যৌথ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জেনেভা প্রোটোকলের ভূমিকা কী ছিল ? কেন এই প্রোটোকলটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় ? জেনেভা প্রোটোকল মূল্যায়ন করুন? অথবা, জেনেভা প্রোটোকলের ব্যর্থতাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

 

  • যৌথ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জেনেভা প্রোটোকলের ভূমিকা কী ছিল ? কেন এই প্রোটোকলটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় ? জেনেভা প্রোটোকল মূল্যায়ন করুন?
  • অথবা, জেনেভা প্রোটোকলের ব্যর্থতাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

                                      প্রথম বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর ইউরোপের সন্মুখে অন্যতম মূল সমস্যা ছিল ভবিষ্যৎ যুদ্ধবিগ্রহের সম্ভাবনা হতে এই মহাদেশের নিরাপত্তা রক্ষা করা। প্যারিস শান্তি সম্বেলনে এই উদ্দেশ্যেই নানা রক্ষাকবচের কথা চিন্তা করা হয়েছিল। জাতিসংঘ সৃষ্টি করা হয়েছিল এই একই উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য। কিন্তু শীঘ্রই দেখা গেল যে লীগ অফ নেশনস এর চুক্তিপত্র একেবারে ত্রুটিহীন নয়। কোন সমস্যা সমাধানে লীগ কাউন্সিলে মতানৈক্য ঘটলে তা কিভাবে মীমাংসা করতে হবে তার কোন নির্দেশ চুক্তিপত্রের শর্তাদির মধ্যে ছিল না। উপরন্তু ১৯২৩ খ্রীঃ লীগের সাধারণ সভার আলোচনায় স্থির হয় যে আক্রমণকারী দেশের বিরূদ্ধে শর্তানুযায়ী কি ধরণের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে, তা প্রত্যেক দেশের সরকারই স্থির করবেন। এই অবস্থায় যুগ্ম নিরাপত্তার মূল ভিত্তিই দুর্বল হয়ে গেল লীগ-অফ-নেশনস এর কার্যকারিতা সম্বন্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গ একমত পোষণ করত না। ফ্রান্স ইউরোপের অন্যান্য ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো নিজ নিজ নিরাপত্তার প্রয়োজনে লীগের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে সর্বদাই আগ্রহী ছিল। তারা লীগের মাধ্যমেই যুগ্ম নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলবার জন্য চেষ্টা করে আসছিল। ফ্রান্স প্রস্তাবিত পারস্পরিক সাহায্য-সহায়তা চুক্তির খসড়া যখন বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহিত হতে পারল না, তখন সাময়িকভাবে হতাশার ভাব দেখা দেয়। কিন্তু লীগের মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলবার জন্য চেষ্টার বিরাম হল না। লীগের ত্রুটিগুলো দূর করার জন্য গ্রীস চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রতিনিধিদ্বয় ১৯২৪ খ্রীঃ লীগের সাধারণ সভার পঞ্চম অধিবেশনে একটি দলিল পেশ করেন। কিন্তু সাধারণত এটি জেনেভা প্রোটোকল নামে পরিচিত। যুদ্ধ প্রতিরোধের ব্যাপারে লীগের যে দুবর্লতা ছিল তা দূর করার উদ্দেশ্য নিয়েই এটি রচিত হয়েছিল। এই জেনেভা প্রোটোকলের দলিলটি সাধারণ সভায় উপস্থিত করা হলে ইউরোপের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহ প্রায়ই একে সমর্থণ জানাল। কিন্তু বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো এর অনেক শর্তকে আপত্তিমূলক মনে করল – 

() ব্রিটেনের শ্রমিক মন্ত্রীসভা এই দলিলকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯২৪ খ্রীঃ শেষভাগে রক্ষণশীল দলের মন্ত্রীমন্ডলী গঠিত হলে তারা প্রোটোকলের বাধ্যবাধকতার মধ্যে যেতে অস্বীকার করলেন। 

() ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন সমূহ এই প্রোটোকলের বিরূদ্ধে মতপ্রকাশ করল। এর একাদশ শর্ত দ্বারা কোন দেশের আভ্যন্তরীন সমস্যায় লীগ কাউন্সিলকে হস্তক্ষেপের যে অধিকার দেওয়া হয়েছিল তা কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশের মনঃপূত ছিল না। কারণ তারা তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণে নিজ নিজ দেশ হতে জাপানিদের বহিষ্কার করতে ব্যস্ত ছিল। 

() ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষ, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি কয়েকটি দেশ নিজ নিজ দেশের উন্নয়নের ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে এই অজুহাতে কোন দেশকে সাময়িক সাহায্য দানের অক্ষমতা জানাল। 

() বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের নীতি আক্রমণকারী দেশকে সমষ্টিগতভাবে শাস্তিদানের নীতি তখনও কয়েকটি দেশের রাজনীতিকরা গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না।

১৯২৫ খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী অষ্টিন চেম্বারলেন স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন যে ব্রিটিশ সরকার জেনেভা প্রোটোকল গ্রহণ করবেন না। দেশের প্রোটোকলের নিরস্ত্রীকরণের শর্তটিরও আর কোন মূল্য রইল না, এইরূপভাবে এই প্রচেষ্টার অপমৃত্যু ঘটল।

  • জেনেভা প্রোটোকল?

                                        জেনেভা প্রোটোকলের সমান্তরালভাবে ফ্রান্স লিগ অব নেশনস-এর মাধ্যমে তার নিরাপত্তাকে বজায় রাখার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। মূলত ফ্রান্সের উদ্যোগে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাকডোনাল্ড হেরিয়ট লিগ চুক্তিপত্রের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলি দূর করার জন্য লিগের সাধারণত সভায় একটি দলিল পেশ করেন। সাধারণত এই দলিলটিই জেনেভা প্রোটকল নামে পরিচিত। জেনেভা প্রোটোকলে আক্রমণাত্মক যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। তাছাড়াও জেনেভা-প্রোটোকল অনুযায়ী স্থির করা হয় স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলি কখনোই এক অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে না। দ্বিতীয়ত আন্তর্জাতিক আইন বা চুক্তি সংক্রান্ত বিবাদ বিসম্বাদ আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে উপস্থিত করা হবে। এতে আরো বলা হয় লিগ-কাউন্সিল আক্রমণকারী দেশসমূহের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অবলম্বন করবে। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য রাষ্ট্রকে লিগ প্রয়োজনীয় সাহায্য দেবে এবং প্রয়োজন হলে আক্রমণকারী দেশের টপ যুদ্ধ সৃষ্টির জন্য ক্ষতিপূরণ আরোপ করবে। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জুনের মধ্যে নিরস্ত্রীকরণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বানের একটি শর্ত এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই প্রোটকলের অন্যতম এক বৈশিষ্ট্য হল যে এর মধ্য দিয়ে স্থির হয় যে এরপর বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিবাদ বিসম্বাদের ক্ষেত্রে লিগ কাউন্সিল প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। জেনেভা-প্রোটোকলের ব্যর্থতা : ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলি বেশিরভাগই জেনেভা প্রোটোকলকে সমর্থন জানায়। কিন্তু বৃহৎ শক্তিগুলি এই প্রোটোকলের কিছু শর্ত সম্পর্কে আপত্তি জাগায় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী অষ্টেন চেম্বারলেন জানিয়ে দেন যে ব্রিটিশ সরকার জেনেভা প্রোটকল গ্রহণ করবেন না। এই অবস্থায় প্রোটকলের নিরস্ত্রীকরণের শর্তটির আর কোন মূল্য থাকল না, ফলে জেনেভা-প্রোটোগল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

  • কেলগ ব্রিয়াঁ চুক্তি (১৯২৮ খ্রীঃ)?

লোকার্নো চুক্তির পর জাতিসংঘের বাইরে থেকে নিরাপত্তা সমস্যার সমাধানে প্রধানতম পদক্ষেপ হল প্যারিসের চুক্তি। প্যারিসে এক সম্মেলনে যুদ্ধাবসানের উদ্দেশ্যে প্যারিস চুক্তি নামে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে জাতিসঙ্ঘের পোল্যান্ডের প্রতিনিধি সকল প্রকার আক্রমণাত্মক যুদ্ধ তখন থেকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দেন। এই ঘোষণা সর্ববাদী সম্মত হয়েছিল। ঐতিহাসিক দিক থেকে নিরাপত্তা সমস্যা সমাধানে একটি স্বতন্ত্র প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। এরই পরিণতি প্যারিসের চুক্তি। প্যারিসের চুক্তিকে ফরাসি মার্কিন যৌথ উদ্যোগের ফল বলা যায় (The poet of paris war born of American initialise and Frerch courtsey) ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিলে ফরাসি বিদেশমন্ত্রী ব্রিয়াঁ প্রভাবশালী মার্কিন নাগরিকদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি চুক্তির প্রস্তাব উপস্থাপিত করেন। তাতে বলা হয় ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই দুটি দেশ জাতীয় নীতির হাতিয়ার হিসেবে যুদ্ধ বর্জন করবে। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত করে মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব ফ্রান্স কেলা্ এই চুক্তিকে সম্প্রসারিত করে বিশ্বজনীন করার পাল্টা প্রস্তাব রাখলেন। ব্রিয়া এতে সম্মত হলেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ২৭শে আগস্ট ছয়টি বৃহৎ শক্তির প্রতিনিধিবর্গ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি জাপান) তিনটি লোকার্নো চুক্তিভুক্ত শক্তি (বেলজিয়াম, পোল্যান্ড চেকোশ্লোভাকিয়া) এবং ব্রিটিশ স্বশাসিত উপনিবেশগুলো ভারত প্যারিসে মিলিত হয়ে চুক্তিটি স্বাক্ষর করে। বিশ্বের অন্যান্য স্বাধীন রাষ্ট্রবর্গকে এই চুক্তিতে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই চুক্তির প্রধান প্রধান শর্তগুলি হল

(i) যুদ্ধবিগ্রহের নীতি বর্জন করা এবং জাতীয় উন্নতির জন্য যুদ্ধ পরিহার করা। 

ii) শান্তিপূর্ণভাবে সব ধরনের পারস্পরিক সংঘাতের মীমাংসা এবং 

(iii) এই চুক্তিপত্র অন্যান্য রাষ্ট্রের গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত রাখা। চুক্তির প্রাথমিক রচয়িতারা জানিয়েছিলেন যে চুক্তির দ্বারা আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ ঘোষণা নিষিদ্ধ করা হয়নি। ব্রিটেন জানিয়ে দেয় যে তার ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার অধিকার বলতে বিশ্বের কয়েকটি অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, কারণ অঞ্চলগুলোর অখণ্ডতা এবং মঙ্গলসাধন তার শান্তি নিরাপত্তার সঙ্গে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মরক্ষার অর্থ হল মনরো নীতির লঙ্ঘন ঘটলে তার প্রতিরোধ করা। সকল ব্যাখ্যার ফলে চুক্তিটির সার্বিক চরিত্র ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। অসম্পূর্ণ হলেও চুক্তিটি এক বিরাট পদক্ষেপ ছিল। ইতিহাসে এটাই ছিল প্রায় বিশ্বজনীন প্রথম রাজনৈতিক চুক্তি। প্রথমে অনিচ্ছুক হলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন এত উৎসাহী হল যে প্যারিস চুক্তি সাধারণভাবে স্বীকৃত হবার আগেই তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে এটি কার্যকর করার জন্য একটি আলাদা চুক্তির প্রস্তাব করে তা সম্পাদন করেন। কমপক্ষে পয়ষট্টিটি দেশ চুক্তিটি গ্রহণ করেছিলএই সংখ্যা জাতিসঙ্ঘের বর্তমান সদস্যসংখ্যার তুলনায় কিছু (সাতজন) বেশি ছিল। চুক্তিটির উপযোগিতার জন্য নয়সম্ভবত শুধু মতৈক্যে আসার জন্যই অনেক রাষ্ট্র এতে যোগ দেয়। জাপান ইটালি শীঘ্রই এটি খোলাখুলিভাবে লঙ্ঘন করতে শুরু করে। চুক্তিটির মার্কিন উদ্যোক্তাদের দ্বারা ব্যবহৃতযুদ্ধ বেআইনীসজ্ঞার অর্থ ছিল বিশ্বজনীন অলিখিত একটি আইন যার দ্বারা যুদ্ধকে দোষনীয় বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। আইনভঙ্গ হয়েছে তা নির্দেশ দানের জন্য কোন কতৃপক্ষ ছিল না। কিন্তু বিশ্বের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় এই ভাবাদর্শ গভীর রেখাপাত করেছিল।

Post a Comment

0 Comments