- ভার্সাই সন্ধি জার্মানির পক্ষে একটি “জবরদস্তিমূলক সন্ধি ” আলোচনা করুন। অথবা ভার্সাই ব্যবস্থার একটি সমালোচনামূলক টীকা লিখুন?
- অথবা
- ভার্সাই চুক্তি একটি “আরোপিত শান্তিচুক্তি” অলোচনা করুন?
- অথবা
- আপনি কী মনে করেন যে ভার্সাই সন্ধির দ্বারা জার্মানিকে অপদস্ত করা হয়েছিল?
- ভার্সাই চুক্তি কী প্রকৃতই কঠোর ছিল ? অথবা ‘পরাজিত বীরদের রক্ত দিয়েই ভার্সাই চুক্তির শর্তগুলি লেখা হয়েছিল'—মন্তব্য করুন?
ভার্সাই চুক্তির সমালোচকদের মধ্যে বেশ কিছু কাল ধরেই এই মর্মে ধারণা, বলবৎ ছিল যে এই চুক্তি আদৌ ন্যায়সঙ্গত ছিল না। সমসাময়িক কূটনীতিবিদদের মধ্যে হ্যারল্ড নিকসন ও নরম্যান ডেভিস, খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ জে. এম. কেইনস এবং ঐতিহাসিক WH উইলসন প্রমুখ ভার্সাই চুক্তির বিরূদ্ধে মত ব্যক্ত করেন। বলা হয় যে ভার্সাই চুক্তির কঠোরতার দরুনই নাৎসীবাদের জঙ্গি মনোভাব অনেকাংশে গড়ে উঠেছিল। এই সমালোচকেরা আরও বলেন যে, কাইজারের ওপর আরোপিত যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি ওয়েইমার প্রজাতন্ত্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কোনোরকম যৌক্তিকতা ছিল না বিশেষ করে যখন এই প্রজাতন্ত্র দক্ষিনপন্থীদের আক্রমণের হাত থেকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। জার্মানদের মধ্যে বিভিন্ন মতাবলম্বী ব্যক্তিবর্গই ভার্সাই চুক্তিকে কঠোর ও আরোপিত একটি একটি চুক্তি বলে সমালোচনা করেন। ভার্সাই চুক্তির আঞ্চলিক শর্তগুলির বিরুদ্ধেও তীব্র আলোচনা করা হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে যে, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রের বিষয়টি সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। উত্তর শ্লেজডিগ এর ডেন এবং দক্ষিণ সাইলেশিয়ার চেকদের ক্ষেত্রে এই অধিকার দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সুদেতান অঞ্চল বা অস্ট্রিয়ার জার্মাণদের ক্ষেত্রে এই অধিকার প্রদান করা হয়নি। ফলে চেকোশ্লাভিয়া ও পোল্যান্ড অঞ্চলে অসংখ্য বিক্ষুব্ধ জার্মানদের সমাবেশ গড়ে উঠেছিল। ঐতিহাসিক ল্যাৎসাম বলেছেন যে, ভার্সাই চুক্তি পুরানো সমস্যা যতটা না সমাধান করেছিল তার চেয়ে নতুন সমস্যার বেশি সৃষ্টি করেছিল। পোল্যান্ড ও চেকোশ্লাভিয়ার জার্মাণ জাতিগোষ্ঠির অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা করে যে সংখ্যালঘু সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছিল তা পরবর্তী পর্যায়ে ইউরোপীয় শক্তির পক্ষে ক্ষতিকারক হয়েছিল। ভার্সাই চুক্তির একজন বড়ো সমালোচক ছিলেন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ জে. এম. কেইনস। তিনি তাঁর গ্রন্থ 'Economics
Consequence of peace'-এ ভার্সাই চুক্তির অর্থনৈতিক শর্তগুলির কঠোর সমালোচনা করেন। তাঁর মতে জার্মানির অর্থনীতির ভিত্তিকে পঙ্গু করে দেওয়ার যে প্রচেষ্টা চুক্তি প্রনেতাবর্গ গ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে দিয়ে তাদের অদুরদর্শিতার পরিচয় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। ভার্সাই চুক্তির অন সমালোচকদের বক্তব্য ছিল—ভার্সাই চুক্তির একটি মাত্র সমাধান ছিল তা হল এ চুক্তির সংশোধন।
Finance Subcommittee ভার্সাই চুক্তির সমর্থনে পরবর্তী পর্যায়ে বেশ কিছু ঐতিহাসিক বক্তব্য রেখেছেন। Ruth Hening. তাঁর ' Versailles and
after 1919-1933' গ্রন্থে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং তিনি ১৯৭০ এর দশকের পর থেকে ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু বহু আগেই ফরাসী প্রধানমন্ত্রী ভার্সাইয়ের 'সমর্থনে বক্তব্য রেখেছিলেন। ভার্সাই চুক্তির আঞ্চলিক শর্তসমূহের সমর্থনে বলা হয়ে থাকে যে, জার্মান যুদ্ধে জয়লাভ করলে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটত তাঁর তুলনায় ভার্সাই চুক্তির দরুন আঞ্চলিক পরিবর্তন তুলনামূলক কম ছিল। F.Fisher দেখিয়েছেন যে, জার্মানির যুদ্ধ সংক্রান্ত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী ব্যাপক অঞ্চল জার্মানির অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল। ক্ষতিপূরণ সম্পর্কিত ব্যাপারে কেইনস-এর বক্তব্যের বিরূদ্ধে বক্তব্য রাখেন ই. মান্তু। তাঁর মতে, ১৯৩০ এর দশকে জার্মানি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে ধরণের অগ্রগতি ঘটিয়েছিল তা থেকে বোঝা যায় যে, জার্মাণির অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অগ্রগতি ঘটানোর মতো অন্তর্নিহিত শক্তি ও ক্ষমতা ছিল। সুতরাং সেক্ষেত্রে কেইনস এর ‘জার্মাণির পক্ষে এই বিপুল পরিমান অর্থ প্রদান করা অসম্ভব' -এই বক্তব্যটি অপ্রযোজ্য। ভার্সাই চুক্তির সমর্থনে ঐতিহাসিকেরা নানা ব্যাখ্যা দিলেও একথা অস্বীকার করা চলে না যে, এই চুক্তি শান্তি স্থাপনের ব্যাপারে সাফল্যের পরিচয় দিতে পারেনি। কারণ চুক্তি স্বাক্ষরের দু-দশকের মধ্যে আরও একটি ধ্বংসাত্মক তান্ডব সমগ্র পৃথিবীর শান্তিকে বিনষ্ট করেছিল। টেলরের মতে, ভার্সাই চুক্তির মূল সমস্যা ছিল এই যে, শুরু থেকেই এই চুক্তি কার্যকরী করার প্রয়োজন ছিল, কেননা জার্মানরা কখনোই এই চুক্তি মেনে নেয়নি, Antony Lentin 'Guilt at versailles' গ্রন্থে ম্যাকিয়াভেলির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন যে, “বিজয়ী শক্তির উচিত বিজিত শক্তিকে সন্তুষ্ট করা অথবা পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা। কিন্তু ভার্সাই চুক্তি এর কোনোটাই করেনি। যুদ্ধের এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির জন্য জার্মানিকে দায়ী করা হয়েছিল। এই কারনে তীব্র জার্মাণ বিরোধী একটি বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসাপরায়ন মানসিকতার মধ্যে শান্তি সম্মেলনের প্রতিনিধিবর্গকে অগ্রসর হতে হয়েছিল।
ইতালির ন্যায় রাষ্ট্রের উপস্থিতিতে আরেকটি বিষয় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে তা হল যে, যুদ্ধের সময় যে সব প্রতিশ্রুতি বা দায়িত্বভার গ্রহণ করা হয়েছিল সেগুলি পালন করার ব্যাপারে প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে উপস্থিত কুটনীতিবিদদের ভাবতে হয়েছিল। যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হয়েছিল ততই গোপন কূটনৈতিক চুক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। অনেকক্ষেত্রে এই চুক্তিগুলি গৃহিত সিদ্ধান্তেরই ফল ছিল।
0 Comments