ইতালির ঐক্য আন্দোলনে মাৎসিনি ও ক্যাভুরের ভূমিকা আলোচনা করুন? অথবা ইতালির ঐক্য আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায় সংক্ষেপে আলোচনা করুন?

 

  • ইতালির ঐক্য আন্দোলনে মাৎসিনি ক্যাভুরের ভূমিকা আলোচনা করুন?
  •  অথবা ইতালির ঐক্য আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায় সংক্ষেপে আলোচনা করুন

                             মাৎসিনি : ইতালির ঐক্য আন্দোলনে মাৎসিনির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন। গ্রেনভিলের মতে, “মাৎসিনি ছিলেন ইতালির প্রজাতান্ত্রিক ঐক্যের মস্তিষ্ক, এবং বিধিপ্রেরিত নায়ক”, সি. ড়ি হ্যাজিনের মতে, “মাৎসিনি ছিলেন ইতালির পুনঃজাগরণের আধ্যাত্মিক শক্তি, নবজাগরণের প্রত্যাদেশীয় পুরুষ।ইতালির জেনোয়া নগরীতে এক চিকিৎসকের গৃহে ১৮০৫ খ্রীঃ মাৎসিনির জন্ম হয়। মাৎসিনি ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির, এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। যিনি ছিলেন স্বভাব সাহিত্যিক। দান্তে, সেক্সপিয়র, কেরটে,শিলার প্রভৃতি সাহিত্যিকদের তিনি ছিলেন অণুরাগী পাঠক। তাঁর লেখনি ছিল যুক্তিতে ক্ষুরধার, আবেগে সিঞ্চিত। ইয়ং ইতালীয় পত্রিকায় তাঁর প্রকাশিত রচনাবলি ইতালির যুবশক্তিকে অণুপ্রানিত করেছিল। তিনি ১৮৩৩ খ্রীঃ ইতালি থেকে নির্বাসিত হন। দীর্ঘকাল পিতৃভূমি থেকে দূরে থাকলেও তিনি সংবাদপত্রের মাধ্যমে ইতালির মুক্তির জন্য জনগণের মানসিক প্রস্তুতি করেন। ইয়ং ইতালি দল গঠন এবং আন্দেলন ছিল মাৎসিনির শ্রেষ্ঠ অবদান। মাৎসিনি মনে করতেন যে ইতালির জনসাধারণের মধ্যে ইতালিয় মুক্তি ঐক্যের চেতনা না জাগলে প্রকৃত ঐক্য আসবে না। এজন্য তাঁর দল প্রচারে মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ ইতালির আদর্শ ছড়িয়ে দেয়। তিনি শ্বেত, রক্ত সবুজ রঙের সজ্জিত ইতালির জাতীয় পতাকার প্রবর্তন করেন। এই পতাকার একপিঠে গনতন্ত্র, সাম্য মানবতা এবং অপর পিঠে স্বাধীনতা ঐক্য কথাগুলি লিখিত ছিল। ইয়ং ইতালি দলের মুখ্যপত্রের নাম ছিল ইয়ং ইতালি। এই পত্রিকা জনসমাজে বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। ইয়ং ইতালি আন্দোলনের প্রভাবে প্রাদেশিকতা, আঞ্চলিকতায় খন্ডিত ইতালি নতুন ঐকবোধে জেগে ওঠে। ইতালির মানসিক ভাবগত ঐক্যের বুনিয়াদ রচিত হয়। মাৎসিনি জানতেন যে, ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করার পক্ষে প্রধান বাধা হল ইতালিতে অস্ট্রিয়ার আধিপত্য। এজন্য তিনি বলপ্রয়োগের দ্বারা অস্ট্রিয়াকে বহিষ্কার করার কথা বলেন। অস্ট্রিয়ার বিরূদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে ইতালিবাসীরা নিজ শক্তিতে জয়লাভ করতে সক্ষম বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি বৈদেশিক শক্তির সহায়তা গ্রহণের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর নীতি ছিলইতালিকে নিজ শক্তিতে মুক্ত হতে হবে। তিনি গণবিদ্রোহ গেরিলা যুদ্ধের উপর গুরুত্ব দেন। তাঁর মতে 'Education and Insurrection ' অর্থাৎ জনগণের সঠিক রাজনৈতিক শিক্ষা এবং বিদ্রোহের মাধ্যমে ইতালির মুক্তি আসবে। মাৎসিনি মনে করতেন যে, বৈদেশিক শাসন থেকে ইতালির মুক্তি শেষ কথা নয়। ইতালির ঐক্য হল এই আন্দোলনের আসল লক্ষ্য। তিনি ইয়ং ইতালির স্বেচ্ছাসেবকদের বলেন যে, “কেবলমাত্র ইতালি, ঐক্যবদ্ধ ইতালি তোমাদের মন্ত্র হবে,” ইতালিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছিল মাৎসিনির অণ্যতম প্রধান লক্ষ্য। ঐক্যবদ্ধ ইতালিতে প্রজাতন্ত্র গনভোট ব্যবাস্থা স্থাপণের দ্বারা ইতালিয় রিসঅর্বিমেন্টে বা মুক্তি আন্দোলন সম্পূর্ণ হবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।

মাৎসিনি কেবলমাত্র অলস আদর্শবাদের পুঁজারি ছিলেন না। তিনি আদর্শের সঙ্গে কর্মের সমন্বয় করার চেষ্টা করেন। তারই প্রভাবে ইতালির যুব সমাজের মধ্যে ইয়ং ইতালি দল বিশেষ অণুপ্রেরণা সঞ্চার করে। তিনি ইতালির মুক্তি আন্দোলনকে রাজা অভিজাত শ্রেণীর কবল থেকে মুক্ত করে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। বোল্টন কিং নামক ঐতিহাসিকের মতে জাতীয় মুক্তির সঙ্গে জনসাধারণের যোগসূত্র স্থাপন ছিল মাৎসিনির মুখ্য কৃতিত্ব। ইতালির জনসাধারণের মধ্যে দেশপ্রেম স্বদেশের ঐক্য চিন্তার জাগরণ দ্বারা তিনি ইতালির ভাবগত ঐক্য সম্পন্ন করেন।

কাভুর : ম্যাৎসিনির প্রধান কৃতিত্ব ছিল যে, ইতালির দেশপ্রেমিকদের তিনিই ছিলেন শিক্ষক প্রেরণাদাতা। বাস্তবক্ষেত্রে তাঁর পরিকল্পনার বিশেষ সাফল্য দেখা যায় না। কিন্তু তাঁর আদর্শবাদী প্রভাবেই ইতালিতে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী অভ্যুত্থান ঘটে এবং কাভ্যুর তা ব্যবহার করে ইতালির ঐক্য স্থাপন করেন। নতুবা বৈদেশিক সহায়তা নিয়ে কাড্যুরের মুক্তিযুদ্ধের সফলতা আসত না। ম্যাৎসিনীর প্রত্যক্ষ আন্দোলনগুলি সফল হয়নি। তিনি বেশিরভাগ সময় নির্বাসনে জীবন কাটান। ১৮৮৪ খ্রীঃ তিনি রোমান প্রজাতন্ত্র গঠন করলেও তা ফরাসী সেনার আক্রমণে ধ্বংস হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন নব ইতালীর প্রাণপুরুষ। তাঁরই প্রভাবে মধ্য ইতালির প্রজাতান্ত্রিক দেশপ্রেমিকরা হ্যাপসবার্গ শাসকদের বিতাড়িত করে এবং পিডমন্টের সঙ্গে সংযুক্তি ঘোষণা করে। তাঁরই ভাবশিষ্য গ্যারিবল্ডী দক্ষিণ ইতালি জয় করেন। পরে তা পিডমন্টের সঙ্গে, সংযুক্ত হয়। যদিও ইতালির বৃহত্তম নিরক্ষর কিষাণ উচ্চ বুর্জোয়ারা তাকে সমর্থণ করেনি। এজন্য তার প্রজাতান্ত্রিক আদর্শ রূপায়িত হয়নি। কিন্তু ইতালিতে প্রজাতন্ত্র স্থাপিত না হওয়ার কারনে ক্যাভুর কর্তৃক স্থাপিত ইতালির রাজনৈতিক ঐক্য ইতালিয়দের আশা-আকাঙ্খা পূরণে ব্যার্থ হয়, কারণ কাভ্যুর কর্তৃক রাজতান্ত্রিক ঐক্য ছিল অসম্পূর্ণ এবং ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থা। ম্যাৎসিনীই ছিলেন ইতালির রিসঅর্গিমেন্টোর আত্মা স্বরুপ। গ্রেনভিলের মতে, যদি ম্যাৎসিনির বিপ্লবী ভাবধারা কার্যকারী না থাকত তবে মধ্য ইতালি দক্ষিণ ইতালি পিডমন্টের সহিত সংযুক্ত হত। ম্যাৎসিনির প্রজাতান্ত্রিক আদর্শকে ক্যাভুর পরিত্যাগ করেন। ইতালিয় বিপ্লবীদের স্বপ্নের ইতালি ক্যাভুর গঠন করেন নি। গনভোট প্রজাতন্ত্রের আদর্শ ত্যাগ করে ক্যাভুর সম্পত্তির ভোটাধিকারের ভিত্তিতে একটি বুর্জোয়া রাজতন্ত্র স্থাপন করেন। এর ফলে বুর্জোয়া শ্রেণীই রাজনৈতিক ক্ষমতা পায়। সমাজের দরিদ্র বঞ্চিত লোকেরা পদানত থাকে। ম্যাৎসিনী ইতালির সর্বসাধারণের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মুক্তির যে চিন্তা করতেন কাভ্যুর তা ত্যাগ করেন।

Post a Comment

0 Comments