- প্যারী কমিউন?
ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়ার যুদ্ধে জার্মানির কাছে ফ্রান্সের পরাজয় ফ্রান্সের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতনু অধ্যায়ের সূচনা করল। সেডানের যুদ্ধে পরাজয়ের দুদিন পর ফ্রান্সে দ্বিতীয় রাজতন্ত্রের পতন ঘটল এবং তৃতীয় ফরাসি প্রজাতন্ত্র ও অন্তবর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হল (৪ ঠা সেপ্টেম্বর)। এই অন্তবর্তী সরকার জার্মাণীর সঙ্গে যুদ্ধ বিরতি সম্পাদন করল। এরপর নতুন ভাবে সংবিধান রচনা করবার দায়িত্ব এক নব নির্বাচিত জাতীয় সভার ওপর ন্যাস্ত করা হল। ফ্রান্সের কৃষক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। কিন্তু শীঘ্রই নতুন সরকারের সঙ্গে প্যারিসের জনগণের সংঘর্ষ সৃষ্টি হল। ফলে ফ্রান্সের অভ্যন্তরীন ইতিহাসে যে ভয়াবহ অন্তদ্বন্দ্ব দেখা দিল তা প্যারি কমিউন নামে পরিচিত। প্যারি কমিউন ছিল প্যারিসের বিপ্লবী ঐতিহ্যের স্বতঃস্ফুর্ত আত্মপ্রকাশ। অবশ্য প্যারি কমিউন ফ্রান্সের ইতিহাসে বহুবার বিদ্রোহ বহ্নি জ্বেলেছিল। তাঁরা সমাজতন্ত্রবাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ফ্রান্সকে শহর ও গ্রামের ভিত্তিতে বিভক্ত করে প্রত্যেক শহর ও গ্রামে কমিউন এর ওপর স্থানীয় শাসনভার অর্পণ করতে চেয়েছিলেন। এককথায় প্যারিস কমিউন শাসন ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে শোষণের অবসান করতে চেয়েছিলেন। সরকারি সৈন্য প্যারিস থেকে সরিয়ে নেবার পর, প্যারিস সম্পূর্ণভাবে বিদ্রোহী কমিউনের অধিকারে আসল। এরপর প্যারি কমিউন একটি সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করল। প্যারিসের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য ৯০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি সাধারণ সংসদ প্যারিসবাসী কর্তৃক নির্বাচিত হল (২৬ শে মার্চ)। বিপ্লবীরা প্রত্যেক শহরের পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসনের অধিকার ও স্বায়ত্তশাসিত কমিউনগুলির সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের নীতি ঘোষনা করল।
এদিকে ফরাসি সরকারের কর্ণধার থিয়ার্স ফ্রান্সের শাসনতান্ত্রিক ঐক্য বিনাশের পক্ষপাতী ছিলেন না। সরকারের সৈন্য বাহিনী দেশের ঐক্য রক্ষার উদ্দেশ্যে প্যারিস কমিউন ধ্বংস করতে উদ্যত হলেন, ফলে প্যারিসে রক্তক্ষয়ী বীভৎস গৃহযুদ্ধের সূচনা হল। সরকারি সৈন্যবাহিনী দুমাস ধরে অবরোধের পর অবশেষে প্যারিসে প্রবেশ করল। এরপর শুরু হল শতাব্দীর প্রচন্ডতম তথাকথিত “রক্তক্ষয়ী সপ্তাহ” (২১ শে-২৮ শে মে, ১৮৭১ খ্রিঃ) অনূন্য ২০ হাজার প্যারিসবাসী নিহত হল। দুই পক্ষেই বর্বরতা ও নৃশংসতার পরিচয় দিল। কিন্তু থিয়ার্স সরকার যে অমানুষিকতার পরিচয় দিলেন তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অবশেষে গ্যামবেটার অণুরোধে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটল । প্যারিস কমিউন ব্যর্থ এবং ফ্রান্সের রাজনৈতিক ঐক্য সুরক্ষিত হল।
প্যারিস কমিউনের ব্যর্থতার মূল কারণ ছিল ফরাসি সরকারের সামরিক শক্তি ও নিষ্ঠুর দমননীতি। এই দমন নীতির সম্মুখে কমিউনের পক্ষে অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব ছিল না। এছাড়া কমিউনের সদস্যদের মধ্যে একতার অভাব দেখা যায়। যদিও প্রথমে এটি প্রজাতন্ত্রের সমর্থন ও পরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমর্থন পেয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্যারিসের শ্রমিকশ্রেণিই কমিউনের প্রতি অবিচল আস্থা অক্ষুন্ন রেখেছিল।
0 Comments