প্রথম বলকান যুদ্ধ সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ রচনা প্রস্তুত করুন?

 

প্রথম বলকান যুদ্ধ সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ রচনা প্রস্তুত করুন?

                               তরুন তুর্কি আন্দোলনের নেতৃবর্গ গনতান্ত্রিক সংস্কার প্রবর্তনের নীতি ঘোষনা করেছিলেন বটে কিন্তু মুখ্যত তাদের উদ্দেশ্যে ছিল তুরস্কীকরণ নীতি অনুসরণ করে তুরস্ক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর উপর একাধিপত্য স্থাপন করা। সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত তুরস্কীকরণ নীতির নামে প্রথমেই ম্যাসিডোনিয়া আলবেনিয়ার খ্রীষ্টান প্রজাবর্গের উপর অকথ্য অত্যাচার আরম্ভ হয়। এইরূপ অত্যাচারের ফলে তুরস্ক সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিদ্রোহাগ্নি জ্বলে ওঠে। তুরস্কের অত্যাচার নিবারণ করার জন্য ১৯১২ খ্রীঃ সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো, গ্রীস বুলগেরিয়া বলকানের এই রাষ্ট্রচতুষ্টয় বলকান লীগ নামে এক সংঘ প্রতিষ্ঠা করে। তরুণ তুর্কিদের তৎপরতা ম্যাসিডোনিয়ার উপর তুরস্কের কতৃত্ব সুদৃঢ় করতে প্রয়াসী থাকেন। মেটারনিক এক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার তত্ত্বের যুক্তি দেখান। তুর্কি সেনাবাহিনী অতি সহজেই এই বিদ্রোহ দমন করে। এর সামান্য পরে ১৮২১ খ্রীঃ দক্ষিণ গ্রিসের মোবিয়া প্রদেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে এবং অচিরেই তা দাবাগ্নির মতো সমগ্র গ্রিসে পরিব্যাপ্ত হয়। এসময় ইউরোপের জনমত কিন্তু গ্রিসের পক্ষে ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গ্রিসের সমর্থণে সভা-সমিতি অনুষ্ঠিত হতে থাকে এবং গ্রিসে নানারকম আর্থিক সামরিক সাহয্য আসতে থাকে। অনেকে যুদ্ধে যোগদানের জন্য ব্যক্তিগতভাবে গ্রিসে যান। গ্রিক বিদ্রোহ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে তুর্কি সুলতান তাঁর সমস্ত মিশরে শাসনকর্তা মহম্মদ আলি- কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। এর বিনিময়ে তিনি মহম্মদ আলিকে সিরিয়া দামাস্কাস দানের প্রতিশ্রুতি দেন। পাশ্চাত্য কায়দায় শিক্ষিত প্রায় ১১ হাজার সৈনিক নিয়ে মহম্মদ আলি পুত্র ইব্রাহিম আলি ১৮২৫ খ্রীঃ মোবিয়ায় অবতরণ করেন। এর ফলে যুদ্ধের গতি পরিবর্তীত হয়। গ্রিকরা পরাজিত হতে থাকে। হাজর হাজার গ্রিককে হত্যা করে জলে নিক্ষেপ করা হয়। ১৮২৭ খ্রীঃ মধ্যে প্রয় সমগ্র গ্রিস তুরষ্কের অধিকারে আসে।. খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী গ্রিকদের উপর তুরষ্কের নির্যাতন সমগ্র ইউরোপে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এর ফলে সমগ্র ইউরোপে গ্রিসের অনুকূলে জনমত গড়ে ওঠে। রুশ জার প্রথম আলেকজান্ডার ১৮২৪ খ্রীঃ গ্রিসকে সাহায্যের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু মেটারনিকের বিরোধিতার ফলে তিনি পিছিয়ে যান। রাশিয়ার নতুন জার নিকোলাস তুরষ্কের বিরূদ্ধে গ্রিসকে সাহায্যের কথা ঘোষনা করেন। রাশিয়ার এই ঘোষণার মধ্যে গ্রিসকে সাহায্য করা অপেক্ষা বলকানে রুশ প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যই বেশি কার্যকরী ছিল। জারের আপাতত লক্ষ্য ছিল সার্বিয়া এবং দানিয়ুব অঞ্চলের মোলডাভিয়া ওয়ালেশিয়া অঞ্চল দখল করা। তিনি এই রাজ্য দুটি থেকে তুর্কি সেনা অপসারণের দাবিও জানান। তুরষ্কের সুলতান ইনকারম্যানের সন্ধি' দ্বারা রুশ দাবি মেনে নেন এবং সার্বিয়ার স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেন।

১৮২৭ খ্রীঃ লন্ডন চুক্রি দ্বারা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স রাশিয়া গ্রিসের স্বায়ত্তশাসন মেনে নেয়, এবং এই উদ্দেশ্যে তুরষ্কের সুলতানের কাছে একটিযুক্তপত্র পাঠায়' তুর্কি সুলতান প্রস্তাবে অসম্মত হলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স রাশিয়া যুগ্মভাবে তুরস্ক আক্রমণ করে এবং নাভারিনোর নৌযুদ্ধে তুরষ্ক মিশরের যুগ্মবাহিনীকে ধ্বংস করে। ইংল্যান্ডের উদ্দশ্য ছিল তুরস্ককে ভয় দেখিয়ে যুদ্ধত্যাগে বাধ্য করে ধ্বংস করা নয়। তুরস্কের পতনে রাশিয়া শক্তিশালি হয়ে উঠবে। তাই ইংল্যান্ড ফ্রান্স তাকে দুর্বল বা যুদ্ধ থেকে সরে দাড়ায়। এই অবস্থায় রাশিয়া এককভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যায় এবং পরাজিত তুরস্ককে আড্রিয়ানোপলের সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করে। রাশিয়ার শক্তিবৃদ্ধিতে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়াসকলেই শঙ্কিত হয়ে ওঠে এবং এই সন্ধি পরিবর্তনের জন্য রাশিয়ার উপর চাপ দিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত লন্ডনের চুক্তি দ্বারা ১৮৩২ খ্রীঃ তুরস্ক গ্রীসের স্বাধীনতা মেনে নেয়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স রাশিয়া এই স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব নেয় এবং মোলডালিয়া ওয়ালেশিয়া তুরস্কের অধীনে থাকে এবং ব্যাভেরিয়া রাজবংশের প্রথম অটো গ্রিসের রাজা হন।

বিভিন্ন কারণে গ্রিসের স্বাধীনতা সংগ্রাম ইউরোপীয় ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়

() ভিয়েনায় সমবেত রাষ্ট্র নীতিকগন ন্যায্য অধিকার স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠার নামে গনতন্ত্র জাতিয়তাবাদী ভাবধারার অগ্রগতির বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, গ্রিসের স্বাধীনতা সংগ্রাম তার বিরুদে এক সফল প্রতিবাদ। 

() গ্রিসের স্বাধীনতা সংগ্রাম মেটারনিক ব্যবস্থা এবং ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের অসারতা অপ্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করে। 

() গ্রিসের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্য বলকান অঞ্চলের অপরাপর স্বাধীনতাকামী জাতিবর্গের মনে গভীর অণুপ্রেরণা আশার সঞ্চার করে তাদের তুরস্ক বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। 

() এই যুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের ফলে তুরস্কের শাসনতান্ত্রিক সামরিক দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রবর্গের কাছে তুরস্করুগ্ন-ব্যক্তি' বা 'Sick man of Europe' বলে পরিচিতি লাভ করে। এই দুর্বলতার ফলে পরবর্তীকালে ইউরোপের রাজনীতিতে নানা জটিলতার সৃষ্টি করে। 

() গ্রিক স্বাধীনতা সংগ্রামকে নানাভাবে সাহয্য করায় রাশিয়ার আন্তর্জাতিক মর্যদা প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং ভূমধ্যসাগরের অঞ্চলে রুশ প্রভাব সুদৃঢ় হয়।

Post a Comment

0 Comments