- ১৯২৯ সালে অর্থনৈতিক মহামন্দার আন্তর্জাতিক প্রভাব কী ছিল ?
- অথবা
- ১৯২৯ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার উদ্ভবের প্রেক্ষাপট এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আলোচনা করুন?
১৯২৯ এর মহামন্দার ফলাফল সুদূর প্রসারী হয়েছিল। অর্থনৈতিক দিক থেকে ইউরোপ হয়েছিল বিপর্যস্ত, উদার পুঁজিবাদ অবাধ অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের প্রচলিত মূল্যবোধের অবক্ষয় ইউরোপকে ছুড়ে দিয়েছিল হতাশার অন্ধকারে। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার দিকে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল। কেননা সোভিয়েত রাশিয়া মহামন্দার গ্রাস থেকে আত্মরক্ষা করে উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখতে পেরেছিল।
প্রতিটি ইউরোপীয় দেশকেই মহামন্দার ভয়াবহ প্রভাব বহন করতে হয়েছিল। ৩ বছরে ৫ হাজার মার্কিন ব্যাঙ্ককে তাদের দরজা বন্ধ করে দিতে হয়। ১৯৩১ খ্রীঃ জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার ব্যাঙ্কগুলি দেউলিয়া হয়ে যেতে থাকে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের অধিকাংশ পুঁজি জার্মানি থেকে তুলে নেয়। জার্মাণির আর্থিক অবস্থাও অস্ট্রিয়ার মতো শোচনীয় হয়ে ওঠে। ইউরোপের প্রায় সব দেশেই শেয়ার বাজার বন্ধ হয়ে যায় ও কিছু দিনের মধ্যেই অধিকাংশ ইউরোপীয় সরকারও ডোমিনিয়ন মুদ্রার স্বর্ণমান ত্যাগ করে। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে জার্মানি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জার্মাণির সাধারন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পেশাদার শ্রেণী বা শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশা জাত ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সদ্ব্যাবহার করেছিলেন হিটলারের নেতৃত্বাধীন নাৎসী দল। জাতির আর্থিক সঙ্কট, অবসাদ, আতঙ্ক ও নৈরাজ্যের সময় নতুন অর্থব্যবস্থার লোভ দেখিয়ে পুঁজিপতিদের কমিউনিষ্ট ভীতিকে কাজে লাগিয়ে ১৯৩২ খ্রীঃ হিটলার কৌশলে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ব্রিটেন বা ফ্রান্সের এরুপ পরিণতি না ঘটলেও এই সমস্যা তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলেছিল ইউরোপের প্রায় সব দেশেই এসময় অর্থনৈতিক জীবনে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ তীব্রভাবে বেড়ে যায়। শিল্পপতি, ব্যাঙ্কার, কৃষক, শ্রমিক সবাইকে নির্ভর করতে হয় রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির ওপর। ইউরোপীয় দেশগুলি নিজস্ব আর্থিক ব্যবস্থা সম্পর্কে অত্যন্ত বেশি মাত্রায় সচেতন হয়ে উঠলে আন্তর্জাতিক স্তরে পারস্পরিক লেনদেনের সম্ভাবনা শুরু হয়। ফলে পারস্পরিক সহযোগিতার বদলে আন্তর্জাতিক স্তরে সমস্যা ও সংকট দেখা দেয়। ইউরোপীয় রাষ্ট্রবর্গ যুদ্ধকালীন ঋণকে ক্ষতিপূরনের সঙ্গে যুক্ত করার ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করে। ফ্রান্সের দাবি ছিল জার্মানি ক্ষতিপুরণের অর্থ প্রদান করলে তবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ ফ্রান্স পরিশোধ করবে। ১৯৩৩ এর জুন মাসে জার্মান ক্ষতিপুরণের অর্থ প্রদান বন্ধ করে দেয়। ১৯৩৪ এর জোনস অ্যাক্ট পাস করে আমেরিকা সেই সব দেশকে ঋনদান করতে অস্বীকার করে যারা আমেরিকার প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ করেনি। মহামন্দার অভিঘাত অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় ফ্রান্সে কিছুটা পরে পড়েছিল। ১৯২৯ নাগান আশ্চর্যজনকভাবে ফরাসি অর্থনীতির স্থিতাবস্থা বজায় ছিল। কিন্তু ১৯৩১ থেকে ফরাসি অর্থনীতিতে বিপর্যয় শুরু হয়। অপরদিকে ১৯৩০ এর দশকের মাঝামাঝি নাগাদ ব্রিটেন, জার্মানি ও আমেরিকার অর্থনীতি বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে স্থিতাবস্থা অর্জন করেছিল। কিন্তু ফরাসি অর্থনীতি এদের চুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছিল। Adamthwaite-এর মতে মহামন্দার সূচনার সময়কালের এই তফাতের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ফল পরিলক্ষিত হয়,
প্রথমত, এর ফলে ফ্রান্স ও জার্মাণির শিল্পায়নের মধ্যে ব্যবধান উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে। যার দরুন ফ্রান্সের হীনমন্যতা বোধও বৃদ্ধি পায় ৷
দ্বিতীয়ত, ফরাসি পুনরস্ত্রীকরণের সম্ভাবনাও বিলম্বিত হয়।
তৃতীয়ত, ফ্রান্সের আভ্যন্তীন রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব ও জটিলতা বৃদ্ধি পায় ।
মহামন্দার অব্যবহিত পরেই দেখা দিয়েছিল শ্রেণীসংঘাত। যদিও ১৯৩৩ নাগাদ মহামন্দার ঝড় অনেকটাই প্রশমিত হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিত্তশালী লোকেরা সামাজিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনায় ভীত ছিল। বেকার সমস্যা ও মজুরির ক্রমাবনতি দক্ষিণ ও বামপন্থীদের মধ্যে আদর্শগত দ্বন্দ্ব ও ব্যবধানকে আরও বাড়িয়ে তোলে। অর্থনৈতিক সংকট ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সামাজিক বিভাজনকে আরও তীব্র করে তুলেছিল। স্বভাবতই জাতীয় ঐক্য বিপন্ন হয়েছিল অথচ এই সময়েই জাতীয় ঐক্য বিশেষভাবে জরুরী ছিল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই জাতীয় পরিস্থিতি একনায়কতন্ত্রী শাসকদের সঙ্গে বোঝাপড়ার প্রয়োজনীয়তাকে আরও বেশি জরুরী করে তুলেছিল। অর্থনৈতিক এই সংকটের সুষ্ঠ মোকাবিলা করতে ইউরোপীয় রাষ্ট্রবর্গের সরকার ব্যর্থ হলে সংসদীয় গনতন্ত্র সম্পর্কে সংশয় দেখা দেয়। বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী উভয় ক্ষেত্রেই হতাশা ও বিক্ষোভের সূচনা হয়। জাপান থেকে আয়ারল্যান্ড সুইডেন থেকে নিউজিল্যান্ড এবং আর্জেন্টিনা থেকে ঈজিপ্ট এই বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে মহামন্দার অভিঘাত পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। তবে হবসবম মনে করেন যে কেবলমাত্র স্বল্প মেয়াদী রাজনৈতিক ফলাফলের ভিত্তিতে মহামন্দার প্রভাবকে বিচার করা সঠিক হবে না। তিনি মহামন্দার মনস্তাত্ত্বিক দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন। তাঁর মতে মহামন্দার দরুন এরুপ একটি ধারণা গড়ে উঠেছিল যে অর্থনৈতিক দিক থেকে ১৯৩০ এর পূর্ববর্তী পর্যায়কে ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হবে না। মহামন্দার দরুন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয় তার প্রভাব আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও পড়েছিল। ইউরোপীয় শক্তিবর্গ যে সময় মহামন্দার ধাক্কা সামলাবার জন্য ব্যস্ত সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জাপান মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করলে লিগ ব্যবস্থার দুর্বলতা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।
0 Comments