স্বপক্ষে যে সব যুক্তি দেখিয়েছে তা কোনভাবেই অর্থশূন্য নয়। কিন্তু সাহিত্য বা কবিতার তাৎপর্যবোধে এসবই উপাদান মাত্র। রামচন্দ্র ও পাণ্ডবদের বিপরীত রুমে স্থাপন করে পূর্বোত্তদের নৈতিক দাবীকে নস্যাৎ করা হয়েছে এবং এই দুই নীতির বলিষ্ঠ দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে কাব্যসত্য বা জীবন সত্য পূর্ণমর্যাদার অধিষ্ঠিত হয়েছে। অরোদী পার্টসের জীবন যন্ত্রণা, দুর্যোধনের খেদোষ্ঠিও শূন্য পরিণাম, মধুসুদনের রাবণের হাহাকারে ভরা বেদনা—এসবই হৃদয় সংঘর্ষজাত উপলব্ধির শিল্পসম্মতরূপ বলেই তা কাব্যসত্য উন্নীত। আদর্শ প্রচারের জন্য নীতির দোহাই দেওয়া কখনও জীবন সত্যরূপে কাব্যের বা সাহিত্যের সত্য হতে পারে না, কারণ নৈতিক আবেদনের কোন সার্বজনীনতা নেই। বার্নার্ডশ-এর নাটকগুলিকে বলা যায় drama of cocas এবং তার চরিত্রেরা প্রায়শই তাঁর আদর্শের মাউথপিস। তবু তাঁর নাটকগুলি কালজয়ী হয়েছে মননশীলতার গভীরে বৌদিক সৌন্দর্যময়তায় উন্নীত হওয়ার জন্যে। সাহিত্য বা কাব্যকে শিল্পসম্মতরূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে রচয়িতার মনন ও কল্পনাই যথার্থ সারবস্তু এবং তার অভাব ঘটলেই সাহিত্য হয়ে ওঠে প্রচারধর্মী পুস্তিকা। বাংলা সাহিত্যে নজরুল বা সুকান্তের অনেক কবিতাই সাম্যবাদী প্রচারমূলক কবিতা। নজরুলের ‘আমার কৈফিয়ৎ’, ‘বিদ্রোহী' প্রমুখ কবিতাগুলি এক বিশেষ সময় ও যুগের পরিপ্রেক্ষিতে রচনা। সে যুগের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে কবিতার আবেদনও ইতিহাসে পর্যবসিত। অথচ প্রেমেন্দ্র মিত্রের চোখে ছিল শ্রেণীহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন, অথচ 'সম্রাট' ও 'ফেরারীফৌজ’- এ আছে মানব সভ্যতার বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে জীবন সমস্যার অনুসন্ধান।

“সাত সাগরের তীরে/ ফৌজদার হেঁকে যায় শোনো/আনো সব সূর্য কণা/রাত্রি মোছা চক্রান্তের প্রকাশ্য প্রান্তর/ এবার অজ্ঞাতবাস শেষ হলো ফেরারীফৌজের।'

সুভাষ মুখোপাধ্যায় মূলতঃ সাম্যবাদী কবি। পদাতিক কাব্যগ্রন্থের বহু কবিতাতেই (যেমন কানামাছির গান, মে দিনের কবিতা ইত্যাদি) রাজনৈতিক বক্তব্য প্রাধান্য পাওয়ায় কবিতার আবেদন সংকুচিত। কিন্তু 'ফুল ফুটুক' কাব্যে এর বিপরীত ভাবই নজরে পড়ে। পুরাণ প্রতিমা, চিত্রকল্প, ভাষা ছন্দ স্তবক বিন্যাস — সবেতেই আছে খাঁটি শিল্পরূপ যার দর্শণে জীবন সত্য প্রতিবিম্বিত।

‘আজও দেখতে পাচ্ছি—/হিরণ্যগর্ভদিন/হাতে লক্ষ্মীর ঝাঁপি নিয়ে আসছে। / গান গেয়ে/ আমাকে বলছে দাঁড়াতে।/গুচ্ছ গুচ্ছ ধানের মধ্যে দাঁড়িয়ে/তার বলিষ্ঠ হাত দুটো আমি দেখতে পাচ্ছি।' এমনই ঘটেছে 'সালেমনের মা' কবিতায়।

‘এক আকালের মেয়ে তোমার/ আরেক আকালের মুখে দাঁড়িয়ে/ তোমাকেই সে খুঁজছে।

এসব কবিতাতেও সাম্যবাদী শ্রেণীহীন সমাজের কথা আছে, তবে তা শিল্পের অনুরোধে মননশীল জীবন সত্যে উত্তরিত।

সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে মুখ্যতঃ মার্কসবাদী কবি। মার্কসবাদ মনে করে যে নন্দনতত্ত্ব প্রভৃতি ভাবাদর্শগত রূপগুলি মানুষের অর্থনৈতিক প্রয়োজনকে ভিত্তি করে বুনিয়াদের উপরে নানা পর্যায়ে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া সৃজন করে এবং শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রয়োজনই সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কস এর মতে বস্তুভিত্তি ও অর্থনীতি শিল্পসাহিত্যের Skeleton। এই Skeleton কে সজীব করে তোলার জন্য প্রয়োজন ‘slumbering power'। মাকর্স-এর মতে যা slumbering power, তাকে বির প্রেরণা, কল্পনা বলা যেতে পারে, এবং মার্কসবাদীদের মতে তা হল সমাজ সচেতনতা বা social consciousness। এই consciousness কে ভাববাদীরা মনে করেন বস্তু বিবিক্ত বিশুদ্ধ চৈতন্যসত্তা এবং তারই জন্য তাঁদের দাবী 'Artis's autonon.y'। এর সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যেখানে আমি সৃষ্টিকর্তা সেখানে আমি একক, আশি মুক্ত। বাইরের ঘটনাপুঞ্জ দ্বারা আবদ্ধ নই'। কিন্তু মার্কস-এর মতে এই কনসাসনেস হল মানুষের সামাজিক সত্তা যা চৈতন্য নির্ধারক। (It is not the consciousness of men that determiner their being, on the contrary, their social being determines their consciousness)। মার্কসবাদ ন৷ে করে যে শিল্পী স্বাধীন ব্যক্তিত্বের অধিকারী, কিন্তু তাঁর এই স্বাধীনতা কখনই বন্ধন মুক্ত স্বেচ্ছাচার নয়। মানুষ সুন্দরকে রূপায়িত করে আন্তঃশক্তির সহায়তায়। এখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মার্কসবাদের বিরোধ নেই। রবীন্দ্রনাথ ব্যাক্তির অর্থে বুঝেছিলেন যে ব্যক্ত হয়। বহুজনের কাছে ব্যক্ত হতে গেলে সমাজ পরিবেশ হতে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তা হওয়া যায় না, দেশ, কাল ও সমাজের একজন হিসাবেই তা করতে হয়। সুতরাং স্রষ্টা কখনই সমাজ পরিবেশ হতে বিচ্ছিন্ন কোন সত্তা নয়। সত্য ও স্বাধীনতা সম্বন্ধে লেনিন বলেছেন যে বুর্জোয়া সমাজে সত্য ও স্বাধীনতা নিছক ভণ্ডামি। যেখানে অর্থন, নিয়ামক হয়ে পরগাছা স্বরূপ মুষ্টিমেয় ধনীর হস্তে ন্যস্ত থাকে, এবং যার বিপক্ষে থাকে অসংখ্য দারিদ্র্যক্লিষ্ট শ্রমজীবী- -সে সমাজে সত্য ও স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না। 'Freedom and the Artist' গ্রন্থে Z. Apresyan বলেছেন, 'the freedom of the artist in the Marxist-Leninist meaning of the word consists of advancing with the people, creating intellectual riches for the poeple in their interest'। এঙ্গেলস একটি পত্রে মন্তব্য করেছেন, 'The more the opinions of the auther remain hidden, the better for the work of art'। ইয়েনান ফোরামের বক্তৃতায় মাও সে তুং ও একই কথা বলেছেন। তাঁর মতে শিল্পের ক্ষেত্রে শৈল্পিক গুণের অভাব ঘটলে রাজনীতির দিক হতে তা যতই প্রগতিশীল হোক না কেন সামাজিকভাবে তা মূল্যহীন। অর্থাৎ মার্কস যে In accordance with the laws of beauty'-র কথা বলেছিলেন, সকলেই সেই চিরন্তন সত্যকেই মেনে নিচ্ছেন। ফ্রান্সে শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ক ১৯৬৬ সালের আলোচনাতেও শিল্পীদের উপর কোন দায়িত্ব যেমন চাপিয়ে দেওয়া হয়নি, তেমনি সমাজ পরিবর্তনে শিল্পীর সঙ্গে ঐক্যও কামনা করা হল।

কিন্তু মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও সে তুং যাই বলুন না কেন, রাশিয়ায় পরবর্তীকালীন বোরিস পাস্তেরনাক ও সোনঝেনিৎসিনের পরিণাম এবং লেখক শিল্পীদের উপর প্রশাসনিক তদারকি ও নির্দেশনামা, চীনে Gang of Four ইত্যাদি এ কথাই প্রমাণ করে শিল্পীর ন্যূনতম স্বাধীনতা ক্রুশ্চেভের সঙ্গেই বিদায় নিয়েছিল। কবি বা সাহিত্যিক যদি সমাজতান্ত্রিক শ্রেনী বৈষম্যকে তুলে ধরাই সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বলে মনে করেন তা যেমন সাহিত্যের পক্ষে দুর্দিনের সূচক, তেমনি শোষণমুক্ত সামাজিক আদর্শের অনুগামী নয় বলেই বিরূপ সমালোচনা ও সাহিত্যকে হেয় প্রতিপ” করাও সাহিত্য সমালোচনার নীতি হতে পারে না। সাহিত্য আর যাই হোক কখনও বুর্জোয়া শ্রেণী চরিত্র বিনাশের অস্ত্র হতে পারে না। শেক্সপিয়ার, মিল্টন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কালিদাস, রবীন্দ্রনাথ এঁরা সকলেই স্পষ্টরূপে কালজয়ী হয়েছেন তাদের প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের স্ফুরণে। তাঁদের সৃষ্টির মধ্যে  সমাজের প্রতিফলন আছে, কিন্তু সৌন্দর্যচেতনা তথা আধ্যাত্মিক চেতনায় তাঁরা অনেক ঊর্ধ্বে বলেই তাঁদের মহত্ব যুগের পর যুগ ধরে মানব স্বীকৃত। কালিদাস ও ভবভূতির মধ্যে, শেক্সপীয়র ও বেন জনসনের মধ্যে এবং রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য কবিবৃন্দের মধ্যে যে পার্থক্য তা ব্যক্তিস্বত্তা ও ব্যক্তি প্রতিভার। শ্রেণী বৈষম্য বিনাশ ও শোষিত জন সাধারণের পক্ষে সব দেশেই বহু রচনা রচিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যেও এর সংখ্যা কম নয়। এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য যে সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা এনেছে। শ্রেণী কাঠামো, ধনবন্টন ব্যবস্থা ও উৎপাদন ব্যবস্থায় এর প্রভাব কম নয়। বাংলা সাহিত্যে সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, সমর সেন, মণীষ রায়, অরুণ মিত্র, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি। এঁরা সাম্যবাদের জয়গান গাইলেও এমন অনেক কবি রয়েছেন যাঁরা মানবতার জয়গান গেয়েছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মত কবিরা। আসলে সমাজ ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ব্যতীত আজকের যুগে কোন সৃষ্টি সার্থক নয়। যতই সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শোষিত জনসাধারণের অবর্ণনীয় ও শোচনীয় কাহিনীকে সাহিত্যে বা কবিতায় উপস্থাপনা করা হোক না কেন, তা যদি শিল্প সম্মত রূপায়ণের সামিল না হয়, তবে তা প্রচার পুস্তিকা বা ইতিহাস, সাহিত্যপদবাচ্য নয়। বার্নার্ড শ, বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথের তত্ত্ব মূলক রচনা নিছক তত্ত্বের মধ্যে বিলীন হয়নি, তা লোকত্তর হয়েছে শিল্পগত কারণে। কবিতায় যেখানে কবির অনুভূতি ও আবেগের প্রাধান্য, সেখানে যেকোন রকমের নিছক তত্ত্ব বা তথ্য কবিতার রসহানী ঘটাতে পারে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এক সময় ভাববাদী দৃষ্টিকোণ হতে সরে এসে বলেছেন, ' যেখানে একজন ধনি দশজনকে শোষণ করে, যেখানে হাজার মানুষের স্বাতন্ত্র্য হরণ করে একজন শক্তিশালী হচ্ছে, যেখানে বহু লোকের ক্ষুধার অন্ন একজনের ভোগবাহুল্যে পরিণত হচ্ছে—সেখানে। মানুষের সত্য রূপ, শান্তিরূপ আপন সুন্দর সৃষ্টির মধ্যে প্রকাশ পেল না।'

কবিতা বা শিল্পের প্রয়োজন আনন্দদান—ভাববাদীদের এই তত্ত্বকে নস্যাৎ করে নন্দনতত্ত্ববিদ্ আনন্দ কুমার স্বামী বলেছেন, 'Artist is producing a utility something to be used more pleasure is not a use from that point of sight'.

'কাব্য জিজ্ঞাসা-য় অতুল চন্দ্র গুপ্ত বলেছেন যে, কাব্যের লক্ষ্য রস এবং সেই রস অনুভূতির সাপেক্ষ। কাব্যের জগৎ মায়ার জগৎ হলেও বস্তু নিরপেক্ষ মায়া যেমন অসম্ভব, তেমনই অসম্ভব বস্তুকে বাদ দিয়ে ভাবের সাধনা।

অধ্যাপক শশীভূষণ দাসগুপ্ত সৌন্দর্য সৃষ্টির মূলে সৃজনশীল মানব প্রতিভার উপর জোর দিয়ে বলেছেন যে স্রষ্টার প্রতিভা অবশ্যই ইতিহাসের আবর্তনের উপর নির্ভরশীল। মোনালিসার হাসি, বিয়াত্রিশের প্রেম, মিশরের মমি, পড়ো বাড়ির দুর্গন্ধ, অন্ধকারে বাদুড়ের ডাক, ভুখা ভগবানের আর্জি প্রভৃতিকে তিনি বর্তমান বাস্তব ও মনের জগতের বিষয় বলে মনে করেন না। তাঁর মতে আমাদের বাস্তবপন্থী সাহিত্যে' আমরা চাই বাস্তবজীবন ও বাস্তব জগতের আসল রূপটি ফুটাইয়া তুলিতে, কিন্তু সেই আসল রূপকে কখনও কি রক্ত মাংসের চোখে দেখা যায়? যেটুকু দেখি মনে—নিছক চোখে দেখা জিনিষ লইয়া কোন কাব্য কবিতাই বাড়িয়া উঠিতে পারে না'।

সুতরাং বস্তু নিরপেক্ষ আনন্দদান নয়, বাস্তব ভিত্তির উপর মহৎ প্রতিভার মননই কবিতা বা সাহিত্যের উৎস। কলা কৈবল্যবাদীরা Art for Art's Sake এর নামে যেকথা বলেন, a work of art has an intrinsic value without didactic and moral purpose' এবং যা গুইটার, অস্কার ওয়াইল্ড, হুইসলার, ওয়াল্টার, পেটার, ব্রাডলে প্রমুখ মনস্বাদের যুক্তি সম্মত তত্ত্ব, তা বাস্তব পরিস্থিতি ও ইতিহাসের আবর্তনের অনুকূল নয়। চিলির মার্কসবাদী কবি পাবলো নেরুদার বক্তব্য এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। 1 think that realism and the fanceful and invention are the two laws of artistic creativity. If the artist negates realism, he loses view of reality, his art turns to a spectre. If the artist negates the fanciful and dreams, his art becomes helpless and pedestrian'.

কবিতার উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে কলা কৈবল্যবাদীদের আনন্দরসাস্বাদন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। এই দুই দিক যখন সমান তালে পা ফেলে অগ্রসর হয়, তখনই সৃষ্ট হয় মহৎশিল্প। মিল্টনের প্যারাডাইস লষ্ট এ মানবের বৈজয়ন্তীর জয়গান গাওয়া হয়েছে। মধুসূদনের মেঘনাদ বধ কাব্যেও রাবণের হাহাকারের মধ্যে মানব চেতনার দিকটি সুদক্ষভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। মহৎশিল্পের মধ্যে আমরা চেতনা আলোড়নকারী দিক সমূহ, আত্মবন্ধন হতে মুক্তি, গতানুগতিক জীবনকে পরিহার করে উন্নত উৎকর্ষের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রেরণা পাই। 'ঐকতান' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছেন,

'সব চেয়ে দুর্গম যে মানুষ আপন অন্তরালে তার পূর্ণ পরিমাপ পাই বাহিরের দেশে ও কালে/ সে অন্তরময়,/অন্তর মিশালে তবে তার অন্তরের পরিচয়।

মধুময় পৃথিবীর ধূলি কে তিনি স্বীকার করেছেন অন্তরের তাগিদে, বলেছেন, ‘শেষ স্পর্শ নিয়ে যাব যবে ধরণীর/বলে যাব, 'তোমার ধূলির/তিলক পরেছি ভালে।/ দেখেছি নিত্যের জ্যোতি দুর্যোগের মায়ার আড়ালে।/

সত্যের আনন্দরূপ এ ধূলিতে নিয়েছে মুরতি/এই জেনে এ ধূলায় রাখিনু প্রণতি।'


Post a Comment

0 Comments