- আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে লোকার্নো চুক্তির তাৎপর্য আলোচনা করুন?
জেনেভা প্রোটোকলের ব্যর্থতার পর ফ্রান্স জার্মাণির সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি পুনর্বিন্যাস্ত করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে। সৌভাগ্যবশত এই সময় জার্মানিতে গুস্তাভ স্ট্রেসেম্যান চ্যান্সেলরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখার পক্ষপাতি ছিলেন। ফ্রান্সের তরফ থেকে ফরাসি রাষ্ট্রপ্রধান ব্রিয়া জার্মানির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিলেন। এরই ফলশ্রুতি হিসাবে ১৯২৫ খ্রীঃ লোকার্নো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঐতিহাসিক ই.এইচ. কারের মতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে লোকার্নো চুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালীন পর্যায়ে জার্মানিকে অন্যান্য শক্তিগুলির সঙ্গে সমমর্যাদার আসন প্রদান করা হয়। টেলরের মতে, যদি কোনো চুক্তির সাফল্যের মানদন্ড স্বাক্ষরকারীদের সন্তুষ্টি বিধানের ওপর নির্ভরশীল হয় তাহলে লোকার্নো চুক্তিকে নিঃসন্দেহে আদর্শ একটি চুক্তি হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। চেম্বারলেন, ব্রিয়া এবং স্ট্রেসেম্যান জাতীয় বীরের মর্যাদা লাভ করেন এবং যৌথভাবে এদের নোবেল শান্তি পুরষ্কার প্রদান করা হয়। ভাওয়েজ পরিকল্পনা প্রবর্তনের জন্য ক্ষতিপূরনকে কেন্দ্র করে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল তা কিছুটা হ্রাস পায়। ফ্রান্স ও জার্মাণিতে নতুন সরকার দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের পথ পরিহার করে শান্তি ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার পথ প্রশস্ত করে। এইজাতীয় মানসিকতা লোকার্নো চুক্তি স্বাক্ষরের পথও প্রশস্ত করে। লোকানো চুক্তির মূল্যায়ন করতে গিয়ে টেইলর বলেছেন, 'Locarno gave the
Europe a period of peace and hope' । জার্মানিকে লিগ অব নেশনস এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন লোকার্নো চুক্তির স্বাক্ষর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল এবং এগারো বছর পর এই চুক্তি লঙ্ঘন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাস দেয়। এই চুক্তিতে বিজয়ী ও বিজিত উভয়পক্ষেই সমতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে সম্মেলনে মিলিত হয়। ফলে যুদ্ধজনিত বিদ্বেষ ও তিক্ততার অবসান ঘটে। এই চুক্তির দরুন উত্তেজনাপ্রবন রাজনীতির স্থলে পারস্পরিক বোঝাপড়ার পথ প্রশস্ত হয়। রেনি অ্যালবার্ট কেরি লোকার্নো চুক্তির মূল্যায়ন করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন 'Locarno represent
nonetheless an important landmark in the story of the post war era' লোকানো চুক্তির দরুন জার্মানি পশ্চিম ইউরোপে কোনো আঞ্চলিক দাবি থেকে বিরত থাকে এবং অসুবিধে সত্ত্বেও ভার্সাই চুক্তির ৪২ এবং ৪৩ নং ধারা মেনে নিতে রাজি হয়। তাছাড়া কোনভাবেই লোকার্নো চুক্তির মধ্যে চাপিয়ে দেওয়ার কোনো ব্যাপার ছিল না। জার্মানির সম্মতি পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই গৃহিত হয়। পশ্চিম সীমান্তের গ্যারান্টির বিষয়টি রেনি অ্যালবার্ট কেরির মতে কূটনৈতিক দিক দিয়ে সাফল্যের পরিচায়ক ছিল, কারণ ফ্রান্সের নিরাপত্তার চাহিদা অনেকটাই পূরণ করা সম্ভবপর হয়েছিল। লোকার্নো ছিল জার্মানির পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। লোকার্নো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে মানসিকতা সৃষ্টি করেছিল তার গুরুত্বও যথেষ্ট ছিল। লোকার্নো চুক্তি সমসাময়িক কালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট আশা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করলেও এই চুক্তি সীমাবদ্ধতার উর্দ্ধে ছিল না। ঐতিহাসিক Ruth Henning মনে করেন, লোকার্নো চুক্তি যথেষ্ট আশা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করলেও কতকগুলি প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। প্রথমত, ব্রিটেন ফ্রান্স-জার্মানি ও বেলজিয়াম-জার্মানির সীমান্ত সম্পর্কে গ্যারান্টি প্রদান করেছিল সেই বিষয়ে ব্রিটেন নিজে কতটা কারণেই Henning তুলেছেন যে, এই গ্যারান্টির দায়িত্ব নির্বাহ করার জন্য ব্রিটেন পর্যাপ্ত পরিমানে সেনা মোতায়েন করেনি। তাছাড়া ফরাসি অথবা জার্মাণির কোন শক্তির আগ্রাসনের মোকাবিলা কোন পরিস্থিতিতে করতে হবে সেই বিষয়েও কোনোরকম স্থিরতা বা নিশ্চয়তা ছিল না। জার্মানি পশ্চিম ইউরোপ ও রাইনল্যান্ডে ভার্সাই চুক্তি কর্তৃক নির্ধারিত সীমানা মেনে নিতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু পূর্ব ইউরোপের ক্ষেত্রে জার্মানি ভার্সাই ব্যবস্থা না মেনে রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে ওই ব্যবস্থা পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করবে এমন প্রশ্ন নিয়েও অনিশ্চয়তা ছিল। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে ব্রিটেনের সীমিত দায়িত্বের বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায়। বলাবাহুল্য, ব্রিটেন কর্তৃক গৃহিত এই দায়িত্বে ফ্রান্স সন্তুষ্ট ছিল না। ১৯২৫ এর পর থেকে জার্মানির দ্বারা ভার্সাই চুক্তি সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। জার্মানির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে Henning যে প্রশ্ন তুলেছেন তার ভিত্তি রয়েছে, কেননা Taylor তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, লোকার্নো চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই স্ট্রেসেম্যান রাশিয়ার সঙ্গে ১৯২২ খ্রীঃ স্বাক্ষরিত র্যাপালো চুক্তির নবীকরণ করেন এবং লিগ অব নেশনস এ যোগদান করার পব স্ট্রেসেম্যান এই মর্মে বক্তব্য রাখেন যে, জার্মানির উপস্থিত সামরিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জার্মানির পক্ষে কোনরকম অবরোধ ব্যবস্থায় শামিল হওয়া সম্ভবপর নয়। টেইলরের মতে, এর মধ্য দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি জার্মানির একটি প্রছন্ন নিরপেক্ষতার মনোভাব প্রকাশ পায় । লোকার্নো চুক্তিতে রাশিয়া এবং আমেরিকার উপস্থিত ছিল না। এই দুটি শক্তির অনুপস্থিতি নিঃসন্দেহে লোকার্নো চুক্তির একটি সীমাবদ্ধতা ছিল। তবে টেইলর মনে করেন যে, এর চেয়েও বড় একটি ছিল লোকার্নো চুক্তিতে ইতালির উপস্থিতি। পরবর্তী পর্যায়ে ইতালি সম্পর্কে এইরূপ একটি ধারণার সৃষ্টি হয় যে ইতালি জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম। টেইলরের মতে এই ভ্রান্ত ধারণার ফলে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পক্ষে ক্ষতিকারক হয়েছিল।
0 Comments