- জাতিসংঘ তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল কেন ?
অ্যালিজার্ন-এর মতে League of nations বা জাতিসংঘ ছিল বিজয়ীদের স্বার্থকে সুসংঘবদ্ধ এবং পরাজিতদের দমন করার জন্য একটি যুদ্ধোত্তর সংস্থা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে শান্তি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছিল জাতিসংঘ। জাতিসংঘ উদ্ভবের ক্ষেত্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের যথেষ্ট কৃতিত্ব ছিল। উইলসন তাঁর চৌদ্দ দফা শর্তের শেষ শর্তে বলেছিলেন, 'ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির স্বাধীনতা ও আঞ্চলিকতা অখন্ডতা সমভাবে বজায় রাখবার জন্য বিভিন্ন দেশকে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে। ১৯১৯ খ্রীঃ জাতিসংঘের গঠনতন্ত্র রচিত হয়েছিল। ১৯২০ খ্রীঃ ১০ই জানুয়ারী আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। ই. এইচ. কার তাঁর 'International
nations between two world wars' গ্রন্থে বলেছিলেন যে, জাতিসংঘের প্রধান কর্তব্য ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্তর্জাতিক বিরোধের মীমাংসা করা এবং ভবিষ্যতে যুদ্ধ যাতে না হয় তার চেষ্টা করা। কিন্তু জাতিসংঘ যখন ক্ষমতার শীর্ষে ছিল তখনও তার শক্তি বিশ্বের সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়নি। মধ্য আমেরিকার শান্তি রক্ষার দায়িত্ব জাতিসংঘের নয় তা জাতিসংঘ মেনে নিয়েছিল। মিশর জাতিসংঘের সদস্য না হওয়ার ফলে গ্রেট ব্রিটেন এবং মিশরের বিবাদ আন্তর্জাতিক বিবাদ হিসাবে পরিচিতি পায়নি। চিন ও বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির বিবাদ জাতিসংঘের বিচার্য বিষয় হয়ে ওঠেনি। এই ঘটনাগুলি জাতিসংঘের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল। কিন্তু জাতিসংঘের কাজের পরিধি সুদূরপ্রসারী ছিল। আয়ারল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের বিরোধের মীমাংসা উচ্চ সাইলেশিয়াকে কেন্দ্র করে পোল্যান্ড ও জার্মাণির বিরোধের মিমাংসা করেছিল জাতিসংঘ। ১৯২০-১৯৩০ খ্রীঃ পর্যন্ত যুদ্ধ প্রতিরোধ করে এবং বিভিন্ন বিরোধের মীমাংসা করে জাতিসংঘ তার কার্যকলাপের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছিল। নরম্যান জাতিসংঘ সম্পর্কে একটি বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘ হল খারাপ মায়ের কন্যা সন্তান।' ১৯৩১ খ্রীঃ থেকেই জাতিসংঘের ব্যর্থতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। জাপান জাতিসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ করেছিল। ১৯৩৬ খ্রীঃ ইতালি ইথিওপিয়া আক্রমণ করলে ইথিওপিয়া জাতিসংঘে ইতালির বিরূদ্ধে অভিযোগ জানালেও জাতিসংঘ কোনও সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। জাতিসংঘ হিটলারের সাম্রাজ্যবাদী নীতিকে বাধা দিতে পারেনি। যার ফলে ১৯৩৯ খ্রীঃ জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করেছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ফলে প্রমাণিত হয়েছিল জাতিসংঘ বিশ্বে শান্তি রক্ষা করতে ব্যর্থ।
প্রথমত, কমপক্ষে পাঁচটি বড় রাষ্ট্র একসাথে এর সদস্য ছিল। কিংবা দুটি বড়ো রাষ্ট্র জাতিসংঘের বাইরে ছিল না এমন দিন জাতিসংঘের সময়কালে কখনও আসেনি। জাতিসংঘ বিশ্ব সংগঠন হলেও বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্র এর সদস্য ছিল না। মার্কিন রাষ্ট্রপতি জাতিসংঘ গঠনে মুখ্য কারিগর হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর সদস্য না হওয়ার ফলে জাতিসংঘের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছিল। জাতিসংঘ একটি বিতর্ক সভা ছিল। ইতালি ও জার্মান এর সদস্যপদ ত্যাগ করেছিল এবং সোভিয়েত রাশিয়া বিতাড়িত হওয়ায় জাতিসংঘের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, উগ্র জাতিয়তাবাদ ও সামন্ততন্ত্র জাতিসংঘের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল। ইতালিতে মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদ এবং জার্মানিতে হিটলারের উত্থানের ফলে জাতিসংঘের শান্তি বজায় রাখার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। নর্থ এজ এবং গ্রিড বলেছিলেন, ১৯৩১-৩৯ খ্রীঃ ছিল সংকটের সময়কাল। এই সময়কালে উগ্র জাতিয়তাবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদী নীতি জাতিসংঘকে দুর্বল করে দিয়েছিল। প্রথমে জাপান পরে ইতালি এবং সবশেষে জার্মান এই নীতি গ্রহন করার ফলে জাতিসংঘের ব্যর্থতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল।
তৃতীয়ত, জাতিসংঘের অধীনে কোনও নিজস্ব আন্তর্জাতিক সামরিক বাহিনী ছিল না। ফলে সদস্য রাষ্ট্রগুলির সামরিক বাহিনীর উপরই জাতিসংঘকে নির্ভর করতে হত। এর ফলে জাতিসংঘের পক্ষে সামরিক বাহিনীর সাহায্যে নির্দেশ অমান্যকারী রাষ্ট্রগুলিকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রেও নিজস্ব সামরিক বাহিনীর অভাব জাতিসংঘের ব্যর্থতা স্পষ্ট করে দিয়েছিল।
চতুর্থত, নর্থ এজ এবং গ্রীড জাতিসংঘের ব্যর্থতার ক্ষেত্রে তোষণ নীতির বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মাণির প্রতি তোষন নীতি নেওয়ায় জার্মানি আক্রমনাত্মক নীতি নেওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহিত হয়েছিল। ফলে জাতিসংঘের ব্যর্থতার জন্য তোষন নীতিকেও দায়ী করা হয়েছিল।
পঞ্চমত, উড্রো উইলসনের চৌদ্দ দফা নীতি অনুসারে যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত অস্ত্রের ব্যবহার হ্রাস করার কথা বলা হলেও জাতিসংঘ বিভিন্ন দেশের মধ্যে যে যুদ্ধ বা অস্ত্রের প্রতিযোগিতা চলছিল তা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। অস্ত্র নির্মাণ হ্রাসও জাতিসংঘ বন্ধ করতে পারেনি। ফলে জার্মানিও অস্ত্রশস্ত্রের দিক থেকে শক্তিশালী হয়ে জাতিসংঘের দুর্বলতাকে স্পষ্ট করেছিল।
ষষ্ঠত, জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে আনুগত্যের অভাব ছিল। লিগ কাউন্সিল-এর স্থায়ী সদস্যরা একমত না হলেও কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত না। স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলি নিজেদের স্বার্থকেই বড় করে দেখেছিল। আন্তর্জাতিক স্বার্থের পরিবর্তে রাষ্ট্রগুলির নিজের স্বার্থ বড় হওয়ার ফলে জাতিসংঘের ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠেছিল।
সপ্তমত, জাতিসংঘের সংবিধানটিও ত্রুটিপূর্ণ ছিল। জাতিসংঘের সংবিধানের ১০-১৫নং ধারায় যুদ্ধকে ‘বেআইনি’ ঘোষণা করা হলেও আগ্রাসন নিষিদ্ধ হয়নি। অর্থনৈতিক অবরোধের বিষয়টি আক্রমণকারী রাষ্ট্রের বিরূদ্ধে নেওয়া হলেও এর ফলে আগ্রাসন প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি।
অষ্টমত, জাতিসংঘকে উপেক্ষা করে জাপান ১৯৩১ খ্রীঃ মাঞ্চুরিয়া দখল করার ফলে জাতিসংঘের ব্যর্থতা প্রকাশ পেয়েছিল। জাপানের বিরুদ্ধে মাঞ্চুরিয়া জাতিসংঘের কাছে অভিযোগ করলেও জাতিসংঘ কোন কার্যকরী ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারেনি। জাতিসংঘ জাপানের মাঞ্চুয়িা অধিকারে প্রতিবাদ জানালে ১৯৩৩ খ্রীঃ জাপান জাতিসংঘের সদস্যপদ ছেড়ে দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাপানের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারাটাই জাতিসংঘের ব্যর্থতার অন্যতম পরিচয় ছিল।
নবমত, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা জাতিসংঘের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল। পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের প্রতি জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল, জার্মান, ইতালি ও স্পেনে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই ধরণের সাম্রাজ্যবাদী নীতি বিশ্বশান্তির পক্ষে অন্তরায় ছিল। জাপান, ইতালি, জার্মাণির কাছে জাতিসংঘ তার শান্তিস্থাপনের নীতিকে কার্যকরী করতে পারেনি। ফলে জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছিল।
জাতিসংঘ ব্যর্থ হলেও আর্থিক উন্নয়ন, শ্রমিকদের উন্নয়ন, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কৃতিত্ব রেখেছিল । ওয়ালটার্স তার ‘The League and the future collective security system' গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন—জাতিসংঘ ব্যর্থ হলেও তার আদর্শ ও আন্তর্জাতিক আবেদনটি স্থায়িত্ব লাভ করেছিল। David Armstrong তাঁর 'The rise of the
International organisation; A short Story' গ্রন্থে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক আইন, অর্থনৈতক স্বাধীনতা, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা এবং শান্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ যে উদ্যোগ নিয়েছিল তা উল্লেখযোগ্য ছিল।
0 Comments